Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি || Atin Bandyopadhyay » Page 7

নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি || Atin Bandyopadhyay

শেষে অবশ্য তিথিকে খুঁজে পাওয়া গেল ইলিশ মাছের নৌকায়। জেলেরা টের পেয়েই জলে লাফিয়ে পড়েছিল।

তারপর সেই দুর্যোগের মধ্যে তিথিকে নিয়ে বাড়ি আসতে পেরেছিল ঠিক, তবে সেদিনই জ্বরে পড়ে গেল অরণি। জ্বর বাড়ল। বাবা বাড়ি নেই—তিনদিনের মাথায় বুকে কফ জমে গেল—কবিরাজ অমূল্যধন, এলাকার ধন্বন্তরি, তিনি বলে গেলেন, সান্নিপাতিক জ্বর—ভোগাবে।

অরণি প্রায় মাসখানেক বিছানায় পড়ে থাকল। এত দুর্বল হয়ে গেল যে প্রায় উঠতে পারে না। বিছানায় লেগে আছে। বাবা ফিরে এসে খুব প্রমাদ গুণলেন। তিথি বলতে গেলে সারাদিন তার ঘরেই পড়ে থাকে। সেবা—শুশ্রূষারও শেষ ছিল না। বাবাই তিথিকে অনুপান—সহ কখন বড়ি মেড়ে খাওয়াতে হবে বলে দিয়েছেন। যেমন বাসকপাতা, তুলসিপাতা, মধু এবং পুনর্ণবার পাতা তিথিও ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করত। একেবারে একজন শিশুকে যেভাবে পরিচর‍্যা করা দরকার, তিথি তাকে সেভাবেই অতি যত্নে বিছানা থেকে তুলেছে, কপালে জলপট্টি দিয়েছে, এবং তিথি যে কত দায়িত্বশীল তার এই পরিচর্যার বহর না দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না। তার আরোগ্য কামনায়, সে সেই জঙ্গলের মন্দিরগুলিতে মাথা ঠুকে এসেছে, মানত করেছে, অরুদা ভালো হয়ে উঠলে তাকে নিয়ে যাবে। বাতাসা মিসরিভোগ দেবে।

বিকেলের দিকে বাবুরা আসতেন। বাবা ক’দিন ঘর থেকে বেরই হলেন না। জেঠিমা, তুলিও তাকে দেখে যায়। ছোট পিসি ঘরে ঢোকেন না। বাইরে থেকেই, মুখ বাড়িয়ে বলবেন, মুখে তোর রুচি কীরকমের?

তার খাওয়ায় রুচি ফিরে এলে বলেছিলেন, আর ভয় নেই। এবার ভালো হয়ে উঠবি। আর ভয় নেই। তিথির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, মেয়েটা তোর জন্য যা করেছে!

তিথি এসব কথায় খুবই লজ্জায় পড়ে যেত। টিপয়ের গেলাসে জল রেখে দিত ঢাকনা দিয়ে। বেদানার খোলা ছাড়িয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিত। প্রথম পথ্যের দিনে হেলানচার ডগা সেই তুলে এনেছে। জঙ্গল থেকে গন্ধপাঁদাল। মৌরলা মাছ দিয়ে গন্ধপাঁদালের ঝোল পথ্য। তিথিই তাকে ধীরে ধীরে বাইরে নিয়ে এল একদিন। কাছারিবাড়ির বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার পেতে বলেছিল, আমার জন্য এই ভোগান্তি। কিছু হলে আমার যে কী হত! আমি আর কাউকে মুখ দেখাতে পারতাম না। বলেই ফুঁপিয়ে তার কি কান্না।

কাঁদছিস কেন? আমি তো ভালো হয়ে গেছি। অরণি বলত।

তিথি তখন তার কথায় জবাব না দিয়ে পালাত। সে দেখতে পেত তিথি সুপারিবাগানে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যেন এক দিশেহারা কিশোরী—সে শুধু দেখত। জোরে আর ডাকতে পারত না।

তিথি বড় সুন্দর দেখতে।

অরণি সুপারিবাগানের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবছিল। চুল কোঁকড়ানো। চোখ টানা টানা—গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। নাকে নথ ঝুলিয়ে দিলে দুগ্গা ঠাকুর।

সে জানে ভেতর বাড়িতে তিথি ফুটফরমাস খাটতে ভালোবাসে—তিথি গামছাটা নিয়ে আয়, তিথি দ্যাখ বৃন্দাবনদা এল। ভাঁড়ার থেকে চাল, ডাল বের করে দে। ভেতর বাড়িতে দাদাদের সঙ্গে গেলে এমন কত কথা শুনতে পেত অরণি। বাজার থেকে ঝুড়ি ভর্তি সওদা এলে ফ্রক গুটিয়ে ছোট পিসির সঙ্গে বাজার গোছাত। কোথায় কী রাখতে হবে তিথি ঠিক জানে। কখনও বীণাপিসির সঙ্গে মাছ কুটতে বসে যায়—ঘাট থেকে কাটা মাছ ধুয়ে আনে। কোচরে থাকে থোকা থোকা লটকন ফল। ফাঁক পেলেই খোসা ছাড়িয়ে খায়। তার ঘরে এসে তাকেও দেয়।

যখনকার যে ফল, কোঁচড়ে নিয়ে ঘোরার স্বভাব। কামরাঙ্গা, লটকন, আঁশ—ফল—কোথায় যেসব পায়! জমিদারবাবুদের বাড়িগুলি পার হয়ে গেলেই মজা খাল, মজা খালের পাড়ে পাড়ে অজস্র গাছপালা, ঝোপজঙ্গল। তিথি জানে কোথায় কোন গাছ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোন গাছে কী ফল পেকেছে—জমিদারিতে এলাহি গাছপালা। জঙ্গলেরও যেন ব্যবস্থা আছে। দিঘির পাড়ে বিলাতি গাব গাছের ছায়া বিকালে লম্বা হতে হতে দিঘিটাকে অন্ধকার করে দেয়। কালো জল, থামের মতো বড় বড় সব গজার মাছ ভেসে উঠলে তিথিই তাকে নিয়ে গেছে সেখানে—তিথিই খবর দিত, গাছে বিলাতি গাব পেকেছে। যেমনি গাছ, তেমনি তার বিশাল কাণ্ড। আর গাছে বড় বড় তেল চুকচুকে পাতা। গভীর ঘন ছায়ার মধ্যে লাল রঙের পাকা বিলাতি গাব তিথির চোখ এড়ানো কঠিন। জমিদারবাবুদের দেশটা সে যেন চিনেছে তিথির চোখ দিয়ে।

তিথি একটা বালিশ দিয়ে গেছে মাথার কাছে। ইজিচেয়ারে মাথায় বালিশ দিয়ে সে তিথির কথাই ভাবছিল।

মেয়েটার মাঝে মাঝে কী যে হয়?

এভাবে জীবন নিয়ে খেলা তিথির পক্ষেই সম্ভব। কারণ তিথি অনাথ। বাবুদের বাড়ির এঁটোকাটা খেয়ে সে বড় হয়ে উঠছে।

অরণি ভাবল অষ্টমী স্নানে এবারে তিথিকে নিয়ে যেতেই হবে। কাচের চুড়ি কিনে দিতে হবে। মেয়েটাও বেশি কিছু চায় না। ভালোবাসলে কাচের চুড়ি কিনে দিতে হয়—ভালোবাসার দাম সামান্য কটা কাচের চুড়ি—ভাবলেই কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায় তার।

একমাত্র পূজার ছুটিতে অরণি বাড়ি যেতে পারে। স্টিমারে পাঁচ সাত ঘণ্টা লেগে যায় বারদি যেতে। সেখান থেকে গয়না নৌকায় সে বাড়ি যায়। বাবা সঙ্গে থাকেন। গেল পূজায় সে একাই গেছে। গাঁয়ের লোকজন বারদির ঘাটে কেউ না কেউ থাকে। ছোটকাকাও চলে আসেন তাকে নিতে।

বাড়ি গেলেই এক কথা কাকিমার, ও সেজদি দ্যাখ এসে, অরু আমাদের কত বড় হয়ে গেছে! সেদিনকার ছেলে, দেখলে চেনাই যায় না। এক একটা বছর যায় আর সে লম্বা পা ফেলে যেন দৌড়ায়। তিথিরও হয়েছে তাই।

পূজার ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় তিথিই তার সব গোছগাছ করে দেয়। জামা—প্যান্ট কেচে সব ধোপা বাড়ি দিয়ে আসে। তার বইপত্র গুছিয়ে দেয়। এবং স্টিমারঘাটেও যাওয়া চাই তার। হাতে টিনের স্যুটকেসটি তিথি কিছুতেই কাউকে দেয় না। স্টিমারে উঠে আসে বাবার সঙ্গে। তারপর স্টিমার ঘাট থেকে ছেড়ে দিলে মঠের চাতালে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ স্টিমার দেখা যায়—দাঁড়িয়ে থাকে।

অকারণে ঝগড়ারও শেষ নেই।

ব্যাটবল খেলার জন্য স্টাম্প বানাচ্ছে সে। মেজদা শহর থেকে ব্যাট কিনে এনেছে। একটি টেনিস বলও। তার উপর স্টাম্প বানাবার দায়িত্ব পড়েছে। সে জঙ্গলে ঢুকে জারুলগাছে উঠে গেছে ডাল কাটছে। তিথির তখন নিচ থেকে হাজার রকমের প্রশ্ন।

গাছে উঠেছ কেন? নামো। পড়ে হাত—পা ভাঙলে কে দেখবে।

শোন তিথি সবতাতে মাতব্বরি করবি না। ভাগ এখান থেকে।

ডাল কাটছ কেন বলবে তো!

আমার ইচ্ছে, কাটব।

না কাটতে পারবে না।

তোর গাছ?

হ্যাঁ আমার গাছ। নামো বলছি। উনি অবেলায় বাবুদের কথায় গাছে উঠে গেছেন!

ডালে কোপ দিতেই তিথির চেঁচামেচি শুরু।

অ হরমোহনদাদু, দ্যাখো এসে অরুদা গাছের ডাল কাটছে।

আর তখনই হরমোহনদাদুর তড়পানি শুরু হয়ে যায়। গাছের নীচে এসে তাড়া—নামেন গাছ থেকে। কে অবলায় আপনাকে গাছে তুলে দিয়েছে। পড়ে—টরে হাত—পা ভাঙলে কী হবে?

গ্রীষ্মের ছুটি, পুজোর ছুটি, বড়দিনের বন্ধে তিথির শুধু অপেক্ষা বাবুদের আত্মীয়স্বজনরা কে কবে আসবে। কেউ আসার কথা থাকলেই সে দৌড়ে সবার সঙ্গে স্টিমারঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মালপত্র নামানো হয়। তিথি দেখেশুনে সব মালপত্র নামায়। ছোট তরফের বউদিমণি এলে ত কথাই নেই। সে বউদিমণির ব্যাগ—এটাচি হাতে নিয়ে বাড়ি চলে আসে।

বউদিমণি এলে সে কিছু পায়।

যেমন সেবারে তাকে একটা গন্ধ সাবান দিতেই কি খুশি! নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকছে। তার ঘরে ছুটে এসে বলেছে, ছোট তরফের বউদিমণি দিল। একবার মেলা থেকে পেতলের মাকড়ি কিনে দিয়েছিল বাবার বউঠান—কী খুশি তিথি। বাড়ি বাড়ি সে কানে মাকড়ি পরে ঘুরেছে।

কে দিল রে?

গিন্নিমা দিয়েছে। গিন্নিমা বলল, তিথি, মেয়েদের কান খালি থাকলে ভালো দেখায় না। পেতলের মাকড়ি জোড়া দিলাম। সব সময় পরে থাকবি। কান খালি রাখলে বাড়ির অমঙ্গল হয়।

তিথি ভালো ফ্রক গায়ে দিলে, স্নো পাউডার মাখলে সবার এক প্রশ্ন—কে দিল?

অকপটে তিথি সব বলে দিত, কে কখন ডেকে তাকে কী কী দিয়েছে।

তিথির সঙ্গে তার যে দু—একবার হাতাহাতি হয়েছে, তাও আজ কেন যে মনে পড়ল!

সেই যে বছর সে এখানে চলে আসে, বোধ হয়, সেবারেই হবে। তখনও সবার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তিথির মামা, তার সমবয়সিই হবে, চরণের সঙ্গে ডাংগুলি খেলার জন্য গাছের ডাল খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পেয়ারা গাছের সোজা ডাল হলে ভালো হয়। পেয়ারা গাছের ডাল ওজনেও ভারী। উৎকৃষ্ট ডাং পেয়ারা গাছের ডাল থেকেই তৈরি করা যায়। ডাল কাটার দা নিয়ে বাগানে ঘোরাঘুরি করতেই সহসা তিথি উদয় গাছতলায়। চেঁচাচ্ছে—ও বৃন্দাবনদা, পেয়ারা গাছের ডাল কাটবে অরুদা। গাছের নীচে ঘুর ঘুর করছে।

মারব এক থাপ্পড়। আমি ডাল কাটব, তোকে কে বলেছে?

ডাল না কাটলে দা নিয়ে পেয়ারাতলায় কেন?

তোদের গাছ?

হা আমাদের গাছ।

বৃন্দাবনদা চেঁচাচ্ছে, অরুদাদা ও গাছের ডাল কাটবে না। কানে উঠলে বড়কর্তা রাগ হজম করতে পারবেন না।

অবশ্য গাছটা যে খুব দামি সে জানত। কাশীর পেয়ারা—এক একটা পেয়ারা পোয়াটেক ওজনের। বড়কর্তা গাছটা কাশী থেকে আনিয়েছিলেন কি না সে জানে না, তবে গাছটার প্রতি বড়কর্তার তীক্ষ্ন নজর থাকে সে জানে। সে গোপনে ডাল কাটবে ভেবে গাছের নিচে ঘুর ঘুর করছিল। মেয়েটার স্বভাব এত মন্দ, ঠিক খেয়াল রেখেছে। নিজের হলেও কথা ছিল।

সে বলেছিল, অমলদা বলেছে কাটতে।

কে অমলদা?

যেন তিথি বাড়ির ছোটবাবুকে চেনেই না।

ডাকব, অমলদাকে। তুই বাড়ির ছোটবাবুকে চিনিস না। তাদের এঁটো খেয়ে তুই মানুষ।

আমি কাউকে চিনি না। সোজা কথা বলে দিলাম, ডাল কাটবে না। কাটলে বিপত্তি হবে।

অমলদাও ছুটে এসেছিল।

কি হয়েছে রে অরু?

ডাল কাটতে দেবে না।

সহসা তেড়ে গেল তিথিকে, তুই কে রে? যা ভাগ।

তিথি কি সে মেয়ে! সে ছুটে এসে তার হাত থেকে প্রায় জোরাজুরি করেই দাটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করল। এবং এতেই লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। সে কিছুতেই ডাল কাটতে দেবে না। সে হাতের দা ছাড়বে না। সহসা তিথি তাকে জাপটে ধরে দা কেড়ে দৌড়। সে কিংবা অমল কেউ তার নাগালই পেল না।

পরে দেখা হলে বলেছিল, এমন সুন্দর গাছটায় ডাল কেউ কাটে! মায়া হয় না!

কত কথাই যে মনে হচ্ছিল অরণির।

অরু তারপর ক্রমশ আরোগ্যলাভ করতে থাকলে একদিন তিথিই তাকে ধরে ধরে নদীর পাড়ে নিয়ে গেল। স্কুলেও সে ক্রমে যেতে পারছে। এবং এভাবে নদীর ঘাটে এক সময় অষ্টমী স্নানের পরবও শুরু হয়ে গেল।

বর্ষায় নদীর দু—পাড় এমনিতেই দেখা যায় না। কত সব একমাল্লা, দোমাল্লা নৌকায় পুণ্যার্থীরা চলে আসছে। পানসি নাও দেখা গেল। নদীর উত্তরের চরের দিকটায় ললিত সাধুর আশ্রম, সেখানেও হাজার হাজার পুণ্যার্থীর ভিড়। সড়ক ধরে ক্রোশখানেক হেঁটে গেলে সেই মঠ মন্দির—সেখানেও পুণ্যার্থীরা জড়ো হয়েছে। সারা নদী জুড়ে বজরা, পানসি। আনারস, তালের নৌকারও বিশাল বিশাল বহর। নদীর পাড়ে বাবুদের সব প্রাসাদের পর প্রাসাদ, সেই সব প্রাসাদেও দূর দেশ থেকে এসেছে আত্মীয়স্বজনরা। নদীতে ডুব দিয়ে কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গা বলবে বলে এসেছে।

তিথিও বসে নেই। সকাল থেকে সে ছোটপিসির সঙ্গে ফুল দুর্বা তুলেছে। তিল তুলসী কাঠের বারকোশে সাজিয়ে রেখেছে, সঙ্গে হরীতকী। বাবুদের মেয়ে বউরা ঘাটে ডুব দিতে যাবে। হরমোহনদাদুও বসে নেই। মাথায় ফেট্টি বেঁধে কাঁধে বাঁশের লাঠি ফেলে সবার আগে আগে যাচ্ছে।

তিথি অরণির দরজায় এসে ডাকল, কী হল? বসে থাকলে কেন! ঘাটে ডুব দিতে যাবে না। সবাই যাচ্ছে। এ—দিনে নদীর জলে ডুব দিলে কাশীবাসের পুণ্য হয় জানো!

অরণি চারপাশে খাতা বই মেলে বসে আছে। ওর এসবে খুব একটা বিশ্বাস নেই। তাছাড়া একগাদা টাস্ক বাকি। দ্বিজপদ সার টাস্ক দিয়ে গেছেন রাতে। সে বই—এর ভেতর ডুবে থেকেই বলল, তোরা যা, আমি পরে ডুব দিয়ে আসব।

পরে ডুব দিলে হবে! সময় পার হয়ে যাবে না। তুমি কিছুই জানো না। পড়া তো তোমার সারাজীবনই থাকবে—কিন্তু এই পুণ্যস্নান, এত গ্রহ সমাবেশ আবার কবে হবে কেউ জানে! সব বছর অষ্টমী স্নান হয়। মহাঅষ্টমী স্নান কালে ভদ্রে হয়।

আসলে তিথি ভেতর বাড়িতে যা শোনে তাই এসে উগলে দেয়।

অগত্যা, তাকে যেতেই হল। ডুবও দিতে হল। কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গাও বলতে হল।

তিথি আজ শাড়ি পরেছে। তিথিকে এত লম্বা লাগছিল দেখতে যে সে অবাক না হয়ে পারেনি। ফেরার পথে এক ফাঁকে সে তার কাছে এসে অতি সতর্কভাবে বলছিল, মন্দিরে যাব। আমাকে তুলিদি সঙ্গে নেবে বলেছে। তুলিদির সঙ্গে যাব না। বলেছি, ছোট তরফের বউদিমণির সঙ্গে যাব। বউদিমণি খবর পাঠিয়েছে। তুমি কিন্তু রেডি থেকো।

তারপরই আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলেছিল, মনে আছে?

কী মনে আছে, কী জানতে চাইছে, অরণি বুঝতে পারছে না।

তিথি মনে করিয়ে দিল, তোমার অসুখের সময় মন্দিরে মানত করেছি। বাতাসা মিসরি কিনতে হবে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে কালভৈরবীর মন্দিরে যাব।

তিথি ঠিক দুপুরেই চুপি চুপি তার ঘরে হাজির। তাড়াতাড়ি রওনা না হলে মন্দির দর্শন করে বাড়ি ফেরা যাবে না। তিথির জন্য বাতাসা মিসরি কিনতে হবে, অরু সেজন্য বাবার কাছ থেকে টাকা নেবার সময় বলল, তিথি যে কি না, আমার জন্য মন্দিরে মানত করেছে। ও পয়সা পাবে কোথায়। থলে থেকে তোমার টাকা নিয়েছি।

জগদীশ আজ নাজিরখানায় যাননি। সকাল থেকেই তাঁর কাজের শেষ ছিল না। বাবুরা সবাই ঘাটে ডুব দিতে যাবেন। নতুন কাপড় গামছা সে ঘরে ঘরে হরমোহনকে দিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। বউঠানের জন্য লালপেড়ে, নলিনীর জন্য সাদা থান, তুলির জন্য লম্বা নতুন ফ্রক, বউমাদের জন্য তাঁদের শাড়ি—ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরে সবাই আজ নতুন জামা—কাপড় পরবে। ধর্মাচরণের কোনও ব্যাঘাত না ঘটে সেই নিয়েও তাঁর ভাবনা কম ছিল না। অরণিকে নিয়ে তিথি মন্দিরে যাবে, মানত থাকলে না গিয়েও উপায় নেই, অরণি টাকা নেবার সময় এজন্য তিনি না বলে পারলেন না—বেশি করে নাও। মেলায় গেলে কেনাকাটা করতে হয়। তিথি কিছু নিতে চাইলে কিনে দিয়ো। ওর তো দেখার কেউ নেই।

তিথিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে অরণির আর কোনও সংকোচ থাকল না।

নদীর পাড়ে গিজ গিজ করছে লোক। চাদর টাঙিয়ে অস্থায়ী তাঁবু তৈরি হয়েছে। স্টিমারঘাটের বিশ্রামাগারে মানুষজন গিজ গিজ করছে। রাস্তার দু—দিকেই জিলিপির দোকান, বিন্নি খই বস্তা খুলে বিক্রি হচ্ছে। লাল বাতাসা, আর কোথাও রসগোল্লা, বুঁদে, যে যা পারছে নদীতে ডুব দিয়ে এসে শালপাতায় খাচ্ছে।

তিথির কোনও দিকেই যেন খেয়াল নেই।

সে হেঁটে যাচ্ছে। ভিড় দেখলেই সরে দাঁড়াচ্ছে। হেমন্তবাবুর প্রাসাদ পার হয়ে, সেই বড় মাঠ, মাঠেও তাঁবু পড়েছে। কোথাও আয়না, চিরুনি, তাবিজের মালা, মণিহারি দোকানে সুগন্ধ তেল, সাবান, কী নেই! যেন সারা দেশ থেকে যে যা পেরেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে।

তিথির কোনও দিকেই খেয়াল নেই।

ক্রোশখানেক পথ হাঁটতে হবে। এদিকটায় বেশ ফাঁকা। তারপর বাজার। তার বাবা গোরাচাঁদ মেলায় জিলিপির দোকান দিয়েছে, সে ওদিকটায় কিছুতেই গেল না। যেন সে তার বাবাকে এড়িয়ে কোনওরকমে এখন মন্দিরে পৌঁছতে চায়। হাতে কাঁসার ঘটি, তাতে নদীর জল—মন্দির সংলগ্ন মাঠে মিসরি, বাতাসার দোকান—অরু বলল, মিসরি বাতাসা কিনতে হবে তো!

তিথির গায়ে ভারী সুঘ্রাণ। শাড়ির আঁচল বিছিয়ে বলল, কী সুন্দর না, কত কারুকাজ করা রেশমি সুতোয়। বাতাসা মিসরির ঠোঙা শাড়ির আঁচল মেলে তুলে নিল। এক হাতে কাঁসার ঘটি আর আঁচলে বাতাসা মিসরির ঠোঙা। সে ভিড় ঠেলে অরণির হাত ধরে মন্দিরে ঢুকে গেল। তারপর সোজা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। অরণি কিছুই বলতে পারছে না। জায়গাটা মানুষজনের যাওয়া—আসায় জল—কাদায় মাখামাখি।

তিথি সবই করছে, যেমন ফুল বেলপাতা তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, শিবের মাথায় জল ঢালতে বলছে। এক মন্দির থেকে আর এক মন্দিরে লাফিয়ে লাফিয়ে ঢুকছে, ভোগের মিসরি বাতাসা কলাপাতায় রেখে দিচ্ছে। তিথি প্রণাম করে উঠে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অরণি আর কী করে, সেও হাঁটু গেড়ে প্রণাম করছে।

ফেরার সময়ই অরণি না বলে পারল না, কিরে, তোর সেই দোকান দেখছি না! দু—হাত ভরে কাচের চুড়ি পরবি বললি, তুই কেমন হয়ে যাচ্ছিস। গোবর্ধন দাসের দোকান কোথায়?

তিথি হাসল। তুমি আমাকে কিনে দেবে?

কোথায় দোকান।

তিথি বলল, থাক।

না থাকবে না। কোথায় দোকান বল!

অরণি মেলায় সেই দোকান কোথায় খুঁজে বেড়াতে থাকল। তিথির লজ্জা হয়েছে। তিথির এই আচরণে সে কিছুটা বেকুফ। চারপাশে এত জিলিপির দোকান মিষ্টির দোকান, সে কিছুই যেন দেখছে না।

অরণি এবার নিজেই বলল, আয়। জিলিপি খাই। গরম গরম জিলিপি আমার খেতে বেশ লাগে।

তুমি খাও, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

তোকে কেউ কিছু বলেছে?

কী বলবে!

আমার সঙ্গে আসায়?

না। কেউ কিছু বলেনি। বললেই শুনব কেন! তুলিদি ডেকে পাঠিয়েছিল, মেলায় আমার সঙ্গে যাবে। আমি তো সব বুঝি অরুদা। তোমার সঙ্গে মেলায় ঘুরি তুলিদির পছন্দ না। আমিও বলে দিয়েছি, না, যেতে পারব না। ছোট তরফের বউদিমণি ডেকে পাঠিয়েছে।

তারপরই মেলায় মন্দিরের সামনে টেনে নিয়ে গেল তাকে।

একটা কথা বলব!

বল।

তুমি মন্দিরে দাঁড়িয়ে বলবে, তুলিদিকে কখনও স্বপ্নে দেখনি!

অরু বলল, কেন তুলি তোকে কিছু বলেছে?

তুলিদি যে বলল, তুমি তাকে প্রায়ই স্বপ্নে দ্যাখো।

মিছে কথা।

মন্দিরে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে বলো, মিথ্যে কথা।

সে ভেতরে ঢুকে দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মিথ্যে কথা। তুলিকে আমি কখনোই স্বপ্নে দেখিনি।

তিথি কী খুশি!

সে তার নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে। অরুর হাত ধরে হাঁটছে। এতক্ষণ চারপাশে কী ছিল, কারা ছিল সে কিছুই খেয়াল করেনি। কাচের চুড়ির কথাও মনে ছিল না। অরুদা, তুলিদিকে স্বপ্নে দেখে এই তাড়নাতেই সে কাহিল ছিল। দেবতার সামনে কেউ মিছে কথা বলে না। অরুদা দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, তুলিদিকে কখনোই স্বপ্নে দেখেনি। স্বপ্নে না দেখলে ভালোবাসাও হয় না। সে কিছুতেই এতক্ষণ নিজের কথাটা বলতে পারছিল না—তাকে অরুদা স্বপ্নে দ্যাখে কি না।

অরণি বানিয়ে বলল, জানিস সেদিন রাতে তোকে স্বপ্নে দেখলাম। তুমি আমি মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। গরম জিলিপি ভাজা খাচ্ছি। তারপর নদীর চরে নেমে গেলি, জলে মাটির প্রদীপ ভাসালি।

আর তিথিকে পায় কে? মন্দিরে না নিয়ে এলে সে কিছুই জানতে পারত না। তার যে কত কাজ এখন। পুণ্যার্থীরা নদীর পাড়ে জড়ো হয়ে ডুব দিয়েছে। যে যার মতো ব্রত উদযাপন করছে। কেউ অঘোর চতুর্দশী ব্রতের জন্য ধুতুরা ফুলের মালা গলায় পরে পুরোহিতের সামনে বসে গেছে। কেউ মৌনি স্নান করছে—ভূত চতুর্দশী ব্রত, সাবিত্রী চতুর্দশী—যার যেমন মানত। নদীর বুকে যতদূর চোখ যায় শুধু নৌকা আর নৌকা, কোনওটায় ছই দেওয়া, গয়না নৌকাও আছে। পানসি বজরা—যেদিকে চোখ যায়, শুধু মানুষের সমারোহ। জলে প্রদীপ ভাসাচ্ছে কেউ। তিথি তার অরুদার কল্যাণ কামনায় জলে প্রদীপ ভাসিয়ে তীরে দাঁড়িয়ে থাকল। স্রোতের মুখে প্রদীপ ঘুরে ঘুরে কতদূর নিমেষে চলে যাচ্ছে।

মন্দিরতলায় সাধু সন্নেসিদের ভিড়। মাঠের দিকটায় নাগরদোলা, হাড়ি পাতিলের দোকান, জাদুকরের তাঁবু, কোথাও আবার হরিসংকীর্তন, খোল করতালের সঙ্গে জায়গাটায় যেন মাটি ফুঁড়ে ধ্বনি উঠছে। অরু হাত ধরে তিথির কেন জানি মনে হচ্ছিল আশ্চর্য এক করুণাধারায় সে ভেসে যাচ্ছে। সে মোহিত হয়ে গেছে সব দেখে। কিছুতেই তার নড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।

এই তিথি! দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? গোবর্ধন দাসের দোকানে যাবি না!

যে সম্বিত ফিরে পেল সে। তার তো আর কিছুই দরকার নেই। সে তো সবই পেয়ে গেছে। চুড়ি পরে আর কী হবে! তবু অরুদার কথা সে ফেলতে পারল না। গোবর্ধন দাসের দোকান আস্তাবলের কাছে। সে সেখানে ছুটে যেতে চাইলেই সহসা কে যেন বলল, এই তুই তিথি না!

সে থমকে দাঁড়াল। লোকটাকে সে কোথায় যেন দেখেছে! আবার মনে হল লোকটাকে সে যেন চেনে। গলায় কণ্ঠি, মাথায় ছাঁটা চুল, ধুতি পরনে, ফতুয়া গায়। কপালে তিলক কাটা—লোকটা রাস্তা আগলে আছে। সামনে তাকে কিছুতেই এগোতে দিচ্ছে না।

কী রে জবাব নেই কেন। তুই তিথি না! গোরাচাঁদের আগের পক্ষের মেয়ে না তুই!

তিথি বলল, হ্যাঁ, কেন!

তোকে কত ছোট দেখেছি। তুই কবে এতবড় হয়ে গেছি—তোর বাপের দোকানে গেলাম। বলল, দেখুনগে হয় বাড়িতে আছে, নয় মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বললাম, তোর তো এঁটো খাওয়ার অভ্যাস! অভ্যাসটা আছে, না গেছে।

অরুর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। একজন আগন্তুক যদি গায়ে পড়ে তিথিকে অপমান করতে চায়, সে ছাড়বে কেন।

অরণি বলল, কে বলেছে ও এঁটো খায়! আপনি কে!

আরে আমি জানি না ভাবছ। বাবুদের আমি তোলা আদায় করতাম। তোমার বাবা আমাকে চেনে। তিথির বাবাকে পালমশাই খবর পাঠিয়েছেন। ঐ যে দেখছ, দূরে, ঠিক বরাবর দেখ, দেখছ না, নদীর বুকে বজরা নৌকা একখানা, ওখানে কর্তামশাই তার পরিবার নিয়ে আছেন। মহাঅষ্টমী স্নান বলে কথা। আমাকেই পাঠাল, আমি তো খুঁজে বেড়াচ্ছি, পাই কোথা। এখানে এসে গোরাচাঁদের কথা মনে পড়ে গেল। আয় মা, তুই যে অন্নপূর্ণা, কে না জানে! চল আমার কর্তামশাইকে দর্শন দিয়ে আসবি।

লোকটা কি পাগল! অরণির এমনই মনে হল। কিন্তু লোকটা যে বলল, সে তার বাবাকে চেনে! তিথির বাবাকেও চেনে। লোকটাকে চটাতেও পারে না! সে কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে জানতে পারলে বাবা খুবই দুঃখ পান।

কী করে আর অরু! শুধু বলল, রাস্তা ছাড়ুন আমরা যাব।

কোথায় যাবে? তুমিও সঙ্গে চল না। কর্তামশাই তোমাকে দেখলে খুশিই হবেন। তোমার বাবা বন্দরে গেলে, মহাজনের সঙ্গে একবার দেখা না করে আসেন না। বাবুরাও চেনে। কত বড় মানুষ, বড় মনকষ্টে ভুগছেন।

অরণি ফিক করে হেসে দিল। লোকটার কাতর অনুনয় তাকে ভারী কৌতূহলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কে মহাজন, সে নামই শোনেনি। অথচ লোকটা যেভাবে কথা বলছে, তাতে কর্তামশাইটি যে খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না। বজরায় চেপে পুণ্যস্নানে এসেছেন। তার দাসী বাঁদি চাকর—বাকরের মধ্যে বোধ হয় এই লোকটিও পড়ে। বজরার পাশে আলাদা নৌকায় তারা আছে। অরু খুব গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে পরে যাবে। ওর বাবাকে না বলে যায় কী করে?

তখনই তিথি কেমন লোকটার শরীরে দুর্গন্ধ পেল। লোকটার হাবভাব একদম ভালো না। মেলায় দুষ্টু লোকের অভাব থাকে না। সে অরুর দিকে তাকিয়ে বলল, শিগগির চলে এসো অরুদা। বলেই ছুটতে থাকল। দ্রুত এবং যত সত্বর সম্ভব লোকটার নাগাল থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য যেন ছুটছে।

অরণিও ছুটতে থাকল। তিথি কি ভয় পেয়ে গেছে! ঝাউতলার কাছে গিয়ে দেখল তিথি দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাঁপাচ্ছে। চোখ মুখে ভীষণ উত্তেজনা। এত হাঁপাচ্ছে যে কথা বলতে পারছিল না। প্রচণ্ড ঘামাচ্ছে।

অরণিও দম নিতে পারছিল না। মন্দিরতলা থেকে এই ঝাউতলার দূরত্ব কম না। তিথি কখনও নৌকায় লাফিয়ে পড়েছে—এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায়। সোজা রাস্তায় ভিড়ের জন্য হাঁটা যাচ্ছে না। তিথি পালাবার জন্য নৌকাগুলির উপর দিয়ে ছুটছিল। কোনও নৌকা কাত হয়ে যাচ্ছে, কোনও নৌকা টলে উঠছে, নৌকার আরোহীরাও তাকে তেড়ে গেছে—কি দস্যি মেয়েরে বাবা! কার মেয়ে? মেলায় এসে সাপের পাঁচ পা দেখেছে।

কিন্তু তাকে কিছু বলার আগেই তিথি আর এক নৌকায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, চরের কাছে রাস্তায় এত ভিড় নেই। সে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে যখন উঠছিল, সব নৌকা থেকেই মানুষজন চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।

কার মেয়ে?

কোথায় থাকে?

পরীর মতো জলে উড়ে বেড়ায়। মা—বাবাই বা কেমন।

কেউ বলল, কচি খুকিটিও নও। লজ্জাশরম খেয়ে বসে আছো। পায়ের শাড়ি তুলে নৌকা থেকে নৌকায় লাফিয়ে ছুটে যাচ্ছ!

তিথি কিছুই গ্রাহ্য করছিল না। সে ঘাটের সিঁড়ি ধরে আবার জনারণ্যে মিশে গেছে। লোকটা তাকে খুঁজে পেলেই যেন তার মরণ।

অরুকেও সবাই দেখেছে, মেয়েটার পিছু পিছু নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়ছে।

এই তিথি, কী হল তোর?

শিগগির চলে এসো।

কেন!

বলছি, চলে এসো! কেন, পরে বলব।

এখন তারা দুজনেই মজা খালের সাঁকোর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর বিশাল বিলাতি গাবের গাছ। তার ঘন ছায়ায় ঠান্ডা হয়ে আছে জায়গাটা। মানুষজনের চলাচল কম।

দুজনই এতক্ষণ হাঁপাচ্ছিল। দুজনেই এবারে যেন কিছুটা ধাতস্থ। তিথি বলল, লোকটা ভালো না অরুদা। মহেশ পাল বাজারে তোলা আদায় করত। এতক্ষণ সব মনে পড়ছে। লোকটা ছ্যাঁচড়া স্বভাবের। বাবুরা তাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার কেন এখানে উদয় কিছুই বুঝছি না।

অরু বলল, তোর বাবাকে সত্যি চেনে?

চিনবে না কেন? বাবাকে বাজারে কিছুতেই বসতে দেবে না। আমাদের বাড়ি পর্যন্ত আসত। বাবার তো জানো তখন মাথা খারাপ। ঠাঁই নেই কোথাও। বাজারের ফাঁকা জায়গায় ফুলুরি ভেজে পয়সা হত, লোকটার হম্বিতম্বিতে বাবা খুবই ঘাবড়ে গেল। পরে দেখেছি, আমাদের বাড়িতেও আসত। বাবা না থাকলে…

তিথি চুপ করে গেল। যেন বোবা হয়ে গেছে।

ঠিক আছে চল। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।

যেন কোনও গত জন্মের পাপের বোঝা বয়ে তিথি হাঁটছে। তার বোধহয় পা চলছিল না। লোকটা তার শরীর কচলাত। বাবা বুঝত কি বুঝত না সে জানে না, সেও কিছু বলত না, লোকটা বাড়ি উদয় হলেই আতঙ্কে সে পালাবার চেষ্টা করত।

তারপর তার আর কিছু মনে পড়ছে না। তার বয়সই বা কত তখন। মহেশ পাল যে ছ্যাঁচড়া স্বভাবের বাবুদের কানেও কথাটা উঠে গেল। ভুঁইঞা কাকা না থাকলে কি যে হত! লোকটাকে ডেকে বললেন, ‘মহেশ অনেক হয়েছে। তোমার অনাচারে বাবুদের ইজ্জত যেতে বসেছে। কাল থেকে যেন সকালে উঠে আর তোমার মুখ দেখি না। তিথি তোমার হাত কামড়ে দিয়েছে কেন—তুমি এত বড় অমানুষ!’

তারপর থেকেই লোকটা হাওয়া।

তিথির সবই মনে পড়ল। লোকটা যে তার আবার পেছনে লেগেছে, সেও টের পেল। ভাবতে গিয়ে চোখমুখ এত কাতর হয়ে পড়ছে যে সে আর একটা কথা বলতে পারছে না। ভয়ে বুক থেকে কান্না উঠে আসছে।

তখন সাঁজ লেগে গেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে নদীর পাড়ে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে গ্রামগুলি—শুধু মঠের দিকটায় কিংবা নদীতে লণ্ঠন জ্বলছে—দোকানে দোকানে হ্যাজাক, ডেলাইট। এবং দূরে সেই বজরায় বোধ হয় হ্যাজাকের আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। ওটা গোপীবল্লভ মহাজনের বজরা—চাউর হয়ে গেছে সারা মেলায়। কারণ যারা পুণ্যস্নান করে নদীর পাড়ে খড়কুটো জ্বেলে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছে, তারাই বলাবলি করছিল—তীর্থ মাহাত্ম্যের কথা। মহাজনের মতো জাঁদরেল মানুষও বিধাতার কোপের শিকার হতে চায় না। অষ্টমী স্নানে নদীতে ডুব দিতে এসেছে।

তিথি হাঁটছিল ঠিক, তবে তার মধ্যে কোনও বিসর্জনের বাজনা বাজছে বুঝতে কষ্ট হয় না। কাছারিবাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাবারও তার ক্ষমতা নেই। অন্ধকার গাছপালার ছায়ায় তিথি কেমন নিস্তেজ গলায় ডাকল, অরুদা।

কী হল, এত পেছনে পড়ে থাকলি কেন?

তিথি নড়ছে না।

অরু কাছে গিয়ে বলল, শরীর খারাপ?

তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো।

অরুর খুবই সংকোচ হচ্ছিল, রাস্তার উপর যে জড়িয়ে ধরা যায় না কিছুতেই তিথি বুঝছে না। কে কখন দেখে ফেলবে, বাড়ি ফেরার এই রাস্তাটা যতই নির্জন হোক, বাবা নাজিরখানা থেকে এখন ফিরে আসতে পারেন। বৃন্দাবনদা, হরমোহনদা, কিংবা অন্য কেউ, কত লোকই এই রাস্তায় হেঁটে যায়, সে কিছুতেই তিথি বললেও তাকে জড়িয়ে ধরতে পারে না।

সুপারিবাগানের ভেতর ঢুকে গেলে কিছুটা আড়াল মিলতে পারে। বাগানের শেষ দিকটায় মুলিবাঁশের ঘর তিথিদের। দাওয়ায় কুপি জ্বলছে দূর থেকেও বোঝা যায়। তিথির ভাইবোনদের কোলাহলও টের পাওয়া যাবে কিছুটা ভেতরে ঢুকে গেল। বোধ হয় এভাবে পাগলের মতো ছোটা তিথির উচিত হয়নি। খুবই কাহিল হয়ে পড়তে পারে।

সে বলল, চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। তুই এভাবে না ছুটলেই পারতিস।

তিথি সহসা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল।

কেন আমি ছুটেছি, তুমি জানো?

লোকটাকে তোর এত ভয় কেন বুঝি না।

বুঝবে না। আমি মরে গেলেও বুঝবে না কিছু, কেন তিথি মরে গেল।

আবার পাগলামি শুরু করলি।

লোকটা বাবাকে টোপ দিচ্ছে। লোকটার কাছে, বাবার কাছে আমি এখন টোপ ছাড়া কিছু না। নিজেকেই ঘেন্না হচ্ছে। আচ্ছা অরুদা আমার শরীরে কী আছে বলো তো, আমি কেন টোপ হয়ে ঝুলব। শরীর জ্বালিয়ে দিলে তোমাদের সবার শিক্ষা হবে।

তিথির মধ্যে আবার আগেকার সেই তিথি হাজির। তাকে জড়িয়ে না ধরায় সে অপমানিত বোধ করছে। সমবয়সি এই মেয়েটিকে সে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। তিথিকে কেন টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হবে! কীসের টোপ। কে সেই শিকারি, যে টোপ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে ফেলে দেবে। কবে থেকেই যেন তিথি এটা অনুমান করতে পেরে তাকে নিয়ে বারবার উধাও হবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না, অরুর এতে বিন্দুমাত্র সায় নেই বলে। তিথির যা সাজে, তার তা সাজে না।

অরু তো ইচ্ছে করলেই তিথিকে নিয়ে দেশান্তরী হতে পারে না। সে এখানে পড়তে এসেছে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল এমনও ভাবে। বাবুদের বাড়ির সবাই তাকে খুব ভালো এবং বিনয়ী বলে জানে। বাবার সে খুবই অনুগত। সে ইচ্ছে করলেই তিথির মতো পাগল হয়ে যেতে পারে না।

সে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।

তিথি তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তিথি কিছু চায়। কী চায় সে—যে বোঝে না তাও না। কিন্তু সে তো মনে করে এতে তিথি খাটো হয়ে যাবে। সেও খাটো হয়ে যাবে। এই সব আশঙ্কাতেই সে তিথিকে জড়িয়ে ধরতে সাহস পাচ্ছে না।

সুপারির বাগান বলে যথেষ্ট আড়াল রয়েছে। জ্যোৎস্না রাতেও কিছুটা ম্রিয়মাণ অন্ধকার এবং নদী থেকে হাওয়া উঠে আসছে। সুপারি গাছগুলো হেলছে দুলছে। নীচে সবুজ ঘাস। তাকে জড়িয়ে তিথি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছিল।

আর এ—সময়ে তিথি বড়ই বিহ্বল গলায় বলছে, অরুদা আমি আর পারছি না। কেমন নিস্তেজ গলার স্বর, এবং কিছুটা গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। তুমি আমার সব দেখেছ। আমার আর কিছু গোপন করার নেই। আমার সব ভেসে যাচ্ছে অরুদা।

আবার সেই স্খলিত গলার স্বর—আমি ডুবে যাচ্ছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে না ধরলে বাঁচব না।

আর অরু কেমন এক আশ্চর্য গন্ধ পেল তিথির শরীরে। ভেসে গেলে কিংবা ডুবে গেলে মেয়েদের শরীরে এসময় এক আশ্চর্য গন্ধে ভরে যায় বোধ হয়।

প্রথমে মনে হল, পদ্মপাতার গন্ধ।

তারপর মনে হল নদীর জলের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা শ্যাওলার গন্ধ এবং শেষে কেন যে মনে হল নদীর জলে মাছের ঝাঁক ভেসে গেলে যে গন্ধ ওঠে, কেমন এক আঁশটে গন্ধ তিথির শরীরে।

নারী রহস্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে মেয়েদের শরীরে এমনই বুঝি ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এবার তিথিকে আলিঙ্গনে অবারিত মুগ্ধতায় নিয়ে যেতে চাইল অরু। তিথির হুঁশ নেই। তারও না। স্বপ্নের মতো এক অস্পষ্ট ইচ্ছার জগতে তারা ভ্রাম্যমাণ। কেন যে মনে হচ্ছিল অরুর, যে—কোনও সময় তাঁর হাত থেকে পিছলে যেতে পারে তিথি। নদীর জলে পড়ে গেলে তিথি সত্যি কোনওদিন মীন হয়ে তার অপেক্ষায় নদীতে ঘুরে বেড়াতে পারে।

নদীর জলে ডুবে গেলে তাকে আর সে কিছুতেই খুঁজে পাবে না।

যখন উভয়ের হুঁশ ফিরে এল, অরণি কেমন লজ্জায় পড়ে গেল। তিথিকে অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখাচ্ছিল। সে তার শাড়ি সায়া ব্লাউজ বুকে জড়িয়ে রেখেছে। এবং বারবার বলছে, তুমি যাও অরুদা, তুমি কিচ্ছু জানো না। তুমি বোকা আছো।

অরু কিছুটা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েছিল। সত্যি সে কিছু জানে না।

তুমি যাও না অরুদা! কে আবার দেখে ফেলবে। এবং এও বুঝতে পারছে, তিথি খুব দ্রুত সায়া গলিয়ে দিচ্ছে। তারপর শাড়ি পেচিয়ে এক দৌড়। তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে তিথিদের বারান্দায় যে কুপিটা জ্বলছিল, দপ দপ করে তাও নিভে গেল।

অরণি বুঝে পেল না, স্বপ্নের জগতে তিথিকে সে মীন হয়ে জলে ভেসে যেতে কেন যে দেখল!

জলের গভীরে তিথি ডুব দিচ্ছে, ভেসে উঠছে, আবার ডুবে যাচ্ছে। ঠিক ভরা গাঙে যেন একটা শুশুক মাছ। স্তন্যপায়ী মাছের ডুবে যাওয়া ভেসে ওঠা সে কতদিন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিথির সঙ্গে সে দেখেছে। তিথির যে কী হত, শুশুক মাছ দেখলেই জলে লাফিয়ে পড়তে চাইত। মাঝ নদীতে কিংবা কিনারে সে শুশুক মাছ ভেসে যেতে দেখলেই কেন যে বলত, অরুদা তোমার ইচ্ছে হয় না, পাখির মতো আমরা কোথাও উড়ে যাই, মাছের মতো আমরা কোথাও ভেসে যাই।

তারপরই কেন যে মনে হল, সে তিথির শরীরে আবিষ্ট হয়ে ডুবে যেতে পারেনি। আসলে জড়িয়ে ধরার উষ্ণতাই তাকে এত কাবু করে দিয়েছিল যে, সে বেশিদূর এগোতে পারেনি, কিংবা সাহস পায়নি, কিংবা স্তন অথবা শরীরের সঙ্গে তার শরীর মিশেই যায়নি, তার আগেই সে বুঝি হেরে গেছে, অথচ ভ্রাম্যমাণ কোনও শুশুক মাছের মতো জলের তলায় কেন যে মনে হয়েছিল তার, দীর্ঘক্ষণ সে বিচরণ করেছে। তার করুণ অবস্থা দেখে তিথি বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ক্ষেপেই গিয়েছিল—তুমি যাও অরুদা, তুমি যাও না। সে কাপুরুষের মতো কাজটা করে ফেলে বড় অসহায় বোধ করছে।

অথবা কোনও ঘোর থেকে সে যদি এসব দেখে ফেলে। দেখতেই পারে।

তিথিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালে তিথির শরীর তার মধ্যে নানা মোহ তৈরি করে দেয়। তিথি আজ শাড়ি পরায় সেই মোহ অতীব অনন্ত হয়ে বিরাজ করেছে তার মধ্যে। সারা দুপুর বিকেল অষ্টমীর মেলায় তিথির চঞ্চল স্বভাব তাকে যে তাড়া করেছে, সে তাও বোঝে। তিথিকে নিয়ে সে ফিরছিল, এবং এই নির্জন জায়গায় তিথিকে নিয়ে ঢুকে গেছে। ঢুকে গেছে না, ঘোরে পড়ে গিয়ে তিথির সর্বস্ব লুটে নেবার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, কী যে হয়েছিল, সে কিছুই আর ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না।

সে যখন কিছুই করতে পারছিল না, কারণ সে তো জানে না, কীভাবে শরীরে শরীর বিভোর হয়ে থাকে—তার অপটুত্ব নিশ্চয়ই তিথিকে পীড়া দিচ্ছিল। তিথি তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হা হা করে বুঝি হেসেও উঠেছিল। তারপর দৌড়াতে পারে। কিংবা তিথি দাঁড়িয়ে আছে, সায়া শাড়ি বুকে জাপ্টে তাকে যে দেখছিল, সেটাও যে কোনও ঘোর থেকে দেখে ফেলেনি তার নিশ্চয়তা কি!

তারপরই মনে হল সে তার জামাপ্যান্টে হাত দিয়ে দেখতে পারে। রাতে স্বপ্নে কতবার প্যান্ট নোংরা করে ফেলেছে, চুপি চুপি উঠে গিয়ে প্যান্ট পালটেছে, দু—একবার বাবার কাছে সে ধরাও পড়েছে, বাবার এক কথা, বাইরে যাবি? যা। আমি জেগে আছি, ভয়ের কিছু নেই।

বাবা কি জানেন, এ—বয়সেই সবার এটা হয়। এবং সেই ভেবেই বাবা তাকে অভয় দিয়ে গেছেন। রাতে ওঠার অভ্যাস সবারই কমবেশি থাকে, বাবা কি ভেবে অভয় দিতেন তার কোনও স্পষ্ট ধারণা তার নেই। বাইরে বের হলে অন্ধকার মাঠ কিংবা বনজঙ্গলের এক ভূতুড়ে অবয়বের মধ্যে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে—সেই ভেবে যদি বাবা অভয় দেন। সে টর্চ জ্বেলে বের হয় ঠিক, এবং ধোওয়া প্যান্ট হাতে আলগা করে তুলে নেয়। তারপর বাইরে বের হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্যান্ট খুলে খুব সতর্কভাবে জংঘা এবং আশ্চর্য সব নীলাভ বনরাজিনীলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জল ঢেলে সব সাফ করে নিলে পবিত্রতা সৃষ্টি হয়। তারপর ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লে সহজেই ঘুমিয়ে যেতে পারে। আর যদি তা না হয়, সারা রাত তার অস্বস্তিতে ঘুম হয় না।

ঘোর যদি হয়।

সে তার প্যান্টের উপর প্রথমে হাত রাখল। না কিছুই ভিজে যায়নি। কিংবা পিচ্ছিল হয়ে নেই তার জংঘাদেশও। তবে তার এটা কী হল! কী দেখল! কিছুই হয়নি তার! অথচ কেন যে দেখল তিথিকে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ শুশুক মাছ হয়ে গেছে জলের নিচে। কেন যে দেখল, তিথি সায়া শাড়ি বুকে জাপ্টে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

জ্যোৎস্না রাত, নদীর ঢেউ, জলে অজস্র নৌকায় লম্ফের আলো, বাঁশবনে পাখির কলরব এবং স্টিমারঘাটের গ্যাসের বাতি তাকে কেমন কুহকে ফেলে দিয়েছে। অথবা তিথিও তাকে কুহকে ফেলে দিতে পারে। সে কিছুটা অন্যমনস্কভাবে তিথির খোঁজে বাড়িটায় গিয়ে দেখলে হয় সে বাড়িতে আছে, না মেলায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারাটা দিন সে যে তিথিকে নিয়ে মেলায় ঘুরেছে, তার কেন যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিংবা সুপারিবাগানে ঢুকে সে তিথিকে নিয়ে মজে গিয়েছিল, তাও ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে। খুবই একা এবং নিঃসঙ্গ সে। মনে মনে সে তিথিকে নিয়ে কত কিছু ভাবে—তিথির জন্য এই আকুলতাই তার এই ঘোরে পড়ে যাওয়ার মূলে। তিথিকে টোপ হিসাবে কে ব্যবহার করতে চায়—যদি চায়ই, তিথি ইচ্ছে করেই তাকে আজ টোপ দিল কেন, কিংবা তিথির অন্তরালে কোনও দৈব যদি তাকে তাড়া করে থাকে। কোনও দৈব যে ছলনা করেনি কে বলবে! তিথি সেজে যদি হাজির হয়, সাধ্য কি সে তাকে অবহেলা করে।

নানারকমের সংশয়ে সে ভুগছিল এবং কখন কাছারিবাড়ি ফিরে ঘরের জানালায় চুপচাপ বসে আছে, টেরই পায়নি।

জানালায় কেউ যেন তখনই উঁকি দিয়ে গেল।

কে?

সে ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। ফ্রক গায় মেয়েটা তিথি না তুলি তাও বুঝতে পারছে না। সে কিছুটা বোকার মতো দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল। না কেউ না। তারপর ফের কাছারিঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জানালায় বসলে সে দেখল এবারে শাড়ি পরা কোনও নারী তার দিকে এগিয়ে আসছে।

সে আর পারল না।

সে চিৎকার করে ডাকল, কে ওখানটায়। কদম গাছের নিচে কে দাঁড়িয়ে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

অরণি ভালো করে চোখ কচলে দেখল, না কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। অরণির ভয় ভয় করছে। একবার ছুটে পড়ার ঘরে চলে গেলে হত। বাবার ফিরতে রাত হবে। অষ্টমী স্নানে বাবার একদণ্ড ফুরসত থাকে না। জমিদারবাবুদের সঙ্গে মেলায় ভলান্টিয়ার থেকে জলছত্রের সব ব্যবস্থাই তাকে দেখতে হয়। চিঁড়ে গুড় বাতাসার ব্যবস্থা করতে হয়। বেশি রাত হয়নি। স্টেশন মাস্টারের ঘরে বসে বাবা যদি পাশাখেলায় মত্ত হয়ে পড়েন—তবে ফিরতে অনেক রাত হবে। বাবা কোথায়, সে তাও জানে না। তবে বাবা আজ নাজিরখানায় যাননি, সারাদিন তাঁবুতে বসে ছিলেন—তারপর কোথায় সে জানে না। পাইক—বরকন্দাজদের কারও পাত্তা নেই। বাবুদের ছেলেরা হয় যাত্রা দেখতে গেছে। আজ যে ‘তরণী বধ’ পালা হবে তাও সে জানে। আট আনা অংশের জমিদার অম্বিকাবাবুর নাটমন্দিরে যাত্রাপালা দেখার জন্য বাড়ির ভেতরও কেউ থাকবে বলে মনে হয় না। স্কুল ছুটি, পড়া থেকে ছুটি, সামনে তার টেস্ট পরীক্ষা, অথচ সারাটা দিন তিথিকে নিয়ে ঘুরছে, কেবল মনে হচ্ছে, তিথি না, অন্য কেউ। কোনও দৈব তার সঙ্গে সারাদিন ছলনা করে গেছে। তিথি হয়তো তার সঙ্গে যায়ইনি।

সে বড়ই বিভ্রমে পড়ে যাচ্ছে।

কদম গাছের ছায়া কিংবা কলাতলায় কেউ যদি ফের আসে। আর আশ্চর্য তখনই মনে হল, ঘরে কে তবে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখল! তিথি মেলায়, তার সঙ্গেই তো তিথি ফিরছে। তিথিই ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখে—কখন তার ঘরে ঢুকে গেল মেয়েটা।

এতসব বিভ্রমে পড়েই সে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। এদিকটায় এত নিরিবিলি যে একদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভয় করছে। কে কখন তার সামনে ফ্রক কিংবা শাড়ি পরে হাজির হবে ঠিক কি। আসলে মাথাটাই কেমন গণ্ডগোল শুরু করে দিল।

আসলে সে সকাল থেকেই নিজের মধ্যে নেই। সে কুহকে পড়ে গেছে সকাল থেকেই।

তবু নিজের উপর চরম আস্থা বজায় রেখে সে কোনওরকমে কেয়াফুল গাছের নিচে ছুটে গেল। পড়ার ঘরে অন্ধকার। কারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ভেতর বাড়ির দিকের রাস্তায় ঢুকে বুঝল গোটা এলাকাটাই রহস্যময় হয়ে গেছে। কেবল বৈঠকখানায় একটি অতি মৃদু সেজবাতি জ্বলছে। সেখানে বাবার হুজুর নবকুমারবাবু বদরি হুঁকোয় চোখ বুজে তামাক সেবন করছেন। পাশে আরও একজন।

তিনি কে?

তাঁকে সে কখনও দেখেনি।

বয়স্ক মানুষ। গোঁফ আছে। পাকা গোঁফ। গলায় কণ্ঠি। ঘরে মৃদু সৌরভ তামাকের। লোকটার মুখ ধোঁয়ায় কিছুটা আচ্ছন্ন। তবে খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি বোঝাই যায়। পায়ে পাম্প সু। মোজা। সিল্কের পাঞ্জাবি গায়। হাতের আঙুলে হীরের আংটি—কারণ এই নিষ্প্রভ সেজবাতির আলোতে আঙুলের আংটি থেকে হীরের দ্যুতি উঠছে। কোনও কূট গভীর পরামর্শে তাঁরা দুজনেই যে মগ্ন ছিল, অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

তখনই স্তিমিত গম্ভীর গলা—কে দরজায় দাঁড়িয়ে।

অরু অর্থাৎ অরণি সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়াল। সে কোনও জবাব দিল না।

এ—সময় এদিকটায় বোধহয় তার আসা উচিত হয়নি। কারণ এতবড় প্রাসাদতুল্য বাড়িতে কোথায় কে আছে বোঝাও দায়। তুলির ঘর বন্ধ। রোয়াক থেকে সে উঠোনে নেমে যাবার সময়ই মনে হল বীণাপিসির দরজা হাট করে খোলা। ঘরের ভেতর হ্যাজাক বাতি জ্বলছে।

আর অবাক, সে দেখল, জেঠিমা—বীণাপিসি এবং আরও দু—একজন অপরিচিত মহিলা ফরাসের ওপর বসে আছেন। পানের বাটা থেকে পান তুলে মুখে দিচ্ছেন কেউ। বেশ হাসিমশকরা যে চলছে তাও বোঝা যায়। রান্নাবাড়ির দিকে সরে যাওয়ায়, তাকে কেউ দেখছে না।

তুলি কোথায়?

তা যাত্রাপালা দেখতে যেতে পারে।

প্রাসাদের সুন্দর বউমাটিও নেই। কিংবা থাকতে পারে, ভেতরের দিকে থাকতে পারে। সে তো ঘরের সবটা দেখতে পাচ্ছে না। বিশাল জানালাগুলি প্রায় দরজা সমান। খড়খড়ির পাল্লা। জানালা বন্ধ। খড়খড়ি তোলা আছে বলে, বাইরে আলো এসে পড়ছে।

কিছুটা যেন এই বাড়িতে গোপন গম্ভীর অবস্থা, যে—কেউ ইচ্ছে করলেই এদিকটায় ঢুকতে পারে না। বৃন্দাবনদাকেও দেখা যাচ্ছে না। রান্নাবাড়িতেও কেউ নেই। আজ রাতের খাওয়া কি হবে তাও সে বুঝতে পারছে না। শুধু দাওয়ায় হারিকেন জ্বলছে একটা।

সে পাঁচিলের দিকে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে আছে, কীসের এক রহস্য যেন তাকে তাড়া করছে। ‘টোপ’ কথাটা তার ভালো লাগেনি। কার টোপ, কীসের টোপ, পাঁচিল সংলগ্ন অন্দরের দরজায়, তার আড়ালে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, এমন ভাববার সময়ই সে দেখল, সুপারিবাগানের ভেতর থেকে একটা আলো এসে তার পায়ের কাছে পড়ছে। সে চোখ তুলতেই টের পেল, বাগানের ভেতর দিয়ে কেউ হারিকেন হাতে এগিয়ে আসছে।

এ—জায়গাটাও নিরাপদ নয়। আসলে কি সে তিথিকে খুঁজতে এদিকটায় চলে এসেছে!

তিথি রান্নাবাড়িতেই পড়ে থাকে। যদি তিথির দেখা পাওয়া যায়। দেখা হলে সে তার মনের সংশয় খুলে বলতে পারত।

তিথি তুই কি দৈব তাড়িত?

তিথি তুই সত্যি সারাদিন আমার সঙ্গে মেলায় ছিলি?

তিথি তুই নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়লি, মিসরি বাতাসা মন্দিরে দিলি, কিন্তু আমার যে কী হয়েছে, কেন যে মনে হচ্ছে সবই অলীক ঘটনা। কোনও ঘোরে পড়ে গেছি। তুই সত্যি করে বল তো…

কী বলব?

সত্যি করে বল তোর সঙ্গে আমার কিছু হয়েছে কি না!

কী হবে?

বারে তুই যে বললি, তুমি কী অরুদা, আমার কিছুই খুঁজে পাচ্ছ না।

তুমি আমার কী খুঁজছিলে?

আমি মুখ ফুটে বলতে পারব না। আমি কী খুঁজছিলাম, তুই জানিস না?

কী করে জানব, না বললে!

তারপরই অরণি ঘাবড়ে গেল।

কার সঙ্গে কথা বলছে! এ তো বাগানের ভেতর দিয়ে হারিকেন হাতে বৃন্দাবনদা পাঁচিলের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। কেমন একটা গোপন শলাপরামর্শ চলছে। কে কথা বলল, কার গলার স্বর? তিথির মতো অবিকল নকল করে কে কথা বলল!

সে দরজায় আড়াল থেকে পা টিপে টিপে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখল, বৃন্দাবনদা হারিকেন রোয়াকে রেখে করজোড়ে প্রণিপাত সারছে। তারপর যা বলল, তাতে অরণির হৃৎকম্প উপস্থিত হবার জোগাড়।

ধরে এনেছে হুজুর। সাজানো হচ্ছে। কোথায় যে থাকে। একটু চঞ্চল স্বভাবের। সাজিয়ে দিচ্ছে বউমা। গোরাচাঁদ আমাকে পাঠাল। দোষ নেবেন না। ছেলেমানুষ, বুদ্ধিসুদ্ধি পরিপক্ব নয়।

অরণি আড়াল থেকেই টের পেল এই যে আর্জি পেশ সবই ধনাঢ্য ব্যক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে।

নবকুমারবাবু বললেন, তা ঠিক, ঐ সেদিন হল মেয়েটা। থাকার জায়গা নেই, বাগানের এক কোণায় ঘর তুলে নিতে বললাম। এখন পালমশাই আপনার দয়ার শরীর। কন্যেটিকে উদ্ধার করে নিলে, গোরাচাঁদের বড়ই কল্যাণ হয়।

বৃন্দাবনদাই বললেন, যা হোক শেষ পর্যন্ত হুজুর রাজি করানো গেছে। গোরাচাঁদ তো হুজুর কেঁদেই ফেলল। এতবড় সুযোগ হাতের কাছে, তুই অবহেলায় নষ্ট করবি। আমাদের পাকাবাড়ি হবে, বাজারে মুদির দোকান করে দেবে, সংসারে এতবড় সুখের খবর, তুই রাজি হয়ে যা।

নবকুমারবাবু গড়গড়া থেকে মুখ তুলে বললেন, মেয়েটি বড়ই শান্ত প্রকৃতির। বয়সকালে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী হবার সম্ভাবনা আছে। গোরাচাঁদের মেয়েটিকে আপনার যখন দেখার সাধ হয়েছে তখন দেখে যাওয়াই ভালো। মেয়েটি সাক্ষাৎ দেবী দুর্গা।

অরণি দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে, শুনতেও পাচ্ছে সব। নদীর পাড়ে বাড়ি বলে নির্জনতা সামান্য বেশিমাত্রায়, সে কান খাড়া করে শুনছে।

অস্পষ্ট আলোতে লোকটার মুখ মাঝে মাঝে কেন যে বাঘের মতো হয়ে যাচ্ছে। অথবা শিকার ধরার লোভে চোখ চক চক করছে। হাই তুলছে, কথাও বলছে, আজ্ঞে বাবুমশাই, মহেশই বছরখানেক আগে খবরটা দিয়েছে, বাড়ছে, দেবী দুর্গার শরীর পুষ্ট হচ্ছে। সেই খবর রাখত, কখনও নদীর জলে সাঁতার কাটছে, কখনও ছুটছে নদীর চর পার হয়ে, চুল উড়ছে। সে যা দেখত, বন্দরের ঘাটে নেমে গদিতে হুবহু বর্ণনা দিত। শুনতে শুনতে কেমন আমার আবেগ সৃষ্টি হয়ে গেল। দুই পত্নীর পরামর্শ নিতে হয়। পুত্রসন্তান না থাকলে মরেও যে শান্তি পাবে না তারা। তারা রাজি হয়ে গেল। বাড়িঘরের সৌন্দর্য রক্ষার্থেই মহাঅষ্টমী স্নানে আসা—একবার দেখেও যাওয়া। এমনকি পাখনাওয়ালা কন্যা যে ফুরুত করে হাত থেকে উড়ে যাবে।

অরণি বুঝল, আসলে লোকটা টাকার গরমে সেদ্ধ হচ্ছে। তিথির মতো অনাথ বালিকার পক্ষে উড়ে যাওয়া যে কিছুতেই সম্ভব না, ‘ফুরুত করে উড়ে যাবে’ কথাটাতে সে আরও বেশি টের পেল।

অরণি এখন যে কী করে!

তার অবশ্য করবারও কিছু নেই।

সে রেগেমেগে নদীর পাড়ে গিয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। অথবা দৌড়ে গিয়ে সে তার বাবাকে খবর দিতে পারে। মহেশ তিথিকে কচলাত, বাবা খবরটা শোনার পরই ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং দেশ ছাড়া করেছিলেন।

বাবা খবর পেলে ছুটে চলে আসতে পারেন, গোরাকাকাকে ধমকও দিতে পারেন, তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! এতটুকুন মেয়েটাকে টাকার লোভে একটা পিচাশের হাতে তুলে দিচ্ছিস! টাকার পিচাশ! টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। বয়সের গাছ পাথর নেই, তুই কী রে! দু—দিন বাদে যমের দুয়ারে দৌড়বে, তোর এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান নেই গোরা!

আর তখনই কেন যে নদীর পাড়ে চিৎ হয়ে তিথির পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা অরণির চোখে ভেসে উঠল। মেয়েটার সেই অসহায় মুখ এবং ক্ষোভ দুই—ই তাকে যেন তাড়া করছে।—কেন আমার সব দেখে ফেললে, কেন! সব দেখে ফেলার পরও উষ্ণতায় জড়িয়ে ধরার সময় কিছুই খুঁজে পাও না কেন? বলো! বলো!

তিথি তুই কোথায়! আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি না। তোর কথা শুনতে পাচ্ছি। সে তার চারপাশে তিথিকে খুঁজছে। কেউ নেই। চারপাশে শুধু ম্রিয়মাণ জ্যোৎস্না।

এখন তার একটাই কাজ, বাবাকে দৌড়ে গিয়ে খবরটা দেওয়া।

অরণির মনে হল বাবাকে গিয়ে খবরটা দিতে পারলে তিনি ছুটে আসতে পারেন।—আবার মহেশের কবজায় পড়ে গেল মেয়েটা! তুই কী রে, ধম্ম অধম্ম নেই! কচি মেয়েটার পেছনে সেই থেকে লেগে আছিস। অনাথ বলে কি ফ্যালনা! যার যা খুশি তাকে নিয়ে যেভাবে খুশি ফুর্তি করবে। বের করছি ফুর্তি করা। বাবা এলেই মহেশের জারিজুরি যেন ভেস্তে যাবে।

সে এই ভেবে প্রাসাদের অন্দরমহল পাড় হয়ে দিঘির পার ধরে ছুটবে ভাবল। সেই সব পেয়ারা গাছ, লিচু গাছের বাগান পার হয়ে নদীর পাড়ে চলে যাবে ভাবল—এক্ষুনি খবরটা না দিতে পারলে তিথির সমূহ সর্বনাশ।

সে তখনই দেখল তিথিদের বাড়ি থেকে কারা বের হয়ে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে সে ঝুপ করে বসে পড়ল। শুধু জঙ্গলের ফাঁকে মাথাটা বের করে রেখেছে।

আগে গোরাকাকা—হাতে প্যাট্রোম্যাক্স।

আলোয় আলোয় ভরে গেছে তিথিদের বাড়িঘর—সুপারিবাগান।

এই কী দেখছে!

ঐ তো বাবা।

বাবা তিথিকে যেন জোর করে ধরে নিয়ে আসছেন। প্যাট্রোম্যাক্সের আলোয় দেবীর মুখ ঝলমল করছে। বেনারসি শাড়ি পরনে, তিথির হাতে বালা, কঙ্কন, কোমরে সোনার বিছেহার, তিথির শাড়ির কুঁচিতে সোনার ঝলমলে লেসের কারুকাজ, মাথায় টায়রা, চোখ বিস্ফারিত, তিথি যেন হাঁটতে পারছে না, শাড়ি আর অলঙ্কারের ভারে জবুথবু হয়ে গেছে। যেন যে—কোনও মুহূর্তে শাড়ির প্যাঁচে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে।

আর তার পাশেই তুলি। বোধহয় পড়ে গেলে তুলে ধরবে। তুলির শরীরে ভর করে তিথি যেন কোনওরকমে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই বুড়ো লোকটার কাছে যাবে, কিংবা নদীতে বজরা ভেসে আছে, সেখানে তুলে নিয়ে যেতে পারে—কী যে হবে, সে কিছুই জানে না।

তিথি জমিদারবাবুদের এঁটো খেয়ে বড় হয়েছে, তার পক্ষে বেশি আশাও করা বোধ হয় ঠিক না, তাকে যেভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে তিথির বলারও কিছু থাকতে পারে না। তাকে একবার দেখবেন সেই গোপীবল্লভ না কি যেন, শীর্ষ পালও হতে পারে—তার মাথা ঠিক নেই, সে ঠিক মনে করতে পারে না। মহেশ নৌকায় তুলে নিতে চেয়েছিল তিথিকে, বড়ই মহাজন ব্যক্তি মানুষটি বজরায় শুয়ে আছেন, আরাম করছেন, তিথিকে নিয়ে যেতে পারলে তিনি দেখে খুবই খুশি হবেন—এমন সব কথাবার্তা মেলাতে তিথিকে বোধ হয় বলেইছিল—তিথি লোকটাকে একদম পাত্তা দেয়নি। নৌকার পর নৌকা লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেছে। সে তো দেখতেই পাচ্ছে, তিথিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বাবুদের বৈঠকখানায়। অনাথ মেয়েটির এত হেনস্থা। কেউ টের পাচ্ছে না। বাবাও না। মহেশ কচলাত বলে, তাকে দেশান্তরী করতে চেয়েছিলেন, এখন এই কালভৈরবের হাত থেকে কে উদ্ধার করবে তাকে?

কেন তুমি?

কে?

বারে দেখতে পাচ্ছ না আমি তিথি। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, আমার দাসদাসীর অভাব থাকবে না জানো, সোনার অলঙ্কারে আমাকে মুড়ে দেওয়া হয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না—পছন্দ হলেই বজরায় নিয়ে তোলা হবে।

তিথি তুই কোথা থেকে কথা বলছিস?

কেন এই যে দূরে, আমি যাচ্ছি, গাছপালা ভেদ করে আমাকে নিয়ে তোলা হচ্ছে বাবুদের বৈঠকখানায়, নদীর পাড়, কাশবন, জলের ঢেউ, চড়ায় পাখিদের ওড়াউড়ি থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্ধকার প্রেতপুরীতে, তুমি অরুদা কিছুই বুঝতে পারছ না।

হঠাৎ কেউ ইচ্ছে করলেই তুলে নিয়ে যেতে পারে?

বারে আমার কর্তাটির যে ইচ্ছে হয়েছে, আমাকে চিবোবে।

তিথি আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

আর বুঝতে হবেও না।

আমি তোকে নিয়ে কোথাও চলে যাব।

কোথায়?

যেখানে বলবি।

তবে গেলে না কেন? ঘোর উজানে তোমাকে নিয়ে সাঁতার কাটব বলে বের হলাম, নদীর জলে টেনে নামাতে চাইলাম, তুমি তো কিছুতেই রাজি হলে না। আমাকে ফেলে কতবার নদী থেকে উঠে এসেছ, মনে নেই। এখন যত কষ্টের কথা তোমার মনে পড়ছে। আমি মরে গেলে রক্ষা পাও তোমরা, আমি বুঝি না।

তিথি তুই চুপ করবি!

চুপ করব কেন? আমি তোমার খাই না পরি।

প্যাট্রোম্যাক্সের আলো, লোকজন, তিথি, বাবুদের অন্দরমহলে কখন ঢুকে গেছে! সে একাই দাঁড়িয়ে আছে ঝোপের আড়ালে। এতক্ষণ তিথির সঙ্গে কথাও বলেছে। সে আর তিথি, তিথি এত কাছ থেকে কথা বলে, অথচ সে তাকে দেখতে পায় না কেন? তিথি বলে, না সে নিজেই তিথির হয়ে কথা বলে।

এই প্রবাসে তিথি ছাড়া সেও যে বড় অনাথ।

ঝোপজঙ্গলে জোনাকি উড়ছে। ভাদ্রমাসের আকাশ—সব নক্ষত্র আকাশে যেন ফুটে আছে। নীল এবং সবুজের সমারোহে সে ডুবে যাচ্ছিল। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। কাছারিবাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। খুব গোপনে কাজটা হচ্ছে, তিথিকে দেখানো হচ্ছে, তিথির বাবা অকুল পাথারে পড়ে আছে—তিথিকে পালমশাই—এর হাতে তুলে দিতে পারলেই পাকাবাড়ি, বাজারে পাকা বন্দোবস্ত এমন সব সুযোগ কে হাতছাড়া করে!

সবার উপরই সে ক্ষুব্ধ।

বাবার উপরও।

কেউ মানুষ না।

তিথির দুঃখ কেউ বুঝল না।

ভাবতে ভাবতে কখন সে স্টিমারঘাটে চলে এসেছে। একা দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভয়ও করছে। নদীতে সারি সারি নৌকা। লণ্ঠন জ্বলছে। কোনও নৌকায় রান্না হচ্ছে। তিথি পাশে থাকলে তার কোনও ভয় থাকত না। সে ঠিক নৌকায় উঠে পড়তে পারত। এবং টালমাটাল নৌকায় তিথিকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারত।

তার কিছুই ভালো লাগছে না।

আজ দিনটাই তার খারাপ।

সে কিছু করতেও পারে না। তবে তিথি এত সহজে ধরা দেবে, কেন যে তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

এই ভেবেই মনে সাহস সঞ্চয় করে ফেলল অরণি। শরীরও আর দিচ্ছে না। সাহস সঞ্চয় হতেই টের পেল, সে খুবই ক্লান্ত। খিদেও পেয়েছে। রান্নাবাড়িতে খাওয়ার আজ কোনও বন্দোবস্ত হয়নি। কোথায় খাবে, কী খাবে, তাও সে জানে না। অষ্টমী স্নান উপলক্ষে উপবাসের নিয়ম যদি থাকে—তাই বা কী করে হবে, তা হলে সারাদিন না খেয়ে থাকা যে বড় কষ্টের।

এইসব সাত—পাঁচ ভাবতে ভাবতে, নদীর পাড় থেকে চালতে গাছের জঙ্গল পার হয়ে কাছারিবাড়ির মাঠে ঢুকে গেল। মাঠে কেউ নেই—দূরে বাবুদের প্রাসাদে ঢোকার মুখে হাসনুহানার জঙ্গলে কেউ হারিকেন নিয়ে ভেতর বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে।

সে কোনওরকমে শরীর টানতে টানতে কাছারিবাড়ির দরজায় উঠে গেল। ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। আর অবাক মেঝেতে আসন পেতে কেউ তার ভাত ডাল তরকারি মাছ ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে একটা বগি থালায়।

থালা তুলে তো সে আরও অবাক। দই মাছ মিষ্টি সহ কিছুটা পলান্ন এবং সাদা ভাত। পলান্নের সুবাসে তার জিভে জল এসে গেল।

ক্লান্ত অবসন্ন, তার কেমন চোখ বুজে আসছে। তার হাত মুখ ধোওয়া দরকার। বালতি ভর্তি জল রেখে গেছে কেউ। সে চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে কেমন এক ঘোরের মধ্যে খেতে বসে গেল। এবং লণ্ঠন জ্বলছে সামনে। টিনের চালে গাছের ডাল নড়ানড়ি করছে বাতাসে।

খস খস শব্দ, এবং এই শব্দমালায় সে আগে বড়ই ভয় পেত, এখনও এইসব শব্দমালা উচ্ছ্বল না হয়ে উঠলেই তার কেমন সব মৃতবৎ মনে হয়। কেমন স্থবির মনে হয় চরাচর। সে একা এই কাছারিবাড়িতে থাকতে থাকতে খুবই অভ্যস্ত হয়ে ওঠায়, সে সহজেই দরজার বাইরে গিয়ে কীটপতঙ্গের আওয়াজ শুনতে ভালোবাসে। পাখির কলরব, নদীর জলে ছলাত ছলাত শব্দে তার কখনও মনেই হয় না সে কাছারিবাড়িতে একা আছে। আম জাম গাছের ছায়াও তার বড় অবলম্বন। রাতের অন্ধকারে দূরের মাঠে শেয়ালেরা ডেকে গেলেও সে ভাবে, সে আর একা নয়। সবাই আছে তার আশেপাশে। মানুষই শুধু মানুষের নির্ভর এটা তার তখন আর মনে হয় না।

সে খাচ্ছিল।

আর কেমন সুস্বাদু খাবার তার জিভে স্বাদের রহস্য সৃষ্টি করতে করতে, টিনে ডালপালার শব্দ শুনতে শুনতে আবার কেন যে মনে হচ্ছে তিথি কথা বলছে।

শুনছ?

কী শুনব?

বারে আগের জন্মে জানো আমি নদীতে ডুবে থাকতাম। ভেসে উঠতাম।

কেন ডুবে থাকতিস?

বারে আগের জন্মে আমি শুশুক মাছ ছিলাম। ভেসে উঠতাম।

যা, বাজে কথা।

তুমি কিছুই জানো না? ভরা কোটালে নদীর পাড়ে এলেই তারা আমায় ডাকে।

কে ডাকে?

বারে নদীর গর্ভে তারা যে উঠে আসে।

বাজে কথা।

তুমি আমার কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। কিছুই তুমি আর আমার শরীরে খুঁজে পাও না। তুমি জানোই না কেন তুমি আমার শরীরে আঁশটে গন্ধ পাচ্ছিলে!

আঁশটে গন্ধ কোথায়? বাজে কথা? পদ্মপাতার গন্ধ পাচ্ছিলাম।

তুমি তো নিজের মধ্যে নেই অরুদা। কিছুই তুমি মনে করতে পারছ না। শরীরে আমার শ্যাওলার গন্ধ, তারপর পদ্মপাতার গন্ধ—শেষে আঁশটে গন্ধ। আমি তো ভেসে উঠেছিলাম, শ্যাওলার জঙ্গল ফুঁড়ে, পদ্মপাতার নিচে ডুব দিলাম। শরীরে পদ্মপাতার গন্ধ পেলে। আরও ভেসে উঠলে আঁশটে গন্ধ। তুমি কেমন ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলে—অথচ শরীরে কিছুই খুঁজে পেলে না। মাছের শরীরে মানুষ কী করে খুঁজে পাবে সব।

তা ঠিক। তুই মাছ হয়ে গেছিলি।

শুশুক মাছ। নদীর জলে ভেসে যেতে চাইলাম, নড়লে না, দাঁড়িয়ে থাকলে। আমি যে তোমাকে নদীর জলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। নদীতে ডুবে ডুবে আমরা শুশুক মাছ হয়ে গেলে কেউ আর আমাদের খুঁজেই পেত না। আমার সঙ্গে চলো না?

কোথায়?

কেন নদীতে?

কী হবে গিয়ে?

দুজনে মাছ হয়ে থাকব।

যা, তুই একটা পাগল।

আমি পাগল, না তুমি পাগল! জলের নীচে শুশুক মাছ হয়ে থাকলে কত সুবিধে বলো তো!

কীসের সুবিধে!

তুমি যাবে কি না বলো। কেউ টের পাবে না। বলেই তিথি তার শরীর থেকে সব সায়া শাড়ি সেমিজ খুলে ফেলতে থাকল, তারপর নদীর চরে ছুটতে থাকল।

সেও নেমে গেছে তিথির পিছু পিছু।

সব চরাচর একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে। নীল জল এবং জলরাশি খেলা করে বেড়াচ্ছে চারপাশে। ঢেউ উঠছে। তারা দুজনেই হেঁটে হেঁটে পার হয়ে গেল নদী।

তারপরই এক বিশাল বালির চর সামনে। কেমন এক অন্য গ্রহে তাকে নিয়ে তিথি উঠে এসেছে।

ঐ যে দেখছ?

তিথি তুই আমাকে কী দেখাচ্ছিস?

ঐ যে দেখছ, নদীর চড়ায় একটা স্টিমার আটকে আছে। ওটাই আশরাফ সারেঙের স্টিমার। কবে কোন কালে নদীর গর্ভে ডুবে গিয়ে বালির চড়ায় ভেসে উঠেছে।

তিথি তাকে কোথায় নিয়ে এল! কিছুই সে চিনতে পারছে না। কেমন তেপান্তরের মাঠে নেমে আসার মতো এবং সে যেদিকে তাকাচ্ছে, সর্বত্রই সে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। একটা বজরা দেখতে পেল। বজরটা বালির চড়ায় প্রায় সবটাই ডুবে আছে। জেগে আছে শুধু তার মাস্তুল আর গলুইর দিকটার একটা ঘর। এভাবে ভাঙা—জাহাজের কবরখানায় সে কী করে যে এসে হাজির হল বুঝতে পারছে না।

তিথিও পাশে নেই।

কোথায় গেল।

এক অতি অবধারিত লীলা দেখতে পেল তিথির। অথচ তিথি নেই।

তিথি তখনই উড়ে উড়ে হাজির।

অরুদা।

কোথায় থাকিস।

আমার সঙ্গে এসো। আশরাফ সারেঙের ঘরটা খুঁজে পেয়েছি। ঐ যে স্টিমারটা দেখছ, বালিতে ডুবে আছে, ঐ যে ডেক ছাদের ঘরটা দেখছ, ওখানটায় আশরাফ সারেঙ থাকতেন। ওর লুঙ্গি, ফতুয়া, দড়িতে ঝুলছে। একটা জানালাও আছে। চলো না, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?

ওরা দু’জনই এখন উড়ে যেতে পারছে। শরীর এত হালকা হয় বাতাসে উড়ে গিয়ে এই প্রথম টের পেল অরণি। তিথি পাশে থাকায় এটা হয়েছে। তিথির শরীরে তো কিছুই নেই। সে হালকা হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু তার শরীরে জামা এবং প্যান্ট—জামাপ্যান্টে হাওয়া এসে ঢুকলেই বিপদ। জামাপ্যান্ট হাওয়ায় পত পত করে ওড়ে অথবা জামার মধ্যে হাওয়া আটকে গিয়ে নৌকার পালের মতো ফুলে ওঠে—তখন সে অবশ্য অনায়াসে হালকা হয়ে গিয়ে দূরের নক্ষত্রও ছুঁয়ে আসতে পারে, তার শরীরে জামাপ্যান্ট থাকায় কোনও অসুবিধাই হচ্ছিল না।

তখনই বালির চরে জেগে থাকা একটা ডেক ছাদের ঘরে তিথি ঝুপ করে নেমে পড়ল।

এই অরুদা কোথায় যাচ্ছ আমাকে ফেলে—

সে যেন কত শত কোটি বছর আগেকার এক ছোট্ট গ্রহাণু—তার নিজস্ব কোনও বেগ আর গতি নেই—সে এক মহাশূন্যে অখণ্ড হয়ে আছে, তিথি ডেক ছাদে দাঁড়িয়ে। আশরাফ সারেঙের একটা ভাঙা সানকি হাতে সে অপেক্ষা করছে তার অরুদা যেখানেই যাক, তার কাছে আবার ফিরে আসবে।

তখনই তাকে কে যেন ঝাঁকাচ্ছে। ডাকছে, এই অরু ওঠ। খাবি না। কত রাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়লি!

আমি খাইনি!

না খাওনি।

বাবা তিথি কোথায়?

ওকে মহাজন বজরায় তুলে নিয়ে গেছে।

আমি খাব না।

খাবি না কেন?

আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছে না। এই তো কিছুক্ষণ আগে খেলাম। তারপর…

তারপর কী!

আমি আর কিছু জানি না।

মেলায় খেয়েছিস।

অরণি চুপ করে থাকল।

অরণি এই প্রথম তিথিকে স্বপ্নে দেখেছে। সত্যি দেখেছে। কিন্তু তিথিকে তার স্বপ্নের কথা আর কখনোই বলা হবে না। তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গিয়েছে গোপীবল্লভ পাল। তিথি আর কখনোই নদীর গভীর জলায় শুশুক মাছ হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *