নগ্ন ঈশ্বর – চার
অবনীভূষণ বিজন এবং সুমিত্রর দীর্ঘদিন জাহাজে কেটে গেছে। অবনীভূষণ এখন প্রৌঢ়। বিজন সুমিত্র উত্তরত্রিশের যুবক। ওরা সফরে ক্রমশ এক প্রাচীন নাবিকের গন্ধ মেখে বন্দর থেকে বন্দরে, এক সমুদ্র থেকে অন্য সমুদ্রে এবং এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে ঘুরছে। তারপর একই জাহাজে ওরা তিনজন একদা দূর সমুদ্রযাত্রায় বের হয়েছিল। সে রাতও তুষারঝড়ের রাত ছিল। সে ঘটনার সাক্ষী অবনীভূষণ ছিল, বিজন ছিল এবং সুমিত্র ছিল। শুধু এ ঘটনা অথবা কাহিনী একা এক অবনীভূষণের থাকছে না, বিজনেরও থাকছে না, এমনকি সুমিত্রেরও নয়। এ ঘটনা অথবা কাহিনী ওদের সকলের এবং সকল মানুষের।
ফোকসালে সকলেই প্রায় ঘুমোচ্ছিল। কারণ দীর্ঘ সমুদ্রাযাত্রার পর এই বন্দরের আলো—ঘর—বাতি সবই কেমন মুহ্যমান এবং তুষারঝড় হচ্ছে। সুতরাং জাহাজিরা বন্দর দেখে খুশি হতে পারল না। ওরা ডেকে পায়চারি করতে করতে বন্দরের গল্প করল না। ওরা শীতে অবসন্ন, ওরা কম্বল মুড়ি দিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকল।
বিজন গ্যাঙওয়ের পথ ধরে ফিরছিল। গ্যাঙওয়েতে তুষারঝড়টা মুখোমুখি লাগছে। সুতরাং সে হাঁটতে হাঁটতে চিফ কুকের গ্যালিতে চলে এল। হাত পা সেঁকল এবং চা করে আবার সেই শীতের রাজ্যে ঢুকে জাহাজটা পাহারা দেবার সময় দেখল, দূরে কোথাও কোনো আলোর রেখা ফুটে উঠছে না। তুষার—ঝড়ের জন্যে সব কেমন অন্ধকারময়। বসে বসে সে ঝড়ের শব্দ শুনল, সমুদ্র দূরে গর্জন করছে। জাহাজটা নড়ছিল। যেন জাহাজটা হাসিল ছিঁড়ে এবার ছুটবে অথবা জাহাজের শরীরে এক রকমের শব্দ, যা বিজনকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। মাস্টের আলোগুলি দুলছিল—সে দেখতে পেল। বন্দরের আলোগুলি অস্পষ্ট, বরফের কুচি ওদের অস্পষ্ট করে রেখেছে। সে হাতের দস্তানাটা এবার আরও টেনে দিল।
নিচেও কোনো লোক চলাচল করছে না। ক্রেনগুলো দৈত্যের মতো এই জেটির সকলকে তুষারঝড়ের ভিতর পাহারা দিচ্ছে। উইংসের আলো জ্বলছে না। শুধু জাহাজটা নড়ছিল। এতদিনের এই সমুদ্রযাত্রা এবং প্রপেলারের শব্দ, এনজিন রুমের শব্দ তারপর সমুদ্রের ঢেউ—সবই কেমন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সবই কেমন রাতদুপুরে মাঠের নির্জনতায় ডুবে যাওয়ার মতো। সে এবার ধীরে ধীরে উঠল। বসে থাকলেই শীত বেশি করছে। সে পায়চারি করতে লাগল। এবং ডেক পার হলে গ্যালি, পরে সব জাহাজিদের ফোকসাল। বিজন এত দূর পর্যন্ত হেঁটে গেল না। সে পোর্টহোলের কাচের ভিতর দিয়ে বড় মিস্ত্রির কেবিন দেখল। ওর ঘরে নীল লাল মিশ্রিত এক ধরনের আলো। বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণ এত রাতেও একটা বই পড়ছেন। অশ্লীল সব বই এবং নগ্ন সব ছবি দেয়ালে দেয়ালে। বড় মিস্ত্রি জাহাজ নোঙর করলে ঘন ঘন রেলিংয়ে ভর করে দূরে কিছু যেন প্রত্যক্ষ করছিলেন। প্রত্যাশা যেন কিছুর। অন্ধকার জেটিতে কিছু আবিষ্কারের জন্য পাগল। বিজন বলেছিল, স্যার, বন্দরে কেউ নেই। খালি।
কেউ নেই! কথাটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
যথার্থই কেউ নেই স্যার।
অবনীভূষণ চোখের চশমা খুলে রুমালে মুছতে মুছতে কথাটা অবিশ্বাস করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ডেসির আসার কথা অথচ ডেসি এল না। তিনি বিড় বিড় করে তুষারঝড়কে ধিক্কার দিচ্ছিলেন। ডেসি এলে এই জাহাজ মনোরম… বড় কামুক গন্ধ এই জাহাজের অলিগলিতে, নোনা জলের ঘন রঙ অথবা সমস্ত বিষাদ সমুদ্রের—ডেসি একা সামলাত। ডেসি এলে ওর ঘরে রাত যাপনের প্রশ্ন উঠত। অন্যান্য সফরের মতো বন্দরের দিনগুলো উপভোগের সুখ পেত। বড়ই দুঃসময়, এমনকি বেশ্যামেয়েরা পর্যন্ত ঘর থেকে বের হচ্ছে না, কী অনাবশ্যক দিন—শুধু তুষারঝড়, বরফের কুচি উড়ছে আর রাত বলে, আলো কম বলে সমস্ত শহরটা অদ্ভুত রহস্যময় ঠেকছে। দূরে ইতস্তত কোনো কুকুরের চিৎকার, গির্জাতে ঘণ্টা বাজছে এবং অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি যাচ্ছে, জেটিতে একটা মাতাল পুরুষকে পর্যন্ত দেখা গেল না। কী অবিশ্বাস্যভাবে নসিব বদলা নিতে শুরু করেছে। ডেসির জন্য এই প্রচণ্ড শীতকে উপেক্ষা করে বড় মিস্ত্রি রেলিংয়ে ভর করে প্রতীক্ষা করছিলেন। উত্তেজনায় শরীর অধীর হচ্ছিল। কারণ উত্তর অঞ্চলের অন্য বন্দরে ডেসির চিঠি ছিল। চিঠিতে লেখা ছিল—চিফ, জাহাজ তোমার ভিড়বে রাতে। যত প্রতিকূল অবস্থাই হোক না, আমি উপস্থিত থাকব জেটিতে। তোমাকে নিয়ে ঘরে ফিরব। চিঠিতে সে ওর বেড়ালের জন্য বড় মিস্ত্রিকে কড মাছের চর্বি আনতে লিখেছিল।
বড় মিস্ত্রি অশ্লীল পুস্তকের ভিতর থেকে ডেসির তলপেটের গন্ধ নিচ্ছিলেন যেন। এবং এ সময়ে পোর্টহোলে প্রতিবিম্ব পড়তেই তিনি প্রশ্ন করলেন, কে?
আমি স্যার, সুখানী। বিজন বলল।
অবনীভূষণ শান্ত গলায় বললেন, সুখানী, আমাকে একটু চা খাওয়াবে ভাই। রাত অনেক হল। ঘুম আসছে না। আর এই রাতে বয়দের জ্বালাতন করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
বিজন ফের চিফ কুকের গ্যালিতে ঢুকে গেল। চা করল, তারপর চিফ এনজিনিয়ারের দরজাতে দাঁড়িয়ে ডাকল, আপনার চা এনেছি স্যার। দরজা খুলুন।
বড় মিস্ত্রি ভিতর থেকে বললেন, দরজা খোলাই আছে, ভিতরে এসো।
বিজন দরজার ভিতর ঢুকে দেখল, নীল কাচের গেলাসে এখনও লিকার পড়ে আছে। সে টিপয়তে চা রাখল। তারপর বের হতেই শুনল, তিনি ডাকছেন, সুখানী। সুখানী কাছে গেলে বললেন, কোথাও কেউ নেই?
না স্যার।
কোনো ঘরে কেউ আসেনি?
না স্যার।
যথার্থ কথা বলছ?
হ্যাঁ, স্যার। কোনো কেবিনে কেউ আসে নি।
কাপ্তানের ঘর?
ঘর ফাঁকা স্যার।
ঠিক আছে, যাও। বড় সাব অবনীভূষণ কেবিনের সোফায় বসে চা খেলেন। রাত এখন কত? কাচের ঘরে ঘড়ির কাঁটা নড়তে দেখলেন। রাত বারোটা বেজে গেছে। সমুদ্রে এবার একনাগাড়ে কত দিন? দশ মাসের উপর হবে। হোম থেকে কবে বের হয়েছেন—কত কাল আগের যেন সেইসব দিন, সেইসব বন্দর এবং স্ত্রীর কালো দুটো চোখ এখন পোর্টহোলের কাচে দৃশ্যমান। শরীরে তার যৌবন নিঃশেষ অথচ প্রেমটুকু আলোক—উজ্জ্বল দিনের মতো। সবই তিনি স্মরণ করতে পারছেন অথচ ডেসি এল না—ডেক ছাদে কার পায়ের শব্দ। তিনি এবার কম্বল টেনে শুয়ে পড়লেন। কারণ বাইরে তখনও তুষারঝড় হচ্ছে।
বিজন তুষারঝড়ের জন্য চিফ স্টুয়ার্ডের কেবিন এবং অ্যালওয়ের ফাঁকটাতে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকল। এই ফাঁকটুকু থেকে গ্যাঙওয়ে স্পষ্ট। ওর শরীরে এখন ঠান্ডা হাওয়া লাগছে না। জাহাজ কতদিন পর বন্দর পেল অথচ দুর্যোগের জন্য জাহাজিরা কিনারায় নামতে পারছে না। কাল সকালে এবং অপরাহ্ণ বেলায় যখন জাহাজিরা একে একে জাহাজ খালি করে বন্দরে মানুষজন গাছপালা মাটির টানে নেমে যাবে, তখন ওরা কিংস পার্কে অথবা সান্তাক্লজের চূড়ায় উঠে শহর দেখবে তখন… তখন বিজনের বড় ইচ্ছা এই ঠান্ডায় কোনো যুবতীর উত্তাপ, কাপ্তানের ইচ্ছা কিছু উত্তাপ…. তখন বিজন পাশের কেবিনে বড় পরিচিত শব্দ শুনল। শব্দটা মধুর। শব্দটা ভীষণ উত্তেজনাময়—সে স্থির থাকতে পারছে না। সে ধীরে ধীরে দরজায় কান পেতে শুনতে চাইল—কিছুই শোনা যাচ্ছে না, অস্পষ্ট। সে এ সময় অধীর যুবকের মতো দেয়ালে হাত রাখল।
বিজন এই ফাঁকটুকুতে দাঁড়িয়ে শান্তি পাচ্ছে না। পোর্টহোলের কাচে মুখ রাখা যাচ্ছে না। পোর্টহোলের কাচে কিছুই দেখা যাচ্ছে না—সে এই কেবিনের একটা রন্ধ্রপথ খোঁজার জন্য খুব সন্তর্পণে দেয়াল হাতড়ে বেড়াতে লাগল। দরজার পাল্লা ধীরে ধীরে একটু ফাঁক করতে গিয়ে বুঝল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ভিতরে এবং বাইরে আলো বলে বিজন বুঝতে পারছে না, বিজন এবার বাইরের আলো নিভিয়ে এক ঘন অন্ধকার সৃষ্টি করতেই দেখল পোর্টহোলের উপরে যেখানে স্টিম পাইপ আছে তার পাশে গোলাকার ছিদ্রপথ। সে তাড়াতাড়ি টুলটা গ্যাঙওয়ে থেকে নিয়ে মই বেয়ে ওঠার মতো উঠল। মুখটা কিঞ্চিৎ ঢুকিয়ে দেখল ওরা দুজনই পাশাপাশি শুয়ে আছে। ওরা উভয়ে রাতের প্রথম প্রহরে বোধহয় যৌনক্রিয়ায়û মুখর ছিল। এখন শান্ত। এখন ঘর এবং ঘরণীর মতো ওদের মুখচ্ছবি। কোনো অপরাধবোধের চিহ্ন নেই মুখে। যেন কত দীর্ঘ দিনের আলাপ, যেন কত দীর্ঘদিনের প্রেম এবং সহিষ্ণুতা উভয়কে গভীর শান্তিতে আচ্ছন্ন রেখেছে। বিজন, কম্বলের নিচে ওদের নগ্ন এমন এক ছবির কথা চিন্তা করে টুল থেকে নেমে পড়ল। ওর ওয়াচ শেষ হবে এখন। সুতরাং এই নগ্নতা দর্শনে তৃপ্তি নেই, এতে শুধু উত্তেজনা বাড়ে। মেয়েটির রুক্ষ চুলে সুমিত্রর মোটা শক্ত হাত। অন্য হাতটি কম্বলের নিচে নড়ছিল… কম্বলের নিচে মেয়েটির তলপেটের কাছাকাছি কোথাও ইঁদুরের মতো ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে অথবা যেন শরীরের সকল কুশল চিন্তার কথা ভুলে সারারাত যৌনসংযোগে মগ্ন থাকলে সকলই সুখের আকর…. বিজন আর ভাবতে পারল না, সে তাড়াতাড়ি টুলটা হাতে নিয়ে কেবিনের পাশ থেকে সরে গিয়ে কিঞ্চিৎ ছুট দিল। সে ছুটতে ছুটতে বড় মিস্ত্রির কেবিনের পাশে এসে দাঁড়াল এবং বলতে চাইল, স্যার আমি… আমি যথার্থ কথা বলিনি।
এখন বড় মিস্ত্রি দরজা খুললে বলতে হবে স্টুয়ার্ডের ঘরে চটুল রমণী স্টুয়ার্ডকে পতিব্রতা ভার্যার প্রেম এবং সুখ বিতরণ করছে। সুতরাং কাল ভোরে আপনার দরজার পাশ দিয়ে একজন চটুল রমণী উঁচু জুতো পরে এবং নিতম্বে রস সঞ্চার করতে করতে জেটিতে নেমে যাবে তারপর আমি অভিযোগের করুণ বিষোদগারে জর্জরিত হব, সে ঠিক নয় স্যার। সুতরাং সকল ঘটনার কথা খুলে বলাই ভালো।
সে ডাকল, সাব।
কে বাইরে? কম্বলের ভিতর থেকেই বড় মিস্ত্রি চোখ পিট পিট করে তাকাতে থাকলেন।
আমি স্যার, সুখানী।
ঘরে এসো। শরীরটা বড় খারাপ বোধ হচ্ছে।
বিজন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল এবং বলল স্যার, আমি যথার্থ কথা বলিনি।
যথার্থ কথা বলিনি! তবে আস্তে বলো। দরজাটা ভেজিয়ে দাও। বড় ঠান্ডা হাওয়া আসছে। বাইরের তুষারঝড়টা মনট্রিলের দিকে যাচ্ছে না তো, অথবা ভ্যানকুবার থেকে জাহাজ আসার কথা ছিল—ওরা কিছু মেয়ে আমদানি করতে পারে হয়তো।
না স্যার। সেসব কথা আমি বলছি না। আমাদের জাহাজে এই ঝড়ের মধ্যেও একজন মেয়ে উঠে গেছে। মেয়েটা চিফস্টুয়ার্ডের কেবিনে আছে।
এমত কথায় বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণের চোখ গোল হয়ে উঠল। ওঁর বাসি দাড়িগুলি লম্বা হয়ে গেল যেন। তিনি বললেন, এই ঝড়ের রাতে!
আজ্ঞে স্যার।
ভালো কথা নয়।
নয় স্যার।
তুমি দেখলে?
আজ্ঞে দেখলাম স্যার। টুলের উপরে উঠে উঁকি দিয়ে দেখতে হল ঘুলঘুলিতে।
ওরা কী করছে। অবনীভূষণ ঢোক গেলার মতো মুখ করে থাকলেন।
বিজনকে কিঞ্চিৎ লজ্জিত দেখাচ্ছে। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই স্যার।
তুমি তো খুব স্বার্থপর লোক হে। আমি একটু দেখতে যাব ভাবছি আর তুমি কিনা বলছ আমাকে একা ফেলে চলে যাবে!
আমার ওয়াচ শেষ হতে দেরি নেই স্যার।
আরে চলো। বলে তিনি কম্বল ছেড়ে উঠে পড়লেন। ওভারকোট গায়ে জড়িয়ে বললেন, দেখা যাক না ঘটনাটা কেমনভাবে ঘটেছে। বুঝলে সুখানী, ডেসি নামে একটি মেয়ে আমার কেবিনে আসার কথা ছিল। সেজন্য আমার ঘুম আসছে না। আর ডেসি মেয়ের মতো মেয়ে বটে। ডেসি বেশ্যামেয়েদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর। সে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে পারে। এক এক রাতে পাঁচটা সাতটা লোককে সে হজম করতে পারে।
তাই বুঝি স্যার! সুখানীকে এ সময় ভয়ানক বোকা বোকা লাগছিল।
একে, দেখে কেমন মনে হল?
স্যার, ওরা এখন শুয়ে আছে। তবে ঘুমোয়নি। ঘুমোলে, কম্বলের নিচে স্যার ইঁদুর নাচত না।
রাত গভীর এবং ঝড়ের গতি বাড়ছে। অ্যালওয়ের দরজা বন্ধ। ঝড়টা ভিতরে ঢুকতে পারছে না অথচ বাইরে ভয়ংকর শব্দে যেন আকাশ ফেটে পড়ছে। যেন জাহাজের মাস্তুল এবার ভেঙে পড়বে। ওরা দুজনে সন্তর্পণে এনজিন রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে চলল, উভয়ে হেঁটে যেতে থাকল। পাশের কেবিনগুলোর দরজা বন্ধ। অবনীভূষণ খুব মদ টেনেছিলেন বলে গতিতে শ্লথ ভাব। অথবা বয়সের ভারে ঠিকমতো যে হেঁটে যেতে পারছেন না। তিনি বালকেড ধরে ধরে হাঁটছিলেন। শরীরের ওজন ভয়ানক, হাত পা শক্ত এবং নিবিড় এক মদিরতা ওঁকে এই গতির ভিতর আচ্ছন্ন করে রাখতে চাইছে।
বড় মিস্ত্রি চলতে চলতে খুব আস্তে এবং জড়ানো গলায় বললেন, আমার শরীরটা কিঞ্চিৎ মোটা হয়ে গেছে। এতবার এনজিন রুমে নামা—ওঠা করি তবু ভুঁড়ির হেরফের হচ্ছে না। আপদ!
হ্যাঁ স্যার, আপদ!
পেট মোটা থাকলে যৌনতায় আনন্দ পাওয়া যায় না। তৃপ্তি নেই।
বিজন ভাবল, লোকটা মদ খেয়েছে বলে এত কথা বলছে। কারণ সুখানী জানত দিনের বেলাতে বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণ গোমড়ামুখো। কোনো কথা নেই—তিনি চুপচাপ এনজিনে নেমে যান অথবা বাংকে শুয়ে শুয়ে অশ্লীল সব বই পড়েন। অথবা ব্রিজের নিচে ছোট একটা ডেকচেয়ারে বসে পাইপ টানতে টানতে দূরের বন্দর, পাইন গাছ এবং সমুদ্র দেখেন। কোনো কথা বলেন না, কোনো হাসি—ঠাট্টা করেন না জাহাজিদের সঙ্গে। তখন তিনি যথার্থই বড় মিস্ত্রি জাহাজের।
বিজন একটু থেমে বলল, স্যার টুলটা নিয়ে আসি। টুলটা না নিলে ঘুল—ঘুলিতে মুখ রাখা যাবে না।
কেবিনের আলো এবং একটি ক্যালেন্ডারের পাতায় সুন্দর এক হ্রদের দৃশ্য অথবা অ্যালওয়ে পার হয়ে অন্য অফিসারদের কেবিন, স্টোর রুম এবং ডাইনিং হল অতিক্রম করে চিফ স্টুয়ার্ডের ঘর—বাংকে বেশ্যা রমণীর সুন্দর চোখ, আর পারা যাচ্ছে না—সে আগে আগে চলতে থাকল, কোনো কথা বলল না। অন্য কেবিনে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাল না।
বিজন ফিস ফিস করে বলল, এসে গেছি।
যে টুলটা বালকেডের পাশে সন্তর্পণে রাখল। বলল, এবারে উঠুন স্যার। সে আঙুল দিয়ে ঘুলঘুলি নির্দেশ করে দিল।
আমাকে উঠতে সাহায্য কর। বড় মিস্ত্রি মাতাল। তিনি কুকুরের মতো উত্তেজনাতে হাঁসফাঁস করছেন।
বিজন অ্যালওয়ের আলোটা নিভিয়ে দিল। বাইরে ঝড় এবং ঝড়ের গতি বাড়ছে। সুতরাং ওদের কথাবার্তার শব্দ ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বড় মিস্ত্রি ফস করে লাইটার জ্বালিয়ে একটা চুরুট ধরালেন। ওদের মুখ এখন বীভৎস রকম দেখাচ্ছে।
বিজন বলল, স্যার এক কাজ করেন?
এখন কোনো কাজের কথা নয়, সুখানী তুমি বড় বেশি কথা বল।
বিজন কোনো জবাব দিল না অথচ মনে মনে গাল দিল। বেঢপ মোটা বামন।
দেখ সুখানী, আমার ভাড়া করা স্ত্রী যদি কাল জাহাজে আসে, তুমি আবার এ সব ঘটনার কথা বলে দিও না। মেয়েটি খুব সুন্দর। বছর পাঁচেক আগে নাইট ক্লাবে ওর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বুঝলে সুখানী, তুমি তো মদ খাও না অথচ মেয়েমানুষের শরীর পেলে পেটুকের মতো কথাবার্তা বলো।
বিজন বলল, স্যার, আপনি আমার ওপরওয়ালার ওপরওয়ালা। আপনার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথাবার্তা বলতে ভয় হয়।
সুখানী, আবার তোমার সেই বেশি কথা।
সুতরাং ভয়ে ভয়ে বিজন টুলটা ধরে রাখল। অ্যালওয়ে অন্ধকার বলে ওরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে না।
আমাকে টুলে উঠতে সাহায্য করো। ফের ধমক দিলেন বড় মিস্ত্রি।
চিফ টুলের উপর উঠে সেই ঘুলঘুলিতে চোখ রাখতে গিয়ে বুঝতে পারলেন যে তিনি এই হালকা টুলে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারবেন না। শরীর টলছিল। তিনি একটি শক্ত টুল অন্বেষণ করলেন। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, শক্ত টুল নেই সুখানী?
আছে স্যার। কসপের ঘরে একটা শক্ত টুল আছে। কসপকে ডেকে তুলব?
না, দরকার নেই। বেশি হইচই করো না, সকলে, কুকুরের মতো এখানে এসে ভিড় করবে। এবং কাপ্তান জানলে রাগ করবেন।
বড় মিস্ত্রি এবার টুল থেকে নেমে পড়লেন। ফিস ফিস করে বললেন, বরং তুমি দেখ ওরা কী করছে। যা দেখবে, সব বলবে। কিছু লুকোলে আমি ধরতে পারব।
বিজন টুলের উপর উঠে ঘুলঘুলিতে চোখ রাখল। গরম হাওয়া ভিতর থেকে বের হয়ে আসছে। স্টুয়ার্ড এবং মেয়েটি সন্তর্পণে এখন কী যেন লক্ষ্য করছে। খরগোসের মতো ভীত চোখ নিয়ে কী যেন দেখছে। ওরা তাড়াতাড়ি উঠে বসল। বোঝা যাচ্ছে দুজনই উলঙ্গ। ওরা পরস্পর কী বলছে বুঝতে পারছে না বিজন।
বিজনকে কিছু বলতে না দেখে বড় মিস্ত্রি ক্ষেপে গেলেন।—সুখানী, তুমি নেমকহারাম, পাজি। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলছেন।—তুমি নিজে সব দেখছ অথচ আমাকে কিছু বলছ না।
স্যার, ওরা এখন উঠে বসল।
তারপর সুখানী?
ওরা বোধহয় টের পেয়েছে।
মেয়েটি দেখতে কেমন সুখানী?
রোগা স্যার। মেয়েটি এখন আবার কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল।
চিফস্টুয়ার্ড তখন ভিতরে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলছিল, মর্লিন, কারা যেন বাইরে কথা বলছে। যদি টের পায় তবে নিশ্চয় হামলা করবে।
মর্লিন উঠতে চাইল না। বলল, শরীর আর দিচ্ছে না। বাইরে ঝড়, নতুবা চলে যেতাম সুমিত্র।
সুমিত্র খুব দুঃখের সঙ্গে একটা হাত ওর স্তনের নিচে রাখল এবং কাছে টানল। বলল, অ্যালওয়েতে এখনও যেন কারা চলাফেরা করছে। কথা বলছে। অনেকক্ষণ থেকে এটা হচ্ছে। দরজা খুলে দেখব?
এই সুখানী, হারামজাদা! তুমি আমাকে বাগে পেয়ে খুব কলা দেখাচ্ছ হে।
স্যার, ওরা কিছু করছে না।
নিশ্চয় করছে। তুমি আমায় মিথ্যা কথা বলছ।
ভেতরে মেয়েটি বলল, না, আমার শরীর ভালো নেই সুমিত্র। ঠান্ডায় জমে গেছিলাম। এই ঘর আমাকে উত্তাপ দিচ্ছে। আমি আজ আর একটি লোককেও সামলাতে পারব না। সে অন্য পাশ ফিরে ঘুমোবার চেষ্টা করল। চিফ স্টুয়ার্ড সুমিত্র হাঁটু ভাঁজ করে রাখল মেয়েটির নিতম্বের নিচে এবং বুকে হাত রেখে ঘন হয়ে শুতে চাইল। অথচ শান্তি পাচ্ছিল না। সে ফের উঠে বসল। পোর্টহোল খুলে সমুদ্রের গর্জন শুনতে চাইল। ওর শরীর নগ্ন। ঠান্ডা হাওয়া ওকে কাঁপিয়ে তুলছে। স্টুয়ার্ড তাড়াতাড়ি রাতের পোশাক পরে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে শুনল, বাইরে চেঁচামেচি, সুতরাং সে একটা হাই তোলার চেষ্টা করল।
স্যার, আমি মিথ্যা বলছি না।
তুমি আলবাৎ বলছ। খুব আস্তে অথচ ক্ষুণ্ণ গলায় বললেন বড় মিস্ত্রি।
বিজন মরিয়া হয়ে বলল, বলেছি তো বেশ করেছি।
বেশ করেছ! তুমি বেশ করেছ! আচ্ছা… এইটুকু বলে বড় মিস্ত্রি কড়া নাড়লেন, স্টুয়ার্ড, দরজা খোল। আমি বড় মিস্ত্রি। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দ হল না বলে তিনি ফের বললেন—আমি। স্টুয়ার্ড আমি কোনো হামলা করব না। তুমি বললে আমি তিন সত্যি করতে পারি।
তুষারঝড় সকলকেই নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। দীর্ঘদিনের সমুদ্রযাত্রা অতিক্রম করার পর এই বন্দর, বন্দরে আলো অথবা কোনো রাস্তার নিচে বেশ্যা রমণীর আপ্যায়ন ওদের জন্য প্রতীক্ষা করল না। বড় সাহেবের ডেসি আসেনি, সুখানী বাইরে গিয়ে একটু মদ গিলতে পারেনি অথবা রমণীর মুখ দর্শন যেন কত কাল পর, কত দীর্ঘ সময় ধরে ওদের নোনা জলের চিহ্ন মুখে, রমণীর নরম নরম মুখ এবং চাপ চাপ আস্বাদন সবই কোন অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত।
এই দিকের কেবিনগুলি ফাঁকা। স্টুয়ার্ডের একমাত্র কেবিন, পরে ডাইনিং হল, সামনে ছোট ঘর অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য। ডেকের নিচে মাংসের ঘর তারপর সোজা সব ফাঁকা কেবিন, কারণ এই শীতের অঞ্চলে কোনো যাত্রী ওঠেনি। কেবিনে সুতরাং কোনো মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। স্টুয়ার্ড এসব জেনেই মেয়েটিকে অন্ধকার জেটির ওপর থেকে তুলে সিঁড়ি ধরে জাহাজে নিয়ে এসেছিল—কারণ সে জেটি থেকে তখন দেখেছে গ্যাঙওয়েতে কোয়ার্টার মাস্টার নেই, সুতরাং এটাই উপযুক্ত সময়। সে সময়ের সদ্ব্যবহার করেও কোনো ফল লাভ করতে পারল না, এত সতর্কতা তবু সব কেমন ফাঁস হয়ে গেল! চিৎকার এবং হামলা আরও বেশি হতে পারে ভেবে সে দরজা খুলে দিল। ভয়ানক শীত এই অ্যালওয়ের অন্ধকারে। কেবিনের আলোতে সে বড় মিস্ত্রির পাথরের মতো চোখ দুটো দেখল। এই সময় চিফস্টুয়ার্ডকে অদ্ভুত রকমের তোতলামিতে পেয়ে বসল।
বড় মিস্ত্রি কেবিনের ভিতর ঢুকে গেলেন। বললেন, আমি তিন সত্য করছি স্টুয়ার্ড, আমি কোনো হামলা করব না। আমাকে একটু সুখ দাও। আমি তবেই চলে যাব। কেমন বেহায়া এবং নির্লজ্জ ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন বড় মিস্ত্রি। তিনি ধমকের সুরে বিজনকে ডাকলেন, এসো। নচ্ছার সব জাহাজি। এটা তোমার বাড়ি নয় সুখানী! এখানে মা বাবা ঘুলঘুলি দিয়ে দেখতে আসবে না, এসো।
সুখানী ভালো ছেলের মতো বড় মিস্ত্রিকে অনুসরণ করল। সে কেবিনের ভিতর ঢুকল না। সে দরজার একটা পাল্লা ধরে উঁকি দিল মাত্র। স্টুয়ার্ডের সবকিছু দেখছে। ভয়ে ওর তোতলামি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। বড় মিস্ত্রির চোখ দুটো চক চক করছে এবং হননের ইচ্ছাতে একাগ্র। জানোয়ারের মতো উদগ্র লালসা মুখে, অবয়বে। সে দেখল, বড় মিস্ত্রি চেয়ার টেনে বসেছেন, দেয়ালে বিচিত্র সব নগ্ন ছবি এবং এই বাংকের অন্য পাশে মর্লিন—ওর কোমল ত্বকের গন্ধ অথবা মুরগির মতো নরম কলজের উত্তাপ বড় মিস্ত্রিকে এতটুকু অন্যমনস্ক করছে না। সে ঘরের ভিতর নিমন্ত্রিত অতিথির মতো বসে থাকল।
মর্লিন কম্বলের ভিতর থেকে উঁকি দিল। ওর সোনালি চুল বালিশের উপর, ওর নীল চোখ শান্ত। বড় মিস্ত্রির বিদঘুটে শরীর ক্রমশ পাশবিকতায় আচ্ছন্ন হচ্ছে। মর্লিন কম্বলের ভিতরে এসব দেখে ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। সে অন্য একটি মুখ দেখল দরজার পাশে। সে মনে মনে বড় মিস্ত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাইল, ম্যান, আমি জানি তোমাকে নিয়ে কোন কোন ভঙ্গিতে ক্রীড়াচাতুর্য প্রদর্শন করলে তুমি দু’বার, তিনবার অত্যধিক চারবার… কিন্তু শরীর ভালো নেই, বড় কষ্ট এই শরীরে, শীতে শরীর মুখ বিবর্ণ এবং ভিতরে ভয়ানক যন্ত্রণায় ভুগছি। তুমি আজকের মতো রেহাই দাও। এই দুর্যোগ যাক, বসন্ত আসুক—তখন তোমার কত টাকা আমার কত সুখ বিদ্যমান, দেখাব। অথচ মর্লিন কিছু বলতে পারছে না। ভয়ে ওর শরীর কেবল গুটিয়ে আসতে থাকল।
সুখানী দেখল, বড় মিস্ত্রি কেমন পাগলের মতো করছেন। পোশাক আলগা করার সময় তিনি দরজা খোলা কী বন্ধ পর্যন্ত দেখছেন না। সুতরাং সুখানী নিজেই দরজাটা টেনে দিল।
বড় মিস্ত্রি দুটো শক্ত হাত ওর সোনালি চুলের ভিতর ঠেসে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লেন। তিনি মর্লিনের চুলের ভিতর মুখ গুঁজে দিলেন। মর্লিন মৃতপ্রায় পড়েছিল। বড় মিস্ত্রি কম্বলটা শরীর থেকে বাঁ হাতে ঠেলে দিলেন। ঠোঁট দুটো নীল, বিবর্ণ। ঠোঁট দুটো কামড়ে দেবার সময় দেখলেন, কেমন সাপের মতো পিছলে যাচ্ছে। অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলছে, ম্যান আমাকে মেরে ফেলো না। আমি আর পারছি না।
মর্লিনের মুখ থেকে তখন থুথু উঠছিল। বাইরে বড় মাস্টের আলোগুলো দুলছে। মেসরুমে বাতি জ্বলছিল। মনসুর আসবে এ সময়। ওর এখন ওয়াচ। মনসুরকে ডাকতে হবে। যতক্ষণ না ডাকবে ততক্ষণ মনসুর শুয়ে থাকবে। সুতরাং সুখানী বিরক্ত হচ্ছে। বড় বেশি সময় নিচ্ছে বড় মিস্ত্রি। সুখানী দরজা ঠেলে উঁকি দিতেই দেখল বড় মিস্ত্রি বড় বেশি বেহুঁস। সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। মর্লিনের শরীর থেকে সুখানী বড় মিস্ত্রিকে শক্ত হাতে ঠেলে ফেলে দিল। তারপর টানতে টানতে দরজার বাইরে এনে বলল, আপনি দাঁড়ান। বেশি ইতরামি করলে ভালো হবে না। বলে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণ অসহায় পুরুষের মতো স্টুয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখলে কাণ্ডটা, কাল আমি ওকে দেখব।
স্টুয়ার্ড বলল, বড় দুর্বল স্যার। শীতে কষ্ট পাচ্ছিল। আমি জাহাজে তুলে এনেছি। টাকা তো মুফতে দেওয়া যায় না। তাই রয়ে সয়ে একটু সুখ নিচ্ছিলাম।
ওরা দুজনই চুপচাপ বালকেডে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল।
স্টুয়ার্ড অত্যন্ত বিচলিতভাবে কথা বলতে থাকল, স্যার, এটা অত্যাচার হচ্ছে ওর উপর। একটা রুগণ মেয়েকে দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়।
তার জন্য আমি কী করতে পারি। বলে, তিনি অ্যালওয়েতে পায়চারি করতে থাকলেন। অন্ধকার আলওয়েতে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সেই থেকে থেকে আগের মতো সমুদ্রগর্জন ভেসে আসছে। তুষারঝড়ের গতি কমছে কী বাড়ছে অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে বড় মিস্ত্রি টের করতে পারলেন না। তিনি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, সুখানী বড় দেরি করছে। স্টুয়ার্ডের দিকে এখন নজর বড় মিস্ত্রির। স্টুয়ার্ড এখনও কিছু বলছে না।
তোমার নিশ্চয়ই স্টুয়ার্ড যেতে ইচ্ছা করছে ভিতরে?
স্যার, আপনার কথার উপর আমার কথা বলা সাজে না।
বড় মিস্ত্রি ভাবলেন, এবার কড়া নাড়বেন দরজার। কিন্তু সেই মুহূর্তে দরজা খুলে গেল। বিজনকে খুব বিব্রত দেখাচ্ছে। চোখ মুখ উদ্বিগ্ন। বলল, স্যার ঘরে মদ আছে? মেয়েটা কেমন করছে স্যার! বড় নিস্তেজ, একটু মদ দিলে হত।
সুমিত্র বলল, স্যার, আমি আগেই বলেছি এত ধকল সে সহ্য করতে পারবে না।
বড় মিস্ত্রি চিৎকার করে বলতে চাইলেন, তুমি একটা অমানুষ, সুখানী। অথচ বলতে পারলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তুমি একটা পশু, তুমি পশু সুখানী।
স্যার বিশ্বাস করুন, আমি কিছু করিনি।
কিছু করনি!
না স্যার, শুধু আদর করছিলাম। কিন্তু কেবল দেখছি মুখ থেকে ওর থুথু উঠছে সাদা সাদা ফেনার মতো। আমি বারবার আলোতে মুখ দেখলাম। জল দিলাম খেতে। খেল। ফের ওরকম হতেই দরজা খুলে দিয়েছি। আপনারা আসুন।
স্টুয়ার্ড কথা বলতে পারছিল না। বড় মিস্ত্রি বিমূঢ়। নেশার রঙ মুছে যাচ্ছে। এবং তিনি এই সময় সারিবদ্ধ উট দেখলেন, ওরা মরুভূমির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সারিবদ্ধ উটের দলটা একটা নগ্ন মানুষকে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শুধু। মানুষটার হাত—পা বাঁধা। তিনি প্রায় চিৎকার করে ওঠবার ভঙ্গিতে বললেন, ওদিকের দরজা বন্ধ করে দাও। আলো নেভাও বাইরের। স্টোর থেকে মদ নিয়ে এসো।
ওরা ভিতরে ঢুকে বাংকের পাশে দাঁড়াল। সবুজ গাউনটা পাশ থেকে তুলে মর্লিনের কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া হল। সুখানী পায়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। মর্লিনের বড় বড় চোখ দুটো স্থির। বিবর্ণ হাত দুটো বুকের উপর। মুখের রঙ জলের সঙ্গে গলে গেছে। সাদা এবং অদ্ভুত এক অবয়বের মুখ যা দেখলে ভয় ভীতি ক্রমশ মানুষকে গ্রাস করে।
বড় মিস্ত্রি বললেন, মর্লিন মরে যাচ্ছে সুখানী।
স্টুয়ার্ড বলল, যথার্থই মরে যাচ্ছে মর্লিন?
বড় মিস্ত্রি পুনরাবৃত্তি করলেন, মর্লিন মরে যাচ্ছে সুখানী।
সুখানী বলল, কোনো ডাক্তার….?
ও বাঁচবে না। ডাক্তার ডাকলে সকলে ধরা পড়ে যাব।
স্টুয়ার্ড অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাল, স্যার, আমরা ওকে মেরে ফেললাম।
বড় মিস্ত্রি ধমক দিলেন, আস্তে কথা বল। এত বেশি বিহ্বল হবে না। পোর্টহোল খুলে দেখ ঝড়ের গতি কীরকম? এবং বড় মিস্ত্রি এই নিশ্চিত মৃত্যু জেনে যেন বলতে চাইলেন, এতটুকু পাশবিকতা যে সহ্য করতে পারে না তার মরাই উচিত।
সুখানী পোর্টহোলের কাচ সন্তর্পণে খুলে মুখ গলাবার চেষ্টা করল। বাইরে ঝড়। এবং জলের উপর অন্ধকার। দূরে সমুদ্রের উপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একটা জাহাজ দেখল সে বাইরে। জাহাজটা লকগেট দিয়ে বন্দরে ঢুকছে। সে সমুদ্রের বুকে পাহাড়টা দেখল, আলো, ঘর বাড়ি দেখল। জাহাজটা এখন এখানেই নোঙর ফেলবে। সে জাহাজিদের হাড়িয়া—হাপিজের শব্দ এবং যাত্রীদের কোলাহল এই পোর্টহোল থেকেই শুনতে পেল। সে বলল, ঝড় কমে যাচ্ছে স্যার। তারপর বলল, পাশে একটা জাহাজ নোঙর ফেলছে।
বড় মিস্ত্রি হাঁটু গেড়ে বসলেন মর্লিনের পাশে। ওর কপালে মুখ হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। বড় মিস্ত্রি ভিতরে খুব কষ্ট অনুভব করছিলেন। ভয়ানক কষ্টবোধে তিনি সুখানীর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছেন না। স্টুয়ার্ড স্টোর রুমে গেছে মদ আনতে; তিনি ভালো করে মর্লিনের শরীর ঢেকে বসে আছেন। একটু মদ খেলে যদি উত্তেজনা আসে। অথবা বাঁচবার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাঁর ইচ্ছা হল মেজ মালোমকে ডেকে এই ঘটনার কথা, ওষুধের কথা অথবা কোনো বুদ্ধির জন্য… তিনি আর ভাবতে পারছিলেন না। স্টুয়ার্ড এ সময় মদ এনে ওর মুখে ঢেলে দিলে, মদটুকু ঠোঁটের কস বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
স্টুয়ার্ড বলল, কী হবে স্যার!
বড় মিস্ত্রি বললেন, জানতে পারলে ফাঁসি হবে।
এই ধরনের কথায় চোখ গোল গোল হয়ে উঠল স্টুয়ার্ডের। সে দ্রুত বলে চলল, আসুন, তবে ওকে পোর্টহোল দিয়ে জলে ফেলে দিই স্যার। কেউ টের পাবে না।
ওকে ভালো করে মরতে দাও। তা ছাড়া বাইরে যাত্রীজাহাজ এসে থেমেছে।
এখন অনেক রাত স্যার। আসুন ওকে জেটিতে ফেলে আসি।
গ্যাঙওয়েতে সুখানী মনসুর আছে। এইসব ঘটনা কাক—পক্ষীতে টের পেলে পর্যন্ত কপালে দুঃখ থাকে।
কী হবে স্যার? আগে এমন ঘটবে জানলে মর্লিনকে তুলে আনতাম না স্যার। কী কুক্ষণে এই বন্দরে এসেছি। ঝড় ঝড় শুধু ঝড়।
ওদের ভিতর নানা ধরনের কথা হচ্ছিল। এবং এইসব বিচিত্র সংলাপ ওদের তিনজনকেই সাময়িকভাবে এই মৃত্যু সম্পর্কে নির্বিকার করে রাখছে। এ সময় ওরা তিনজনই ওর পাশে বসল। বড় মিস্ত্রি বললেন, এসো, আমরা তিনজনই ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকি। ওর মৃত্যু আমাদের জানুর উপর সংঘটিত হোক—এমত এক আবেগদীপ্ত কথায় অবনীভূষণ চোখ বুজলেন। তাঁর মনেই হল না শরীর থেকে যেসব জাহাজি যন্ত্রণা নেমে এই মেয়েটির দুর্বল শরীরে গরল ঢেলেছে তারা এখনও একই শরীরে বিদ্যমান। তিনি যেন কোনো এক উপাসনা গৃহে বসে আছেন এমতই এক গভীর প্রত্যয়ের চোখ। তিনি বললেন, এসো ওকে আমরা শান্তিতে মরতে দিই। কারণ আমরা জানি না ওর নিকট আত্মীয় কেউ আছেন কি না, আমরা কোনো পুরোহিতকেও ডাকতে পারছি না, সুতরাং ঈশ্বরের নাম আমরাই স্মরণ করাব। আর এই গৃহই আমাদের উপাসনাগৃহ।
কেবিনের নীল দেয়ালে একটা মাকড়সা অনবরত নিচ থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে। ওদের তিনজনের কোলের উপর মর্লিনের মুখ, শরীর। দেয়ালে পা ঠেকে আছে। মর্লিনের শরীর কম্বল আবৃত। র্যাকে ওর ওভারকোট। হাতের দস্তানা নীল রঙের। চোখ দুটো মর্লিনের ক্রমশ সাদা হয়ে আসছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওরা তিনজনই এই মৃত্যুর দ্বারা অভিভূত হচ্ছিল এবং মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে ভাবছিল। ওরা দেখল—চোখ দুটো সাদা হতে হতে একেবারে স্থির হয়ে গেল। একটা ঢেকুরের মতো শব্দ, তারপর মৃত্যু।
ওরা মর্লিনের মৃত শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বড় মিস্ত্রি পায়চারি করলেন কেবিনে। দেয়ালে শরীর রেখে মর্লিনের মুখ দেখছিল সুখানী। সে একটু হেঁটে গিয়ে কম্বল দিয়ে মর্লিনের মুখটা ঢেকে দিল। স্টুয়ার্ড দেয়ালে টাঙানো নগ্ন চিত্রের ক্যালেন্ডার থেকে—আজ কত তারিখ, কী মাস, কী বছর এবং বন্দরের নামটা পর্যন্ত তুলে আনল। স্টুয়ার্ড, বড় মিস্ত্রি এবং সুখানীর নির্বিকার ভঙ্গি দেখে দুঃখিত হল। সে বলল, স্যার, সারা রাত আমরা মড়া আগলে পড়ে থাকব।
বড় মিস্ত্রি কী ভেবে যেন দরজা খুললেন, এবং বাইরে যাবার উপক্রম করতেই সুখানী হাত চেপে ধরল, স্যার, আপনি আমাদের ফেলে চলে যাচ্ছেন?
তোমাদের ফেলে যাচ্ছি না সুখানী। মর্লিনের জন্য বাইরে একটু জায়গা খুঁজতে যাচ্ছি।
সুখানী বলল, দরজা বন্ধ করে দেব স্যার?
দাও। বড় মিস্ত্রি অ্যালওয়ে ধরে হাঁটতে থাকলেন। গ্যাঙওয়েতে মনসুর বসে আছে। তিনি গ্যাঙওয়েতে নেমে যেতেই মনসুর উঠে দাঁড়াল এবং আদাব দিল। তিনি লক্ষ্য করলেন না ওসব। তিনি জাহাজময় ঘুরে জেটিতে, জেটির জলে মর্লিনকে ফেলে রাখবার জন্য জায়গা খুঁজতে লাগলেন। তিনি কোথাও জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি দেখলেন সর্বত্র এক নিদারুণ নিরাপত্তার অভাব। তিনি দেখলেন, সর্বত্রই যেন কে জেগে আছে। ওঁদের এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। এ সময়ে ওঁর ফের মদ খেতে ইচ্ছা হল। কিন্তু এ সময় মদ খাওয়া অনুচিত কারণ মর্লিনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাই এখন একমাত্র কর্তব্য। তিনি তারপর দেখলেন ডেকের উপর থেকে একটা শুকনো পাতা উড়ে উড়ে সমুদ্রের দিকে চলে যেতে থাকল। তিনি ভাবলেন, মর্লিনের শরীরে কোনো কোনো আঘাতের চিহ্ন বিদ্যমান….. মর্লিন একবার ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছিল অথবা পাশবিকতার চিহ্ন এখনও ওর শরীরে বিদ্যমান কি না অথবা সুখানী এবং স্টুয়ার্ডের শরীরে মাংস ভক্ষণের মতো উদগার নিক্ষেপ করেছে কি না, যা ওদের তিনজনকেই গ্রাস করবে…. তিনি ছুটতে থাকলেন, তিনি তাড়াতাড়ি কেবিনের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললেন, স্টুয়ার্ড, দরজা খোল—স্টুয়ার্ড! স্টুয়ার্ড!
কেবিনের দরজা খুললে তিনি ঝড়ের মতো ঢুকে মর্লিনের শরীর থেকে কম্বল তুলে নিলেন। ওর শরীরের শেষ আবরণটুকু খুলে ঝুঁকে পড়লেন শরীরের উপরে। সুখানী এসো, স্টুয়ার্ড এসো। বড় মিস্ত্রি চিবুকের নিচে হাত রেখে বললেন, এই দাঁতের চিহ্ন কার?
সুখানী অত্যন্ত সংকুচিত চিত্তে বলল, স্যার আমার। মর্লিনের সামনে মিথ্যা বলে পাপ আর বাড়াতে চাই না।
বড় মিস্ত্রি তীক্ষ্ন চোখে মর্লিনকে দেখতে লাগলেন। সুখানীর কথার সঙ্গে নিজেও বিড় বিড় করে বললেন, শরীরের এসব চিহ্ন দেখে পুলিশ ধরে ফেলবে।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে!
আমাকেও নেবে। বড় মিস্ত্রি একবার সুখানীর দিকে তাকালেন।
সুখানী বলল, বড় অমানবিক!
স্টুয়ার্ড বলল, এই তুষারঝড় এ—জন্য দায়ী।
বড় মিস্ত্রি বললেন, পুলিশের ঘরে আমাদের বিচার হওয়াই উচিত। সুতরাং এসো, ওকে এখন আর কোথাও নিক্ষেপ না করে এখানেই ফেলে রাখি।
এইসব কথা বলার পর সকলে দাঁড়িয়ে থাকল। সকলে পরস্পরকে চোখ তুলে দেখল।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, যা হয় তাড়াতাড়ি করুন।
সুখানীর সঙ্গে তোমার এখানেই ফারাক। এসব কাজ তাড়াতাড়ি হয় না।
তাড়াতাড়ি হয় না?
না, হয় না।
স্যার আপনি ঠিক কথা বলেছেন!
আমাদের এখন ভাবতে হবে কোনো অপরাধই আমরা করিনি। এখন শুয়ে পড়লে ঘুমোতে পারব এমন মনের অবস্থা সৃষ্টি করতে পারলেই এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। যদিও আমরা জানি মনের এমন অবস্থা সৃষ্টি করা অসম্ভব। সুতরাং বোস।
বড় মিস্ত্রি ফের বললেন, একটু কফি হলে ভালো হত। সুখানী কী বলছ।
তা মন্দ নয় স্যার।
স্টুয়ার্ড কিন্তু বের হতে চাইল না। কারণ ওর ভয় কফি আনতে গেলেই ওরা এই কেবিন ছেড়ে চলে যাবে এবং ভোরবেলায় যখন সব জাহাজিরা,—তখনও অন্ধকার থাকবে ডেকে, তখনও সূর্য ভালো করে আকাশের গায়ে ঝুলবে না,—সকল জাহাজিরা ডেক—ছাদ অথবা এনজিনে নেমে যেতে শুনবে স্টুয়ার্ডের ঘরে একজন তরুণীর মৃতদেহ—কম্বলের নীচে স্টুয়ার্ড মৃতদেহটিকে আড়াল করে রেখেছিল।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার আমার মাথার ভিতরটা কেমন ফাঁকা ঠেকছে। তারপর ওদের উত্তর করতে না দেখে বলল, স্যার, আসুন মর্লিনকে পোর্টহোল দিয়ে জেটির জলে ফেলে দি।
যখন লাশ ফুলে ফেঁপে জলের উপর ভেসে উঠবে, যখন দাঁতের কামড় দেখে তোমার দাঁতের চিহ্ন নেবে, তখন…?
কোথাও কোনো উপায় নেই।
আপাতত দেখতে পাচ্ছি না।
সুখানী বলল, বড় দুঃখজনক পরিস্থিতি।
বড় মিস্ত্রি অন্যমনস্কভাবে মর্লিনের দস্তানা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।
স্টুয়ার্ড যেন ক্ষেপে গেল।—স্যার, আমার কেবিনে এসব হচ্ছে! আপনারা আমাকে জপাতে চাইছেন। আপনারা যদি আমাকে এ কাজে সাহায্য না করেন আমি একাই ওকে বয়ে নিয়ে যাব। স্টুয়ার্ড তাড়াতাড়ি কম্বলের ভিতর থেকে মর্লিনকে তুলে কাঁধে ফেলল তারপর দরজা দিয়ে বের হতেই মিস্ত্রি ওর হাত চেপে বলল, তুমি কি ক্ষেপে গেলে?
স্টুয়ার্ড এবার কেঁদে ফেলল, স্যার, আপনারা এ সাংঘাতিক ঘটনাকে আমলই দিচ্ছেন না! আমাকে আপনারা ফাঁসিয়ে দিতে চাইছেন। ঘরে আমার স্ত্রী আছে, সন্তান—সন্ততি আছে।
এইসব কথায় তিনি যথার্থই অভিভূত হলেন। তিনি ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে গেলেন। চোখ মুখ উদ্বিগ্ন। এবং অবিবাহিত জীবনের কিছু সুখদুঃখের কথা স্মরণ করতে পেরে যেন বলতে চাইলেন, স্টুয়ার্ড তুমি আমি সকলে এক সরল পাশবিকতার মোহে আচ্ছন্ন। কখনও ঘরে, কখনও উঠোনে এবং দূরের যব গম ক্ষেতের ভিতর নগ্ন শরীর আমাদের শুধু কামুক করে তোলে। অথবা এই জাহাজ আমাদের কত দীর্ঘ সময় সমুদ্র এবং আকাশের ভিতর আবদ্ধ করে রেখেছে—শুধু নোনা জল, কখনও প্রবাল দ্বীপ এবং নির্জনতা জাহাজের অস্থির এনজিনের শব্দ, দেয়ালের উলঙ্গ সব ছবি আমাদের নিরন্তর নিষ্ঠুর করে রাখছে। সুতরাং দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর বন্দর এবং রমণীর দেহ স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। মর্লিন মরে গেছে। এসো, ওর শরীর আমরা সযত্নে রক্ষা করি। বন্দরে ঝড়। এ অঞ্চলে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত। দেশটাতে এখন শীতের শেষ—কুয়াশা লেগেই থাকবে। ডেসি এমন দিনে আসবে না।
এতক্ষণ সকলকে চুপচাপ থাকতে দেখে সুখানী মর্লিনের চুল মুঠোর ভিতর তুলে বলল, স্যার দেখুন, এই সোনালি চুল কী অপূর্ব! সুখানী ভাবল, কীভাবে আর কথা আরম্ভ করা যায়। স্টুয়ার্ড ভয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছে। সুখানী দুঃখিতভাবে বলল, এই সোনালি চুলে মর্লিন স্যার সুগন্ধ তেল মাখত। গন্ধটা কিন্তু এখনও জীবিত মেয়েদের মতো, তারপর সে একটা ঢোক গিলে বলল, স্যার, আপনি পর্যন্ত ভয়ে টেসে গেলেন! কথা বলছেন না! চুপচাপ বসে মর্লিনের হাতের দস্তানা আপনার শক্ত হাতে গলাবার চেষ্টা করছেন। স্টুয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলল, এসো, তোমাকে লাশটা নামিয়ে রাখতে সাহায্য করছি।
বড় মিস্ত্রি বাংক থেকে নেমে পোর্টহোলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাচের ভিতর থেকে পাশের জাহাজ স্পষ্ট। কাচ খুলে দিলে জাহজিদের শব্দ পেলেন, যাত্রীজাহাজ বলেই সেখানে মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি পোর্টহোলে মুখ রেখে ভাবলেন, এই পোর্টহোল দিয়ে লাশটাকে হাড়িয়া করে দেওয়া যাক। স্টুয়ার্ডের ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কান্না আর ভালো লাগছে না। বস্তুত বড় মিস্ত্রি নিজেও এই মৃতদেহ নিয়ে কী করা যাবে ভেবে উঠতে পারছেন না। তাঁর মাথার ভিতরও শূন্যতা এসে আশ্রয় করেছে। তিনি পোর্টহোলে মুখ রেখেই বললেন, স্টুয়ার্ড, সুখানি মর্লিনকে কাঁধে নাও। তাড়াতাড়ি পোর্টহোল দিয়ে গলাবার চেষ্টা করো বলে, তিনি পাগলের মতো পোর্টহোলটাকে টেনে ফাঁক করবার চেষ্টা করতে থাকলেন।
সুখানী বলল, স্যার, আপনারও কি মাথা খারাপ হয়ে গেল।
বড় মিস্ত্রি গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তবে আমরা কী করতে পারি সুখানী? সমস্ত জাহাজ ঘুরে দেখলাম মর্লিনকে কোথাও রাখা যাচ্ছে না। যেখানেই রাখতে যাব— সেখানেই ধরা পড়ে যাচ্ছি। তারপর তিনি থেমে থেমে বললেন, আহা, ওকে যদি সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারতাম! সমুদ্রে ফেলে দিলে কোনো চিহ্নই পাওয়া যেত না।
সুখানী বলল, স্যার তবে আসুন, ওকে বরফ ঘরে রেখে দি। ভেড়া গোরুর সঙ্গে পড়ে থাকবে। কেউ টের করতে পারবে না। জাহাজ সমুদ্রে গেলে ওকে ফেলে দেওয়া যাবে।
বড় মিস্ত্রির কপাল কুঁচকে উঠল। তিনি আড়চোখে সুখানীর দিকে চাইলেন। যেন, সুখানী এখানে একমাত্র বুদ্ধিমান এবং স্থিরচিত্ত পুরুষ। সুতরাং তিনি ওর উপরই নির্ভর করতে পারেন এমত এক নিশ্চিন্ত মত পোষণ করছেন মনে মনে। তিনি বললেন, স্টুয়ার্ড কী বলে?
স্টুয়ার্ড কোনো কথা বলছে না। সুখানী ওদের দুজনকে অনুশাসনের ভঙ্গিতে বলল, তবে আর দেরি করে লাভ নেই। ওকে কাঁধে তুলে নেওয়া যাক।
মর্লিনের হাত পোর্টহোলে গলানো ছিল এবং মাথাটাও। পোর্টহোল থেকে ওর শরীর ঝুলে পড়ছিল। স্টুয়ার্ড ওর কোমর একটু উপরে তুলে রেখেছে। বড় মিস্ত্রি ডানদিকে দাঁড়িয়ে মর্লিনের তলপেটের নিচে হাত রেখে স্টুয়ার্ডকে ধরে রাখতে সাহায্য করছিলেন।
ওরা তিনজন মিলে মর্লিনকে বাংকে শুইয়ে দিল। ওরা প্রথমেই দরজা খুলে দিল না। সুখানী এখন মাঠে দাঁড়িয়ে কোনো সেনাবাহিনীকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে। সে বলল, স্যার, দরজা খোলার আগে আমাদের কান পেতে শুনতে হবে, বাইরে কোনো শব্দ হচ্ছে কিনা। তারপর দরজা খুলে একজনকে ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্য কেউ যদি আসে তবে শিস অথবা হাতের ইশারা। ইতিমধ্যে মর্লিনকে রসদঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর ফের দরজা বন্ধ করে ছাদের ঢাকনা খুলে মর্লিনের লাশ নিচে হাড়িয়া করে দিলেই ভয় থেকে নিষ্কৃতি। সে রাজ্যটা চিফস্টুয়ার্ডের একান্ত নিজস্ব। এবং আশা করব জাহাজ যতদিন না বন্দর ছেড়ে সমুদ্রে যায় ততদিন স্টুয়ার্ড মর্লিনকে আগলে রাখতে পারবে। তাই বলে সুখানী স্টুয়ার্ডের কাঁধে চাপ দিল।
এনজিন রুমে নেমে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ। অ্যাকোমোডেশান ল্যাডার ধরে ডেক—ছাদে উঠে যাওয়ার পথটাতে বড় মিস্ত্রি কড়া নজর রাখছেন। তাছাড়া ডাইনিং হলের পথটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। বড় মিস্ত্রি অ্যালওয়ের আলো নিভিয়ে পাহারাদারদের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এখন বাইরে ঝড় নেই বললেই হয়। এনজিন রুমে কোনো ফায়ারম্যান হয়তো ওয়াচ দিতে নেমে যাচ্ছে, বুটের ঠক ঠক শব্দ সিঁড়ি ধরে ক্রমশ নিচে নিচে—তিনি সন্তর্পণে অন্ধকার থেকেই বললেন, এবার তোমরা রসদঘরে ঢুকে যাও। কেউ নেই।
সুখানী মর্লিনের মাথার দিকটা ধরেছিল। স্টুয়ার্ড পায়ের দিকটা ধরে বাইরে নিয়ে এল। তারপর রসদঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করার আগে ডাকল, স্যার, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। অ্যালওয়ের আলো জ্বেলে দিন।
ওরা ধীরে ধীরে মর্লিনকে একটা টেবিলের উপর শুইয়ে দিল। টেবিল থেকে কাচের ডিস এবং অন্যান্য সব পানীয় পাত্র তুলে অন্য স্থানে রেখে দিল। এই ঘরে অন্যান্য দরজা খুললে জাহাজিদের রসদ, নিচে রসদ ঘর—ভিন্ন ভিন্ন রকমের সব সবজি এবং সবজির গন্ধ আসছে এই ঘরে। ওরা এ সময় মর্লিনের শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ল।
স্টুয়ার্ড বলল, কম্বল দিয়ে ঢেকে দি?
বরং ওর গাউনটা নিয়ে এসো।
মর্লিনের নগ্ন শরীর ভয়ানক কুৎসিত দেখাচ্ছে। বড় টেবিলের উপর ওর শরীর মৃত ব্যাঙের মতো—হাত পা দুটো শীর্ণ এবং চুলের সেই গন্ধটা তেমনি ফুর ফুর করে উড়ছে। চোখ দুটো এখনও শুধু স্থির। ওর বুকের পাঁজর স্পষ্ট। স্তনের সর্বত্র মাতৃত্বের চিহ্ন ধরা পড়ছে। স্টুয়ার্ড এবার কেমন শিউরে উঠল। এই শুকনো স্তনের আশে পাশে সহসা সে দেখে জঠরে নিমগ্ন কোনো যুবক যেন হাত বাড়াচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি কম্বল এনে ওর শরীর ঢেকে দিল।
ওরা এখন সকলেই কথা কম বলছে। বড় মিস্ত্রি ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, নিচে হাড়িয়া করে দেওয়া যাক তবে।
স্যার। স্টুয়ার্ড ডাকল।
বলো।
আপনি স্যার আমাদের ওপরওয়ালা। আপনি আমাদের সাহস দিন।
যেন এই পশুবৎ আচরণ অথবা নিষ্ঠুর ইচ্ছার দ্বারা প্রহৃত এই যুবতীর সকল অস্তিত্বের করুণা ক্রমশ জাহাজের ঘুলঘুলিতে মুখ রাখছে। দেয়ালে ওদের ছায়া পড়ছিল। সুখানী কেমন বিকৃতভাবে একটা ঢোক গিলে বলল, আমি নিচে নেমে যাচ্ছি। আপনারা উপর থেকে ওকে হাড়িয়া করুন। এই বিসদৃশ ঘটনা চোখে আর দেখা যাচ্ছে না।
বড় মিস্ত্রি নিচের ঢাকনা খুলে দিল। নিচের ঘরগুলো অন্ধকার। সুখানী সিঁড়ি ধরে নেমে যাবার আগে নিচের আলো জ্বেলে নিল। স্টুয়ার্ড হাঁটু গেড়ে বসল। নিচের ঘরগুলোতে ভয়ানক ঠান্ডা। আলু, পেঁয়াজ এবং শাক—সবজি এখান থেকে কিছু কিছু চোখে পড়ছে। বরফের ঠান্ডা স্রোত সুখানীকে ভয়ংকর কষ্ট দিচ্ছে। সবকিছু ক্লান্তিকর। সে এবার উপরের দিকে তাকাল। বড় মিস্ত্রি হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন।
ওরা তিনজন বড় টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ওরা তিনজন মাথায়, কোমরে এবং পায়ে হাত রাখছে। বড় বড় চিনেমাটির বাসন টেবিলের নিচে, কাবার্ডে টি—সেট সাজানো। মাদক দ্রব্য পানের নিমিত্ত সব পাতলা কাচের পাত্র ইতস্তত সজ্জিত। বড় মিস্ত্রি অন্যমনস্ক ছিলেন। পা সরিয়ে আনার সময় কিছু কাচের পাত্র ভেঙে নিচে গড়িয়ে পড়ল। কাচ ভাঙার শব্দ, টেবিলের উপর বড় দর্পণে তিনজনের প্রতিবিম্ব, মর্লিনের শক্ত শরীর—সবই ভীতিপ্রদ। মর্লিন ওদের দিকে যেন শক্ত চোখ নিয়ে চেয়ে আছে। সুতরাং নিরন্তর এক পাপবোধ ওদের তীব্র তীক্ষ্ন করছিল।
ওরা এবার মর্লিনকে কোলের কাছে নিয়ে শব—বাহকের মতো সিঁড়ি ধরে নেমে যাবার সময় সন্তর্পণে ছাদের ঢাকনা টেনে খুব ধীরে ধীরে—যেন এতটুকু আওয়াজ না হয় অথবা যেন মর্লিনের গায়ে আঁচড় না লাগে—ওরা মর্লিনকে এ সময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছিল। অথচ মর্লিনের শরীর মুরগির মৃত ঠ্যাং—এর মতো কদর্য এবং কঠিন। এই আলিঙ্গনের উষ্ণতা ওদের তিনজনকেই ভাবপ্রবণ করে তুলছিল।
মর্লিনের মুখ থেকে সব রঙ মুছে গেছে। চোখে টানা কাজলের চিহ্ন তখন চোখের নিচে এবং ভ্রুর আশেপাশে লেগে আছে। পুতুলনাচের নায়িকার মতো চোখ—মুখ। ওরা মর্লিনকে দরজার সামনে শুইয়ে দিল। বরফ ঘরের তালা খুলে দিল স্টুয়ার্ড—বড় বড় সব মাংস, গোরু, ভেড়া, শূকর এবং গোটা গোটা ধড় হুকের মধ্যে ঝুলছে। অথবা বড় বড় সব টার্কির মাংস—সোঁদা গন্ধ সর্বত্র, প্রচণ্ড ঠান্ডা এই বরফ ঘরে। ওরা তিনজনই ভিতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি মর্লিনকে একপাশে রেখে একটা ত্রিপলে ঢেকে বের হয়ে পড়ল। দরজা টেনে সিঁড়িতে ওঠার মুখে প্রথম কথা বলল স্টুয়ার্ড—স্যার, কাল ভোরে যখন চিফ কুক রসদ নিতে আসবে, কী বলব?
রসদ দেবে।
ওরা ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই রসদের ওজন দেখে। দরজাটা খোলা থাকলে দেখার ভয় আছে।
দরজা বন্ধ রাখবে।
দরজা সবসময় বন্ধ রাখলে সন্দেহ করতে পারে। কারণ মেস—রুম মেট গোস্ত কেটে এনে ওজন করে দেয়।
মেস—রুম মেটকে ভোরবেলায় অন্য কাজ দেব। রসদ ভালো দেবে, ওজন বেশি দেবে। সবাই খুশি থাকবে তবে। কেউ সন্দেহ করবে না।
স্টুয়ার্ড তবু সিঁড়ি ধরে উঠল না। সে বরফ ঘরের দিকে পিছন ফিরে তাকাল।
সে নড়ছিল না। সে বিড়বিড় করে কীসব বকছিল। সে দরজাটার সামনে হেঁটে গেল। দরজা খুলতেই দেখল পা’টা মর্লিনের খালি। সে ত্রিপল দিয়ে পা’টা ঢেকে দরজা বন্ধ করে তালাটা লাগাল। তালাটা টেনে দেখল ক’বার। যখন দেখল তালাটা ঠিকমতো লেগেছে—কোথাও কোনো গোপন বিশ্বাসভঙ্গ উঁকি দিয়ে নেই অথবা যখন সবই অতি সন্তর্পণে সংরক্ষিত হল…. আর কী হতে পারে, স্টুয়ার্ড এইসব ভেবে সন্দেহের ভঙ্গিতে বলল, স্যার এটা আমার ভালো লাগছে না। অর্থাৎ এখন মনে হচ্ছে যেন স্টুয়ার্ড নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়ছে।
এতক্ষণ পর মনে হল, বড় মিস্ত্রির গলাটা ভিজে যাচ্ছে। এতক্ষণ পর একটা চুরুটের কথা মনে হল। তিনি চুরুটে আগুন দিয়ে বললেন, কেন, কী হতে পারে?
সুখানী মুখ বিকৃত করে বলল, ওর কথা বাদ দিন স্যার।
সুখানী যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।
বেশ চুপ করে থাকলাম।
স্টুয়ার্ড বলল, আর একবার নামলে হয় স্যার।
কেন? আবার কেন?
দেখতাম কোথাও কিছু পড়ে থাকল কি না। স্টুয়ার্ডকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। যেন এই হত্যার জন্য ওকে সকলে দায়ী করে সরে পড়ছে। সে বলল, স্যার, ধরা পড়লে আমি সকলের নাম বলে দেব। কাউকে ছাড়ব না। আপনারা সকলেই ওকে কামড়েছেন।
বড় মিস্ত্রি ধমক দিলেন, স্টুয়ার্ড, তোমার মন অত্যন্ত ছোট।
স্যার, আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন না। আপনারা কাল থেকে যদি এমুখো না হন তবে কী করতে পারি! স্টুয়ার্ডের গলায় কান্না ভেসে উঠল।
সুখানী পায়ের নখে ডেকের কাঠে আঁচড় কাটবার চেষ্টা করছিল। বড় মিস্ত্রি স্টুয়ার্ডের মুখ দেখছেন। সে মুখ বিবর্ণ। তিনি এবার স্টুয়ার্ডের হাত ধরে বললেন, রাতে কোথাও যাব না স্টুয়ার্ড। ছাদের নিচে বরফ ঘরে মর্লিনের পাশে বসে থাকব। কোনো ভয় নেই তোমার।
ওরা তিনজনই এবার যার যার কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। স্টুয়ার্ড নিজের কেবিনের দরজা খুলে দিল। দরজার পাল্লাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। সে দরজা বন্ধ করতে যেন সাহস করছে না। ওর ভয় করছে। এতদিনের জাহাজি জীবন অথচ কখনও এমন নিষ্ঠুর ঘটনার দ্বারা সে আহত হয়নি।
বড় মিস্ত্রি কিছু বলতে পারছেন না। তিনি খুব ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।
সুখানী বলল, শুয়ে পড় স্টুয়ার্ড। রাত আর বেশি নেই।
সুখানীর ঘর ডেক পার হলে। সে ফোকসালে থাকে। জাহাজের শেষ দিকটাতে জাহাজিদের জন্য অনেকগুলো ঘর। সুখানী এবং ডেক—কসপ সেখানে থাকে—পাশাপাশি বাংকে।
সুতরাং সুখানী বাইরে এসে দেখল, রাত কমে যাচ্ছে। সুখানী হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। রাত শেষ হচ্ছে। বরফ পড়ছে না। ঝড় নেই। এক শান্ত নীল রঙ জাহাজের শরীরে যেন লেপ্টে আছে। কুয়াশা নেই। সুতরাং শহরের আলো স্পষ্ট। আকাশে ইতস্তত নক্ষত্র জ্বলছে। যেসব জাহাজ উষ্ণ স্রোতে সমুদ্রে মাছ ধরতে বের হয়েছিল ওরা একে একে ফিরে আসছে। সে এই শীতের ভিতর রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়াল। রাতের সব ঘটনা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। দেশ বাড়ির কথা মনে হল। স্ত্রীর কথা মনে হল—সন্তান—সন্ততি অর্থাৎ এক সুনিপুণ সাংসারিক জীবনের কথা ভেবে এই জাহাজি জীবনকে ধিক্কার দিতে থাকল। প্রেম, প্রীতি, স্নেহ, হৃদয়ের ঘরে সব মরে গেছে, কারণ এই মৃত্যুজনিত বেদনা সুখানীকে আড়ষ্ট করছে না, মর্লিন মরে গেছে—জাহাজের অন্যান্য জাহাজিরা ঘুমে মগ্ন শুধু ওয়াচের জাহাজিরা জেগে ওয়াচ দিচ্ছে। যদি পুলিশ খোঁজ করতে আসে, যদি এই হত্যাজনিত দায়ে একটা লম্বা দড়ি ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে… সুখানী ভয়ে নিজের গলাটা চেপে ধরল এবার। তারপর আরও সব ভয়ংকর দৃশ্যের কথা ভেবে সে চুপি চুপি স্টুয়ার্ডের কেবিনে ফিরে যাবার জন্য পা চালাল। এক দুরারোগ্য ভয় সুখানীকে নিঃসঙ্গ পেয়ে জড়িয়ে ধরছে।
সে স্টুয়ার্ডের কেবিনে এসে দেখল, দরজা খোলা! পাল্লা ধরে স্টুয়ার্ড আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে ডাকল, এই! এই! হচ্ছে কী! এবং মনে হচ্ছে বজ্রজনিত মৃত্যু। সুখানী ওকে নাড়া দিল বারবার। এবং স্টুয়ার্ডকে টেনে নিল বাংকের কাছে; তারপর ধমক। চুপচাপ শুয়ে থাক। এমন করবে তো খুন করব।
সুখানী ঘুরে গিয়ে বড় মিস্ত্রির কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল। কেবিনের দরজা খোলা। বড় মিস্ত্রি একটা টেবিলের উপর ঝুঁকে আছেন। শরীরে কোনো জীবনের লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না।
সুখানী ডাকল, স্যার, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন।
বড় মিস্ত্রি টেবিল থেকে নড়লেন না।—দরজাটা টেনে দাও সুখানী। বড় মিস্ত্রি টেবিল থেকে মাথা তুললেন না। মর্লিনের সাদা চোখ ওঁকে তখনও অনুসরণ করছে যেন। তিনি কেবিনে পায়চারি করতে থাকলেন। রাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পায়চারি করার ইচ্ছা। ভোরের বাতাসে পাখিরা যখন উড়বে, যখন কোথাও কোনো হত্যা অথবা রাতের দুর্ঘটনাজনিত দুঃখ মাস্তুলের গায়ে লেগে থাকবে না, তখন বড় মিস্ত্রি বাংকে শুয়ে ঘুম যাবার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু অধিক সময় তিনি পায়চারি করতে পারলেন না। তিনি বাংকে শুয়ে পড়লেন।
সুখানী ডেক ধরে হেঁটে চলে গেল। সে নিজের ফোকসালে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকল। আলো জ্বালল না। দরজা বন্ধ করে পোর্টহোল খুলে সামনে মুখ রেখে বসে থাকল। রাতের সব পাখিদের দেখে ইতস্তত ছড়ানো নাবিকদের সব ছবি দেখে এবং দূরের জেটিতে একটি শিশুর কান্না শুনে ওরও মর্লিনের জন্য কষ্ট হতে থাকল!
ওরা তিনজন জাহাজের তিনটি ঘরে পোষা পাখিদের মতো ঘুমোচ্ছিল। বরফ ঘরে মর্লিন। ত্রিপলে শরীর ঢাকা পড়ে আছে। অন্যান্য কেবিনে দীর্ঘদিন পর রাতের এই প্রহরটুকুকে জাহাজিরা আস্বাদন করছে। ঠান্ডার জন্য সকলেই কেমন কুঁকড়ে ছিল। কোয়ার্টার মাস্টার গ্যাঙওয়ের ওয়াচ শেষ করে ফোকসালে ফিরে আসছে। ভোরের আলো ফুটে উঠলে সকলে রেলিংয়ে ভর করছে—জেটি অতিক্রম করে শহরের বাস ট্রাম এবং রমণীদের প্রিয়মুখ… তারপর মাটির স্পর্শের জন্য উদ্বিগ্ন এক জীবন…. আহা এই দেশ, মাটি, পাব, নাইট ক্লাব, সুখ শুধু সুখ, উলঙ্গ এক চিন্তা সব সময়ের জন্য—জাহাজিরা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর সুখ নামক উলঙ্গ এক নগরে হাঁটছে যেন।
ওরা তিনজন পোষা পাখির মতো স্বপ্ন দেখল।
বড় মিস্ত্রি স্বপ্নের কোলাহলে এক অপার্থিব দৃশ্য দেখে অনেক দূর চলে যেতে থাকলেন। তিনি দূরে সব চীনার গাছ দেখলেন, আকাশ দেখলেন অথবা দেখলেন পাইন আপেলের নীচে সুন্দরী রমণীগণ নগ্ন হয়ে বসে আছে। তিনি বড় বড় চীনার গাছ ফাঁক করে চলে যাচ্ছেন। ডেইজি ফুলের গন্ধ কোথাও এবং সামনে সেই উলঙ্গ নগর। তিনি পোশাক পরিত্যাগ করে সেই নগরে প্রবেশ করে কেবল হ্যাঁচ্চো দিতে থাকলেন।
বড় মিস্ত্রি স্বপ্নের ভিতর বিগত জীবনের কিছু মহত্তম ঘটনা দেখতে পেলেন।
সুখানী স্বপ্ন দেখল—একটা উট মরুভূমি থেকে নেমে আসছে। ওর সঙ্গে দড়ি দিয়ে এক উলঙ্গ নারীকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বরফঘরে ছাল তুলে নেওয়া গোরু অথবা শূকরের মতো দেখাচ্ছে রমণীকে। উট দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এক মরূদ্যানে প্রবেশ করল। সামনে নীল হ্রদ। হ্রদের জলে উট নেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যুবতী প্রাণ পাচ্ছিল। যখন খেজুর গাছের পাতাগুলি সবুজ গন্ধ ছড়াচ্ছিল তখন সুখানী দেখল যুবতী সেই উটের পিঠে বসে এবং হাজার হাজার পুরুষ সেই যুবতীর জন্য প্রাণ দিতে উদ্যত হচ্ছে। যুবতী বসে বসে প্রেমের আধার থেকে কণামাত্র বিতরণ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সুখানী ফের যখন উটটিকে দেখল তখন স্বপ্নের ভিতর উটটি চলাফেরা করছিল—উটের পায়ে দড়ি এবং দড়িতে রমণীর শরীর আবদ্ধ। সেই এক ঘটনা বারবার চোখের উপর পুনরাবৃত্তি হতে থাকল।
সুখানী স্বপ্নের ভিতর শেষ পর্যন্ত এলবিকে দেখল। এলবির সকরুণ চোখ এবং কান্না স্বপ্নের অলি গলি থেকে বের হয়ে আসছে।
আর স্টুয়ার্ড একটা মৃত কৃমি হয়ে বাংকে পড়েছিল। নড়ছিল না। সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুখ। অথচ ওর স্বপ্নে একটা তাজা গোলাপ ফুল ফুটে ছিল সবসময়। চেরি নামক এক যুবতীর মুখ সেই ফুলের ভিতর থেকে বারবার উঁকি দিচ্ছে। সে শুয়ে শুয়ে শুধু ঢোক গিলল। ওর স্বপ্নের শেষটুকুতে ছিল একটি পুরুষ—অশ্বের নিচে শুয়ে একটি নগ্ন যুবতী বারবার সহবাসের চেষ্টায় ব্যর্থ হচ্ছে।
তারপর জাহাজে ভোর হল। সকলেই উঠে পড়ল একে একে। এখনও জাহাজ—ডেকে অন্ধকার আছে। সারেং সকলকে বলল, টান্টু। ওরা উপরে উঠে এল। ওরা জল মারতে আরম্ভ করল ডেকে। এনজিনের জাহাজিরা এনজিন সারেংয়ের সঙ্গে নিচে নেমে গেল। বয়লারের স্মোকবক্স পরিষ্কার করার জন্য কয়েকজন কোলবয় তরতর করে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল। মেজ মিস্ত্রি একবার নীচে নেমে ব্যালেস্ট পাম্পের আশেপাশে টর্চ মেরে কী যেন অনুসন্ধান করে গেছেন—উপরে এখন ডেকজাহাজিরা ডেকে জল মারছে। রাতে যে তুষারঝড় হয়েছিল জল মেরে তার শেষটুকু যেন পরিষ্কার করে দিচ্ছে। একটু বাদে আলো ফুটবে। এবং রোদ উঠবে।
ডেক—জাহাজিরা গাম—বুট পরে জল মারছিল। হিমেল হাওয়া সমুদ্র থেকে উঠে আসছে। জেটি অতিক্রম করলে বালিয়াড়ি। এ দেশে এবার বসন্ত আসছে। বালির চরে নতুন ঘর উঠছে। কার্নিভেল বসবে। গাছের পাতাসকল কুঁড়ি মেলেছে। ডেক—জাহাজিরা এই শীতের ভিতর রোদের উষ্ণতার জন্য প্রতীক্ষা করছিল এবং তীরের দৃশ্যসকল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার গ্লানি মুছে দিচ্ছিল।
ঠিক এ সময়েই স্টুয়ার্ড দরজা খুলে দেখল ভোর হয়ে গেছে। ওর স্বপ্নের কথা মনে হল এবং মনে হল ভাণ্ডারী, চিফ কুক আসবে রসদ নিতে। তারপর গত রাতের মর্লিন, মৃত্যু এবং হত্যাজনিত দায়—সবকিছু ওকে ফের গ্রাস করতে থাকল। সে বাথরুমে গেল না, চোখমুখ ধুল না—রসদ ঘরের ঢাকনা খুলে তরতর করে নিচে নেমে গেল। বরফ ঘরের দরজা খোলার আগে ভাবল, বড় বড় ভালো গোস্ত বাইরে বের করে দরজা বন্ধ করে দেবে। সে মেনুর কথা ভাবল। কী মেনু হবে এমত একটা আন্দাজ করে দরজা খুলতেই সে ভয়ে এবং বিস্ময়ে হতবাক! দেখল, মর্লিনের মুখ খোলা। মর্লিনের মৃত সাদা চোখ ওকে দেখছে। সে সেই ছোট ত্রিপলে মুখ ঢাকতে গিয়ে দেখল পা বের হয়ে থাকছে। সে টানাটানি করল অনেকক্ষণ। কিন্তু পা মাথা একসঙ্গে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিতে পারল না।
স্টুয়ার্ড একা বলে হুক থেকে গোস্ত নামাতে দেরি হচ্ছিল। ওর কষ্ট হচ্ছিল খুব। কী করবে কী না করবে ভেবে উঠতে পারছে না। একটা অস্পষ্ট আশঙ্কা ওকে সব সময় বিব্রত করছে। ওর গলা শুকিয়ে উঠছে। ছাদে পায়ের শব্দ। ভাণ্ডারী, চিফ কুক নেমে আসছে। ওদের শব্দ পেয়ে সে হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে বসে পড়ল। মর্লিনকে টেনে টেনে বরফ ঘরের বালকেডের পাশে নিয়ে গেল। স্টুয়ার্ড দেখল, ওর অনাবৃত দেহের রঙ এবং এই বাসি গোস্তের রঙ হুবহু এক। সে ঝুলানো ষাঁড় গোরুর ভেতর থেকে দেখল ওরা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। সে কেমন মাথার ভিতর যন্ত্রণা বোধে অবসন্ন হয়ে পড়ছে। সে দুবার দুর্গা দুর্গা নাম জপতেই ভূতের মতো নতুন এক বুদ্ধির আশ্রয়ে চলে গেল—কপিকলটাকে এগিয়ে এনে মর্লিনকে পায়ে গেঁথে হুকে ঝুলিয়ে দিল। সে নিচে বসে সব দেখতে দেখতে ভাবল—এই অনাবৃত শরীরের রঙ নিয়ে মর্লিন এখন ছাল চামড়া ছাড়ানো গোরু ভেড়া হয়ে গেল। দরজা থেকে মর্লিনের অস্পষ্ট শরীরের রঙ এবং আকার আধপোড়া শূকরের মতো দেখাচ্ছিল। স্টুয়ার্ড বুঝল, এই ঘরের দেয়াল, ছাদ এবং হুকের সর্বত্র একই দুঃখময় নৈরাশ্যে নিমজ্জিত। সে দরজার ভিতর দিয়ে ঝোলানো গোস্তের সঙ্গে মর্লিনের এতটুকু প্রভেদ খুঁজে পাচ্ছে না। সে এবার কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারল। রসদ বের করে অন্যান্য দিনের মতো কমবেশি করার স্পৃহাতে মেসরুম—মেটকে ডেকে আলু কপির ঘরে হামগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে ঢুকে গেল।
অন্যান্য দিনের মতো চিফকুকের সঙ্গে স্টুয়ার্ডের বচসা হল না রসদ নিয়ে। চিফকুক উলটেপালটে গোস্ত দেখল। ওরা রসদ নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। ডেক ভাণ্ডারী এবং এনজিন ভাণ্ডারীও রসদ নিয়ে উপরে উঠে গেল। স্টুয়ার্ড সকলকে দুটো করে আলাদা ডিম দিয়েছে। চিফকুককে আলাদা অক্সটেল দিয়েছে। সকলেই মোটামুটি খুশি। ওরা সকলে রসদ নিয়ে উপরে উঠে গেলে স্টুয়ার্ড ফের বরফ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। অনেকগুলো ঝুলানো মাংসের লাশ অতিক্রম করে মর্লিনের পিঠ এবং মাথার ডান দিকের অংশটা অস্পষ্ট এক শূকরের মাংসের মতো। টার্কির পেটের দিকটার মতো নিতম্বের ভাঁজ। এই ঘরে মর্লিন শূকর ভেড়া অথবা গোরুর মতো শরীর নিয়ে এখন হুকে ঝুলছে। শুকনো স্তন এবং অন্য কিছু দেখার জন্যই সে এবার ভিতরে ঢুকে মুখোমুখি দাঁড়াল। মর্লিনের তলপেট সংলগ্ন মুখ, সোনালি চুলে এখনও তাজা গন্ধ, অথচ মর্লিনকে মরা মাংস ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। সে পেটের নিচে হাত বুলোতে থাকল অন্যমনস্কভাবে।
যে ভয়টা নিরন্তর কাজ করছিল স্টুয়ার্ডের মনে এ সময় সেই ভয়টা কেটে যাচ্ছে। সে বলল, মর্লিন আমরা তোমাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করব। সে প্রদক্ষিণ করার মতো মর্লিনের শরীরটা একবার ঘুরে ঘুরে দেখল। সে বলল, এই নিষ্ঠুরতার জন্য গতকালের তুষারঝড় দায়ী। অথচ মনে হল— নিরন্তর সে তার অপরাধবোধকে দূরে রাখার স্পৃহাতে এমন সব কথা বলছিল। সে নিজের মনেই হেসে বলল, শুধু মাংস ভক্ষণে তৃপ্তি থাকে না মর্লিন।
তারপর সে দরজা বন্ধ করে উপরে উঠে যাচ্ছে।
জাহাজে দৈনিক কাজ জাহাজিরা করে নিচ্ছে। সারাদিন কাজ। দিন ছোট বলে রাতের কিছু অংশও ওদের কাজের ভিতর ঢুকে গেল। সারাদিন কাজের পর এক সময়ের জন্য বড় মিস্ত্রি, স্টুয়ার্ড এবং সুখানী একত্রে বসেছিল। ওরা কোনো কথা বলেনি। কারণ রাতে একই দুঃস্বপ্ন এসে এদের জড়িয়ে ধরবে ওরা জানত।
ওরা প্রতি রাতে জাহাজের কেবিনে দুঃখী জাহাজির মতো বসে থাকত।
একদিন ওদের পোর্টহোলের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ায় সুখানী বলল, বড় সাব, বাইরে রোদ উঠেছে।
বড় মিস্ত্রি বললেন, সুখানী, চল, মর্লিনকে দেখে আসি।
স্যার, ও—ভাবে মর্লিনকে আমি দেখতে পারব না। স্যার, বরং আমাদের পুলিশের কাছে ধরা দেওয়া ভালো। এভাবে মৃতদেহের উপর কুৎসিত আচরণ করে জাহাজে আমি বাঁচতে পারব না। রাতে স্যার ঘুম হচ্ছে না। যেখানে যখন থাকছি মর্লিন মৃত পাথরের চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকছে।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, আমার সামনে শুধু ঈশ্বরের থাবা। যেখানে থাকছি সেখানেই গলা টিপে ধরতে চাইছে।
বড় মিস্ত্রি দেখছেন ধীরে ধীরে ওরা তিনজনই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বড় মিস্ত্রি বললেন, রাতে আজকাল একই স্বপ্ন দেখছি—আমার স্ত্রী সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছেন। মৃত। চোখ মুখ পচে গেছে।
সুখানীর চোখ মুখ লাল। ওর শরীর বাংকের উপর হিংস্র থাবা নিয়ে বসে আছে।
বড় মিস্ত্রি স্টুয়ার্ডকে বললেন, স্টুয়ার্ড, মর্লিনকে সন্ধ্যার পর হুক থেকে নামিয়ে বাইরে শুইয়ে রাখবে। আমি আর সুখানী শহর থেকে ফুল নিয়ে আসব। ওর পোশাক যেন পরানো থাকে। আমরা মর্লিনকে ভালোবাসার চেষ্টা করব।—সুখানী, তিনি সুখানীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমার মনে হয় যদি যথার্থই আমরা মর্লিনকে ভালোবাসতে পারি, যদি মনে হয় মর্লিনের শরীর প্রীতিময়—তখন আমাদের পাপবোধ নিশ্চয়ই কিছুটা লাঘব হবে। কারণ আমরা সকলেই একদিন এরকম ছিলাম না। আমরা ঘুমোতে পারব। সারারাত কঠিন দুঃস্বপ্ন আমাদের আগলে থাকবে না।
সুখানী বলল, বরং আমাদের জীবনেও কিছু কিছু মহত্তর ঘটনা আছে যা মর্লিনকে ফুল দেবার সময় বলতে পারি।
পাঁচটা না বাজতেই জাহাজ ডেকে রাত নেমে এল। বাইরে ঠান্ডা। শীত যাবার আগে যেন বন্দরটাকে প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ভোরের রোদটুকু এবং আকাশের পরিচ্ছন্নতা এই শীতকে তীব্র তীক্ষ্ন করেছে। ওরা তিনজন গ্যাঙওয়ে ধরে নেমে গেল। ওরা ওভারকোট পরেছিল, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ ছিল ওদের। বড় মিস্ত্রি হাতে একটা স্টিক রেখেছে।
সুখানী সহসা বলল, স্যার স্টুয়ার্ডের ফিরে যাওয়া উচিত। মর্লিনকে জাহাজে একা ফেলে রাখা উচিত হয়নি। অন্য কেউ যদি ওকে আবিষ্কার করে ফেলে?
বড় মিস্ত্রি বললেন, আরে না! তুমিও যেমন—স্টুয়ার্ড ফাঁক পেলেই ওখানে ঘুর ঘুর করবে এবং ধরা পড়ার সুযোগ করে দেবে।
এ সময় ওরা সমুদ্রের ধারে ধারে কিছু পুরুষ এবং রমণী দেখতে পেল। জেটির জাহাজগুলো অতিক্রম করে ছোট এক মাঠ, কিছু টিউলিপ ফুলের গাছ। বার্চ জাতীয় গাছের ছায়ায় ছায়ায় ওরা হেঁটে যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে সব লাল নীল রঙের বাড়ি। এবং সাদা আলো। সমুদ্রের জল বাতাসের সঙ্গে উঠে আসছে। ইতঃস্তত ভিন্ন ভিন্ন পাব এবং নাইট ক্লাবের লাল বিজ্ঞাপন। অন্য দিন হলে স্টুয়ার্ড এইসব নাইট ক্লাবে ঢুকে যেত, ওদের উলঙ্গ নাচ দেখে সারারাত কামুক হাওয়ায় ভেসে বেড়াত। সুখানী, পাবের ধারে অথবা রাস্তার মোড়ে পালকের টুপি পরে সং দেখানোর মতো যারা দাঁড়িয়ে থাকত তাদের একজনকে বগলে চেপে বালিয়াড়িতে নেমে যেত—কিন্তু আজ ওরা তিনজনই শুধু দেখছে, ওরা তাজা ফুল কেনার জন্য পথ ধরে হাঁটছে।
বড় মিস্ত্রি স্টুয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মর্লিনকে জেটির কোন জায়গা থেকে তুলে নিয়েছিল?
জেটির তিন নম্বর ক্রেনের নিচ থেকে।
সুখানী স্টুয়ার্ডকে পুলিশের মতো জেরা করে বলল, সে তখন কী করছিল?
একজন জাহাজিকে সুখ দিচ্ছিল।
কতক্ষণ ধরে?
খুব শীত। সময় আমি হিসাব করিনি।
তুমি ওকে কী বললে?
আমি একটু সুখ চাইলাম।
উত্তরে সে কী বলল?
ওরা উঁচুনিচু পথ ধরে হাঁটছিল। ওরা শহরের বাজার দেখার জন্য এবং ফুল কেনার জন্য উঠে যাচ্ছে। বড় মিস্ত্রি চলতে চলতে লাঠি ঘুরাচ্ছিলেন, যেন তিনি কুকুরের দৌড় দেখতে যাচ্ছেন। হত্যাজনিত কোনো ভয়ই ওদের এখন নেই, এমত চোখ—মুখ ওদের সকলের।
সে বলল, একটু গরম দাও আমাকে, নইলে শীতে মরে যাব।
বড় মিস্ত্রি ধমকের সুরে বললেন, সুখানী, আমরা এই বন্দর—পথ ধরে কোথায় যাচ্ছি?
স্যার, ফুল কিনতে।
কিন্তু গোটা পথটা ধরে তুমি একটা পেটি দারোগার মতো কথা বলছ!
বড় মিস্ত্রিকে খুশি করার জন্য সে বলল, আজ ভোরেও স্যার কাগজ দেখলাম। শহরের কর্তৃপক্ষ মর্লিন সম্পর্কে একেবারে উদাসীন। শহর থেকে একটি মেয়ে গায়েব হয়ে গেল অথচ…
স্টুয়ার্ড নাকের মধ্যে রুমাল ঢুকিয়ে ভিতরটা পরিষ্কার করল। এবং বলল, নিরুদ্দিষ্ট কলামটা দেখেছিলে?
হ্যাঁ, দেখেছিলাম বইকি। ওতে আছে, এক ভদ্রমহিলার একটি কুকুর নিখোঁজ হয়েছে। কুকুরের যে খোঁজ দিতে পারবে তাকে দশহাজার পাউন্ড পুরস্কৃত করা হবে। স্যার, চলুন, একটা কুকুর ধরে নিয়ে ভদ্রমহিলার কাছে যাই।
ওরা একটা পথের মোড় ঘুরল। এই পথটা একটু অন্ধকার। ওরা ক্রমশ সমুদ্র থেকে দূরে সরে আসছে। সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে না আর। বাতাসের সঙ্গে তেমন জলীয় কণাও নেই। আগন্তুক তিনজনকে শহরের পুরুষ ও রমণীগণ দেখছিল। নীল আলো, হিমেল হাওয়া এবং পথের বাস, ট্রামের শব্দ, নাইট ক্লাবের সংগীত, কাফে, বার মিলে একটা রহস্যের অন্ধকার যেন এই পথটার ভিতর ঢুকে স্তব্ধ হয়ে আছে। ওরা এখানে থামল। একটা বাড়ির ভিতর থেকে কিছু কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে। ওরা দেখল, উপরে লেখা আছে ‘কুকুর ভাড়া পাওয়া যায়’।
ওরা একসময় একটা সরু লেগুনের পাড় ধরে হাঁটতে থাকল। উঁচুনিচু পথ। সমুদ্র বড় সন্তর্পণে খুব সরু পথ করে শহরের ভিতর ঢুকে গেছে। কতবার ডেসি এবং বড় মিস্ত্রি এখানে নৌকা বাইচ দেখতে এসেছিলেন। ডেসিকে নিয়ে বড় মিস্ত্রি কোন কোন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন—নৌকা বাইচ দেখার পর লেগুন অতিক্রম করে এক নির্জন স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় একটি বার্চগাছের নিচে অথবা দূরের সব পাহাড়শ্রেণী পার হলে ছোট্ট কিশোরী মেয়ের গ্রাম্য এক পাবে সারাদিন মাতলামি এবং অন্য অনেক সব নগণ্য ঘটনার স্মৃতি ভিতর থেকে বয়ে বয়ে উঠে আসছিল।
বড় মিস্ত্রি, সুখানী এবং স্টুয়ার্ডের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললেন কারণ যে সেতুটা এই লেগুনকে সংযুক্ত করছে সেখানে হরেক রকম যুবক—যুবতী লেগুনের জলে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে এবং প্রেম নিবেদন করছে। দূরে পাহাড়শ্রেণী, মাথায় লাল নীল অজস্র আলো। লেগুনের নীল জলে সরু সরু স্কিপ বাঁধা। ছই আছে এবং অনেকটা ঘরের মতো—যেখানে ইচ্ছা করলেই কোনো বেশ্যা রমণীকে নিয়ে রাত কাটানো যায়। ডেসি এবং বড় মিস্ত্রি অনেকবার এইসব স্কিপে রাত কাটিয়েছেন—ওদের দুজনকে আজ তিনি এ কথা জানালেন। জাহাজে রোজ রোজ ডেসি যাচ্ছে আর রোজ রোজ তিনি তাড়িয়ে দিচ্ছেন—এ কথাও জানালেন। নির্মল এই আকাশ, মাথার উপর পাহাড়শ্রেণীর অজস্র আলো এবং দূরের কোনো গ্রাম্য পাবের কিশোরী এক বালিকার মুখচ্ছবি—বড় মিস্ত্রিকে প্রাণ খুলে কথা বলবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিল।
বড় মিস্ত্রি বললেন, কী ফুল কিনবে?
ওরা তখন সেতু অতিক্রম করে নিচে বাজারের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
সুখানী বলল, রজনীগন্ধা দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এখানে তা পাওয়া যাবে না।
সুখানী একটা ফুলের নাম মনে আনার চেষ্টা করছিল। অথচ কিছুতেই সে নামটা স্মরণ করতে পারল না। ফুলগুলি এ অঞ্চলে পাওয়া যায়, ঠিক রজনীগন্ধারই মতো। ফুলগুলির গায়ে মোমের রঙ অথবা যেন কচি আঙুরের স্তবক এবং সুগন্ধময়। সে ভাবল সেই সব ফুলের স্টিক কিনে নেওয়া যাবে।
ওরা বাজারে ফুলের গলিতে ঢুকে গেল।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার আমরা ব্যবহারে যথার্থই মানুষের মতো হবার চেষ্টা করব। আমরা মদ খাব না এই ক’দিন।
এটা ভালো প্রস্তাব বটে। বড় মিস্ত্রি মাথা নাড়লেন।
ওরা ফুল নিয়ে জাহাজে উঠে গেল একসময় এবং ভালোবাসার অভিনয় করার জন্য নাটকের প্রথম অঙ্কের গর্ভে ঢুকে গেল।
কেবিনে ওরা আরও কিছুক্ষণ বসে থাকল। দেয়ালের সাদা রঙ কেবল এই কেবিনে শূন্যতা সৃষ্টি করছে। ওরা পরস্পর কিছুক্ষণের জন্য অপরিচিতের মতো মুখ করে বসে থাকল। ওয়াচের ঘণ্টা পড়ছে। সারাদিন জেটিতে যে চঞ্চলতা ছিল, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিভে আসছে। দূরে সমুদ্র গর্জন করছে। আকাশ তেমনি পরিষ্কার। এই জাহাজের বুকে নক্ষত্রের আলো এসে নামছে। তিনজন নাবিক বসে থাকল। রাতের নিঃসঙ্গতার জন্য বসে থাকল। ওরা মর্লিনের জন্য মর্লিনের পাশে দুঃখ লাঘবের জন্য বসে থাকল। ওরা আগের মতোই চুপচাপ। দূর থেকে আগত সমুদ্র গর্জন শোনার জন্যই হোক অথবা এই জাহাজের কোনো কক্ষে রমণীর মৃত শরীর হুকে ঝুলছে, রমণীর ঘর সংসার, ওদের দুঃস্বপ্ন সকল… মানুষ এক নির্লজ্জ ইচ্ছার তাড়নাতে ভুগছে এইসব চিন্তা, তারপর সমুদ্র অতিক্রম করে সেই প্রিয় সংসার এবং মাঝে মাঝে পুলিশ নামক এক জন্তুর ডাক… ওরা ভয়ে পরস্পর এখন তাকাতে পারছে না।
স্টুয়ার্ড বলল, আসুন, স্যার, একসঙ্গে নামি। একা একা নামতে ভয় করছে। স্টুয়ার্ড হাতের দস্তানা বের করল বালিশের ভেতর থেকে। ওভারকোট নিল এবং জুতো জোড়া বের করার সময় সুখানী চিৎকার করে উঠল, স্টুয়ার্ড একটা রাস্কেল। স্যার, সে মর্লিনকে হুক থেকে নামায়নি। আমি যাব না স্যার, আমার বীভৎস দৃশ্য সহ্য হবে না।
বড় মিস্ত্রি প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসলেন। বললেন, ওটা বীভৎস বললে চলবে কেন সুখানী?
স্টুয়ার্ড বলল, আপনিই বলুন স্যার।
বড় মিস্ত্রি ফের বললেন, আমরা এই মানুষেরা বীভৎস স্থানটুকুর জন্যই লড়াই করছি। সংগ্রাম বলতে পারো অথবা লোভ লালসা, চরম কুৎসিত বস্তুটির জন্য আমাদের কামুক করে রাখে। এবার বড় মিস্ত্রি সুখানীকে দু’হাতে ঠেলে রসদ ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে বললেন, তুমি যদি পা দুটো উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে দেখ, কী দেখবে সুখানী? একটা মুখের মতো অবয়ব দেখবে, নাক দেখবে, গহ্বর দেখবে। শুধু চোখ নেই। কবন্ধের মতো অথবা অন্ধ বলতে পারো। আর অন্ধ বলেই সকল অত্যাচার নীরবে সহ্য করছে। অন্ধ বলেই এত কুৎসিত, এত ভয়ংকর এবং আমাদের এত ভালোবাসা।
রসদ ঘরে আলু পেঁয়াজের গন্ধ। ডিমের শুকনো গন্ধ। বাসি বাঁধাকপির গন্ধ মলমূত্রের মতো। সুখানী ফুলগুলি এবার বুকে চেপে ধরল। স্টুয়ার্ড বরফ—ঘরের দরজা খুলে বড় মিস্ত্রিকে দেখাল—কিছু কি দেখতে পাচ্ছেন স্যার?
বড় মিস্ত্রি যথার্থই কিছু দেখতে পেলেন না। সারি সারি হুকে বড় বড় ষাঁড়ের শরীর ঝুলছে। ভেড়া এবং শূকর। টার্কির শরীর পর্যন্ত। সব এক রঙ। এক মাংস। এবং শুধু ভক্ষণের নিমিত্তই তৈরি। তিনি নিজেই এবার ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, মর্লিন কোথায় স্টুয়ার্ড!
ওরা একটি টেবিল সংগ্রহ করে মর্লিনকে সযত্নে তার উপরে রেখে দিল। পোশাক পরানো হল। পায়ে জুতো এবং ফুলগুলি ওর মাথার কাছে রেখে ওরা বসে থাকল নির্বোধের মতো। বড় মিস্ত্রি পায়ের দিকটায় বসে আছেন। দু’পাশে সুখানী এবং স্টুয়ার্ড। ওরা মর্লিনের মুখ দেখছিল। যত ওরা মৃত মুখ দেখছিল তত ওদের এক ধরনের আবেগ গলা বেয়ে উঠে আসছে। ওর প্রতি আচরণে এতটা নির্বোধ না হলেও চলত এমত এক চিন্তার দ্বারা প্রহৃত হচ্ছে। বড় মিস্ত্রিই বললেন, এই মৃত রমণীর কাছে আমাদের জীবনের এমন কী মহত্ত্ব ঘটনা আছে যা বলতে পারি—তিনি এইটুকু বলে উঠে দাঁড়ালেন—এমন কী ঘটনা আছে জাহাজি জীবনে যা বলে এই তীক্ষ্ন বিষণ্ণতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি?
সুখানী বলল, ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে। এইটুকু বলে চিবুকে হাত রাখে সুখানী। কিছুক্ষণ কী যেন দেখল সমস্ত ঘরটার ভিতর। পাশের একটা ষাঁড়ের শরীর ঝুলছে। এবং মাঝে মাঝে ওর শরীরে এসে ধাক্কা দিচ্ছে যেন। সে বলল, আমরা সকলেই জীবনের কোনো না কোনো মহত্তর ঘটনা বলব। চিরদিন আমরা এমন ছিলাম না।
স্টুয়ার্ড বলল, মহত্তর ঘটনা বলতে পারলে ফের আমরা ঘুমোতে পারব।
বড় মিস্ত্রি পায়ের কাছটায় বসলেন আবার।
স্টুয়ার্ড দেখল ওদের সকলের চোখ ধীরে ধীরে কোটরাগত হচ্ছে। চোখের নিচে এক ধরনের অপরাধবোধের চিহ্ন ধরা পড়েছে। সে সুখানীকে বলল… আচ্ছা সুখানী, আমার চোখের নিচে কালি পড়েছে!
আয়নায় দেখো। আমার তো মনে হয় তোমারই সবচেয়ে বেশি!
সুমিত্র, বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার, কাপ্তান আমাকে বলেছেন, তোমার কি কোনো অসুখ করেছে স্টুয়ার্ড? তোমাকে খুব পীড়িত দেখাচ্ছে!
অবনীভূষণ বললেন, তুমি আবার বলনি তো, রাতে স্যার ঘুম হচ্ছে না। কেমন এক অশরীরী পাপবোধ চারধারে ঘোরাফেরা করছে। বলনি তো?
আমি পাগল নাকি স্যার! আমি এমন কথা বলতে পারি?
সুখানী এবার কঠিন গলায় বলল, তুমি শালা পাগল। আলবত পাগল। পাগল না হলে একটা রুগণ বেশ্যা মেয়েকে কেবিনে কেউ তুলে আনতে পারে?
স্যার, আপনি শুনুন। নালিশের ভঙ্গিতে বলল সুমিত্র।
সুখানী, তুমি বেশ্যা বলবে না। মর্লিন বেশ্যা হলে তোমার মা—ও বেশ্যা।
বড় মিস্ত্রি তার মাকে বেশ্যা বলেছে—বিজন ভাবল। সে সুখানী জাহাজের আর অবনীভূষণ বড় মিস্ত্রি জাহাজের। সুতরাং বড় মিস্ত্রির বিজনের মাকে বেশ্যা বলার এক্তিয়ার আছে। সুতরাং বিজন চুপচাপ বসে থাকল। কোনো জবাব দিল না। নির্বোধের মতো তাকাতে থাকল ফের ঘরের চারিদিকে।
সুমিত্র আর দেরি করতে চাইল না। সে বলল, স্যার আমার জীবনে একটা মধুর ঘটনা আছে। অনুমতি দিলে বলতে পারি।
বলবে? অবনীভূষণ অদ্ভুতভাবে ঠোঁট চেপে কথাটা বললেন।
হ্যাঁ স্যার, আগেই বলে ফেলি। আগে আগে যদি একটু ঘুমোতে পারি।
বলো।
সুমিত্র গল্প আরম্ভ করার আগে মর্লিনের মুখের খুব কাছে ঝুঁকে পড়ল। বলল, এই মুখ দেখলে, স্যার আমার শুধু চেরির কথা মনে হয়। তখন জাহাজে স্যার তেলওয়ালার কাজ করতাম।
বিজন এবার উঠে দাঁড়াল। আমি সুখানী জাহাজের, তাছাড়া আমি স্যার এই তিনজনের ভিতর সকলের ছোট। আমাকে সকলের আগে বলতে দেওয়া হোক। বলে সেও মর্লিনের মুখের কাছে ঠিক স্টুয়ার্ডের মতো ঝুঁকে পড়ল। সে বলল, এই মুখ দেখলে শুধু এলবির কথা মনে হয়। তখন স্যার আমাদের জাহাজ অস্ট্রেলিয়াতে।
সুমিত্র চিৎকার করে উঠল, বেয়াদপ!
বড় মিস্ত্রি দেখলেন ওরা ঝগড়া করছে—তিনি বললেন, বরং গল্পটা আমিই বলি। বলে তিনি আরম্ভ করলেন—শেষ রাতের দিকে ভীষণ ঝড়ের ভিতর জাহাজ বন্দর ধরেছে। আমি তখন জাহাজের পাঁচ নম্বর মিস্ত্রি। আমাদের জাহাজ সেই কবে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে নোঙর তুলে সমুদ্রে ভেসেছিল, কবে কোন এক দীর্ঘ অতীতে যেন। আমরা বন্দর ফেলে শুধু সমুদ্র এবং সমুদ্রে ভাসমান দ্বীপ—বালির অথবা পাথরের জনমানবহীন দ্বীপ দেখছি। সুতরাং দীর্ঘদিন পর বন্দর পেয়ে তুষাররাতেও আমাদের প্রাণে উল্লাসের অন্ত ছিল না। আমাদের মেজ মালোম উত্তেজনায় রা রা করে গান গাইছিলেন…।
অবনীভূষণ কিছুক্ষণ থেমে সহসা বলে ফেললেন, এ কী স্টুয়ার্ড তুমি বাসি বাঁধাকপির মতো মুখ করে বসে আছ কেন? শুনছ তো গল্পটা।
কী যে বলেন স্যার!
বুঝলে তোমাদের অবনীভূষণও বিকেলের দিকে সাজগোজ করে তুষারঝড়ের ভিতরেই বের হয়ে পড়ল। সেই লম্বা ওভারকোট গায়ে অবনীভূষণ, লম্বা তামাকের পাইপ মুখে এবং ভয়ংকর বড় বেঢপ জুতো পরে অবনীভূষণ গ্যাঙওয়ে ধরে নেমে গেল। আর নেমে যাবার মুখেই দেখল মেজো মালোম বন্দর থেকে ফিরছে। মেজ মালোম বেশ সুন্দরী এক যুবতীকে নিয়ে এসেছেন। যুবতীর পাতলা গড়ন, ছিমছাম চেহারা আর কালো গাউন, সোনালি ব্লাউজের উপর ফারের মতো লম্বা কোট গায়ে।
তুষারঝড়, সুতরাং গাছের পাতা সব ঝরে গেছে। আর পাতা ঝরে গেছে বলে কোনো গাছই চেনা যাচ্ছে না। ওরা বৃদ্ধ পপলার হতে পারে, পাইন হতে পারে এমনকি বার্চ গাছও হতে পারে। আমার সঙ্গে আমার প্রিয় বন্ধু ডেক অ্যাপ্রেন্টিস উড ছিল। শীতে পথের দু’পাশে কাঠের বাড়ি এবং লাল নীল রঙের শার্সির জানালা এবং বড় বড় জানালার ভিতর পরিবারের যুবক—যুবতীদের মুখ, একর্ডিয়ানের সুর, গ্রাম্য লোকসংগীত তোমাদের অবনীভূষণকে ক্রমশ উত্তেজিত করছে।
বড় মিস্ত্রি এবার সুখানীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার সব হুবহু মনে পড়ছে। নাচঘরে অবনীভূষণ দুজন যুবতীকে একলা দেখতে পেল।
তখন ব্যান্ড বাজছে, হরদম বাজছে। মদের কাউন্টারে ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাবিক এসে ভিড় করছিল। ওরা কেউ কেউ মাথার টুপি খুলে তিমি শিকারের গল্প আরম্ভ করল। উত্তর সাগরে ওরা গর্ভিণী তিমি শিকার করতে গিয়ে দুজন নাবিককে হারিয়েছে এমন গল্পও করল। ভিড় সেই কাচঘরে ক্রমশ বাড়ছিল। মিশনের ডানদিকে মসৃণ ঘাসের চত্বর আর মৃত বৃক্ষের মতো কিছু পাইন গাছ—তার নিচে বড় বড় টেবিল আর ফাঁকা মাঠে হেই উঁচু এক হারপুনার হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছে। হারপুনার কাচঘর অতিক্রম করে কাউন্টারের সামনে লোকটির সঙ্গে ফিস ফিস করে কী বলছে। অবনীভূষণ সব লক্ষ্য করছিল। হারপুনার সেই যুবতী দুজনকে উদ্দেশ্য করে হাঁটছে। অথবা তোমাদের অবনীভূষণের মনে হচ্ছিল যেন কে বা কারা সেই যুবতী দুটিকে উদ্দেশ্য করে লম্বা গলায় বড় রাস্তায় হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছে…. ট্যানি টরেন্টো… ট্যানি টরেন্টো….
রাত ক্রমশ বাড়ছিল। গল্প ক্রমশ জমে উঠেছে। মর্লিনের সাদা মুখ এবং পায়ের নিচে বসে বড় মিস্ত্রি সব দেখতে পাচ্ছিল। এখন যেন আর সেই মুখ দেখে অবনীভূষণের এতটুকু ভয় করছে না। তিনি এবার প্রিয় মর্লিনকে উদ্দেশ্য করেই যেন গল্পটা শেষ করলেন—অবনীভূষণের মনে হল দীর্ঘদিন পর তিনি এক অসামান্য কাজ করে ফেলেছেন। বুঝলে মর্লিন, তোমার এই বড় মিস্ত্রি সেই জাহাজে আবদ্ধ যুবতীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, আপনি নির্ভয়ে ঘুমোন, আমি বাইরে তুষারঝড়ের ভিতর বসে আপনার পাহারায় থাকছি। বলে তোমার বড় মিস্ত্রি দরজা বাইরে থেকে টেনে বদ্ধ করে দিয়েছিল এবং ঠিক দরজার সামনে ভয়ংকর ঠান্ডার ভিতর পা মুড়ে বসেছিল এবং জেগে জেগে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন… দ্বীপের স্বপ্ন… বড় এক বাতিঘর দ্বীপে, সব বড় বড় জাহাজ সমুদ্রগামী—জাহাজের মাস্তুলে তোমাদের অবনীভূষণ ‘মানুষের ধর্ম’ বড় বড় হরফে এইসব শব্দ ঝুলতে দেখল। অবনীভূষণ নিঃশব্দে হাঁটু মুড়ে মাথা গুঁজে বসে থাকল—তার এতটুকু নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না, যেন জীবনের সাত রাজার ধন এক মাণিক খুবই হাতের কাছে রয়েছে। তাকে গলা টিপে মারতে নেই।
বড় মিস্ত্রি জীবনের সেই মহৎ গল্পটুকু বলে সকলকে দুঃখিত করে রাখলেন। মর্লিনের মৃত শরীরে এবার ওরা ফুল রাখল। এবং ওরা যথার্থই এখন এই রসদ ঘরে সেই যুবতীকে প্রত্যক্ষ করল।
সুখানী, বড় মিস্ত্রি ফুল রেখে উপরে উঠে যাচ্ছে। পিছনে স্টুয়ার্ড দরজা বন্ধ করে ফিরছে। ওরা সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল। খোলা ডেকে দাঁড়াল। এই উদার আকাশ এবং শহরের নীল লাল আলো এবং সাগর দ্বীপের পাখিরা কেবল ডাকছে। ওরা এখন সমুদ্রের সিঁড়ি ভেঙে আকাশের তারা গুণতে থাকল যেন এবং এ সময়েই ওরা ঘরে ফেরার জন্য সকলে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ওরা নির্জন ডেক ধরে যে যার আশ্রয়ে চলে গেল। পরস্পর কোনো কথা বলল না। বলতে পারল না।
এরা বন্দরে নেমে সোজা মার্কেটে চলে গেল। পথের কোনো দৃশ্যই ওদের আজ চোখে পড়ছে না। তাজা ফুলের জন্য ওরা সন্ধ্যা না হতেই দোকানে ভিড় করল। ওরা আজও তিনগুচ্ছ ফুল নিয়ে জাহাজে ফেরার সময় কোনো পাব—এ ঢুকে একটু মদ খাবার জন্য আকুল হল না। মর্লিন এক তীব্র পাপবোধের দ্বারা ওদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
স্টুয়ার্ড নিজের কেবিনে চোখ টেনে আর্শিতে দেখল। চোখের নিচটা টেনে টেনে দেখল। রুগণ পীড়িত ভাবটা কমেছে কী না দেখল। বড় মিস্ত্রির চোখ দেখল। বড় মিস্ত্রিকে কিঞ্চিৎ সতেজ মনে হচ্ছে।
সে বড় মিস্ত্রির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, স্যার, আমাকে আগের চাইতে সুস্থ মনে হচ্ছে না?
সুখানী বলল, মোটেই না।
বড় মিস্ত্রি বললেন, আমাদের তিনজনকেই গত রাতের চেয়ে বেশি সুস্থ মনে হচ্ছে।
ওরা সিঁড়ি ধরে নিচে নামবার সময় শুনল, দূরে কোথাও একদল পাখি উড়ে যাচ্ছে। ওদের মুখে খড়কুটো। ওরা আসন্ন ঝড়ের আগে ডিম পাড়ার জন্য পাহাড়ের খাঁজ অন্বেষণে রত। সুখানী সিঁড়ি ধরে নামবার সময় পাখিদের মুখে খড়কুটো দেখল। কেবল বড় মিস্ত্রি শুনলেন পাখিরা পাখায় রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে বিষণ্ণ সুরে কাঁদছে।
স্টুয়ার্ড একধারে ফুলগুলি রেখে মর্লিনের মুখটা ঠিক করে দিল। তারপর গাউনটা টেনে পায়ের নিচটা পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপর বাসি ফুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে দেবার সময় বলল, মনে হয় আমরা আমাদের প্রিয়জনের পরিচর্যা করছি। আমাদের এত যত্ন মর্লিন বেঁচে থাকতে পেত!
সুখানী বলল, আচ্ছা স্যার, এসব করার হেতু কী? কী দরকার এই ফুল সংগ্রহের। কী দরকার প্রতি রাতে এ—ভাবে… আমাদের আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাস যুক্তির যে ধর্ম থাকছে না।
বড় মিস্ত্রি বাধা দিয়ে বললেন, মৃতের প্রতি সম্মান দিতে হয় সুখানী। মর্লিনকে এখন যত সুন্দর মনে হচ্ছে, যত স্বচ্ছ মনে হচ্ছে, ওকে আমরা এখন যত ভালোভাবে দেখতে পারছি…
স্টুয়ার্ড মাঝপথেই বলে ফেলল, মর্লিন যে সত্যের জোরে বেঁচে ছিল এতদিন, মরে গিয়ে সেই সত্যকে সে আবিষ্কার করল, কী বলেন স্যার? আর সেজন্যই বোধহয় ওকে আমরা এত ভালোবেসে ফেলেছি।
সুখানী বলল, কীসব বলছ পাগলের মতো। বলে যে মর্লিনের শক্ত হাত পাগুলিকে ঠিক করে দিল। চুলগুলি যত্ন করে গুছিয়ে দিল। তারপর টেবিলটাকে প্রদক্ষিণ করার সময় ষাঁড় গোরু অথবা শূকরের মাংস ঝুলতে দেখে জীবন সম্পর্কে কেমন উদাসীন হয়ে পড়ল। সে চেয়ারে বসে মর্লিনের পায়ের কাছে মাথা রেখে ঘুম যাবার ভঙ্গিতে হাত পা টানা দিতে গিয়ে বুঝল এই শরীর এখন মলমূত্রের আধার। অথচ মর্লিনের চোখ পাথরের মতো। বড় মিস্ত্রি মর্লিনকে নিবিষ্ট মনে দেখছেন, স্টুয়ার্ড গল্প আরম্ভ করেছে।
সে বলল, তখন আমি জাহাজের তেলয়ালা সুমিত্র। সে বক্তৃতার কায়দায় বলল, স্যার আপনি আছেন, নচ্ছার সুখানী আছে আর এই সম্মানীয়া অতিথি—আমাদের এই মহত্তর ঘটনার স্মৃতিমন্থনই আশা করি আমাদের সুস্থ করে তুলবে।
সুখানী বলল, তাহলে বুঝতে হবে মাথাটা আর ঠিক নেই।
চুপ রও বেয়াদপ! তুমিই সব নষ্টের গোড়া। বলে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। সে কিছু বলতে পারছিল না; ওর কষ্ট হচ্ছে বলতে। সে আবেগে কাঁপছিল। সে ধীরে ধীরে বিগত জীবনে চেরি নামক এক রাজকন্যার গল্প শোনাল। তার আর চেরির গল্প। জাহাজি জীবনের অপূর্ব এক প্রেম ভালোবাসার গল্প।
স্টুয়ার্ড গল্প শেষ করে মর্লিনের মাথার কাছে দাঁড়াল এবং ওর চোখ দুটোতে চুমু খেল। বলল, আমাদের ছোট এবং স্বার্থপর ভেব না, মর্লিন।
সারা ঘরময় সুখানী এখন কোনো মাংসের শরীর দেখতে পাচ্ছে না। দূর থেকে আগত কোনো সংগীতের ধ্বনি যেন এই ঘরে বিলম্বিত লয়ে বেজে চলেছে। সে থেকে থেকে কবিতার লাইন বারবার আবৃত্তি করল। এবং এই আবৃত্তির ভিতরেই সে এলবিকে স্মরণ করতে পারে।
ওরা তিনজন আজও ফুল রাখল মর্লিনের শরীরে। ওরা উঠে যাবার সময় কোনো বচসা করল না। ওরা কোনো সমাধি ক্ষেত্র থেকে ফিরে আসছে যেন এমত এক চোখ—মুখ সকলের।
বন্দরে এটাই ওদের শেষ রাত ছিল। ভোরের দিকে জাহাজ নোঙর তুলবে। ওরা তিনজন প্রতিদিনের মতো বসল। প্রতিদিনের মতো বাসি ফুলগুলি মর্লিনের শরীর থেকে তুলে ভিন্ন জায়গায় রাখল।
বড় মিস্ত্রি দু’হাত প্রসারিত করে দিলেন টেবিলে। সুখানী দীর্ঘ সময় ধরে উপাসনার ভঙ্গিতে বসে থাকল। সে তখন চোখ বুজে একটি বিশেষ দৃশ্যের কথা স্মরণ করে গল্পটা আরম্ভ করতে চাইছে।
সুখানী বড় মিস্ত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলল, তখন স্যার আমার নাম ছিল বিজন। তখন আমি সুখানী হইনি। বলে, গল্পটার ভূমিকা করল।
তারপর আস্তে আস্তে বিজন এক অব্যক্ত বেদনার গল্প শোনাল। জাহাজের বাতাস পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে শুনল বিজনের গল্প। একসময় বিজন গল্প শেষ করে অবসন্ন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সে এখন মর্লিনের কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। সে যেন এই কপালের কোথাও কিছু অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে।
বড় মিস্ত্রি এত অভিভূত যে গল্প শেষ হবার পরও তিনি কিছু সময় ধরে বিজনের মুখ দেখলেন। তিনি বিজনকে মর্লিনের কপালে নুয়ে পড়তে দেখে বললেন, কী দেখছ সুখানী?
সুখানী বড় মিস্ত্রির কাছে এল এবং বলল, Peace is on her forehead. Peace-কে অন্বেষণ করছি স্যার। মর্লিন সারাজীবন ঝড়ে নৌকা বেয়ে এখন গভীর সমুদ্রে বৈতরণী পার হচ্ছে। এইটুকু বলে বিজন পুনরায় এলবির সেই কবিতাটি একটু অন্যভাবে আবৃত্তি করল—
‘‘She had dropped the sword and
dropped the bow and the arrow : peace
was on her forehead, and she had
left the fruits of her life behind herself
on the day she marched back again to
her master’s hall.’’
জাহাজ ছাড়বার সময় ওরা তিনজন নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। শীতের প্রকোপ কমে গেছে। সুখানী, স্টুয়ার্ড এবং অন্যান্য সকল জাহাজিরাই বন্দর থেকে চোখ তুলে নিল। বন্দর ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বন্দরের আলো ঘর বাতি সবই একে একে সমুদ্রের ও—পাশে হারিয়ে গেল। আবার ওরা, সকল জাহাজিরা দীর্ঘদিন এই সমুদ্রে রাত যাপন করবে। ওরা বন্দরের জন্য আকুল হবে ফের। এবং মাটির স্পর্শের জন্য হবে ভয়ংকর মরিয়া।
বড় মিস্ত্রি ডেক ধরে হেঁটে ডেক—কসপের ঘরে ঢুকলেন। বললেন, আমাকে কিছু তক্তা দাও কসপ। করাত, হাতুড়ি বাটালি দাও। কিছু পেরেক লাগবে। সব আমার ঘরে রেখে এসো।
বড় মিস্ত্রি এবং স্টুয়ার্ডের কোনো ওয়াচ ভাগ নেই বলে ওরা খুশিমতো নিচে নেমে যেত। ওরা সন্তর্পণে সকলের আড়ালে সেই কাঠ, পেরেক নিচে নিয়ে গেল।
বড় মিস্ত্রি কানে পেনসিল গুঁজে সেই প্রায়—অন্ধকার রসদঘরে কাজ করতেন। তক্তাগুলোকে পালিশ করে উজ্জ্বল করে তুলতেন মাঝে মাঝে। কিছু পাথর কফিনে সাজিয়ে চট বিছিয়ে মর্লিনের বিছানা, তারপর ওরা গান করত নিচে। দুঃখ এবং বেদনায় সেই গান সমুজ্জ্বল। মাঝে মাঝে ওরা নিজেদের ঘর অথবা স্ত্রী পুত্রদের কথা বলত। ওরা বলত, আমরা যথার্থই মানুষ, ঈশ্বর!
বড় মিস্ত্রি বলতেন, আমার বড় ছেলেটা জলে ডুবে মারা গেল! দুঃখ আমার অনেক স্টুয়ার্ড। স্টুয়ার্ড বলত, কী আশ্চর্য স্যার, আমরা মর্লিনকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি দেখুন। সুখানী এসব কথায় থাকত না; সে চুপচাপ একটু ফাঁক পেলেই রসদ ঘর অতিক্রম করে বরফ ঘরে ঢুকে যেত। মাঝে মাঝে বলত, দেখছেন স্যার, মর্লিন অবিকৃতই আছে। মনে হয় মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে।
বড় মিস্ত্রি বললেন, কফিনে কিছু কারুকার্য করলে ভালো হত।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার ধর্মযাজকের কাজটুকু কে করবে?
সুখানী বলল, কেন আমরাই করব। পৃথিবীতে আমরা তিনজন বাদে মর্লিনকে আর কে এত ভালোবেসেছে। এই জাহাজে কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই আমরা এখানে আশ্রয় নিয়েছি। মর্লিনকে জীবনের সুখদুঃখের ভাগ দিয়েছি। ধর্মযাজকের কাজ আমরাই করব। আমরা তিনজন ওর শববাহক হব। আমরা তিনজন ওর পরম আত্মীয় এবং আমরা তিনজনই ওর ধর্মযাজক। সুখানী কিছুটা দৃঢ়তার সঙ্গেই কথাগুলি উচ্চারণ করল। তারপর গজকাঠি দিয়ে কফিনের মাপ দেখে বলল, ইচ্ছে হচ্ছে এই কফিনের পাশে একটু জায়গা নিয়ে শুয়ে থাকি। আর উঠব না। সব সুখ দুঃখ প্রিয় মর্লিনের সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যাক।
রাতে বড় মিস্ত্রি বললেন, আমার কাজ শেষ। এসো, এখন আমরা ওকে কফিনের ভিতর পুরে দি।
সুখানী কাতর গলায় বলল, স্যার, আজ থাক। আসুন, আজও আমরা গোল হয়ে বসি। মর্লিনকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে আমরা বড় একা হয়ে যাব। জাহাজটা বড় অসহায় লাগবে। এইসব কথার সঙ্গে এক দ্রুত কান্নার আবেগ উথলে ওঠে সুখানীর গলাতে। ঘরে আমার স্যার কেউ নেই। এলবিকে পরিত্যাগ করে আর কোথাও নোঙর ফেলতে পারিনি। প্রিয় মর্লিন আমাকে একটু আশ্রয় দিয়েছিল যেন। স্যার, ওকে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেব!
বড় মিস্ত্রি বললেন, আমারও ভালো লাগছে না হে।
স্টুয়ার্ড বলল, আজকে থাক। কালই ওকে গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করব।
পরদিন ওরা তিনজন যখন রাত গভীর, জাহাজিরা কোথাও কেউ জেগে নেই, শুধু ওয়াচের জাহাজিরা এনজিন রুমে এবং ব্রিজে পাহারা দিচ্ছে, যখন সমুদ্র শান্ত, যখন আকাশে অজস্র তারা জ্বলছিল এবং দূরে কোথাও কোনো তিমি মাছের দল ভেসে যাচ্ছে অথবা ডলফিনের ঝাঁক এবং এক কাক—জ্যোৎস্না নীল জলের উপর, জাহাজটা রাজহাঁসের মতো সাঁতার কাটছে তখন শববাহী দলটি গ্যাঙওয়েতে কফিন রেখে সব বাসি ফুলগুলি প্রথমে সমুদ্রে ফেলে দিল। ফুলগুলি দূরে দূরে ভেসে যাচ্ছে, ওরা ফুলগুলি দেখতে পাচ্ছে না। ওরা মর্লিনের জুতো এবং গাউন নিক্ষেপ করল, তারপর হাতের দস্তানা। ওরা এসব ফেলে দেবার সময়ই কাঁদছিল। ওরা কাঁদছিল। তিনজন নাবিকের চোখ থেকে জল কফিনের উপর পড়ছিল। সমুদ্র এবং বন্দর যাদের ঘর এবং এইসব বেশ্যামেয়েরা যাদের ঘরণি সেইসব রমণীদের উদ্দেশ্যে তিনজন নাবিক যেন চোখের জল ফেলছিল। ওরা পরস্পর দুঃখে এতই কাতর, ওরা এতই ব্যথিত….. ওরা কান্নার আবেগ সামলানোর জন্য রুমাল ঠেসে দিচ্ছিল মুখে। ওরা প্রিয় মর্লিনের কফিন কাঁধে তুলে ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলে ফেলে, দেখল, আস্তে আস্তে প্রিয় মর্লিন জলের নিচে ডুবে যাচ্ছে। ওরা পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার আবেগে এলবির উচ্চারিত সেই কবিতাটি আবৃত্তি করল—
‘‘When the warriors came out first from
their Master’s hall, where had they hid
their power? Where were their armour
and their arms?
They looked poor and helpless, and
the arrows were showered upon them
on the day they came out from their
Master’s hall.
When the warriors marched back
again to their Master’s hall where did
they hide their power?
They had dropped the sword and
dropped the bow and the arrow; peace
was on their foreheads; and they had
left the fruits of their life behind them
on the day they marched back again to their Master’s hall.’’