নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি – আট
জগদীশ কিছুতেই অরণিকে ঘুম থেকে তুলতে পারলেন না।
হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন, হাত ছেড়ে দিলেই শুয়ে পড়ছে। ঘুম জড়ানো চোখে। তার এক কথা।
আমি খেয়েছি, এই তো খেয়ে শুলাম। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
অগত্যা জগদীশ আর কী করেন!
রান্নাবাড়িতে ঢুকে গেলেন। রাত কম হয়নি। অরণির জন্য সবাই বসে আছে। মহাজন গোপীবল্লভ তার বামুন ঠাকুর দিয়ে জমিদারবাবুর বাড়িতে পেল্লাই ভোজের ব্যবস্থা করেছেন। পাত পেতে কেউ কেউ খেয়ে গেছে। অরণি না খেলে বউঠান কিংবা বাবুরা খেতে পারছেন না, অগত্যা কী করা যায়, জগদীশ বউঠানকে বললেন, অরু খাবে না। ওর খিদে নেই বলছে।
নবকুমারবাবু বারান্দায় বের হয়ে আসছেন। বাড়ির আরও সবাই, লম্বা বারান্দায় কিংবা বিশাল রান্নাঘরে আসন পাতা। জলের গেলাস থালা দিয়ে ঢাকা। সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়ার রেয়াজ এই রান্নাবাড়িতে।
তুলিকেও তুলে আনা হয়েছে। সেও খাবে। কিছুটা বনভোজনের মতো ব্যবস্থা করেছিলেন গোপীবল্লভ পাল। তার লোকজন জঙ্গল সাফ করে নদীর পাড়ে রান্নার বন্দোবস্ত করেছিল। তার বামুন ঠাকুর অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠা বজায় রেখে রান্না করেছে। বাবুরা নদীর পাড়ে যাবেন না, বাড়িতে সব পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা সুচারুভাবেই করা হয়েছে। কিন্তু অরণির জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল, সে এসে গেলেই খেতে বসা হবে, সেই অরুকেই কাছারিবাড়ি থেকে নিয়ে আসা গেল না।
বৃন্দাবন বলল, আমি একবার যাই।
জগদীশ বললেন, গিয়ে লাভ হবে না। ওতো বলছে, সে খেয়েছে।
তুলি বলল, কখন খেয়েছ?
তাতো জানি না।
বউঠান বললেন, ঘুমের ঘোরে বলছে, তুমি আর একবার যাও!
না বউঠান। ও ঘুমিয়ে পড়লে, তুলে খাওয়ানো খুবই ঝামেলা। একটা তো রাত। না খেলেও কিছু হবে না।
বউঠান সহজে ছাড়বার পাত্র নন।
ও কী খেল! রান্নাবাড়িতে ওকে কে খেতে দিল!
বড়দা বলল, আসলে, বাহানা। আমি গিয়ে দেখছি।
বড়দা মেজদা সবাই আসনে বসে গেছেন। তুলি, নবকুমারবাবু, বাড়ির কেউ বাদ নেই। জগদীশও বসে গেছেন—অরণি সারাদিন কোথায় ঘুরেছে মেলায় তিনি কিছুই জানেন না, মেলায় জলছত্র থেকে ভলান্টিয়ারদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তাঁর—সারাদিনে একবার অরণির সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি, অবশ্য তাঁর টাকার থলে থেকে অরণি কিছু টাকা চেয়ে নিয়েছে, তিথিকে নিয়ে মেলায় যাবে, এমনও ভাবতে পারে অরণি, কাজেই মেলায় তারা যদিও মিঠাই মণ্ডা পেট ভরে খেয়ে থাকে, এমন সাত— পাঁচ ভাবনাই অরণিকে জোরজার করে তুলে খাওয়াবার বিষয়ে জগদীশকে কিছুটা নিস্পৃহ করে রাখতে পারে। তিনি মেজদার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে যেতে হবে না। খেয়ে নাও। কতক্ষণ তোমরা আর বসে থাকবে!
জগদীশ রান্নাবাড়ি থেকে ফেরার সময় টের পেলেন, আকাশ ভেঙে বজ্রপাত নেমে আসছে। সারা আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকায় ভেসে গেল চরাচর। ঝড় উঠবে। বৃষ্টিও নামতে পারে জোরে। সারাদিন যা গরম গেছে, ভ্যাপসা গরমে শরীরের সব রক্ত যেন ঘাম হয়ে বের হয়ে আসছিল—তিনি খুবই ক্লান্ত, নদী থেকে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ায় তার শরীর জুড়িয়ে গেল।
তিনি টের পেলেন আকাশ বড় গুরুগম্ভীর।
তিনি কিছুটা পা চালিয়ে হাঁটছেন আবার কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। আকাশ যেন খুবই নিচে নেমে এসেছে। এলোমেলো হাওয়ায় গাছের ডালপালা দুলছে। শীতল হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে আরাম বোধ করছিলেন।
নদীর দিকে তাকালেন তিনি। সুপারিবাগান পার হয়ে নদী দেখাও কঠিন। মিশকালো অন্ধকারে সব ঢেকে গেছে। মনে হল হঠাৎ হাওয়া পড়ে গেল। চরাচর কেমন থম মেরে গেছে। নদীর পাড়ে তার কাছারিবাড়ি বলে ঝোড়ো হাওয়া উঠলে বেশ জোরেই এসে কাছারিবাড়িতে আছড়ে পড়ে। ঘরের দরজা জানালা সব ঠাস ঠাস করে বন্ধ হয়, খুলেও যায়। দরজা খোলা রেখে অবশ্য আসেননি। শেকল তুলে দিয়ে এসেছেন—কিন্তু জানালাগুলি সব খোলা। জোর বৃষ্টি হলে বিছানা সব ভিজে যায়।
তিথিও নেই যে সব নজর রাখবে। গোপীবল্লভ নদীতে রাত কাটিয়ে সকালে পাল তুলে দেবেন বজরার। মানুষজন তাঁর মেলা। বজরার সঙ্গে নৌকার বহর। কোনওটায় বামুনঠাকুর, কোনওটায় গদির সরকারমশাই—সবাই সপরিবারে হাজির কর্তার সঙ্গে। এমন পুণ্যস্নানের সুযোগ কেউ ছাড়তে রাজি হয়নি। ঝি—চাকরদের আলাদা নৌকা। বজরায় শুধু তার দুই স্ত্রী, তিথি উঠে যাওয়ায় অবশ্য তিনজন। তার দুই স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তিথিকে। শুভদিনে বিবাহ। দেশে রেখে যেতে কেউ রাজি হয়নি। মহাজনের ইচ্ছের উপর কারও কথা নেই। নবকুমারবাবু অবশ্য বলেছিলেন, কিছুদিন এখানে থেকে গেলেও অসুবিধা হবে না। আপনার যখন পছন্দ হয়েছে। দিনক্ষণও ঠিক—গোরাচাঁদের ভাঙা ঘরে না রাখেন, আমাদের বাড়িতেও তিথি থাকতে পারবে।
গোপীবল্লভ রাজি হননি।
অত্যন্ত সদাশয় মানুষটি কেবল বলেছিলেন, থাকতে পারে, তবে এটোকাঁটা খেয়ে না আবার আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করে। যা স্বভাব!
তখন সবাই একবাক্যে বিষয়টি নিয়ে মনস্থির করে ফেলে। গোঁরাচাদও রাজি। তার তো বাড়িতে পাকা দালানকোঠা হবার কথা। বাজারে মুদিখানাও খুলে দিতে পারেন। মহাজন মানুষটি কম কথা বলেন। তার পাকা গোঁফ এবং নাদুসনুদুস শরীরটি তেল মাখনে যে ডুবে আছে দেখলেই বোঝা যায়। তিথি তার সেবাযত্ন করতে পারবে, আসলে এখানে রেখে যেতে মন তাঁর সায় দেয়নি। বাবুরাও ও মহাজন ব্যক্তিটিকে খুশি রাখতে পারলে অসময়ে ধার কর্জ পেতে অসুবিধা হয় না। জমিদারির খাজনা সরকারের ঘরে জমা দেবার সময় বাবুদের মহাজনের গদিতে ছুটতেই হয়। শুধু যে গোপীবল্লভের পাটের ব্যবসা, তেজারতির কারবার নিয়ে এমন রমরমা অবস্থা তাও নয়। ইস্টিমার কোম্পানির তিনি একজন বড় অংশীদার। তিথির সৌভাগ্য এমন হবে জগদীশ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। তিনি অন্ধকারে দাঁড়িয়েই মেয়েটার ভালো হোক বলে কপালে হাত ঠেকালেন।
তিথি না থাকায় কাছারিবাড়িটাই শুধু খালি হয়ে গেল না, জমিদারবাবুর প্রাসাদ, সুপারির বাগান, নদীর চর, দিঘির পাড়ের ঝোপজঙ্গল সবই খালি হয়ে গেল। নদীর জলে আর যখন তখন কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে না। কিংবা কোঁচড়ে খই—বাতাসা নিয়েও ইস্টিমার ঘাটে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না। তিথির কথা ভাবতে গিয়ে জগদীশ কেমন কাতর হয়ে পড়লেন।
তখনই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
জগদীশ দৌড়ে ঘরের সিঁড়িতে উঠেই টের পেলেন, তীরবেগে ঝড় ছুটে আসছে। হাওয়ায় যেন তাকে উড়িয়ে নেবে।
তিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা—জানালা বন্ধ করে দিতে থাকলেন। অরণি ঘুমুচ্ছে। মশারি না টাঙিয়েই শুয়ে পড়েছে। মশার কামড়ে ছেলেটা জেরবার, কোনোই হুঁশ নেই। চালে আমের বড় ডালের ঘসটানিতে ঘরটা কাঁপছে। তিনি হারিকেনের আলো উসকে দিলেন। বৃষ্টির ছাট এত তীব্র যে টিনের চালে বড় রকমের দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। তারপরই মনে হল ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ। আমগাছের অতিকায় ডালটি কেটে ফেলা উচিত ছিল, ঝড়বৃষ্টির সময়ই এ—কথাটা তিনি ভাবেন, কিন্তু কাটা আর হয় না। সেই ডালটি ভেঙে পড়ল কি না কে জানে! সামনের দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পারেন, কিন্তু দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছেন না—বাড়িতেই এই অবস্থা, নদীতে না জানি কী হচ্ছে—ভাদ্র—আশ্বিনের এই সময়টায় নদী মাঝে মাঝে ক্ষেপে ওঠে—অসময়ে ভরা কোটালেরও আবির্ভাব হয়। দুর্যোগ শুরু হয়ে যায়। নদীর দু—পাড় জলে প্লাবিত হয়। নদীতে কেউ নৌকা রাখতে সাহস পায় না। ইস্টিমার মাঝনদীতে থাকলে কিনারে ভিড়িয়ে দেওয়া হয়। গেরাফি ফেলে, মোটা কাছিতে বেড় দিয়ে দেওয়া হয়।
মহাজনের বজরায় কী অবস্থা, কে জানে! তবে বজরার মাঝিরা হাওয়ায় গন্ধ শুঁকে টের পায় সব। তারা যথেষ্ট সাবধানী। মহাজনের বজরা আসিনুল মাঝির হেপাজতে থাকে। সে বড় দড়িয়ার মাঝি ছিল একসময়, তার ঝড়বৃষ্টির অভিজ্ঞতা যথেষ্ট—ঘূর্ণিঝড়েও তার নাও কাত করতে পারে না। সে ঠিকই টের পেয়ে গেছে, নদীর কুহেলিকার কথা। বড় শরিকের অতিথিনিবাসের কাছে বজরা নিয়ে তুলতে পারে। ঝড়ের দাপটে কোনও অঘটন ঘটে গেলে যাতে নৌকাডুবির আশঙ্কা না থাকে, তার ব্যবস্থাও তার জানা।
জগদীশ বারান্দায় নেমে যাবার জন্য দরজা খুলতে কিছুতেই সাহস পাচ্ছেন না। ঝড়ে ডাল ভেঙে পড়ল, না বিশাল আমগাছটির গোড়া উপড়ে গেল! কী যে করেন তিনি। তখনই চারপাশে আর্ত চিৎকার, কোথাও শাঁখ বাজছে, কাঁসি—ঘণ্টার শব্দও কানে আসছে—বাবুদের প্রাসাদেও তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। চারপাশে শুধু শঙ্খধ্বনি। উলুধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। আসলে দুর্যোগ যে অতিমাত্রায় আতঙ্কে ফেলে দিচ্ছে মানুষজনকে বোঝাই যায়। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এই দুর্যোগের রাতে ঝড়ের ছোলায় কাছারিবাড়ির টিনের চাল উড়ে গেলে অরুণিকে নিয়ে বিপদে পড়ে যাবেন। হুড়মুড় করে মাথার উপরের মুলিবাঁশের পাটাতনও ভেঙে পড়তে পারে। হরমোহন থাকলে তাঁর এত আতঙ্ক হত না। অরুণির কথা ভেবেই তিনি কাতর হয়ে পড়ছেন। ডেকে তুললে হয়—এ যে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা, কোনও হুঁশ নেই।
এই অরণি, অরণি!
সাড়া নেই। দরজা খুললে বৃষ্টির ছাটে সব ভিজে যাবে। হাওয়ায় হারিকেনও নিভে যেতে পারে। তিনি তাড়াতাড়ি মাথার উপরের পাটাতন থেকে টর্চটা নামিয়ে হাতের কাছে রেখে দিলেন। একবার মাঠ পার হয়ে প্রাসাদের দিকে যেতে পারলে ভালো হত। নিরাপদ জায়গা। কিন্তু অরণিকে যে ঘুম থেকে তোলাই যাচ্ছে না।
এই, কিরে তুই! কী ঝড় শুরু হয়েছে। ওঠ। শিগগির ওঠ।
তিনি অরণির হাত টেনে বসিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু এ কি, সে তো বসে থাকছে না। হয়েছেটা কী! কেমন নেশাখোর মানুষের মতো সে বেহুঁশ।
অরু! তোর কী হয়েছে!
অরণি সাড়া দিচ্ছে না।
সারাদিন কোথায় ছিলি! মেলায় কী খেয়েছিস?
জগদীশ ভয় পেয়ে গেছেন। তাকে ডাকছেন, তাকে ঠেলে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছেন, অথচ অরণি চোখ খুলে তাকাচ্ছে না। বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে, অরণি স্বাভাবিক থাকলে, কখনোই এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে পারত না। তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গেছে শোনার পর থেকে সে যেন আরও বেহুঁশ।
এখন জগদীশ যে কী করে! ঝড়ে, নদীর প্লাবনে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।
একটা গাছ ভেঙে পড়ল, অরণি কিছুই টের পাচ্ছে না। লম্বা হয়ে পড়ে আছে।
অরণি বাবুদের প্রাসাদে যাবি? এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না। অরণি তুই ওঠ, ঘরের নিচে আমরা চাপা পড়ে থাকব। অরণি, তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গেছে, এই দুর্যোগে, বজরার অবস্থা কীরকম বুঝতে পারছি না। আসিনুল যদি বাতাসের গন্ধ শুঁকে ঝড়ের আভাস টের না পায়, বজরা ডুবে যেতে কতক্ষণ!
অরণি এবার তাকাল।
তাকাল ঠিক। তবে ওর চাওনি স্বাভাবিক নয়। কোনও অতি দ্রুত ধাবমান জলরাশি পার হয়ে সে যেন নদীর পাড়ে উঠে এসেছে। চোখে কিছুটা দুঃস্বপ্ন, কিছুটা দুশ্চিন্তা এবং ক্ষোভ জ্বালাও হতে পারে—তিথির জন্য অরণির কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক, নানা ধন্দ দেখা দিতেই জগদীশ বললেন, এখন ঘুমাতে নেই, অবস্থা বিশেষ ভালো ঠেকছে না। দেখি ভেতর বাড়িতে যাওয়ার কোনও অবস্থা করা যায় কি না।
ছাতায় যে কাজ হবে না তিনি জানেন।
বৃষ্টি মাথায় ছুটে যেতে পারেন, তবে, যা ঝড়, গাছটাছ মাথার উপর উপড়ে পড়া বিচিত্র নয়। এবং অরণি যাবে কি না, সে তো উঠেও বসল না। তার যেন জীবন নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই। সে যেন সব সুখ দুঃখ এবং অনুভূতির বাইরে।
অরণি তোর কী হয়েছে?
অরণি এবার উঠে বসল ঠিক, তবে মাথা দু হাঁটুর ফাঁকে গোঁজ করে রাখল।
আর একটা ছোলা এত জোড়ে এসে ঘরে ধাক্কা মারল যে, মনে হয় সব এবার সত্যি উড়িয়ে নেবে। কবে থেকে তাঁর এই নদীর পাড়ে বাস, কখনও এমন ভয়ঙ্কর ঝড়ের সোঁ সোঁ আওয়াজ টের পাননি। কোথাও যেন বড় রকমের ধ্বংসকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল অরণি!
শুনতে পাচ্ছেন, আপনি শুনতে পাচ্ছেন বাবা!
তিনি অনেক কিছুই শুনতে পাচ্ছেন, মহাপ্রলয়ের মতো অবস্থা, মনে হয় নদীর জল ফুলেফেঁপে পাড় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের ঘাসের জমি জলে ডুবে গেছে দেখতে পেলেন। বাতাসের শব্দে নানাপ্রকার কুহক তৈরি হচ্ছে। নদীর জলে বাতাসের প্রচণ্ড চাপ, জল উথাল—পাতাল হচ্ছে নদীতে, তার শব্দও কান পাতলে শোনা যাচ্ছে—কিছু ঝড়ের পাখি বাঁশঝাড়ের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে, বাঁশের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে যাওয়ায় কোথাও দূরে কোঁ কোঁ আওয়াজ উঠছে। আর তার ভেতর সেই সব অসহায় পাখিরা আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু অরণি কী বলতে চাইছে! তিনি তার কিছুই বুঝতে পারছেন না।
কোনও শব্দ কিংবা নদীর পাড়ে কোনও তরঙ্গমালার আঘাত যদি ভাসমান কিম্ভূতকিমাকার হাহাকার হয়ে ভেসে আসে, সেই সব শব্দমালার কথা কি অরণি বলতে চাইছে! সে কি কোনও হাহাকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
অরণিকে না বলে পারলেন না, তুই কী শুনতে পাচ্ছিস?
তিথি আমাকে ডাকছে?
তিথি ডাকছে! তোকে কেন ডাকবে?
ডাকছে। শুনতে পাচ্ছেন না, অরুদা, তুমি যাবে না!
তুই কোথায় যাবি তিথির সঙ্গে।
সে তো আমাকে নিয়ে যেতে চায়।
স্বভাব লাজুক অরণির এমন কথায় তিনি ঘাবড়ে গেলেন। সামনে টেস্ট পরীক্ষা, অরণি সতেরো বছরে পড়েছে। মেয়েদের সম্পর্কে সে খুবই লাজুক, কখনোই সে তুলির সঙ্গে কথা বলতে পারে না। জমিদারবাবুর মেয়েটা একটু চঞ্চল স্বভাবের, কিন্তু অরণি কখনোই তার সামনে পড়তে চায় না, তুলি এক দরজা দিয়ে ঢুকলে সে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়, সেই অরণিকে তুলির বয়সি তিথি এই ঘোর দুর্যোগে কোথায় নিয়ে যাবে!
তিনি কিছুটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ছেলেটার মাথা বিগড়ে যায়নি তো! ধমকও দিতে পারেন না, ছেলেটা এমনিতেই তার ভারী কোমল স্বভাবের, তাকে বড় হতে হবে, পড়াশোনা করে মানুষ হতে হবে, তার মায়ের এমন ইচ্ছের কথা ভালোই জানে, সে কেন দুর্যোগের রাতে তিথির কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে!
কী আজেবাজে বকছিস? তিথি কেন মরতে আসবে, সে তো বজরায় আছে, বজরা না থাকলেও, বড় শরিকের অতিথিনিবাসে গিয়ে উঠেছে। নদী যদি সত্যি খেপে যায় তবে আসিনুল আগেই তা টের পাবে। সে বজরা পাড়ে ভিড়িয়ে দিয়েছে ঠিক, সে খুব হুঁশিয়ার মাঝি, বহু ঝড়ঝঞ্ঝার সে সাক্ষী। জলে জলে তার জীবন কেটেছে, সেটা বুঝতে শেখো।
তবু যে ডাকছে তিথি! ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে সে ছুটে আসছে!
অরণি, তুই স্বপ্ন দেখছিস। তাই স্বপ্নে বকছিস। তোর স্বপ্ন দেখা কী শেষ হয়নি! শুয়ে শুয়ে বিড় বিড় করে সেই কখন থেকে—
স্বপ্ন কেন হবে বাবা! আমি তো দেখতে পাচ্ছি, ওর বগলে একটা পুঁটুলি, সে পাগলের মতো নদীর পাড় ধরে ছুটে আসছে। বজরাখানা নদীর পাড়ে ডিমের খোলার মতো তুফানে এসে আছড়ে পড়েছে। খান খান হয়ে গেছে বজরা। আশরাফ চাচার স্টিমার ডুবে যাচ্ছে।
মহাজন খুবই সদাশয় মানুষ—তিথিকে ফেলে তিনি কিছুতেই অতিথিনিবাসে গিয়ে উঠতে পারেন না। বজরা ডিমের খোলার মতো তছনছ হয়ে পড়ে আছে পাড়ে, জানলি কী করে!
আর তখনই কড়াৎ করে বজ্রপাতের শব্দ। চরচর কেঁপে উঠল, কোনও বৃক্ষের উপর পড়তে পারে—বজ্রপাতের সাদা গন্ধও নাকে এসে লাগল জগদীশের।
তিনি তাড়াতাড়ি দোহাই জয়মুনি বলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন। জয়মুনির দোহাই দিলে বজ্রের ধার কমে আসে—মুনিঋষিদের বাক্য কখনও বিফল হয় না। জয়মুনি সহজেই বজ্রের ব্যাপকতা নষ্ট করে দিতে পারেন। নিজের এবং পুত্রের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তিনি জয়মুনির দোহাই না দিয়ে পারেননি।
কিন্তু অরণির কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে হাঁটুর মধ্যে মাথা গোঁজ করে বসেই আছে চারপাশের ব্যাপ্ত তাণ্ডবলীলা তাকে বিন্দুমাত্র সচকিত করছে না।
সহসাই ফের অরণি বলল, আমি যাব বাবা।
কোথায় যাবি!
তিথি নদীর পাড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আর পারা যায়! কেন সে অপেক্ষা করবে। সে মহাজনের এখন আশ্রিত জন, তার জন্য ভাবতে হবে না। মহাজনের লোকজনের অভাব নেই—তাদের কাছ থেকে তিথি কখনোই ছাড়া পেতে পারে না। সব মনের ভুল। হাতমুখ ধুয়ে, মাথায় মুখে ভালো করে জল দে। বায়ুচরা হয়ে গেলে লোকে ভুলভাল কথা শুনতে পায়। ভুলভাল বকে। ওঠো। মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছি। ওঠো, বালতিতে জল আছে, হাতমুখ ধুয়ে নাও।
অরণির এক কথা, আমি যাব বাবা। নদীর জল তালগাছ সমান উঁচু হয়ে ভেসে যাচ্ছে। হাজার হাজার শুশুক মাছ সাঁতার কাটছে। ওরা তিথিকে নিতে এসেছে, আমি জানি।
তুই সব জানিস। যতসব আজগুবি চিন্তা!
আজগুবি নয়। সত্যি কথা। তিথি আর জন্মে শুশুক মাছ ছিল। সে আমাকে বলেছে।
আর কী বলেছে? জগদীশ বিরক্ত হয়ে গালে চড়ই কষাতে যাচ্ছিলেন।
ও যে বলেছে, তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখোনা অরুদা?
স্বপ্ন দেখলে কী হয়?
বারে ওর তো বিশ্বাস, স্বপ্ন দেখলে ভালোবাসা হয়। ভালোবাসলে স্বপ্ন দেখতে হয়। আমি ওকে মিছে কথা বলেছি বাবা। ওকে আমি স্বপ্নে আগে কখনও দেখিনি। তবু বলেছি, স্বপ্নে দেখেছি। ও যদি খুশি হয় তাই বলেছি।
ওতে কিছু হয় না। উঠে আয়। তুই নিজের মধ্যে নেই।
ও যে বলেছে, তুমি অরুদা তুলিকে কখনও স্বপ্ন দ্যাখো না তো?
আসলে জগদীশ জানেন গোরার মেয়েটা বড় হতে হতে কিছুটা ইঁচড়ে পক্ব হয়ে গেছে। মেয়েটা এমন সব কথা বলেই অরণির মাথা বিগড়ে দিয়েছে।
তা না হলে তার স্বভাবলাজুক ছেলের এই পরিণতি হয় না। বেজায় নির্লজ্জ না হয়ে গেলে বাবাকে কেউ ভালোবাসার কথাও বলতে পারে না। এমনও হতে পারে অরণি তার অস্তিত্বের কথাই ভুলে গেছে। সে যে তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে, তেমনও হুঁশ না থাকতে পারে। জগদীশ খুবই বিচলিত হয়ে পড়ছেন। কাউকে যে ডাকবেন, ডেকে কথা বলবেন, অরণি ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আপনারা আসুন, কিছু তার উপর নিশ্চয়ই ভর করেছে। নদীর জলে মেয়েটা ভেসে গেল না তো! মরে গেল না তো! ভূত হয়ে অরণির মাথায় ঢুকে গেল না তো! ভূত প্রেতে জগদীশের প্রবল বিশ্বাসও আছে—তিনি ভাবলেন সকাল হলে অনাদি ওঝাকে ডেকে দেখাবেন, এখন রাতটা কাটলে হয়।
তখনই অরণি দাঁড়িয়ে গেল। চোখমুখ কেমন তার থমথম করছে।
অরণি চিৎকার করে উঠল, ডুবে গেল—স্টিমারটা ডুবে গেল। আশরাফ চাচা ডেকে ছোটাছুটি করছে। লাইফ জ্যাকেট, বয়া সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। সবাই নেমে না গেলে তিনি নামতে পারছেন না।
অরণি, বাবা তুই কী হয়ে যাচ্ছিস? কোথায় স্টিমার?
ঐ দ্যাখো বাবা, ডেক ছাদে তিথি চাচার ভাঙা সানকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি সব। তিথিকে স্বপ্নটার কথা না বললে পাপ হবে। আজ সত্যি তিথিকে স্বপ্নে দেখেছি।
এবারে তিনি তিরস্কার না করে পারলেন না—বের করছি তোমার পাগলামি। টানতে টানতে বালতির কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, মাথাটা ধুয়ে দিলে আরাম পেতে পারে। ওর ঘুমানো দরকার। আসলে কোনও ঘোর থেকেও এসব দেখতে পারে। মাথাটা ধুয়ে দিলে শরীর ঠান্ডা হবে। কিন্তু অরণি কিছুতেই যেতে চাইছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরণি যে তার পুত্র এখন কিছুতেই মনে হচ্ছে না জগদীশের। যেন এক নতুন জগৎ আবিষ্কারে অরণি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে।
তারপরই অরণি কাণ্ডখানা ঘটিয়ে ফেলল। হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেল দরজার দিকে, আমি আসছি তিথি, তুই দাঁড়া বলে দরজা খুলে দুর্যোগের মধ্যে ছুটতে থাকল।
জগদীশ হতভম্ব। মাথায় কিছু দিচ্ছে না তাঁর। তিনি কিছুটা উদভ্রান্ত। তারপর কী ভেবে যে টর্চটা হাতে নিয়ে বের হয়ে ডাকতে থাকলেন—তুই যাস না অরণি। তিনি প্রাসাদের দিকে ছুটে যেতে পারতেন, প্রবল বর্ষণে তার শরীর ভিজে যাচ্ছে, ঝোড়ো হাওয়ায় এগোতে পারছেন না। সবকিছু ঝাপসা। টর্চ জ্বেলে দেখলেন, অরণি সুপারিবাগানের মধ্যে ঢুকে গেছে। তিনিও সুপারিবাগানের মধ্যে যাবার জন্য ছুটছেন, বৃষ্টি কিংবা বন্যার জলে থইথই করছে মাঠ, তারও যেন হুঁশ নেই। টর্চ জ্বেলে কাউকেই দেখতে পেলেন না, একা অরণি নদীর পাড়ের দিকে ছুটছে। এক অতিকায় অজগরের মতো নদী ফুঁসছে, গাছপালা তছনছ করে ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব, একবার কী ভেবে চিৎকার করেও ডাকলেন, কে কোথায় আছেন আপনারা, শিগগির আসুন, অরণি উন্মাদ হয়ে গেছে।
তারপর তিনি যা দেখলেন! হতবাক। পাড়ে বগলে পুঁটুলি নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঝাপসামতো অস্বচ্ছ টর্চের আলোয় কিছুই স্পষ্ট নয়। কে দাঁড়িয়ে আছে তাও বোঝা যায় না, তবু কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে যেন এক জলাভূমি হয়ে গেছে নদীর পাড়, গাছ সব উপড়ে পড়েছে, সুপারিগাছগুলিও আস্ত নেই—তিনি ছুটতে ছুটতে কেবল অসহায় আর্তনাদে ভেঙে পড়ছেন, অরণি, বাবা যাস না। সামনে দ্যাখ কত বড় ঢেউ এগিয়ে আসছে। সাবধান।
আর সাবধান!
কড়াৎ করে আবার বাজ পড়ল।
সারা আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি—মেঘ ডাকছে গুরু গুরু। অজস্র বর্ষণে নদী ভরা কোটালের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আর দেখলেন, কারণ টর্চটাও তার হাতে নেই। কোথায় ছিটকে পড়েছে—এক কঠিন লণ্ডভণ্ড অবস্থা তার। চোখ স্থির। তিনি তারপর চোখ বুজে ফেললেন আতঙ্কে। অরণি আবছামতো এক নারীর হাত ধরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। নদীর ঢেউ তাকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল।
আর সকালেই খবর, তিথিও হারিয়ে গেছে। ঝড় ওঠার পর সবাই দেখেছে, তিথি বজরা থেকে লাফিয়ে ছুটে গেছে নদীর পাড়ে পাড়ে। কেউ আটকাতে পারেনি—বাঁচাও বাঁচাও, এই ছিল তার মুখে একমাত্র কথা। একবার শুধু বলেছে, আমাকে বাঁচাও অরুদা। অরুদা তুমি কোথায়।
তারপর যা খবর, নদীর বুকে কোনও চড়ায় আশরাফের স্টিমার ডুবি হয়েছে। ঝড়ে ক্ষতির শেষ নেই। মানুষজনও ডুবে মরেছে নদীতে। তবে মরার লাশ পাওয়া গেলেও অরণি কিংবা তিথির লাশ আবিষ্কার করা যায়নি,—এবং এভাবেই তিথি এবং অরণির এই কাহিনী বছর পার না হতেই কিংবদন্তির রূপ পায়।
কেউ বলে, তিথি শুশুক মাছ হয়ে গেছে। অরণিকে সঙ্গে নিয়ে নদীর জলে হারিয়ে গেছে। কেউ পূর্ণিমা রাতে ভরা কোটালে গভীর রাতে দু’জনকেই ঢেউ—এর মাথায় সাঁতার কাটতেও দেখেছে।
কেউ বলে, মোহনার কাছে চড়া জেগে উঠেছে, খুঁজলে তাদের সেখানে পাওয়া যেতে পারে।
আবার কারও সোজা কথা, ওসব বাজে কথা। আসলে অরণি উন্মাদ হয়ে গেছিল। তিথিকে ভালোবেসে সে উন্মাদ হয়ে গেছে। এটা বয়সেরই দোষ। তিথি সেই সুযোগে ওকে নিয়ে নদী পার হয়ে কোথাও চলে গেছে। মেয়েটা জলের পোকা, তাকে আটকায় কে!