দেবযান (Debjaan) : 15
পৃথিবীর হিসেবে দীর্ঘ দু বছর কেটে গেল।
সেদিন পুষ্প ও যতীন বসে কথা বলচে বুড়োশিবতলার ঘাটে, এমন সময় পুষ্প হঠাৎ চীকার করে বল্লে–এই! থামোথামো–খবরদার–
পরক্ষণেই সে ব্যাকুল, উদ্বিগ্ন মুখে বহুদূর আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বল্লে–যতীনদা, যতীনদা–
যতীন বিস্মিত সুরে বল্লে–কি হোল? পুষ্প বল্লে–কিছু না। যতীন নাছোড়বান্দা, সে বার বার বলতে লাগলো–কি হোল বল না পুস্প? বলবে না?
অবশেষে পুষ্প বল্লে–আশা বৌদিকে খুন করতে যাচ্চে তার সেই উপপতি নেত্য
–সে কি!
–ঐ যে দেখতে পাচ্ছ না?
যতীন ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে বলে–চলো চলো ছুটে যাই সামলাই গিয়ে– আমি তো কোনো দিকে কিছু দেখচি নে–ওঠো।
বিস্মিত যতীন পুষ্পের দিকে চেয়ে দেখলে যে তার যাবার কোন। ব্যস্ততা নেই। সে চুপ করে বসেই রইল, কিছুক্ষণ পরে পুষ্পের বিশাল আয়ত চোখ দুটি বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
যতীন বল্লে–কি হয়েছে, চলো চলো–
–গিয়ে কি হবে। এ যাত্রা রক্ষা হোল গিয়ে–
–বেঁচে গিয়েছে?
–আপাতত বটে। আহা, কি দুঃখ আশা বৌদির!
–আমি সেখানে যাবো পুষ্প। চলো দেখা যাক–
–না।
–তোমার ওই সব কথা আমার ভাল লাগে না পুস্প, সত্যি বলছি। আমি আলবৎ যাবো সেখানে। আমার মন কেমন হচ্চে বল তো?
–সেজন্যেই তোমার আরও যাওয়া উচিত নয়। দেখে কষ্ট পাবে খুব।
-চলো পুষ্প, তোমার পায়ে পড়ি, আচ্ছা তুমি বোঝ সব, অথচ মাঝে মাঝে–
অগত্যা পুষ্প ওকে নিয়ে কলকাতায় আশার বাসায় এসে উপস্থিত হোল। তখন যতীন বুঝতে পারলে কেন পুষ্প এখানে তাকে আনতে চায় নি। নেত্য আজকাল মদ খায়, মাতাল অবস্থায় এসে দিন-দুপুরে সে আশাকে এমন মার দিয়েছে যে, সে ঘরের মেঝেতে পড়ে ভয়ার্ল্ড চোখে দুর্দান্ত মাতালটার দিকে চেয়ে আছে। দরজার চৌকাঠের এপারে একখানা নেপালী কুরি পড়ে, সম্ভবত নেত্যর হাত থেকে ঠিকরে পড়ে থাকবে। ওদের দোরের বাইরে আশপাশের ঘরের ভাড়াটেরা জড়ো হয়ে উঁকি মেরে মজা দেখচে। নেত্য মত্ত অবস্থায় টলচে ও হাত নেড়ে নেড়ে জোর গলায় আস্ফালন করছে–ওকে আমি আজ খুন করে ফেলবো–আচ্ছা পাল মশায়, আপনি বিচার করুন, ওকে কে খেতে দিচ্চে, পরতে দিচ্চে? ও দেশে না খেয়ে মরছিল কিনা ওকে জিজ্ঞেস করুন না? আমি মশাই হক কথা হক কাজ বড় ভালবাসি। আমি আনলাম ওকে এখানে, খাওয়াই পরাই, অথচ সেই শম্ভু ব্যাটা এসে তলায় তলায় ফুৰ্তি মারে। কত দিন পই পই করে বারণ করিচি-করি নি? তেমন পুরুষ বাপে নেত্যনারাণের জন্ম দেয় নি–আজ তোকে খুন। করে ফাঁসি যাবো, সেও থোড়াই কেয়ার করে এই শৰ্ম্মা। এত বড় তোর বদমাইসি! কম করেছি আমি তোর জন্যে? তোর নিজের বিয়ে করা ভাতার কোনো দিন তোকে খেতে দেয়নি, আর আমি কিনা.. দিয়েচে কোনো দিন সেই যতীন?
এই সময় আশা আধ-বসা অবস্থায় উঠে ঝাঁঝের সঙ্গে বল্লে–খবরদার! তিনি স্বগে গিয়েছেন, তাঁর নামে কিছু বোলো না–
নেত্য বিদ্রুপের সুরে বল্লে–ওরে আমার স্বামী-সোহাগী সতী রে! মারো মুখে ঝাঁটা, বলতে লজ্জাও করে না? আমি বলচি, না তুই বলতিস্ সেই যনেটা বেঁচে থাকতে? আবার স্বামী-সোহাগ দেখাতে এসেচেন, মরণ নেই? ভারি স্বামী ছিল মুরোদের, সব জানি, বিয়ে করে একখানা কাপড় কিনে দেবার, এক মুঠো অন্ন দেবার ক্ষমতা হয় নি–
আশা আবার উঠে বল্লে–আবার ওই কথা! তিনি মরে স্বগগে গিয়েছেন, তাঁর নামে কেন বলবে তুমি?
নেত্য হঠাৎ তেড়ে এসে আশার কাঁধে এক লাথি মেরে বল্লে– স্বামীর সোহাগ উথলে উঠলো বদমায়েশ মাগীর, যে বেরিয়ে এসেছে তার মুখে আবার–গলায় দড়ি দিগে যা–
আশার চেহারা আগের চেয়ে খুব খারাপ হয়ে গিয়েচে, গায়ের রঙেও আগের মত জলুস নেই, লাথি খেয়ে সে কিন্তু এবার ঠেলে
উঠলো। বল্লে–তাই দেবো, গলায় দড়ি দিয়ে তোমায় পুলিশের হাতে যদি তুলে না দিই–
-চুপ–পুলিশ তোর বাবা হয়!
–আবার মুখে ওই সব কথা?
এইবার একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক এগিয়ে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। বল্লে–এসব আপনাদের কি কাণ্ড? আপনার না ভদ্র লোক? আশপাশের বাড়ীতে গেরস্তর ঝি-বউ সব রয়েছে, এখানে মদ খেয়ে চেঁচামেচি চলবে না। হ্যাংগামা করতে হয়, ন্যারা করতে হয়, সরকারী রাস্তা পড়ে রয়েছে। আমার বাড়ী ওসব করলে পুলিশে খবর দিতে হবে।
পালমশায় এবার বোধ হয় সাহস পেয়ে এগিয়ে এসে বল্লেন– আমিও তাই বন্ধু। বলি এখানে ওসব কোরোনি–তা মাতালের সামনে। এগোতে কি সাহস হয়!
প্রৌঢ়া স্ত্রীলোকটি আশাকে ধরে ঘরের বাইরে আনতে আনতে বল্লে–মাতালের সামনে তক্কো কত্তে আছে, ছিঃ মা–দেখচো না ওর এখন কি ঘটে জ্ঞান আছে? এসো আমার ঘরে
আশা চলে যায় দেখে নেত্য জড়িত কণ্ঠে বাজখাঁই আওয়াজে বল্লে– এই, কোথাও যাবিনি বলে দিচ্চি–হাড় ভাঙবো মেরে–খবরদার! এই। আমি এখন চা আর ডিম ভাজা খাবো–করে না দিয়ে যদি নড়বি– নিয়ে যেও না মাসী–
প্রৌঢ়া স্ত্রীলোকটি যেতে যেতে বল্লে–আচ্ছা, চা করে ডিম ভেজে আমার ঘর থেকে পাঠিয়ে দিচ্চি বাবা–আপনি একটু শান্ত হয়ে শুয়ে থাকুন–
পালমশায় উপস্থিত লোকজনদের দিকে চেয়ে বল্লে–চলো সব। চলো, কি দেখতে এসেচো সব? দুটো হাত পা বেরিয়েচে কারো, না ঠাকুর উঠেচে? বনু তখন ওখানে যেওনি, যে বড় কে বাপের ব্যাটা।
শেষের কথা ক’টি পৌরুষগর্বের উচ্চারণ করবার সময় তিনি নেত্যনারায়ণদের ঘর থেকে বেশ একটু দূরে বারান্দার প্রায় ওপাশে চলে গিয়েচেন যদিও, তবুও চলতে চলতে একবার পেছন ফিরে দেখে নিলেন, দুর্দান্ত মাতালটা তাঁর কথা শুনলো কিনা।
যতীন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বল্লে এতদূর নেমেচে ওর অবস্থা। এ। আমি ভাবিনি–
পুষ্প বল্লে–ভাবা উচিত ছিল, এ সব জিনিসের এই কিন্তু পরিণাম এখান থেকে চলো যাই–
যতীন চুপ করে বসে ছিল, আশার দুর্দশা তার মনে গভীর রেখাপাত করেছে। সে দুঃখিত ভাবে বল্লে–তুমি কেবলই এসে চলে যেতে চাও, কিন্তু আমি কোথায় গিয়ে শান্তি পাবো পুষ্প? আমার কর্ত্তব্য পালন করিনি বলেই আজ ওর এই দুর্দশা। আমি যদি স্বামীর কর্তব্য পালন করতাম, যদি আশার জন্যে তেমন টাকাকড়ি রেখে যেতে পারতাম, তাহোলে–
–তোমার ভুল এখনো গেল না।
–কেন, ঠিক কথা বলচি কি না? ভুলটা কোথায়?
পুষ্প মৃদু হেসে ওর পাশে এসে বল্লে–তোমাকে এত ভাল ভাল জায়গায় নিয়ে গেলাম, তোমার বুদ্ধিটা যেমন স্কুল তেমনই রইল–
-কেন?
-আশা বৌদি নিজের কৰ্ম্মফলে এখনও অনেকদিন এই রকম ভুগবে। তুমি ওর কৰ্ম্মের বন্ধন কাটাতে পারো সাধ্যি কি? টাকা রেখে যেতে, টাকা সুদু চলে যেত। বড় লোকের ছেলেদের তো অনেক টাকা দিয়ে বাপ-মা মরে যায়–তারা উচ্ছন্ন যায় কেন?
–আমি এখানে থাকবো পুষ্প। ওকে ফেলে যেতে পারবো না এ ভাবে–
–তুমি কেন, দরকার হোলে আমিও থাকবো। এখানে থাকতে আমার রীতিমত কষ্ট হয়–তবুও আমি তোমার জন্যে, যদি আশা বৌদির এতটুকুও উপকার করতে পারতাম তবে এখানে থাকতে কিছু আপত্তি করতাম না। কিন্তু তুমি এখনও অনেক জিনিস বোঝে নি। এসব নিষ্ফল চেষ্টা। করুণাদেবীর মুখে শুনেচি করুণার পাত্র মেলানো। বড় দুর্ঘট। নয়তো করুণাদেবীর মত শক্তিশালিনী দেবী আশা বৌদিকে এখান থেকে উদ্ধার করতে পারেন না? এক্ষুনি পারেন–কিন্তু তাঁরা জানেন, তা হয় না। জীব নিজের চেষ্টায় উন্নতি করবে, বাঁশ দিয়ে ঠেলে উঁচু করে দিলে জীব উন্নতি করে না! নয়তো ভগবান এক পলকে সব পাপী উদ্ধার করতে পারতেন। তাঁর উদ্দেশ্য বুঝে কাজ করতে হয়। সে তুমি আমি বুঝিনে, কিন্তু করুণাদেবী, প্রেমদেবীর মত দেবদেবীরা অনেকখানি বোঝেন–তাই তাঁরা অপাত্রে–
–আমি না বুঝতে পারি, কিন্তু তুমি ঠিক বোঝো। তোমার দেখবার ক্ষমতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। তবুও তোমার সঙ্গে এখানে ওখানে গিয়ে আমার অনেক উন্নতি হয়েচে আগেকার চেয়ে–এখন বুঝিয়ে বল্লে বুঝি। তোমার সেই সন্ন্যাসীর মতে এখন বোধ হয় আমার মুকুলিত চেতন–নয়তো বুঝিয়ে বল্লেও বুঝতাম না, মনে সংশয়। জাগতো, অবিশ্বাস জন্মাতো, তা হোলে সে সব তত্ত্ব আমার কোনো কাজে লাগতো না।
এই সময় নেত্যনারাণ ডাকতে লাগলো চেঁচিয়ে–ও আশা, শোনো এদিকে–এই আশা
প্রৌঢ়া বাড়ীওয়ালী বারান্দায় বার হয়ে বল্লে–একটু চা খাচ্চে, আপনাকেও পাঠিয়ে দিচ্ছি তৈরী হোলে। আশা এখন যেতে পারবে না।
নেত্য গরম মেজাজে বল্লে–কেন যেতে পারবে না–শুনতে পাই কি? ও আমার মেয়েমানুষ, আমি যখন ডাকবো, আলবৎ আসবে–ওর বাবা আসবে–
এই কথাটা যতীনের বুকে যেন গরম শূলের মত বিঁধলো। আশা তার স্ত্রী, বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে যার সঙ্গে সে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে–সেই আশা অপরের ‘মেয়েমানুষ? নেত্যর হুকুমে তাকে চলতে হবে? যতীনের মাথা যেন ঘুরে উঠলো। এক মুহূর্তে সমস্ত দুনিয়া বিস্বাদ, মিথ্যে, জোলো হয়ে দাঁড়ালো-মস্ত একটা ফাঁকি, মস্ত একটা ধাপ্পাবাজির মধ্যে পড়ে গিয়েছে সে। পুষ্প-টুপ, সন্নিসি-টিন্নিসি সব এই মস্ত জুয়োচুরির অন্তর্গত ব্যাপার। নইলে অগ্নিসাক্ষী করে, হোম করে, বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে যাকে সে সহধৰ্ম্মিণী করেছিল–
কিংবা এই হয়তো নরক!
সে হয়তো নরক ভোগ করচে-স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য করেনি, জোর করে তাকে শ্বশুরবাড়ী থেকে এনে কাছে রেখে সংশোধনের চেষ্টা করে নি, ক্লীবের মত নিশ্চেষ্ট হয়ে ছিল, সেও তমোগুণ। তার জন্যেই এই দারুণ নরক তাকে স্বচক্ষে দেখতে হচ্চে, কে যেন টেনে নিয়ে আসচে এখানে, এই শোচনীয় দৃশ্য দেখতে কে যেন তাকে বাধ্য করচে, নিয়তির মত নিষ্ঠুর সে আকর্ষণ, রেহাই দেবে না তাকে।
পুষ্প বল্লে–চলো যতীনদা, আর এখানে থেকে কষ্ট পেয়ো না
যতীন দুঃখ মিশ্রিত হতাশার সুরে বল্লে–তুমি অতি করুণাময়ী। তুমি জানো যে এ আমার কৰ্ম্মফলের ভোগ, এ নরক। তুমি দয়া করে তাই কেবল এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইচ, আমি সব বুঝতে পেরেচি এবার। কিন্তু পুষ্প দয়াময়ী, আমার সাধ্যি কি, আমি যাই? চুম্বক যেমন লোহাকে টানে, আশার ভাগ্য ও আমার কর্মফল। পরস্পরকে তেমনি টানচে। টেনে আনচে কোথায় তোমাদের সেই তৃতীয় স্তর থেকে আমার সে টানে আসতেই হবে এবং আমি কোথাও যেতেও পারবো না।
পুষ্প দৃঢ়স্বরে বল্লে–তুমি দুৰ্বল হয়ে হাল ছেড়ে বসে থেকো না, সেও কি পুরুষের কাজ, বীরের কাজ? তা ছাড়া তোমাকে এই বন্ধন। থেকে বাঁচাবো আমি। নইলে তুমি বুঝতে পারছো না কি বিপদ তোমার সামনে।
কিন্তু যতীন কিছুতেই না যেতে চাইতে পুষ্প কিছুক্ষণের জন্যে পৃথিবীতে থেকে চলে গেল, বল্লে–পৃথিবীর ভোরের দিকে সে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু রাত দুটোর পর নেত্য মদ্যপানের অবসাদে ঘুমিয়ে পড়াতে যতীন ভাবলে এবার সে স্বস্থানে ফিরতে পারে। আশা বাড়ীওয়ালীর ঘরেই ঘুমুচ্চে, সুতরাং এখন আর কোনো ভয় নেই, উদ্বেগ নেই। যেন ভয় উদ্বেগ থাকলেই সে ভয়ানক কিছু সাহায্য করতে পারতো!
পৃথিবী ছেড়ে বাইরের আকাশের তলায় এসে সে দেখলে শূন্যপথের সাধারণ চলাচলের মার্গগুলি একেবারে জনশূন্য। কেউ কোথাও নেই। যতীন একটু বিস্মিত হয়ে গেল। পৃথিবীর লোক না দেখতে পাক, কিন্তু অসীম ব্যোমের নানা স্থান দিয়ে বিশেষত ভূপৃষ্ঠ থেকে একশো দেড়শো গজের ওপর থেকেই মেঘপদবীর সমান্তরালে বা তদূদ্ধের বহ পথ সীমা-সংখ্যাহীন অনন্তের দিকে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে। এই সব পথ কোনো বাঁধাধরা সুরকি সিমেন্টের তৈরী রাস্তা নয়–আত্মিক জীব, দেব-দেবী, উচ্চ জীবগণের গমনাগমন দ্বারা সুনির্দিষ্ট একটা অদৃশ্য জ্যোতি রেখা মাত্র।
সাধারণত বিশ্বের এই রাজমার্গগুলিতে আত্মিক পুরুষেরা সর্বদা যাতায়াত করেন, কিন্তু আজ সেখানে কেউ নেই–আরও ওপরে এসে যে স্থান ধূসরবর্ণ আত্মাদিগের অধিষ্ঠানভূমি, সেও জনহীন।
যতীন বুঝতে পারলে না, এরকম ব্যাপারের কারণ কি। আজ এত বছর সে এসেচে আত্মিকলোকের তৃতীয় স্তরে–কিন্তু এমন অবস্থা সে দেখেনি কখন। তাঁর মনে যেন কেমন ভয়ের সঞ্চার হোল। অথচ কিসের ভয় সে নিজেই জানে না। যে একবার মরেচে, সে আর মরবে না, তবে ভয়টা কিসের?
হঠাৎ যতীন দেখলে একটি লোক যেন আতঙ্কে চারিদিকে চাইতে চাইতে ঝড়ের বেগে উড়ে দ্বিতীয় স্তরের আত্মিক লোক থেকে আরো ঊর্ধ্বলোকের দিকে পালাচ্চে। পৃথিবী হোলে বলা চলতো লোকটা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্চে। ব্যাপার কি? এর নিশ্চয় কোনো গুরুতর কারণ আছে।
যতীন তাঁকে কিছু বলতে গেল, কিন্তু তাঁর পূর্বেই লোকটা অন্তর্হিত হোল–মনে হোল পলায়মান ব্যক্তি যেন হাতের ইঙ্গিতে তাকে কি বল্লে–কি বিষয়ে সাবধান করতে গেল।
লোকটি অদৃশ্য হবার কিছু পরেই যতীনের মনে হোল কী এক ভীষণ টানে তাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অতি ভীষণ সে টানের বেগ, তিমির-প্রসারক যেন কোন্ বিশাল চৌম্বক শক্তি জগব্রহ্মাণ্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তাঁর জাল বিস্তার করেছে–যতীনের সামনে, পাশে, দূরে, চারদিকে ঝড়ের মত কোথা থেকে সেই ভীষণ শক্তির লীলা এক মুহূর্তে ব্যাপ্ত হয়ে গেল। যতীন যেন ভীম আবর্তে তলাতল পাতালের
অভিমুখে কোথায় চলেচে..তার জ্ঞান লোপ পেয়ে আসচে…কেবল। এইটুকু সে লক্ষ্য করলে, শুধু সে নয়, ঝড়ের মুখে তার মত বহু জীবাত্মা কুটোর মত কোথায় চলেছে বিষম ঘূর্ণিপাকের টানে!…তারপর একটা আর্ত চীৎকার স্বর, এক কি বহু সম্মিলিত কণ্ঠের আর্তনাদ, যতীন ঠিক বুঝতে পারছে না, তার সংজ্ঞা নেই, অতিপ্রাকৃত কী এক বিষম শক্তির আমোঘ আকর্ষণ তাকে খেলার পতুলে পরিণত করেছে।
ভয়ানক অন্ধকার তার চারিদিকে, এই কি তলাতল পাতাল? পৃথিবী কোথায়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, চন্দ্র সূৰ্য্য কোথায়, পুষ্প কোথায়? করুণাদেবী কোথায়, হতভাগিনী আশা কোথায়–সব লুপ্ত, একেবারে! কোন্ রসাতলে সে চলেচে দুর্লঙ্ঘ্য আকর্ষণে।
অনেকক্ষণ…অনেক যুগ যেন কেটে গিয়েছে…জ্ঞান নেই যতীনের। অন্ধকার ছাড়া আর কোনদিকে কিছু নেই। বহুদিন সে কী এক গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিল। সব অন্ধকার…বিস্মৃতি…
পুষ্পের ডাকে তার চৈতন্য হোল। পুষ্প তাকে ডাকচে, ও যতীনদা, যতীনদা, বেরিয়ে এসো।
পুষ্প ও আর একজন তাকে প্রাণপণে ডাক দিচ্চে, যেন কতদূর থেকে…
যতীন বলে উঠলো–অ্যাঁ!
–শীগগির চলে এসো–ওঁ কৃষ্ণ, ওঁ কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করো–ওঁ কৃষ্ণ, ওঁ কৃষ্ণ, ওঁ কৃষ্ণ–
পুষ্প, পুষ্প ডাকচে!
যতীনের জ্ঞান একটু একটু ফিরে এসেচে–এ কোন্ স্থান।
কে যেন ওর হাত ধরলে এসে। পুষ্পের কণ্ঠস্বর ওর কানে গেল আবার। পুষ্প যেন কাকে বলচে–এবার যতীনদা বেঁচে গেল। তবে এখনও ঠিক জ্ঞান হয়নি–
আবার আত্মিকলোকের নির্মল বায়ুস্তরে ওর নিশ্বাসপ্রশ্বাস সহজ ও আনন্দময় হয়ে আসছে। যতীন জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখলে, সামনে। পুষ্প ও পুষ্পের মা। সে বিস্ময়ে ওদের দিকে চেয়ে বল্লে–কি হয়েছিল। বল তো? এ কি কাণ্ড! এমন তো কখনো–
তারপর সে চারিদিকে চেয়ে দেখে আরও অবাক হয়ে গেল। সে পৃথিবীর এক গরীব গৃহস্থের পুরোনো কোঠাঘরের মধ্যে। পৃথিবীতে রাত্রিকাল, সম্ভবত গভীর রাত্রি। বর্ষাকাল, বাইরে ঘোর অন্ধকার, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে বাড়ীর পেছনের বাঁশবনে। ঘরের এক কোণে কিছু পেতল কাঁসার বাসন একটা জলচৌকির ওপরে, একটা পুরোনো তক্তপোশ, দুতিনটি বস্তা–একটার ওপর আর একটা সাজানো-সম্ভবত ধান। ঘরের মেঝের একপাশে একটা জলের বালতি, ওদের ঠিক সামনে মেঝের ওপর মলিন কাঁথা পাতা একটা বিছানার একপাশে ছোট ছোট বালিশ পাতা–আর একটা ছোট বিছানা, কিন্তু সে ছোট বিছানাটা খালি। আর বিছানার সামনে মেঝের ওপরেই মলিন শাড়ী পরনে একটি মেয়ে বসে অঝোরে কাঁদচে, মেয়েটির কোলে একটি মৃত শিশু, সম্ভবত ছ’সাত মাসের। ঘরের দরজার কাছে একটা পুরোনো হ্যারিকেন লন্ঠনে বোধ হয় লাল তেল জ্বলচে, কারণ আলোর চেয়ে ধোঁয়া বেশি হয়ে লণ্ঠনের কাঁচের একটা দিক কালো করে ফেলেচে। ঘরের মধ্যে আরও দুতিনটি মেয়ে ও পুরুষমানুষ সবাই ক্রন্দনরতা মেয়েটিকে ঘিরে নিঃশব্দে বসে।
মেয়েটি কাঁদছে আর বিলাপ করচেও আমার ধনমণি, ও আমার সোনা, হাসো, দেয়ালা করো, আমার মানিক, চোখ চাও–আমার কোল খালি করে পালিও না আমার সোনা–কোথায় যাবা আমায় ফেলে?
যতীন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে পুষ্পের ও পুষ্পের মার দিকে চেয়ে বল্লে–এ সব কি ব্যাপার! এরা কারা? আমি কোথায়?
মেয়েটি একমনে বিলাপ করেই চলেচে কোলের মৃত শিশুর দিকে চোখ রেখে।
–কাল থেকে তুমি একবারও মাইএ মুখ দ্যাওনি যে বাবা আমার! মাই খাবা? মায়ের মাইএ মুখ দেবা না, ও মানিক আমার? আর মুখ দেবা না? চোখ চাও দিনি–
মেয়েটির আকুল ক্রন্দনে যতীনের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের চঞ্চলতা দেখা দিল, পরের কান্না শুনে এমন কখনো তার হয়নি সম্পূর্ণ অননুভূত কোন্ অনুভূতিতে ওর চোখে জল এসে পড়লো।
পুষ্প বল্লে–চলে এস যতীন দা, চলো সব বলছি। তুমি পুনর্জন্মের টানে পড়ে পৃথিবীতে জন্মেছিলে আজ ছ’সাত মাস। ওই তোমার মা। আজ আবার দেহ থেকে মুক্তি পেলে। ওই মৃত শিশুই তুমি কি বিপদেই ফেলেছিলে আমাদের।
যতীন অবাক হয়ে বল্লে–পুনর্জন্মের টান! সে কি! আমি এই বাড়ীতে–
–এই ঘরেই জন্মেছিলে। এরা ব্রাহ্মণ, গ্রামের নাম কোলা বলরামপুর, জেলা যশোর। ভগবানের কাছে বহু ডাক ডেকে আর করুণাদেবীর দয়ায় আজ উদ্ধার পেলে–নতুবা দেহ ধরে এই সব অজ পাড়াগাঁয়ে এমন বহুঁকাল কাটাতে হোত–পুনর্জন্মের ঠ্যালা বুঝতে পারতে। বার বার পৃথিবীতে যাওয়া-আসার কুফল এখন বুঝতে পারচো তো? কতবার না বারণ করেছি?
যতীনের মন তখন কিন্তু পুষ্পের ওসব আধ্যাত্মিক তিরস্কারের দিকে ছিল না। তার সামনে বসে এই তার পৃথিবীর মা, গরীব ঘরের মা, তারই বিয়োগব্যথায় আকুলা, অশ্রুমুখী। গত ছ’মাসের শৈশবস্মৃতি কোনো দাগই কাটেনি তাঁর শিশু-মস্তিষ্কে। কিন্তু কত বিনিদ্র রজনী যাপনের মৌন ইতিহাস ওই দরিদ্রা জননীর তরুণ মুখে! তারই মা, তারই নবজন্মের দুঃখিনী জননী, যাঁর বত্রিশ নাড়ী ছিঁড়ে ছ’মাস পূৰ্ব্বে এই দরিদ্র গৃহে কত আশা আনন্দের ঢেউ তুলে একদিন সে পুনরায় ধরণীর মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। কি অদ্ভুত মোহ, কি আশ্চর্য্য মায়ার বাঁধন, মনে হচ্চে স্বর্গ চাইনে, করুণাদেবীকে চাইনে, পুষ্পকে চাইনে, আশাকে চাইনে, আধ্যাত্মিক উন্নতি- টুন্নতি চাইনে–এই পৃথিবীর মাটিতে পৃথিবীর এই মায়ের কোলে সুখদুঃখে সে আবার মানুষ হয়! এই টিপ টিপ বৃষ্টিধারা, এই বর্ষার রাত্রিটি, এই গরীব মায়ের তারই জন্যে এ আকুল বুকফাটা বিলাপ–এ সব জীবনস্বপ্নের কোন্ গভীর রহস্যময় অঙ্ক অভিনয়ের দৃশ্যপট! ভগবান হিরণ্যগর্ভের অধিষ্ঠিত স্বপ্ন।
ওর মনে পড়ল যাত্রায় শোনা গানের দুটো লাইন–
এ নাটকের এ অঙ্কে পেয়েছি স্থান তোর অঙ্কে,
হয়তো যাবো পর অঙ্কে পর অঙ্কে পুত্র সেজে।
ওদের মধ্যে একজন প্রৌঢ়া বল্লে–আর কেঁদো না বৌ, যা হবার হয়ে গেল, এখন উঠে বুক বাঁধো–মনে করো ও তোমার ছেলে নয়– ভারত করতে যদি ও আসতো তা হোলে কোলজোড়া হয়ে থাকতো, তা ভারত করতে তো আসে নি–কেঁদো না–
একজন আধবুড়ো গোছের লোক বল্লে–বিষ্টি মাথায় এখন আর কোথায় যাবো–সকালের আর বেশি দেরি নেই, সাধন আর হরিচরণকে নিয়ে আমি যাবো এখন
প্রৌঢ়া বল্লে–বিষ্টিরও বাপু কামাই নেই–সেই যে আরম্ভ করেচে বিকেলবেলা, আর সারারাত
কথা বলতে বলতে কাক কোকিল ডেকে রাত ফর্সা হয়ে গেল। পুষ্পের বার বার আহ্বানেও যতীন সেখান থেকে নড়তে পারলে না। পুত্রহারা জননীর আকুল কান্না, ও আছাড়ি-বিছাড়ির মধ্যে সেই আধ বুড়ো লোকটি আর দুজন ছোঁকরা মৃত শিশুদেহ নিয়ে বৃষ্টিধারা মাথায় বাঁশবনের পথে চললো। যতীন, পুষ্প ও পুষ্পের মা গেল ওদের সঙ্গে। বাড়ী থেকে দু রশি আন্দাজ দূরে ছোট্ট একটা নদী, কচুরিপানার দামে আধ-বোজা; ওরা শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহটা নদীর ধারে পুঁতে ফেললে। তখনও ভাল করে দিনের আলো ফোটেনি, বৃষ্টিধারায় চারিধার ঝাঁপসা। পথে-ঘাটে লোকজন নেই কোথাও–বর্ষাকালের ধারামুখর প্রভাতকাল।