প্রতি বছর মরশুম শুরুর আগে
প্রতি বছর মরশুম শুরুর আগে ক্লাব সদস্যদের মধ্যে একটা ম্যাচ খেলা হয়। সভাপতির একাদশ বনাম ননীদার একাদশ। ম্যাচ না বলে ফিস্ট বলাই ভাল। লাঞ্চের নামে হয় ভূরিভােজ। তারপর আর কারুর খেলায় উৎসাহ থাকে না, অবস্থাও থাকে না। মিষ্টি নরম রোদে ঘাসের উপর বেশির ভাগই গড়িয়ে পড়ে। রিজার্ভে যে ছেলেরা থাকে তারাই তখন খেলে।।
ননীদা খেলাটাকে প্রীতি-সম্মেলন হিসাবে দেখেন পঞ্চাশ ভাগ। পৃষ্ঠপোষকদের ততায়াজ করার জন্য পঁচিশ ভাগ রেখে, বাকি অংশটুকু নবাগতদের ট্রায়াল হিসেবে গণ্য করেন। সভাপতি হন তাঁর নিজের টিমের ক্যাপ্টেন, আর একদিকের ননীদা। ক্লাবের যাবতীয় কর্মকর্তা ও তাদের বাচ্চা ছেলেরা থাকে সভাপতির দলে আর জনা দশেক অতিরিক্ত নিয়মিত প্লেয়ার ও একজন উইকেটকিপার। খেলা শুরুর আধঘণ্টার মধ্যেই একে একে অতিরিক্তদের মাঠে ডাক পড়ে। ননীদার দলে থাকে নবাগত ছেলেরা ও ননীদার সমসাময়িক ও তদূর্ধ্ব বয়সি বিগত দিনের কয়েকজন প্লেয়ার।
যদিও দুটি দলের নামে একাদশ শব্দটি আছে, আসলে সেটা অষ্টাদশ কি ত্রয়োবিংশও হতে পারে। নির্ভর করে মাঠে খেলার আগে কজন হাজির হয়েছে। সদ্যস্যরা গেস্টও আনতে পারে, সেজন্য মাথাপিছু পাঁচ টাকা দিতে হয়। ভবানীর গেস্ট এবার মিনতি ওরফে মিনু; অফিসের দারোয়ান-ইন-চার্জ কাম রিসেপশনিস্ট গুপো রঞ্জনবাবু আমার গেস্ট। অফিসে যত লোক দেখা করতে আসে রঞ্জন সেনগুপ্ত তার শতকরা পাঁচজনকে ভিতরে যেতে দেয়। আশা করছি এরপর আমার সঙ্গে যারা দেখা করতে আসবে তারা ওই শতকরা পাঁচজনের অন্তর্ভুক্ত হবে। টপ কর্মকর্তারা, যারা বাৎসরিক মোটা দক্ষিণা দেয়, তাদের গেস্টদের জন্য চাঁদা নেওয়া হয় না। তাদের সঙ্গে আসে স্ত্রী-পুত্রকন্যারা।
ক্লাব প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও ননীদার হাতে। অর্থবান, যশোলোভী, ঈষৎ বোকা ধরনের, তোষামোদপ্রিয় লোক খুঁজে বার করে, তাকে নানানভাবে জপিয়ে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে (ননীদা বলেন, ট্যাকটিকস প্রয়োগ করে) মোটা টাকা আদায় করার দায়িত্ব ননীদাই এতকাল বহন করে আসছেন। এই টাকার উপরই ক্লাবের জীবন-মরণের অর্ধেক নির্ভর করে।
আগের প্রেসিডেন্ট ছিল কাউন্সিলার দুলাল দাঁ। ইলেকশনে হেরে গিয়ে ডোনেশন ছাঁটাই করে, ১/৬-এ নামিয়ে এনেছে। ননীদা প্রতিশ্রুত ছিলেন ইলেকশনে সি সি এইচ খাটবে। কিন্তু কাজের সময় লুচি-আলুর দমের বাক্স সংগ্রহ ছাড়া ছেলেরা আর কিছুই করেনি। এবার ননীদা নাকি শাঁসালো একজনকে পাকড়িয়েছেন। চাঁদমোহন শ্রীমানী টেস্ট ম্যাচের পাঁচটি টিকিট চেয়েছে, বিনিময়ে দেড় হাজার টাকা দেবে। ননীদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সি এ বি-তে তাকে কোনও একটা কমিটিতে ঢুকিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। শ্রীমানী, বলাই বাহুল্য, এ বছর আমাদের প্রেসিডেন্ট। গুড়, ঘি ও চালের আড়তদার, গোটা পাঁচেক রেশন দোকানের সে মালিক।
শ্রীমানীকে প্রথম দেখলাম এই খেলার দিন। গৃহিণী ও দুই ছেলেকে নিয়ে ওর মোটর পৌঁছতেই ননীদা ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। গাড়ি থেকে প্রথমে যখন শ্রীমানীর পা বেরোল, কে যেন পিছন থেকে আস্তে বলল, এ যে হাথি মেরা সাথি। পিছন ফিরে দেখলাম, তন্ময় আর গুটি চারেক নতুন ছেলে ফিক ফিক হাসছে। শ্রীমানী নামার পর হাঁফ ছেড়ে গাড়ির স্প্রিং এক ইঞ্চি উঁচু হয়ে গেল। শ্রীমানী-গিন্নি নামার পর আর এক ইঞ্চি উঠল। দুই ছেলে নামতে ৩/৪ ইঞ্চি আরও উপরে উঠল। গাড়িতে রয়েছে পাঁচ বাক্স সন্দেশ, পাঁচ হাঁড়ি দই, এক ঝুড়ি কমলালেবু। সেগুলো নামানো হল না। ননীদা বললেন, গাড়িতে চাবির মধ্যে থাকুক। লাঞ্চের সময় বার করব। এখন টেন্টে নিয়ে গিয়ে রাখলে কিছু বাকি থাকবে না।
কেন, ক্লাবে বুঝি চোর-ফোর খুব আছে! শ্রীমানী বলল। মনে হল বাঘ ডাকছে। ননীদা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ছেলেপুলেরা একটু দুষ্টু হয়ই, বোঝেনই তো, হেঁ হেঁ হেঁ, চুরি করে খেতেই ওদের ভাল লাগে। কিন্তু চোর ওরা নয়।
নয় যে, বুঝলেন কী করে? ক্রিকেটাররা বুঝলেন, রিলেতে শুনেছি, খেলতে খেলতে মাঠের মধ্যেই চুরি করে। পুষ্পেন সরকারকে পরিষ্কার বলতে শুনেছি অম্বর রায় একটা রান চুরি করল এই ফাঁকে। বুঝুন, মাত্র একটা রান, কতই বা তার দাম। কিন্তু লোভ সামলাতে পারল না। শ্রীমানী-গিন্নি ক্ষুব্ধস্বরে বলল।
শ্রীমানী-পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে টেন্টের দিকে এগোতে লাগলাম। ননীদা আমায় চোখ টিপলেন। মুখে গদগদ ভাব এনে শ্রীমানীকে বললাম, আপনি যে ক্রিকেট খেলতেন তা আপনার হাঁটা দেখেই বোঝা যায়।
এখন একটু মোটা হয়ে গেছি, শ্রীমানীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একসময় দারুণ খেলতাম। খালি ছক্কা মারতাম। বল মাটিতে পড়ার আগেই পাঁচ হাত বেরিয়ে হাঁকড়াতাম। তখন অনেক রোগা ছিলুম। আমায় নামতে দেখলেই ফিল্ডাররা আপনা থেকেই বাউন্ডারির ধারে সরে যেত।
আজ তা হলে আপনার ছক্কা দেখা যাবে। বলতে যাচ্ছিলুম দেখার সৌভাগ্য হবে, কিন্তু তন্ময়দের দলটা কাছেই থাকায় বলতে পারলাম না।
ভাল বোলার আছে কি? ফাস্ট বোলার? ব্যাঘ্রকণ্ঠে শ্রীমানী বলল। ফাস্ট বল হলে আমি ঠিক ভাল খেলতে পারি না।
ননীদার দিকে তাকালাম সঠিক ট্যাকটিসের জন্য। ননীদা ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে, খুব বিষণ্ণ গলায় বললেন, ফাস্ট বোলার! নাহ আমাদের ক্লাবে নেই। কোথাও নেই, না বেঙ্গলে না ইন্ডিয়াতে। তাই তো ভাল ব্যাটসম্যানও পাওয়া যাচ্ছে না। আপনাদের আমলে বাঘা বাঘা বোলার ছিল তাই আপনারাও বাঘের মতো ব্যাট করেছেন।
ঠিক ঠিক। এখন বোলাররা ইঁদুর, তাই ব্যাটসম্যানরা ইঁদুর হয়ে গেছে। শ্রীমানী গর্জন করে উঠল।
আপনারা যদি একটু ইন্টারেস্ট নেন তা হলে আবার নিশ্চয় ফাস্ট বোলার পাব। মাঝে মাঝে আপনি যদি আমাদের ম্যাচগুলোয় নামেন তা হলে আপনার হাঁকড়ানোর ঠেলা খেয়ে বোলাররা জোরে বল করার জন্য ইস্পায়ারড হবে।
বুঝলেন ননীবাবু, আমার খুবই খেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ব্যবসায় এত টাইম দিতে হয় যে— ইঞ্জিনের স্টিম ছাড়ার মতো শ্রীমানীর দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
সব থেকে মজবুত লোহার চেয়ারটা দেখিয়ে ননীদা ওকে বললেন, আপনি বিশ্রাম করুন। আর লোহার চেয়ার ছিল না। দৌড়ে টেন্ট থেকে আর একটি শ্রীমানী-গিন্নির জন্য আনলাম। দুটো আঙুল দিয়ে চেয়ারটার বসার জায়গা টিপে পরীক্ষা করে তিনি বসলেন।
সারসের মতো গলা ও ঠ্যাং নিয়ে ভাইস-প্রেসিডেন্ট অ্যাটর্নি মাখন দত্ত সস্ত্রীক হাজির হলেন। বছরে ইনি ত্রিশ কিলো আলু, দশ কিলো মাংস, পঞ্চাশ পাউন্ড পাউরুটি ও পাঁচ কিলো সরষের তেল দেবেন। ওঁর জন্য বরাদ্দ দুটি টেস্টম্যাচ টিকেট। দত্ত-গিন্নিকে বসালাম শ্রীমানী গিন্নির পাশে। মাখন দত্ত, শোনা যায় কলেজ টিমে দু-চারবার খেলেছে।
কতকগুলো গোপন নিয়ম এই ম্যাচের জন্য স্থির করা আছে। খেলার দুই আম্পায়ার, স্কোরার এবং আমার মতো পুরনো দু-একজনই তা জানে। নিয়মগুলি ননীদার তৈরি। খেলার প্রথম একঘণ্টা আমি স্কোরার। শাঁসালো কেউ শূন্য রানে কোনওক্রমেই যাতে আউট না হয়, সেটা দেখবে আম্পায়ার। স্কোরারের কাজ দশকে পনেরো এবং পনেরোকে কুড়ি করা। বাই রান খুব সাহায্য করে টোটালকে তিরিশ-চল্লিশ রান বাড়াতে।
ভবানী আজ খুবই ব্যস্ত। শ্রীমানী একাদশের বিপর্যয় রোধ করার দায়িত্ব আজ তার ঘাড়ে। মিনুকে সে দত্ত-গিন্নির পাশে বসিয়েছে। শ্রীমানী নিজে ব্যাটিং অর্ডার করেছে। ভবানীকে রেখেছে দ্বাদশ স্থানে। তাই নিয়ে ভবানী খুবই অসন্তুষ্ট। অত দেরি করে নেমে কী খেলা সে মিনুকে দেখাবে? একটা লেমনেড মিনুর হাতে দিয়ে সে হাত নেড়ে কী সব বলছে। কানে এল ওর গলা, ভাল রিলায়েবল্ ব্যাটসম্যানরাই শেষদিকে থাকে। যখন গোড়ার দিকে ফেল করে তখন তারা আটকায়। যেমন সোবার্স এখন ছয়-সাতে নামছে।
মিনু বলল, শুনেছি ব্র্যাডম্যান তিন নম্বরে নামত।
নামবে না কেন, ওদের তো এগারো নম্বরও সেঞ্চুরি করতে পারে। আমাদের টিমে সেরকম কেউ তো আর নেই। তাই আমাকে—
শ্রীমানী-গিন্নি কটমট করে তাকিয়ে আছে দেখে ভবানী থমকে পড়ল।
তোমাদের টিমের ক্যাপ্টেনটা ঠিক রোড রোলারের মতো। দৌড়বে কী করে, রান আউট হয়ে যাবে যে! মিনু হাসতে হাসতে ঠোঁটে ঔ চেপে ধরল।
শ্রীমানী-গিন্নির দিকে তাকিয়ে ভবানী বলল, আমি চট করে রান্নার দিকটা একবার দেখে আসি। তুমি বরং এখানে থাকো। বলতে বলতে ভবানী টেন্টের পিছন দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শ্রীমানী-গিন্নি একটু চেঁচিয়েই দত্ত-গিন্নিকে বলল, ক্রিকেট মাঠে আজকাল, বুঝলেন দিদি, বড় আজেবাজেরা খেলা দেখতে আসে। এমন সব মন্তব্য তারা করে যে খেলা দেখাই দায় হয়ে ওঠে। চলুন আমরা বরং ওধারটায় বসি।
সেই ভাল। দত্ত-গিন্নি উঠে দাঁড়ালেন।
ওরা এসে স্কোরারের টেবলের পিছনে একটা বেঞ্চে বসল।
ননীদা টসে জিতে সভাপতির দলকে ব্যাট করতে দিলেন। লাঞ্চের পর খেলার ইচ্ছা ওদের থাকে না বলেই, সভাপতির দলকেই প্রথমে ব্যাট করতে দেওয়া হয়। প্রথমে ব্যাট করতে নামল মাখন দত্ত আর পন্টু চৌধুরী। নামার আগে শ্রীমানী দুজনকে জানিয়ে দিল, তাড়াহুড়ো করবেন না। দেখে দেখে খেলবেন, বলের পালিশ উঠলে তবেই সামান্য হাত খুলবেন। তারপর আমি তো আছিই।
নতুন একটি ছেলেকে ননীদা বল করতে দিয়েছেন। প্রবল উৎসাহের জন্যই ওর। প্রথম বলটি ফুলটস হয়ে গেল। মাখন দত্ত ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যাবার সময় ব্যাটটিকে হাতপাখার মতো সামনে একবার নেড়ে দিল। ব্যাটে লেগে বলটি শিপে দাঁড়ানো তন্ময়ের পাশ দিয়ে তিরবেগে থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে পৌঁছল। হই হই করে উঠল দর্শকরা। ব্যাঘ্র গর্জন উঠল, তাড়াহুড়ো নয়, বি স্টেডি।
দত্ত-গিন্নি পুলকে লাল হয়ে শ্রীমানী-গিন্নিকে বলল, বিয়ে হওয়ার পর এই প্রথম ব্যাট ধরলেন।
তাই নাকি, ওমা! দেখে তো মনে হল না। শ্রীমানী-গিন্নি বিস্ময় প্রকাশ করল। উনিও বড়ছেলে হবার পর আর মাঠমুখো হননি। খেলার কোনও জিনিসই তো আর নেই, তাই আর্জেন্ট অর্ডার দিয়ে প্যান্ট জামা বুট করালেন। কী যে শখ!
মাখন দত্তর অফ স্টাম্প ঘেঁষে পর পর দুটি বল বেরিয়ে যাওয়া মাত্র ননীদা বোলারের কাছে গিয়ে কী যেন বললেন। ছেলেটি অবাক হয়ে কী যেন বলতে গেল কিন্তু ননীদা তা শোনার জন্য অপেক্ষা না করে শর্ট লেগে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন না।
পরের তিনটি বল লোপ্পাই ফুলটস এবং লেগস্টাম্পের বাইরে। মাখন দত্ত হুমড়ি খেয়ে তিনবার ঝাড় দিলেন, ব্যাট বলে লাগল না। পরের ওভারে ননীদা বল নিলেন। ভাল লেগব্রেক করাতেন, এখনও পারেন, পন্টু চৌধুরীকে দুটি বল অফ স্টাম্পের বাইরে লেগব্রেক করালেন। শ্রীমানীর নির্দেশ ভুলে গিয়ে পন্টু চৌধুরী ব্যাটটাকে ছিপের মতো বাড়িয়ে রইল। বল ব্যাটে লেগে তিনবারই পয়েন্টের দিকে গেল।
ইয়েয়েস, মাখন দত্ত রান নেবার জন্য দৌড়ল, তন্ময় শ্লিপ থেকে ছুটে গিয়ে ব্যাকোয়ার্ড পয়েন্ট থেকে বলটা কুড়িয়ে সোজা উইকেটকিপারের গ্লাভসে বল পাঠাতেই সে উইকেট ভেঙে দিল। মাখন দত্তের তখন ক্রিজে পৌঁছতে চার হাত বাকি।।
হাউউউজ দ্যাট! কোরাসে আবেদন হল।।
দ্বিধাহীন কণ্ঠে স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার হাবলোদা বলল, নট আউট।
নতুন ছেলেরা এমন ডাহা অন্যায়ের প্রতিকার প্রার্থনার ভঙ্গিতে ননীদার দিকে তাকাল। ননীদা বললেন, বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছে আম্পায়ার।
চার হাত বাইরে, এতে কোনও ডাউট থাকতে পারে?তন্ময় বিরক্ত হয়ে বলল।
ননীদা কথাটা শুনেও শুনলেন না। তন্ময় বিরক্ত হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে স্লিপে দাঁড়িয়ে রইল। এই ম্যাচের গোপন নিয়মগুলো তন্ময়ের জানার কথা নয়। জানলে হয়তো এভাবে রাগ দেখাত না। সি সি এইচ-এর মতো ছোট ছোট ক্লাবগুলো কাদের দয়ায় চলে সে কথা যেদিন জানবে, সেদিন ও নিশ্চয় ক্লাবকে ভাল না বেসে পারবে না।
এক ঘণ্টা খেলার পর সভাপতি দলের স্কোর পাঁচ উইকেটে ৮১। মাখন দত্ত ৩১ নট আউট। যে পাঁচজন আউট হয়েছে তার মধ্যে ভুলু গোঁসাই একডজন বল দেয়, বিকাশ মাইতি দেয় একশো টাকা। গোঁসাইকে ২০ আর মাইতিকে ২৫ রানের মাথায় আউট দেওয়া হয়েছে। হাবলোদা আর পটাবাবু এ পর্যন্ত নির্ভুল আম্পায়ারিং করে চলেছে। তারা দুজনে এগারোটা এল বি ডব্লু, সাতটা রান আউট, নটা স্টাম্পিং ও তিনটে ক্যাচ আউটের আবেদন নাকচ করেছে। ঠিক করা আছে শ্রীমানীকে হাফ সেঞ্চুরি করাতেই হবে, নয়তো পরের বছর ওকে প্রেসিডেন্ট পদে ধরে রাখা যাবে না।
পঞ্চাননদা এসে আমার কানে কানে বললেন, পোলোয়া চড়ানো হল এখন, তারপর চাটনি।
ঘড়ি দেখে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। চাটনি নামলেই লাঞ্চ। বড় মন্থরগতিতে রান উঠছে, এতক্ষণে মাত্র পাঁচটি উইকেট পড়েছে। অথচ লাঞ্চের আগেই শ্রীমানীকে অন্তত হাফ-সেঞ্চুরি করিয়ে দিতে হবে। ব্যাটিং অর্ডারে সে নিজেকে রেখেছে। ভবানীর আগে, এগারো নম্বরে। নবম উইকেট না পড়লে শ্রীমানী নামছে না, তার মানে দুটোর আগে নয়। কিংবা আড়াইটেও বাজতে পারে, কেন না আর এক ভাইস প্রেসিডেন্ট দয়াশঙ্কর যোশির (তিন জোড়া প্যাড) আট বছরের পুত্র আট নম্বরে। তাকে ১৫ রান করাতেই হবে।
ভাবলাম শ্রীমানীকে বলি, আপনি ৯ নম্বরে এসে লাঞ্চটাকে তাড়াতাড়ি করিয়ে দিন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ব্যাটিং অর্ডার তৈরি করার সময় নিজের নামের পাশে ১১ লিখে শ্রীমানী বলেছিল, তলার দিকে নিজেকে রাখলুম কেন বলুন তো? ননীদা এবং আমি তখন, বাঘ মিউ না করে হালুম করে কেন, এমন এক প্রশ্নের জবাব খোঁজার মতো মুখ করে তাকিয়ে ছিলাম। শ্রীমানী মুচকি হেসে বলেছিল, যদি ঝরঝর করে উইকেট পড়ে তা হলে আটকাবে কে? ওর বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতায় স্তম্ভিত আমার মুখের দিকে ননীদা সপ্রশংস চোখে তাকিয়েছিলেন। তখন ভবানী কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিনুকে এগিয়ে আসতে দেখে রান্নার দিকটা একবার ঘুরে আসি বলে দ্রুত মিলিয়ে যায়।
শ্রীমানীকে বিপর্যয়রোধের সুযোগ দেওয়া ও লাঞ্চকে ত্বরান্বিত করার জন্য মাঠে ননীদার কাছে চিরকুট পাঠালাম—পোলাও চড়েছে। সভাপতিকে নামাবার ব্যবস্থা করুন।
চিরকুট পাঠাতে ননীদা হাত তুলে বোঝালেন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। দুটি টুঙ্কি দিয়ে শিপ থেকে তন্ময়কে ডেকে এনে, হাতে বল তুলে দিলেন। তারপর আম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে মাথাটা হেলালেন। হাবলোদাও একই ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন। দুর্যোধনকে ডেকে আমি বললাম, কলাপাতা, খুরি, গেলাসগুলো এবার ধুয়ে রেডি করে রাখ।
হঠাৎ চোখে পড়ল আমার গেস্ট গুপো রঞ্জনবাবু আসছে। কাঁধে একটা ক্যামেরা ঝুলছে। আমায় দেখে একগাল হেসে বলল, ক্যামেরাটাও আনলুম। ক্রিকেটের ছবি তোলা আমার দারুণ হবি। ভাল অ্যাকশন পেলে তুলব। লাঞ্চের কদূর?
বললাম, খুব শিগগিরই। মাথায় তখন একটা আইডিয়া এসে গেছে। শ্রীমানীর ছবি তুলে প্রেজেন্ট করলে কেমন হয়! নেটটা একদম অচল হয়ে গেছে। নতুন একটা কি খুশি হয়ে দেবে না?
রঞ্জনবাবু, দারুণ অ্যাকশন পাবেন যদি ওই লোকটার ছবি তোলেন।
কোন লোকটা বললেন? ওই মোটা হোঁদল কুতকুতের?
আস্তে, রঞ্জনবাবু আস্তে। বলেই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি শ্রীমানী-গিন্নি রঞ্জনবাবুকে দেখছে।
আরে দূর মশাই, অমন মোটার আবার অ্যাকশন! ফরোয়ার্ড খেললে তো হাতির মতো দেখাবে, ব্যাক খেললে গণ্ডার মনে হবে।
প্লিজ রঞ্জনবাবু, ছবি চাই না, চুপ করুন।
আরে দূর মশাই, ভাল সাবজেক্ট পাব বলে ক্যামেরাটা— রঞ্জনবাবু থেমে গিয়ে চোখ দুটো সরু করে টেন্টের পিছন দিকে দৃষ্টি পাঠিয়ে দিল। প্যাড পরে ভবানী গদগদ হয়ে মিনুকে কী বলছে। মিনুর হাতে ভবানীর ব্যাট। সে ব্যাটটা দোলাতে দোলাতে ভবানীর কথা শুনছে।
দ্যাটস এ গুড আনন্দবাজার রবিবাসরীয়র সাবজেক্ট। বলেই ক্যামেরা বাগিয়ে রঞ্জনবাবু কুঁজো হয়ে শিকারির মতো এগোল। শ্রীমানী-গিন্নি জ্বলন্ত চোখে রঞ্জনবাবুকে লক্ষ করে যাচ্ছে।
শ্রীমানী ব্যাট করার জন্য তৈরি হয়ে হাজির। স্ত্রীর কাছে গিয়ে বলল, ওগো, গাড়ি থেকে সন্দেশ, দই, লেবুগুলো আনিয়ে রাখো।
আনবখন। শ্রীমানী-গিন্নি মন্দ্রকণ্ঠে ঘোষণা করল।
শ্রীমানী কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই মাঠ থেকে ননীদার বিকট চিৎকার উঠল, আউজাট? পটাবাবু কট অ্যান্ড বোল্ড হওয়া মাখন দত্তকে বিদায় সঙ্কেত জানাতে এবার আর দ্বিধা করল না। ৩১ রানেই ডগমগ হয়ে মাখন দত্ত ফিরল।
ওয়েল প্লেড, শ্রীমানী তারিফ ছুড়ে দিল।
আমি বললাম, মিস্টার শ্রীমানী, আপনাকে কিন্তু কয়েকটা ছক্কা আজ দেখাতেই হবে।
হাই তুলে শ্রীমানী মুখগহ্বরের ফটকে কয়েকটা তুড়ি দিয়ে বলল, ফাস্ট বোলার তো তেমন দেখছি না। ছক্কা মারব কাকে?
আমি মাথা চুলকে সরে এলাম। পরের ওভারেই দুটি উইকেট পড়ল। শ্রীমানী গ্লাভস পরতে শুরু করল। সভাপতির দল আট উইকেটে ৯৭। তন্ময়ের ওভারের প্রথম বলেই নবম উইকেটের অফ স্টাম্পের বেল উড়ে গেল। শ্রীমানী উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল।
চাঁদমোহন শ্রীমানী মন্থর গতিতে উইকেটে পৌঁছল। তন্ময় কোমরে হাত দিয়ে একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে। ননীদা লেগ ও অন থেকে যাবতীয় ফিল্ডসম্যান সরিয়ে অফে পাঠাতে শুরু করলেন। সাবধানের মার নেই। ফট করে কেউ ক্যাচ ধরে ফেলতে পারে। তারপর তন্ময়কে ডেকে কানে কানে কী বললেন। বাধ্যের মতো তন্ময় মাথা নাড়ল।
শ্রীমানী মিনিট চারেক ক্রিজের চার বর্গগজ এলাকা গভীর মনোেযোগে ঘাড় হেঁট করে পরীক্ষা করল। গুটি চারেক কাঁকর আবিষ্কার করে খুঁটে তুলে ফেলে দিল। ব্যাট দিয়ে কয়েকটি স্থান দুরমুশ করে ক্রিজে দাঁড়িয়ে গার্ড চাইল, ওয়ান লেগ। হাবললাদা নিখুঁত গার্ড দেবার জন্য মিনিট পাঁচেক সময় নিল। তারপর বুটের ডগা দিয়ে ক্রিজে দাগ কেটে শ্রীমানী শুরু করল ফিল্ড প্লেসিং নিরীক্ষণ। তাও হয়ে যাবার পর স্টান্স নিল।
তন্ময় এতক্ষণ বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখছিল। এবার বল করার জন্য ছুটতে শুরু করল এবং যখন মধ্যপথে, শ্রীমানী উইকেট থেকে তাড়াতাড়ি দু-পা পিছিয়ে গেল।
কী ব্যাপার! সকলের চোখ সাইট স্ক্রিনের দিকে ফিরল। দুর্যোধনের কুকুরটা সেখানে ঘাড় চুলকোতে ব্যস্ত।
হাবলোদা হেট হেট করে ছুটে যেতেই, বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে কুকুরটা লং অফ বাউন্ডারির দিকে সরে গেল। শ্রীমানী আবার চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে তৈরি হয়ে দাঁড়াল। মুখে মৃদু হাসি।
অদ্ভুতভাবে তন্ময়ের অফ কাটারটা আধহাত বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকে শ্রীমানীর অফ স্টাম্পটাকে শুইয়ে দিল। বেচারা শ্রীমানী। যে কোনও প্রথম শ্রেণীর ব্যাটসম্যান ওই বল সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাবে।
দর্শকদের গুঞ্জন থেমে গেল। শ্রীমানী ফ্যালফ্যাল করে শায়িত স্টাম্পটির দিকে তাকিয়ে। তন্ময়ে কোমরে হাত রেখে হাসছে। ননীদা শুধু আম্পায়ারের উদ্দেশ্যে মাথাটা দুবার নাড়লেন।
নো বল।
চমকে সবাই তাকিয়ে দেখল, হাবললাদা নির্বিকার মুখে ডান হাতটি ট্রাফিক পুলিশের মতো বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রীমানী ক্রিজ থেকে রওনা হয়েছিল, দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিল্ডাররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তন্ময় ঘুরে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চোখে হাবলোদার দিকে তাকিয়ে বোলিং মার্কে ফিরে গেল।
শ্রীমানী ক্রিজে দাঁড়িয়ে উইকেটকিপারকে বলল, নো বলটা ডাকতে লেট না হলে একটা ছক্কা দেখাতুম।
পরের বল সোজা কপাল টিপ করা। শ্রীমানী মুখের সামনে ব্যাটটা তোলার সময়টুকু মাত্র পেয়েছিল। বলটা কনুইয়ে লাগতেই খটাং শব্দ হল।তারপর টাল সামলাতে না পেরে ঘুরে পড়ল উইকেটের উপর। মড়াৎ করে স্টাম্প ভাঙার শব্দ হল। তন্ময় ঘুরে দাঁড়িয়ে আম্পায়ার হাবলোদাকে বলল, নো বঅঅল।
মাঠের মধ্যে সর্বাগ্রে ছুটে গেল ক্যামেরা হাতে রঞ্জনবাবু, তারপর আমি। শ্রীমানীকে আটজন চ্যাংদোলা করে যখন আনছে, শ্রীমানী-গিন্নি রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এল।
দারুণ সাবজেক্ট মতিবাবু, দারুণ! স্ন্যাপ নিতে নিতে রঞ্জনবাবু মহাফুর্তিতে বলে উঠল।
খপ করে শ্রীমানী-গিন্নি ক্যামেরাটা ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে বলল, নিকুচি করেছে তোর সাবজেক্টের। হতভাগা মিনসে ছবি তোলার আর জিনিস পেল। যা না মুখপোড়া ওই ফড়িংয়ের মতো মেয়েটার ফস্টিনস্টির ছবি তোল না গিয়ে।
রঞ্জনবাবু নির্বাক। আমরা সবাই কী বলব বা করব ভেবে পাচ্ছি না। তন্ময় শান্ত গলায় বলল, এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যান, বোধহয় কনুইয়ের হাড় ভেঙেছে।
সপরিবারে শ্রীমানীকে গাড়িতে তুলে ননীদা পি জি হাসপাতালে রওনা হলেন। আমরা মুহ্যমান হয়ে নিচু গলায় কথা বলছি। দুর্যোধন এসে বলল, পাতা পাতি দিব কি?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। এরপর আর খেলার দরকার কী! রঞ্জনবাবু ক্যামেরার ভাঙা টুকরোগুলো হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে বলল, মতিবাবু, আমার দামি ক্যামেরাটা আপনার জন্য ভাঙল।
আমার জন্য! নিশ্চয়। আপনিই তো বলেছিলেন হোঁদলকুতকুতটার ছবি তুলতে। রঞ্জনবাবুর গলা ভারী হয়ে এল। কয়েক ফোঁটা জল চোখ থেকে নেমে গোঁফ ভিজিয়ে দিল। আমার তখন একটা কথাই মনে হল, অফিসের দরজা দিয়ে হাতি ঢুকে গেলে রঞ্জন সেনগুপ্ত তাকাবে না, কিন্তু আমার পরিচিত একটি মাছিকেও আর গলতে দেবে না।
ভবানী ভীষণ মনমরা হয়ে বলল, এখুনি লাঞ্চ করার দরকার কী, আমার ব্যাটিংটা হয়ে গেলেই তো হতে পারত। মিনুর আবার কবে মাঠে আসার সময় হবে কে জানে।
লাঞ্চের সময় তন্ময় বলল, সরি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দই সন্দেশ লেবুও গাড়ি করে চলে যাবে এটা একদম ভাবিনি। লাঞ্চটা আমিই মাটি করে দিলুম।
কিন্তু সি সি এইচ-এর কী ক্ষতি হল, সেটা আমার মতো দু-চারজন ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারল না।