Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দুঃস্বপ্ন || Atin Bandyopadhyay

দুঃস্বপ্ন || Atin Bandyopadhyay

তবে তুমি এখানে দাঁড়াও আমি দেখছি ভিতরে কেউ আছে কিনা!

সোমা দাঁড়িয়ে থাকল। মনীষ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সে উঠে যাচ্ছে। সোমা তাকে উঠে যেতে দেখছে। সিঁড়ির বাঁকে মনীষ হারিয়ে গেলে সোমা সংস্কৃত কলেজের পাশে সেই পুরনো বইয়ের দোকানগুলো দেখল। এখানে সে নানাভাবে এসেছে। মনীষের সঙ্গে সামনের দেবদারু গাছটার নিচেই প্রথম আলাপ হয়েছিল।

এখানে এসে সেই প্রথম আলাপের দিনক্ষণগুলো কেমন মনে পড়ে গেল। বিয়ের পর সে যে এখানে দু—একবার আসেনি তা নয়, এসেছে। প্রথম বেশ কয়েকবারই এসেছে। কিন্তু এলেই সে দেখেছে বন্ধুবান্ধবদের আর আগের কৌতূহল সোমা সম্পর্কে আদৌ নেই। সে ওটা চাইছেও না। তবু মনে হয়েছে কেন জানি মনীষকে বিয়ে করার পর সব পুরুষবন্ধুদের কাছে তার দাম কমে গেছে। সেজন্য পরে আর এদিকে মাড়ায়নি সোমা। বরং মনীষই গিয়ে মাঝে মাঝে খবর নিয়েছে সবার।

তখনই মনে হল পিছন থেকে কে ডাকছে। সে তাকাল। মনীষ নয়। ওর অন্য চেনা পুরুষবন্ধু। বলল, এসো সোমা।

ও কোথায়?

বসে গেছে। আমি তোমাকে নিতে এলাম।

তুমি কেমন আছ?

ভালো। তুমি?

ভালো। তবে মাঝে মাঝে তোমাদের কথা মনে হলে খুব এখানে আসতে ইচ্ছা করে।

হয়েছে থাক। কী করছ বল?

কী আর করব। বাড়িতে আর বসে থাকতেও পারি না। ও অফিস চলে গেলে একা একা ভালো লাগে না বলে কলেজে একটা কাজ নিয়েছি।

ভালো করেছ। যা দিনকাল পড়েছে!

সোমা ওপরে উঠে দেখল জাঁকিয়ে বসে গেছে মনীষ। যেন সে এখানে একাই এসেছে। তার সঙ্গে কেউ ছিল না। সোমা যে ঢুকল সে তা পর্যন্ত টের পায়নি। হা হা করে কী কথায় হাসছে। সোমা কাছে যেতেই বলল, এতগুলো অকালকুষ্মাণ্ড একসঙ্গে বসে আছে দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না সোমা। বসে গেলাম। তুমি বসো। এই বিনু একটা চেয়ার এনে দে তোর বৌদিকে। এতদিন পর আমরা এসেছি, সোমার নামে কিছু আজ সেলিব্রেশান হোক।

বিনু সোমার সহপাঠী ছিল। সে সোমাকে, সোমা বলে ডাকত। তুই—তুকারি করত। সোমা এই বছর চারেকের ভিতর সামান্য ভারী হয়েছে। এবং চুল সে সবসময়ই শ্যাম্পু করত। চোখ খুব টানা, তার ওপর সোমার ভারি বদ স্বভাব ছিল, সে এলেই খুব একটা জাঁকজমক করে আসত না। খুব সাদাসিদে পোশাক, যেন সে ঘরেই ছিল পথ ভুল করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে নেমে এসেছে। বিনু কতদিন বলেছে, এই সোমা শোন, তুই একদিন চোখে কাজল টেনে আয় না। তোকে ভালো করে দেখি।

নিমেষে বিনুর সে সব কথা মনে পড়ে গেল। এবং মনীষ যেহেতু ওর সমবয়সি ছাত্র এবং সহপাঠী, সে তার চোখে—মুখে কোনো পূর্বস্মৃতি ধরা পড়ুক তা চাইল না। খুব হয়েছে। শালা তুমি তো খুব এখন সাঁতার কাটছ আর আমি চেয়ার টেনে মরব এমন বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বলতে পারল না। সে একটা টিনের চেয়ার টেনে নিল। অন্য চেয়ারে নানারকমের মানুষ বসে গেছে। ওর ইচ্ছা ছিল না সোমা একটা সামান্য টিনের চেয়ারে বসুক। সে নিজে উঠে যাবার সময়ই বলে গেল, তুই বস সোমা। আমি নিয়ে আসছি। সোমা বিনুর দিকে তাকাল। কেমন আছিস?

তুই?

খুব ভালো।

আমরা ভালো নেই।

কেন কী হয়েছে? ভালো নেই কেন? একটা বিয়ে করে ফেল।

কী সময় পড়েছে! এ—সময়ে কেউ বিয়ে করে!

সুধীর বলল, এখন বিয়ে বিয়ে ভাল্লাগে না! কে আজ সেলিব্রেট করছে বল?

বিনু বলল, আমার পকেটে ভাই পয়সা নেই।

অশোক বলল, তোর পকেটে কোনদিন পয়সা থাকে?

বিনু বলল, না থাকলে কী করব।

সোমা বলল, তোমরা বিনুকে চটিও না। বরং আমি তোমাদের সবাইকে আমার নামে সেলিব্রেট করছি।

মনীষ বলল, হল! বললাম তোদের আজ কিছু খসাব, এখন শালা উলটো চাপ।

কী হচ্ছে! শালা শব্দ মনীষ উচ্চারণ করায় সোমার যেন সম্মানে লেগেছে। না মাইরি বিনু, এখন আর আমাদের—স্বাধীনতা নেই।

আমাদের বলছিস কেন? বল তোর নেই। একটু খিস্তি—খেউড় করলে সোমা, মানুষ ছোট হয়ে যায় না। কেমন গম্ভীর গলায় বিনু এমন বলল।

তাই বুঝি।

সুধীর ডাকল, এই আবদুল, আজ স্পেশাল কী আছে রে?

চিকেন প্যাটিস, চিলি চিকেন।

ওসব চিলি ফিলি চলবে না? মনীষ তুমি কী খাবে। সোমা শীতকাল বলে একটা মেরুন রঙের চাদর গায়ে দিয়েছে। এবং চাদরে ওর মুখের অর্ধেকটা ঢাকা। সে যখন কথা বলে চাদরটা নামিয়ে নেয়। বিনুর এসব সহ্য হচ্ছে না। অশোকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সোমা কোনো কথা বলছে না। সে একবার রেস্তোরাঁতে সোমাকে খাওয়াবে বলে নিয়ে গিয়ে অযথা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কী সব করতে চেয়েছিল, পারেনি। সেই থেকে সে অশোকের সঙ্গে দেখা হলে বেশি কথা বলত না। বিয়ের পর বন্ধ করেই দিয়েছিল। এখানে ওর যতটুকু অসুবিধা হচ্ছে এই মানুষের জন্য। কিন্তু অশোকই প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মনীষের সঙ্গে। এবং অশোক মনীষের খুব বন্ধু লোক। তবে এই যে রক্ষে, অশোক কখনও বন্ধুত্বের দাবিতে ওর বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেনি। কেন জানি আজ অনেক দিন পর সোমার সবার সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করতে ইচ্ছে হল।

সোমা বলল, অশোক তুমি কী খাবে?

সে কেমন উদাসীন গলায় বলল, বল কিছু একটা।

কেন, তুমি বলতে পার না? সোমা পুরনো জলছবি মুছে দেবার চেষ্টা করছিল। অশোকই সহসা বলল, তোমরা হঠাৎ? তুমি তো এখন বড়মানুষের বউ।

একটা শো দেখতে এসেছিলাম। অনেকদিন পরে আসা, তাই ও বলল, দেখি আমাদের পুরনো বন্ধুবান্ধব কে আর এখন এখানে আসছে। সে অশোকের কথা গায়ে মাখল না।

ভালো করেছ এসে, অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম।

অশোক কী ওর সেই বিসদৃশ ঘটনা এখন বেমালুম ভুলে গেছে! ওর তো এখন শুধু সেই ঘটনার কথাই মনে হবার কথা। সোমা আজ অশোকের ওপর আর রাগ পুষে রাখেনি। কারণ সে দেখেছে মেলামেশার সুযোগে কেউ একটু বেশি চালাকি করে ভালোবাসা করে, কেউ কম। অশোককে সোমার এখন বরং বোকাই মনে হয়। বলে কয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা অশোকের ছিল না। অশোকের সহিষ্ণুতা ছিল না। ধুম—ধাড়াক্কা সে কিছু না বলেই সবটা করতে চেয়েছিল। তাকে সেদিন সোমার ইতর এবং ফাজিল মনে হয়েছিল। বলেছিল অশোক তুমি এমন ইতর, নীচ, জানতাম না।

অশোক সেদিন কিছু বলেনি। সে মাথা নিচু করে বসে ছিল। একটা কথাও বলেনি। সোমা খাবার ফেলে চলে এসেছিল। বিয়ের পর সে বুঝেছে মনীষও এটাই চেয়েছে। মনীষ ভালোবাসার ব্যাপারে শুধু সহিষ্ণুতা বেশি।

বিনু বলল, তা হলে অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।

সুধীর সোমার দিকে তাকাল।

ভয় নেই। যতটা খুশি দিতে পার।

সবাই এবার নড়েচড়ে বসল। মনীষ সবার বড় এমন একটা ভারিক্কি চালে বসে রয়েছে। কারণ এই চারজনের ভিতর সে—ই মোটামুটি এই ভালোবাসার ব্যাপারটাতে কী রহস্য আছে সব জেনে ফেলেছে। সে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, রমেশ দিল্লিতে বড় একটা চাকরি নিয়ে চলে গেছে।

ও শালা কেরিয়ারিস্ট। ওর কথা তুলে আর আমাদের এমন ভালো দিনটা মাটি করে দিস না মনীষ। সুধীর এটুকু বলে কী বলবে ভেবে একবার সোমার দিকে তাকাল, পরে মনীষের দিকে। ওর যেন মনীষকেই কিছু আঘাত দিতে ইচ্ছা করছে। বলতে ইচ্ছা হচ্ছে মামার দৌলতে তুমিও কম যাও না। কিন্তু সোমা সহসা একসঙ্গে এতটাকা খরচ করতে রাজি হয়েছে, এমন একটা খাবার টেবিলে আর হোস্টকে বিব্রত করে লাভ নেই। সে বলল, তুই নিতাইয়ের খবর জানিস?

না।

সে আত্মহত্যা করেছে।

বলিস কি!

সোমা বলল, আত্মহত্যা কেন?

আত্মহত্যা কেন সে তো সে বলতে পারবে।

এমন মানুষ কখনও আত্মহত্যা করতে পারে!

পারে। সব পারে, মনীষ খুব উদাসীন গলায় বলল।

সোমা বলল, ও তো কাজলকে বিয়ে করেছিল না?

একটা ছেলেও হয়েছে। বিনু বলল।

আহা রে! সোমার মুখটা যথার্থ খুব উদ্বিগ্ন দেখাল।

অশোকের এ—সব মৃত্যু—ফিত্যুর কথা শুনতে আদৌ ভালো লাগে না। চারিদিকে এখন অরাজকতা, রোজ মানুষ খুন হচ্ছে, বারাসতে এগারো জন, সকালে উঠেই এসব দেখতে দেখতে সে ভিতরে বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে থাকে। এখানে সারাদিন পর আসা একটু রিলিফের জন্য। বাড়িতে একগাদা ভাই—বোন। সে স্কুলে যতক্ষণ থাকে শান্তি, এখন আবার সে স্কুলও কর্তৃপক্ষ রোজ রোজ বোমাবাজির জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। কী করে যে দিনটা কাটে তার! সে বলল, স্রেফ আমরা খাব আর সুখের গল্প করব। এত দুঃখ চারিদিকে যে তাকানো যায় না। এখানে এসেও যদি তোমরা আত্মহত্যা—ফত্যা নিয়ে কথা চালাচালি কর—তো উঠে যাব।

ঠিক আছে বোস। মনীষ বলল। কেউ আর এ নিয়ে আলোচনা করবে না। তুই কি এখনও সেই জে.এন.অ্যাকাডেমিতেই আছিস?

কী করব ভাই। চেষ্টা তো করলাম। সুরেন্দ্রনাথে নাইটে একটা পার্ট টাইম হবার কথা ছিল। সে পর্যন্ত হল না। ওরা এইসব আন্দোলনের একটা কিনারা না হলে কিছু করছে না।

অশোককে দেখলেই মনে হয়, সে স্কুলের শিক্ষক বলে কেমন এখনও একটু মনমরা হয়ে আছে। আর সবাই কলকাতার কাছাকাছি কলেজে চাকরি পেয়ে গেছে। সে কোনো কলেজে কিছু করে উঠতে পারল না।

সোমা বলল, তাহলে অশোক তুমি একটা জায়গায় আছ?

অশোক বলল, তা আছি। কখন প্রাণটা যায়। তোমাদের কলেজে কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে না?

হচ্ছে না আবার! পরীক্ষা বন্ধ। বড়দি দুবার চেষ্টা করতে গিয়ে ভীষণ নাজেহাল হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি পারবেন না। কর্তৃপক্ষ স্কুলে পুলিশ পাহারা দেবে বলেছিল। তিনি রাজি হননি।

যা চলেছে!

আমরা কিন্তু আবার সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছি। মনীষ সবাইকে মনে করিয়ে দিল।

বিনু বলল, আমি, সোমা তোকে একটা অনুরোধ করব। রাখবি?

কী অনুরোধ? বলে সোমা মুখ থেকে চাদর নামিয়ে দিল। বিনু এতক্ষণ পর ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছে। বড় সুন্দর ঢলঢলে মুখ। বলল, তুই চোখে কোনোদিন কাজল দিলি না।

ও, সেই কথা?

না, সে কথা নয়। সেই গানটা গাইবি গুনগুন করে, আমরা সবাই শুনব।

কোন গানটা?

এখন নিজের ছায়ায় রচিছে কত মালা…। বড় ভালো লাগত এ—গানটা।

এটা কী গান গাইবার জায়গা?

তোকে জোরে জোরে গাইতে বলছি না। গুনগুন করে গাইবি। আমরা চুপচাপ কান পেতে শুনব।

বাড়িতে আয় না! কত গান শুনতে পারিস দেখব।

সে যাব’খন একদিন।

হয়েছে। কতবার বলেছিস, যাবি। কোনোদিন গেলি না।

যাব এবার ঠিক যাব। গাইবি?

না। এখানে গান গাওয়া যায় না।

মনীষ তুই বলে দেখ না।

তোর কথাই শুনছে না, আর আমার কথা শুনবে?

আবদুল জল রেখে গেল। বিনু অপলক দেখছে সোমাকে। ওর অনুরোধ রাখল না বলে কেমন দুঃখী মুখ নিয়ে বসে রয়েছে। মনীষ সে দুঃখ দেখে বলল, সোমা তুমি গেয়ে শোনাও না গানটা। তা না হলে, আবার একটা আত্মহত্যার খবরপাবে। পুলিশ ধরতেই পারবে না কেন সে আত্মহত্যা করল। মনীষ ব্যবহারে সব সময় ওদের খুব কাছাকাছি আসতে চাইল।

সোমা বলল, কী বাজে বকছ!

দেখলি তো আমাকে ও কী চোখে দেখে!

বিনু বলল, আমি সত্যি আত্মহত্যা করব সোমা। আমি লিখে রাখব, এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী সোমা। বালিশের তলায় রেখে গেলে দেখবে কেমন মজা।

ও বাবা, দরকার নেই, আমি গেয়ে শোনাচ্ছি। সে দু’বার গলা সাফ করে বলল, আচ্ছা তোমরা কী! একটা সময় অসময় নেই? তোমরা কী সবাই পাগল?

এখন খুব সময় অসময় দেখানো হচ্ছে। আগে তো, এই সোমা গা না, ব্যাস, গান আরম্ভ হয়ে গেল। টেবিলে তাল দিচ্ছে নিশীথ। তোমার নিশীথকে মনে পড়ে সোমা?

খুব।

সে বেটা এখন কৃষ্ণনগরে পোলট্রি করেছে।

এই না সে বলত, আমেরিকায় যাবে ডক্টরেট করতে?

কেন, করেছে তো। পোলট্রিতে। নানা জাতের মুরগি ব্রিডিং করাচ্ছে। সুধীর জলের গেলাসগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে এমন বলল। বেটা সারাজীবন হাঁস—মুরগি ব্রিডিং করল। নিজের কিছু হল না।

কার কী হয়েছে? তোমরা বাদে কে কী ব্রিডিং করতে পারছে?

সোমা বলল, আমরা কিন্তু টেবিল ম্যানার্স মানছি না।

সুধীর বলল, আমরা ভুলেই গেছিলাম এখানে একজন মহিলা বসে আছেন। এবং তিনি আমাদের বন্ধুপত্নী।

বিনু বলল, সুধীর তোর মুখ বড্ড আলগা। আজ ক’টা উইকেট ডাউন রে?

সোমা বিনুর এমন কথায় নিজেকে খুব সেকেলে ভাবল।

শীত আরম্ভ হয়ে গেছে। এ—বছর বিদেশ থেকে কোনো টিম খেলতে আসছে না।

পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ে। রঞ্জি ট্রফি আরম্ভ হতে অনেক দেরি। হয়তো ইংল্যান্ড—অস্ট্রেলিয়ার খেলার কথা বলছে। কিন্তু সে যতটা জানে খেলা আরম্ভ হতে আরও সপ্তাহখানেক বাকি।

সুধীর বলল, আজকের খবর জানি না।

অশোক বলল, শুনেছি শোভাবাজারে সকালের দিকে ওয়ান উইকেট ডাউন খেলা চলছে।

কারা খেলছে?

বলা নিরাপদ তো? বলে সে চারিদিকে তাকল। যা আজকাল দিন যাচ্ছে।

সোমা খুব উদ্বিগ্ন মুখে তাকাল। বলল, কেন কী হয়েছে? বল না শুনি।

ভাই আমার চোখে দেখা নয়। শোনা। চিৎপুরে ট্রাম—বাস বন্ধ।

সোমা এবার বুঝতে পারল। কোন পার্টি কার বিরুদ্ধে খেলছে আজকাল সে—সব আর খুলে কেউ বলতে চায় না। মনীষ এমন লক্ষ্মীছাড়া দেশের যে কী হবে ভেবে মুখ উদাস করে রাখল।

আবদুল খাবার রেখে গেছে। ওরা চিকেন—প্যাটিস এবং ক্রিম কফি খাচ্ছে। তখনই মনে হল সোমার, কয়েকটা টেবিল পার হলে একটা গোলাকার টেবিলে চার পাঁচজন খুব নিভৃতে কী যেন আলাপ করছে। এবং সবচেয়ে উঁচু লম্বা যে মানুষটি ওর দিকে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে, সোমার মনে হল মানুষটাকে সে কোথাও দেখেছে এবং খুব চেনা। অথচ সে মনে করতে পারছে না সে কে। কোথায় কীভাবে আলাপ। সোমা একটুকরো প্যাটিস মুখে দিতে দিতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

এ—জায়গা খুব পরিচিত জায়গা। অন্যত্র হলে সোমা ভয় পেত। বারবার ফিরে ফিরে তাকানো ওকে কেমন বিব্রত করে তুলছে। এবং কিছুটা চুরি করে দেখার মতো ভাব চোখে। সোমাও যতটা পারছিল সবার অলক্ষ্যে মাঝে মাঝে সেদিকে তাকাচ্ছে। এবং সেই চোখ যা তাকে কোনো দূরাগত স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে চাইছে।

বিনু বলল, আমাদের কিন্তু সেই গানটা এখনও শোনা হল না।

সোমা বলল, আমার ভালো লাগছে না। সোমার চোখ—মুখে এমন মায়া মাখানো যে বিনু আর ওকে অনুরোধ করতে পারল না। শুধু বলল, সোমা, আমরা বেশিদিন আমাদের মুক্ত জীবনকে ধরে রাখতে পারি না।

অশোক বলল এই আরম্ভ হয়ে গেল নীতিবাক্য।

না রে নীতিবাক্য নয়। ভেবে দেখ তো কী সুন্দর ছিল সেইসব দিনগুলো।

সোমা বলল, আমরা যে যার বাড়ি থেকে কত মিথ্যা কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য বের হয়ে গেছি। রোদ জল ঝড় মানিনি। ফিরতে রাত হয়ে গেছে। মাকে একবার সাপ্টে ধরে গালে চুমু খেলেই মা—র রাগ সব জল! কী বাবা দস্যি মেয়ে, মা বলত। একবার মনে আছে মনীষ, তোমরা আমাকে ম্যাড হাউসে নিয়ে গিয়েছিলে। জোর করে প্রথম এক পেগ জিন খাওয়ালে লাইমজুস দিয়ে, কী আমার ভয়, কিন্তু বাড়ি গিয়ে স্রেফ বলে দিলাম, মাথা ধরেছে কিছু খাব না। পার পেয়ে গেলাম। বেশ স্বপ্নের মতো মনে হয় দিনগুলো।

তা মনে হবে না কেন? মনীষ বলল, চারপাশে বন্ধুজন, বান্ধবী এবং উড়ে বেড়ানো। মেয়েদের তো ঐ স্বভাব, মধুটি খাব, কাঁটার ঘা—টি খাব না।

বাজে বকো না, সোমা এমন ভর্ৎসনার সুরে বলল। কেবল মেয়েদের বেলায় এটা খাটে না। তোমরাও কম যাও না বাপু। বলেই সোমা তাকাল দূরের টেবিলে, দেখল মানুষটা তাকে আবার চুরি করে দেখছে।

এখন আমরা উঠব। সোমা বলল।

এত তাড়াতাড়ি?

না রে, দিনকাল বড় খারাপ। আটটা বাজতেই রাস্তা ফাঁকা।

অশোক বলল, কী বই দেখলি?

মহান পরিচালকের বই।

কেমন দেখলি?

মনীষ তাকাল সোমার দিকে। খুব ভালো। সোমা কিছু হয়তো বলবে এ—ব্যাপারে। কারণ সোমার ভালো লাগেনি। ওর বোর করেছে। কিন্তু সোমা কিছু না বলতে সে কেমন উৎসাহ পেয়ে গেল। সে বলল, বোঝা যায় ফিল্মের যে আলাদা একটা ল্যাঙ্গোয়েজ আছে। সে তার নিজগুণেই ভাস্বর।

যা ব্বে? সুধীর কেমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তুই কবে থেকে আবার ফিল্ম ক্রিটিকের কাজ নিলি? শুনেছি তো ক্যাপিটালিস্ট বনে যাবার জন্য দিন—রাত উইকেটে দাঁড়িয়ে বেমক্কা খেলে যাচ্ছিস।

ফিল্ম—ক্রিটিকের কী আছে। তবে সাধারণ দর্শকদের ভালো নাও লাগতে পারে।

ওরা একটা নিটোল গল্প খুঁজতে চায়।

সে গল্পটা বল। সোমা মুচকি হাসল।

মনীষ কিছুতেই বলতে চাইছে না। সে বলল, ওদের কথা বাদ দাও। ওরা এসেছিল খুব একটা মারামারি, অথবা নিটোল প্রেম, কিংবা হত্যা রাহাজানি এসব দেখবে বলে।

তুই এটা কী বলিস! ওঁর মতো পরিচালকের কাছে সেটা কেউ আশা করে না। ওরা নিশ্চয়ই ওঁর ছবি দেখতে ভালোবাসে বলেই এসেছে।

সোমা বলল, বের হয়ে দেখি তিন যুবক আর এক যুবকের কলার চেপে ধরেছে। বলছে, বোঝাও কী দেখলে। একজন বলল, শালা তুমি আমাদের সিডিউস করছ। তুমি না বললে আমরা আসতাম না।

মানে! বিনু বলল।

মানে জানি না। সোমা বলল, দেখলাম, সে আমতা আমতা করে তার তিন বন্ধুকে বোঝাচ্ছে, আজকের দিনের কত বড় সমস্যা তিনি এই সামান্য সময়ের ভিতর তুলে ধরেছেন। প্রায় গীতিকাব্যের শামিল।

এ—ভাবে বই শেষ হয়! আজকের দিনের সমস্যা গীতিকাব্যের মতো!

হয় না?

ধুস শালা! তুমি বোঝ না কিছু, তুমি জান না ওর ডিউপার্ট আছে। ওটা পরে দেখানো হবে। বলে সেই বন্ধুর হাসি নকল করতে চাইল সোমা।

মনীষ সোমার কথায় কেমন ছোট হয়ে গেল। বলল, মুশকিল কী জানিস, এ—দেশের মানুষের একটা স্বভাব আছে, সে স্বভাবটা হচ্ছে যা বুঝি না তাই বোঝার ভান করি।

সোমা বলল, তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে বল।

আমি নিজের দিকে তাকিয়েই বলছি, ফিল্ম ওয়ার্লডে এটা রেভলিউশান।

বিনু বলল, আমি দেখেছি। আমার কিন্তু অন্য কথা মনে হয়েছে।

মনীষ ব্যাগ খুলে টাকা গুনছিল। সে না তাকিয়েই বলল, কী মনে হয়েছে?

তোমরা ব্লো—আপ দেখেছ কেউ?

অশোক বলল, আমি দেখেছি।

বিনু বলল, বইটা এলে তোমরা সবাই দেখো। তারপর আবার আলোচনায় বসা যাবে।

মনীষ বুঝল বিনু এ—ব্যাপারে আর এগুবে না। বিনু বাজে তর্ক করেও না, করতে ভালোও বাসে না।

মনীষ বলল, তবু তোরা সবাই দেখিস। না দেখলে বড় কিছু একটা মিস করবি।

আবদুল টাকার চেঞ্জ ফিরিয়ে দিল। সে বিশটা পয়সা রেখে বাকি সব তুলে সোমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে এমন ভাবতেই দেখল, দূরের টেবিলে সোমা কাকে দেখছে। প্রায় চুরি করে দেখার মতো।

মনীষের এটা ভালো লাগল না। সোমা যে ধরা পড়ে গেছে সে তার আচরণে এমন কিছু প্রকাশ করল না। সে শুধু বলল, আমরা যাচ্ছি!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
Pages ( 1 of 14 ): 1 23 ... 14পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *