নগ্ন ঈশ্বর – তিন
কাকাতিয়া দ্বীপ থেকে ফসফেট নিয়েছে জাহাজটা। জাহাজ আগামী দশদিন পাশাপাশি ওসানিক দ্বীপপুঞ্জ সকল অতিক্রম করে অনবরত জল ভাঙবে। দশদিন জাহাজিরা মাটি দেখতে পাবে না, তেরো মাস সফরে যেমন এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে গিয়েছে, সমুদ্রের নোনা জল ভেঙে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে, তেমনি এ—দশ দিনও শুধু জলই দেখবে অথবা অসংখ্য নক্ষত্র এবং রাতের আঁধারে অন্য জাহাজের আলো।
তখন বিকেলের ঘন রোদের রঙ জেটিতে, ফসফেট—কারখানার প্রার্থনা—হলের গম্বুজে এবং দূরে, দূরে নারকেল গাছের ছায়াঘন চত্বরে অথবা শ্রমিকদের ভাঙা কুটিরে, আকাশ অথবা নীলের গভীরতায় সমুদ্র মগ্ন। জলের নীল অথবা সবুজ ঘন রঙের ছায়া সাহেবদের বাংলোগুলো উজ্জ্বল করে রেখেছে। কিছু শ্রমিক বিকেলের আনন্দ হিসেবে ছোট ছোট স্কীপ নিয়ে বঁড়শি নিয়ে সমুদ্রে ভেসে গেল। এবং তারা এই জাহাজের পাশ দিয়ে গেল। গলুইতে জাহাজিরা ভিড় করে আছে। যেখানে দ্বীপের পাথর সমুদ্রে বাতিঘরের মতো, যেখানে ফার্ন জাতীয় গাছ সমুদ্রের হাওয়ায় নড়ছে, সেখানে দ্বীপের সব শিশুরা অযথা লাফাল, নাচল, গাইল। কখনও সমুদ্রের জলে স্নান করল অথবা সাঁতার কাটল। এইসব দৃশ্যের ভিতর জাহাজটা ছাড়বে। গলুইতে জাহাজিরা ভিড় করে থাকল। মাস্টে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর জাহাজ ছাড়ছে এমন ভাবের কালো বর্ডার দেওয়া নিশান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রিজে কাপ্তান, বড় মালোম। গ্যাঙওয়েতে কোয়ার্টার মাস্টার এখনও পাহারা দিচ্ছে। সিঁড়ি এখনও জেটি থেকে তোলা হয়নি, অথচ সকল কাজ শেষ। ডেক, ফল্কা সব জল মেরে সাফ করা হয়েছে। হ্যাচ, ত্রিপল এবং কাঠের সাহায্যে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবু মেজ মালোম সারেংকে ডেকে গলুইতে চলে এলেন না, কিংবা ওয়ারপিন ড্রাম ঘুরিয়ে বললেন না হাসিল—হাপিজ। বললেন না, তোমরা জাহাজিরা এসো, আমরা বন্দরের নোঙর তুলে সমুদ্রের পাল তুলি।
সমুদ্রের শান্ত নিবিড়তার ভিতর দ্বীপের পাহাড়, ঘর—বাড়ি, কারখানা এবং এইসব দ্বীপের পুরুষ—রমণীরা সকলে যেন রাজকন্যার মতো জেগে সারা রাত ধরে, মাস ধরে এমনকি বৎসর, যুগ যুগ ধরে কোনো এক রাজপুত্রের প্রতীক্ষাতে মগ্ন। সুপারি গাছ, নারকেল গাছ এবং উষ্ণদেশীয় সকল শ্রেণীর গাছ দ্বীপে দৃশ্যমান। সুমিত্র, জাহাজি সুমিত্র, সেজন্য বিকেলে পথে ঘুরতে ঘুরতে কখনও এ অরণ্য অঞ্চলে ঢুকে কাগজি লেবু সংগ্রহ করত। দু’পা এগিয়ে গেলে ওপাশে সমুদ্র, ধারে ধারে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। সুমিত্র প্রায়ই বালিয়াড়িতে চুপ হয়ে, বালুচরের সঙ্গে ঘন হয়ে এই দ্বীপের নিবিড়তায় মগ্ন থাকত। যেন সে দীর্ঘদিন পর নিজের দেশের মতো দৃশ্যমান বস্তু সকলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে।
প্রস্থে দৈর্ঘ্যে তিন গুণিত চার মাইল পরিমিত স্থানটুকু জুড়ে এই দ্বীপ। কিছু সমতল ভূমি, কিছু পাহাড়শ্রেণী। দ্বীপের দক্ষিণ অঞ্চলে সাহেবদের বাংলো—সকল, পার্ক, বিদ্যালয় এবং ক্লাব—ঘর। পশ্চিমটুকু জুড়ে শ্রমিকদের নিবাস। পাহাড়ের উপর যেখানে কৃত্রিম উইলো গাছের সংরক্ষিত অঞ্চল আছে, যেখানে মার্বেল পাথরের প্রাসাদ এবং দ্বীপসকলের প্রধান কর্তার অবস্থিতি—তার ঠিক নিচে সুপেয় জলের হ্রদ। পাথুরে সিঁড়ি নিচে বালিয়াড়িতে গিয়ে নেমেছে। ছোট নীল হ্রদ অতিক্রম করার স্পৃহাতে সুমিত্র কোনো সিঁড়ির নিচে বসে থাকত। সমুদ্রের বুকে মার্বেল পাথরের স্থাপত্যশিল্প সুমিত্রকে রূপকথার গল্প স্মরণ করিয়ে দিত। সেখানে একদা সুমিত্র এক যুবতীকে আবিষ্কার করল। যুবতী উইলো গাছের ছায়ায় হ্রদের তীরে বসে ভায়োলিন বাজাত।
সুমিত্র জাহাজ—রেলিংয়ে ভর করে গতকালের কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারছে। সে দীর্ঘ সময় সিঁড়িতে বসেছিল এই ভেবে—যুবতী হয়তো এই পথ ধরে অপরাহ্ণ বেলায় অন্য অনেকের মতো সমুদ্রে নেমে আসবে। যুবতীর প্রিয়মুখ দর্শনে সে প্রীত হবে। কিন্তু দীর্ঘ উঁচু পাহাড়শ্রেণীর ফাঁক দিয়ে যুবতীর মুখ স্পষ্ট ছিল না। সুতরাং অন্য দিনের মতো ভায়োলিনের সুরে মুগ্ধ হওয়া ব্যতিরেকে কোনো গত্যন্তর ছিল না। প্রতি দিনের প্রতীক্ষা তার কখনও সফল হল না। এবং সেইসব নিষিদ্ধ এলাকায় যেতে পারত না বলে সমুদ্রে যুবতীর প্রতিবিম্ব দেখে গল্পের ডালিমকুমার হয়ে বাঁচবার স্পৃহা জন্মাত। আহা, আমি ওর চোখে স্পষ্ট হলুম না গো! যখন জাহাজিরা শ্রমিকদের বস্তিতে পুরনো কাপড়ের বিনিময়ে যৌন—সংযোগটুকু রক্ষা করত, তখন সুমিত্র পাথরের আড়ালে বসে উদাস হবার ভঙ্গিতে আকাশ দেখত।
সূর্য এখন সমুদ্রে ডুবছে। নীল সমুদ্রের লাল রঙ এখন পাহাড় এবং পাহাড়শ্রেণীর উপত্যকা সকলকে স্নিগ্ধ করছে। ছোট ছোট স্কীপগুলো ঘরে ফিরছে। ক্লাব—ঘরে ব্যান্ড বাজছে। জেটিতে অনেক মানুষের ভিড়। সুন্দরী রমণীরা, আর পাহাড়ের সব বাসিন্দারা যুবতীকে জাহাজে তুলে দিল। সকল জাহাজিরা গলুইতে ভিড় করে থাকল। সেই যুবতী, চঞ্চল দুটো চোখে, গ্যাঙওয়ে ধরে উঠে আসছে। সন্ধ্যার গাঢ় লাল রঙ যুবতীকে রহস্যময়ী করে তুলছে।
এবার সব ডেক—জাহাজিরা দু’ভাগ হয়ে আগিলা—পিছিলা চলে গেল। উইঞ্চ হাড়িয়া—হাপিজ করল হাসিল। ড্যারিক নামানো হল। যুবতীর বাপকে দেখা গেল কাপ্তানের ঘরে। কিছু কিছু জেটির লোক ডেকে উঠে এসেছিল। ওরা সিঁড়ি তোলার আগে নেমে গেল। যুবতীর বাবা নেমে গেলেন। তারপর জাহাজ ধীরে ধীরে তীর থেকে সরতে থাকল। রুমাল উড়ল অনেক জেটিতে, যুবতী কেবিনে ফিরে যাওয়ার আগে সন্ধ্যার গাঢ় রঙের গভীরতায় ওই দ্বীপের ছবি দেখতে দেখতে কেমন তন্ময় হয়ে গেল। এই তার দেশ, এত সুন্দর এবং রমণীয়।
কেবিনে ঢুকে যুবতী টুপাতি চেরি দেখল কাপ্তান—বয় সবকিছু সযত্নে সাজিয়ে রেখেছে। চেরি আয়নায় মুখ দেখল, তারপর লকার খুলে রাতের পোশাক পরে বোট ডেকে উঠে যাবার জন্য দরজা অতিক্রম করতেই মনে হল জাহাজটা দুলছে এবং মাথাটা কেমন গুলিয়ে উঠছে। চেরি আর উপরে উঠল না। সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। নরম সাদা বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে পোর্টহোলের কাচ খুলে দিল। চেরি এখন সমুদ্র এবং আকাশ দেখছে।
দরজায় খুব ধীরে ধীরে কড়া—নাড়ার শব্দে চেরি প্রশ্ন করল, কে?
আমি কাপ্তান—বয়।
এসো।
আপনার খাবার, বলে সযত্নে টেবিল সাজাল।
চেরি বলল, এক পেয়ালা দুধ, দুটো আপেল।
আর কিছু?
না।
আপনার কষ্ট হচ্ছে মাদাম?
না।
উপরে উঠবেন না? বেশ জ্যোৎস্না রাত। বোট—ডেকে আপনার জন্য আসন ঠিক করা আছে।
না, উপরে উঠব না।
বয় চলে যাচ্ছিল, চেরি ডেকে বলল, শোন!
কাপ্তান—বয় কাছে এল। বলল, তুমি কাপ্তানকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।
জী, আচ্ছা। কাপ্তান—বয় দরজা টেনে চলে গেল।
তখন ফোকসালে জাহাজিরা চেরিকে কেন্দ্র করে মশগুল হচ্ছিল। সকলে ওর চোখমুখ দর্শনে সজীব। এবং চেরি যেন এই নিষ্ঠুর জাহাজে সকল জাহাজিদের নিঃসঙ্গ মনে সমুদ্রযাত্রাকে সুখী ঘরণির ঘরকন্নার মতো করে রাখছে। আর এমন সময় ডেক—সারেং এলেন, এনজিন—সারেং এলেন। তাঁরা দরজায় দরজায় উঁকি দিয়ে বললেন, তোমরা উপরে যাও, বোট—ডেকে মাস্তার দাও।
জাহাজিরা সিঁড়ি ধরে উপরে উঠল সকলে। ওরা বোট—ডেকে পশ্চিমমুখো হয়ে দাঁড়াল। ডেক—সারেং ওদের পাশ দিয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরা, বাপুরা, ওঁর সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করতে যাবে না। কাপ্তানের বারণ আছে। জেনানা মানুষ, কাঁচা বয়েস, তার উপর আবার শুনছি রাজার মেয়ে এবং তিনি নাকি আমাদের কোম্পানির একজন কর্তাব্যক্তি।
সুমিত্র হাসল। —কী যেন বলেন চাচা! উনি তো কাকাতিয়া দ্বীপের প্রেসিডেন্টের মেয়ে।
সারেং বললেন, ওই হল। যে রাজা, সেই—ই প্রেসিডেন্ট।
এখন রাতের প্রথম প্রহর। অল্প জ্যোৎস্না সমুদ্রে এবং জাহাজ—ডেকে। জাহাজিরা গরম বলে সকলে ফোকসালে গিয়ে বসল না। ওরা ফল্কার উপর বসে ভিন্ন রকমের সব কথাবার্তা বলল। দু—একজন জাহাজি অভদ্র রকমের ইঙ্গিত করতেও ছাড়ছে না। এ ধরনের কথাবার্তা শুনে অভ্যস্ত বলে সুমিত্র রাগ করল না। বরং হাসল। দীর্ঘদিনের সমুদ্রযাত্রা সুমিত্রকে বিরক্ত করছে।
সুমিত্র ভাবল, সেই মেয়ে, হ্রদের তীরে বসে বেহালা বাজাত, পাথরের আড়ালে বসে হ্রদে প্রতিবিম্ব দেখে যার রহস্য আবিষ্কারে সে মত্ত থাকত, যার প্রতিবিম্ব সমুদ্রের কোনো রাজপুত্রের ইচ্ছাকে সকরুণ করে রাখত, অথবা সেই প্রাসাদের ছায়া, ঘন বন, সমুদ্রের পাঁচিল এবং উঁচু পাথরের সব দৃশ্য সুমিত্রকে ঠাকুমার গল্প মনে পড়িয়ে দিত….যেন রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে….যাচ্ছে….শুধু পাতালপুরীতে ভোজ্যদ্রব্য, যেন প্রাসাদের পর প্রাসাদ, কোনো জন—মনিষ্যির গন্ধ নেই, ফুলেরা, গাছেরা, পাখিরা এবং পতঙ্গসকল পাথর হয়ে আছে। হ্রদের তীরে খুব নিচু উপত্যকা থেকে সুমিত্র যতদিন চেরিকে দেখেছে, ততদিন পাতালপুরীর দৃশ্যসকল কাকাতিয়া দ্বীপের সকল দৃশ্যমান বস্তুসকলের উপর এক ক্লান্ত ইচ্ছার ঘর তৈরি করে চলে গেছে।
এখন জাহাজিরা সকলে বাংকে শুয়ে পড়েছে। সুমিত্রও দরজা বন্ধ করে কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল। সুমিত্র এই বাংকে শুয়ে পর্যন্ত চেরির কথা ভাবছে—চেরি হয়তো শুয়ে পড়েছে। সিঁড়ি ধরে গ্যাংওয়েতে যখন উঠে আসছিল চেরি, সুমিত্র তাকে স্পষ্টভাবে দেখেছিল। বড় বড় চোখ মেয়েটির—বাদামি রঙ শরীরে, চোখের রঙ ঘন গভীর এবং সমস্ত শরীরে প্রজাপতির মতন হালকা গড়ন যেন ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছার ঘর সবটুকু যত্ন দিয়ে তৈরি করেছেন।
জাহাজ এখন সমুদ্রে। তীর দেখা যাচ্ছে না, কেবল দ্বীপ অথবা প্রবালবলয়। ভোরের সূর্য উঠেছে সমুদ্রে। সমুদ্রটাকে দু—ফাঁক করে সহসা যেন সূর্যটা আকাশে উঠে গেল। ডেক—জাহাজিরা এ সময় জাহাজে জল মারছে। এবং অন্য অনেক জাহাজি ইতস্তত রঙের টব নিয়ে মাস্টে, ড্যারিকে রঙ দেবার জন্য ফল্কায় ফল্কায় হাঁটছে। সুমিত্র ভোরে উঠে ওয়াচে যাবার আগে গ্যাংওয়েতে চোখ তুলে দিল। চেরি সেখানে নেই। বোট—ডেক খালি। ব্রিজে ছোট মালোম দূরবিন চোখে লাগিয়ে দূরের আকাশ দেখছে।
সুমিত্র এনজিন—রুমে নেমে যাবার আগে দুখানা ভাঙা চাঁদের মতো রুটি খেল, জল খেল। চা খেল। অন্যান্য জাহাজির মতো প্রশ্ন করে জানতে চাইল, গত রাতে চেরি কেবিনে শুয়ে সারারাত ঘুমিয়েছিল, না, গরমে কেবিনের দরজা খুলে রাতে ডেকে বসে সমুদ্র এবং আকাশের নিরাময় ভাবটুকু লক্ষ্য করে শরীর নিরাময় করেছিল!
সুমিত্র এনজিন—রুমে নেমে যাওয়ার সময় দেখল ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস চুরি করে টুপাতি চেরির পোর্টহোলে উঁকি দিচ্ছে। সুমিত্ররও এমন একটা ইচ্ছা যে না হচ্ছে, তা নয়। তারও না—দেখি না—দেখি করে পোর্টহোলের কাচ অতিক্রম করে চেরির অবয়ব দর্শনে খুশি হবার ইচ্ছা। কিন্তু পোর্টহোলের মুখোমুখি হতে কেমন যেন বিব্রত বোধ করল। সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ধরে এনজিন—রুমে নেমে কসপের ঘর থেকে তেল মেপে এনজিনের পিস্টনগুলোতে এবং অন্যান্য যুক্তস্থানে তেল ঢালতে লাগল। ওয়াচ শেষে উপরে উঠবে তখন নিশ্চয়ই চেরি কেবিনে পড়ে থাকবে না, সমুদ্র এবং আকাশ দেখার জন্য নিশ্চয়ই বোট—ডেকে উঠে পায়চারি করবে, সে এমত চিন্তাও করল।
ওয়াচ শেষে অন্য পীরদারদের ডেকে দিল সুমিত্র। এনজিন—রুম থেকে সোজা না উঠে, স্টোকহোলড দিয়ে ফানেলের গুঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল, প্রত্যাশা চেরি যদি ব্রিজের ছায়ায় বোট—ডেকে বসে থাকে। সে ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে এই ইচ্ছায় যথার্থই বোট—ডেকে উঠে গেল। যখন দেখল ব্রিজের ছায়ায় কেউ নেই, তখন সুমিত্র কেমন বিচিত্র এক অপমানবোধে পীড়িত হতে থাকল।
সুমিত্র স্নান করার সময় ভাণ্ডারীকে বলল, মানুষের কত রকমের যে শখ জাগে চাচা!
ভাতিজার হ্যান মনের দশা ক্যান?
এই কিছু না। সুমিত্র মনে করতে পারল, এনজিন—রুমে সে যতক্ষণ ছিল, সব সময়টা উপরে ওঠার জন্য মনটা ছটফট করেছে। সে চেরির সঙ্গে কী এক আত্মীয় সম্পর্কে যেন ঘনিষ্ঠ। সে মনে মনে এই বোধের জন্য না হেসে পারল না।
এ—ছাড়া সুমিত্র পর পর দু’দিনের জন্য একবারও চেরিকে বোট—ডেকে অথবা গ্যাঙওয়েতে এমনকি ডাইনিং—হলেও দেখল না। যুবতী এই জাহাজে উঠেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। দশদিনের সমুদ্রযাত্রা। এ—দু’দিন চেরি জাহাজ—ডেকে একবারও বের হল না। সুতরাং সুমিত্র যতবার এনজিন—রুমে নেমেছে, ততবার কেবিনের পাশে এসে একবার থেমেছে। সে পোর্টহোলের ঘন কাচের ভেতর দিয়ে চেরির কেবিন প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা করত। কিন্তু পোর্টহোলের ঘন কাচের ভিতর দিয়ে চেরির কেবিন সবসময় অস্পষ্ট থাকছে। কেবিনের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মেস—রুম মেট অথবা মেস—রুম বয় এদিকে আসছে না। বুড়ো কাপ্তান—বয় চেরিকে দেখাশোনা করছে। অফিসাররা পর্যন্ত জাহাজে চুপ মেরে গেছেন। যত জাহাজটা চলছে তত যেন নাবিকরা সব ঝিমিয়ে পড়ছে। চেরি দরজা খুলল না, ডেকে বের হল না, পায়চারি করল না। অফিসারসকল প্রতিদিন ডেক—চেয়ারে সাজগোজ করে বসে থাকলেন, অবসর সময় একটু আলাপ অথবা উদ্বিগ্ন হবার ভঙ্গিতে কৃত্রিম ইচ্ছা প্রকাশের জন্য। কখনও কখনও ছোট মালেম দরজা পর্যন্ত হেঁটে আসতেন। তারপর সমুদ্রের নির্জনতা ভোগ করে একসময় কেবিনে ঢুকে সস্তা সব ক্যালেন্ডারের ছবি দেখে ভয়ানক অশ্লীল আবেগে ভুগতেন।
সমুদ্রে নীল নোনা জল, আকাশে ইতস্তত নক্ষত্র জ্বলছে। খুব গরম পড়েছে—উষ্ণমণ্ডলের এই আবহাওয়া জাহাজিদের ফোকসালে বসতে দিচ্ছে না, ওরা শুতে পারছে না গরমে। ওরা উপরে উঠে ফল্কাতে মাদুর বিছিয়ে সেজন্য অধিক রাত পর্যন্ত তাস খেলছে। কেউ জাল বুনছে মাস্টের আলোতে। জাহাজটা চলছে, জ্যোৎস্না রাত। সমুদ্রে অকিঞ্চিৎকর তরঙ্গ এবং সহসা সমুদ্র থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে এসে জাহাজিদের সুখ দিচ্ছে। এবং প্রপেলারটা অনবরত ঝিঁ ঝিঁ পোকার করুণ আর্তনাদের মতো যেন কাঁদছে। বিশেষ নির্দিষ্ট গতিতে জাহাজটা চলছে, দৃশ্যমান বস্তু বলতে এই নক্ষত্রের আকাশ এবং সমুদ্র। গরমে কাপ্তান ব্রিজে পায়চারি করছেন। দুটো একটা আলো দেখা যাচ্ছে সমুদ্রে। দ্বীপপুঞ্জের জেলেরা এখন হয়তো গভীর সমুদ্রে মাছ ধরছে।
সুমিত্র জাহাজিদের বলল, আচ্ছা ব্যাপার তো! দু’দিনের ভেতর একবারও যুবতীকে ডেকে দেখা গেল না! এ যে দেখছি চাচারা তোমাদের বিবিদেরও হার মানাচ্ছে!
ডেকের বড় ট্যান্ডল বলল, তোমাদের ভয়েই বার হচ্ছে না।
আমরা খেয়ে ফেলব নাকি?
বড় বাকি রাখবে না।
সুমিত্র দেখল তখন বুড়ো কাপ্তান—বয় এদিকেই আসছে। সে এসে ওদের পাশেই তাস খেলা দেখতে বসে গেল।
সুমিত্র বলল, রাজকন্যার খবর কী চাচা?
আর বলবেন না দাদা। রাজকন্যাকে দেওয়ানিতে ধরছে। মাথা তুলতেই পারছে না। শুধু বিছানায় পড়ে থাকছে।
রাজকন্যা কিছু বলছে না তোমাকে?
আমি বুড়োমানুষ, আমাকে কী বলবে দাদা!
অন্য জাহাজি প্রশ্ন করল, মাথা একেবারেই তুলতে পারছে না?
কাপ্তান—বয় বলল, পারছে। বিকেলে দেখছি কেবিনেই পায়চারি করছে। মনে হয়, কালতক ডেকে ঘুরে বেড়াতে পারবে।
জাহাজটা তখন তেমন দুলছে না। ওরা ফল্কার উপর বসে গল্প করছে। জ্যোৎস্নার আলোতে ওদের মুখ বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। গ্যালিতে মাংস সিদ্ধ করছে ভাণ্ডারী। উইন্ডসহোল ধরে নিচ থেকে জাহাজিদের কথা ভেসে আসছে। এবং সেখানেও চেরি—সংক্রান্ত কথাবার্তাতে ওরা নিজেদের কঠিন মেহনতের দুঃখকে ভুলতে চাইছে।
সুমিত্রই সকল জাহাজিদের খবরটা দিল—কাল টুপাতি চেরি ডেকে বের হবে। পরদিন আটটা—বারোটার ওয়াচে সুমিত্র এনজিন—রুমে নেমে কসপের ঘর থেকে তেল মেপে নিল। ক্যানে ভর্তি তেল সে এনজিনের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে দিচ্ছে। একটু নুয়ে মেসিনের ভিতর ঝুঁকে পড়ল। তারপর ক্যানের তেল উঠাল, নামাল এবং সে ঘুরে ঘুরে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করছে….সে ক্যান উঠাল, নামাল। অন্য কোনো দিকে তাকাতে পারছে না। সে যেন বুঝতে পারছে উপর থেকে সিঁড়ি ধরে কারা নামছে। সে চিফ ইনজিনিয়ার এবং কাপ্তানের গলা শুনতে পাচ্ছে। সুতরাং এ সময়ে কোনো অন্যমনস্কতা রাখতে নেই। এ সময়ে সে তেলয়ালা সুমিত্র। তাকে ক্রমশ উপরে উঠতে হবে। তাকে ছোট ট্যান্ডল থেকে বড় ট্যান্ডল হতে হবে। বড় মিস্ত্রির চোখে যেন কোনো অন্যমনস্কতা ধরা না পড়ে এবং সে যেন জীবনের ঋণ অনাদায়ে পরিশ্রমী তেলয়ালা সুমিত্র। সুতরাং সে ভীষণভাবে রড ধরে মেশিনের ভিতর ঝুঁকে কাজ করতে থাকল। থামের মতো সব মোটা পিস্টন রডগুলো উঠছে নামছে, ক্রাঙ্কওয়েভগুলো ঘুরছে অনবরত এবং এইসব ভয়ংকর শব্দে উপরের কণ্ঠসকল ঢেকে যাচ্ছে। তবু সে এ—সময়ে কোনো রমণীর কণ্ঠ শুনতে পেল এবং চোখ না তুলেই বুঝল বড় মিস্ত্রি আর কাপ্তান চেরিকে নিয়ে এনজিন—রুমে নেমে আসছে। সিলিন্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে রেসিপ্রকেটিং এনজিনের কার্যকারিতা সম্বন্ধে বড় মিস্ত্রি তাকে বিস্তারিত বলছেন।
সুমিত্র যেখানে কাজ করছে, সেটা এনজিনের তৃতীয় স্তর। দ্বিতীয় স্তরে চেরি এবং কাপ্তান। চেরি এনজিনটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। সুতরাং অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুমিত্র একবার চেরিকে গোপনে দেখে ফেলল। চেরি সিলিন্ডার পরিদর্শন করে সিঁড়ি ধরে ক্রমশ নিচে নামছে। ওরা সুমিত্রের পাশ দিয়ে যথাক্রমে নিচে নেমে যাচ্ছে। সুমিত্র নিজের পোশাকের দিকে তাকাল—নীল কোর্তা ওকে মোল্লা মৌলভি বানিয়ে রেখেছে। চেরি নিচে নেমে যাচ্ছে। মেশিনের হাওয়ায় ওর চুলগুলো উড়ছে। গায়ে সাদা সিল্কের ফ্রকোট। পরনে নেভি ব্লু স্কার্ট। সুমিত্র নিজেকে আড়াল দেবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, বড় মিস্ত্রি এবং কাপ্তান চেরিকে এনজিনের মতো দ্রষ্টব্য বস্তু হিসাবে সুমিত্রর দিকে হাত তুলে দেখাচ্ছে—এরা ইন্ডিয়ান। কোম্পানি ওদের কলকাতা অথবা বোম্বাই বন্দর থেকে তুলে নেয়। খুব কম পয়সায় ওরা বেশি কাজ দেয়।
বড় মিস্ত্রি অনেকটা পাদরিসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, বেচারা!
সুমিত্র লজ্জায় মেশিনের ভিতর আরও ঝুঁকে পড়ল। চেরি ওর মুখ না দেখে ফেলে এমত ইচ্ছা এখন সুমিত্রর।
সুমিত্রর এখন কত কাজ। সে ঘুরে ঘুরে এনজিনের সকল স্থানে তেল দিল। চেরি হেঁটে যাচ্ছে, চেরি ফিরেও তাকাচ্ছে না, চেরি পোর্ট—সাইডের বয়লার ককের সামনে দাঁড়াল। বড় মিস্ত্রি বলল, এটা কনডেনসার। সার্কুলেটিং পাম্পের সাহায্যে জল ফের বয়লারে চলে যায়। ফের চেরি এবং বড় মিস্ত্রি ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। ওরা গল্প করছে। সে তাকাল না। লজ্জায় সংকোচে সে টানেলের ভিতর ঢুকে গেল। কিন্তু চেরির চোখ দুটো বড় গভীর এবং ঘন। সুমিত্র টানেলের মুখে এসে প্রপেলার শ্যাফটের একপাশে দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে চেরিকে আড়াল থেকে দেখতে থাকল। চেরি ওকে দেখতে পাচ্ছে না, ওর শরীরের বাদামি রঙ, হালকা পোশাক—প্রজাপতির মতো যেন এনজিনে ও উড়ে বেড়াচ্ছে।
চেরি ইভাপোরেটারের পাশ দিয়ে যেতেই সেই গোপনীয় চোখ দুটোকে আবিষ্কার করে ফেলল। চেরি দেখল দুটো ডাগর চোখ (ঠিক যেন ঠাকুমার গল্পের রাজপুত্রের মতো) রাক্ষসের দেশে চেরিকে কেউ চুরি করে দেখছে। এইসব ভেবে একটু অন্যমনস্কতায় ভুগে যখন আবার চোখ তুলল চেরি, তখন দেখতে পেল চোখ দুটো সেখানে নেই, অন্যত্র কোথায় সরে গেছে।
ভয়ে সুমিত্র একপাশে সরে দাঁড়াল। সে তেল দিল ইতস্তত এবং কাপ্তানকে টুপাতি নালিশ দিলেও যেন বলতে পারে, না মাস্টার, আমি শুধু এনজিনেই তেল দিচ্ছি। টুপাতি এ সময়ে সামনে এসে দাঁড়াল। লজ্জায়, সংকোচে সুমিত্র চোখ তুলতে পারছে না। সে পেটের সঙ্গে অথবা এইসব যন্ত্রের সঙ্গে যেন মিশে যাচ্ছে। চেরি এখন সুমিত্রর কোঁকড়ানো চুল শরীরের বাদামি রঙ দেখছে। ঘাড়ের নরম মাংসগুলো দেখল। তারপর সিঁড়ি ধরে স্টিয়ারিং—এনজিনে তেল দিতে যাবার সময় সুমিত্র শুনল টুপাতি যেন ওর সম্বন্ধে কী বলছে।
সুমিত্র ফোকসালে এসে কাপড় ছাড়ল—কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলল না। উপরে উঠে স্নান করল, কোনো কথা বলল না। খেতে বসে চুপচাপ খেয়ে উঠল। অন্য তেলয়ালা বলল, কী হয়েছে রে? মুখটা খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
অনেকে এমত প্রশ্ন করলেও সুমিত্র জবাব দিচ্ছে না। সে বাংকে বসে অযথা সিগারেট খেল, অযথা কতকগুলি ইংরেজি পত্রিকার সস্তা অশ্লীল ছবি দেখল এবং কোনো আতঙ্কে সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। এনজিনের ভিতর থেকে সেই চোখ দুটো যেন এখনও ওকে তাড়া করছে। বারবার মনে হচ্ছে চেরির প্রতি চোখের এই স্পর্শকাতরতা সুখকর নয়। পোর্টহোলে সুমিত্রকে উঁকি দিতে দেখেছে এবং সেজন্য নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছে চেরি। কাপ্তানকে নালিশ দিয়েছে হয়তো।
আর বিকাল বেলাতেই বুড়ো কাপ্তান—বয় এল পিছিলে। প্রায় ছুটতে ছুটতে এল। সুমিত্র বাংকে শুয়ে ছিল, ঘুম আসছে না। সেই চোখ কেবল ওকে অনুসরণ করছে। কাপ্তান—বয় সারেংয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে বলল, সারেংসাব, বাড়িয়ালার ঘরে সুমিত্রর ডাক পড়েছে।
সুমিত্র শুনল, কাপ্তান—বয় এইসব কথা বলে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে যাচ্ছে। সে শুনল, সারেং সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে আসছে এবং ওর ঘরের ভিতরও সেই শব্দ। সুমিত্র ভয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকল।
সারেং ডাকল, এই সুমিত্র ওঠ। বাড়িয়ালা তোকে ডাকছে।
সুমিত্র উঠে বসল, আমাকে যেতে হবে সারেংসাব?
কী করি বল? বাড়িয়ালা যে যেতেই বলল।
আমি কিছুই করিনি সারেংসাব। সুমিত্র অপরাধবোধে পীড়িত হতে থাকল। বার বার নামতে উঠতে পোর্টহোলে সহসা কখনও চোখ রেখেছে এবং এক তীব্র কৌতূহল ওকে বারবার এই বৃত্তিতে প্রলুব্ধ করেছে।
সুমিত্র লকার খুলে সাদা জিনের প্যান্ট পরল, জ্যাকেট গায়ে দিল, তারপর পায়ে জুতো গলিয়ে সারেংসাবকে বলল, চলুন। সে সিঁড়ি ধরে উঠবার সময় দৃঢ় হবার চেষ্টা করল। কেউ প্রশ্ন করলে না। কারণ, বাড়িয়ালা একমাত্র জাহাজিদের অপরাধের জন্য তাঁর ঘরে অথবা ডাইনিং—হলে ডেকে থাকেন। সুতরাং সকল জাহাজিরা সুমিত্রকে দেখল সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে। সুমিত্র যেন ওর অপরাধ সম্বন্ধে সচেতন, সে সেজন্য চোখ তুলল না। সে এখন অন্য কোনো জাহাজিকেই দেখছে না। জাহাজটা যে চলছে এ—বোধও এখন সুমিত্রর নেই। উষ্ণমণ্ডলের গরম কমে যাচ্ছে, বিকেল হতেই ঠান্ডা—ঠান্ডা ভাব ডেকে, সুমিত্র ডেক ধরে যাবার সময় তাও অনুভব করতে পারল না। সে সারেংয়ের সঙ্গে বোট—ডেক পার হয়ে ব্রিজে উঠে যাবার সিঁড়ি ধরে কাপ্তানের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
ওরা এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। সারেং ঘরে ঢুকতে ইতস্তত করছে এবং কোনোরকমে গলা সাফ করতেই কাপ্তান দরজা খুলে বের হলেন। তিনি ওদের দেখে বললেন, সারেং, তুমি কেন? তোমাকে তো ডাকিনি!
হুজুর, কাপ্তান—বয় যে বলল—
আরে না না, সুমিত্র হলেই চলবে। আমাদের সম্মানীয়া যে যাত্রীটি যাচ্ছেন, তিনি একবার ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
এতক্ষণ সুমিত্র শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু বাড়িয়ালার এইসব কথায় সে কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয় করতে পারছে। সে বলল, মাস্টার, আমি যাব?
তুমি একবার পাঁচ নম্বর কেবিনে যাবে। যখন ডেকে পাঠিয়েছেন, তখন যেতেই হবে।
সুমিত্র ইচ্ছা করলে বোট—ডেক অতিক্রম করে টুইন—ডেকে নেমে অফিসার গ্যালি ডাইনে ফেলে পাঁচ নম্বর কেবিনে হাজির হতে পারে, অথবা অ্যাকোমোডেশান ল্যাডারেরই একটা অংশ ডাইনিং হলে নেমে গেছে—সেই সিঁড়ি ধরে নামলেও চেরির দরজা। একটু ঘোরা পথ অথবা খুব কাছের পথ—কোনটা ধরে যাবে ভাবছিল, ভাবছিল চেরির সহসা এই ইচ্ছা কেন? পাথরের আড়াল থেকে চেরি ওকে নিশ্চয়ই দেখেনি, কারণ সেখানে সুমিত্রর অবয়ব স্পষ্ট ছিল না। সে অন্যমনস্কভাবেই হাঁটছিল। সে সিঁড়ি ধরে টুইন—ডেকে নেমে দেখল কমলা রঙের রোদ ডেকে, কিছু নীল তরঙ্গ জাহাজের চারপাশটায়। পিছিলে জাহাজিরা অনেকে নামাজ পড়ছে। সে নেমে আসার সময় তাদেরও দেখল।
ডেক—কসপ বলল, কিরে সুমিত্র, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কাপ্তান তোকে কিছু বলেছে?
সুমিত্র কোনো উত্তর না দিয়ে আলওয়েতে ঢুকে দেখল কেবিনের দরজা বন্ধ। সে ধীরে ধীরে কড়া নাড়তে থাকল।
ভিতর থেকে কাপ্তান—বয় বলল, কে?
আমি চাচা, সুমিত্র।
ভিতরে এসো। ভিতরে এসো।
সে পা টিপে টিপে কেবিনে ঢুকল। সে দেখল, কাপ্তান—বয় লকার, টিপয় এবং অন্য সব বাংকের বিছানা ঝেড়ে দিচ্ছে। চেরির বাদামি রঙের ঘাড় আঙুরফলের মতো রঙ ধরেছে। চেরি ঘাড় গোঁজ করে বাক্সের ভিতর কী যেন খুঁজছে।
কাপ্তান—বয় বলল, সুমিত্র এসেছে মাদাম।
সুমিত্র দেখল সেই আঙুলফলের মতো ঘাড় খুব সন্তর্পণে যেন নড়ছে। যেন বেশি চঞ্চল হতে নেই, উচ্ছল হতে নেই। সে দেখল সুমিত্রকে ঘাড় ঘুরিয়ে এবং যত ধীরে ঘাড় ঘুরিয়েছিল তার চেয়েও ধীরে ঘাড় ফেরাল।—ওকে বসতে বল।
সুমিত্র পাশের ছোট্ট ডেক—চেয়ারে বসল।
চেরি তখনও বাক্সের ভিতর কী যেন খুঁজছে। সে বলল, বয়, তুমি যেতে পারো।
সুমিত্র বাংলায় বলল চাচা, আপনি চলে যাচ্ছেন!
মেয়েমানুষকে এত ভয় দাদা, ফোকসালে তো খুব হইচই করতে।
সুমিত্র জবাব দিতে পারল না। সে চুপ করে বসে থাকল। কাপ্তান—বয় দরজা বন্ধ করে চলে গেল। সুমিত্র এ সময় উঠল এবং দরজা কিঞ্চিৎ খুলে দিল। সে নিচে এনজিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে অথবা সুমিত্রর মুখে উষ্ণবলয়ের শেষ উত্তাপ—চিহ্ন… সে চুপ করে বসে পড়ল ফের। পোর্টহোলের কাচ খোলা, উপরে পাখা ঘুরছে এবং দরজা দিয়েও কিছু হাওয়া প্রবেশ করতে পারছে, তবু সুমিত্র ঘেমে নেয়ে উঠল। যত সে দৃঢ় হবার চেষ্টা করছে, তত যেন ওর মুখে আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণতার ছোপ লাগছে। তত সে অসহায় বোধ করল নিজেকে।
এতক্ষণ পর চেরি মুখ ফেরাল। শরীরে হালকা গাউন, ব্রেসিয়ার স্পষ্ট। চেরি দু’হাঁটু ভাঁজ করে বাংকে বসল। সুমিত্রর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল, পোর্টহোলে রোজ উঁকি মারতে কেন?
আর উঁকি মারব না মাদাম।
কেন উঁকি দিতে তাই বল।
দীর্ঘদিন সফর করছি। দেশে জাহাজ ফিরছে না, কেবল জল আর জল।
একটু বৈচিত্র্য চাইছ?
আজ্ঞে।…. সুমিত্র আর কিছু প্রকাশ করতে পারল না। ভয়ে এবং বিষণ্ণতায় আড়ষ্ট বোধ করতে থাকল। ওর পায়ে সুন্দর জুতো, নেলপালিশ নখে, সুগোল হাঁটু পর্যন্ত পা… সে নিচু করে রেখেছে মুখ, তবু ওর সব যেন দেখতে পাচ্ছে সুমিত্র। গাউনের শেষ প্রান্তে লতার গুচ্ছ, পায়ের কোমল ত্বকে কেবিনের আলো… সে আর পারছে না, সে বলল, মাদাম, আর হবে না। আমাকে ক্ষমা করুন।
তুমি তো ভারতবর্ষের লোক সুমিত্র?
সুমিত্র মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, এবং চোখ তুলে এই প্রথম চেরির চোখ দুটো খুব কাছে থেকে দেখল, এত উজ্জ্বল, এত প্রাণবন্ত চোখ সে যেন ওই প্রথম দেখল। শালীনতার তীব্র তীক্ষ্ন ভাব চেরিকে, চেরির চোখ দুটোকে কঠিন করে তুলেছে। সুমিত্র চেরিকে সহ্য করতে পারছে না। সে বলল, আমি উঠি।
চেরি এবার না হেসে পারল না,—তুমি ভয়ানক ভীতু সুমিত্র। শুনেছি সম্রাট অশোক দিগবিজয়ে বের হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ছেলে এবং মেয়েকে এইসব দ্বীপে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই ভারতবর্ষের ছেলে তুমি!
সুমিত্র এবার একটু হালকা বোধ করল এবং ভালো করে কেবিনের চারপাশটা দেখে নিল। এতক্ষণ পরে সে ধরতে পারছে এই কেবিনে ফুলেল তেলের গন্দ, বিদেশি দামি সেন্টে অথবা কোথাও ধূপ দীপ অনবরত জ্বলে জ্বলে চেরিকে, ওর পোশাককে রূপময় করেছে। বাংকের উপর ভায়োলিন। দেয়ালে সুন্দর ক্যালেন্ডার। সমুদ্রে ঢেউ। বাইরে ঢেউ ভাঙার শব্দ। নিচে এনজিন—ঘরের আওয়াজ এবং চেরির চোখ দুটোতে দ্বীপপুঞ্জের কমলালেবুর গন্ধ। চোখ দুটো কমলালেবুর মতোই সজল।
চেরি কাপ্তান—বয়কে দিয়ে দু’কাপ কফি আনাল। চেরি ইচ্ছা করেই দূরত্ব ভেঙে দেবার চেষ্টাতে এক কাপ কফি খেতে অনুরোধ করল। সুমিত্র এরপর ভারতবর্ষের কোনো রাজপুত্রের মতোই দৃঢ় হল এবং বলল, আপনি আমায় কেন ডেকেছেন মাদাম?
সুমিত্রর দৃঢ়তাটুকু কেন জানি চেরির ভালো লাগল না। যে মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও এনজিনে ঘাড় গুঁজে কাজ করছিল, যার চোখ দুটো ভয়ে বিব্রত ছিল, সে সহসা এমত দৃঢ় ইচ্ছায় প্রকট হবে, অথচ চোখে কোনো করুণার চিহ্ন থাকবে না, অবাধ্য যুবকের মুখভঙ্গিতে বসে থাকবে চেরি এমত ভাব সহ্য করতে পারছে না। সে ফের প্রশ্ন করল, পোর্টহোলে উঁকি দিয়ে কী দেখার চেষ্টা করতে বল।
মাদাম, আমার সম্বন্ধে আপনি খুব বেশি ভাবছেন।
একবার নয়, দুবার নয়, অনেকবার পোর্টেহোলে উঁকি দিয়েছ তুমি। ভেবেছ, পোর্টহোলের কাচ মোটা বলে আমি কিছু দেখতে পাইনি? সি—সিকনেসে ভুগছিলাম, নতুবা কাপ্তানকে দিয়ে তক্ষুনি ডেকে পাঠাতাম।
সুমিত্র মাথা নিচু করে আগের মতো বসে থাকল।
পরে জেনেছি তুমি ইন্ডিয়ান সুমিত্র। টুপাতি একটা বালিশ টেনে কোলের উপর চেপে বলল, কফি ঠান্ডা হচ্ছে, খেয়ে নাও।
সুমিত্র ভয়ে ভয়ে কফিতে চুমুক দিল। খুব আদর—যত্নে এই মেয়েটি প্রতিপালিত—সে তাও ধরতে পারছে। সে একবার ভাবল, কাপ্তানকে বলে দেয়নি তো; সুমিত্র কেমন শুকনো মুখে কফি গিলতে থাকল। বলল, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি এই পথ ধরেই আর এনজিন—রুমে আসব না। আপনি দয়া করে কাপ্তানকে শুধু কিছু বলবেন না। আমি সব করব। আপনি যা বলবেন সব করব। সে কেমন আড়ষ্ট গলায় এইসব বলে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। কারও দিকে তাকাল না। সোজা ফোকসালে গিয়ে বাংকে শুয়ে ভয়ংকর অপমানবোধে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল।
চেরি বাংকেই চুপ করে বসে থাকল। সুমিত্রর পায়ের শব্দও একসময় মিলিয়ে গেছে। পোর্টহোলের কাচে এখন আর কোনো প্রতিবিম্ব ভাসছে না। এতক্ষণ এই কেবিনে সুমিত্রর চোখ মৃত এবং সাদা ছিল, এতক্ষণ চোখ দুটোতে যেন নিঃসঙ্গ ভূতের আতঙ্ক—এইসব ভেবে চেরি নিজের উপরই বিরূপ হতে থাকল। সে সুমিত্রকে কোনো কৌশলেই যেন আয়ত্তে আনতে পারছে না। অথচ দু’দিনের দেওয়ানি চেরিকে যখন এই কেবিনে মৃত্যুর মতো আতঙ্কিত করে রেখেছিল, তখন পোর্টহোলের কাচে কোনো এক যুবকের চঞ্চল চোখ, জীবনের প্রতীক যেন… যেন দর্পণ—তাকে নিয়ত রাজকন্যার মতো করে রেখেছে। ঠাকুরমার গল্পের স্মৃতি এই কেবিনে কোনো এক যুবকের শরীরে রূপ পাচ্ছিল—রাজপুত্র, কোটালপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, এক রাজ্য আক্রমণ করে অন্য রাজ্যে, কত গাছ, কত পাখ—পাখালি কত বন—বাদাড় অতিক্রম করে যাচ্ছে—আহা, ভারতবর্ষের রাজপুত্রেরা ঘোড়ায় চড়ে একদা রাজকন্যা খুঁজতে বের হত, গল্পে রাজপুত্রের চোখ যেমত এই বয়স পর্যন্ত অনুসরণ করেছে চেরিকে—এই কেবিনে সেই চোখ, সেই রাজপুত্র এতক্ষণ ক্লান্ত ঘোড়ার মতো পা ঠুকে ঠুকে নিঃশেষ হয়ে গেল। চেরি উচ্চারণ করল—বেচারি!
বস্তুত টুপাতি চেরি শৈশবের রূপকথার রাজপুত্রের চোখকেই যেন পোর্টহোলে প্রত্যক্ষ করেছিল। দেওয়ানিতে মাথা তুলতে পারছে না, শরীরে ভীষণ ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং সারাদিন বাংকে পড়ে থাকা, সে—সময় পোর্টহোলের ঘন কাচে সুমিত্রর চোখ দুটোই এক অসামান্য রূপকথার রাজত্ব, সুখ এবং আনন্দ এই কেবিনে পৌঁছে দিয়ে গেছে। ঠাকুরমার কোলে শুয়ে রাজপুত্রের গল্প শুনতে শুনতে চেরি ঘুমিয়ে পড়ত, যে রাজপুত্রের চোখ দুটো জীবনের এতদিন পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করে আসছে, পোর্টহোলে সহসা সেই চোখ দুটোকে যেন আবিষ্কার করেছে চেরি এবং প্রত্যক্ষ করেছে।
রাত্রিবেলায় সুমিত্র ওয়াচে নামার সময় অন্য পথ ধরে গেল।
ওয়াচ থেকে উঠে আসবার সময় কসপ বলল, কাজ রাজকন্যা তোমাকে কী বলল সুমিত্র?
সুমিত্র জবাব দিল, আমার দেশ কোথায়, কী নাম—এইসব নানারকমের কথা। সব মনে নেই।
সাহেবদের ফেলে তোমার দিকে এমন নজর!
কী করি! রাজকন্যার মর্জি বোঝা দায়।
বিকাল বেলায় সুমিত্র দেখল চেরি বোট ডেকে বসে আছে। কাঁটা দিয়ে উল বুনছে। পাশে ছোট মালোম বসে—নিশ্চয়ই গল্প করছেন। ডেক—অ্যাপ্রেন্টিসরাও সেখানে আছে। বেশ গুলজার বলতে হবে। সে পিছিলের ছাদের নিচ থেকে সব দেখল। রঙিন কাগজের মতো মখমলের পোশাক চেরির সমস্ত শরীরে জড়ানো। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত গাউনের শেষ প্রান্ত ঝুলছে। চুলের গুচ্ছ বুফা কায়দায় জড়ানো। ঘাড়ের মসৃণ ত্বক, কমলা রঙের রোদ, কালো মেঘবরণ চুল এই সমুদ্রের নীল নির্জনতাকে ভেঙে দিচ্ছে। সুমিত্র গ্যালিতে ঢুকে, গ্যালির জানালা দিয়ে আড়ালে চেরিকে দেখতে থাকল। অন্যান্য জাহাজিরাও সেখানে এসে ভিড় করছে। ওর এই ভিড় ভালো লাগছে না। ওর মনে হল ফের জাহাজি নিঃসঙ্গতা ওকে জড়িয়ে ধরছে। এই মনোরম বিকেল, কমলা রঙের রোদ এবং ছোট মালোমের উপস্থিতি কেন জানি তাকে কেবল পীড়া দিচ্ছে। সে গ্যালি থেকে বের হয়ে সিঁড়ি ধরে নেমে ফোকসালে ঢুকে বাংকে শুয়ে পড়ল। এক অহেতুক ঈর্ষার জন্ম হচ্ছে মনে। সে বাংকে শুয়ে চেরির অসামান্য রূপে দগ্ধ হতে থাকল।
কাপ্তান—বয় ছুটতে ছুটতে এসে বলল, সুমিত্র, আবার যে ডাক পড়েছে পাঁচ নম্বর কেবিনে।
সুমিত্র বলল, কেন, চেরি তো বোট—ডেকে বসে আছে দেখে এলাম।
এখন আর নেই। কেবিনে ঢুকেই বলছে, সুমিত্রকে আসতে বল।
কী ফ্যাসাদে পড়া গেল চাচা!
কোনো ফ্যাসাদ নেই। আল্লাতায়লায় ভরসা রাখ। খুশি হয়ে চলে যাও।
কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে সুমিত্র প্রথমে অনুমতি নিল, পরে ঘরে ঢুকে ডানদিকের বাংকে বসল। চেরি সুমিত্রর জন্য প্রতীক্ষা করছিল এমন ভাব চোখে—মুখে। সে—ও সুমিত্রর পাশে বসে পড়ল এবং বলল, জাহাজে কত দিন ধরে কাজ করছ?
এই নিয়ে দু’সফর।
যাত্রী—জাহাজে কোনোদিন চড়নি?
না মাদাম।
তাই তুমি জানতে না অন্যের কেবিনে কখনও উঁকি দিতে নেই।
পোর্টহোল দিয়ে কেবিন অস্পষ্ট বলে আমিও আপনার কাছে অস্পষ্ট—এই ভেবেছি। আপনি ঘরের অন্ধকারে পড়ে থাকতেন, আমি বাইরের আলোতে থাকতাম। সে কথাটা তখন আমার কিন্তু একবারও মনে হয়নি।
তবে বল আমাকে দেখার জন্য চুরি করে উঁকি দিতে?
সুমিত্র মাথা নিচু করে রাখল আগের মতো।
হুঁ এ তো ভালো কথা নয়, সুমিত্র।
সুমিত্র মাথা তুলছে না। সুমিত্রর চোখে—মুখে ফের অপরাধবোধ জেগে উঠছে।
এইসব জাহাজে তোমার কাজ করতে ভালো লাগে?
না মাদাম। কাজ করতে ভালো লাগে না।
তোমার দেশ ভারতবর্ষ, কত বিরাট আর কত অসামান্য দেশ!
আজ্ঞে, মাদাম।
ঠাকুমার কাছে তোমার দেশের রাজপুত্রদের গল্প শুনেছি। সমুদ্রের ধারে ঠাকুমা আমাদের তোমার দেশের রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। এইসব কথা বলে চেরি উত্তেজিত হল অথবা কেমন উত্তেজিত দেখাল চেরিকে। চেরি বলল, চিফ—এনজিনিয়ারের কথায় তোমার কিন্তু প্রতিবাদ করা উচিত ছিল।
কোন কথায় মাদাম?
তোমাদের সস্তায় নেওয়া হয়। যেন অনেকটা গোরু—ভেড়ার মতো ভাব।
ওঁরা তো ঠিকই বলেছেন মাদাম। আমরা তাঁদের কাছে—
এইসব লোকদের আমি ঘৃণা করি।
সুমিত্র এবার কথা বলল না। সবকিছুই রহস্যময় মনে হচ্ছে। চেরির সকল কথাই কেমন অসংলগ্ন। সুমিত্র বুঝল না চেরি যথার্থ কাকে ঘৃণা করছে। সুতরাং সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল এবং চেরির অসামান্য রূপে বিহ্বল হতে থাকল।
আমি কাপ্তানকে ধমক দিতে পারতাম। কিন্তু দিইনি। এতে তোমাদের আরও বেশি অপমান করা হবে। একটু থেমে চেরি ফের বলতে থাকল, কাপ্তান এবং চিফ—এনজিনিয়ার আমাকে এনজিন—রুমের সবকিছু দেখালেন। তোমাদের দেখালেন, যেন তোমাদের বাদ দিলে এনজিনের নাট বল্টু বাদ যেত।
মাদাম, আমরা নাবিক। এর চেয়ে বড় অস্তিত্বের কথা ভেবে আপনি অযথা কষ্ট পাবেন না।
তার চেয়ে বড় কথা তুমি ভারতবর্ষের ছেলে। গৌতম বুদ্ধ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ তোমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন।
আপনি দেখছি ভারতবর্ষের প্রতি খুব অনুরক্ত।
আমি একটি মহান জাতির প্রতি অনুরক্ত। এখন চেরিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই মুহূর্তে জাহাজে বিপ্লব শুরু করে দিতে পারে।
আমি উঠি মাদাম। ওয়াচের সময় হতে বেশি দেরি নেই।
যেন চেরি শুনতে পেল না, যেন খুব অন্যমনস্ক। চেরি আবেগের সঙ্গে বলতে থাকল, সুমিত্র, আমিও ভারতবাসী। আমার পূর্বপুরুষ ভারতবর্ষ থেকে বাণিজ্য করতে এসে এই সকল দ্বীপে থেকে গেল। আর ফিরল না। তোমাকে দেখে আমি তবে খুশি হব না, তোমার অপমানে আমি আমার অপমান ভাবব না?
সুমিত্র ফের স্মরণ করিয়ে দিল তার ওয়াচের সময় হয়ে গেছে। অথচ চেরি এতটুকু কর্ণপাত করছে না কথায়। এবং সেজন্য সুমিত্র চেরির সকল কথারû ভিতর নষ্ট—চরিত্রের লক্ষণ খুঁজে পাচ্ছে। এই বিষণ্ণ আলাপ সুমিত্রকে চেরি সম্বন্ধে আদৌ কোনো কৌতূহলী করছে না। সুমিত্র মৃত চোখ নিয়ে বসে থেকে সকল কিছুকে বিরক্তিকর ভেবে পোর্টহোলের কাচে ঠান্ডা হাওয়ার গন্ধ নিতে সহসা উঠে দাঁড়াল।
সুমিত্র চলে যাচ্ছে। দরজায় এক পা রেখে দেখল চেরি কথাবার্তায় এখন নরম এবং সহজ হয়ে উঠছে। চেরির মুখ প্রসন্নতায় ভরা। যেন প্রগাঢ় স্নেহ এই জাহাজি মানুষটির জন্য সে লালন করছে। সুমিত্র নির্ভয়ে দরজা টেনে দিতে শুনল, চেরি ভিতর থেকে বলছে, ঠাকুমা আমাদের সকলকে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। ভারতবর্ষের রাজপুত্রদের গল্প করতেন। ভয় অথবা বিষণ্ণতা এ—কদিন ধরে সুমিত্রকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, চেরির শেষ আলাপ, প্রগাঢ় স্নেহবোধ সুমিত্রকে নূতন জীবন দান করছে। সে ডেকের উপর দিয়ে প্রায় ছুটে এল। হালকা শিস দিল ফোকসালে নামার সময়।
চেরি বাংকে বসে থাকল। ভয়ানক একঘেয়ে এই সমুদ্রযাত্রা—চেরি ঠাকুমার স্মৃতি মনে করল। সেই সব রাজপুত্রদের ঘোড়াসকলকে মনে করল। অথবা রাক্ষসের প্রাণ রুপোর কৌটায় সোনার ভ্রমরে… যেন পা ছিঁড়ছে হাত ছিঁড়ছে—রাক্ষসটা গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে… চেরি এই কেবিনে উঠে দাঁড়াল। অথবা নির্জন দ্বীপে রাজকন্যা নিদ্রিত, রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে ছুটছে… চেরি ঠাকুমাকে স্মরণ করতে পেরে এইসব ভাবল। সেইসব মনোরম বিকেলের কথা তার মনে হল। যেন সুমিত্রকে দেখেই সে তার কৈশোর—জীবনের কথা মনে করতে পারছে। বিকালের সমুদ্র পাহাড়ের ধারে, ছোট ছোট মাছেরা খেলছে। সমুদ্রের ধারে ওরা ছুটোছুটি করছে। নারকেল গাছের ছায়ায় ঠাকুমা ভারতবর্ষের দিকে মুখ করে বসে আছেন, যেন যথার্থই তিনি ভারতবর্ষকে, তাঁর পিতৃপুরুষের দেশকে, দেখছেন। তখন অ্যান্টনি নারকেল গাছ থেকে ডাব কেটে দিচ্ছে সকলকে। ওরা বালিয়াড়িতে ছুটে ছুটে ক্লান্ত। ওরা ডাবের জল খেতে খেতে ঠাকুমার পাশে বালির উপর শুয়ে পড়ল। তখন সমুদ্রে সূর্য ডুবছে। নির্জন পাহাড়ি দ্বীপে কচ্ছপেরা ডিম পেড়ে গেল এবং ঠাকুমা তাঁর ঠাকুমার—মতো—রূপকথার গল্প আরম্ভ করে চেরির মুখ টিপে বলতেন, তোর জন্য ভারতবর্ষ থেকে এক টুকটুকে রাজপুত্র ধরে আনব। চেরির সেই কৈশোর মন ঠাকুমার কথা যথার্থই বিশ্বাস করে এক রঙিন স্বপ্নে ঠাকুমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ত।
চেরি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পোর্টহোলের কাচ খুলে দিল। পর্দা তুলে দিল, অথচ সেই চোখ দুটোকে আর খুঁজে পেল না। যতক্ষণ সুমিত্র এই বাংকে বসে ছিল, যতক্ষণ গল্প হল, পোর্টহোলের চঞ্চল চোখ দুটোর গোপনীয় ভাব সুমিত্রর চোখে—মুখে ফিরে এল না। কেমন নিষ্প্রভ, কেমন পাথরের মতো চোখ নিয়ে এতক্ষণ ওর কেবিনে বসে থাকল সুমিত্র। সুতরাং সকল দুঃখকে ভুলে থাকবার জন্য পোর্টহোলের পাশে দাঁড়িয়ে ভায়োলিনটা বাজাতে থাকল চেরি। উপরে নিচে, সামনে পিছনে শুধু নিরবচ্ছিন্ন আকাশ, শুধু নীল সমুদ্র এবং মনে হল সমুদ্রে রূপকথার রাজপুত্রেরা ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। এবং সেই সব দ্বীপপুঞ্জের অনেক সম্ভ্রান্তবংশীয় যুবকদের চেরি পোর্টহোলে দাঁড়িয়ে দেখল ঘোড়ায় চড়ে সমুদ্রে সুমিত্রর সমানে সমানে ছুটতে পারছে না। জীবনের প্রথম লগ্নে ভারতবর্ষের এক সুপুরুষ যুবাকে, যুবার কোমল চোখ দুটোকে পরম অপার্থিব বস্তু ভেবে চেরি কেমন প্রীত হতে থাকল। চেরি সেই দিঘির (ঠাকুমার বর্ণিত রূপকথা) সিঁড়িতে সুমিত্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। যেন রাজপুত্র কোটালপুত্র নামছে, নামছে। মানিকের আলোয় দিঘির সিঁড়ি ধরে রাজকন্যার দেশে নামছে। নিঝুম পুরী, কোনো শব্দ নেই। লোক নেই, প্রাণী নেই, পাখি নেই, নিঃশব্দ ভাব। সোনার গাছ। গাছে হীরা—পান্নার ফল। সোনার ঝরনা, সোনার পাখি। একই গাছের ডালে নাচ এবং গান। রাজপুত্র গান শুনতে শুনতে নাচ দেখতে দেখতে সদর দেউড়ি পার হয়ে সাত দরজা ডাইনে ফেলে অন্দরের চাবিকাঠিতে হাত বুলাল। এখানে ছোট নদী বইছে—সুবর্ণরেখা নদী। নদী ধরে পদ্ম ভাসছে—কখনও হীরা, কখনও মাণিক্যের। এবং রাজপুত্র চন্দনকাঠের পালঙ্কে রাজকন্যাকে দেখল। এইসব গল্প শুনে টুপাতি চেরি বলত, আমরা কোনোদিন ইন্ডিয়ায় যাব না ঠাকমা?
ঠাকুমা বলতেন, বড় হলে, যাবে। দেখবে তখন কত রাজপুত্র তোমাদের খুঁজতে বের হয়েছে।
চেরি যেন এই বয়স পর্যন্ত কোনো রাজপুত্রকে অনুসন্ধান করতে করতে সহসা পোর্টহোলের কাচে তাকে আবিষ্কার করেছে।
ছোট বড় ঢেউ উঠছে সমুদ্রে। দূরে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডলফিনরা, ফ্লাইং—ফিসের ঝাঁক বর্শার মতো ছুটে আসছে জাহাজের দিকে। দুটো—একটা দ্বীপ, দুটো একটা আগ্নেয়গিরি আকাশ লাল করছে। দ্বীপে ছোট ছোট পাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ছে। জলে, লাল নীল হলুদ রঙের মাছ। তখন সূর্য উঠছে।
আবার বিকাল। সূর্য পাটে বসেছে। পোর্টেহোলের ঘন কাচে কোনো চোখ ধরা দিচ্ছে না। টুপাতি দেখল, সুমিত্র আর অ্যালওয়ে ধরে এনজিনে নামছে না। অথবা এনজিন—রুম থেকে উঠে আসছে না। অভিমানে টুপাতির চোখে জল আসতে চাইল।
সেই বিকালে ছোট মালোম এসে বললেন, আসুন, আমরা একসঙ্গে চা খাই।
চেরি বলল, ক্ষমা করবেন মিস্টার। আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
পরদিন ডিনার—পার্টিতে নিমন্ত্রণ করলেন কাপ্তান। বললেন, আজ আপনি আমাদের গেস্ট। আমরা সকলে একসঙ্গে ডাইনিং—হলে খাব।
চেরি বলল, বেশ হবে।
বুড়ো কাপ্তান উঠলেন। চেরি ফের প্রশ্ন করল, আর ক’দিন বাদে বন্দর ধরবে ক্যাপ্টেন?
তিনি কী হিসাব করে একটি তারিখের উল্লেখ করলেন এবং কাপ্তান কী ভেবে ফের বললেন, সন্ধ্যায় ডাইনিং—হলে, একটু নাচ—গান হোক—এই আমার ইচ্ছা।
বেশ হবে।
আপনি অংশগ্রহণ করলে বাধিত থাকব।
অংশগ্রহণ করব।
ভারতীয় জাহাজিটি নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করছে? কাপ্তান কথাপ্রসঙ্গে যেন এই কথাগুলো বললেন।
কোথায় করছে! চেরি এই বলে বড়ো বড়ো হাই তুলল।
ছোঁড়া ভারী বেয়াদপ দেখছি!
ভয়ানক। আবার হাই তুলল চেরি।
দাঁড়ান, ঠিক ব্যবস্থা করছি।
তা করুন। সে কেবল হাই তুলতে থাকল।
এবার আমি আসি।
আচ্ছা।
তখন ঘড়িতে সাতটা বাজল। আটটা—বারোটা ওয়াচের জাহাজিরা বোট—ডেকে উঠে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ওরা ফানেলের পাশ দিয়ে স্টোকহোলডে নেমে যাবে এমন সময়ে কাপ্তান—বয় ছুটে এল। বলল, সুমিত্রকে বাড়িয়ালা তাঁর কেবিনে ডাকছে।
সুমিত্র এই ডাকে ভীত অথবা সন্ত্রস্ত নয়। চেরির চোখে যে স্নেহ দেখেছিল, নিশ্চয়ই তা বেইমানি করতে পারে না। অন্য কোনো কারণ অথবা সারেঙের কানভারী কথা—এমন সব ভেবে সে অ্যাকোমোডেশান ল্যাডার ধরে ব্রিজ অতিক্রম করে কাপ্তানের ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা ছিল বলে কাপ্তান তাকে দেখতে পাচ্ছে। কাপ্তান যে চার্ট—রুমে কোনো মানচিত্র দেখছে এমন চোখে সুমিত্রকে দেখে দেখে একসময় বলল, তুমি এই জাহাজে কোল—বয়ের চাকরি করতে?
ইয়েস মাস্টার।
আমি তোমাকে ফায়ারম্যান করেছি?
ইয়েস স্যার।
তারপর ইফাতুলা কার্ডিফে নেমে গেল বলে তুমি গ্রিজার হলে?
ইয়েস স্যার।
ইয়েস, স্যার, ইয়েস স্যার! বেয়াদপ পাজি, ন্যাস্টি হেল! কাপ্তান চিৎকার করতে থাকলেন।
সুমিত্র নিচের দিকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। সুমিত্র বুঝতে পারছে না। ওর বেয়াদপি কোথায় এবং কখন ঘটেছে। তবু স্বীকার করাই ভালো। নতুবা কাপ্তান এখনই লগ—বুক এনে খচ খচ করে হয়তো লিখবেন—সুমিত্র, অ্যান ইন্ডিয়ান সেলর ডাজ নট ক্যারি আউট হিজ জব। সে বলল, ইয়েস মাস্টার, আর কোনোদিন বেয়াদপি হবে না।
তাহলে কোনোদিন বেয়াদপি করবে না বলছ?
না মাস্টার, কোনোদিন করব না।
ফের কোল—বয় হবার যদি ইচ্ছা না থাকে, চেরিকে যথাযথ সম্মান দেখাবে।
সুমিত্র ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর কাপ্তানের কথামতো যখন ব্রিজ পার হয়ে সিঁড়ি ধরে বোট—ডেকে নেমে এল, যখন দেখল সকল জাহাজিরা নেমে যাচ্ছে স্টোকহোলডে, তখন উত্তেজনায় অধীর হতে হতে সে বাংলায় অশ্লীল সব কথাবার্তা বলল চেরিকে উদ্দেশ্য করে এবং এসময় তার একটু মদ খাবার শখ জাগল।
বিকেলবেলা চেরির ঘরে ডাক পড়তেই সুমিত্র তাড়াতাড়ি ছুটে গেল। এক মুহূর্ত দেরি করল না, অথবা সাজগোজের জন্য আয়নার সামনে দাঁড়াল না। সে অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল চেরি ভয়ানক ভাবে সাজগোজ করে বসে আছে। কোলের উপর ভায়োলিন। প্রসাধনের তীব্র তীক্ষ্ন ভাব সুমিত্রকে যেন সুচতুর যৌনবিলাসী হতে বলছে। চেরিকে সে দেখল। মখমলের পোশাক দেখল এবং নগ্ন ভঙ্গিতে বসে ঠোঁটে বিদ্যুৎ খেলতে দেখল। চিবুকে ভাঁজ পড়েছে—পায়ের ভাঁজে ভাঁজে কেমন আড়ষ্ট ভঙ্গি।
সুমিত্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, কোনো কথা বলল না।
এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।
সুমিত্র কোথায় বসবে ঠিক করতে পারল না।
ডেক—চেয়ারটাতে বোস সুমিত্র।
সুমিত্র খুব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসল।
অমন পুতুল—পুতুল ভাব কেন? কোনো সজীবতা নেই চলাফেরাতে। কেবিনে ঢোকবার আগে পোর্টহোলের চোখ দুটো কোথায় রেখে আসো?
আমাকে ক্ষমা করবেন মাদাম। সেই চোখ দুটো কিছুতেই আর সংগ্রহ করতে পারছি না।
কেন, কেন পারছ না?
আজ্ঞে, কাপ্তান অযথা ধমকালেন।
চেরি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অযথা হো হো করে হেসে উঠল, আচ্ছা কাপ্তানের পাল্লায় পড়েছ।
ইয়েস মাদাম। আপনি কিন্তু ও—কথা আবার কাপ্তানকে বলবেন না।
কাপ্তানকে তুমিও কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে পারলে না?
সুমিত্র জিভ কাটল।— তা হয় না মাদাম। আমাদের কাপ্তান খুব ভালো লোক। অন্য জাহাজের কাপ্তান ভারতীয় জাহাজিদের সঙ্গে সাধারণত কোনো কথাই বলেন না। সব সারেঙের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। অথচ আমাদের প্রিয় কাপ্তান সকল জাহাজিদের নাম জানেন। তাছাড়া নাম ধরে ডেকে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করেন। আমি কিছু ইংরেজি জানি বলে তিনি খুব খুশি আমার উপর। এই জাহাজে কোলবয় হয়ে উঠেছি, তাঁর দয়ায় এখন আমি গ্রিজার। জাহাজিদের এর চেয়ে বড় উন্নতি এত অল্প সময়ে হয় না।
তবে বলতে হয় কাপ্তান তোমাকে খুব ভালোবাসেন?
হ্যাঁ মাদাম।
আমি ভায়োলিন বাজাই, কই, কোনোদিন তো বললে না আপনার বাজনা শুনতে ইচ্ছা হয়, ভালো লাগে?
কথার আকস্মিক পরিবর্তনে সুমিত্র ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, সাহসে কুলায় না মাদাম।
সাহসে কুলায় না, না ইচ্ছা হয় না?
সুমিত্র এবার জিভ কাটল। চোখে পোর্টহোলের প্রতিবিম্ব ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠেই ফের মিলিয়ে গেল।—যদি অভয় দেন তো বলি।
সুমিত্র আবার ভাবল কোনো বেয়াদপি করে ফেলছে না তো? সে বলল, না থাক মাদাম।
কেন থাকবে? তুমি বলো। অভয় দিচ্ছি।
সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় আপনার বাজনা শুনেছি, দিঘির পারে উইলোগাছের ছায়ায় বসে রোজ বিকেলে ভায়োলিন বাজাতেন।
তুমি লুকিয়ে এতসব করতে?
কিছু মনে করবেন না মাদাম। আমরা সেলার। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর বন্দরে এলেই একটু বৈচিত্র্য খুঁজি। কেউ মদ খায়… কেউ…। চুপ করে গেল সহসা।—না থাক।
চেরি খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, ডাইনিং—হলে নাচগান হবে। তুমি এসো।
সুমিত্র জবাব দিল, সে হয় না, মাদাম। জাহাজিদের অতদূর যাবার সাধ্য নেই।
চেরি বলল, আমি যদি কাপ্তানকে অনুরোধ করি?
মাদাম, আপনি জাহাজে আর চার—পাঁচ দিন আছেন। আপনি নেমে গেলে সব জাহাজিরা, সব অফিসাররা আমাকে ঠাট্টা—বিদ্রুপ করবে।
চেরি চুপ করে থাকল। অন্যমনস্কভাবেই ছড় চালাল ভায়োলিনের তারে। এই সুর সুমিত্রর সেই পরম অপার্থিব চোখ দুটিকে যেন খুঁজছে।
ছোট মালোম এলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। সেই শব্দে সুমিত্র উঠে দাঁড়াল।—আমি তবে আসি মাদাম।
বোস। ছোট মালোমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি যাচ্ছি। একটু দেরি হবে। চেরি এবার সুমিত্রকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি রোজ এই পথ ধরে নামবে সুমিত্র, কথা দাও।
আপনি দুঃখ পাবেন মাদাম। আমার চোখ দুটো ফের বেইমানি করতে পারে।
না, কথা দাও।
এই পথ ধরেই নামব। কথা দিলাম।
চেরি বসে ছিল চুপচাপ। সুমিত্র চলে গেছে। ছোট মালোমও চলে গেছেন। সে ঘড়ি দেখল। ছ’টা বাজার দেরি নেই। সে বাংক থেকে নেমে জামাকাপড় বদলাল। সে তার দামি ইভনিং—পোশাক পরে আয়নায় প্রতিবিম্ব ফেলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এ—সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চেরি প্রশ্ন করল, কে?
আমি, ক্যাপ্টেন স্মিথ।
হয়ে গেছে আমার। আমি যাচ্ছি। বলে চেরি বেহালা হাতে বের হল। কাপ্তানের সঙ্গে চলতে থাকল। ওরা ডাইনিং—হলের দিকে যাচ্ছে। যে সকল অফিসারদের, এনজিনিয়ারদের ওয়াচ নেই তারা পূর্বেই নির্দিষ্ট স্থানে বসে আছে। চেরি ঢুকলে সকলে উঠে সম্মান দেখাল চেরিকে। মালবাহী জাহাজের ছোট ডাইনিং—হল, অল্প পরিসরে কয়েকজন মাত্র পুরুষ। ঘরে নীল আলো। বাটলার, কাপ্তানের আদেশমতো এই ছোট্ট ঘরটিকে বিচিত্র সব রঙিন কাগজে এবং বিভিন্ন রকমের চেয়ার—টেবিলের জেল্লায় জৌলুস বাড়াবার চেষ্টা করেছে। চেরি কেমন খুঁতখুঁত করতে থাকল।
কাপ্তান একটু ইতস্তত করে বলল, সমুদ্রের দিনগুলোতে কোনো আনন্দ নেই। মাদাম। সুতরাং স্বল্প আয়োজন থেকেই যতটা আনন্দ নিতে পারি।
আমি কিন্তু অন্য কথা ভাবছি কাপ্তান। সেটা আপনাকেও ভেবে দেখতে বলি।
বলুন।
এই ছোট্ট ঘরে না হয়ে খোলা ডেকে ভালো হয় না?
কাপ্তান এবারও একটু ইতস্তত করল।— আপনি সব জাহাজিদের এ আনন্দে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন?
মন্দ কী! আমার কিন্তু মনে হয় সেই ভালো হবে। ডেকে সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে। সমুদ্রে ঢেউ নেই। এমন সুন্দর দিন…।
তাই হবে।
সুতরাং চার নম্বর এনজিনিয়ার দৌড়ে গেল ডেকে। ডেকের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ড্যারিকে, মাস্টে সবুজ—লাল—নীল আলো জ্বেলে দিল। সতরঞ্চ পেতে সকল জাহাজিদের বসতে বলা হল। তারপর কাপ্তান নিজেই বলতে থাকলেন, আমাদের মাননীয়া অতিথি মিস টুপাতি চেরির সম্মানার্থে এই আনন্দের আয়োজন। আমাদের সমুদ্রের দিনগুলো ভয়ানক নিঃসঙ্গ। সুতরাং সকলেই আজ খোলা মনে আনন্দ করব। এবং এই সম্মানীয়া অতিথির প্রতি নিশ্চয়ই অশালীন হব না।
অফিসারদের জন্য কিছু চেয়ার, কাপ্তান একপাশে এবং তার ডাইনে রেলিংয়ের ধারে চেরি বসল। সমুদ্রে ঢেউ নেই বলে জাহাজ বিশেষ দুলছে না। একটু একটু শীত লাগছে। সকল জাহাজিরা চারপাশে বসে আছে। চেরি সহজ হয়ে দাঁড়াল, প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল, আমরা আজ সকলে পরস্পরের বন্ধু। আসুন, আমরা আজ সকলে একসঙ্গে ঈশ্বরের প্রার্থনা করি। এই কথায় সকলে উঠে দাঁড়াল। ওরা প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশ দেখতে থাকল।
তারপর ছোট মালোম চেরির অনুমতি নিয়ে গান গাইলেন, লেটস লাভ মাই গার্লফ্রেন্ড অ্যান্ড কিস হার…।
মেজ মিস্ত্রি তাঁর ছোট্ট ক্যানারি পাখিটা খাঁচাসহ টেবিলের উপর রাখলেন। শিস দিয়ে পাখিটাকে নানা রকমের অঙ্গভঙ্গিতে নাচালেন। সকলে হেসে গড়াগড়ি দিল।
কাপ্তান কীটসের একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন সকলকে।
একটু বাদে এলেন জাহাজের মার্কনি সাব। মুখোশ পরে চারিধারে বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো ঘুরে বেড়ালেন কিছুক্ষণ। হাতের লাঠিটা মাঝে মাঝে ঘোরাচ্ছেন, তিনি যেন কী খুঁজছেন, অথবা কী যেন তাঁর হারিয়ে গেছে। শেষে কাপ্তানের কাছে এসে বললেন, দিস ম্যান, মাই ফ্রেন্ড, দিস ম্যান ইজ দি রুট অফ অল ইভলস। সুতরাং আসুন, ওকে খতম করে জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাই। বলে তিনি তাঁর লাঠিটা কাপ্তানের মাথায় তুলে ফের নামিয়ে আনলেন, না, মারব না। নোবেল কমিটির শান্তি পুরস্কারটা আমার ভাগ্যে ফসকে যাক—সেটা আমি চাই না। এবং দুঃখে দুটো বড় হ্যাঁচ্চো দেওয়া যাক। তিনি বড় রকমের দুটো হ্যাঁচ্চো দিলেন। লাঠিটা আপনারা নিয়ে নিন, বলে ক্লাউনের কায়দায় লাঠিটা ছুড়ে মেরে ফের ধরে ফেললেন। এবারও সকলে না হেসে পারল না।
এনজিন—রুমে যাদের ওয়াচ ছিল, তারা উপরে উঠে মাঝে মাঝে উঁকি মেরে যাচ্ছে। সুমিত্র সকলের পিছনে বসে আছে। ব্রিজে ঘণ্টা বাজল। এখন সাতটা বাজে। সুতরাং আর আধঘণ্টা এখানে বসে থাকা যাবে। সুমিত্র উঠি—উঠি করছিল, এ সময় চেরি বলল, এবার সুমিত্র আমাদের একটু আনন্দ দিক।
কাপ্তান বললেন, সুমিত্র গান গাইবে।
স্যার, আমাদের গান আপনাদের ভালো লাগবে না।
না সুমিত্র, ঠিক কথা বলছ না। আমরা এখানে কেউ সংগীতজ্ঞ নই। শুধু একটু আনন্দ—সে যেমন করে হোক। একটু আনন্দ, আনন্দ কর।
সুমিত্র একটি সাধারণ রকমের বাংলা গান গেয়ে শোনাল।
এ সময় ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস এল পায়ে খড়খড়ি লাগিয়ে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে অথবা শুয়ে বসে নাচল। এবং শেষে চেরি ওর দীর্ঘদিনের অভ্যাসকে বেহালার তারে মূর্ত করে তুলে সকলকে আনন্দ দিল।
তারপর রাত নামছে, ডাইনিং—হলে কাঁটা—চামচের শব্দ। সেখানে বাটলার এবং অন্যান্য বয়সকল ছুটোছুটি করে পরিবেশন করল। সকলে মদ খেল অল্পবিস্তর। চেরি মদ খেয়ে মাতাল হল আজ।
রাত দশটা বেজে গেছে। চেরি নেশাগ্রস্ত শরীরে কেবিনের ভিতর ডেকচেয়ারে বসে আছে। সুমিত্র সকলের পিছনে চুপচাপ বসে ছিল। উইংস থেকে একটি আলোর তির্যক রেখা এসে ওর চোখে পড়েছে। চেরি ক্ষণে ক্ষণে সুমিত্রকে দেখছিল। দুটি পরস্পর গোপনীয় দৃষ্টি ঘনিষ্ঠ হতে হতে এক সময় লজ্জায় আনত হল। সে কেবিনে ঢুকে পোর্টহোলের পর্দা সরিয়ে দিল। ঘুম আসছে না। এ সময় সুমিত্রকে ডেকে পাঠালে হত।
বয়, বয়! দরজায় পায়ের শব্দে চেরি উঠে গেল এবং দরজা খুলে দিল! শরীর টলছে।— বয়, আজ সুন্দর রাত। বয়, তোমার বাড়িতে কে কে আছে? মাদাম, অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়ুন। গেলাসে জল রেখে গেছি।
বয়, তুমি জানো আমি ভারতীয়?
জী, না।
জেনে রাখো আমি ভারতীয়। বড় দুঃখ হয়, আমরা আর সে দেশে যেতে পারব না। বয়, একটা কথা বলব তোমাকে। কিন্তু সাবধান, কাউকে বলবে না।
মাদাম, আপনার শরীর ভালো নেই। শুয়ে পড়ুন।
বয়, সুমিত্র কিন্তু রাজপুত্র হতে পারত। ওর চোখ, মুখ, শরীর সব সুন্দর।
মাদাম, সুমিত্র যে রাজার ঘরের ছেলে। ভাগ্য দোষে—
চেরি এবার কিছু বলল না। সে ধীরে ধীরে উঠে পোর্টহোলে মুখ রাখল।—তুমি যাও, বয়।
মাদাম, দরজাটা বন্ধ করে দিন। কাপ্তান—বয় বের হয়ে যাবার সময় এই কথাগুলো বলল।
চেরি পোর্টহোল থেকে যখন দেখল কাপ্তান—বয় ঘরে নেই, ওর পায়ের শব্দ অ্যালওয়েতে মিশে গেছে এবং যখন মনের উপর শুধু সুমিত্রই একমাত্র দৃশ্যমান তখন দরজা বন্ধ না করে নিচে এনজিন রুমে নেমে সুমিত্রর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোই ভালো। চেরি দরজা খুলে বাইরে বের হল। এনজিন—রুমে নামার মুখেই দেখল সুমিত্র তেলের ক্যান নিয়ে উপরে উঠে আসছে।
এই যে, মাদাম!
সুমিত্র, তোমার ওয়াচ শেষ?
না মাদাম, পিছিলে যাচ্ছি, স্টিয়ারিং—এনজিনে তেল দিতে।
রাত এখন কত?
এগারোটা বেজে গেছে, মাদাম।
জাহাজে আর কারা এখন জেগে থাকে সুমিত্র?
অনেকে মাদাম। অনেকে। ব্রিজে ছোট মালোম, এনজিন—রুমে তিন নম্বর মিস্ত্রি, স্টোকহোলডে চারজন ফায়ারম্যান, তিনজন কোল—বয়, কম্পাস ঘরে কোয়ার্টার—মাস্টার, ফরোয়ার্ড পিকে কোনো ডেকজাহাজি।
তুমি এত কষ্ট করতে পারো সুমিত্র!
এখন তো কোনো কষ্টই নেই মাদাম। যখন কোল—বয় অথবা ফায়ারম্যান ছিলাম সে কী কষ্ট!
তুমি আমার ঘরে আসবে সুমিত্র?
আপনার শরীর ভালো নেই মাদাম। আমি আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিতে সাহায্য করছি। কারণ চেরির এই উচ্ছৃঙ্খল ভাবটুকু ভালো লাগছে না সুমিত্রর। সে চেরির অন্য কোনো অনুরোধ রাখল না। সে চেরিকে ধরে বলল, আসুন।
কোথায় সুমিত্র?
কেবিনে।
আমার ভালো লাগছে না।
ভালো না লাগলে তো চলবে না মাদাম।
তুমি কেবিনে বসবে, বলো?
বসব।
তোমার ফের ওয়াচ ক’টায়?
ভোর আটটায়।
চেরি কেবিনের দিকে না গিয়ে ডেকের দিকে পা বাড়ালে সুমিত্র বলল, এ তো আচ্ছা বিপদে পড়া গেল দেখছি। রাতদুপুরে জাহাজিরা দেখলে বলবে কী?
কী বলবে সুমিত্র?
কী আর বলবে! আসুন। ধমকের সুরে কথাগুলো বলল সুমিত্র। তারপর জোর করে চেরিকে কেবিনে ঠেলে দিতেই শুনতে পেল—চেরি বলছে—ভালো হচ্ছে না সুমিত্র। আমি মাতাল বলে কিছুই বুঝতে পারছি না ভাবছ। কাল ঠিক কাপ্তানকে নালিশ করে দেব দেখ। আমার উপর জোর খাটালে ঈশ্বর সহ্য করবেন না।
ফের সুমিত্র নিজের অবস্থা বুঝে খানিক বিব্রত বোধ করছে। এমত ঘটনার কথা কাপ্তানকে বললে—তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন না। অথবা মনে হল বৃদ্ধ কাপ্তানকে খবর দেওয়া যায়—চেরি ডেকের অলিগলিতে ঘুরতে চাইছে। চেরি মদ খেয়ে মাতাল এবং চেরির এই সময় যৌনেচ্ছার বড় ভয়ানক শখ। কিন্তু দেখল যে রাত গভীর। ফরোয়ার্ড পিক থেকে ওয়াচ করে ডেক—জাহাজি হামিদুল ফিরছে। ওয়াচের ঘণ্টা বাজছে ব্রিজে। সুতরাং বৃদ্ধ কাপ্তানকে এ সময় ডেকে তোলা নিশ্চয়ই সুখকর হবে না। বরং কাপ্তান—বয়ের খোঁজে গেলে হয়, যথার্থ উপকার এসময় তবে হতে পারে। সে আরও কিছু ভাবছিল তখন চেরি ওর হাতটা পিছন থেকে খপ করে ধরে ফেলল। বলল, দোহাই সুমিত্র, আমাকে একা ফেলে যেও না। খুব ভয় করছে।
সুমিত্র ছোট মালোমের কথা মনে করতে পারল। প্রতিদিন ওয়াচের শেষে অথবা রাতের নিঃসঙ্গতায় ভুগে ভুগে এই দরজার ফাঁকে চোখ রাখার জন্য উপস্থিত ছোট মালোম। এই দরজায় হাত রেখে বলত, বোট ডেকে বড় সুন্দর রাত।
চেরি বলত, আমার শরীরটা যে ভালো যাচ্ছে না থার্ড।
আমরা এখন একটা নির্জন দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, মাদাম।
সেটা আমার দ্বীপের চেয়ে নিশ্চয় বেশি সুন্দর হবে না থার্ড।
চেরি কতদিন এমন সব কথা বলে প্রাণ খুলে হাসত।—তোমাদের থার্ড আচ্ছা বেহায়া! চেরি ভয়ানক টলছিল। সে এখন এক হাত বাংকে রেখে অন্য হাতে সুমিত্রের কলার চেপে বলছে, মাই প্রিন্স।
মাদাম, আপনি কীসব বলছেন!
আমি ঠিক বলছি সুমিত্র। আমি ঠিক বলছি। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও সুমিত্র, নতুবা আমি জোরে জোরে চিৎকার করব। বলব, প্রিন্স প্রিন্স। একশোবার বলব। সকলকে শুনিয়ে বলব। তুমি কী করবে? কী করতে পারছ?
ভয়ে সুমিত্র কাঠ হয়ে থাকল। সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে বলল, চুপ করুন মাদাম চুপ করুন। আপনার ঈশ্বরের দোহাই।
সুমিত্র দেখল কেবিনের পোর্টহোল খোলা। ফরোয়ার্ড পিকে কোনো জাহাজি যদি এখন এই সময় ওয়াচে যায়, চোখ তুলে দেখলে ওদের দুজনকে স্পষ্ট দেখতে পাবে। সে তাড়াতাড়ি পোর্টহোলের কাচ বন্ধ করতে গিয়ে দেখল—ক্যালেন্ডারটা উড়ছে। সে সন্তর্পণে পোর্টহোল দিয়ে কিঞ্চিৎ মুখ বার করে যখন দেখল কেউ এ—পথে আসছে না, বারোটা—চারটের পরীদাররা সব এনজিন রুমে নেমে গেছে এবং শেষ ওয়াচের পরীদারদের চিৎকার স্টোকহোল্ড থেকে উঠে আসছে তখন দ্রুত পোর্টহোলে কাচ এবং লোহার প্লেট উভয়ই বন্ধ করে দিয়ে চেরির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল এবং বাংলায় বলল, বেশ্যা! তারপরের খিস্তি উচ্চারণ না করে মনে মনে হজম করে ফেলল। তবে অভ্যস্ত ইংরেজিতে উচ্চারণ করল, মাদাম, আমাকে বিপদে ফেলবেন না।
বোস সুমিত্র।
সুমিত্র পূর্বে এ—কেবিনে যে সংকোচ নিয়ে যে ভয় এবং মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বসত আজও তেমন দু’হাতের তালুতে মাথাটা রেখে কেমন অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকল। সে এ—মুহূর্তে কিছুই ভাবতে পারছে না। চার ঘণ্টা ওয়াচের পর ক্লান্ত শরীরটাকে যখন ফোকসালে নিয়ে যাবে ভাবছিল, যখন স্নান সেরে শরীরের সকল ক্লান্তি উত্তাপ দূর করবে ভাবছিল তখন চেরির এই মাতাল ইচ্ছা ব্যাধিগ্রস্ত শরীরের মতো ক্রমশ ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
চেরি বলল, তুমি ইচ্ছা করলে স্নান সেরে নিতে পারো সুমিত্র।
সুমিত্র যেহেতু একদা এইসব কেবিনের দেয়াল সাবান—জল দিয়ে পরিষ্কার করেছে, যেহেতু ওর সব জানা… সুমিত্র সুতরাং উত্তর করছে না।
চেরি বাংক থেকে উঠে ওর পাশে বসল। বলল, মাই প্রিন্স। বলে সুমিত্রর কপালে চুমু দেবার জন্য ঝুঁকে পড়ল।
সুমিত্র উঠে দাঁড়াল এবং বলল, মাদাম, আপনি পাগল।
চেরির পা দুটো টলছে এবং চোখ দুটো তেমনি মায়াময়।
সুমিত্রর এই অপমানসূচক কথায় চোখ দুটো কেমন সজল হয়ে উঠল। নিচে এনজিনের শব্দ। আরও নিচে সমুদ্র অতল থেকে যেন ফুঁসছে। চেরি বলল, আমি ভারতবর্ষে যাব সুমিত্র। তুমি নিয়ে চলো। তুমি আমাকে ঘোড়ার পিছনে নিয়ে কেবল ছুটবে, ছুটবে—কোথাও পালিয়ে যাবে।
চেরির সেই রাজপুত্রের কথা মনে হল। সেই রাজকন্যার কথা মনে হল। রাজকন্যা স্বয়ম্বর সভা অতিক্রম করে দূরে দূরে চলে যাচ্ছে। ঝাড়লণ্ঠন পরিত্যাগ করে আঁধারের আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। মুক্তোর ঝালর—দ্বারীরা হাঁকছে অথচ নিকটবর্তী কোনো জলাশয়ে প্রতিবিম্ব রাজপুত্রের। সকলের অলক্ষ্যে রাজপুত্র রাজকন্যার জন্য প্রতীক্ষা করছে। চেরির এইসব কথা মনে হলে বলল, তুমি পারো না সুমিত্র, তুমি আমাকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে পারো না!
সুমিত্রকে উদাস দেখে ফের বলল, পারো না তুমি? আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না ভারতবর্ষে?
মাতাল রমণীকে খুশি করার জন্য সুমিত্র বলল, নিয়ে যাব।
তোমার দেশের গ্রাম মাঠ দেখব সুমিত্র!
সুমিত্র সহজভাবে কথা বলতে চাইল।—ফুল দেখবে না? পাখি দেখবে না?
ফুল দেখব, পাখি দেখব।
আমার দেশের আকাশ দেখবে না? আকাশ?
সাপ বাঘ দেখবে না? সাপ বাঘ? বিধবা বউ, যুবতী নারী? এইসব বলতে বলতে সুমিত্র কেমন উত্তেজিত বোধ করছিল। সে মরিয়া হয়ে যেন বলে ফেলল, আমি সব দেখাতে পারি। কিন্তু দেখাব না। তুমি নেশায় টলছ। নিজের সম্বন্ধ তুমি সচেতন নও, সুতরাং সব দেখালে অন্যায় হবে।
প্রথমটায় চেরি ধরতে না পেরে বলল, কী বললে? চেরির চোখ দুটো তারপর সকল ঘটনার কথা বুঝতে না পেরে ছোট হয়ে এল।—কাপুরুষ! চেরি সুমিত্রর মুখের কাছে এসে কেমন একটা থু শব্দ করে দরজার পাট সহসা খুলে দিল। গেট আউট, ইউ গেট আউট! এমন চিৎকার শুরু করল চেরি যে সুমিত্র পালাতে পারলে বাঁচে। সুতরাং সুমিত্র ছুটতে থাকল। সে ডেক ধরে ছুটে এসে পিছিলে উঠে দেখল পরীদারেরা সকলে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে এইসব কথা গোপনে লালন করে দীর্ঘ সময় ধরে মেয়েটির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দুঃখ বোধ করল।
তখন চেরি পোর্টহোলের প্লেট খুলে দিল। কাচ খুলে দিল। সে শরীরটাকে বাংকে এলিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে—এমন সময় দরজায় শব্দ, কড়া নাড়ছে কে যেন। ধীরে ধীরে এবং সন্তর্পণে। অথবা চোরের মতো। সে বুঝতে পারছে—কারণ চট করে শরীরের মাতাল ভাবটা কেটে গেছে পোর্টহোলের ঠান্ডা হাওয়ায় এবং নিজের বেলেল্লাপনার রেশটুকু ধরতে পেরে লজ্জিত, কুণ্ঠিত। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার সামনে। বলল, কে?
আমি মাদাম।
আপনি কে?
আমি থার্ড।
আজ তো আকাশে নক্ষত্র নেই। আকাশে মেঘ দেখতে পাচ্ছি। এইসব কথার ভিতর চেরির মাতাল মন ধীরে ধীরে যেন সুস্থ হচ্ছে। এতক্ষণ প্রায় সে সকল বস্তুকে দুটো অস্তিত্বে দেখছিল— দুটো ক্যালেন্ডার, দুটো লকার, চারটে বাংক এবং এমনকি সুমিত্র পর্যন্ত দুটো অস্তিত্বে ওর পাশে বসে ছিল। পোর্টহোলের ঠান্ডা হাওয়ায় সবকিছুই মিলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে। যেন সবই এখন এক অখণ্ড বস্তু। তবু থার্ডকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, চলুন কাপ্তানের ঘরে। রাতদুপুরে কেমন জ্বালাতন করছেন টেরটি পাবেন।
এতক্ষণ মাদাম, দয়া করে আপনার কেবিনে কে ছিলেন?
চেরি বিদ্রূপ করে বলল, কেন, আপনি নিজে। তারপর দরজাটা মুখের উপর ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিয়ে বলল, লক্ষ্মীছেলের মতো ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন।
কিন্তু সুমিত্র নিজের বাংকে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারল না। সুমিত্রের মনে পড়ল মাতাল রমণী যদি দরজা খুলে শুয়ে থাকে, যদি থার্ড সেই ফাঁকে বেড়ালের মতো সন্তর্পণে ঢুকে পড়ে এবং চুরি করে চেটে চেটে মাংসের স্বাদ নিতে নিতে যদি… ভালো নয়, ভালো নয় সব—এমন ভেবে সে ডেকের উপর উঠে এলো। কাপ্তান—বয়ের দরজায় কড়া নেড়ে ডাকল, চাচা, অ চাচা, একটু উঠুন।
বৃদ্ধ কাপ্তান—বয়ের সারাদিন পরিশ্রমের পর এই বিশ্রামটুকু একান্ত নিজস্ব। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুতরাং দু—এক ডাকে সাড়া পেল না সুমিত্র। সুমিত্র বারবার ধীরে ধীরে ডাকল, চাচা, অ চাচা! সে জোরে ডাকতে পারছে না, কারণ পিছনে মেসরুম মেট এবং মেসরুম বয় থাকে। তারপর এনজিনের স্কাইলাইট পার হলে ফানেল। ফানেল অতিক্রম করে অ্যাকোমোডেশান ল্যাডার, যা ধরে কাপ্তানের ঘরে উঠে যাওয়া যায়। জোরে ডাকাডাকি করলে বৃদ্ধ কাপ্তানের ঘুম পর্যন্ত ভেঙে যেতে পারে। সুতরাং ধীরে ধীরে সে কড়া নাড়তে থাকল।
বৃদ্ধ কাপ্তান—বয় একসময় দরজা খুললে বলল, চেরির দরজা বন্ধ করে আসুন চাচা। মদ খেয়ে ভয়ানক মাতলামি করছে।
তাড়াতাড়ি কাপ্তান—বয় গায়ে উর্দি চাপিয়ে নিচে ছুটল। গিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। তবু সে ধীরে ধীরে ঠেলে দেখল—দরজা খোলা এবং খুলে যাচ্ছে। চেরি বাংকের উপর বসে ক্যালেন্ডারটা দেখছে নিবিষ্ট মনে। কাপ্তান—বয়ের কোনো আওয়াজই চেরি শুনতে পাচ্ছে না। তখন দরজাটা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। কিন্তু কী ভেবে ঘরের ভিতর ঢুকল কাপ্তান—বয়। টিপয়ে খাবার জল রাখল, তারপর পিতৃত্বের ভঙ্গিতে বলে উঠল, মাদাম, শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে। এখন প্রায় একটা বাজে।
চেরি বড় বড় হাই তুলছে। সে কম্বলটা নিচে ঠেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল। কাপ্তান—বয় দাঁড়িয়ে ছিল—চেরি কাত হয়ে শুয়ে ক্যালেন্ডারটা দেখছে। ওর পোশাকের গাঢ় রঙের ভাঁজ এখন আর নেই। চোখে অবসাদের চিহ্ন। কেমন এক তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব ওর সমস্ত অবয়বে। কাপ্তান—বয় কম্বলটা ওর শরীরের উপর বিছিয়ে দিয়ে বাইরে এল। দরজা টেনে সন্তর্পণে তালা মেরে দিল। ডেকে বের হয়ে দেখল ঠান্ডায় সুমিত্র তখনও পায়চারি করছে।
কাপ্তান—বয় কাছে এসে বলল, দরজা বন্ধ করে তালা মেরে দিলাম।
যাক, বাঁচা গেল। এইটুকু বলে সুমিত্র পিছিলের দিকে উঠে যেতে থাকল।
ভোরবেলায় জাহাজিরা সাবানজল নিয়ে কেবিনের দেয়াল ধুতে অথবা ফল্কা বেঁধে নিচে নেমে অদৃশ্য হতে চাইছে। তখন চেরি বিছানায় উঠে বসল। দরজা বন্ধ দেখল। সে গত রাতের কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারছে। সুমিত্র, জাহাজি সুমিত্রর প্রতি চেরির বলতে ইচ্ছা হল, গত রাতের ঘটনার জন্য আমাকে ক্ষমা কর সুমিত্র। এই জাহাজে, সমুদ্রের ভয়ানক নিঃসঙ্গতা এবং তোমার পাথরের মতো শরীরের স্থির অথবা অচঞ্চল উপস্থিতি আমাকে নিয়ত তীব্র তীক্ষ্ন করছে। আমাকে অস্থির, চঞ্চল করেছে। অথচ তুমি কখনও পুতুলের মতো শরীর নিয়ে, কখনও একান্ত বশংবদের চিহ্ন শরীরে এঁকে আমার কেবিনে সময়, কাল অতিক্রম করার হেতু আমি ক্রমশ এক অস্থির নিয়তির ইচ্ছায় কালক্ষয়ের বাসনায় মগ্ন। কৈশোরের স্বপ্ন তোমার অবয়বে কেবল রূপ পাচ্ছে। আমার প্রিয়তম দ্বীপে এমত ঘটনা ঘটলে কী হত জানি না, আমার বাবা বর্তমান—তিনি আমাকে কী বলতেন জানি না এবং তোমার উপস্থিতি সহসা আমাকে অন্ধকারে নিদারুণ চঞ্চলতার জন্মদানে আমার সম্মানিত জীবনকে বিব্রত করে কেন জানি না, তবু তুমি কখনও এই কেবিনে এসে দাঁড়ালে আমি অধোবদনে লজ্জিত থাকব। তারপর আয়নায় চেরি তার মুখ দেখে উচ্চারণ করল—গত রাতের ঘটনার জন্য তুমি আমায় ক্ষমা করো সুমিত্র।
রাতের বিড়ম্বনার জন্যই হোক অথবা অন্য কোনো কারণে, সুমিত্র ভোর রাতের দিকে শরীরে ভীষণ ব্যথা অনুভব করতে থাকল। পাশের বাংকে অনাদি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওর যেহেতু চারটে আটটা পরী, যেহেতু এক্ষুনি তেলয়ালা হাফিজদ্দি ওকে এসে ডেকে তুলবে সুতরাং জল তেষ্টাতে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে ওকে ডাকা ভালো।
সুমিত্র ডাকল, অনাদি, ও অনাদি। একটু উঠে জল দে ভাই।
এই রাতে জল চাওয়ায় অনাদি আশ্চর্য হল। সে বলল, উঠে খেতে পারিস না।
শরীরে ভয়ানক কষ্ট।
কেন, কী হল!
মনে হয় জ্বর এসেছে।
অনাদি তাড়াতাড়ি উঠে কপালে হাত রেখে দেখল জ্বরে সুমিত্রর শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সে জল দিল সুমিত্রকে এবং শরীরটা টিপে দেবার সময় বলল, রাত একটা পর্যন্ত তুই কোথায় ছিলি রে?
সুমিত্র উপরের দিকে হাত তুলে দেখাল।
কী করছিলি।
চেরিকে পাহারা দিচ্ছিলাম।
চেরি তোকে কিছু বলেছে?
না।
জাহাজের একঘেয়েমি তোর ভালোই লাগছে।
সুমিত্র জবাব দিল না। চুপ করে অন্য দিকে দেখতে দেখতে সুমিত্র কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
ভোরের দিকে সারেং ঘরে ঢুকে বলল, কী রে বা, অসুখ বাধাইছ!
না, তেমন কিছু নয় চাচা। মনে হয় ফ্লু গোছের কিছু। মেজ মালোমের কাছ থেকে একটু ওষুধ এনে দেন চাচা।
সারেংকে চিন্তিত দেখাল। ওর পরী কে দেবে এখন এমতই কোনো চিন্তা যেন সারেঙের মনে। সুতরাং সে একজন ফালতু আগওয়ালকে ডেকে সুমিত্রর পরী দিতে বলে যাবার সময় বলে গেল—পরীতে সুমিত্রর আজ যেতে হবে না এবং তখুনি কোনো কয়লায়ালাকে দিয়ে ওষুধ পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছে। সব কাজ হয়ে যাবার পর সারেং যেন খুশি। তবে সুমিত্র যেন ডেকে উঠে ফের ঠান্ডা না লাগায়, বেশি হাঁটাহাঁটি না হয় সেজন্য সারেং শাসনের ভঙ্গিতেও কিছু কথা বলে গেল। বিশেষত, ভাতের জন্য ভাণ্ডারীকে পীড়াপীড়ি করলে নির্ঘাত পরী দিতে হবে এইসব কথার দ্বারা সারেং সকলের উপরে, সে—ই জাহাজের সব খালাসিদের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা এমন এক ধারণার ভিত্তিতে সারেং মেজ মিস্ত্রির মতো ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে গেল—যেন এনজিনিয়ার হাঁটছে।
শুয়ে ছিল, সে পরীদারদের ওঠানামার সঙ্গে ধরতে পারছে, এখন ক’টা বাজে। পোর্টহোল খোলা ছিল, কিন্তু সে সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে না। উপরের ঘরে ট্যান্ডেলের তামাক কাটার শব্দ ভেসে আসছে। পাশের ফোকসালে কোনো জাহাজি এখন নামাজ পড়ছে। তা ছাড়া সমুদ্রে ঢেউ একটু বেশি আজ। জাহাজটা কিঞ্চিৎ বেশি দুলছে যেন।
মুখটা ওর বিস্বাদ লাগল। সে এক মগ চায়ের জন্য প্রতীক্ষা করছে এখন। ভাণ্ডারী এক মগ চা এনে দিলে ঢক ঢক করে সবটা খেয়ে সমস্ত শরীরে কম্বল ঢেকে পড়ে থাকবে—তারপর যদি ভীষণভাবে ঘাম হয় শরীরে তবে নিশ্চয়ই শরীরটা ঠান্ডা হবে এবং অসহনীয় যন্ত্রণাবোধ থেকে সে মুক্তি পাবে।
কেবিনে বসে চা—এর সঙ্গে স্যান্ডউইচ, কিছু ফল এবং মাখনের স্বাদ এতবার চেখেও যখন চেরি তৃপ্তি পেল না, যখন আটটা—বারোটার পরীদাররা সকলে নেমে গেছে ধীরে ধীরে অথচ সুমিত্র নামছে না—দূরে সমুদ্রের বুকে সূর্যের ম্লান আলো তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে এবং তরঙ্গসকলকে আলোকিত করছে; কিছু উড়ুক্কু মাছ তেমনি ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটছে, ছোট মালোম দূরবিনে আকাশ এবং সূর্যের অবস্থান প্রত্যক্ষ করছেন তখন চেরির মনে হল ডেকছাদের ছায়া ধরে একটু হেঁটে এই জাহাজের রেলিংয়ে ভর করে একটু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালে হয়। সমুদ্রের উপর জাহাজের প্রপেলার জল কেটে যাচ্ছে, জলে ফসফরাস জ্বলছিল—সূর্যের ম্লান আলোর জন্য সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকার থাকলে এখন যেন ভালো হত। ফসফরাস জ্বলছে, এইসব দেখে গত রাতের মতো ঘোর উত্তেজনায় ভুগতে পারত। রাতের নিঃসঙ্গতায় এখানে চেরি কতবার এসে ভর করে দাঁড়িয়েছে। রেলিংয়ে ঝুঁকে ফসফরাস জ্বলতে দেখেছে। কখনও সুমিত্র থাকত, কখনও থাকত না। একদিন সে সুমিত্রকে খুশি করার জন্য বলেছিল—দ্বীপে নেমে সোজা আমাদের প্রাসাদে গেলে না কেন? সুমিত্র তুমি…। সুমিত্র এই সময় কোথায়! ডেকসারেং এক নম্বর ফল্কার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। জাহাজিরা সাবানজল নিয়ে মাস্টের উপর উঠে হাসিঠাট্টায় মশগুল। চেরি তখন ডাকল, সারেং, সারেং!
ডেকসারেং দৌড়ে এলে চেরি বলল, সুমিত্র কোথায়? সে তো এখনও নিচে নামেনি। ওর তো আটটা—বারেটা ওয়াচ।
সারেং জবাব দিল, মাদাম, ওর অসুখ হয়েছে।
চেরি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, যাঃ!
জী মাদাম। আপনাকে আমি মিথ্যা বলতে পারি?
ওকে কে দেখাশুনা করছে?
কে করবে মাদাম? কেউ তো বসে নেই। সকলেই কাজ করছে। ও জ্বরে কাতরাচ্ছে।
তোমরা ওকে দেখতে পারো না! জ্বর হয়েছে… একলা ফেলে…
তা দেখি, মাদাম। সারেং নিজের দোষ কাটাবার জন্য বলে গেল, সব ব্যবস্থা করা হয়েছে মাদাম। এনজিন—সারেং মেজ মালোমের কাছ থেকে ওষুধ এনেছে।
তারপর চেরির মনে পড়ল এই মালবাহী জাহাজে সেবা—শুশ্রূষার কোনো ব্যবস্থা নেই। জাহাজিদের জন্য ভালো ওষুধ নেই। কোনো ডাক্তার নেই। সাধারণ রকমের অসুখে মেজ মালোমই ওষুধ দেন। সাধারণ রকমের অসুখে প্রয়োগ করার মতো কিছু ওষুধপত্র এই জাহাজের কোনো এক প্রকোষ্ঠে সঞ্চিত আছে। কাপ্তানের উপর কোম্পানির উপর চেরির রাগ ক্রমশ বাড়তে থাকল। অথচ চেরি ফোকসলের দিকে হেঁটে যেতে পারছে না। গত রাতের ঘটনাসকল চেরিকে সংকুচিত করছে। যেন এই মুখ সুমিত্রকে দেখানো চলে না। যেন সুমিত্রর ফোকসালে ঢুকলে সে অপমানিত হতে পারে। গত রাতের দুঃসহ অপমানের কথা নিশ্চয়ই সে ভুলে যায়নি। সুতরাং, কী ভেবে চেরি নিজের কেবিনে ঢুকে কিছু ফল তুলে নিল হাতে এবং কাপ্তান—বয়কে ডেকে বলল, যাও সুমিত্রর কেবিনে এই ফলগুলি রেখে এসো। কিছু বললে বলবে বাটলার দিয়েছে। আমার কথা বলবে না।
কাপ্তান—বয় দরজার চৌকাঠ পার হলে চেরি বলল, জ্বর কত এবং কেমন আছে দেখে আসবে।
কাপ্তান—বয় আলওয়েতে হাঁটছিল এবং শুনতে পাচ্ছে, ওকে বেশি নড়াচড়া করতে বারণ করবে। মনে থাকে যেন, আমার কথা বলবে না।
কাপ্তান—বয় খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে। কারণ তখনও চেরি নানারকমের নির্দেশ দিচ্ছে।—কম্বল গায়ে না থাকলে দিয়ে দেবে। কাপ্তান—বয় সব শুনে হাসল। বস্তুত চেরি আভিজাত্য বোধে ফোকসালের দিকে হেঁটে যেতে পারছে না। কাপ্তান—বয় বুঝল, চেরির ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। ডেকছাদের নিচে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল—দূরে কেবিনের দরজাতে ভর করে চেরি অপলক চোখে কাপ্তান—বয়ের কাছে কোনো খবরের প্রতীক্ষায় আছে। কাপ্তান—বয় এবার সত্বর ছুটে গেল। কারণ ওরও চেরির দুঃখবোধে মনের কোণে এক স্নেহসুলভ ইচ্ছার রঙ করুণ হয়ে উঠেছে।
সিঁড়ি ধরে নামছিল কাপ্তান—বয়। নিচের ফোকসালগুলি সবই প্রায় খালি। কিছু কিছু জাহাজি ডেকে হল্লা করছে। ওরা দেশের গল্পে, বিবিদের গল্পে মশগুল। প্রতিদিনের মতো ফলঞ্চা বেঁধে কেউ কেউ জাহাজে রঙ করছে। কাপ্তান—বয় প্রতিদিনের এইসব একঘেয়েমি দৃশ্য দেখতে দেখতে নিচে নেমে গেল। সুমিত্রর শিয়রে দাঁড়িয়ে কপালে হাত রাখল। ডাকল, সুমিত্র, ওঠ বাবা।
এই সময় কে কপালে হাত রাখল! ডাকল! সুমিত্রর মনে হল বড় প্রীতময় এই জাহাজিদের সংসার। দীর্ঘদিনের সফরে কাপ্তান—বয়কে আপনজনের মতো করে ভাবতে গিয়ে চোখে জল এল। সে ডাকল, চাচা!
কেমন আছ?
শরীরটা বড় ব্যথা করছে।
একটু নুনজল এনে দেব? গরম জল?
গরম জল ভাণ্ডারী দিয়েছে।
কী খেলে।
কিছু না। ভাবছি ভাত খাব না। শরীরটা খুব ঘামছে। মনে হয় ভালো করে ঘাম হলে শরীরটা খুব ঝরঝরে হবে।
যখন কাপ্তান—বয় দেখল শরীরে কোনো উত্তাপ নেই এবং যখন বুঝল ফ্লু—গোছের কিছু হয়েছে তখন আর বেশি দেরি করল না। পকেট থেকে আপেলগুলো বের করে দিয়ে বলল, নাও খাও। খাবে। কী খেতে ভালো লাগে বলবে। বিকেলে এনে দেব। তারপর সুমিত্রকে একটু বিস্মিত হতে দেখে বলল, বাটলার দিয়েছে। বড় বড় চোখে তাকাবার মতো কিছু হয়নি।
সুমিত্রর শরীরে কম্বল টেনে দিয়ে কাপ্তান—বয় বাইরে বের হয়ে গেল। সিঁড়ি ধরে উঠছে। সুমিত্র শুয়ে শুয়ে উপরে কাপ্তান—বয়ের জুতোর শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে শুনতে পেল। ওর পোর্টহোলটা খোলা নেই। খোলা থাকলেও সে আকাশ দেখতে পেত না। মালবোঝাই জাহাজ। সমুদ্রের জলে মাঝে মাঝে পোর্টহোলটাকে ঢেকে ফেলছে। সমুদ্রের এই জল দেখে গতরাতের কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারছে সুমিত্র। চেরির যৌন ইচ্ছা এবং প্রগলভতা ওর মনে এখনও কামনার জন্ম দিচ্ছে। অথচ সে পারছে না। বারবার এই আত্মঘাতী ইচ্ছা ওকে নিদারুণ যন্ত্রণায় দগ্ধ করছে, রাতে চেরির কেবিন থেকে ফিরে এসে এই ফোকসালে দীর্ঘ সময় পায়চারি করেছে এবং সকল দগ্ধ যৌন ইচ্ছার প্রতি উষ্মা প্রকাশের জন্য বার বার জাহাজিসুলভ খিস্তি করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে চেয়েছে।
বিকালে সুমিত্রর জ্বরটা থাকল না। বাংকে বসে সে—শরীর তার এখন হালকা, নিরন্তর এই বোধে খুশি। সে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে একটি বেঞ্চিতে বসল। সমুদ্রের হাওয়ায় ওর শরীর প্রাণ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। সে এবার ধীরে ধীরে চার নম্বর ফল্কা অতিক্রম করে ডেক—ছাদের নিচ দিয়ে এলওয়ে পথটাকে দেখল—সেখানে কোনো পরিচিত মুখ ভেসে উঠছে না। সেই মুখ, নরম ঘাড় আর তার কোমল মন সুমিত্রর নিঃসঙ্গ এবং পীড়িত শরীরের জন্য বড় প্রয়োজন। এবং গত রাতের ‘বেশ্যা’ এই শব্দটি গ্লানিকর সুতরাং উচ্চারণে কিঞ্চিৎ সংযত হওয়া প্রয়োজন। তারপর এই মুহূর্তে নিজেকে ছোটলোক ভেবে ক্ষোভ থেকে কিঞ্চিৎ প্রশমিত হওয়া গেলে মন্দ কী? চেরির মাতাল যৌনেচ্ছাতে সমুদ্রের নেশা ছিল। ওর ঘরে দ্বীপের আভিজাত্য অনেক দূরের স্মৃতির মতো এবং এইজন্যই বুঝি সমুদ্রের ঢেউ অথবা আকাশ দেখতে দেখতে একটু প্রেম করা চলে—ভালোবাসলে ক্ষতি নেই, তারপর রাত যদি ঘন ঘন শরীরের রমণীয়তায় তন্ময় করে রাখে, যুক্ত করে রাখে তবে বিঘ্নকারী জানোয়ারের মতো ইতর হবার প্রয়োজন কোথায়! সে ভাবল, সুতরাং আজ রাতে চেরির দরজার পাশ দিয়ে একবার হেঁটে যাবে। এবং গৃহপ্রবেশের দিনে গিন্নিমার মতো একবার যৌনসংযোগ ঘটাবে—এই নিরন্তর ইচ্ছার জন্য সে এবার ডাকল— ভাণ্ডারী—চাচা, আমাকে একমগ চা দিন।
ভাণ্ডারী উঁকি দিল গ্যালি থেকে। জাহাজিরা ঘরে ফেরার মতো একে একে সকলে পিছিলে জমছে। ওদের হাতে রঙের টব ছিল। ওরা হাতের রঙ কেরোসিন তেলে মুছে নিচ্ছে। ওরা এবার স্নান করবে। নামাজ পড়বে এবং আহার করবে। তারপর সমুদয় কাজ সেরে ওরা গিয়ে বেঞ্চিতে বসে ন্যক্কারজনক কথাবার্তায় ডুবে ডুবে জল খাবে। সুমিত্র ওদের সকলকে দেখল। ওরা সকলে ওকে এক প্রশ্ন করল, তোমার শরীরটা ক্যামন আছেরে বা? এইসব বলে ওরা ফোকসালে নেমে গেলে ভাণ্ডারী বলল, চা কড়া করে দেব?
তাই দাও।
সুমিত্রর এখন আর কিছু করণীয় নেই। সুতরাং পা ঝুলিয়ে বসে থাকল। শরীরে সমস্ত দিনের সঞ্চিত গ্লানি এই সমুদ্র এবং এক কাপ চা দূর করে দিল। সে এবার জাহাজের অলিগলি না খুঁজে সোজা দিগন্তে নিজের দৃষ্টিতে নিযুক্ত করে তার দেশ বাড়ির চিন্তা—সেখানে কী মাস, কী ফুল ফুটছে অথবা কোন ঋতু হতে পারে, দুর্গাপুজোর সময় হতে কত দেরি, শেফালি ফুল ছড়ানো উঠোন অথবা বৃষ্টি বৃষ্টি… এবং জাহাজে থেকে থেকে বাংলাদেশের মাস কালের হিসাব ভুলে গেল সুমিত্র। অথবা এইসব চিন্তার দ্বারা দেশের আকাশকে উপলব্ধি করার জন্য আঁকু—পাঁকু করতে থাকল সুমিত্র।
ডেক—সারেং বলল, তবিয়ত কেমন?
ভালো চাচা। জ্বরটা মনে হয় সেরে গেছে।
কী খেয়েছিলে?
চাপাটি খেলাম চাচা।
ভালো করেছ।
রাত্রে দেখি বাটলারকে বলে একটা পাঁউরুটি সংগ্রহ করতে পারি কি না।
অনাদি উঠে এল। সে বলল, এখানে বসে শরীরে ঠান্ডা লাগানো হচ্ছে? এক্ষুনি নেমে পড়! বলে, সুমিত্র অনাদিকে অনুসরণ করে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। সারেংয়ের ঘরটা অতিক্রম করে স্টোর রুমের পাশের নির্জন জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে সুমিত্র ডাকল, অনাদি!
কিছু বলবি!
তুই তো সারাদিন পাঁচ নম্বরের সঙ্গে ডেকে কাজ করছিলি?
হ্যাঁ, তা করছিলাম।
চেরিকে ডেকে বের হতে দেখলি না?
না। তবে এলওয়ে ধরে আসবার সময় দেখলাম চেরি বিছানায় শুয়ে আছে।
কিছু করছে না।
ঘরটা অন্ধকার। দরজা জানলা সব বন্ধ করে রেখেছে।
সুতরাং ভালোমতো দেখিসনি।
না।
সুমিত্রকে দেখে মনে হচ্ছে খুব আশাহত। অনাদি নিজের ফোকসালে চলে গেল এবং পিছনে এসে এ সময় কাপ্তান—বয় ডাকল, সুমিত্র, এই নাও তোমার বিকেল এবং রাতের খাবার। বাটলার দিয়েছে।
চাচা, বাটলার এত সদয় কেন আমার প্রতি?
তা আমাকে বললে কী হবে! বরং বাটলারকে জিজ্ঞেস কর। একটু থেমে বলল, তোমার শরীর এখন কেমন?
ভালো চাচা।
বেশি নড়বে না। এ—জ্বর কিন্তু খুব খারাপ। আবার হলে অনেক ভোগান্তি হবে। বলে চলে যাবার জন্য উদ্যোগ করতেই সুমিত্র কেমন যেন সংকোচের সঙ্গে ডাকল, চাচা।
কাপ্তান—বয় মুখ ফিরিয়ে বলল, কী!
আমার যে শরীরটা খারাপ করেছিল, চেরি জানে?
তা আমি কী করে জানব বাপু।
তোমাকে কীছু জিজ্ঞেস করেনি?
না। আমি কতক্ষণ থাকি ওর কাছে? কাপ্তান—বয় আর দাঁড়াল না। সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুমিত্র ফোকসালে ঢুকে ফের বাংকে শুয়ে পড়ল। শরীরটা বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে। গত রাতের ঘটনাগুলো ওকে এখনও যেন যন্ত্রণা দিচ্ছে। অথচ একবার চেরির কেবিনে যেতে পারলে সব দুর্ঘটনার যেন অবসান হত। তবু সে নিজের শরীরে কম্বল টেনে পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। নির্জনতায় ভুগে কেমন বিস্বাদ বিস্বাদ সব। অনাদি পাশের বাংকে শুয়ে বকবক করছে ছোট ট্যান্ডলের সঙ্গে। এইসব কথা এবং যৌন আলাপ শুনতে ভালো লাগছে না। ফোকসালের সর্বত্র একই জৈব ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মুসলমান বৃদ্ধ পুরুষসকল অযথা বদনা নিয়ে বারবার এই ঠান্ডা দিনেও গোসলখানায় ঢুকে স্নান করছে এবং আল্লা আল্লা করছে।
ফোকসালে ফোকসালে এখন অন্ধকার। এবং সন্ধ্যা অতিক্রম করছে বলে সকলে আলো জ্বলে দিল। কিন্তু সুমিত্রর এই আলো ভালো লাগছে না। আলোটা ওর চোখে লাগছে। সে আলোটা নিভিয়ে দিতে বলল। এবং এই অন্ধকার এখন ওকে গ্রাস করছে। রাত বাড়ছে। ফোকসালে ফোকসালে জাহাজিরা ভিড় করে আছে। ওরা এবার উপরে উঠবে। ওরা রাতের আহার শেষ করে আবার নিচে নেমে আসবে।
সুতরাং সুমিত্র দীর্ঘ সময় এই বাংকে একা আর পড়ে থাকতে পারছে না। রাত যত বাড়ছিল, ঘন হচ্ছিল, তত শরীরের দুর্বলতা যৌনক্ষুধাকে আবেগমথিত করছে। এবং যখন দেখল ফোকসালে ফোকসালে ডেক—জাহাজিরা ঘুমিয়ে পড়েছে, এনজিন অথবা ডেকসারেং—এর ঘরে আলো জ্বলছে না তখন ধীরে ধীরে সে সিঁড়ি ধরে চোরের মতো পা টিপে টিপে উপরে উঠতে থাকল।
ডেকে উঠতেই শীত শীত অনুভব করল সুমিত্র। অস্ট্রেলীয় উপকূলের যত নিকটবর্তী হচ্ছে তত শীতটা যেন বাড়ছে। তত সমুদ্র যেন শান্ত হয়ে আসছে। আজও সে ডেকে এসে দেখল কেউ কোথাও নেই। মাস্টের আলোগুলি ভূতের মতো রাতের আঁধারে দুলে দুলে ভয় দেখাচ্ছে। ব্রিজে ছোট মালোমও পায়চারি করছেন; ওঁর এখন ওয়াচ নিশ্চয়ই। সুমিত্র আড়াল থেকে দেখল সব এবং খুশি হল। ছোট মালোম কেবিনে থাকেন। সুতরাং চেরির কেবিনে কোনো শব্দ হলে পোর্টহোল দিয়ে উঁকি মারতে পারেন। সে উত্তেজনায় দাঁড়াতে পারছিল না, চুলোয় যাক ছোট মালোম—সে ছুটে এলওয়ে পথে ঢুকে গেল। এবং চেরির দরজার উপর ভর করে সতর্ক গলায় ডাকতে থাকল, মাদাম, মাদাম! আমি এসেছি দরজা খুলুন, যেন বলার ইচ্ছা, আমি যথার্থই কাপুরুষ নই। আপনাকে বেশ্যা বলে নিরন্তর আমি দগ্ধ। আমরা সকলেই উনুনের তাপ চুরি করে শরীর গরম করছি। আপনি দরজা খুলুন মাদাম।
চোরের মতো সুমিত্র কড়া নাড়তে থাকল। রাত বলে এনজিনের আওয়াজ প্রকট। সুতরাং এখন কেউ সুমিত্রর কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাবে না। কেউ এদিকে এলে এনজিন রুমে নেমে যাবার মতো ভান করে দাঁড়িয়ে থাকবে। বড় মালোমের ঘর পর্যন্ত খোলা নেই। সে আবার কড়া নাড়তে থাকল এবং এ—সময়েই দেখল ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। চেরির পায়ের শব্দ ভিতরে। চেরি দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। ভিতর থেকে প্রশ্ন এল, কে! কে?
আমি সুমিত্র, মাদাম। সে আর কীছু প্রকাশ করতে পারছে না। সে উত্তেজনায় অধীর। সে শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। সমস্ত গা পুড়ে যাচ্ছে। গলা ভয়ে শুকনো, কাঠ। সে কোনোরকমে গলা ঝেড়ে আবার ডেকে উঠল, মাদাম, আমি সুমিত্র।
দরজা খুললে চেরি দেখতে পেল সুমিত্র দরজায় দাঁড়িয়ে ঘামছে। এই শীত—শীত রাতেও এমত ঘাম সুমিত্রর মুখে শরীরে সর্বত্র। কেবিনের আলোয় মুখের বিন্দুসকল ঝলমল করছে। সুমিত্রর চোখের নিচে কালি পড়েছে; বিশেষ করে গত রাতের সেই যুবকটিকে যেন আর চেনাই যাচ্ছে না। চেরি এবার সুমিত্রের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এল। পাখা খুলে দিয়ে বলল, বোস। ইজিচেয়ারে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল চেরি। তারপর ধীরে সুস্থে বাংকে বসে বলল, এত রাতে!
সুমিত্র চেরির কণ্ঠে গত রাতের কোনো ইশারাকেই খুঁজে পেল না। একেবারে স্বাভাবিক।
মাদাম!
কিছু বলবে?
চেরি দেখল সুমিত্রর চোখ দুটো জ্বলছে। সমস্ত শরীর থেকে কামনার আবেগ গলে গলে পড়ছে। স্থিরভারে তাকাতে পারছে না—যেন অবসন্ন সৈনিক কুয়াশার অন্ধকার থেকে পথ খুঁজে খুঁজে অবিরাম হেঁটে হেঁটে কোনো আশ্রমে উপস্থিত। পানীয় জলের মতো যুবতীর চোখ মুখ শরীর তার তৃষ্ণা দূর করার জন্য যেন অপেক্ষা করছে। সে শুধু বলল, আপনি ফুল ভালোবাসেন মাদাম?
ভালোবাসি সুমিত্র।
পাখি?
পাখি ভালোবাসি।
আমার ফুল, পাখি কিছুই ভালো লাগছে না মাদাম।
কেন, কেন?
কী জানি। এই জাহাজ কেবল উচ্ছৃঙ্খল হতে বলছে।
সুমিত্র! খুব দূর থেকে যেন চেরির গলা ভেসে আসছে। গলা আবেগে কাঁপতে থাকল।
আমাকে কিছু বলবেন মাদাম?
তুমি উচ্ছৃঙ্খল হলে আমার যে কিছু থাকল না। নিজের সতীত্ব প্রমাণে চেরি যেন মরিয়া হয়ে উঠল।
না না। আপনি ভুল বুঝবেন না মাদাম। আমি যত্নের সঙ্গে সব পরিহার করে চলেছি মাদাম। অথবা বলতে পারেন, চলার চেষ্টা করছি।
সুমিত্র, কখনও যদি সময় অথবা সুযোগ পাই আমি ভারতবর্ষে যাবই।
ভয়ানক গরিবের দেশ। রাজপুত্রেরা এখন ফুটপাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে মাদাম।
চেরি নিজেও তার ইচ্ছার কথা যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। এক কৃত্রিম আদর্শ উভয়কে সংকুচিত করে রাখছে। অথবা এও বলা যেতে পারে, চেরির ব্যবহার কেবলই মাতৃসুলভ হয়ে উঠছে। সে সুমিত্রর কপালে হাত রেখে বলল, সারাটা দিন আমার কী যে গেছে!
সুমিত্র আর পারছে না। সুতরাং মাথাটা ইজিচেয়ারের উপর আরাম করার জন্যে স্থাপন করল। যেন ঘুমোচ্ছে সুমিত্র এবং দেখলে মনে হবে মৃত। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসাড়। সে যেন আর দাঁড়াতে পারছে না। সে হেঁটে যেতে পারছে না ফোকসালে—দেখলে এমনই মনে হবে সুমিত্রকে। দীর্ঘ সময় ধরে চেরিও চুপ করে শুয়ে থাকল বাংকে। এখন ওরা উভয়ে পরস্পর আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করার জন্যে প্রথম শহীদ কে হবে, কে প্রথম যৌন বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্যে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবে এমতই কোনো এক প্রতিযোগিতায় মত্ত। চেরি শুয়ে শুয়ে সুমিত্রর অবয়বে সেই রাজপুত্রের প্রতিবিম্ব দর্শনে আর স্থির থাকতে পারল না। সে যিশুর নাম স্মরণ করে ডাকল, এসো সুমিত্র।
চেরি আবার ডাকল, সুমিত্র এসো। নীল আলো জ্বলছে, দেখ।
সুমিত্র জবাব দিচ্ছে না। এমনকি ওর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়ল না। যেমন শিথিল শরীর নিয়ে পড়ে ছিল তেমনি পড়ে থাকল।
সুমিত্র, সুমিত্র। চেরি বাংকে থেকে নেমে সুমিত্রর ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে দেখল, সুমিত্র যথার্থই ঘুমিয়ে পড়েছে। যে আবেগ এবং যৌনেচ্ছা এতক্ষণ ধরে বাজিকরের মতো আবির্ভূত করে রেখেছিল, সুমিত্রর অসহায় মুখ দেখে সেই রঙ জলের মতো নির্মল হল। চেরি সন্তর্পণে কাছে গিয়ে কম্বলে পা শরীর ঢেকে দিয়ে কেবিনের নীল আলোর ছায়ায় ভারতবর্ষের রাজপুত্রের মুখ দেখতে দেখতে রাত ভোর করে দিল। বাইরে আলো ফুটে উঠছে। পোর্টহোলের কাচ খুলে দিতেই বাইরের ঠান্ডা হাওয়া এই কেবিনের সকল ঘটনাকে প্রীতিময় করে তুলছে। চেরি বাংক থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকে পোশাক পালটাল। শেষে কাপ্তান—বয়ের খোঁজে ডেকে বের হয়ে গেল। ডেক—ছাদের নিচে এসে দাঁড়াতেই দেখল দুটো নির্জন দ্বীপের পাশ দিয়ে জাহাজ যাচ্ছে। সবুজ এক প্রান্তর, এই ভোরের মিষ্টি আলো, এবং দিগন্তের ফাঁকে সূর্য উঠছে, শুধু রক্তিম আকাশ, কেবিনে সুমিত্র ঘুমোচ্ছে, চেরির বুক ঠেলে কেমন এক কান্নার চিহ্ন ঠোঁটে মুখে ফুটে উঠল। দূরের দ্বীপ থেকে মাটির গন্ধ ভেসে আসছে, সবুজের গন্ধ এই জাহাজের ফাঁকফোকরে যত অন্ধকার আছে সব নির্মল করে দিচ্ছে। দ্বীপের পাখি সকল জাহাজটাকে দেখে চক্রাকারে উড়তে থাকল। নীল রঙের পাখিরা ডাকল আর আকাশের চারধারে সাদা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এবং তার ফাঁকে ফাঁকে দ্বীপের সকল পাখিরা কোনো এক নিরুদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে। চেরি ভাবল, এই দ্বীপের কোনো গুহায় তার এবং সুমিত্রর জন্য একটু আশ্রয় কি মিলতে পারে না! একটু আশ্রয়ের জন্য মাটির কাছে তার প্রার্থনা, ঈশ্বর আমার কী হবে!
কাপ্তান—বয় এসে ডাকল, মাদাম।
কফি। দু’কাপ।
ধীরে ধীরে জাহাজটা দ্বীপ দুটোকে পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। সূর্যের আলো দ্বীপের সব অপরিচিত গাছের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রে এসে পড়েছে। জনহীন এইসব ছোট ছোট দ্বীপ কতকাল থেকে এমন নিঃসঙ্গ কাটাচ্ছে কে জানে। দ্বীপের ঝোপ জঙ্গলের পাশে সুমিত্র এবং তার জন্য যদি কোনো তপোবন থাকত, যদি একফালি রোদ সেই কুটির—সংলগ্ন উঠোনে এসে পড়ত এবং সারাদিন পর সমুদ্র থেকে ঘরে ফিরে এসে সুমিত্র ওকে জড়িয়ে যদি জীবনের স্বাদ গ্রহণ করত, কত রঙিন স্বপ্ন দেখল চেরি, কত আকাঙ্ক্ষার কথা, বিচিত্র সব শখ সারাদিন ধরে ডেক পাটাতনে ভেবে ভেবে কখনও অন্যমনস্ক, কখনও বেদনায় বাংকে শুয়ে শুয়ে স্মৃতিকে ধরে রাখোর স্পৃহাতে এক নির্দিষ্ট যুবকের পায়ের শব্দ শুনতে চায়।
তখন সুমিত্র চোখ খুলে দেখল এই কেবিন। গভীর ঘুমের আচ্ছন্ন ভাবটুকুর জন্য বুঝতে পারল না কোথায় এবং কীভাবে, সে দেখল এই কেবিন ওর পরিচিত। তারপর একে একে বিগত রাতের ঘটনার কথা স্মরণ করে সে ফের আতঙ্কিত হল। দিনের আলো পোর্টহোল দিয়ে কেবিনে গলে গলে পড়ছে। চেরি ঘরে নেই। সুতরাং মনে নানা অগোছালো চিন্তা জট পাকাচ্ছে। অথবা রাত হলেই তার কী যে হয়। নিজের এই অপরিণামদর্শিতার জন্য সে দুঃখিত হল। তারপর চেয়ার থেকে সন্তর্পণে উঠে ডেকে এসে দেখল, চেরি দূরের দ্বীপসকল দেখছে। চেরি খুব ঝুঁকে আছে রেলিংয়ে। সে তাড়াতাড়ি নিজের কেবিনে ঢুকে বিছানায় হাত—পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
কাপ্তান—বয় এসে ডাকল, মাদাম।
এই যে!
আপনার কফি দেওয়া রয়েছে।
দু’কাপের মতো?
হ্যাঁ মাদাম।
চেরি তাড়াতাড়ি কেবিনে ঢুকবে ভাবল, সুমিত্রকে হাতমুখ ধুতে বলবে বাথরুমে। তারপর একসঙ্গে কফি খেতে খেতে দ্বীপের গল্প, ওর দেশ বাড়ি এবং অন্য অনেক সব খবর নিতে হবে—কিন্তু ভিতরে ঢুকেই দেখল, কেবিন ফাঁকা। সুমিত্র নেই। তারপর সে দেখল পোর্টহোলের কাচ খোলা। সে এবার কফির সবটুকু বেসিনে ঢেলে দিল। একটু এগিয়ে গিয়ে কাচ এবং লোহার প্লেট দিয়ে পোর্টহোল বন্ধ করে দিল। যেন সুমিত্রর কোনো প্রতিবিম্ব ভাসবে না এবং লজ্জায় আর অধোবদনও হতে হবে না। নিজের এই দুর্বলতাকে পরিহার করার জন্য সে আজ ভালোভাবে স্নান করল। সুমিত্রকে এড়িয়ে চলার জন্য নানা রকমের পত্রপত্রিকা খুলে বসল বাংকে। মনের বিক্ষিপ্ত ইচ্ছাগুলিকে সংযত করতে গিয়ে বারবার সে হোঁচট খাচ্ছে। কোথায় যেন এক বিশাল পাথরের বোঝা হয়ে ভারতীয় জাহাজিটা মনের উপর চেপে বসে আছে। চেরি আর পারছে না। চেরি নিজেকে রক্ষার জন্য দরজা খুলে তাড়াতাড়ি কাপ্তানের কেবিনে ছুটে গেল। বলল, আপনার এই বারান্দায় একটু বিশ্রাম নিতে চাইছি।
যতক্ষণ খুশি।
একটি ইজিচেয়ারে বসে সমুদ্র দেখতে থাকল চেরি। এখানে সুমিত্র নেই, শুধু সমুদ্র শুধু ঢেউ। কিছু পারপয়েজ মাছ। কিছু ঢেউ মেঘ হয়ে আছে আকাশে। সমুদ্রের ওপাশ দিয়ে একটা জাহাজের মাস্তুলে নিশান উড়তে দেখছে। কাপ্তান নিচে আছেন। তিনি দূরবিন চোখে রেখে জাহাজটাকে দেখলেন। চেরি উঠে দাঁড়ালে কাপ্তান ওর হাতে দূরবিন দিয়ে বললেন, দেখুন দূরে একটা তিমি মাছ দেখতে পাবেন। চেরি কিন্তু দূরবিন চোখে রেখে সুমিত্রর দিকে চেয়ে থাকল। পিছনের রেলিংয়ে সুমিত্র ঝুঁকে আছে—সে বোধহয় প্রপেলারের শব্দ কান পেতে শুনছে। চেরি দূরবিনটা কাপ্তানের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ইজিচেয়ারটা ইচ্ছা করে দূরে সরিয়ে নিল। সুমিত্রকে আর দেখা যাচ্ছে না এবং সে খুশি হওয়ার ভান করে কাপ্তেনকে পরবর্তী বন্দর সম্বন্ধে প্রশ্ন করল, আশা করছি দু’দিন বাদেই আমরা সিডনি পৌঁছাব।
আপনার সমুদ্রযাত্রা ভালো লাগছে না বোধহয়?
চেরি কথা বলল না।
ভালো লাগবে কী করে! যাত্রীজাহাজে যেতে পারলে আপনার এতটা অসুবিধা হত না।
চেরি বলল, কাল বিকেলটা বেশ লাগল।
তা বটে।
আপনাদের কথা আমার মনে থাকবে ক্যাপ্টেন।
আপনার কথাও আমাদের মনে থাকবে। কাল আপনার ভায়লিনের সুর অপূর্ব লাগছিল।
ক্যাপ্টেন, এবার কিন্তু কথাটা একটু খোশামোদের মতো মনে হল।
না মাদাম, আপনি বিশ্বাস করুন। সকলেই আপনার প্রশংসা করছে। সুমিত্র ভারতীয়, সে পর্যন্ত বলল, মাস্টার, এ সফরের কথা আমরা সকলেই মনে রাখতে বাধ্য হব। তারপর সে আপনার কথায় এল।
চেরির বলতে ইচ্ছা হল, আর কিছু বলেছে, আর কিছু? কিন্তু সম্মানিত জীবনের কথা ভেবে সে ওই প্রগাঢ় ইচ্ছাকে জোর করে থামিয়ে দিল।
কাপ্তান চেরির নিকট থেকে উৎসাহ না পেয়ে চার্ট—রুমে ঢুকে গেল এবং নিজের কাজ করতে থাকল।
চেরি ব্রিজে পায়চারি করছে। একবার উইংসের পাশে ঝুঁকে অথবা কখনও কম্পাসটার সামনে এসে (যেখানে কোয়ার্টার—মাস্টার স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে) নিজেকে বারবার আড়াল করার চেষ্টা করল। সুমিত্রকে আর দেখাই যাচ্ছে না। সুমিত্র পিছিলে কোথাও নেই। সে অ্যাকোমোডেশন ল্যাডার ধরে নেমে বোট—ডেক পার হয়ে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সুমিত্র এখন এনজিন—রুমে। সে হাতঘড়িতে সময় দেখে এমত ধারণা করল। এবং কেন জানি অপার বিষণ্ণতা চেরিকে গ্রাস করছে। এবার দু’হাত ছুড়ে চেরির যেন বলবার ইচ্ছা—কে আছ তোমরা এসো, সুমিত্র নামে এক ভারতীয় যুবক আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমাকে রক্ষা করো!
সুতরাং বিকেলে জোর করে নিজেকে কেবিনে আবদ্ধ করে রাখল। সুমিত্র যে ক’বার এনজিন—রুম থেকে উঠেছে নেমেছে, প্রত্যেকবার চেরির দরজা, পোর্টহোল বন্ধ দেখেছে। বিকেলবেলাতে সুমিত্র কাপ্তান—বয়কে প্রশ্ন করল, চাচা, রাজকন্যার দরজা—জানালা যে সব বন্ধ!
কী জানি, মেয়েমানুষের মর্জি বোঝা দায়। আমাকে বলল, ঘুমালে ডেকো না। বারোটার সময় দরজার কড়া নাড়লাম, খাবার দিতে হবে…. কোনো সাড়াশব্দ না। কাপ্তানকে বললাম—তিনি বললেন, বোধহয় ঘুমোচ্ছে, সুতরাং বাটলারকে বলে দাও যেন খাবারটা গরম রাখার ব্যবস্থা রাখে। ও আল্লা, নিচে নামতেই দেখি হৈ—হল্লা বাধিয়ে দিয়েছে।
সুমিত্র বলল, কাপ্তান আচ্ছা রাজকন্যার পাল্লায় পড়েছে!
তা হবে। কিন্তু কাল রাতে তোমার কথাই বারবার বলছিল।
কেন? কেন?
না, থাক। ওসব আমার বলা বারণ আছে, বলে কাপ্তান—বয় টুইন—ডেকে নেমে গেল।
এবং এ সময় সুমিত্র দেখল চেরি সান্ধ্য—পোশাকে টুইন—ডেক অতিক্রম করে এদিকেই আসছে।
সুমিত্র অন্যান্য সকল জাহাজিদের সঙ্গে কথা বলছে—চেরিকে দেখছে না এমত ভাব ওর চোখে—মুখে। চেরি আফট—পার্টে চলে আসছে। সুমিত্রর গলা শুকনো শুকনো ঠেকছে। চেরি আফট—পার্টে উঠে সুমিত্রকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সুমিত্রর দিকে তাকাল না, অথবা কথা বলল না। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে জাহাজ—ডেকে। সুতরাং সকলে সরে দাঁড়াল। চেরি স্টারবোর্ড সাইডের ডেক ধরে এক নম্বর, দু’ নম্বর ফল্কা পার হয়ে ফের অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুমিত্র পাশের জাহাজিকে বলল, চেরিকে খুব শুকনো লাগছে, না চাচা?
জাহাজে চড়লে প্রথম সকলেরই একটু শরীর খারাপ হয়। সুখী ঘরের মেয়ে। তা, একটু শুকনো লাগবে।
সুমিত্র এইসব কথা শুনল না। সে পিছিল থেকে নড়ছে না। সে চেরিকে ফরোয়ার্ড—ডেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল। চেরির মুখ শুকনো, সেই হেতু একটা কষ্ট—কষ্ট ভাব সুমিত্রর মনে। চেরি চুপচাপ চলে যাচ্ছে—গেল। সুমিত্র স্থাণুবৎ। এই প্রথম একজন পরিচিত যুবতীর জন্য মনে মনে দুঃখ বোধ করছে এবং যতবার অস্বীকারের ইচ্ছায় দৃঢ় হয়েছে ততবার এক দুর্নিবার মোহ সুমিত্রকে উত্তেজিত করে একসময় নিদারুণ প্রেমে ঘনিষ্ঠ করতে চেয়েছে।
সুমিত্র অনেকক্ষণ স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থেকে সহসা দেখল ডেক এবং অন্যত্র সকল স্থান আলো আলোময় করে জাহাজ গতিশীল। সে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে ডেক ধরে নেমে গেল। সে হাঁটতে থাকল উদ্দেশ্যহীনভাবে। অথচ একসময় সে নিজেকে দেখল চেরির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চেরির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মনে হচ্ছে ভিতরে কোনো আলো জ্বলছে না। চেরি অন্ধকারে শুয়ে আছে চুপচাপ। সে ধীরে ধীরে কড়া নাড়ল।
ক্লান্ত গলায় ভিতর থেকে প্রশ্ন করল চেরি, কে?
আমি, সুমিত্র।
সুমিত্র ভিতরের শব্দে বুঝল চেরি খুব দ্রুত কাজসকল সম্পন্ন করছে। আলো জ্বালাচ্ছে, প্রসাধন করছে। সবকিছুতেই ত্রস্তভাব। সুমিত্র এ—সময় এতটুকু ভীত হল না।
চেরি দরজা খুলল। চোখে ভয়ানক ক্লান্তি, তবু সুমিত্রর হাত ধরে এনে ভিতরে বসাল।
আপনাকে আজ খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে। কাল রাতে বুঝি এতটুকু ঘুমোননি?
সুমিত্র, আমি তোমাকে মিথ্যা বলব না। কাল আমি ঘুমোতে পারিনি।
আমি দেখছি মেজ—মালোমের কাছে ওষুধ পাওয়া যায় কী না।
না সুমিত্র, তুমি বোস। ঘুমোতে পারছি না বলে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
কিন্তু আপনার চোখের কোল যে ফুলে উঠেছে!
সব সেরে যাবে। তুমি বোস। একটু কফি খাও। চেরি দরজায় গলা বের করে কাপ্তান—বয়কে ডাকল।
কফি খেতে খেতে চেরি প্রশ্ন করল, তোমার কে কে আছে সুমিত্র?
কেউ নেই।
কেউ নেই?
না।
মা?
না।
বাবা?
না।
আত্মীয়স্বজন?
সুমিত্র এবারেও ঠোঁট ওলটাল।
কী করে এমন হল?
সব দাঙ্গাতে মারা গেছে। আমার বাড়ি পূর্ববঙ্গে ছিল।
ঈশ্বর! চেরি আর কিছু প্রকাশ করতে পারল না। অনেকক্ষণ নির্জনে বসে থাকার মতো চুপচাপ বসে থাকল। দীর্ঘ সময় ওরা হতবাক হয়ে থাকল।
সুমিত্রই কথা বলল, আমি না ডাকতেই এসেছি বলে রাগ করেননি তো?
সুমিত্র, আমি খুব খুশি হয়েছি খুব।
আপনার শুকনো মুখ দেখে আমার আজ কেন জানি বারবারই মনে হল, এই জাহাজে আপনি আমার মতোই একা। আমার মতো আপনারও কেউ নেই। এবং সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত ধরনের কষ্টে পীড়িত হতে থাকলাম। শেষে বিশ্বাস করুন, কে যেন জোর করে আপনার দরজায় আমাকে এনে হাজির করল।
এইসব কথায় চেরি আবেগে প্রগাঢ় হল। সমস্ত শরীরে এক অদৃশ্য কম্পন। সে তার সকল দৃঢ়তা, সকল প্রত্যয়, সকল সম্মানিত জীবনের আলো গান পরিত্যাগ করে সুমিত্রর দু’হাত চেপে ধরল। কিন্তু আবেগের প্রগাঢ়তায় কিছুই প্রকাশ করতে পারল না। বলতে পারল না, মাই প্রিন্স! আমার আশৈশবের রাজপুত্র! সে মাথা নত করে সুমিত্রর মুখোমুখি বসে থাকল। মনে কোনো আলো জাগল না। নিমজ্জমান তরীর মতো জীবনের এক প্রবল মাধ্যাকর্ষণে ক্রমশ গভীর সমুদ্রে ওরা মিলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে। এবং একসময় সুমিত্র যখন চোখ তুলল চেরিকে দেখবার জন্যে, তখন চেরি অবাক হতে হতে দেখল, সেই চোখ, সেই বিষণ্ণ চঞ্চল চোখ কাচের জানালায় প্রতিবিম্ব হয়ে ভাসছে। কত ইচ্ছাই না চেরিকে এ সময় বিব্রত করেছে, কিন্তু কোনো ইচ্ছার সফলতাকেই অমৃতময় বলে মনে হল না, সুতরাং চেরি সুমিত্রর প্রিয়মুখ দর্শনে শুধু বিহ্বল হতে থাকল।
রাত্রির বিষণ্ণ আলোতে চেরিকে সুখী করার জন্যে সুমিত্র বলল, তোমাকে যদি রাজা—রানির গল্প বলি, তুমি খুশি হবে?
চেরি শুধু চেয়ে থাকল ফ্যাল ফ্যাল করে।
পরদিন ভোরে সুমিত্র টুপাতির কেবিনে ঢুকে বলল, তোমার সময় হবে?
চেরি বলল, আমার হবে, তোমার হবে কী না বল?
আমার আজ থেকে কোনো ওয়াচ থাকবে না।
কেন?
কাপ্তান সারেংকে বলে পাঠিয়েছে, আজ এবং কালকের জন্যে অন্য কাউকে দিয়ে ওয়াচ চালিয়ে দিতে। সুমিত্র আজ বেশ আরাম করে দুটো পা বাংকের উপর তুলে দিয়ে বসল, তারপর ঠাকুমার মুখে শোনা চম্পা এবং আর দুই সখীর গল্প করে চেরিকে আনন্দ দিল। গল্পটা বলতে বেশি সময় নিল না সুমিত্র। বারোটার পর সাহেবদের লাঞ্চ। চেরি খাবে তখন। সুমিত্র এগারোটা বাজতেই উঠে গেল।
বিকেলে বোট—ডেকে গল্প করতে এসে সুমিত্র দেখল চেরি বসে বসে সমুদ্র দেখছে। সে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর কী ভেবে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই ব্রিজে কাপ্তানের গলা পেল।
সুমিত্র, গুড আফটারনুন।
গুড আফটারনুন, মাস্টার।
কাল আমরা বন্দর পাব।
কখন স্যার?
সন্ধ্যায়।
চেরি এখনও চোখ তুলছে না, অথবা ওদের দেখছে না।
কাপ্তান বলল, বেশ সমুদ্রযাত্রা আমাদের। কোনো ঝড় নেই, সমুদ্র একেবারে শান্ত।
মাস্টার, আকাশ খুব পরিষ্কার।
সারা রাতই ডেকে জ্যোৎস্না। মাদাম কী বলেন? চেরিকে উদ্দেশ্য করে কাপ্তান ব্রিজ থেকে কথা বলতে চাইল।
চেরি মুখ না তুলে এক ধরনের সম্মতিসূচক শব্দ করল।
সুমিত্র চলে যাচ্ছিল, চেরি ডেকে বলল, সুমিত্র, কাল আমরা বন্দর পাব।
আশা করছি।
বন্দরে আমার এক আত্মীয়া এবং এক বন্ধু আসবেন রিসিভ করতে, তুমি তাদের সঙ্গে পরিচয় করবে না?
নিশ্চয় করব। কী রকম আত্মীয় হন তাঁরা?
একজন পিসিমা। অন্যজন পিসেমশায়ের দাদার ছেলে। একটা মোটর কোম্পানির পরিচালক।
এইসব কথার ভিতর কেবলই তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। বলো তো আর একটা গল্প শোনাই। খুব আনন্দ পাবে।
না, আর রূপকথা নয়। এবার জীবনের কথা বল। আমি জাহাজ থেকে নেমে গেলে তোমার কষ্ট হবে না?
হবে, খুব কষ্ট হবে।
তোমাকে অযথা মন্দ কথা বলেছি।
এ—কথা এখন আর ভালো শোনাচ্ছে না।
হয়তো আর দেখাই হবে না কোনোদিন। অথচ…
দেখা হবে না কেন? জাহাজে যখন কাজ করছি, তখন নিশ্চয়ই দেখা হবে।
সুমিত্র, তুমি তো জিজ্ঞাসা করলে না তোমার জন্য আমার কষ্ট হবে কি না?
তোমারও হবে। সুমিত্র পাশেই বসে পড়ল। বলল, বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।
এই কথা শুনে চেরি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিল। অথচ সুমিত্রকে দেখে মনে হল না, সে চেরির বিদায়বেলাতে কোনো দুঃখবোধে পীড়িত হবে। চেরি বলল, আমার কেবিনে এসো। বলে, সে হাঁটতে থাকল।
একটু বসো না, এই সমুদ্র তোমার ভালো লাগছে না?
এখনই সন্ধ্যা হবে। চল, কেবিনে নীল আলো জ্বেলে তোমার গল্প শুনব।
একটা অনুরোধ করলে রাখবে?
বলো। যা বলবে আমি সব করব।
আমাকে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাবে?
শোনাব। কেবিনে চলো।
কেবিনে নয় চেরি। এই বোট—ডেকে। খোলা আকাশের নিচে বসে।
তাই হবে।
এখন রাত নামছে সমুদ্রে। ফরোয়ার্ড পিকে পাহারা দিতে দুজন জাহাজি চলে গেল। ব্রিজে পায়চারি করছেন মেজ—মালোম। ওরা লাইফ—বোটের আড়ালে বসে আকাশ দেখল, নক্ষত্র দেখল। পরস্পর গল্প করতে করতে একসময় ঘনিষ্ঠ হল এবং পরস্পর হাতে হাত রেখে সমুদ্রের গর্জন শুনল যেন যথার্থই কোনো রাজপুত্র কোটালপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে… ছুটছে। চেরি এ সময় গর্ভিণী তিমির মতো উদগ্র আবেগে ছটফট করতে লাগল।
চেরি ভায়োলিন বাজাতে বাজাতে বলল, কেমন লাগছে সুমিত্র?
শীতের নদীতে কাশফুলের রেণু উড়ছে। প্রজাপতি উড়ছে যেন এবং শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে নতুন বউ। কলের গান বাজছে নৌকার পাটাতনে। দুটো ফুটফুটে ছেলেমেয়ে সাদা ফ্রক গায়ে তখন চরের কাশবনে প্রজাপতি খুঁজে বেড়াচ্ছে—টুপাতি চেরির বেহালার বাজনা সুমিত্রর মনে সে রাতে এমন একটা ভাব সৃষ্টি করেছিল।
তারপর অধিক রাতে যখন পরস্পর বিদায় জানিয়েছিল কেবিনে, চেরি সুমিত্রর চোখ দুটোতে চুমু খেল, যে চোখ দুটো দীর্ঘকাল ধরে চেরিকে অনুসরণ করে ফিরছে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জাহাজিরা কিনারা দেখার চেষ্টা করল। আকাশের কিনারায় কোনো দ্বীপ অথবা মাটির রেখা ভেসে উঠছে কি না দেখল। ওরা খবর পেয়েছে, জাহাজ বিকালে নোঙর ফেলবে। এবং রাতে পাইলট—জাহাজ এসে বন্দরে জাহাজ টেনে নেবে। সুতরাং জাহাজিরা মন দিয়ে কাজ করল, ডেকে ফল্কায়, অথবা ড্যারিকে। ফানেলে কেউ রঙ করল। চেরি একবার ডেকে বের হয়ে সকল কিছু দেখে কেবিনে ঢুকে গেছে। এবং সুমিত্র এই ভোরেও বাংকে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কাপ্তান—বয় এল এসময়। ফোকসালে ঢুকে ডাকতে থাকল সুমিত্রকে।
সুমিত্র একটা বড় রকমের হাই তুলে বলল, তারপর চাচা, নতুন কিছু খবর আছে?
কাপ্তান যে আবার ডেকে পাঠিয়েছেন।
সুমিত্র ব্রিজে গেলে কাপ্তান বললেন, বিকালে পাইলট ধরবে জাহাজ। সুতরাং তখন থেকে তুমি আর চেরির কেবিনে যাবে না। পাইলট—জাহাজে ওর আত্মীয়স্বজন আসার কথা আছে।
কিন্তু স্যার…।
আমি সব বুঝি সুমিত্র। মনে রেখো, তুমি জাহাজি। কত বন্দরে কত ঘটনা থাকবে। তোমাকে যে একটু দৃঢ় হতে হবে।
সুমিত্র ব্রিজের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল—আকাশ তেমনি পরিষ্কার। জাহাজিরা সকলেই বন্দরের জন্য উদগ্রীব। যত বন্দরের দিকে এগোচ্ছে জাহাজ, তত জাহাজিরা উৎফুল্ল হচ্ছে, সুমিত্রর মনে একটা দুঃসহ কালো মেঘের অন্ধকার নেমে আসতে থাকল। সে ধীরে ধীরে ব্রিজ থেকে নেমে এল। চেরির কেবিন অতিক্রম করার সময় ইচ্ছা করেই আজ আর পোর্টহোলে চোখ তুলে কাউকে খুঁজল না। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ক্লান্ত বোধ করল। ফোকসালে ঢুকে নিজের বাংকে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।
বুড়ো কাপ্তান—বয় এসে সুমিত্রর পাশে বসল।
কিছু খবর আছে চাচা?
না। আমি বুঝি কেবল তোমার দুঃসংবাদই বয়ে আনছি?
তেমন কথা কি আমি বলেছি?
কী জানি বাপু, কেবল খবর আর খবর!
চেরি কী করছে চাচা?
সারাদিন বাইবেল পড়ছে।
আমার কথা কিছু বলছিল?
না।
সুমিত্র পাশ ফিরে শুলো। কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছা নেই। কেবল পড়ে পড়ে ঘুমোতে ইচ্ছা হচ্ছে। বন্দরে জাহাজ নোঙর করলে কোনো পাব—এ ঢুকে মদ খাওয়ার শখ হচ্ছে।
বিকেলে সুমিত্র উপরে উঠে গেল। অ্যাফটার—পিকে ভর করে দাঁড়াল। দূর সমুদ্রে পাইলট—জাহাজটা যেন উড়ে চলে আসছে। এ—সময় চেরিকে দেখার প্রত্যাশা করল সুমিত্র। চেরি ওর আত্মীয়ের জন্য গাঙওয়েতে অপেক্ষা করবে। অথচ চেরি নেই। চেরি এখনও কেবিনে পড়ে আছে। সুমিত্র দেখল পাইলট—জাহাজ থেকে ওর আত্মীয়া—পিসি এবং সেই যুবক উঠে আসছে। হাতে বড় বড় দুটো গোলাপের কুঁড়ি। পাইলট সকলের শেষে উঠে এল। কাপ্তান ওদের সকলকে সঙ্গে করে অ্যালওয়েতে ঢুকে গেলেন। সুমিত্র এইসব দেখে কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।
সুমিত্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপ্তান—বয় এবং মেসরুম মেটের সব কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। পাশাপাশি অন্যান্য জাহাজিরাও এসে ভিড় করেছে। জাহাজিরা সুমিত্রকে কোনো প্রশ্ন করছে না। এইসব ঘটনা ওদের সকলকেই অল্পবিস্তর দুঃখ দিচ্ছে। তখন ওরা সকলেই দেখল চেরি এবং ওরা দুজন, কাপ্তান, বড় মিস্ত্রি, পাইলট—ডেক ধরে হাঁটছে। সুমিত্র তাড়াতাড়ি জাহাজিদের ভিতর নিজেকে আড়াল করে ফেলল। সে চেরিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, চেরি সমুদ্রযাত্রায় যেন ভয়ানক দুর্বল। এখন ওরা পরস্পর বিদায়—সম্ভাষণ জানাচ্ছে। ওরা নেমে গেল। সুমিত্র চেরিকে দেখতে পাচ্ছে না এখন। সে ফের নিচে নেমে বাংকে শুয়ে পড়ল।
চেরি চোখ তুলে এই জাহাজের ডেকে কিছু অন্বেষণ করতে গিয়ে গলায় এক দুঃসহ আবেগের কান্না অনুভব করল—কোথাও কোনো অমৃতের চিহ্ন নেই। চোখ দুটো সজল হতে হতে এক রুদ্ধ আবেগে চেরি ভেঙে পড়ল। এই ঘটনায় প্রিয়জনেরা উদ্বিগ্ন; ভাবল, শারীরিক কুশলে নেই চেরি; ভাবল, দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর প্রিয়জন দর্শনে কোনো পরিচিত আবেগের জন্ম হচ্ছে শরীরে। কাপ্তান নিজেও এই বিচ্ছেদটুকু লালন করতে পারলেন না। তিনি ইচ্ছা করে পাইলটের সঙ্গে জাহাজ—সংক্রান্ত কথাবার্তা আরম্ভ করলেন। কাপ্তান—বয় যখন বখশিশ নিয়ে উঠে আসছিল, চেরি সন্তর্পণে তাকে কাছে ডাকল। একটি চিরকুট দিল, গোলাপের কুঁড়ি দুটো দিল, অথচ কোনো নির্দেশ দিল না, তারপর চেরি পাইলট—জাহাজের পাটাতনে নেমে ইজিচেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে মুহ্যমান। কিছুই এখন সে দেখতে পাচ্ছে না যে, যেন এক রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ছুটে ছুটে সমুদ্র অতিক্রম করছে এবং হিমালয়ের পাদদেশে গিয়ে আর পথ খুঁজে পাচ্ছে না, তাই ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দিয়ে চেরির দিকে অনিমেষ নয়নে চেয়ে আছে।
কাপ্তান—বয় ফোকসালে ঢুকে বলল, এই নাও তোমার বকশিশ। বলে, গোলাপের কুঁড়ি দুটো এবং চিরকুটটি পাশে রাখল।
সুমিত্র বলল, পাইলট—জাহাজটা কত দূরে গেছে?
অনেক দূর।
সুমিত্র এবার চিরকুটটি পড়ল।
যখন আমি বুড়ো হব সুমিত্র, যখন নাতি—নাতনিদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে রূপকথার গল্প করব, তখন বলব ভারতবর্ষের এই রূপকথার রাজপুত্র সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে কাকাতিয়া দ্বীপের রাজকন্যাকে খুঁজতে বের হয়েছিল। বলব, ঘোড়ায় চড়ে নয়, রথে চড়ে নয়, জাহাজে চড়ে। বলব, কাকাতিয়া দ্বীপের রাজকন্যাকে খুঁজে বের করেছিল, ভালোবেসেছিল, সোনার কাঠি রুপোর কাঠি নিয়ে হাত বদলেছিল, কিন্তু রুপোর কাঠি ইচ্ছা করেই শিয়রে রাখার চেষ্টা করেনি।
শেষে তার কোনো এক প্রিয় কবির দুটো লাইন লিখেছে,
–Better by far you should forget and smile
Than that you should remember and be sad.
সুমিত্র উপরে উঠে রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়াল। দূরে পাইলট—শিপ অস্পষ্ট। ক্রমশ তীরের দিকে চলে যাচ্ছে। মনে মনে সেই লাইন দুটো আবৃত্তি করতে গিয়ে বুঝল, পৃথিবী অমৃতময়। চেরি অমৃতময়। দুঃখ এবং বেদনার কিছুই নেই। পিছনে এ সময় কার হাতের স্পর্শে সে ঘুরে দেখল কাপ্তান ওর পিঠে হাত রেখেছেন, বলছেন, আমার কেবিনে এসো সুমিত্র। আজ আমি তোমাকে খ্রিস্টের গল্প শোনাব।