Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

শিবুর মায়ের কথাই থাকিল।

সাত-আনির বাঁড়ুজ্জে বাবুদের কাছারি-ঘর একদিনের জন্য উন্মুক্ত হইয়া আবার বন্ধ হইয়া গেল। বিষয়-সম্পত্তি বন্দোবস্ত যেমন ছিল, তেমনই রহিল। পরদিন প্রাতঃকালেই শিবুর মা নায়েবকে ডাকিয়া বলিলেন, দেখুন, খরচপত্রের টিপ যেমন ঠাকুরঝি আর আমি সই করছিলাম, তেমনই হবে। শিবু সই করবে না।

রাখাল সিং শুধু বিস্মিত হইলেন না, একটু বিরক্তও হইলেন; তিনি দীর্ঘকাল ধরিয়া ঐকান্তিক কামনায় চাহিয়া আসিতেছেন একটি মনিব—যে মনিব নারী নয়, সবল দুঃসাহসী উদার, যে মনিবের চারিপাশে ঐশ্বর্যের আড়ম্বর থাকিবে, অথচ সে অমিতব্যয়ী হইবে না; লোকে যাহাকে ভয় করিবে, অথচ দুর্নাম থাকিবে না। এই কিশোের ছেলেটিকে লইয়া তেমনই একটি মনিব গড়িয়া তুলিবার আকাঙ্ক্ষা তিনি এই দীর্ঘকাল ধরিয়া পোষণ করিয়া আসিতেছেন। তিনি হইবেন তাহার মন্ত্রী, উপদেষ্টা, অপরিজ্ঞাত পরিচালক। শৈলজা-ঠাকুরানীর এই বন্দোবস্তে তাহার মনে আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের সম্ভাবনায় তাহার উৎসাহ এবং আনন্দের আর পরিসীমা ছিল না। তাই শিবুর মায়ের এই বিপরীত আদেশে তিনি বিরক্ত না হইয়া পারিলেন না, এবং সে বিরক্তি তাহার দ্রুকুটি-ভঙ্গিমায় আত্মপ্রকাশ করিল। ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া সিংহ প্রশ্ন করিয়া বসিলেন, কেন? কাল বাবু কাছারিতে বসলেন, প্রজারা সব জেনে গেল, তাদের জমিদার নিজে কাজকর্মের ভার নিলেন–

বাধা দিয়া মা বলিলেন, শিবুর এখনও কাজকর্মের ভার নেবার বয়স হয় নি সিংমশায়, তার পড়াশুনার সবই বাকি। এই তো, পরীক্ষার খবর বেরুলেই তাকে বাইরে পড়তে যেতে হবে।

রাখাল সিং একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, বাবুকে কি আরও পড়াবেন নাকি?

হাসিয়া মা বলিলেন, পড়বে না? না পড়লে মানুষ হবে কী করে সিংমশায়? শিবুকে আমি এম. এ. পর্যন্ত পড়াব। মূৰ্খ জমিদারের ছেলে তাকে যেন কেউ না বলে।

অন্তরের বিরক্তি আর গোপন করিতে না পারিয়া রাখাল সিং বলিয়া ফেলিলেন, তা হলে বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করা দায় হয়ে উঠবে মা।

কেন?

যে রকম দিনকাল পড়েছে, তাতে শক্ত মালিক না হলে বিষয়-সম্পত্তি কারও থাকবে না মা।

মা হাসিয়া বলিলেন, আমরা স্ত্রীলোক বলে আপনি ভয় করছেন?

মাথা চুলকাইয়া নায়েব বলিলেন, তা একটু করছি বৈকি মা।

পিসিমা একমনে রামায়ণের একটি পৃষ্ঠাই এতক্ষণ ধরিয়া পড়িতেছিলেন, তিনি আর বোধহয় থাকিতে পারিলেন না। বইখানা বন্ধ করিয়া উঠিয়া বলিলেন, তুমি বুঝতে পারছ না বউ, সিংমশায় ভাল কথাই বলছেন। এই বিষয়-সম্পত্তি, বাড়ির মান-সম্ভ্ৰম, কীর্তি-বৃত্তি-এ বজায় রাখা কি স্ত্রীলোকের কাজ, না চাকর-বাকরের কাজ?

দৃঢ় অথচ মিষ্ট কণ্ঠে শিবুর মা বলিলেন, সব বজায় থাকবে ঠাকুরঝি।

বিস্মিত হইয়া ভাতৃজায়ার মুখের দিকে চাহিয়া শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, তুমি রাখতে পারবে? তোমার সাহস হচ্ছে?

অবিচল কণ্ঠে মা বলিলেন, পারব, সে সাহস আমার আছে।

মুহূর্তে শৈলজা-ঠাকুরানীর একটা অদ্ভুত রূপান্তর ঘটিয়া গেল, আক্রোশভরা স্থিরদৃষ্টিতে ভাতৃজায়ার মুখের দিকে চাহিয়া তিনি বলিলেন, তা হলে এতদিন আমি তোমার হাত থেকে সব কেড়ে নিয়ে রেখেছিলাম বল।

শিবুর মা বলিলেন নায়েবকে, আমরা স্ত্রীলোক বলে আপনাকে ভয় করে কাজ করতে হবে না। ঠাকুরঝি রয়েছেন, আমি রয়েছি, সব দায়িত্ব আমাদের। যান, কাজকর্ম দেখুন গিয়ে এখন।

ক্ষুদ্র ঘটনাটির এমন একটি তিক্ত পরিণতির সম্ভাবনায় রাখাল সিং অস্বস্তি এবং শঙ্কা বোধ করিতেছিলেন, তিনি অনুমতি পাইবামাত্র যেন স্থানত্যাগ করিয়া পলাইয়া বাঁচিলেন।

শৈলজা-ঠাকুরানী এবার কঠোরতর স্বরে প্রশ্ন করিলেন, কথার আমার জবাব দাও বউ।

শিবুর মা বলিলেন, দোব। সিংমশায় নায়েব হলেও তাঁর সামনে জবাব কি আমি দিতে পারি ভাই? সম্পত্তি তোমার বাপের, শিবু তোমার বাপের বংশধর, অধিকার তোমার যে আমার চেয়ে অনেক বেশি। তুমি কেড়ে কেন রাখবে ভাই, তোমার ভার তুমিই নিয়েছিলে, এখন যদি তুমি ভয় কর, আমি তোমার পেছন থেকে তোমায় সাহায্য করব, এই কথাই বলছি।

ভ্ৰাতৃজায়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, মিষ্টি কথাটা তুমি বেশ শিখেছিলে বউ। যাক, এখন আমার উত্তর শোন, এককালে সম্পত্তি আমার বাপের ছিল, কিন্তু আজ সে সম্পত্তি তোমার ছেলের। তোমার ছেলে বলেই তো আজ আমার কথার ওপর তুমি কথা চালালে!

আমি তো অন্যায় কথা কিছু বলি নি ঠাকুরঝি! আমি বলছি, শিবুর লেখাপড়া শেখা দরকার। সে দশের কাছে মান্যগণ্য হোক, বিদ্বান হোক–সেটা কি তুমি চাও না?

আমি কী চাই, না চাই, সে জেনে তো কোনো লাভ নেই ভাই। আমি তো তোমাদের একটা পোয্য ছাড়া আর কিছু নই।–কথাটা বলিতে বলিতেই শৈলজা-ঠাকুরানী স্থানত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। এই অভিমান তাঁহার অমোঘ অস্ত্র। তাঁহার এই সর্বহারা জীবনে একটি সম্পদ অটুট অক্ষয় ছিল, তাঁহার অভিমান কোনোদিন অবহেলিত হয় নাই। তাহার বাপ ভাই এককালে সহস্ৰ ক্ষতি বরণ করিয়া তাঁহার অভিমান রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহাদের অবর্তমানে শিবুর মা তাঁহার সকল অধিকার শৈলজা-ঠাকুরানীর চরণে বিসর্জন দিয়াও সে অভিমান বজায় রাখিয়া আসিতেছেন। কিন্তু আজ সন্তানের ভবিষ্যৎ লইয়া মতদ্বৈধের মধ্যে আপনার অধিকার কোনোমতেই বিসর্জন দিতে পারিলেন না। শৈলজা-ঠাকুরানী চলিয়া গেলেন, তিনিও অবিচলিত চিত্তে ভঁড়ার ঘরে প্রবেশ করিয়া আপন কার্যে মনোনিবেশ করিলেন।

মামী! পাচিকা রতন একটা বাটি হাতে ঘরে ঢুকিয়া ডাকিল, মামী।

কে, রতন? কী চাই, তেল?

আর একটু পেলে ভাল হয়; না হলেও ক্ষতি নেই। একটা কথা বলছিলাম।

কী, বল।

ধীরে-সুস্থে মানিয়ে ওর মত করালেই পারতে। রাগ-রোষ করবে।

কেন রতন, আমি কি শিবুর মা নই?

রতন অপ্রস্তুত হইয়া গেল; শুধু অপ্রস্তুতই নয়, বিস্মিতও হইল। একটু পরে ঈষৎ হাসিয়া বলিল, মামীরও তা হলে রাগ হয়।

শিবুর মা কোনো উত্তর না দিয়া নীরবে রতনের বাটিতে খানিকটা তেল ঢালিয়া দিলেন। ঠিক এই সময়েই নিত্য বাহিরে ব্যস্তসমস্ত হইয়া ডাকিল, পিসিমা! পিসিমা!

কেহ উত্তর দিল না। মা বাহির হইয়া আসিয়া বলিলেন, কী রে নিত্য?

নিত্য বলিল, লায়েববাবুতে আর কেষ্ট সিং চাপরাসীতে তুমুল ঝগড়া লাগিয়েছে মা।

কে? কার সঙ্গে ঝগড়া করছে? পিসিমা এবার বাহির হইয়া আসিলেন।

আজ্ঞে, লায়েববাবুতে আর কেষ্ট সিং চাপরাসীতে।

ঝগড়া? কিসের ঝগড়া? কেন, বাড়ির কি মাথা-ছাতা কেউ নেই মনে করেছে নাকি?

পিসিমা গম্ভীর মুখে বাহির হইয়া গেলেন, নিত্যও অভ্যাসমত তাহার পিছনে পিছনে ছুটিল।

পিসিমা কাছারি-বাড়িতে আসিয়া দেখিলেন, রাখাল সিং এবং কেষ্ট সিং উভয়েই লজ্জিত নতমস্তকে নীরবে বসিয়া রহিয়াছে। বারান্দার মধ্যস্থলে একখানা চেয়ারের উপর ক্রুদ্ধ আরক্তিম মুখে গম্ভীরভাবে বসিয়া আছে শিবু। মুহূর্তে পিসিমা সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়া লইলেন, পুলকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ব্যাপার কী রে শিবু?

গম্ভীর মুখেই শিবু উত্তর করিল, কিছু না পিসিমা, তুমি বাড়ি যাও। যা ব্যবস্থা করবার আমি করছি।

নিতান্ত অকারণে ঝগড়া।

রাখাল সিং ক্ষুব্ধ মনে কাছারিতে আসিয়া ভাবিতেছিলেন, এখানে আর কাজ করা উচিত নয়। মালিক যেখানে থাকিয়াও নাই, সেখানে কাজ করার অর্থ হইতেছে নিজেকে অকারণে বিপন্ন করা। একটা ফৌজদারি দাঙ্গা বাধিলে সেখানে মর্যাদা বজায় থাকে না; এ বাড়ির কর্তৃত্ব স্ত্রীলোকের হাতে বলিয়া সর্বদা শঙ্কিত হইয়া থাকিতে হয়; এমনকি মৌখিক আস্ফালনে কেহ চোখ রাঙাইয়া গেলেও সকল ক্ষেত্রে তাহার প্রত্যুত্তর দিবার উপায় পর্যন্ত নাই। এখানে কাজ করা আর উচিত নয়।

ঠিক এই সময়েই কেষ্ট সিং আসিয়া বলিল, হুকুম দেন নায়েববাবু, রূপলাল বাগদীকে আমি গলায় গামছা বেঁধে নিয়ে আসব।—উত্তেজনায় ক্রোধে সে উদ্যতফণা সাপের মত ফুলিতেছিল।

নায়েবের মুখ নিদারুণ বিরক্তিতে বিকৃত হইয়া উঠিল, তাহার ইচ্ছা হইল, এখনই এই মুহূর্তে কাজে জবাব দিয়া আসিবেন।

কেষ্ট সিং উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল, বেটা বাগদী আজ ভোরে আমাদের কালীসায়ের পুকুরে আট-দশ সের একটা মাছ মেরেছে। খবর পেয়ে বেটার বাড়ি গিয়ে দেখলাম, উঠোনে বড় বড় মাছের অ্যাঁশ পড়ে রয়েছে। আমি তাকে ধরে নিয়ে আসছিলাম, বেটার মনিব বেণী চাষাসে এসে আমাকে আইন দেখায়, বলে, চুরি করে থাকে—থানায় খবর দাও, তুমি ধরে নিয়ে যাবার কে? হুকুম দেন, রূপো বেটাকে গলায় গামছা দিয়ে নিয়ে আসব। আর বেণী চাষার আমাদের খাস খামারে গাছ কোথায় আছে দেখুন, কাটব।

নায়েব বলিলেন, হুকুম দিতে পারব না বাপু, তুমি মালিকের কাছে যাও।

কই, দাদাবাবু কই? তার কাছে যাই আমি।

মা-পিসিমার কাছে যাও। কালকের ব্যবস্থা সমস্ত রদ হয়ে গিয়েছে। বাবু এখন পড়তে যাবেন কলকাতা, মা-পিসিমার হুকুমমতই সংসার চলবে।

কেষ্ট সিং কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল, বেশ, আমি আর কাজকর্ম করব না মশায়, আমার মাইনে-পত্তর মিটিয়ে দেন।

নায়েব এবার অকারণে ক্রুদ্ধ হইয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, তা আমাকে কী বলছ হে বাপু, যাও না মালিকদের কাছে গিয়ে বল না।

কেষ্ট সিং এবার ক্রোধভরে বলিয়া উঠিল, মালিকের কাছে কেন যাব আমি? আমি চাপরাসী, আপনি নায়েব, আমি আপনাকে বললাম, মালিকের কাছে যেতে হয়, জজসাহেবের কাছে যেতে হয়, আপনি যান। দেন, আমার মাইনে মিটিয়ে দেন।

হুঙ্কার দিয়া রাখাল সিং বলিলেন, আমিও আর চাকরি করব না হে বাপু, তুমি আমাকে চোখ রাঙাচ্ছ কী?

কেষ্ট সিং সমানে গলা চড়াইয়া বলিল, সে কথা আমাকে বলছেন কী মশায়? সে কথা আপনি মালিককে বলুন গিয়ে।

নিত্য-ঝি আসিয়াছিল শ্রীপুকুরের ঘাটে, সে চিৎকার শুনিয়া কৌতূহলভরে কাছারিতে কি মারিয়া দেখিল, নায়েব ও কেষ্ট সিং আরক্ত নেত্ৰে দুই যুদ্ধোদ্যত পশুর মত গর্জন করিতেছে। সে ছুটিয়া বাড়ির দিকে চলিয়া গেল।

নায়েব তক্তপোশে একটা প্রকাণ্ড চাপড় মারিয়া বলিল, সে কথা তুমি আমাকে বলবার কে হে? জান তুমি চাপরাসী, আমি নায়েব?

মেঝেতে লাঠিটা ষ্টুকিয়া কেষ্ট সিং বলিল, আলবৎ বলব, একশো বার বলব। আমাকে বললেই বলব।

ঠিক এই সময়েই শিবু কাছারিতে প্রবেশ করিল। তাহার মুখ চিন্তান্বিত, অতিমাত্রায় ধীর গতি, দৃষ্টি স্বপ্নাতুর, অন্তরলোকের যে রথীর ইঙ্গিতে জীবনরথ পথ বাহিয়া ছুটিয়া চলে, সে রথী যেন মন-তুরঙ্গের বক্সারচ্ছু সংযত করিয়া স্থির হইয়া এক স্থানে পঁড়াইয়া আছে। সকালেই সে গিয়াছিল তাহাদের সমাজ-সেবক-সমিতির একটি অধিবেশনে। গত বর্ষায় অনাবৃষ্টির জন্য দেশে ফসল হয় নাই, পুষ্করিণীতে জল নাই, বৈশাখের প্রারম্ভেই গ্রীষ্মের নিদারুণ প্রখরতায় দেশটা যেন পুড়িয়া যাইতেছে। সমাজ-সেবক-সমিতির অনেকদিন হইতেই একটি দরিদ্রভাণ্ডার খুলিবার সঙ্কল্প আছে, কিন্তু কার্যে পরিণত করিবার মত উদ্যোগ কোনোদিন হয় নাই। এবার আগামী দুই-এক মাসের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ আশঙ্কা করিয়া কয়েকজন বয়স্ক নেতা এই অধিবেশন আহ্বান করিয়াছিলেন।

অধিবেশন হইতে ফিরিবার পথে শিবু ভাবিতেছিল একটা কবিতার কথা। পদ্যপাঠের কবিতা, কোনো ইংরেজি কবিতার অনুবাদ। এক নিৰ্দিষ্ট সন্তানের মাতা এক পৃথিবী পর্যটককে ব্যাকুল আগ্রহে তাঁহার সন্তানের সন্ধান জিজ্ঞাসা করিতেছেন। মা বলিতেছেন, আমার সন্তান নগণ্য নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মেলার মধ্যেও তাহাকে চেনা যায়।

পর্যটক বর্ণনা করে নানা মহামানবের কথা, বক্তার কথা বলে। মা বলেন, না, সে নয়।

পর্যটক বলে, এ মহাযুদ্ধের মধ্যে এক মহাবীরকে আমি দেখেছি। মা বলেন, না, সে নয়, সে নয়।

ঈশ্বরের ধ্যানমগ্ন এক সন্ন্যাসী, মুখে স্বৰ্গীয় জ্যোতি—

না, সেও নয়।

তবে? চিন্তা করিয়া পর্যটক বলে, এক দ্বীপে কুষ্ঠাশ্ৰমে দেখেছি এক মহাপ্রাণকে, তিনি ওই রোগীদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন, তাঁকেও সে ব্যাধি আক্রমণ করতে ছাড়ে নি, তবু তাঁর ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই।

ব্যাকুল আগ্রহে মা বলিলেন, সেই–সেই—সেই আমার সন্তান।

সমাজ-সেবক-সমিতির আবেষ্টনের মধ্যে কবিতাটি অকস্মাৎ মনে পড়িয়া গিয়াছে। তাহার ইচ্ছা হইল, হেডমাস্টার মহাশয়ের নিকট গিয়া মূল কবিতাটি কাহার জানিয়া কবিতাটি একবার পড়িবে। কিন্তু কাছারিতে প্রবেশ করিয়াই এই কোলাহলের আঘাতে তাহার চিন্তাধারা ছিন্ন হইয়া গেল, মুহূর্তে সে যেন সচেতন হইয়া উঠিল, তাহার মন-তুরঙ্গ যেন কশাঘাতে চকিত হইয়া বাতাসের বেগে ছুটিল।

কী, হয়েছে কী সিং মশায়ঃ নায়েববাবুর মুখের উপর তুমিই বা এমন চিৎকার করছ কেন কেষ্ট সিংহ।

রাখাল সিং এবং কেষ্ট সিং উভয়েই মুহূর্তে নির্বাক হইয়া গেল। উভয়েই খুঁজিতে ছিল, কেন তাহারা বিবাদ করিতেছিল, কারণটা কী?

শিবু জ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, কী ব্যাপারটা কী? বাড়ির ইজ্জৎ মর্যাদা আপনারা সব ড়ুবিয়ে দেবেন নাকি?

সতীশ চাকর তাড়াতাড়ি কাছারি-ঘর খুলিয়া একখানা চেয়ার বাহির করিয়া দিয়া বলিল, আজ্ঞে, ঝগড়া যে কী, তা ওঁরাই জানেন; উনিও বলছেন, আমি কাজ করব না: কে সিংও বলছে, আমি চাকরি করব না।

আরক্তিম গম্ভীর মুখে শিবু প্রশ্ন করিল, কেন?

সকলেই নীরব, কেহই এ কথার জবাব দেয় না। ঠিক এই অবসরেই পিসিমা আসিয়া আরক্তিমমুখ শিবুকে দেখিয়া পুলকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ব্যাপার কী রে শিবু?

শিবু উত্তর দিল, কিছু না পিসিমা, তুমি বাড়ি যাও। যা ব্যবস্থা করবার আমি করছি।

রাখাল সিং এবার বলিলেন, আমাদের দুজনেরই দোষ মা। মিছিমিছি খানিকটা বকাকি হয়ে গেল। তা এমন হয়, মন তো সব সময় ঠিক থাকে না মানুষের।

পাচিকা রতন কখন আসিয়াছিল, কেহ লক্ষ্য করে নাই; সে বলিল, শিবু, নায়েববাবু কেষ্ট সিং দুজনেই পুরনো লোক, ঔদের দোষ-ঘাট হলে তার বিচার করবেন পিসিমা, তুমি ওতে হাত দিও না, তুমি বরং বাড়ি এস।

শিবু, পিসিমা, নায়েব, কেউ সিং সকলেই রতনের কথায় আকৃষ্ট হইয়া দেখিলেন, কথা। রতনের নয়, রতনের পিছনে ঈষৎ অবগুণ্ঠন টানিয়া দাঁড়াইয়া শিবুর মা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress