Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী মাত্র পাঁচদিন চণ্ডীগড়ে পদার্পণ করিয়াছেন, এইটুকু সময়ের অনাচার ও অত্যাচারে সমস্ত গ্রামখানা যেন জ্বলিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে। নজরের টাকাও আদায় হইতেছে, কিন্তু সে যে কি করিয়া হইতেছে তাহা জমিদার-সরকারে চাকরি না করিয়া বুঝিবার চেষ্টা করাও পাগলামি।

তারাদাস চক্রবর্তী আদেশমত প্রথম দিন হাজির হইয়া নজর দিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন, এমন কি ছয় ঘণ্টাকাল তীক্ষ্ণ রৌদ্রে খাড়া দাঁড়াইয়াও স্বীকার করেন নাই; কিন্তু সর্বসমক্ষে কান ধরিয়া ওঠ-বোস, ঘোড়দৌড় এবং ব্যাঙের নাচ নাচাইবার প্রস্তাবে আর ধৈর্য রক্ষা করিতে পারেন নাই। চণ্ডীমাতার নিকট কায়মনে জমিদারগোষ্ঠীর বংশলোপের আবেদন করিয়া, প্রকাশ্যে পাঁচদিনের কড়ারে টাকা আদায় দিবার অঙ্গীকারে অব্যাহতি পাইয়া বাড়ি আসেন। আজ সেই দিন, কিন্তু সকাল হইতে কোথাও তাঁহাকে দেখা যাইতেছে না।

ইতিমধ্যে প্রত্যহ মহাপ্রসাদ যোগাইতে হইয়াছে; পুকুরের মাছ, বাগানের ফলমূল, চালের লাউ-কুমড়া জমিদারের লোক যথেচ্ছা টানিয়া ছিঁড়িয়া লইয়া গিয়াছে—ষোড়শী প্রতিবাদ করিতে চাহিয়াছে, কিন্তু তারাদাস কিছুতেই একটা কথাও কহিতে দেয় নাই, তাহার হাতে ধরিয়া কাঁদাকাটা করিয়া যেমন করিয়া হোক নিবৃত্ত করিয়া রাখিয়াছে। পিতার অপমান হইতে আরম্ভ করিয়া এই-সকল নির্যাতন সে কোনমতে এতদিন সহিয়াছিল, কিন্তু আজিকার ঘটনায় তাহার সমস্ত সঞ্চিত ক্রোধ একমুহূর্তে অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। পিতার নিঃশব্দ অন্তর্ধানের হেতু ও তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলাফলের ভার তাহার মন একাকী যেন আজ আর বহিতে পারিতেছিল না। এমনি করিয়া সমস্ত সকাল ও মধ্যাহ্ন যখন অপরাহ্নে গড়াইয়া পড়িল, তখন রাত্রের অন্ধকারে উপবাসী পিতার গোপনে ফিরিয়া আসার প্রত্যাশা করিয়া সে দুটো রাঁধিতে বসিয়াছিল, এমন সময়ে মন্দিরের পরিচারিকা আসিয়া যে অত্যাচার বর্ণনা করিল, তাহা এই—

মাতাল ভূস্বামীর হঠাৎ খেয়াল হইয়াছে যে, অতঃপর নিষিদ্ধ মাংস ত নহেই, এমন কি বৃথা মাংসও ভোজন করিবেন না। অথচ পাঁঠার মাংস যথেষ্ট সুস্বাদু বা রুচিকর নহে। তাই আজ জমিদারের লোক ডোমপাড়া হইতে একটা খাসি আনিয়া মন্দিরে হাজির করে এবং তাহাকে মহাপ্রসাদ করিয়া দিতে বলে। পুরোহিত প্রথমটা আপত্তি করে, কিন্তু শেষে আদেশ শিরোধার্য করিয়া উহাকেই উৎসর্গ করিয়া যথারীতি বলি দিয়া দেবীর মহাপ্রসাদ করিয়া দেয়।

শুনিবামাত্রই ষোড়শী হাঁড়িটা দুম্‌ করিয়া চুলা হইতে নামাইয়া দিয়া ক্রোধে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া দ্রুতবেগে মন্দিরে চলিয়াছিল, বহির্দ্বারে জন-চারেক হিন্দুস্থানী পাইক তাহার গতিরোধ করিয়া দাঁড়াইল। বিশ্বম্ভর দূর হইতে বাড়িটা দেখাইয়া দিয়া সরিয়া পড়িল। ইহারা জমিদারের পালকি-বেহারা। মুখে তাড়ির দুর্গন্ধ, চোখগুলো রাঙ্গা— অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা। যে লোকটা বাংলা শিখিয়াছে, সে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিল, শালা ঠাকুরমোশাই ঘোরে আছে? শালা টাকা দেবে, না ভেগে ফিরচে!
ষোড়শী চাহিয়া দেখিল কোথাও কেহ নাই। পাছে এই দুর্বিনীত মদমত্ত পশুগুলা হঠাৎ তাহাকেই অপমান করিয়া বসে এই ভয়ে সে দুর্জয় ক্রোধ প্রাণপণে সংবরণ করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, না, বাবা বাড়ি নেই।

কোথা ছিপ্‌ছে?

আমি জানি নে, বলিয়া ষোড়শী পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিতেই লোকটা হাত বাড়াইয়া একটা অত্যন্ত অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করিয়া কহিল, না আছে ত তুই চোল। গোলায় গামছা লাগিয়ে খিঁচে লিয়ে যাবো।

এ অপমান ষোড়শীকে একেবারে আত্মহারা করিয়া ফেলিল, সে প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়া কহিল, খবরদার বলচি। চল্‌ আমিই যাবো—তোদের মাতালটা আমাকে কি করতে পারে দেখি গে। বলিয়া সে পরিণাম-ভয়হীন উন্মাদিনীর ন্যায় নিজেই দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া চলিল।

পথে দুই-একজন পরিচিত লোকের সহিত সাক্ষাৎ হইল, কিন্তু ষোড়শী ভ্রূক্ষেপও করিল না। জমিদারের লোকগুলা পিছনে হল্লা করিয়া চলিয়াছে, ইহার অর্থ পল্লীগ্রামের কাহাকেও বুঝাইয়া বলা নিষ্প্রয়োজন বলিয়াই শুধু নয়, কাহারও সাহায্য ভিক্ষা করিয়া এতবড় অবমাননাকে আর নিজের মুখে চতুর্দিকে ছড়াইয়া দিতে তাহার কিছুতেই প্রবৃত্তি হইল না।

কাছারিবাড়ি বেশী দূরে নয়, এককড়ি সম্মুখেই ছিল। সে দেখিবামাত্রই বলিয়া উঠিল, আমি জানিনে—আমি কিছুই জানিনে—সর্দারজী, হুজুরের কাছে নিয়ে যাও। বলিয়া সে শান্তিকুঞ্জের উদ্দেশে অঙ্গুলিসংকেত করিয়া তাড়াতাড়ি গিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।

এতক্ষণে ষোড়শী নিজের বিপদের গুরুত্ব সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিয়া শঙ্কিত হইয়া উঠিল।

কোথায় যাইতে হইবে বুঝিয়াও জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কোথায় যেতে হবে?

লোকটা এককড়ির প্রদর্শিত দিকটা নির্দেশ করিয়া কেবল কহিল, চল্‌।

এ যাইতেই হইবে, তবুও কহিল, আমার কাছে ত টাকা নেই সর্দার, হুজুরের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে তোমাদের কি লাভ হবে?

কিন্তু সর্দার বলিয়া যাহাকে ভিক্ষা জ়ানানো হইল, সে এই আবেদনের ধার দিয়াও গেল না। শুধু প্রত্যুত্তরে একটা বিশ্রী ভঙ্গী করিয়া বলিল, চল্‌ মাগী চল্‌।

আর ষোড়শী কথা কহিল না। এই লোকগুলা স্থানান্তর হইতে আসিয়াছে, তাহার মর্যাদার কোন ধারণাই ইহাদের নাই। সুতরাং টাকার জন্য, খাজনার জন্য নরনারী নির্বিচারে সামান্য প্রজার প্রতি যে আচরণে নিত্য অভ্যস্ত, এ ক্ষেত্রেও তাহাদের কোন ব্যতিক্রম হইবে না। অনুনয় বিনয় নিষ্ফল কাঁদাকাটায় কেহ সাহায্য করিতে আসিবে না।অবাধ্য হইলে হয়ত পথের মধ্যেই টানাহেঁচড়া বাধাইয়া দিবে। প্রকাশ্য রাজপথে অপমানের এই চরম কদর্যতার চিত্র তাহাকে মুখ বাঁধিয়া যেন সুমুখের দিকে ঠেলিয়া দিল।
পথে রাখাল বালকেরা গরু লইয়া ফিরিয়াছে, কৃষকেরা দিনের কর্ম শেষ করিয়া বোঝা মাথায় ঘরে চলিয়াছে—সবাই অবাক্‌ হইয়া চাহিয়া রহিল; ষোড়শী কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত করিল না, কাহাকেও কিছু বলিবার উদ্যম করিল না, কেবল মনে মনে কহিতে লাগিল, মা ধরিত্রী, দ্বিধা হও!

সূর্য অস্ত গেল, অন্ধকার অগ্রসর হইয়া আসিল। সে যন্ত্রচালিত পুতুলের মত নীরবে শান্তিকুঞ্জের গেটের মধ্যে প্রবেশ করিল; থামিবার আপত্তি করিবার কোথাও এতটুকু চেষ্টা পর্যন্ত করিল না।

যে ঘরে আনিয়া তাহাকে হাজির করা হইল এটা সেই ঘর, এককড়ি যেখানে সেদিন প্রবেশ করিয়া ভয়ে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। তেমনি আবর্জনা, তেমনি মদের গন্ধ। সাদা, কালো, লম্বা, বেঁটে নানা আকারের শূন্য মদের বোতল চারিদিকে ছড়ানো। শিয়রের দেয়ালে খান-দুই চকচকে ভোজালি টাঙ্গানো, এককোণে একটা বন্দুক ঠেস দিয়ে রাখা, হাতের কাছে একটা ভাঙ্গা তেপায়ার উপর একজোড়া পিস্তল, অদূরে ঠিক সুমুখের বারান্দায় কি একটা বন্যপশুর কাঁচা চামড়া ছাদ হইতে ঝুলানো—তাহার বিকট দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে নাকে লাগিতেছে। বোধ হয় খানিক পূর্বেই গুলি করিয়া একটা শিয়াল মারা হইয়াছে। সেটা তখন পর্যন্ত মেঝেয় পড়িয়া—তাহারই রক্ত গড়াইয়া কতকটা স্থান রাঙ্গা হইয়া আছে। জমিদার শয্যার উপর চিত হইয়া শুইয়া শুইয়া কি একখানা বই পড়িতেছিলেন। মাথার কাছে আর একটা মোটা বাঁধানো বইকে বাতিদান করিয়া মোমবাতি জ্বালানো হইয়াছে; সেই আলোকে চক্ষের পলকে অনেক বস্তুই ষোড়শীর চোখে পড়িল। বিছানায় বোধ করি কেবল চাদরের অভাবেই একটা বহুমূল্যের শাল পাতা, তাহার অনেকখানি মাটিতে লুটাইতেছে; দামী সোনার ঘড়িটার উপরে আধপোড়া একখণ্ড চুরুট হইতে তখনও ধূমের সূক্ষ্ম রেখাটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া উপরে উঠিতেছে; খাটের নীচে একটা রূপার পাত্রে ভুক্তাবশিষ্ট কতকগুলা হাড়গোড় হয়ত সকাল হইতেই পড়িয়া আছে; তাহারই কাছে পড়িয়া একটা জরি-পাড়ের ঢাকাই চাদর, বোধ হয় হাতের কাছে হাত মুছিবার রুমাল বা গামছার অভাবেই ইহাতে হাত মুছিয়া ফেলিয়া দিয়াছে।

বইয়ের ছায়ায় লোকটার মুখের চেহারা ষোড়শী দেখিতে পাইল না, কিন্তু তবুও তাহার মনে হইল ইহাকে সে আয়নার মত স্পষ্ট দেখিতে পাইয়াছে। ইহার ধর্ম নাই, পুণ্য নাই, লজ্জা নাই, সঙ্কোচ নাই—এ নির্মম, এ পাষাণ। ইহার মুহূর্তের প্রয়োজনের কাছেও কাহারও কোন মূল্য কোন মর্যাদা নাই! এই পিশাচপুরীর অভ্যন্তরে এই ভয়ঙ্করের হাতের মধ্যে আপনাকে একান্তভাবে কল্পনা করিয়া ক্ষণকালের জন্য ষোড়শীর সকল ইন্দ্রিয় যেন অচেতন হইয়া পড়িতে চাহিল
সাড়া পাইয়া লোকটা জিজ্ঞাসা করিল, কে?

বাহির হইতে সর্দার ঘটনাটা সংক্ষেপে বিবৃত করিয়া চক্রবর্তীর উদ্দেশে একটা অকথ্য গালি দিয়া কহিল, হুজুর! উস্‌কো বেটিকো পাকড় লায়া।

কাকে? ভৈরবীকে? বলিয়া জীবানন্দ বই ফেলিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। বোধ হয় এ হুকুম সে দেয় নাই। কিন্তু পরক্ষণেই কহিল, ঠিক হয়েছে। আচ্ছা যা।

তাহারা চলিয়া গেলে ষোড়শীকে উদ্দেশ করিয়া প্রশ্ন করিল, তোমাদের আজ টাকা দেবার কথা। এনেচ?

ষোড়শীর শুষ্ককণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া রহিল, কিছুতেই স্বর ফুটিল না।

জীবানন্দ ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া পুনরায় কহিল, আনোনি জানি। কিন্তু কেন?

এবার ষোড়শী প্রাণপণ চেষ্টায় জবার দিল। আস্তে আস্তে বলিল, আমাদের নেই।

না থাকলে সমস্ত রাত্রি তোমাকে পাইকদের ঘরে আটকে থাকতে হবে। তার মানে জানো?

ষোড়শী দ্বারের চৌকাঠটা দুই হাতে সবলে চাপিয়া ধরিয়া চোখ বুজিয়া নীরব হইয়া রহিল। অসম্ভব বলিয়া সে এখানে কিছুই ভাবিতেও পারিল না।

তাহার এ ভয়ানক বিবর্ণ মুখের চেহারা দূর হইতেও বোধহয় জীবানন্দের চোখে পড়িল, এবং মূর্ছা হইতে তাহার এই আত্মরক্ষার চেষ্টাটাও বোধ হয় তাহার অগোচর রহিল না; মিনিটখানেক সে নিজেও কেমন যেন আচ্ছন্নের ন্যায় বসিয়া রহিল। তারপরে বাতির আলোটা হঠাৎ হাতে তুলিয়া লইয়া এই মৃতকল্প অচেতনপ্রায় রমণীর একেবারে মুখের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং আরতির পূর্বে পূজারী যেমন করিয়া দীপ জ্বালিয়া প্রতিমার মুখ নিরীক্ষণ করে, ঠিক তেমনি করিয়া এই মহাপাপিষ্ঠ স্তব্ধ গম্ভীর মুখে এই সন্ন্যাসিনীর নিমীলিত চক্ষের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া তাহার গৈরিক বস্ত্র, তাহার এলায়িত রুক্ষ কেশভার, তাহার পাণ্ডুর ওষ্ঠাধর, তাহার সবল সুস্থ ঋজু দেহ, সমস্তই সে যেন দুই বিস্ফারিত চক্ষু দিয়া নিঃশব্দে গিলিতে লাগিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *