নাড়ির টান
পাহাড়ি সর্পিল আঁকাবাঁকা পথে বিরাট লৌহদানবটা ছুটে চলেছে। চারপাশ জুড়ে নাম না জানা রঙ বাহারী ফুলের মেলা,পাহাড়ের গা’বেয়ে ফেনীর মতো সুন্দর ঝর্ণাধারা, অতিথি পাখির ঝাঁক নীলাকাশের বুক বেয়ে কোন অজানার দিকে ওড়ে চলেছে , দারুণ নৈঃসর্গিক দৃশ্যগুলি সারাদিন ধরেই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলো স্মৃতিময়।
গোধূলির অস্তরাগে দিবাকর সন্ধ্যারানীর পায়ের নিক্কণধ্বনি কান পেতে শুনেই সপ্তঘোড়ার রথে উঠে বসলো,পুঞ্জ মেঘেরা মিষ্টি হেসে অভিবাদন করে পথ ছেড়ে দিলো।দিবাকর যেতে না যেতেই সাঁঝ বেলাও হুমড়ি খেয়ে পড়লো,সন্ধ্যারানী তার ধূসর ওড়নায় অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী ঢেকে লাজুক হেসে ধরনীতে পা রাখলো। স্মৃতিময়ের অনুভবে স্মৃতির পাতা ওড়ে থাকে—
মা! কতোদিন সে মাকে দেখেনি! মায়ের আদর খায়নি,আর মায়ের হাতের আমসত্ত্ব,কুলের আচার! জিভে জল আসতে টাকরায় শব্দ করে ছেলেবেলার মতন।মনে পড়ে,জন্মদিনে মা সকালেই চান সেরে ঠাকুরপূজো দিতো,পায়েস,লুচি ,আলুর দম কতো কি! অমৃতের স্বাদ সবকিছুতেই,মায়ের হাতের স্নিগ্ধ পরশ টুকুই তো অমৃত
দীর্ঘ বারো বছর ।
হ্যা,ঠিক বারো বছর আগেইতো স্মৃতিময় ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলো।
তীব্র অভিমানে,ক্ষোভ আর নিজের প্রতি ধিক্কারেই পালিয়েছিলো কাউকে কিছু না জানিয়ে।
ভালো ছাত্র বলে সারা গা’জুড়ে সুনাম থাকা ছেলে স্মৃতিময়,কেরানী বাবার একমাত্র আশাও স্বপ্নের সঞ্চয় স্মৃতিময়,স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রদলের আশা স্মৃতিময় যখন দেখলো সে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মাত্র চারটে লেটার পেয়ে পাশ করেছে ,তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে,চোখের সামনে পৃথিবীর রূপ যেন নিমেষেই মুছে যায়।
বাবা,মা,পড়শীরা সকলেই বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ,স্মৃতিময় ঘরের দরজা বন্ধ করে উন্মাদের মতো পায়চারী করতে থাকে।
মা,বাবাও আশঙ্কায় কেঁপে উঠেন,না জানি কি সর্বনেশে কান্ড ঘটিয়ে বসে ছেলেটা।
বারবার বোঝাতে থাকেন,করোনা সান্ত্বনার কথা বলেন।
জবাবে একবার শুধু বলেছিল, ‘এ মুখ আমি আর কাউকে দেখাবোনা–‘–
সেদিন প্রচন্ড শীতের রাত।
গভীর রাতে চুপিসারে গৃহত্যাগ করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় স্মৃতিময়।
অনেক ঘাটের জল খেয়ে পৌছে গেলো একদিন সূদূর মুম্বাইতে।আত্মবিশ্বাসী,মেধাবী স্মৃতিময়ের অদম্য মনোবলেই জীবনে অর্জন করতে সক্ষম হয় সাফল্যের চাবিকাঠি।আজ সে প্রতিষ্ঠিত ,বিদেশী নামী কোম্পানীর চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার।আজ সে গাড়ি,বাড়ি সব করেছে।
এখন তার বড্ড সাধ ,বাবাও মাকে নিয়ে আসবে এখানে।কতোদিন সে বাবাও মাকে দেখেনি।কোন যোগসূত্র তো রাখেনি সে।এজন্য নিজেও কি কম কষ্ট পেয়েছে সে? প্রতিদিন মনে মনে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়েছে,যেদিন,’-তোমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো ,সেদিন আমি ফিরে যাবো,তার আগে নয়’।মায়ের জন্য দুধসাদা গরদ,আরো কতো কি কিনেছে ,বাবার জন্য ও,মাকে গরদখানাতে ঠিক দুগ্গা ঠাকুরুণটি লাগবে,ভাবতেই খুশিতে মন ভরে ওঠে ।
জানালার পাশে বসে থাকায় পাহাড়ি ঠান্ডার ঝাপটা লাগাতে গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নেয় স্মৃতিময়।
কু-কু-ঝিক-ঝিক শব্দের সরিয়ে দুলকি চালে প্রচন্ড
গতিতে ছুটছিল এক্সপ্রেস ট্রেনটি।
রাত তখন ক’টা ঠিক ঠাওর নেই, প্রবল ঝাঁকুনিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন স্মৃতিময় চমকে উঠলো ,কি ব্যাপার!
জানলার দিকে তাকাতেই বিস্ময়ের বুঝি সীমা থাকেনা ।
একি! মা! তুমি?এখানে—
সেই একই রকম লালপেড়ে ডুরে শাড়ি পরে,কপালে তীর্থময়ী সিদূরের মস্তটিপ! ঠিক যেন, লক্ষ্মী ঠাকরুণটি!
কিন্তু,মা এখানে এসময়ে ? জানলো কি করে ,যে সে আসছে? একেই বুঝি বলে মায়ের মন! মায়েরা যে জগজ্জননী! মায়ের দিকে আবারো তাকায় স্মৃতিময়।
আকুল হয়ে হাত বাড়িয়ে তাকেই ডাকছে মা,–শিগগির নেমে আয় বাবা,আমি তোকে নিতেই এসেছি,নেমে পড় এক্ষুনি, ওইতো কাছেই আমাদের বাড়ি,ভোর হয়ে এলো,নেমে পড় জলদি—
ভ্যাবাচ্যাকা স্মৃতিময় বিহ্বলের মতন ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়ে,মা ও ছেলেকে নামতে দেখে নিশ্চিন্তে হাঁটতে থাকেন হন্তদন্ত–
স্মৃতিময়ের মনে আবেগ উথলে উঠে,ওমা,এমন করে ছুটছো কেন গো? দাঁড়াও না, খুব রেগে আছো আমার উপর? জানো মা,তোমরা বুঝি ভেবেছিলে,আমি তোমাদের ভুলে গেছি? বিশ্বাস করো,একদিনের জন্য কিগো,একবেলার তোমাদের ভুলে যাইনি।বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি, ,ও মা,বাবা কেমন আছে গো?
মা একটু ফিরে তাকিয়ে মধুর হাসেন, তর সইছে না বুঝি? এতোদিন যদি অপেক্ষা করলি ,আরেকটু যে করতে হবে বাবা,সব জানবি বাড়ি তো চল্ ,তোর পছন্দের সব আমি তৈরী করেই রেখেছি ,জানিতো, তুই আসছিস-,তোর জন্মদিন যে কাল,আমিতো তাই তোকে নিতে চলে এলাম,দেরী করিসনে ,পা চালিয়ে চল্——-
হতবাক স্মৃতিময় বলতে যায়, কিন্তু আমিতো তোমাদের জানাইনি ,তাহলে?
স্মৃতিময়ের চিরকালের সাদাসিধে মা আবারো মুচকি হাসেন ,ধরেনে্ টেলিপ্যাথি—
ধাক্কা খায় এবারে দস্তুরমত,মা ইংরেজি শব্দ বললো! টেলিপ্যাথি! মা তো ইংরেজি জানেইনা ,হয়তো শব্দটা বাবার কাছে শুনে থাকবে। মাথা নীচু করে ভাবনায় খাবি খেতে খেতে মুখ তুলে মাকে কিছু বলতে গিয়ে অবাক স্মৃতিময়,একি! মা! মা কোথায়?আশেপাশে কোথাও মাকে দেখতে না পেয়ে বিভ্রান্তের মতো বাড়ির পথে ছুটতে থাকে–
ভোরের আলো ফুটে উঠছে।
দীর্ঘ বছর পরে বাড়ির সামনে এসে স্মৃতিময় চমকে উঠে।এতো ভোরেও বাড়ির সামনে,ভেতরে অনেক লোকের সমাবেশ।ব্যাপার কি! কারো অসুখ বিসুখ নয়তো? বাবা!বাবার কি?মা তো কৈ বলেনি?
-“— কে? স্মৃতি?এতো দেরী করে এলে বাবা? একটা দিন আগে এলেওতো–
স্মৃতিময়ের মাথা ঘুরে উঠে, হারুজেঠু না? কি হয়েছে জেঠু?
ভেতরে চলো ,দেখতে পাবে,এসো–
একে? এ কাকে দেখছে স্মৃতিময়? উঠোনে বাঁশের মাচায় বিছানাতে শুয়ে স্মৃতিময়ের মা! একি করে সম্ভব?
মা যে তাকে নিজে গিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনলো! কতো কথাই না বললো! তাহলে! কখন?
পিঠে আলতো স্পর্শে চমকে তাকায় স্মৃতিময়।
বাবা! একি চেহেরা হয়েছে বাবার? শরীর ভেঙে নুয়ে পড়েছে! এতোকিছু ঘটে গেছে তার অবর্তমানে, ভয়ানক অনুশোচনার গ্লানিতে দগ্ধ স্মৃতিময় অঝোরে কাঁদতে থাকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।