Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দুর্গ রহস্য – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 10

দুর্গ রহস্য – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

গভীর ঘুমাইয়া পড়িয়ছিলাম। হঠাৎ মাথার শিয়রে বোমা ফাটার মত শব্দে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম। মুহুর্তের জন্য কোথায় আছি ঠাহর করিতে পারিলাম না।

স্থানকালের জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে দেখিলাম ব্যোমকেশ দ্বারের বাহিরে টর্চের আলো ফেলিয়াছে‌, সেখানে কতকগুলো ভাঙা হাঁড়ি কলসীর মত খোলামকুচি পড়িয়া আছে। তারপর ব্যোমকেশ জ্বলন্ত টর্চ হাতে লইয়া তীরবেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। ‘অজিত‌, এসো–’

আমিও আলুথালুভাবে উঠিয়া তাহার অনুসরণ করিলম; সে কাহারও পশ্চাদ্ধাবন করিতেছে কিম্বা বিপদের ক্ষেত্ৰ হইতে পলায়ন করিতেছে তাহা বুঝিতে পারিলাম না। তাহার হাতের আলোটা যেদিকে যাইতেছে‌, আমিও সেইদিকে ছুটিলাম।

তোরণের মুখে পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ সিঁড়ির উপর আলো ফেলিল। আমি তাহার কাছে পৌঁছিয়া দেখিলাম‌, সিঁড়ি দিয়া একটা লোক ছুটিতে ছুটিতে উপরে আসিতেছে। কাছে আসিলে চিনিলাম-সীতারাম।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘সীতারাম, সিঁড়ি দিয়া কাউকে নামতে দেখেছ?’

সীতারাম বলিল‌, ‘জী হুজুর‌, আমি ওপরে আসছিলাম‌, হঠাৎ একটা লোকের সঙ্গে টক্কর লেগে গেল। আমি তাকে ধরবার চেষ্টা করলাম‌, কিন্তু লোকটা হাত ছাড়িয়ে পালাল।’

‘তাকে চিনতে পারলে?’

‘জী না‌, অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু টক্কর লাগবার সময় তার মুখ দিয়ে একটা বুরা জবান বেরিয়ে গিয়েছিল‌, তা শুনে মনে হল লোকটা ছোট জাতের হিন্দুস্থানী। —কিন্তু কী হয়েছে হুজুর?’

‘তা এখনও ঠিক জানি না। দেখবে এস।’

ফিরিয়া গেলাম। ঘরের সম্মুখে ভাঙা হাঁড়ির টুকরোগুলা পড়িয়া ছিল‌, ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঐ দ্যাখো। আমি জেগেছিলাম‌, বাইরে খুব হালকা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভাবলাম‌, তুমি বুঝি ফিরে এলে। তারপরই দুম করে শব্দ—’

সীতারাম ভাঙা সরার মত একটা টুকরো তুলিয়া আব্ৰাণ গ্রহণ করিল। বলিল‌, ‘হুজুর‌, চট্‌ করে খাটের উপর উঠে বসুন।’

‘কেন? কি ব্যাপার?’

‘সাপ। কেউ সরা-ঢাকা হাঁড়িতে সাপ এনে এইখানে হাঁড়ি আছড়ে ভেঙ্গেছে। আমাকে টর্চ দিন‌, আমি খুঁজে দেখছি। সাপ কাছেই কোথাও আছে।’

আমরা বিলম্ব না করিয়া খাটের উপর উঠিয়া বসিলাম, কারণ অন্ধকার রাত্রে সাপের সঙ্গে বীরত্ব চলে না। সীতারাম টর্চ লইয়া বাহিরে খুঁজিয়া দেখিতে লাগিল।

লণ্ঠনটা উস্কাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ঈশানবাবুকে কিসের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা হয়েছিল এখন বুঝতে পারছি।’

‘কিন্তু লোকটা কে?’

‘তা এখন বলা শক্ত। বুলাকিলাল হতে পারে‌, গণপৎ হতে পারে‌, এমন কি সন্নিসি ঠাকুরও হতে পারেন।’

এই সময় সীতারামের আকস্মিক অট্টহাস্য শুনিতে পাইলাম। সীতারাম গলা চড়াইয়া ডাকিল‌, ‘হুজুর‌, এদিকে দেখবেন আসুন। কোনও ভয় নেই।’

সন্তপণে নামিয়া সীতারামের কাছে গেলাম। বাড়ির একটা কোণ আশ্রয় করিয়া বাদামী রঙের সাপ কুণ্ডলী পাকিয়া কিলবিল করিতেছে। সাপটা আহত‌, তাই পলাইতে পারিতেছে না‌, তীব্র আলোর তলায় তাল পাকাইতেছে।

সীতারাম হাসিয়া বলিল‌, ‘ঢাম্‌না সাপ‌, হুজুর‌, বিষ নেই। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের সঙ্গে দিল্‌লাগি করছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দিল্‌লাগিই বটে। কিন্তু এখন সাপটাকে নিয়ে কি করা যাবে?

সাপটকে চাপা দিল‌, বলিল‌, ‘আজ এমনি থাক‌, কাল দেখা যাবে।’

আমরা ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। সীতারাম দ্বারের সম্মুখে নিজের বিছানা পাতিতে প্রবৃত্ত হইল। রাত্রি ঠিক দ্বিপ্রহর।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সীতারাম‌, তুমি এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে‌, কি করছিলে‌, এবার বল দেখি।’

সীতারাম বলিল‌, ‘হুজুর‌, এখান থেকে নেমে দেউড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি‌, বুলাকিলাল ভাঙি খেয়ে নিজের কুঠুরির মধ্যে ঘুমুচ্ছে। তার কাছ থেকে কিছু খবর বার করবার ইচ্ছে ছিল‌, সন্ধ্যেবেলা তার সঙ্গে দোস্তি করে রেখেছিলাম। ঠেলাঠুলি দিলাম। কিন্তু বুলাকিলাল জাগল না। কি করি‌, ভাবলাম‌, যাই সাধুবাবার দর্শন করে আসি।

‘সাধুবাবা জেগে ছিলেন‌, আমাকে দেখে খুশি হলেন। আমাকে অনেক সওয়াল করলেন; আপনারা কে‌, কি জন্যে এসেছেন‌, এইসব জানতে চাইলেন। আমি বললাম‌, আপনারা হাওয়া বদল করতে এসেছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ বেশ। আর কি কথা হল?’

সীতারাম বলিল‌, ‘অনেক আজে-বাজে কথা হল হুজুর। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একেবারে প্রোফেসার সাহেবের মৃত্যুর কথা তুললাম‌, তাতে সাধুবাবা ভীষণ চটে উঠলেন। দেখলাম বাড়ির মালিক আর নায়েববাবুর ওপর ভারি রাগ। বার বার বলতে লাগলেন‌, ওদের সর্বনাশ হবে‌, ওদের সর্বনাশ হবে।’

‘তাই নাকি! ভারি অকৃতজ্ঞ সাধু দেখছি। তারপর?’

‘তারপর সাধুবাবা এক ছিলিম গাঁজা চড়ালেন। আমাকে প্রসাদ দিলেন।’

‘তুমি গাঁজা খেলে?’

‘জী হুজুর। সাধুবাবার প্রসাদ তো ফেলে দেওয়া যায় না।’

‘তা বটে। তারপর?’

‘তারপর সাধুবাবা কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমিও চলে এলাম। ফেরবার সময় সিঁড়িতে ঐ লোকটার সঙ্গে ধাক্কা লাগিল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, একটা কথা বল তো সীতারাম। তুমি যখন ফিরে আসছিলে তখন বুলাকিলালকে দেখেছিলে?’

সীতারাম বলিল‌, ‘না। হুজুর‌, চোখে দেখিনি। কিন্তু দেউড়ির পাশ দিয়ে আসবার সময় কুঠুরি থেকে তার নাকড়াকার ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনেছিলাম।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যাক‌, তাহলে দেখা যাচ্ছে‌, সাপের হাঁড়ি নিয়ে যিনি এসেছিলেন তিনি আর যেই হোন‌, বুলাকিলাল কিম্বা সাধুবাবা নন। আশা করি‌, তিনি আজ আর দ্বিতীয়বার এদিকে আসবেন না-এবার ঘুমিয়ে পড়।’

সকালে উঠিয়া দেখা গেল ঢাকনি-চাপা সাপটা রাত্রে মরিয়া গিয়াছে; বোধহয় হাঁড়ি ভাঙার সময় গুরুতর আঘাত পাইয়াছিল। সীতারাম সেটাকে লাঠির ডগায় তুলিয়া দুর্গপ্রাকারের বাহিরে ফেলিয়া দিল। আমরাও প্রাকারে উঠিয়া একটা চক্ৰ দিলাম। দেখা গেল‌, প্রাকার একেবারে অটুট নয় বটে কিন্তু তোরণদ্বার ছাড়া দুর্গে প্রবেশ করিবার অন্য কোনও চোরাপথ নাই। প্রাকারের নীচেই অগাধ গভীরতা।

বেলা আন্দাজ আটটার সময় সীতারামকে দুর্গে রাখিয়া ব্যোমকেশ ও আমি রামকিশোরবাবুর বাড়িতে গেলাম। রমাপতি সদর বারান্দায় আমাদের অভ্যর্থনা করিল। —‘আসুন। কর্তা এখনি বেরুচ্ছেন‌, শহরে যাবেন।’

‘তাই নাকি?’ আমরা ইতস্তত করিতেছি এমন সময় রামকিশোরবাবু বাহির হইয়া আসিলেন। পরনে গরদের পাঞ্জাবি‌, গলায় কোঁচানো চাদর; আমাদের দেখিয়া বলিলেন ‘এই যে!—নতুন জায়গা কেমন লাগছে? রাত্রে বেশ আরামে ছিলেন? কোনও রকম অসুবিধে হয়নি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কোন অসুবিধে হয়নি‌, ভারি আরামে রাত কেটেছে। আপনি বেরুচ্ছেন?’ ]

‘হ্যাঁ‌, একবার উকিলের বাড়ি যাব‌, কিছু দলিলপত্তর রেজিস্ট্রি করাতে হবে। তা—আপনারা এসেছেন‌, আমি না হয় একটু দেরি করেই যাব–‘

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না না‌, আপনি কাজে বেরুচ্ছেন বেরিয়ে পড়ুন। আমরা এমনি বেড়াতে এসেছি‌, কোনও দরকার নেই।’

‘তা-আচ্ছা। রমাপতি‌, এঁদের চা-টা দাও। আমাদের ফিরতে বিকেল হবে।’

রামকিশোর বাহির হইয়া পড়িলেন; জামাই মণিলাল এক বস্তা কাগজপত্ৰ লইয়া সঙ্গে গেল। আমাদের পাশ দিয়া যাইবার সময় মণিলাল সহাস্যমুখে নমস্কার করিল।

ব্যোমকেশ রমাপতিকে বলিল‌, ‘চায়ের দরকার নেই‌, আমরা চা খেয়ে বেরিয়েছি। আজই বুঝি সম্পত্তি বাঁটোয়ারার দলিল রেজিষ্টি হবে?

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘যাক‌, একটা দুর্ভাবনা মিটুল।–আচ্ছা‌, বলুন দেখি—’

রমাপতি হাতজোড় করিয়া বলিল‌, ‘আমাকে ‘আপনি বলবেন না‌, ‘তুমি’ বলুন।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘বেশ‌, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে‌, কিন্তু সে পরে হবে। এখন বল দেখি গণপৎ কোথায়?’

রমাপতি একটু বিস্মিত হইয়া বলিল‌, ‘গণপৎ-মুরলীদার চাকর? বাড়িতেই আছে নিশ্চয়। আজ সকালে তাকে দেখিনি। ডেকে আনিব?’

এই সময় মুরলীধর বারান্দায় আসিয়া আমাদের দেখিয়া থতিমত খাইয়া দাঁড়াইল। তাহার ট্যারা চোখ আরও ট্যারা হইয়া গেল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনিই মুরলীধরবাবু? নমস্কার। আপনার চাকর গণপৎকে একবার ডেকে দেবেন? তার সঙ্গে একটু দরকার আছে।’

মুরলীধরের মুখ ভয় ও বিদ্রোহের মিশ্রণে অপরূপ ভাব ধারণ করিল। সে চেরা গলায় বলিল‌, ‘গণপতের সঙ্গে কি দরকার?

‘তাকে দু’ একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’

‘সে-তাকে ছুটি দিয়েছি। সে বাড়ি গেছে।’

‘তাই নাকি! কবে ছুটি দিয়েছেন?’

‘কাল—কাল দুপুরে।’ মুরলীধর আর প্রশ্নোত্তরের অপেক্ষা না করিয়া দ্রুত বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল।

আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। রমাপতির মুখে একটা ত্ৰস্ত উত্তেজনার ভাব দেখা গেল। সে ব্যোমকেশের কাছে সরিয়া আসিয়া খাটো গলায় বলিল‌, ‘কাল দুপুরে—! কিন্তু কাল সন্ধ্যের পরও আমি গণপৎকে বাড়িতে দেখেছি।–’

ঘাড় নাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘খুব সম্ভব। কারণ‌, রাত বারোটা পর্যন্ত গণপৎ বাড়ি যায়নি। কিন্তু সে যাক। নায়েব চাঁদমোহনবাবু বাড়িতে আছেন নিশ্চয়। আমরা তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’

রমাপতি বলিল‌, ‘তিনি নিজের ঘরে আছেন–’

‘বেশ‌, সেখানেই আমাদের নিয়ে চল।’

বাড়ির এক কোণে চাঁদমোহনের ঘর। আমরা দ্বারের কাছে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম‌, তিনি দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া বসিয়া সারি সারি কলিকায় তামাক সাজিয়া রাখিতেছেন। বোধ করি সারাদিনের কাজ সকালেই সারিয়া লইতেছেন। ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া রমাপতিকে বিদায় করিল। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলম‌, ব্যোমকেশ দরজা ভেজাইয়া দিল।

আমাদের অতর্কিত আবিভাবে চাঁদমোহন ত্ৰস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, তাঁহার চতুর চোখে চকিত ভয়ের ছায়া পড়িল। তিনি বলিয়া উঠিলেন‌, ‘কে? অ্যাঁ–ও-আপনারা—!’

ব্যোমকেশ তক্তপোশের কোণে বসিয়া বলিল‌, ‘চাঁদমোহনবাবু্‌, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’ তাহার কণ্ঠস্বর খুব মোলায়েম শুনাইল না।

ত্রাসের প্রথম ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া চাঁদমোহন গামছায় হাত মুছিতে মুছিতে বলিলেন, ‘কি

কথা?’

‘অনেক দিনের পুরোনো কথা। রামবিনোদের মৃত্যু হয় কি করে?’

চাঁদমোহনের মুখ শীর্ণ হইয়া গেল‌, তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া অৰ্ধক্ষুট স্বরে বলিলেন‌, ‘আমি কিছু বলতে পারি না–আমি এ বাড়ির নায়েব—’

ব্যোমকেশ গম্ভীর স্বরে বলিল‌, ‘চাঁদমোহনবাবু্‌, আপনি আমার নাম জানেন; আমার কাছে কোনও কথা লুকোবার চেষ্টা করলে তার ফল ভাল হয় না। রামবিনোদের মৃত্যুর সময় আপনি উপস্থিত ছিলেন তার প্রমাণ আছে। কি করে তাঁর মৃত্যু হল সব কথা খুলে বলুন।’

চাঁদমোহন ব্যোমকেশের দিকে একটা তীক্ষ্ণ চোরা চাহনি হানিয়া ধীরে ধীরে তক্তপোশের একপাশে আসিয়া বসিলেন‌, শুষ্কস্বরে বলিলেন‌, ‘আপনি যখন জোর করছেন তখন না বলে আমার উপায় নেই। আমি যতটুকু জানি বলছি।’

ভিজা গামছায় মুখ মুছিয়া তিনি বলিতে আরম্ভ করিলেন’—

‘১৯১১ সালের শীতকালে আমরা মুঙ্গেরে ছিলাম। রামবিনোদ আর রামকিশোরের তখন ঘিয়ের ব্যবসা ছিল‌, কলকাতায় ঘি চালান দিত। মস্ত ঘিয়ের আড়ৎ ছিল। আমি ছিলাম কর্মচারী‌, আড়তে বসতাম। ওরা দুই ভাই যাওয়া আসা করত।

‘হঠাৎ একদিন মুঙ্গেরে প্লেগ দেখা দিল। মানুষ মরে উড়কুড় উঠে যেতে লাগল‌, যারা বেঁচে রইল। তারা ঘর-দের ফেলে পালাতে লাগল। শহর। শূন্য হয়ে গেল। রামবিনোদ আর রামকিশোর তখন মুঙ্গেরে, তারা বড় মুশকিলে পড়ল। আড়তে ষাট-সত্তর হাজার টাকার মাল রয়েছে‌, ফেলে পালানো যায় না; হয়তো সব চোরে নিয়ে যাবে। আমরা তিনজনে পরামর্শ করে। স্থির করলাম‌, গঙ্গার বুকে নৌকো ভাড়া করে থাকিব‌, আর পালা করে রোজ একজন এসে আড়ৎ তদারক করে যাব। তারপর কপালে যা আছে তাই হবে। একটা সুবিধে ছিল‌, আড়ৎ গঙ্গা থেকে বেশি দূরে নয়।

‘রামবিনোদের এক ছেলেবেলার বন্ধু মুঙ্গেরে স্কুল মাস্টারি করত—ঈশান মজুমদার। ঈশান সেদিন সর্পাঘাতে মারা গেছে। সেও নৌকোয় এসে জুটল। মাঝি মাল্লা নেই‌, শুধু আমরা চারজন-নীেকোটা বেশ বড় ছিল; নৌকোতেই রান্নাবান্না্‌্‌, নৌকোতেই থাকা। গঙ্গার মাঝখানে চড়া পড়েছিল‌, কখনও সেখানে গিয়ে রাত কাটাতাম। শহরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কেবল দিনে একবার গিয়ে আড়ৎ দেখে আসা।

‘এইভাবে দশ বারো দিন কেটে গেল। তারপর একদিন রামবিনোদকে প্লেগে ধরল। শহরে গিয়েছিল জুর নিয়ে ফিরে এল। আমরা চড়ায় গিয়ে নৌকো লোগালাম‌, রামবিনোদকে চড়ায় নামালাম। একে তো প্লেগের কোনও চিকিৎসা নেই‌, তার ওপর মাঝ-গঙ্গায় কোথায় ওষুধ্‌্‌, কোথায় ডাক্তার। রামবিনোদ পরের দিনই মারা গেল।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘তারপর আপনারা কি করলেন?’

চাঁদমোহন বলিলেন‌, ‘আর থাকতে সাহস হল না। আড়তের মায়া ত্যাগ করে নীেকো ভাসিয়ে ভাগলপুরে পালিয়ে এলাম।’

‘রামবিনোদের দেহ সৎকার করেছিলেন?’

চাঁদমোহন গামছায় মুখ মুছিয়া বলিলেন‌, ‘দাহ করবার উপকরণ ছিল না; দেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’

‘চল‌, এবার ফেরা যাক। এখানকার কাজ আপাতত শেষ হয়েছে।’

সিঁড়ির দিকে যাইতে যাইতে আমি জিজ্ঞাসা করিলম‌, ‘কি মনে হল? চাঁদমোহন সত্যি কথা বলেছে?’

‘একটু মিথ্যে বলেছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই।’

সিঁড়ি দিয়ে নামিতে যাইব, দেখিলাম তুলসী অদূরে একটি গাছের ছায়ায় খেলাঘর পাতিয়াছে, একাকিনী খেলায় এমন মগ্ন হইয়া গিয়াছে যে আমাদের লক্ষ্যই করিল না। ব্যোমকেশ কাছে গিয়া দাঁড়াইতে সে বিস্ফারিত চক্ষু তুলিয়া চাহিল। ব্যোমকেশ একটু সমেহ হাসিয়া বলিল‌, ‘তোমার নাম তুলসী‌, না? কি মিষ্টি তোমার মুখখানি।’

তুলসী তেমনি অপলক চক্ষে চাহিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা দুর্গে আছি‌, তুমি আসো না কেন? এসো—অনেক গল্প বলব।’

তুলসী তেমনি তাকাইয়া রহিল‌, উত্তর দিল না। আমরা চলিয়া আসিলাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *