Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ধীরেন ঘোষের বিবাহ || Sharadindu Bandyopadhyay

ধীরেন ঘোষের বিবাহ || Sharadindu Bandyopadhyay

শ্ৰীযুক্ত ধীরেন ঘোষের বয়স তিপ্পান্ন বছর। তিনি অতি সঙ্গোপনে ট্রেনে চড়িয়া কাশী যাইতেছেন। উদ্দেশ্য, দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করা।

ধীরেনবাবু অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী। তাঁহার প্রথম পক্ষ হইতে কয়েকটি কন্যা আছে; সকলেই বিবাহিতা ও সন্তানবতী। গত বছর ধীরেনবাবুর স্ত্রী মারা গিয়াছেন। অতঃপর এ বছর তিনি আবার বিবাহ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছেন। বয়স পঞ্চাশোধে হইলেও তাঁহার শরীর এখনও বেশ মজবুত আছে। কিন্তু এই সহজ কথাটা কেহ বুঝিতে চায় না।

তিনি বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করিলেই চারিদিকে একটা মস্ত গণ্ডগোল বাধিয়া যাইবে; মেয়েরা কান্নাকাটি করিবে; জামাতা বাবাজীরা মুখ ভার করিবেন; পাড়ার ছোঁড়ারা বাগড়া দিবার চেষ্টা করিবে। তাই ধীরেনবাবু গোপনে গোপনে নিজের বিবাহ স্থির করিয়াছেন এবং একটিও বরযাত্রী না লইয়া চুপি চুপি কাশী যাইতেছেন। কাশীতে পাত্রী ঠিক হইয়াছে। একেবারে বিবাহ করিয়া বৌ। লইয়া বাড়ি ফিরিবেন। তখন যে যত পারে চেঁচামেচি করুক, কিছু আসে যায় না।

রাত্রির অন্ধকারে হু হু শব্দে ট্রেন ছুটিয়াছে। ধীরেনবাবুর কামরায় দুটি মাত্র বাঙ্ক; একটিতে তিনি শুইয়া, অন্যটি খালি। ধীরেনবাবু কল্পনাপ্রবণ লোক নয়; অতীত বিবাহিত জীবনের স্মৃতি কিংবা আগামী বিবাহিত জীবনের স্বপ্ন তাঁহার চিত্তকে আন্দোলিত করিতেছে না। তিনি মাঝে মাঝে ঝিমাইতেছেন, আবার জাগিয়া উঠিতেছেন। মন সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ।

গভীর রাত্রে ট্রেন একটি স্টেশনে থামিল। কামরার বাহিরে কয়েকজন লোকের গলার আওয়াজ শুনিয়া ধীরেনবাবু ঘাড় তুলিয়া দেখিলেন।

এই যে গাড়িতে একটা বাঙ্ক খালি আছে—তুমি উঠে পড়—…আর তোমরা?.আমরা অন্য। গাড়ি খুঁজে নিচ্ছি…উলু উলু উলু—

একটি নব যুবক গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল এবং শূন্য বাঙ্কটার উপর বিছানা পাতিতে প্রবৃত্ত হইল। ট্রেন ছাড়িয়া দিল।

ধীরেনবাবু মিটি মিটি চক্ষে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। ছোকরা নিশ্চয় বিবাহ করিতে যাইতেছে। কোঁচানো ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, বয়স আন্দাজ বাইশ-তেইশ। চেহারা মন্দ নয়।

বিছানা পাতা শেষ হইলে যুবক বিছানায় বসিয়া তরিবত করিয়া একটি সিগারেট ধরাইল।

নিরুৎসুক চক্ষে তাহাকে দেখিতে দেখিতে ধীরেনবাবুর মনে হইল যুবককে তিনি পূর্বে কোথাও দেখিয়াছেন। সম্প্রতি নয়, অনেক দিন আগে। কবে কোথায় দেখিয়াছেন মনে করিতে পারিলেন না। কিন্তু তাহার বসিবার ভঙ্গি অঙ্গ-সঞ্চালন-সবই যেন চেনা চেনা।

ধীরেনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, কদূর যাওয়া হচ্ছে? যুবক চমকিয়া তাকাইল। এতক্ষণ সে ধীরেনবাবুকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করে নাই; এখন দেখিল একটা চিমসে গোছের বুড়ো শুইয়া আছে। সে তাচ্ছিল্যভরে বলিল, গয়া।

বিয়ে করতে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

ধীরেনবাবু পাশ ফিরিয়া শুইলেন এবং ঘুমাইবার চেষ্টা করিলেন। ঘুম কিন্তু সহসা আসিল না, কে এই ছোকরা? কোথায় তাহাকে দেখিয়াছেন?—আর একটা অদ্ভুত যোগাযোগ—আজ হইতে ত্রিশ বছর পূর্বে ধীরেনবাবুও গয়ায় বিবাহ করিতে গিয়াছিলেন—এমনি রাত্রির ট্রেনে চড়িয়া। তাহার প্রথম শ্বশুরবাড়ি ছিল গয়ায়।

আশ্চর্য।

নানা অসংলগ্ন কথা চিন্তা করিতে করিতে ধীরেনবাবু শেষে তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িলেন। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি খচখচ্‌ করিতে লাগিল।

প্রত্যুষে ধীরেনবাবুর ঘুম ভাঙিল। তিনি ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেন, যুবক নিজের বাঙ্কে নিদ্রা যাইতেছে। তিনি উঠিয়া বসিয়া একদৃষ্টে যুবকের পানে চাহিয়া রহিলেন।

তাঁহার বুকের ভিতরটা আনচান করিতে লাগিল। চিনি চিনি করিয়াও কেন চিনিতে পারিতেছেন? স্মৃতিশক্তি ভাল; এমন ভুল তো তাঁহার কখনও হয় না। অথচ এই যুবকের সহিত তাঁহার একটা অতি ঘনিষ্ঠ সংস্রব আছে—গাঢ় পরিচয় আছে—

চলন্ত গাড়ির একটা আচমকা ঝাঁকানি খাইয়া যুবকের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল।

পরের স্টেশন কি গয়া?

ধীরেনবাবু বলিলেন হ্যাঁ।

যুবক তখন স্নান কামরায় গিয়া মুখহাত ধুইয়া আসিল; ক্ষিপ্র হস্তে বিছানা গুটাইয়া বাঁধিয়া ফেলিল। ধীরেনবাবু দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার অন্তর অজ্ঞাত সংশয়ে তোলপাড় করিতে লাগিল। এমন অস্থিরতা ও উদ্বেগ তিনি জীবনে কখনও ভোগ করেন নাই। অথচ কেন যে এই উদ্বেগ তাহাও তিনি বুঝিতে পারিতেছেন না। কেবল একটা মানুষকে চিনিতে না পারার জন্য এতখানি ব্যাকুলতা কি সম্ভব?

গাড়ির গতি মন্থর হইল। গয়া আসিয়া পড়িয়াছে। যুবক সিগারেট ধরাইয়া প্রশ্ন করিল, আপনি কোথায় যাবেন?

ধীরেনবাবু ক্ষীণকণ্ঠে বলিলেন, কাশী।

যুবক তাঁহার প্রতি এমন একটি দৃষ্টিপাত করিল যাহার অর্থ কাশী যাবার বয়স হয়েছে বটে।

গয়া স্টেশনে আসিয়া গাড়ি থামিল। যুবক নামিবার উপক্রম করিল।

ধীরেনবাবু ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার নাম কি?

যুবক বিরক্তভাবে ফিরিয়া তাকাইল। আমার নাম শ্রীধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ। বলিয়া সে নামিয়া গেল।

ধীরেনবাবু স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলেন। দীর্ঘকাল তাঁহার আর বাহ্যজ্ঞান রহিল না।

যে লোকটিকে তিনি কিছুতেই চিনিতে পারিতেছিলেন না, তাহাকে চিনিতে আর বাকি নাই। সে আর কেহ নয়–তিনি স্বয়ং। ত্রিশ বছর পূর্বে ধীরেনবাবু যাহা ছিলেন এই যুবকটি সেই। শুধু চেহারার সাদৃশ্য বা নামের ঐক্য নয়—সাক্ষাৎ তিনিই। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।

কিন্তু ইহা কি করিয়া সম্ভব হইল; ধীরেনবাবু স্বপ্ন দেখিতেছেন না তো? তিনি চোখ রগড়াইয়া চারিদিকে চাহিলেন। না, স্বপ্ন নয়; সূর্য উঠিয়াছে। তিনি জাগিয়াই আছেন।

তাঁহার স্মৃতিশক্তিও উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। মনে পড়িল, ত্রিশ বছর পূর্বে তিনি যখন বিবাহ করিতে যাইতেছিলেন, তখন গাড়ির কামরায় একটি বৃদ্ধ ছিল। বৃদ্ধ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল কদ্দূর যাওয়া হচ্ছে? তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেন—গয়া। তারপর যাহা আজ ঘটিয়াছে সমস্তই ঘটিয়াছিল। বৃদ্ধ শেষ মুহূর্তে তাঁহার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। নাম শুনিয়া বৃদ্ধের মুখে স্তম্ভিত বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়াছিল—

সে বৃদ্ধ কে ছিল? সেও কি যুবক ধীরেনবাবুকে দেখিয়া নিজের অতীত যৌবনকে চিনিতে পারিয়াছিল? এমনিভাবে কি অনন্তকাল ধরিয়া চলিতেছে?

এই সময় তিনি ধড়মড় করিয়া গাড়ি হইতে নামিতে গেলেন। দেখিলেন গাড়ি চলিতেছে। গাড়ি আবার কখন চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। তিনি জানিতে পারেন নাই। তিনি আবার ফিরিয়া আসিয়া বসিলেন।

তাঁহার যৌবন এখন গয়ায়। আজ রাত্রে তাঁহার বিবাহ। তবে ধীরেনবাবু কোথায় যাইতেছেন? গয়ায় তাঁহার বিবাহ, তিনি কাশী চলিয়াছেন কি জন্য?

অতিপ্রাকৃত ব্যাপার। বিশ্বাসের যোগ্য নয়। একটা মানুষের দুইটা বিভিন্ন বয়স যুগপৎ বর্তমান থাকে কি করিয়া? কিন্তু ধীরেনবাবু সর্বান্তঃকরণে জানেন ইহাই সত্য। ঐ যুবক যে তিনিই তাহাতে তিলমাত্র সন্দেহ নাই। কি করিয়া সম্ভব হইল তাহা অবশ্য তিনি জানেন না। কিন্তু সম্ভব হইয়াছে। ইহাই কি যথেষ্ট নয়?

পরের স্টেশনে গাড়ি থামিতেই ধীরেনবাবু গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িলেন। কাশী যাইবার আর প্রয়োজন নাই; দ্বিতীয়বার দার-পরিগ্রহেরও প্রয়োজন নাই।

আজ রাত্রে তাঁহার প্রথম পক্ষের বিবাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress