Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নব কলেবরে জগতের নাথ – জগন্নাথ || Manisha Palmal

নব কলেবরে জগতের নাথ – জগন্নাথ || Manisha Palmal

যিনি শ্রীবিষ্ণু যিনি পুরুষোত্তম কৃষ্ণ তিনিই ভক্তের মাঝে শ্রী জগন্নাথ। পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে শ্রীমন্দিরে তিনি শ্রী জগন্নাথ দারুব্রহ্ম রূপে পূজিত হন।
পুরাণে কথিত আছে শ্রীমতি রোহিণী যিনি শ্রীবলভদ্রদেবের গর্ভধারিণী , শ্রীকৃষ্ণের বিমাতা তাঁর কাছে কৃষ্ণের দুই পত্নী রুক্মিণী ও সত্যভামা একদিন কৃষ্ণের গোপলীলা সম্বন্ধে শুনতে চাইলেন। তিনিএই দীর্ঘ কাহিনীর এক নাটকীয় পর্ব বর্ণনার সময় সুভদ্রা কে দায়িত্ব দিলেন দ্বার প্রহরার। প্রায় তখনই শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম সেখানে উপস্থিত হলেন। তারা সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়েই মাতা রোহিণীর সামনে ঘরে প্রবেশ করলেন তাদের কানে এলো মাতা রোহিণীর মুখনিসৃত সেই বর্ণনা এত বিশুদ্ধ ছিল যে আবেগে কৃষ্ণ বলরাম সুভদ্রা র দেহ গলে গিয়ে দন্ডাকৃতির ধারণ করল। একইরকম রূপান্তর ঘটল শ্রীকৃষ্ণের হাতে ধরা সুদর্শন চক্রটির। এমন সময় শ্রী নারদ উপস্থিত হয়ে এই মুর্তি চারটি দর্শন করে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আবেদন রাখলেন কলিযুগের ভক্তদের জন্য এই চতুর্ধা মুর্তি রক্ষা করার—-যা পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে শ্রীমন্দিরে বিগ্রহরূপে বহুকাল ধরে পূজিত হচ্ছেন।
ভগবান শ্রী বিষ্ণুর অবতার ঠিক করলেন মানুষসহ জীবকুলের সবচেয়ে আপনজন হয়ে তিনি ভক্তদের কাছে ধরা দেবেন তাই জীবকুলের নশ্বর দেহ যেমন পরিবর্তন হয় নির্দিষ্টকাল পর ,তেমনি তিনিও পরিবর্তন করবেন তার দেহের— দেহং দেহী যথা জীর্ণং—-!
অবিনশ্বর আত্মা বা ব্রহ্মকে অক্ষুন্ন রেখে নির্দিষ্ট সময় অন্তর তিনি নবকলেবর ধারণ করবেন! একইসঙ্গে নবকলেবর নেবেন বলভদ্র সুভদ্রা ও সুদর্শন! সেই থেকে প্রতি বার বছর অন্তর শ্রীক্ষেত্র পুরীতে শ্রীবিগ্রহ নব কলেবরে প্রকটিত হন। এই নবকলেবর সাধন শ্রীভগবানের মানব লীলার এক সুন্দর উদাহরণ। নশ্বর মানব দেহ নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিবর্তিত হয়। শ্রী বিগ্রহ তিন ধরনের হয়– মনি বিগ্রহ যা পাথরের তৈরি এবং প্রায় অবিনাশী, রত্ন বিগ্রহ যা ধাতু বা অষ্ট ধাতু নির্মিত ও দারু বিগ্রহ যা কাঠ দ্বারা নির্মিত। শ্রী ক্ষেত্রে ভগবান স্বয়ং দারুরূপে প্রকটিত। ভবিষ্য পুরাণ মতে সকল সম্প্রদায় ও বর্ণের মানুষের জন্য পবিত্র হল নিম তাই সকলের ভগবান জগন্নাথের বিগ্রহ নিম কাঠ খোদাই করে করার বিধি চালু হয়। ভগবানের নবকলেবর ধরন সাধারণত 12 বছর অন্তর হলেও সব সময়ই এই নিয়ম ঠিক রাখা যায় না। 2015 সালে দীর্ঘ উনিশ বছর পর নবকলেবর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কলেবর ধারণ এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া যার সূচনা হয় “বনযাগ” যাত্রার মধ্য দিয়ে। প্রাচীন শাস্ত্রকার নীলাদ্রি মহাশয় এর বিধান অনুসারে যে বছর আষাঢ় মাসে দুটি পূর্ণিমা বা পুরুষোত্তম মাসের সঞ্চার হয় যাকে মল মাস বা অধিমাস বলে কি ভুল সেই সময়ে শ্রী দারুব্রহ্মের নবকলেবর উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। শাস্ত্র অনুসারে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের শুভ দিনে শুভ লগ্নে রাজার আদেশে(গুয়াটেকা) বিদ্যাপতি বংশীয় শবররাজ বিশ্বাবসু বংশীয় নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা পবিত্র দারুর অন্বেষণে অরণ্যে যাবেন। যজ্ঞের উপকরণ নিয়ে তাদের সঙ্গে যাবেন রাজার কোনো প্রতিনিধি চতুর্বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ রাজপুরোহিত এবং শিল্পবিদ্যা নিপুন শ্রেষ্ঠ সূত্রধর বা বিশ্বকর্মাগণ। বনযাগ যাত্রার নেতৃত্ব দেন সর্ব প্রবীনদয়িতাপতি ও প্রধান দয়িতাপতি। এদের কাজ হলো যে পবিত্র নিম গাছের কান্ড থেকে দারু বিগ্রহ গুলি নির্মাণ হবে সেগুলি দ্রুত চিহ্নিত করা। বনযাগদল টি প্রথমে দেউলি মঠে পৌঁছায় তারপরে কাকটপুরে মা মঙ্গলার মন্দিরে কিছু আচার-অনুষ্ঠান চলে। এখানে দয়িতাপতিরা অপেক্ষা করেন মায়ের স্বপ্নাদেশের। তারপরেই শুরু হয় দারু সংগ্রহ যাত্রা।বনযাগ দলপতি মা মঙ্গলা সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমে প্রায় 50 টি পবিত্র দারু চিহ্নিত করেন যা দিয়ে দারু মূর্তি নির্মাণ সম্ভব। কৃষ্ণপক্ষ শেষ হতেই জগন্নাথ মন্দিরের মুখ্য প্রশাসক চূড়ান্তরূপে ঘোষণা করে দেন নির্দিষ্ট কোন দারু থেকে সুদর্শনের মুক্তি নির্মাণ করা হবে। দারু চিহ্নত হতেই জগন্নাথ মন্দির প্রশাসন তাকে ঘিরে দেয়। এই গাছের চারপাশে পরিচ্ছন্ন করে গাছের কাছে তৈরি করা হয় দয়িতাপতিদের অস্থায়ী আবাস যা শবরপল্লী নামে পরিচিত।
গাছ চিহ্নিত করা হয় অনেকগুলি সুনির্দিষ্ট লক্ষণ দেখে। যেমন গাছের বিশেষ রং। সুতসংহিতা অনুসারে জগন্নাথের দারু কৃষ্ণাভ।বল ভদ্রের দারু শ্বেতাভ ও সুভদ্রা র দারু রক্তাভ। গাছের গায়ে খোদাই করা থাকে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম সর্প প্রভৃতি প্রতীক। গাছের ডালে সংখ্যা যেমন প্রত্যেকটি দারুর তিন পাঁচ বা সাতটি শাখা।নিম হলেও ওই গাছের স্বাদ কিন্তু স্বাভাবিক তিক্ত হবে না হবে ঈষ ত মিষ্টি। গাছে কোন ক্ষত থাকবেনা থাকবেনা কোন পাখির বাসা। গাছের গোড়ায় থাকবে বৃহদাকার বিষধর সাপের বাসা । যা সর্বক্ষণ গাছটিকে পাহারা দেবে ।অদূরে থাকবে উই ঢিপি।দারুর অবস্থান হবে তিনটি পর্বত তিনটি নদীর বা তিনটি পথের সংযোগস্থলে। দারু চিহ্নিত হবার পর তাকে ঘিরে যাগযজ্ঞ করা হয়। কোন ব্যক্তি দারু মনোনীত করতে পারেন না স্বয়ং ভগবান ই যোগমায়ার মাধ্যমে নিজ কলেবর সেবকদের জানিয়ে দেন।
প্রথমে সোনার কুঠার তারপর রূপার কুঠার সবশেষে লোহার কুঠার দিয়ে চিহ্নিত গাছটিকে কাটা হয়। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে এইসব কুঠার গুলি কিন্তু যেমন তেমন নয় এগুলি বিশেষভাবে নিযুক্ত সেবায়েতরা তৈরি করতেপারেন। কটকেরএঁরা বংশ পরম্পরা য় এই গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছেন। যারা দারু কাটেন তাদের বলা হয় বিশ্বকর্মা।দারু কাটার প্রক্রিয়া খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। কাটা কান্ড গুলি রেশম কাপড়ে মুড়ে পুরীর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কাঠ বয়ে নিয়ে যাওয়ার ও বিশেষ বিধি আছে। বট গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি চারকোনা কৃতি এক ধরনের গাড়িতে শুধু এই দারু বহন করা হয়। দারু বহনের সময় এই গাড়ির মাথায় ছাতা ধরা হয় ও চামর দোলানো হয়। স্হানীয় ভাষায় এটিকে “দারু বিজয় যাত্রা “বলা হয়! দারু শ্রী মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে দেওয়ার পর দয়িতাও বনযাগ দলের সদস্যরা সরলা মন্দিরে পৌঁছে যান ওই দারু বিশেষ ভাবে গ্রহণ করার জন্য।
প্রথমে শুরু হয় বল ভদ্রের বিগ্রহ নির্মাণের। ওই দারুতে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ছাড়াও হল চিহ্ন থাকে। সরলা মায়ের মন্দিরের পুরোহিত বলভদ্রবিগ্রহ নির্মাণের নিম দারু থেকে চন্দন এর মত সুগন্ধ পেয়ে থাকেন। সংগৃহীত দারু গুলিকে স্নানযাত্রার দিন প্রধান দয়িতাপতি নানা উপাচারে স্নান করিয়ে পবিত্র করেন। এবার ওই কাঠ দিয়ে চারটি বিগ্রহ খোদাই করে অলংকারে সুসজ্জিত করে রত্ন বেদীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠার আগে তাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে দারুব্রহ্ম বা আত্মা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। এই মুর্তি নির্মাণ করা হয় সকলের অলক্ষ্যে ওবন্ধ জায়গায়।
দারুব্রহ্ম পরিবর্তনের ক্রিয়াটি করা হয় চোখ বেঁধে কাউকে সাক্ষী না রেখে। বিষয়টি এইরকম যে ভগবানের দেহ পাল্টে ফেলা হলেও অবিনশ্বর আত্মার মতোই রয়ে যাবেন তাদের পুরনো দারুব্রহ্ম। প্রথমে ঘট পরিবর্তন করা হয় ।আষাঢ়ের কৃষ্ণাচতুর্দশীতে ভগবান পূর্বঘট পরিত্যাগ করে নব ঘটে অধিষ্ঠিত হন। সেদিন সন্ধ্যা 8 টা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত শ্রীমন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে। চতুর্দশীর দিন ঘট পরিবর্তনের জন্য নবকলেবর শ্রীমূর্তি চারটকে বিশ্বকর্মা মন্ডপ থেকে বড় দেউলের ভেতরে নিয়ে যান। বিগ্রহের পূর্ব কলেবরও নবকলেবর সামনাসামনি দেখে ব্রম্ভ স্থাপন করা হয়। “গুটিকোদর “জগন্নাথের উদরস্থ ব্রম্ভ নামক পদার্থটি বারোটি যব পরিমিত জায়গায় থাকেন। ওই স্থানকে বলে ব্রহ্মস্হলী। ব্রহ্ম চন্দন তুলসীতে নিমজ্জিত থাকেন। সেই তুলসী ও চন্দন 12 বছর কিংবা তারও বেশী কাল পরে অমলিন থাকে বলে ভক্তদের বিশ্বাস। চারজন পতি মহাপাত্র চারটি বিগ্রহের জন্য নিজেদের হাত-পা অতি সাবধানে বস্ত্রে ঢেকে চোখ ভালোমতো বেঁধে গোপনে পুরান বিগ্রহের উদর থেকে ব্রহ্মমনি বার করে নিয়ে নব কলেবরে ব্রহ্মা স্থলীতে স্থাপন করেন। সেই সময় নানা প্রকার দৈব উপদ্রব ঘটে এমন কি মৃত্যু ঘটে যাবার ভয় থাকে। নবকলেবর নিয়ে কিংবদন্তি হল যে যেসকল দয়িতাপতি ব্রহ্মমনি স্থাপন করেন তাদের দেহত্যাগ হয়ে যায়।
দয়িতাপতিরা এটি কে প্রভুর আশীর্বাদ বলে মনে করেন। ব্রম্ভস্হলীতে ব্রহ্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নবকলেবর ষোড়শোপচারে পূজিত হন।
অন্যদিকে পূর্ব বিগ্রহগুলিএবং তাদের ব্যবহৃত দ্রব্য সকল পার্শ্ব দেবতাগণ ও ঘোড়াগুলি কে মাধবনাট্যার মধ্যে স্থাপন করা হয়। লোকাচার অনুকরণে পূর্ব বিগ্রহ গুলির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও করা হয়। আষাড়ি কৃষ্ণাচতুর্দশী থেকে একাদশ দিনে শুক্লা নবমীতে নবকলেবর এর সঙ্গে “খড়িলাগি”বা শ্বেত অঙ্গ রাগ হয়। তারপর পূর্ণশ্রী অঙ্গরাগ হয়ে অমাবস্যার দিন শ্রী সিংহাসনে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব সমস্ত ভক্তের কাছে প্রকট হন। এটাকেই বলে শ্রী নবযৌবন বা নেত্র উৎসব।
প্রতিবছর স্নানযাত্রার পর রথের আগে জগন্নাথদেবের জ্বর হয়। অঙ্গরাগ বিহীন বিরূপ অবস্থায় 15 দিন কেউ তাদের দর্শন পাবেন না— মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের প্রতি শ্রীজগদীশের এমন ই আদেশ ছিল। এই পক্ষকালের জন্য তাঁরা অনবসরে যান বা ভক্তদের চোখের আড়ালে থাকেন। কিন্তু যেবারতিনি নবকলেবর ধারণ করেন সেবার এই অনবসর কালটি 45 দিনের জন্য দীর্ঘ হয়ে যায়। স্নানযাত্রা সময় স্নান করে জগন্নাথদেবের জ্বর হওয়া নরলীলার মাধুর্য বিস্তারের জন্যই প্রকাশিত হয়। নবকলেবর উৎসবের বিবরণ প্রতিবারই মাদলা পঞ্জীতে যুক্ত করা হয়। দেউলকররা মনে করেন শ্রী শ্রী দারুব্রহ্মের নবকলেবর প্রাকট্যলীলার উদ্দেশ্য হলো শ্রী ভগবানের স্বরূপশক্তি যোগ মায়ার মাধ্যমে সাধন, ভক্তগনের আনন্দবর্ধনও বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর কল্যাণ সাধন।
“জয় জগন্নাথ”!


তথ্যসূত্র- লোকভাষ
বিভিন্ন সংবাদপত্র
মাদলা পঞ্জি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *