নদীর নাম কর্মনাশা
ভারতবর্ষ নদী মাতৃক দেশ। সেই বৈদিক কাল থেকেই গঙ্গা যমুনা গোদাবরী সরস্বতী নর্মদা সিন্ধু এবং কাবেরী এই সাতটি নদী শাস্ত্রমতে অতি পবিত্র ; এই নদী গুলিতে স্নানে পুণ্যার্জন ও সকল পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয়। এছাড়াও এইসব নদীর জল পান যোগ্য এবং সকল প্রকার গ্রাহস্থ কর্মে ব্যবহার যোগ্য। কিন্তু ভারতবর্ষে এমন চারটি নদী আছে অভিশাপগ্রস্ত ; তার জলে কোন পুণ্য কাজ তো হয়ই না এই সব নদীর জল মানুষ স্পর্শ করতে ও ভয় পায়।
কোশী নদী হিমালয়ে উৎপত্তি হয়ে বিহারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভাগলপুরের কাছে গঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীতে প্রতি বছর বন্যায় বহু মানুষ গবাদিপশু ও বন্য জীবজন্তুর মৃত্যু হয়। এবং কৃষি সম্পত্তির প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় এই নদীকে বিহারের অভিশাপ বলা হয়।
চম্বল নদী মূলত মধ্যপ্রদেশের চম্বল উপত্যকায় এই নদী প্রবাহিত খুব প্রয়োজন না হলে এই নদীর সংস্পর্শে স্থানীয় মানুষজন যায় না। কথিত আছে রাজা রতিদেব লক্ষ নরহত্যা করে এই নদীতে রক্তের স্রোত প্রবাহিত করে ছিলেন সেই সময় থেকে এই নদী অভিশাপগ্রস্ত।
ফল্গুনদী বিহারের গয়া জেলায় রামায়ণের বর্ণনা অনুযায়ী শ্রীরামচন্দ্র যখন চোদ্দ বছরের জন্য বনবাসে গেছিলেন সেই সময় তার পিতা দশরথের মৃত্যু হয়। শ্রীরামচন্দ্র তাঁর পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সামগ্রী জোগাড় করতে গিয়ে অনেক দেরি করেন এদিকে নিদৃষ্ট সময় অতিবাহিত হচ্ছে দেখে মৃত দশরথের ইচ্ছা অনুযায়ী মা সীতা সামান্য উপাচারে তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তিনি যে দশরথের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন তার চারজন সাক্ষী হিসেবে ছিলেন ব্রাহ্মণ তুলসী গাছ ফল্গুনদী ও বটবৃক্ষ; কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের কাছ থেকে উপহার পাওয়ার আশায় বটবৃক্ষ ছাড়া বাকি তিন জন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মা সীতা যে দশরথের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন তা অস্বীকার করে। মা সীতা কুপিত হয়ে ব্রাহ্মণ তুলসী গাছ ও ফল্গুনদীকে অভিশাপ দেন। সেই সময় থেকে ফল্গুনদী অন্তঃসলিলা । বালি খুঁড়ে জল উঠলেও সেই জলে কোন পুণ্য কর্ম সম্পন্ন হয় না।
এবার যে নদীটির কথা বলবো তার নাম কর্মনাশা নদী। বিহারের সরোদগের কাছে কৈমুর রেঞ্জে এই নদী উৎপত্তির পর উত্তর পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে বিহার ও উত্তর প্রদেশের সীমান্তে মির্জাপুর সোনভদ্র চন্দৌলী গাজীপুরের মধ্য দিয়ে বক্সারের কাছে চৌসা নামক স্থানে গঙ্গায় মিশেছে। বিস্তৃর্ণ জনবসতির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলেও এই নদীর জল কেউ স্পর্শ করে না। জনশ্রুতি এই নদীর জল স্পর্শ করলে সকল কর্ম নাশ হয়। মহাপাপে নিমজ্জিত হতে হয়। কেন এই নদীর জল অপবিত্র কেন স্পর্শমাত্র সকল কর্ম নাশ হয় এর অনেক কথা প্রচলিত আছে; তবে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য কথা হলো পুরাকালে ইক্ষাকু বংশীয় রাজা হরিশ্চন্দ্রের পিতা ছিলেন রাজা সত্যব্রত। তিনি খুব পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন তাঁর ইচ্ছা হলো তিনি সশরীরে স্বর্গে যাবেন কিন্তু নিয়তির বিধান অনুযায়ী সশরীরে স্বর্গে যাওয়া নিষেধ তাই তিনি তাঁর গুরুদেব ঋষি বশিষ্ঠের কাছে অনুরোধ করলেন তাঁকে স্বর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে কিন্তু ঋষি বশিষ্ঠ তাঁকে সশরীরে স্বর্গে পাঠাতে অস্বীকার করলেন। রাজা সত্যব্রত গুরুদেব ঋষি বশিষ্ঠের উপর ভীষণ রেগে গেলেন তিনি ঋষি বশিষ্ঠের চিরশত্রু ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে তাঁকে সশরীরে স্বর্গে পাঠানোর অনুরোধ করলে বিশ্বামিত্র স্বীয় তপোবলের প্রভাবে রাজা সত্যব্রতকে স্বর্গে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র এতে ভীষণ রেগে গেলেন তিনি রাজা সত্যব্রতকে তৎক্ষণাৎ হেটমুন্ডে মর্তে ফেরত পাঠিয়ে দিলে ঋষি বিশ্বামিত্র রাজা সত্যব্রতকে স্বর্গ ও মর্তের মাঝে থামিয়ে দেন। ঋষি বশিষ্ঠ সত্যব্রতকে চন্ডাল হওয়ার অভিশাপ দেন। তখন থেকে রাজা সত্যব্রত ত্রিশঙ্কু নামে পরিচিত হন। দোদুল্যমান অবস্থায় মাথা নিচের দিকে থাকায় তাঁর মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়তে থাকে অবশেষে ওই লালা থেকেই উৎপন্ন হয় এক নদী। অভিশাপগ্রস্ত এই নদীর জল হয়ে ওঠে অপবিত্র এবং সকল প্রকার শুভ কর্ম বর্জিত। এই নদীর জল স্পর্শে সমস্ত পুণ্য কর্ম নাশ হয়। তাই এই নদীর নাম কর্মনাশা নদী। অদ্যাবধি এই নদীর জল কেউ স্পর্শ করে না।