দশটা বছর কেটে গেছে
০৪.
তারপর দশটা বছর কেটে গেছে।
নারানের এখন আর পাকাপোক্ত নাইটি ডিউটি নেই। নাইট ডিউটি করলে একটাকা পাওয়া যাবে, এই নৈশ ভাতা চালু হতেই দাবি ওঠে, নারান একাই কেন ডিউটি করবে? সবাই যাতে ভাতার টাকা পায় সেজন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্য বেয়ারাদেরও এই সুযোগ দিতে হবে। এর ফলে নারানকে টানা আট বছর নাইট ডিউটি করার পর সকালের বা বিকেলের ডিউটি শুরু করতে হল, আর সেই জন্য
কাগজ বিলি করার কাজটা তাকে ছাড়তে হয়।
ইতিমধ্যে সংসারে মানুষও বেড়েছে। এখন তার এক মেয়ে নয়ন আর চার ছেলে—অবনী, নবনী, রজনী এবং গৌতম। নয়নের বয়স একুশ, অবুর তেরো, নবুর নয়, রাজুর সাত আর গৌতমের এক বছর। ঘরও একটা বাড়িয়েছে। মাটির দেয়ালে টালির ছাদ। গোরু বিক্রি করে গোয়ালটা ভেঙে দিয়েছে। নয়ন ক্লাস সেভেন পর্যন্ত স্কুলে পড়ার পর, সংসারের আর ভাইদের দেখাশোনার জন্য স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কেননা মহামায়া তখন উলটোডাঙায় একটা কাঠের খেলনা তৈরির কারখানায় কাজ পেয়েছিল। হপ্তায় আঠারো টাকা মাইনে। মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য মহামায়া টাকা জমাতে শুরু করেছে। সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাত আটটায় ফিরত। অবুর টাইফয়েড হওয়ায় সে কাজটা ছেড়ে দিয়ে ঠোঙা তৈরিতে সময়টা দেয়।
এই দশ বছরে নারানের শারীরিক কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। একই রকম ছিপছিপে রয়েছে, চোদ্দো বছর আগে চাকরিতে ঢোকার সময় যেমনটি ছিল, শরীরে বাড়তি মেদ নেই, চুল একটিও পাকেনি, বয়স ছেচল্লিশ। রাতে স্বামী-স্ত্রী, নয়ন আর অবু, পুরো পরিবারই, ঠোঙা তৈরি করতে বসত। রাত দেড়টা পর্যন্ত তারা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা কাজ করত। ঠোঙা বিক্রি করত একটাকায় বারো দিস্তা।
অফিসে তার কাজের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। তবে রবিবাবু রিটায়ার করেছেন। নতুন দুজন খেলার বিভাগে এসেছেন, শ্যামল কুণ্ডু আর শৈলেন রায়। ওরা অল্পবয়সি, তাকে নারানদা বলে ডাকে। মাণ্টাবাবু টোলুবাবু, অনাদিবাবু একই রকম আছেন, শুধু চুল পাতলা হয়েছে, মুখের চামড়া আলগা হয়েছে, আর প্রত্যেকেই সামান্য মোটা হয়েছেন।
গত দশ বছরে নারানের জীবনে শুধু একটিই ঘটনা ঘটেছে, যেটা তার জীবনে একটা বড় ব্যাপার। ছয় বছর আগে, অফিসের বাৎসরিক স্পোর্টস দেখতে যাওয়া।
ময়দানে তালতলা মাঠে হত অফিসের স্পোর্টস। নারান শুনেছে, নানান বিভাগের নানান বয়সিরা এতে অংশ নেয়। বেয়ারাদের মধ্যে শুধু অনিল আর দিকপতি এতে নামে— তিনপায়ের দৌড়ে আর আধ মাইল ভ্রমণে। কর্মচারীদের ছেলেমেয়ে, বউদের জন্যও ইভেন্ট আছে।
তখন সবে নৈশ ভাতা চালু হয়ে নারানের নাইট ডিউটি বন্ধ হয়েছে। সেদিন রবিবার, ডিউটি ছিল সকাল দশটা-পাঁচটা। নারান স্পোটর্স দেখতে অফিস থেকে মাঠে চলে যায় দুপুরে। মাল্টাবাবু স্পোর্টস সংগঠনের দায়িত্বে। এন্ট্রি নেওয়া থেকে শুরু করে, ইভেন্টের সূচী তৈরি করা, সভাপতি নির্বাচন থেকে প্রাইজ কেনাকাটার দায়িত্বটাও তাঁর।
শামিয়ানার নীচে বড় একটা টেবলে প্রাইজগুলো সাজানো। দেখেই নারানের মনে পড়ে গেল তার স্কুলের স্পোর্টসের কথা। ছোট ছোট কাপ আর মেডেলে সাজানো টেবলটা যেন দোকানের মতো হয়ে উঠত। দেখলেই লোভ হত, বাড়িতে এসে আলমারিতে সাজাবার। প্রতি বছর দু-তিনটে কাপ বা মেডেল সে জিতত। ক্লাস টেনে পড়ার সময় গো-অ্যাজ-ইউ-লাইকে জেতা কাপটাই ছিল তার জীবনের সব থেকে বড় কাপ। প্রায় এক হাত লম্বা। প্রথম প্রথম সে কাপ-মেডেলগুলো নিয়মিত ঝেড়েমুছে ঝকঝকে করে রাখত। তারপর আর যত্ন করত না। এক সময় রং চটে গিয়ে হলুদ হয়ে গেল। দেশভাগের পর, চলে আসার সময় ওগুলো ফেলে রেখে আসে।
এখন তালতলা মাঠে দাঁড়িয়ে প্রাইজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনের মধ্যে ছাত্রজীবনের চাঞ্চল্য জাগল। প্রাইজ জেতার ইচ্ছেটা আবার নতুন করে তাকে পেয়ে বসল। তবে অফিসের স্পোর্টসে কাপ-মেডেলের থেকে নিত্য ব্যবহারের জিনিসই বেশি। তা হোক, কাপ-মেডেল সাজাবার মতো কাচের আলমারি তার ঘরে নেই, বরং সংসারের প্রয়োজনে লাগার জিনিসই দরকার।
রিটায়ার করে গেলেও রবিবাবু স্পোর্টসের দিন মাঠে আসেন। শামিয়ানার ছায়ায় একটা চেয়ারে বসে অফিসের অ্যাকাউন্টস বিভাগের দুজন প্রবীণ লোকের সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন। নারান তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
কী রে নারান, আছিস কেমন? তুই তো একটুও বদলাসনি দেখছি।…পরিশ্রম করাটা তা হলে চালিয়ে যাচ্ছিস?
কাগজ তো আর বেচি না, তাই খাটুনিটা কমে গেছে। নারান চিন্তিত স্বরে বলল, তাই ভাবলাম একটু দৌড়োদৌড়ি করা দরকার। আপনি একটু মাণ্টাবাবুকে বলে দেবেন?
কেন, কী জন্য?
ভাবছিলাম স্পোর্টসে নামব।
ভাল কথা। নাম। কোন ইভেন্টে, নামছিস?
এখন আর কী করে নামি। পরশু দিনই তো এন্ট্রি নেওয়ার লাস্ট ডে ছিল।
আরে এটা ওলিম্পিক না এশিয়ান গেমস যে দেরিতে নাম দেওয়া যাবে না? ডাক মান্টাকে…এই যে অ্যাই, মাল্টা, এদিকে আয়।
হাতে কাগজপত্র নিয়ে মাল্টাবাবু তখন মাঠের মাঝ থেকে ফিরছিলেন, রবিবাবুর ডাক শুনে এগিয়ে এলেন।
আর কী কী ইভেন্ট বাকি রয়েছে?
অনেক বাকি আছে। ছোটদের পুন রেস, সেলাই রেস, জিলিপি রেস, মহিলাদের ব্যালান্স রেস, ফিফটি মিটার, মিউজিক্যাল…।
থাক থাক, তুই তো ধ্যারারারা রেকারিং ডেসিমিল চালিয়ে দিলি দেখছি। বড়দের কী কী বাকি?
এইট হানড্রেড, ফোর হান্ড্রেড, টু হান্ড্রেড, স্যাক রেস, ওয়াকিং, থ্রিলেগেড রেস, টাগ অব ওয়ার।
নারানের নামটা নিয়ে নে। ও নামবে।
সে কী! এই লাস্ট মোমেন্টে। আচ্ছা নারান, তুই তো কালকেও আমাকে বলতে পারতিস! মাণ্টাবাবু বিরক্ত হয়ে হাতের কাগজ উলটে-পালটে দেখলেন। একশো মিটার তো এইমাত্র হয়ে গেল, আচ্ছা তা হলে স্যাক রেস আর ওয়াকিংয়ে দিয়ে দিচ্ছি।
না না না। নারান প্রায় আঁতকে উঠল। থলের মধ্যে ঢুকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আমি যেতে পারব না। ওসব বাচ্চাদেরই সাজে।
তা হলে ওয়াকিংয়ে নাম।
না মান্টাবাবু, হাঁটাহাঁটি বুড়োদের মানায়।
তুই কি ছোকরা নাকি যে, হাঁটবি না শুধু দৌড়বি? মাণ্টাবাবু তির্যক স্বরে বলেন।
আমাকে বরং দৌড়ের ইভেন্টগুলোতে দিন।
দৌড়ের। হাতের কাগজ দেখে চিন্তিতভাবে মাণ্টাবাবু বললেন, তা হলে দুশো মিটারে…পারবি তো?
আমাকে তিনটেতেই দিন…আটশো, চারশো আর দুশো মিটারে।
কী বললি! তিনটেতে? তুই কি জ্যাটোপেক হয়ে গেছিস ভাবছিস?
নারান মাথা চুলকে বলল, একবার চেষ্টা করে দেখিই না।
তোর বয়স কত সেটা একবার ভেবে দেখেছিস? পর পর তিনটে রেস!
তিনটে রেস জুড়লে কত হবে? নারান মনে মনে যোগ দিয়ে বলল, চোদ্দো শো মিটার। এক মাইলটাক হবে, না তারও বেশি?
এক মাইলের একটু কম। না না, অত তুই পারবি না। দৌড়বার অভ্যেস নেই, শেষকালে…
মাণ্টা ওকে নামতে দাও। রবিবাবু এতক্ষণ ওদের কথা শুনে যাচ্ছিলেন, এইবার মুখ খুললেন। নারান এক সময় রোজ পঁচিশ-তিরিশ মাইল সাইকেল চালাত। ওর কলজে আর মা তৈরি আছে। নামিয়ে দ্যাখোই না!
নামাচ্ছি, কিন্তু কিছু হয়ে গেলে আপনি দায়ি হবেন। মাণ্টাবাবু ব্যাজারমুখে আবার মাঠের ভিতর চলে গেলেন।
কী রে নারান, তোর জ্যাটোপেক হবার শখটা এবার মিটিয়ে নে। পারবি তো?
রবিবাবু, আমি সাত জীবনেও জ্যাটোকে হতে পারব না। উনি যে কাণ্ড করেছেন, পৃথিবীর সব থেকে বড় জায়গা ওলিম্পিকে করেছেন! কত বড় বড় পাল্লার কম্পিটিশন ছিল সেগুলো! আর তালতলা মাঠে আমি? তুলনা হয়? নারান হেসে ফেলল। তবে একটা মিল ওঁর সঙ্গে আমার আছে, আমাদের জন্ম একই তারিখে।
তা হলেই হবে। রবিবাবু ঠাট্টার সুরে বললেন। কাগজ বিলি আর নাইটি ডিউটি করে তুই যা পরিশ্রম করেছিস আমার তো মনে হয় না জ্যাটোপেক প্র্যাকটিসে অত পরিশ্রম করেছে। ঘাবড়ানি, দুগ্না বলে নেমে পড়।
নারান নেমে পড়ল, হাঁটু পর্যন্ত ধুতিটা তুলে কোমরে গুঁজে নিয়ে। প্রথমে চারশো মিটার দৌড়। দুশো মিটারের ট্র্যাক। দুপাক দৌড়তে হবে। তাকে নিয়ে ছজন প্রতিযোগী। স্টাটিং লাইনে মেশিন বিভাগের একজন আর সার্কুলেশন বিভাগের একজনকে দেখে নারানের মনে হল ওরা তার অর্ধেক বয়সি। এই দুজনকেই নজরে রাখতে হবে। এরা একেবারেই তার অজানা। বাকি তিনজনের মধ্যে রয়েছে দরোয়ান রামভরণ, পিওন রাধেশ্যাম আর রিপোর্টার মণিবাবু। এরাও তার থেকে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট। এরা যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এটা সে আন্দাজ করে নিল তাদের পেটের পরিধি থেকে।
স্টার্টার টোলুবাবু। নারানকে দেখে তো তিনি অবাক। এত বছর অফিসে স্পোর্টস হচ্ছে, অথচ স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে এই প্রথম তুই চারশো মিটারে নামলি।
আমি তো বেয়ারা ডিপার্টমেন্ট থেকে নেমেছি!
রাখ তোর বেয়ারা ডিপার্টমেন্ট। তুই আমাদের ডিপার্টমেন্টের লোক। যদি জিততে পারিস, তা হলে… টোলুবাবু তিন সেকেন্ডের জন্য থমকালেন আর সেই ফাঁকে নারান বলল, ডুরান্ড ফাইনালে উঠে মোহনবাগান হারাবে ইস্টবেঙ্গলকে, তাই তো?
তোর ওই এক কথা, আগে ওরা উঠুক তো! তুই জিতলেই মোহনবাগান যেন জিতবে! আর তাই ভেবে নিয়ে নিজের টিমকে জেতাতে এখনই যেন হেরে বসিসনি। মনে রাখিস, ডুরান্ডের থেকেও বড় আমাদের ডিপার্টমেন্টের ইজ্জত। দু পাক শেষ করতে হবে কিন্তু সবার আগে।
সবার আগেই সে শেষ করল। তার অর্ধেক বয়সিদের একজন, মেশিন বিভাগের ছেলেটি দ্বিতীয় হল তার পঁচিশ গজ পিছনে থেকে। সার্কুলেশনের ছেলেটি দেড়পাকের পর পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ে। মণিবাবু তৃতীয় হলেন রামভরণ আর রাধেশ্যামের সঙ্গে, পরদিন কাগজে বেরিয়েছিল, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া।
সার্কুলেশনের ছেলেটি শুরু করেছিল যেভাবে তাতে নারান একটু ভয়ই পায়। পঞ্চাশ মিটার রেসে দৌড়ের মতো গতিতে সবাইকে পিছনে ফেলে ছেলেটি অন্তত কুড়ি মিটার এগিয়ে যায়। মেশিনের ছেলেটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গতি বাড়িয়ে দেয় ওর সঙ্গে থাকার জন্য। নারান একই গতিতে বাকি তিনজনের পাঁচ মিটার সামনে থেকে দৌড়ে চলে। প্রথম পাক শেষ হতেই সে গতি বাড়িয়ে দেয়। দেড় পাকের আগেই দুজনকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে আসে। তখন তার মনে হল, এতক্ষণ সে হেঁটেছে এইবার দৌড়টা শুরু করা যাক। এবং তাই সে করল।
পশমের সুতো বুক দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেই সে ধাক্কা খেল টোলুবাবুর বুকে। নারানকে দু হাতে জড়িয়ে, দশ মাইল দৌড় শেষ করার মতো হাঁফাতে হাঁফাতে টোলুবাবু বললেন, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল নারান তোর ছোটা দেখে। চারশো মিটারে এই প্রথম আমরা জিতলাম। আমার মনে হচ্ছে…
ডুরান্ড আপনারাই পাচ্ছেন।
না না, ওসব ভাবছি না…মনে হচ্ছে, দুশোটাও তুই জিতবি।
নারান জিতল।
তাকে নিয়ে প্রতিযোগী আটজন। সবাই তার থেকে কমবয়সি। কিন্তু সে চিন্তিত নয়। চারশো মিটার তাকে গরম করে দিয়েছে। এখন সে দৌড়বার মজাটা পেয়ে গেছে। দূরত্বটা ছোট, তাই শুরু থেকেই সে এগিয়ে রইল আর একই গতি বজায় রেখে শেষ করতে তার অসুবিধা হল না। তার মনে হল, জ্যাটোপেককে দেখবে বলে ট্রেন ধরার জন্য যে গতিতে সে দশ বছর আগে দৌড়েছিল তার থেকে অনেক কম। জোরেই দৌড়েছে।
বড্ড ছোট মাপের দৌড়। বুঝলেন টোলুবাবু, খুব একটা আরাম হল না। আটশোটা চার পাকের, ওটা দৌড়লে বোধ হয় সুখ পাব, কী বলেন?
জিতলে তো তুই জ্যাটোপেক হয়ে যাবি রে…মানে, অফিসের জ্যাটোপেক?
আপনিও ওই নামটা করলেন! আমাকে লজ্জায় ফেলার জন্য দেখছি আপনারা সবাই ষড় করেছেন। নাহ্, আটশো মিটার হেরে গিয়ে আমাকে এখন লজ্জা থেকে বাঁচতে হবে। ক্ষুব্ধ স্বরে নারান বলল।
প্লিজ, নারান, প্লিজ, তুই হারিসনি, তা হলে ডুরান্ডে সব্বোনাশ হয়ে যাবে। টোলুবাবু আঁকড়ে ধরলেন নারানের দুই মুঠো।
তা হলে ওঁর সঙ্গে কখনও আমার নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করবেন না বলুন?… হিমালয়ের সঙ্গে উইঢিপির কোনও তুলনা সম্ভব?
টোলুবাবু জানালেন তিনি জ্যাটোপেক নাম আর উচ্চারণ করবেন না। এখন বাচ্চাদের আর মেয়েদের কয়েকটা ইভেন্ট, তারপর আটশো মিটার। বিশ্রাম দেবার জন্যই এইভাবে ইভেন্ট সাজানো। নারানকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন রবিবাবু।
এই আটশো মিটারটা জিতলে তুই…
দোহাই রবিবাবু, আর আমাকে জ্যাটোপেক বলবেন না। নারান জোড় হাতে অনুরোধ জানাল।
রবিবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, তিনটে ইভেন্ট জিতলেই জ্যাটোপেক হওয়া যায় নাকি? মাথা খারাপ না হলে কেউ তা বলতে পারে? আরে, আমি বলছিলাম কী, এটা জিতলে তুই প্রমাণ করবি, মানুষের যৌবন শুরু হয় চল্লিশ বছর বয়স থেকে…অবশ্য যদি সে অন্য ধাতুতে গড়া হয়!
ধাতুটাতু তো বুঝি না…লোহা, অ্যালমুনি ছাড়া আর কোনও ধাতুই আমার ঘরে নেই।…আমি কখনও দিতে হবে, দিতে হবে বলে ভিক্ষে করিনি। যতটুকু করেছি নিজের ক্ষমতায় করেছি। সেজন্য পরিশ্রম করেছি…টুকে কি মানে বই মুখস্থ করে পাশ করা হয়তো যায়, কিন্তু রবিবাবু শিক্ষিত হওয়া যায় না। বলতে বলতে নারান উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। গলার স্বর থর থর কেঁপে উঠল যখন সে বলল, দশ বছর আগে জ্যাটোপেককে দেখার জন্য আমি দৌড়েছিলাম ট্রেন ধরতে, দৌড়েছিলাম ট্রেন থেকে নেমেও…দেখা হয়নি। তাইতে কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি!..জ্যাটোপেক আমাকে দৌড় শেখায়নি, আমাকে দৌড়বার জন্য বলেওনি। আমি নিজেই নিজের জন্য দৌড়চ্ছি।
বোস, বোস, এখন একটু ঠাণ্ডা হ। রবিবাবু তাঁর পাশের খালি চেয়ারটা দেখালেন। নারান মাথা নেড়ে ঘাসের উপর বসল।
একই তারিখে তোদের দুজনের জন্ম, এইটুকুই তো মিল।
নারান সলজ্জ ভাবে ঘাড় নাড়ল।
কিন্তু একই রকম বউও কি? জানিস, ওরা দুজন, এমিল আর ডানা, পরস্পরকে প্রেরণা দিত! তা হলে সেই গল্পটা বলি, হেলসিঙ্কিরই ঘটনা। এমিল তাঁর দ্বিতীয় রেস, পাঁচ হাজার মিটারে সোনা জিতলেন। তার কিছু পরেই ডানারও ফাইনাল জ্যাভেলিনে। স্বামী দ্বিতীয় সোনা জিতেছে শুনে বউ ছুটে এসে মেডেলটা দেখতে চাইল। এমিল ওর হাতে দিলেন। ডানা বলল, দারুণ ব্যাপার। এটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি ডানা মেডেল নিয়ে চলে গেল। এর আগের লন্ডন ওলিম্পিকে, তখনও ওদের বিয়ে হয়নি, ডানার পদবি তখন ইনগ্রোভা, জ্যাভেলিনে সেভেন্থ হয়েছিল। ডানা প্রথমবারই যে থ্রো-টা করল তাতেই সোনা, আর ওলিম্পক রেকর্ড! লন্ডনে যতটা দূরে ছুড়েছিল এখানে তার থেকে সাড়ে পঁয়ত্রিশ ফুট দূরে ছোড়ে।
বলেন কী! চার বছরে এত উন্নতি? সাড়ে-পঁয়ত্রিশ ফুট!…খুব প্র্যাকটিস করেছিল।
শুধুই কি প্র্যাকটিস? স্বামীর ওই সোনা জেতাও কি শরীরে, মনে প্রেরণা জোগায়নি? মজার ব্যাপার হল, এমিল এটারই ইঙ্গিত দিয়ে ঠাট্টা করে বলল, বউয়ের সোনা জেতায় তারও হাত আছে। ব্যস, শুনেই তো ডানা রেগে উঠল। বলল, প্রেরণা জোগালেই বুঝি অতদূর পর্যন্ত জ্যাভেলিন ছোড়া যায়? কত তো মেয়ে রয়েছে, তাদের প্রেরণা জুগিয়ে দ্যাখো তো একবার, অতদূর পর্যন্ত ছুড়তে পারে কি না? নারান বোঝ তা হলে, দুজনের মধ্যে কতটা মনের মিল থাকলে তবেই এমন ঝগড়া করা যায়।…একজন এমিলকে বলল, দুটো সোনা তো জিতলেন, এবার ম্যারাথনটাও কি জিততে চান? এমিল বলল, জ্যাটোপেক পরিবারে স্কোর এখন দুই-এক। ব্যবধানটা এত কাছাকাছি যে, বাড়িতে বোধ হয় খাতিরটা কমেই যাবে। ওটা আর একটু উঁচুতে ভোলার জন্য এখন তো ম্যারাথন রেসে আমাকে চেষ্টা করতেই হবে! বোঝ নারান! বলেই রবিবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।
আর তখনই আটশো মিটারের প্রতিযোগীদের স্টার্টিং লাইনে আসার জন্য লাউস্পিকারে অনুরোধ জানানো হল। নারান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাড়িতে আমার খাতির নেই রবিবাবু। আমার বউ এক একরাতে ঠোঙা বানায় হাজারেরও বেশি আর আমার হয় বড়জোর সাতশো!
স্টার্টিং লাইনে টোলুবাবু একা দাঁড়িয়ে। নারান বিস্মিত হয়ে বলল, আর সব কই?
আমিও তো খুঁজছি, গেল কোথায় সবাই?
ঘোষণা হচ্ছে বার বার: আটশো মিটার দৌড়ের প্রতিযোগীরা, আপনারা এক্ষুনি আরম্ভ-সীমায় চলে যান…দেরি করবেন না। পরের ইভেন্টগুলো শুরু করতে তা হলে দেরি হয়ে যাবে।…দিস ইজ লাস্ট কল ফর দ্য…
মাল্টাবাবু এলেন হন্তদন্ত হয়ে।
কেউ নামতে চাইছে না। মণিবাবু বললেন, ওঁকে এখনই একটা প্রেস কনফারেন্সে যেতে হবে, পল্টু বলল, পেট ব্যথা করছে, সুজয় বলল, মাথা ধরেছে, রামভরণ আর বাসুদেবকে খুঁজে পেলুম না, বলাই মিত্তির আর গজুকে হাতে পায়ে ধরে রাজি করিয়েছি তবে ওরা এক পাকের বেশি দৌড়বে না বলেছে..এখন কী করি? ইভেন্টটা ক্যানসেল করে দেব?
না, না, করবেন না। নারান প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, কেউ না দৌড়লে আমি একাই দৌড়ব।
ব্যাপার কী, নামতে চাইছে না কেন? টোলুবাবু জানতে চাইলেন। নারানের দিকে আঙুল দেখালেন মান্টাবাবু।
আগের দুটো রেসে যেভাবে এগিয়ে থেকে নারান সবাইকে হারাল, তাইতে সবাই মনে করছে তারা বেইজ্জত হয়েছে। একজন বয়স্ক লোকের কাছে এত পিছিয়ে থেকে হার…অফিসে আওয়াজ খাওয়ার কথা ভেবেই ওরা…
মাণ্টাবাবু তা হলে আমি নামব না। আপনি ওদের বলুন যে নারান…
চঅঅপ টোলুবাবুর ধমকে নারান থতমত হল। ওদের জন্য তোর হ্যাটট্রিক বন্ধ হবে আমি থাকতে? ফাঁকা মাঠে গোল দিলে সম্মান থাকে না,…অসম্মান নিয়ে জিতবি কেন?…চল, আমি তোর সঙ্গে নামব। স্পোর্টস রিপোর্টিং করি, বুঝলি, স্পোর্টসম্যানশিপ দেখাতে জানি।
টোলুবাবুকে অনেক বুঝিয়েও নিরস্ত করা গেল না। হার্ট, গ্যাস্ট্রিক, ব্লাডপ্রেশার, স্পন্ডলাইসিসের ভয় দেখানো হল, কিন্তু কিছুই কানে নিলেন না। সাব-এডিটর বলাই মিত্তির আর টেলিফোন অপারেটর গজুর সঙ্গে তিনিও হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে দাঁড়ালেন স্টার্ট নিতে। মাণ্টাবাবু হুইল দিয়ে শুরু করালেন। সবাই ধীর গতিতে একসঙ্গে ছুটতে লাগল। নারান হুঁশিয়ার হয়ে রয়েছে, বাকি তিনজনের থেকে যেন সে একহাতও এগিয়ে নিয়ে যায়।
চার পাকের দৌড়। দেড় পাকের পরই গজুর মুখ লাল। হাঁপাচ্ছে।
গজুবাবু চলুন, চলুন। নারান পিছিয়ে ওর পাশে দৌড়তে দৌড়তে বলল, আদ্দেক তো প্রায় হয়ে গেছে, বাকিটাও হয়ে যাবে। আস্তে চলুন, আস্তে।
টোলুবাবু ঠিক দুপাকের মাথায় হাঁটতে শুরু করলেন। নারান আমি ফিনিশ করবই…একটু মোটা হয়ে গেছি এই যা। বুঝলি, আমি ফিটই আছি…যা যা তুই এগিয়ে যা, বুঝলি, সেই বায়ান্ন সালের মোহনবাগানের মতোই আমার অবস্থা:..জোরে ছোট।
তৃতীয় পাক শেষ হবার আগেই গজু আর বলাই মিত্তির দাঁড়িয়ে গেলেন। নারান দৌড় শেষ করল রীতিমতো জোরে ছুটেই। টোলুবাবু তখন আড়াই পাকে। গম্ভীর মুখে তিনি, বাজার করে ফেরার গতিতে, ফিনিশিং লাইনের উদ্দেশে হেঁটে চলেছেন।
পরের ইভেন্ট শুরু হবার আগে শ্যামল কুণ্ডু অনুযোগের সুরে টোলুবাবুকে বলল, এভাবে হেঁটে হেঁটে ফিনিশ না করলেই পারতেন। আমাদের ডিপার্টমেন্ট নিয়ে সবাই। এবার হাসাহাসি করবে।
করুক। চ্যাম্পিয়ান হতে পারব না, সেজন্য লিগের বাকি ম্যাচগুলো তাই বলে খেলব না?.তেমন হলে আমি হামাগুড়ি দিয়েও ফিনিশ করতুম! বুঝলে শ্যামল, এককালে কুস্তি শিখেছি গোবরবাবুর আখড়ায়, আমরা হলুম ওল্ড স্কুলের লোক।
টোলুবাবু তা হলে কী হল? নারান প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি কথা পাড়ল। সে জানে গোবর গুহ আর গোষ্ঠ পালের কথা শুরু করলে টোলুবাবু থামতে পারেন না।
কীসের কী হল?
ডুরান্ডের?
তোর ওই এক চিন্তা, কই আমার তো হচ্ছে না? আমি তো ধরেই রেখেছি, তুই তিনটেতে জিতলে ডুরান্ড নেবে…। টোলুবাবু কথা শেষ না করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে। আকাশের দিকে তাকালেন।
বয়স্ক মহিলাদের মিউজিক্যাল চেয়ারের পর গো অ্যাজ ইউ লাইক। তারপর পুরস্কার বিতরণ। নারান পেল কেরোসিন স্টোভ, টেবলল্যাম্প, হাওয়া-বালিশ আর তিরিশ পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ান হবার জন্য একটা ছোট কাপ। টোলুবাবু দ্বিতীয় হয়ে পেলেন একটা জলের ফ্লাস্ক। সেটা তিনি নারানকে দিয়ে দিলেন।
রবিবাবু পাঁচ টাকার একটা নোট নারানের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, বাড়ি যাবার সময় রসগোল্লা কিনে নিয়ে যাস।…আজ আমার খুব আনন্দ হল।
.
ধান্যকুড়িয়ায় নারান ট্রেন থেকে নামল রাত নটায়। স্টেশন থেকে বেরিয়েই বাজার। রাস্তার দুধারে নতুন কয়েকটা পাকা দোকান ঘর। ওষুধের দোকান, ডাক্তারখানা, শর্টহ্যান্ড টাইপ শেখার স্কুল, বাড়ি তৈরির মালমশলার দোকানের পর, আশুতোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দোকানের সামনে মুখোমুখি বেঞ্চে বসে পাড়ার কয়েক জন বয়স্ক লোক। ওদের মধ্যে রয়েছে তার জ্ঞাতিদাদা শচীন হালদার, চারু রায়, নন্দ ঘটক, শঙ্কর গারু এবং অপরিচিত একজন।
হাতের প্রাইজগুলো বেঞ্চে নামিয়ে রেখে নারান বলল, আশু পাঁচ টাকার রসগোল্লা দাও তো।
সবাই তাকাল নারানের দিকে। শঙ্কর গারু বলল, বাড়িতে কুটুম টুটুম আসবে না কি?
না।
তবে, একেবারে পাঁচ টাকার রসগোল্লা?
পাঁচ টাকার না হলে বাড়ির অতগুলো লোকের মুখে কি আধখানা করে দেব?
ব্যাপার কী নারান, বাড়ির লোককে হঠাৎ যে রসগোল্লা খাওয়াচ্ছ? চারু রায় কৌতূহল দেখাল।
নন্দ ঘটক বলল, নারান তোর সঙ্গের ওগুলো কী? কিনলি নাকি?
ওদের কথার সুরে নারান হালকা ব্যঙ্গের ছোঁয়া পেল। আর মাথাটাও গরম হয়ে উঠল। সে কি এতই গরিব যে রসগোল্লা কিনলে বা হাতে কিছু জিনিস থাকলেই লোকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা শুরু করবে?
অফিসে স্পোর্টস ছিল…নেমেছিলাম। জিতে এগুলো পেয়েছি। তার স্বর ঈষৎ রুক্ষ।
বাঃ বাঃ, কিন্তু স্পোর্টসে তো কাপ মেডেল দেয়, তুমি তা পাওনি? চারু রায়ের প্রশ্ন।
পেয়েছি। নারান মুখ ফিরিয়ে কথাটা বলেই আশুর দিকে তাকাল। চার আনাওলার দেবে। খানিকটা রসও দিয়ো।…তোমার ওই ভাঁড়ে কুলোবে না। একটা ছোট হাঁড়িতে করে দাও।
পেয়েছিস তো একবারটি দেখা। আমাদের এ তল্লাটে তো এখনও পর্যন্ত কলকাতা থেকে কেউ কাপ-মেডেল আনতে পারেনি। এই বয়সে তুই…দেখা দেখা।
দেখে চক্ষু সার্থক করি। নারানের মনে হল, এটা শচীনদার গলা। সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলে না, কিন্তু চিমটি কেটে টিপ্পনীটা ঠিকই দিয়ে যায়।
আমার অত সময় নেই দেখাবার।..আশু ওইটুকু রস দিলে? একটা ফাউ দেবে?
ওরে আশু, একটা নয় দুটো দে, আমরা বরং চাঁদা তুলে তোকে দামটা দিয়ে দোব। নারান ধান্যকুড়িয়ার মান বৃদ্ধি করেছে, সোজা ব্যাপার।…কাপ-মেডেল পেয়েছে, তা সেটা নয় নাই দেখাল..মুখে বলেছে তাই যথেষ্ট!
স্টোভের বাক্সের মধ্যে কাপটা সে রেখেছে। শঙ্কর গারুর কথা শুনে বাক্সর দড়ি খুলে কাপটা নিয়ে এগিয়ে গেল।
এই দ্যাখো। বিশ্বাস হল?
সবাই একটু থতমত হল। চারু রায় কাপটা হাতে নিয়ে তালুতে নাচিয়ে ওজন পরীক্ষা করতে করতে বলল, ছটাকখানেক হবে, রুপোর না কি রে?
ধ্যেত, রুপো না হাতি! কাঁসার ওপর রুপোর জল করা।
দাম কত হবে বল তো শচীন?
টাকাদেড়েক…সেকেন্ড হ্যান্ড হলে আরও কম।
আরে রুপো, কাঁসা, পেতল যাই হোক, একটা কাপ তো বটে! কচ্ছপের সঙ্গে দৌড়ে হোক আর খুঁয়োপোকার সঙ্গে দৌড়েই হোক, নারান জিতে এনেছে তো বটে।…একটা ফ্লাস্কও তো দেখছি, ওরে বাবা টেবিলল্যাম্পও যে! হাতে ওটা কী রে নারান?
নারানের মাথার মধ্যে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। রাগে তার গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। সেই সময়ই আশু ডাকল, দড়ি বেঁধে দিয়েছি, নিয়ে যাও হাতে ঝুলিয়ে।
কাপটা চারু রায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে স্টোভের বাক্সের মধ্যে রেখে দড়ি বাঁধল, ফ্লাস্কটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাওয়া-বালিশ বাঁধা ল্যাম্প আর স্টোভের বাক্স একহাতে আর অন্য হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি ঝুলিয়ে সে পা বাড়াল।
ইতিমধ্যে আরও নানা রকম ফুট কাটা চলছিল।
নারানকে তো একটা সম্বর্ধনা দিতে হয়।
অবশ্যই। এতগুলো প্রাইজ জিতে আনল! কত টাকার মাল হবে বল তো?
ওকেই জিজ্ঞেস করো না। শেয়ালদা বাজার থেকে গাঁটের পয়সা খরচ করে ওই তো কিনেছে।
শেষের কথাটা নারানের কানে গেল। সে আর ধৈর্য রাখতে পারল না। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে এসেই, হাতে ঝোলানো রসগোল্লার হাঁড়িটা আধাপাক ঘুরিয়ে, শচীন হালদারের মাথা লক্ষ্য করে বসাল। কিন্তু তার আগেই হাঁড়িটাকে দোলাতে দেখে বিপদের গন্ধ পেয়ে শচীন অ্যাই অ্যাই বলে সামনে বসা শঙ্কর গারুর উপর লাফ দিয়ে পড়েছিল। হাঁড়িটা বেঞ্চের ওপর পড়ে চৌচির হল, ছিটকে গেল রসগোল্লা আর রস।
মেরেই ফেলব, আজ মেরেই ফেলব। শচীনের চুলের মুঠি ধরে নারান ঝাঁকাচ্ছে আর চিৎকার করে যাচ্ছে, অনেক সহ্য করেছি, এবার শেষ করব।
আশুতোষ দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে। চারু, নন্দ এবং আরও কয়েকজন নারানকে ধরে টেনে সরিয়ে নিল। দেখতে দেখতে সারা বাজার ভেঙে পড়ল। সবারই মুখে এক কথা, কী ব্যাপার?..কী হল নারান হালদারের?…খেপে গেল কেন?
ডাক্তারখানার সিঁড়ির ধাপে নারানকে বসানো হয়েছে। ছড়ানো ছেটানো প্রাইজগুলো কুড়িয়ে এনে একজন তার পাশে রাখল। একটু দূরে একটা ভিড়ের মধ্য থেকে নন্দ ঘটকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
পুলিশে দেওয়া দরকার, আমি এক্ষুনি থানায় যাব। খুন তো প্রায় করেই ফেলেছিল। ভাবো তো, অতবড় একটা হাঁড়ি যদি মাথায় পড়ত! আমি টেনে না নিলে শচীনদা তো মরেই যেত।
নারানের সামনেও একটা ভিড়। মুখ নামিয়ে মাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে। একজন হাত ধরে বলল, চলো নারানদা, বাড়ি চলো।…মাথা গরম আর কোরো না!
সরে যা সামনে থেকে, একটা হেস্ত না করে…। বলতে বলতে নারান মুখ তুলেই ঢোঁক গিলল।
তার আগে আমার মাথা ফাটিয়ে তোমায় হেস্তনেস্ত করার কাজে নামতে হবে।
মহামায়া। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে।
বাড়ি চলো।
ক্লান্ত, অবসন্ন পায়ে নারান বাড়ি ফিরল। সঙ্গে মহামায়া, নয়ন আর অবু। অন্ধকার উঠোনে গোঁজ হয়ে নারান বসে রইল। সারাদিনের কথা, টুকরো টুকরো ভাবে তার মনের মধ্যে আলোড়ন তুলে যাচ্ছে। আশুর দোকানের সামনে যা ঘটে গেল, সেটা ঘটতই না যদি সে স্পোর্টসে না নামত, যদি সে প্রাইজগুলো না পেত, যদি সে রবিবাবুর দেওয়া টাকায় রসগোল্লা কিনতে না যেত।
কেন যে মাঠে গিয়ে তার শরীর-মন আনচান করে উঠল এই চল্লিশ বছর বয়সেও? নারান খুঁজে পেল না এর উত্তর। প্রাইজ জেতার আনন্দ নষ্ট করে দিল তার চণ্ডালের মতো এই রাগ। নিজেকে সে বশে রাখতে পারে না কেন? তারও উত্তর সে পেল না। মহামায়া গিয়ে যদি তাকে টেনে না আনত, তা হলে সে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধাতই। কৃতজ্ঞতায় তার মন আচ্ছন্ন হতে শুরু করল। মহামায়া না থাকলে তার পরিশ্রম কোনও কাজেই লাগত না, এই সংসার গড়ে তোলা, সন্তান পালন করা, এমন শৃঙ্খলার সঙ্গে কিছুই সম্ভব হত না, যদি…
কে? নারান উঠে দাঁড়াল। কে যেন অন্ধকার উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি আশু।
কী ব্যাপার?
এইটে ধরা। আশু তার হাতের হাঁড়িটা এগিয়ে দিল। হারিকেন নিয়ে মহামায়া ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
কেন? নারান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ফেলে এসেছিলে তাই দিয়ে গেলাম।
কোথায় ফেলে এসেছি? আমি তো হাঁড়ি ভেঙে রসগোল্লা নষ্ট করে দিয়েছি।
তা দিয়েছ। এটা হল আমার দেওয়া প্রাইজ। তুমি কলকাতা থেকে কাপ জিতে এনেছ, এতে আমার আনন্দ হচ্ছে। এখানে কেউই তো কখনও কিছু জেতেনি, তুমিই প্রথম, নাও ধরো।
আশু হাঁড়িটা এমন ভাবে বাড়িয়ে ধরল যে,নারান হাতে না নিয়ে পারল না। কুণ্ঠিত স্বরে সে বলল, কিন্তু এমন কিছু তো বড় স্পোর্টস এটা নয়…অফিসের, সামান্যই ব্যাপার।
হোক সামান্য। সব জিনিসই সামান্য থেকে শুরু হয়, তারপর ধাপে ধাপে বড় হয়।
আরে, আমি চল্লিশ বছর বয়সে এখন আর কী বড় হব? এটা দৌড়োদৌড়ির কাজ বুঝলে আশু, বসে বসে সন্দেশ-রসগোল্লা বানানো নয়। ধাপে ধাপে বয়স বাড়বে যেমন, তেমনই ধাপে ধাপে দৌড়ের ক্ষমতাও কমে আসবে। জ্যাটোপেক বায়ান্নর ওলিম্পিক ম্যারাথন জিতল, চার বছর পরের ওলিম্পিকে সিক্সথ..বলেই সে চুপ করে গেল।
আশু একগাল হেসে মহামায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, বউঠাকরুন, নারানের সঙ্গে তো কথায় পারব না, খবরের কাগজের অপিসে চাকরি করে, অনেক খবর রাখে। মিষ্টিগুলো খেয়ে বলবেন কেমন লাগল। আচ্ছা, এখন চলি।
রাতে ছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ার পর, মহামায়া বলল, ধানের ব্যবসা করব।
কীসের?…ধানের ব্যবসা? তুমি?
আমি একা কী করে করব? সবাই মিলে করব। উলটোডিঙিতে কাজে যাবার সময় ট্রেনে একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, নাম রমা, গুমার দিকে ওর বাড়ি। আজ সকালে বাজারে দেখি ও চালের দোকানে বসে। কথায় কথায় রমা বলল, ধান কিনে এনে, সেদ্ধ করে, ধানমিলে ভাঙিয়ে এখন চাল বিক্রি করে। দিনে ছসাত মণ চাল তৈরি করে। বাড়িতে চার-পাঁচ জন লোক, সবাই হাত লাগায়। আমার আর কাজ করার মতো লোক কোথায়। অল্প করেই শুরু করে একবার দেখি না।
মুখে মুখে ধানের ব্যবসা করা খুব সোজা। ধান কিনে আনা নয় হল; তারপর সেদ্দ করা, শুকোনো, নাড়া দেওয়া, দেশের বাড়িতে দেখেছি তো, মাঝ রাত থেকে উনুনের কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তুষের জ্বাল দেওয়া, তারপর সারাদিন ধানের কাছে বসে থাকা, নাড়া দেওয়া। কম খাটুনি? সে তুমি পারবে না।
পারি কি না পারি সেটা পরে দেখা যাবে, আগে কাজে নামি তো। রাম বলেছে, যদি রাজি থাকি তা হলে ও আমায় সব জানিয়ে বুঝিয়ে দেবে।
মহামায়ার কথা শুনে নারানের মনে পড়ল, বউ সোনা জেতার পর জ্যাটোপেকের। কথাটা: বাড়িতে বোধহয় খাতিরটা কমেই যাবে। ওটা আর একটু উঁচুতে তোলার জন্য এখন তো ম্যারাথন রেসে আমাকে চেষ্টা করতেই হবে!
রসিকতা করে বলল, কিন্তু সংসারে এই ধরনের রেষারেষি তো হয়ই। বাবা-ছেলে স্বামী-স্ত্রী সবার সঙ্গে সবার…সংসার গড়ে তুলতে, প্রতিপালনের আর বাড়বাড়ন্তের জন্য কে কতটা সাহায্য দিতে পারে, তাই নিয়ে কম্পিটিশন চলে। মহামায়া কি তাকে পিছনে ফেলে এগোতে চাইছে?
নারানের আর একটা কথা মনে এল। আশুকে সে জ্যাটোপেকের কথা তুলে তখন বলল, বায়ান্নয় ম্যারাথন জিতে কিনা চার বছর পর সিক্সথ! তারপরেই সে চুপ করে গেছল। কথাটা বলেই তখন তার হুশ হয়েছিল, আশুর কাছে জ্যাটোপেকও যা আর জিবেগজাও তাই। বলে কোনও লাভ নেই, ওর মাথায় জ্যাটোপেক ঢুকবে না। যদি ঢুকবে বুঝত, তা হলে সে বলত—ছাপান্নর ওলিম্পিক শুরুর দেড় মাস আগে এমিল ট্রেনিং করছিল ডানাকে কাঁধের উপর তুলে। তখনই হার্নিয়া শুরু হয়। অপারেশন হল। ডাক্তার বলল, দু মাস দৌড় বন্ধ রাখতে হবে। রবিবাবু গল্পটা বলতে বলতে থেমে গিয়ে বলেছিলেন, নারান, ওই মানুষটা আলাদা ধরনের। ওকে দমানো যায় না। দুমাস বন্ধ রাখার বদলে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পরদিনই আবার ট্রেনিং শুরু করে দিল। ওর সিক্সথ হওয়াটাই তো একটা অলৌকিক ব্যাপার।
এসব কথা মিষ্টিওলা আশুকে বলে কোনও লাভ হত না। সংসারটা ঘাড়ে নিয়ে সে এখনও শুধু হাঁটছে, দৌড় দিতে পারছে না। মহামায়া নিজের ঘাড়ে কিছুটা বোঝা তুলে নিতে চাইছে।
কী হল, চুপ করে রইলে কেন? রমাকে বলেছি তাড়াতাড়িই ওকে জানাব। ও যদি পারে তা হলে আমিও পারব।
একটু ভেবে দেখি। পরে তোমায় বলব।
সাতদিন পর ডুরান্ড ফাইনালে, খেলা দুদিন ড্র রেখে যুগ্মবিজয়ী হল মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল। নারানের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে টোলুবাবু বলেছিলেন, তুই এবার থেকে প্রত্যেক বছর স্পোর্টসে নামবি…উফ, যা ঝামেলার মধ্যে থাকতে হয়? আমি অবশ্য ধরেই নিয়েছিলুম তুই তিনটেতে জিতলে একটা নতুন কিছু ডুরান্ডে এবার হবে। এরা আগে কখনও তো জয়েন্ট উইনার হয়নি।
রাতে বাড়ি ফিরে নারান বলল, তুমি একা করবে কেন, দুজনে জয়েন্টলিই কাজ করব, তাতে অনেক ঝামেলা কমে যাবে।
.
০৫.
অফিসের স্পোর্টসে নারানের প্রথম নামা আর ধান কিনে এনে চাল তৈরির ব্যবসা একই বছরে শুরু হয়েছিল। তারপর ছটা বছর কেটে গেছে অর্থাৎ জ্যাটোপেককে দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে তার ব্যর্থ হওয়ার পর দশ বছর! এর মধ্যে মহামায়া বছর তিনেক উলটোডাঙায় এক কাঠের খেলনা তৈরির কারখানায় কাজ করেছে,বাড়িতে ঠোঙা তৈরি করেছে তারপর চাল তৈরির ব্যবসা, যেটা এখনও তারা চালাচ্ছে।
নারানের প্রতি দিনের জীবনযাপন ধারা এখন একটু অন্য রকম। তার অফিসের ডিউটি এখন স্টোর বিভাগে, দিনে দশটা-পাঁচটা। অফিস বাড়ির একদিকে এই স্টোর বিভাগ, খেলার বিভাগ অন্যদিকে, দোতলায়। টোলুবাবু বা মাল্টাবাবুদের কারও সঙ্গেই আর তার দেখা হয় না। তবে প্রতি বছর স্পোর্টসে মাঠে দেখা হয়।
নারান একশো, দুশো বা চারশো মিটারে এখন প্রথম হতে পারে না। অফিসে অনেক অল্পবয়সি ছেলে এসে গেছে, তাদের সঙ্গে গতিতে তাকে হার মানতেই হয় কিন্তু আটশো মিটারে এবং হাজার মিটার ওয়াকিংয়ে সে অফিসে অপরাজেয়। কিন্তু বুঝতে পারছে আটশো মিটারের চুড়ো থেকে এবার তাকে নেমে আসতে হবে। বয়স এখন ছেচল্লিশ। আর পারা যাচ্ছে না। তবে ওয়াকিংয়ে হাঁটায় অনভ্যস্ত কলকাতার বাবুরা যে আগামী দশ বছর পর্যন্ত তার কাছা ধরতে পারবে না, এটা সে জানে।
রাত দুটোয় সে বিছানা থেকে ওঠে। ধানের কুঁড়ো আর তুষ নিয়ে উঠোনে উনুনটা ধরায়। ধান সেদ্ধ করার লোহার কড়াইটা বিরাট। ব্যাসই প্রায় তিন হাত, গভীরতা দুহাত। কড়াইয়ে ভাপা হবে চার বস্তা ধান, প্রতি বস্তায় থাকে দেড় মণ।
উনুন ধরানো হলে নারানের সঙ্গে এসে বসে মহামায়া। উনুনে আঁচ দেওয়ার মুখ দুটি। ওরা দুজন দুধারে দুই মুখে বসে প্রথমে সরু কুঁড়ো গর্ত দিয়ে আগুনে ছুড়ে ছুড়ে দিতে থাকে, তারপর মোটা তুষ। অন্ধকার নিস্তব্ধ মাঝ রাতে দুজনে উনুনের আঁচের দিকে তাকিয়ে অবিরত তুষ ছুড়ে যায়। আগুনের চাপা আভায়, অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে থাকা দুটো মুখের মধ্যে শুধু দু জোড়া চোখ মাঝে মাঝে ঝকঝক করে ওঠে যখন তারা মুখ তুলে পরস্পরের দিকে তাকায়। দু-চারটে মাত্র কথা তারা বলে কাজের কথা।
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মহামায়া একবার ওঠে। অবু আর নয়নকে তুলে দেয় ঘুম। থেকে। নয়ন সংসারের কাজ শুরু করে, অবু পড়তে বসে। পড়াশুনোয় ওর মাথা ভালই। নারান ওকে গ্র্যাজুয়েট করবেই। রাত দুটো থেকে সাতটা, পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে ভাপের কাজ, উনুনে তুষ ছুড়ে যাওয়া। নারান অফিসে যাওয়ার জন্য আটটার ট্রেন ধরে। এর পর মহামায়া একলা।
গর্তের মধ্যে মাটির ছটা নাদা। প্রতিটিতে তিরিশ কলসি জল ধরে। ভাপানো, একসেদ্ধ হওয়া ছ মণ ধান কড়াই থেকে তুলে জলে ডুবিয়ে রাখার জন্য, সে আর নয়ন নাদায় ফেলে।
অবুর স্কুল প্রায় এক মাইল দূরে জোড়ানিমতলায়। সে খেয়ে বেরিয়ে যায় দশটায়। নবু, রাজু যায় প্রাথমিক স্কুলে। গৌতম হামা ছেড়ে হাঁটতে শিখেছে মাত্র।
নাদা থেকে সেদ্ধ ধান তুলে উঠোনে পাতা চটের ওপর শুকোতে দেওয়ার কাজ মহামায়া একাই করে। ধান ছড়িয়ে দিয়ে আধঘণ্টার মতো বিশ্রাম। তারপর চট করে নাড়া দিয়ে ধানগুলোকে ওলটপালট করা, যাতে রোদের তাপ সমানভাবে পায়। এই সময় সারা দুপুর ধানের সঙ্গে লেগে থেকে অন্তত চার-পাঁচ বার সেই ছমণ ধান তাকে চট ধরে উলটাতে হয়। তখন লক্ষ রাখতে হয়, বেশি শুকিয়ে ধানের ওজন যাতে কমে না যায়, তা হলে চালের রং খারাপ হবে, ভাঙাবার সময়ও আস্ত থাকবে না। চালের দাম তাতে নেমে যাবে। আবার কম শুকোলেও চাল ভাঙবে। তাই তীক্ষ্ণ নজর রেখে ধানের কাছে মহামায়াকে সারা দুপুর বসে থাকতে হয় ঝাঁ ঝাঁ রোদুরে। মাঝে মাঝে গোড়ালির চাপে ধান ভেঙে সে দাঁতে কেটে বুঝে নেয় ঠিকমতো শুকোল কি না। ধান বস্তায় ভরার আগে, ঘণ্টা চারেক ছায়ায় ঠাণ্ডা জায়গায় ছড়িয়ে রাখতে হয়।
ততক্ষণে নারান অফিস থেকে ফিরে আসে। কিন্তু এই চার ঘণ্টাও বিশ্রাম পায় না মহামায়া। সকালে ধানভাঙা যে কুঁড়ো, তুষ মিল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছিল, এই সময়টায় কুলো দিয়ে ঝেড়ে সে তাই থেকে খুদ বার করার কাজে ব্যস্ত থাকে। কাজ শেষ হতে হতে রাত আটটা বেজে যায়। তারপর আবার রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠে। উঠোনে উনুনের ধারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে বসা। এই ভাবে তার রাত আর দিন কেটেছে গত ছ বছর। খাটুনি থেকে তার রেহাই নেই। কিন্তু সে কখনও মুখভার করেনি। শরীর আর বইছে না বলে অনুযোগ জানায়নি। সংসারের সুখদুঃখ ঘিরে আবর্তিত হয়ে চলেছে তার দিন আর রাত।
নাদার জল দুদিন পর পর পালটাতে হয়। ছটা নাদায় লাগে একশো আশি কলসি জল। নারান বাড়িতে টিউবওয়েল বসিয়েছে। রাত্রে সে পাম্প করে, মহামায়া কলসিতে জল ভরে, কুড়ি গজ বয়ে নিয়ে গিয়ে নাদায় ঢেলে দিয়ে আসে।
মায়ের কষ্ট দেখে নয়ন এগিয়ে এসেছিল। মহামায়া ধমক দিয়ে বলেছিল, গা-হাত পুরুষ মানুষের মতো শক্ত হয়ে যাবে। এসব কাজ তোকে করতে হবে না। নয়নের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে।
অবুও টিউবওয়েলের হাতল ধরেছিল। নারান তাকে টেনে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এখন পড়ার সময়, মন দিয়ে পড়া কর।
সেদিন ছিল নাদার জল পালটাবার দিন। কলসিতে জল নিয়ে যাবার সময় ছলকে উঠোনের মাটিতে জল পড়ে। ক্রমশ উঠোনটা ভিজে ওঠে, কাদা হয়। তখন পিছল মাটিতে একটু হুশ রেখে হাঁটতে হয়।
মহামায়া অন্ধকার উঠোনে টিউবওয়েল থেকে নাদা, যাতায়াত করছিল। সে জানত মাটি পিছল হয়ে উঠেছে। বহুবার এমন পিছল উঠোনে সে জল বয়েছে। সাবধানেই পা ফেলছিল। তবু, শ্রান্তিতে কীরকম যেন আলগা হয়ে তার দেহের পেশি কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। সে টাল রাখতে না পেরে পিছলে পড়ে গেল। কলসিটা উঠোনে চৌচির হল আর তার মুখ থেকে আহহ-র মতো একটা শব্দ বেরোল।
ছুটে এল সবাই। ধরাধরি করে তাকে বসানো হল। লজ্জা পেয়ে মহামায়া উঠে দাঁড়াতে গিয়ে, উহ্ বলে কাতরে উঠেই আবার বসে পড়ল।
কোথায়? উদ্বিগ্ন নারান জানতে চাইল ব্যথার জায়গাটা।
এই ডান হাঁটুতে।
ভেঙেছে নাকি? অবু বলল।
তুই থাম তো! এরকম অনেকবার পড়েছি…চুন-হলুদ দিলেই সেরে যাবে। মহামায়া ব্যাপারটাকে সহজ করে তোলার জন্য বলল, নয়ন, কলসিটা তো ভাঙল, তুই এবার বালতি করে…
না না, যা পিছল হয়ে রয়েছে, আমিই নাদায় জল ঢালছি। তার আগে, নয়ন তুই চুন-হলুদ গরম কর।
পরদিন সকালেও মহামায়া বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। ধান সেদ্ধর কাজ বন্ধ রইল, কিন্তু শুধু সে দিনের মতোই নয়, বরাবরের জন্যই।
দিন দশেক পর মহামায়া উঠোনে এসে একটা টুলে বসল নয়নের কাঁধে ভর দিয়ে। নারানকে সে ডাক্তার এনে টাকা খরচ করতে দেয়নি। এই সামান্য একটা ব্যাপারে আবার ডাক্তার দেখাব কী? কদিন গরম তেল মালিশ করলেই দেখবে দৌড়তে পারব।
দৌড় তো দূরের কথা, একমাস পরও সে ডান হাঁটু পুরোপুরি মুড়তে ব্যথা বোধ করল। উবু হয়ে বা বাবু হয়ে কোনওক্রমে বসতে পারলেও, উঠতে গেলেই তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয়। উঠোনে টুলে বসে সে করুণ চোখে নেভা উনুন আর বিরাট কড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু সাচ্ছল্য এসেছিল সংসারে, তাও চলে গেল। নয়নের বিয়ে দিলেই জমানো টাকা আর থাকবে না। আবার সেই টানাটানির সংসার। এজন্য মহামায়া নিজেকেই দোষ দেয়। কেন সে আছাড় খেল! এটা কি কপালের লিখন! তাকে কি চিরকালই কষ্ট করে যেতে হবে, সুদিনের মুখ কি কখনও দেখতে পাবে না?
ধানের ব্যবসাটা উঠে গেল। মহামায়া হাঁটতে পারছে তবে ধীরে ধীরে। হাঁটু মুড়তে পারছে কিন্তু খচখচ করে। ব্যথাটা ক্রমশ মিলিয়ে গেলেও মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। নারান এই নিয়ে চিন্তিত। ভাল একজন ডাক্তার দিয়ে একবার হাঁটুটা দেখানো উচিত। রেললাইনের ওপারে বিজয় ডাক্তারের কাছে সে মহামায়াকে নিয়ে গেছল। হাঁটু পরীক্ষা করে ডাক্তার এক্স-রে করাতে বলে।
বাড়ি ফেরার সময় মহামায়া আপত্তি জানাল।
আবার গুচ্ছের টাকা খরচ। ষােলোটা টাকা কম নাকি? ছবি তোলাবার দরকার নেই। ব্যথাটা আগের থেকে অনেক কমে গেছে, আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে। অত ব্যস্ত হবার কী আছে!
এসব জয়েন্টর ব্যথা অত সহজে যায় না। একটা এক্স-রে করাতে এত আপত্তি কীসের? ট্রেনে বনগাঁ গিয়ে… নারান তার স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করল।
ট্রেনে চেপে কেন, আমি হেঁটেই এখন বনগাঁ যেতে পারি। কথাটা তা নয়,…অযথা কেন খরচ করব?
এটা অযথা নয়, খুব দরকারি। অফিসে শুনেছি তো, হাঁটুতে, অ্যাঙ্কেলে চোট পেয়ে কত ভাল ফুটবলারের খেলা শেষ হয়ে গেছে।
আমি কি ফুটবল খেলতে মাঠে নামব?
কেপ্পনি করে চিকিৎসা না করালে হাঁটুতে জল জমবে, বাত হবে, অথর্ব হয়ে যাবে। শেষের কথাটায় মহামায়া ভয় পেল। বাতের যন্ত্রণা ঠিক আছে, সহ্য করতে পারবে, কিন্তু অথর্ব হওয়াকে সে ঘেন্না করে, তাই ভয়ও পায়।
ঠিক আছে, কবে যাব?
বনগাঁ থেকে এক্স-রে করিয়ে এনে নারান খাম হাতেই স্টেশন থেকে বিজয় ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দেখল তালা ঝুলছে। কী ব্যাপার! পাশের ওষুধের দোকানে। শুনল, পাটনায় ডাক্তাবাবুর বড়দার হঠাৎ হার্ট-স্ট্রোক হয়েছে। খবর পেয়েই কাল পাটনা চলে গেছেন। অন্তত সাত দিনের আগে ফিরবেন না।
সোমবার ছিল অফিসের মাইনের তারিখ। সে দিন দুপুরে ক্যাশঘর থেকে মাইনে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সে টোলুবাবুর মুখোমুখি হল।
আরে নারান, খবর কী তোর? দেখে তো মনে হচ্ছে ভালই আছিস।
আপনি কেমন আছেন? একটু শুকনো শুকনো..।
ভাল আছি, ভাল আছি। টোলুবাবু মাঝপথে নারানকে থামিয়ে দিলেন। শরীর টরির নিয়ে কথা বলে মন খারাপ করে দিসনি। হার্ট, লিভার, কিডনি, প্রেশার, এগুলোকে ভুলে থাকতে দে। আর কবছর পরই রিটায়ার করছি…মাঠে যাওয়া বন্ধ করব। খাব-দাব, ঘুমোব আর ছাদে ফুলের বাগান করব। দুটো ছেলে চাকরি করছে…তোর কয় ছেলে?
বড় ছেলে তেরো বছরের, বাকি তিনটে ছোট।
ওহ, তা হলে তো তোকে এখন অনেকদিন চাকরি করতে হবে। করে যা, করে যা। মাইনেটা নিয়ে আসি। টোলুবাবু ক্যাশঘরে ঢুকে গেলেন।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে টোলুবাবু একটা কথাও বললেন না। এমনটা তো কখনও হয় না! নারানের অবাক লাগল। অনিলকে দেখে নারান বলল, টোলুবাবু কেমন যেন বদলে গেছেন মনে হচ্ছে!
তুই জানিস না? ওনার তো দুটো স্ট্রোক হয়ে গেছে। নাইটডিউটি আর করেন না। দুপুরে ডাকের কপি করে বাড়ি চলে যান।
শুনে নারান অবাক হয়ে গেল। একই অফিসে তারা কাজ করে, অথচ এক তলা আর দোতলার মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই! তিন তলার মানুষদের তো সে চেনেই না! খেলার বিভাগে অনেক দিন যায়নি, নারানের ইচ্ছে হল, আগের মতো টোলুবাবুর সঙ্গে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে কথা বলতে।
কী রে, এখানে কী মনে করে? টোলুবাবু চোখ থেকে চশমা নামালেন।
আপনি চশমা নিলেন কবে?
মাস ছয়। বয়স হলে অনেক উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু তুই তো একটুও বদলালি না? চোখের দৃষ্টি কেমন?
ভালই, তিন হাত দূরের খবরের কাগজ পড়তে পারি। কথাটা বলেই নারানের মনে হল, এখন এই লোকটির কাছে দৈহিক সুস্থতার কথা না বলাই ভাল। তাই সে তাড়াতাড়ি যোগ করল, আমি ভাল থাকলে কী হবে, বাড়িতে তো অসুখবিসুখ, নিশ্চিন্তে আর আছি কই..বউয়ের হাঁটুতে…
কী হল হাঁটুতে? টোলুবাবু চশমাটা চোখে দিলেন। নারান তখন আদ্যোপান্ত ব্যাপারটা বলল।
তা ওকে নিয়ে আয়, আমি ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দিচ্ছি। না না, দেরি করিসনি, কালকেই আন।…মনে আছে তোর, চোদ্দো-পনেরো বছর আগে…
চোদ্দো বছর আগে। আপনি দাঁড়িয়েছিলেন ক্যাম্বেল হাসপাতালের…ইয়ে নীলরতন হাসপাতালের সামনে। বলেছিলেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি আমি এসে যাই, তা হলে ধরে নিয়েছিলেন আপনারাই লিগ পাবেন। আমি চার মিনিট আটাশ সেকেন্ডের মধ্যে এসে গেছলাম।
আর লিগটা কিনা পেলি তোরা। টোলুবাবু চোখ পিটপিট করে বললেন। পরের বছর হল অ্যাবাৰ্ডন্ড।
কিন্তু তার পরের বছর তো আপনারা ডাবল করলেন।
তার দুবছর পর জ্যাটোপেক এল কলকাতায়, কিন্তু তুই তাকে দেখতে পেলি না।
আমার জীবনে, টোলুবাবু, এতবড় একটা দুঃখ আর কখনও পাইনি। ওঁকে দেখার ওই প্রথম আর শেষ সুযোগ আমি হারিয়েছি।
তা হলে তুই কাল…না না কাল নয়, তোর অফ-ডে কবে? রবিবার?
হ্যাঁ।
তা হলে রবিবার বিকেলে ঠিক পাঁচটায় ওই জায়গায় বউকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়াবি। এক্স-রে প্লেটটাও আনবি। ওই ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যাব। বেশিক্ষণ কিন্তু আমায় দাঁড় করিয়ে রাখিসনি। শরীরটা কদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না, হার্টটা কেমন যেন ট্রাবল দিচ্ছে।
নারান চলে আসছিল, টোলুবাবু ডাকলেন।
নারান শোন, জীবনে কোনটে বড় দুঃখ আর কোনটে ছোট দুঃখ, সে সবের হিসেব কষা ছেড়ে দে। ওতে শুধু সময় নষ্ট আর মন খারাপ করা। দুটো স্ট্রোক হয়ে গেছে, ডাক্তার বলেছে থার্ডটাই আমার ফুলটাইমের হুইল্ল হবে। আমি এখন আর লিগ, শিল্ড, রোভার্স, ডুরান্ড নিয়ে একদম ভাবি না। এসব এখন তুচ্ছ ব্যাপার বলে মনে হয়। তোরও জীবনে এমন একদিন আসবে যখন জ্যাটোপেককে তোর আনইম্পর্ট্যান্ট বলে মনে হবে।
না না না, এ আপনি কী বলছেন টোলুবাবু। নারান প্রায় শিউরে উঠল। ওঁকে আনইম্পর্ট্যান্ট ভাবব? এমন অধঃপতন আমার যেন না হয়।
টোলুবাবু ফিকে হাসলেন। নিচু গলায় বললেন, না হলেই ভাল। তবে জীবনে বড় বড় সারপ্রাইজগুলো ঘাপটি মেরে থাকে। কখন, কোথায় যে লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে কেউ তা জানে না!…তা হলে রোববার দেখা হচ্ছে।
নারানও জানত না, রবিবারই তার সামনে এসে দাঁড়াবে একটা সারপ্রাইজ।
মহামায়াকে নিয়ে সে বিকেল চারটে-পঁয়ত্রিশে ট্রেন থেকে শেয়ালদায় নামল। হাসপাতালের সামনে পৌঁছতে লাগল চার মিনিট। তারপর অপেক্ষা করতে করতে বাজল পাঁচটা। টোলুবাবু তখনও আসেননি। সাড়ে পাঁচটা। টোলুবাবুর দেখা নেই।
কী ব্যাপার, ঠিক বুঝতে পারছি না তো! নারান হতাশ, উদভ্রান্তের মতো মৌলালি থেকে বউবাজার মোড় পর্যন্ত ঘনঘন তাকাতে লাগল।
পাঁচটা বলেছিলেন না ছটা? মহামায়া সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইল।
পাঁচটা। আর একটু দেখি। না এলে ডাক্তারের কাছেই সোজা টোলুবাবুর নাম করে চলে যাব, এই তো সামনেই ওঁর চেম্বার।
ছটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে নারান আর মহামায়া ডাক্তারের চেম্বারে এল। চোদ্দো বছরে জায়গাটার বিশেষ কিছু বদল ঘটেনি। অপেক্ষার জায়গাটায় রোগীর সংখ্যাটা বেশি। পুরনো দুটো চেয়ারকে নারান চিনতে পারল। নতুন একটা হাতলওলা বেঞ্চ আর ঘরের দরজার ধারে টেবল চেয়ার। একটি অল্পবয়সি রুগণ মেয়ে সেখানে বসে।
আপনার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে? মেয়েটি জিজ্ঞেস করল। নারান ফাঁপরে পড়ল। ডাক্তারকে টোলুবাবু বলে রেখেছেন কি না সে জানে না। তবে আগেরবার তো ডাক্তারকে বলা কওয়া ছিল বলে তার মনে হয়নি। হাঁদু বলে টোলুবাবু ডেকেছিলেন। ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার দরকার হয় না।
না করা নেই। ডাক্তারবাবুর বন্ধু আমাদের পাঠিয়েছেন।
এতে আপনার নাম আর যিনি পাঠিয়েছেন তার নাম লিখে দিন। স্লিপের ছোট্ট প্যাডটা আর কলম মেয়েটি এগিয়ে দিল।
নিজের নাম লিখে নারান তার দলায় টোলুবাবু পাঠাইয়াছেন লিখে দিল। স্লিপটা নিয়ে পরদা সরিয়ে মেয়েটি ভিতরে গেল। পর্দার দিকে তাকিয়ে নারানের মনে হল, এটা তো আগে ছিল না! বেঞ্চে মহামায়ার পাশে বসা মাত্রই মেয়েটি পরদা সরিয়ে বলল, নারানবাবু আসুন।
মহামায়ার কানের কাছে মুখ এনে নারান ফিসফিস করে বলল, টোলুবাবুর নাম লিখে দিয়েছিলাম, তাই সঙ্গে সঙ্গে কল এল।
মহামায়ার সামনে পরদার দিকে তাকিয়েই ছিলেন। তারা দুজন ঘরে ঢোকা মাত্র বললেন, টোলু কবে বলেছিল আপনাকে?
ডাক্তারবাবুর চাহনিতে ও স্বরে এমন কিছু ছিল যেজন্য নারান নমস্কার করতেও ভুলে গেল।
গত সোমবার, অফিসে কথা হয়েছিল। আমরা একই অফিসে কাজ করি। উনি বলেছিলেন, পাঁচটার সময় হাসপাতালের সামনে অপেক্ষা করবেন। আমাকে নিয়ে উনি আপনার কাছে এসেছিলেন একবার, চোদ্দো বছর আগে। সেদিনও তিনি ওইখানে আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে এবার আর আমার জন্য নয়, আমার স্ত্রীর…
বসুন। টোলুর পাঠাননা আপনিই বোধহয় শেষ রোগী।
কথাটা বুঝতে না পেরে নারান হাসল, টোলুবাবু তা হলে এখানে রোগী সাপ্লাই দেন! কিন্তু শেষ রোগী কেন? আর কি কাউকে পাঠাবেন না?
তার চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠতে দেখে ডাক্তারবাবু চোখ নামিয়ে ধীর স্বরে বললেন, কী জন্য এসেছেন বলুন।
উঁচু বেঞ্চে শুইয়ে এবং হাঁটিয়ে মহামায়ার হাঁটু পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু কোনও ওষুধপত্র দিলেন না। শুধু প্রতিদিন কয়েকটা ব্যায়ামের আর টানা আধঘণ্টা হাঁটার নির্দেশ দিয়ে, কী ভাবে হাঁটতে হবে সেটাও দেখিয়ে দিলেন।
আমরা ছটা পর্যন্ত ওঁর জন্য অপেক্ষা করেছি। যদি উনি এসে পড়েন তা হলে ওঁকে বলবেন যে..নারান থেমে গেল ডাক্তারবাবুর তোলা হাত দেখে।
টোলু আর আসবে না। এতক্ষণে ওর দাহ হয়ে গেছে।
নারানের মাথার মধ্যে কথাগুলো অর্থবহ একটা পরিষ্কার আকার নিয়ে ফুটে ওঠা মাত্র সে টেবলের কোনা আঁকড়ে ধরে ঝুঁকে, মুখ থেকে একটা শব্দ বার করল।
ভোররাতে ঘুমের মধ্যেই…আমিই ওর ডেথ সার্টিফিকেট লিখলাম।
নারান থরথর কাঁপছে। মহামায়া ওর একটা হাত চেপে ধরল। ডাক্তারবাবু বেল বাজালেন। পরদা সরিয়ে মেয়েটির মুখ উঁকি দিল।
পাঠিয়ে দাও।
নারান সম্বিৎ ফিরে পাবার আগেই দুজন পুরুষ ও মহিলা ঘরে ঢুকল।
বসুন…বলুন।
মহামায়াই হাত ধরে টেনে নারানকে বাইরে আনল। বেরিয়ে এসেই সে বলল, এভাবে অবাক করে দেবেন ভাবিনি।
এর পর আর সে একটিও কথা বলেনি। মহামায়া কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে চুপ করে গেছে।
ট্রেনে বসে নারান জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। বাইরে ঘোর অন্ধকার, সিগন্যালের লাল-সবুজ, মাঝে মাঝে বাড়ির আলো, রাস্তার আলো, স্টেশনে থামা, যাত্রীদের ওঠা-নামা, মোটরের হেডলাইট, ব্রিজের উপর ট্রেনের ঝম ঝম শব্দ…তার মনের মধ্যেও চলেছে রেলগাড়ি।..তাতে যাত্রী শুধু টোলুবাবু আর সে। টুকরো-টুকরো কথা, হাসি, রাগ, জল-খাওয়া, শোওয়া, নানানভাবে টোলুবাবুকে তার মনে পড়ছে। এক-একটা বছর যেন এক একটা স্টেশনের মতো। নারানের মনের রেলগাড়িও থামছে আর ছাড়ছে।
সোমবার শেষবারের মতো দেখা হল। আমার জীবনে জ্যাটোপেককে না দেখতে পাওয়ার মতো এত বড় দুঃখ আর কখনও পাইনি। কথাটা কি সত্যি? নারান মনে মনে প্রশ্ন করল টোলুবাবুকেই।
নারান সারপ্রাইজগুলো ঘাপটি মেরে থাকে। কখন, কোথায় যে লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে…।
টোলুবাবু শেষে আপনিই কিনা এই কাজ করলেন! আপনিই আমার বড় দুঃখ? কি আরও দুঃখ ঘাপটি দিয়ে রয়েছে? জীবনে তো অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ সইলাম, দেখলামও, কিন্তু এমন করে চমকে দেওয়ার মতো তো আগে কখনও পাইনি!
নারান জীবনে কোনটে বড় দুঃখ আর কোনটে ছোট দুঃখ, সে সবের হিসেব কষা। ছেড়ে দে। ওতে শুধু সময় নষ্ট আর মন খারাপ করা।
ঠিক বলেছেন টোলুবাবু, আমি আর মন খারাপ করব না। আপনাকে আমি ভুলেই যাব, আপনাকে আমি মন থেকেই মুছে ফেলব। নারান ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। পশে বসা মহামায়া তার মুঠোয় চেপে ধরল নারানের বাহুঁ।
ঘুম পাচ্ছে?
নারান চোখ তুলে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ।
.
ডাক্তারবাবুর দেখিয়ে দেওয়া ব্যায়াম শুরু করল মহামায়া আর উঠোনে এধার থেকে ওধার আধ ঘণ্টা হাঁটা। কিন্তু কয়েক দিন পরই তার বিরক্তি ধরল, একঘেয়ে লাগল ছোট জায়গায় এইভাবে হাঁটতে।
উঠোনে আর পারছি না, এবার রাস্তায় হাঁটব। মহামায়া একদিন নারানকে বলল।
পাকা রাস্তা তো একটা, বাস আর লরি অবিরাম চলেছে। হাঁটবে কোথায়? ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটলে তো চোট পাবে।
তুমি কাগজ বিক্রি করতে সাইকেলে যেতে যে রাস্তায়…
ওরে বাবা! সেটা তো আরও বিপজ্জনক! গত চোদ্দো বছরে তাতে দুবার ইট আর খোয়া পড়েছিল। সেসব কবে উঠে গিয়ে আবার গত্ত বেরিয়ে পড়েছে। তবে পঁয়ত্রিশ নম্বর হাইওয়ের থেকে এক দিক দিয়ে ভাল, গাড়ি কম যায়। ঠিক আছে, কাল থেকে ভোরবেলায় দুজনে বেরোব। তুমি হাঁটবে, আমি দৌড়ব। প্র্যাকটিসটা রাখা দরকার।
পরদিন ভোর পাঁচটায় তারা দুজন বাড়ি থেকে বেরোল। রেললাইন পার হয়ে হরিহর ভট্টচার্যের বন্ধ দোকানের সামনে নারান দাঁড়াল। এখন একশো ষাটটা কাগজ হরিহর নিচ্ছে। বিলি করার জন্য দুটো ছেলেকে রেখেছে। সেই পাঁচটা গ্রাম— শালকোনা, আন্দুলিয়া, ঝাউডাঙা, রঘুরামপুর, তুবড়িয়ায় সে একাই কাগজ বিলি করত, আর এখন কিনা লাগছে দুজন। নারান আত্মপ্রসাদ বোধ করল।
ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি। আবছা রাস্তাটার দিকে আঙুল তুলে সে মহামায়াকে বলল, এই রাস্তা দিয়ে বছরের পর বছর কাগজ নিয়ে গেছি আর ফিরেছি, প্রায় আটাশ মাইল..রোজ, একদিনও কামাই করার জো ছিল না, তা হলেই লোকে কাগজ পাবে না। চলো, হাঁটো।
হাঁটতে হাঁটতে নারান বলে যেতে লাগল, জায়গাটায় কী কী বদল ঘটেছে। কোন কোন দোকান আর বাড়িগুলো নতুন হয়েছে। কোথায় একটা সজনে গাছ ছিল, কোন নারকেল গাছটাকে এতটুকু দেখেছে, কোন পুকুরটা ইট-ভাটার জন্য মাটি কাটতে তৈরি হল। ভাগাড় ছিল, শকুনি বসে থাকত, এখন সেখানে ধান চাষ হচ্ছে।
কথা বলতে বলতে নারান তার স্বভাবগত জোরে হাঁটা শুরু করে দিল। মহামায়া বার বার পিছিয়ে পড়ে আর ছুটে নারানের পাশে আসে।
তুমি ছুটবে বলেছিলে, যাও ছোটো। আমি তোমার সঙ্গে হাঁটতে পারব না।
সেই ভাল।
নারান পা থেকে চটি খুলে দুহাতে নিল। মহামায়া হাত বাড়িয়ে বলল, চটি হাতে ছুটবে কী? আমায় দাও।
সেই ভাল।…তোমার তো আধ ঘণ্টা হাঁটার কথা? দশ মিনিট হাঁটা হয়ে গেছে! আরও দশ মিনিট হাঁটবে, তারপর ফিরে আসতে দশ মিনিট। ঠিক এইখানে অপেক্ষা করবে, আমি এখনি ঘুরে আসছি।
বিবর্ণ, গোড়ালির রবার ক্ষয়ে যাওয়া চটিজোড়া মহামায়ার হাতে দিয়ে, ধুতিটা একটু টেনে তুলে নারান ধীর গতিতে ছুটতে শুরু করল।
মহামায়া সামনে তাকিয়েই হাঁটতে হাঁটতে দেখল নারান ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে ছোট থেকে ছোট হয়ে। গাছপালা বাড়ির আড়ালে এক একবার অদৃশ্য হয়ে আবার বেরিয়ে পড়ছে। রাস্তাটা ডান দিকে ঘুরে ধানখেতের মাঝ দিয়ে শালকোনা গ্রামের দিকে গেছে। নারানকে সে আবার দেখতে পেল একই গতিতে ছুটছে।
পিছনে আকাশটা আলোয় ভরে উঠছে। পাখি উড়ছে। আনাজ নিয়ে গোরুর গাড়ি আসছে ধান্যকুড়িয়ার বাজারে। বাতাসে ভেসে রয়েছে মাটির গন্ধ। চারদিকে থমথমে স্তব্ধতা। মাথার উপর গাছের ডালে শালিক ডেকে উঠতে মহামায়া মুখ তুলে তাকাল আর তখনই একটা ইটের ডগায় হোঁচট খেয়ে সে পড়ি পড়ি হয়ে কোনওক্রমে টাল সামলাল।
তার চটির ফিতে ছিঁড়ে গেছে। এটা পরে আর হাঁটা সম্ভব নয়। দুহাতে দুজোড়া চটি নিয়ে মহামায়া আবার হাঁটতে শুরু করেই বুঝল, তার শরীর কষ্ট সহ্য করার যত ক্ষমতাই রাখুক না কেন, পায়ের তলার চামড়া তত রাখে না। কাঁকর আর ভাঙা ইটের টুকরো মাড়িয়ে হাঁটতে তার কষ্টই হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল নারানের ফিরে আসার জন্য।
মিনিট চল্লিশ পরে ছুটতে ছুটতে ফিরে এল নারান। মুখে ক্লান্তির চিহ্নমাত্রও নেই। মহামায়া কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, শালকোনার বটগাছটা ছুঁয়েই চলে। এলাম, দেরি হয়ে গেল,..তাড়াতাড়ি চলো, অফিস যেতে হবে…কটা বাজল?
ঘড়ি কোথায় পাব এই রাস্তার মধ্যে? বহু কষ্টে ধরে রাখা ধৈর্য মহামায়া আর ধরে রাখতে পারল না।
টেবিল-ঘড়িটা নিয়ে কাল বেরোব।
কাল আর বেরোনো হবে না, এই দ্যাখো। মহামায়া চটিগুলো হাত থেকে ফেলে দিল। নিজের চটি পায়ে গলিয়ে নারান বলল, কী হয়েছে?
ছিঁড়ে গেছে। খালি পায়ে এই রাস্তায় আমি হাঁটতে পারব না।
কই, আমার তো খালি পায়ে অসুবিধে হল না? কত লোকই তো খালি পায়ে…!
যারা পারে পারুক। মহামায়া ছেড়া চটি কুড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল।
হাঁটার জন্য কেডসই পরা দরকার। অফিস থেকে ফিরে তোমাকে নিয়ে আজই জুতোর দোকানে যাব।
হাতের একটা ঘড়িও কেনা দরকার। তা হলে সময়ের হুঁশ রেখে দৌড়তে পারবে।
অফিসে কো-অপারেটিভের লোনটা স্যাংশন হলেই কিনব।
রাতে মহামায়াকে নিয়ে বাজারের একমাত্র জুতোর দোকানটায় নারান যখন পেঁৗছল, তখন দোকান বন্ধের জন্য দরজার পাটা লাগানো হচ্ছে। দোকানি খদ্দের হাতছাড়া করতে চায় না। ওদের দুজনকে ভিতরে এনে বসাল।
নারান চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসল। তার পাশে বসল মহামায়া, খালি পা কাপড়ে ঢেকে। দোকানি নারানের পায়ের দিকে তাকাল।
কেডস দিন তো…আমার নয় ওর পায়ের।
কথাটা বলেই নারানের মাথার মধ্যে ঢং ঢং করে দমকলের গাড়ির মতো ঘণ্টা বেজে উঠল। তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। তার মুখ দিয়ে কার গলার স্বর, কার বলা কথা বেরোল!
টোলুবাবু!…চোদ্দো বছর আগে, কোলেবাজারের পাশে জুতোর দোকানে ঢুকেই ঠিক এই কথা বলে উঠেছিলেন।…টোলুবাবু আপনি এখনও বেঁচে আছেন? আমার বুকের মধ্যে আপনি!
…তুই এত পরিশ্রমী, তোকে দেখেও যে আনন্দ হয়!
…টোলুবাবু আপনাকে আমি আনন্দে রাখব, যতদিন বাঁচব আপনাকে…।
লিগ জেতার মতোই সুখ পাচ্ছি রে।
টোলুবাবু আপনার মোহনবাগান বছর বছর লিগ পাবে না, কিন্তু আমি আপনাকে সুখ দেব…।
টোলুবাবু, টোলুবাবু, বাস্তু ছেড়ে এসে নতুন বাস্তু বসিয়েছি, আমার পরিশ্রম করার ক্ষমতা আছে, আপনাকে আমি বাঁচিয়ে রাখব, আনন্দ দেব…আপনি দয়া করে আমাকে ছেড়ে যাবেন না, আমি ঠিক সময়েই আপনার কাছে পৌঁছব…চার মিনিট আঠাশ সেকেন্ডেই…
এ কী! তোমার চোখে জল, কাঁদছ কেন? কী হল? বিড় বিড় করে কীসব বলছ?
মহামায়া হাত ধরে ঝাঁকাতেই নারান ফ্যালফ্যাল করে দোকানদারের মুখের দিকে তাকাল, তারপর মহামায়ার দিকে। সম্বিৎ ফিরে আসতে, কাঁধের জামায় চোখ ঘষে সে শান্ত স্বরে বলল, চোখের জল মানেই কান্না নয়। ছেচল্লিশ বছর বয়সে পুরুষমানুষ কি কাঁদে?..নীল নয়, সাদা রঙের কেই আপনি দেখান।