দীনরাজ্যের এক রাজকন্যা-কথা – 1
একটা কথা জানি “অভাবে স্বভাব নষ্ট “— ঠিক, তাতো হতেই পারে। কিন্তু অভাবে দৈন্যতা নষ্ট? হ্যাঁ, আজ আমি ঋণী আমার স্মৃতির দুয়ারে এ কথার সত্যতায়। আমি দেখেছি সে রাজকন্যাকে, মনেতে ছবি অটুট। ষাটের দশক, বিংশ শতক। কলকাতার অনেক বাসা বদলাবার অভিজ্ঞতার চতুর্থ তম বাসা যখন তালতলাতে, আমার।
আমি কলেজে পড়ি, বাড়ি আর কলেজ অনবরত ব্যস্ত আনাগোনার। পাড়াতে অনেক বনেদী বাড়ি ভগ্নাবস্থায় আচ্ছন্ন। একদিন, দুদিন, তিনদিন সে রাজকন্যাকে দেখতে পেলাম, এক অ্যানিমিক রক্তলাল ভাঙা ইটের কারুকার্যমণ্ডিত এক বাড়ির সদর দরজার কাঠের ফ্রেমে। স্থির চিত্র আছে থেমে। একরাশ কোমড় চুম্বন চুল, গায়ের রঙ গৌরবর্ণ সদৃশ, নাম ধরে নেওয়া যাক “গৌরী”। ঝকঝকে মুক্তোমালার শোভায় প্রচ্ছন্ন সাবলীল হাসি। ” এই শোনো, এই শোনো” হাত নাড়ছে……. আমি ত অবাক চোখে তাকালাম।
আমায় ডাকছে !!! “হ্যাঁ গো, পাড়ায় নতুন বুঝি” উত্তর দিলাম, ” উ, আমরা…..কয়েক মাস হলো এসেছি।”
” ও…. তাই বুঝি, আগে দেখিনি কেন?” এর উত্তর ত আমার জানা নেই, তাই পা চালাতে যাচ্ছি। “এই, হ্যাঁ গো, এসো না আমাদের বাড়ি একটু, গল্প করি, তোমাকে—-তোমাকে আমার খুব ভালো লাগছে, মাই রি” — সাথে খিল খিল হাসি।
ঠিক এভাবে কথা বলতে আমি অভ্যস্থ ছিলাম না, কিন্তু বাঙালদেশের রক্ত,গড়েপিটে নিতে জানতাম। একটা আকর্ষণ বোধ!!! এগিয়ে এলাম। খোলাচুল মস্ত এক ঠাসা খোঁপা করে নিলো। মেয়েটির পেছনে গবগব করে ছাইরঙা ধোঁওয়ার সচল পরদা উড়ছে। মেয়েটি কি বুঝল !!! “গুলের আগুন ত, এখুনি ধরে যাবে” আমার হাত ধরল, “এসো না গো, চা খাওয়াবো” চোখ টিপে হাসতে লাগল। একদিন নয়, তিন চার দিন কলেজ ফেরৎ ঐ বাড়িতেই ঢুকেছিলাম।
সেদিন সম্মোহিতের মতো গৌরীর হাত ধরে ঢুকলাম। ভাঙা ফাটা লাল সিমেন্ট চাতালে তোলা উনুনে তখন দগদগে আগুন গোলা সাজানো হাঁসের ডিমের তাপ। একটা টুলে বারান্দায় এক কোনে সে বসতে দিলো। সারা বাড়ি সন্ধ্যার অন্ধকারের আলোয়ান গায়ে শুয়ে আছে— ভাঙা সিঁড়ি উপরে উঠবার, খড়খড়ি খোঁড়া আধশোয়া কাঠের পাল্লা নিয়ে জানলার ভেতরে ঘরের রহস্যময় জমাট কালো রঙ। আলো বলতে শুধু গনগনে আগুন গুলের।
একটা কেরোসিন কুপি জ্বালাল, হয়ত বা অতিথির জন্য, বিলাসি আপ্যায়ন। বাড়ির মধ্যে ঘোর এক অন্ধকার তখন দারিদ্রের প্রধান প্রসাধন। “বাড়িতে আর কেউ নেই, তোমার ভাইবোন?”
“ওমা…. আমার কোলে চারভাই।” খিলখিল হাসির সাথে, সাজানো মুক্তোর ঝিলিক— “এই ত রাতের রুটি করবো, আটায় জল ঠেসেছি”। দেখলাম অবিশ্বাস্য প্রাচুর্য, পাশে রাখা গামলায় পাহাড় স্তুপ আটার শীর্ষে ভিসুভিয়সের গহ্বর বোঝাই টলটলে জল। গৌরী হাসছে, সে কি অন্তর্যামী!!! বলে, ” ভাইরা, কেউ আসে দশটায়, কেউ বা এগারোটা, অনেকগুলো করে রুটি খায়, রাতে বাড়িতে থাকে , সকালে আবার কে কোথায় বেড়িয়ে যায়, সারাদিনে একবারও আসে না।” আরও বলে গৌরী— “এতো আটা, সব ত আমার মেজোভাই এনে দেয়….” কোথা থেকে, সে কি কাজ করে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আমার মুখে আটকে থাকল, গৌরীর গর্বিত হাসির মুক্তোমালার দোলায়। গৌরীর কথায় নেই কোন আক্ষেপ , নেই ক্ষোভের ঢেউ। সে যে, নদীর স্রোতে বয়ে চলা এক সদ্যোস্ফুট কুমুদ।
ঢোঁক চেপে বলি, “আর তোমার বাবা আর মা?” গৌরী হাসে, আবারও মুক্তোর ঝিলিক । বাবা আছে, এদিক ওদিক রাস্তায় পড়ে, খুব মদ খায় ত, বাড়ি আসে না…… আর আসবে কি, এলেই মা ঝাঁটাপেটা করে বার করে দেয়।” হি হি হি হাসি। না এ জগতের সাথে রিফিউজি ঘরের মেয়ের পরিচয় নেই। ” এই চা খাবে ত?” কালো তুবরে কেটলির চা ন্যাকরায় ছেকে আমাকে এগিয়ে দিলো। কাপটি সযত্নে রক্ষিত — ধরে রাখা আভিজাত্যমণ্ডিত। “দুধ ত নেই, কেমন লাগছে, আরটু মিষ্টি দি” উত্তর– “ননা” আমি দেখেছি, মিষ্টি মানে ভেলিগুড়। দেখেছি , গুড়ো চা ছেকে শুকোবার জন্য কাগজে ছড়িয়ে রাখা। চায়ের পুনর্ব্যবহার প্রথা। “তুমি কি সোন্দর দেখতে,দুগ্গাপতিমার চোখ…..” আমার মুখে মৃদু হাসি, “আমি সুন্দর?” “নয়, দিব্বি বলছি—” হি হি করে হেসে লুটিয়ে পড়ল। “কলেজে পড়ো? না…?” “বাব্বাঃ কত শিক্ষিত, কটা পাস দিয়েছ গো?” এই “কটা পাস” এর ব্যাপারটা আমার তখন জানা, প্রথম কলকাতা এসে বউবাজারের বসতিতে থেকে। ঝকঝকে সোনা গায়ে ফর্সা মেয়ে বউরা আমাদের বাড়ির ( নাম ছিল মাস্টরের বাড়ি) আমাদের নজর করতো কটা পাস দেওয়া ছেলেমেয়েদের। পাস মানে এক একটা মাইলস্টোন। মুখে এলো তিন…., কিন্তু শব্দ বেড়োল না। প্রয়োজন নেই, গৌরী যে শত পাসের ঊর্ধ্বে তা বুঝতে দেরি হয় নি।
“কি দিয়ে রুটি খাবে?”
“কেন, এইত, নটে শাক করব।”
এক চা চামচ সর্ষের তেল এক বিশাল কালো লোহার কড়াই— কড়াইয়ের পেটের তলে লাল দগদগে জ্বালা। ছ্যাৎ করে গৌরী নটে শাকে কড়া ভরিয়ে দিলো। গৌরীর মুখেও লাল আভা। তবে যে রাতের বেলা শাক খেতে নেই, মা(দিদিমা আমার) বলতেন, রাতে শাক খেলে নাকি………….. থাক ওকথা। জগতে নিয়ম সংযম সংস্কার সবই তাদের, যারা ভরপুর খেতে পান।
“তোমার মা কোথায়?” মুখে কি একটু মলিন হাসি! না কি আমার বুঝবার ভুল।
“মা? আছে , এদিক সেদিক, হয় আনাজপাতির দোকানে ফেলে দেওয়া তরকারি কুড়োচ্ছে বা কয়লার দোকানে ফেলে দেওয়া কয়লার গুড়ো জড়ো করছে। কয়লা গুড়ো ও মাটি দিয়ে, মা চমৎকার গুল দেয়। একবার ত দিনে উনুনে আঁচ পড়ে। জানো, গুলের আগুনে রুটি খুব ভালো হয়, ভাই রা আমার হাতের রুটি খেতে খুব ভালবাসে।” গৌরী আবারো হি হি করে হাসতে লাগলো।
দৈন্যতার পরাকাষ্ঠায় যিনি আছেন, চরম দৈন্যের তীক্ষ্ণ চাবুকে বা অনুকম্পার আঁচড়ে দাগ কাটতে কি কেউ পারে তার শরীরে?
কিন্তু আমি চমকে উঠে দাঁড়ালাম, ভাবলাম গৌরীর জগত ত এতো ছোট নয়— তার বিশাল জগত থেকে একটা জ্বলন্ত উল্কা আমায় ছুড়ে দিচ্ছে, শুধু।
সেদিন গৌরীর মাকে দেখতে পাই নি, পেয়েছি পরে একদিন। সেদিনও একই ভাবে গৌরী আমায় চা তৈরি করে দিলো। সেই “রুটি ও নটে শাক” মহাযজ্ঞের আয়োজন …. হঠাৎই দেখলাম, আপাদমস্তক মলিন শাড়িতে মোড়া, লম্বা শীর্ণ, মাথায় ঘোমটা — মা ঢুকলেন, হাতে এক শতছিন্ন কাপড়ের থলে, সেখান থেকে ফুঁচি মারছে কচু গাছের গোঁড়া।
আমাকে দেখলেন কিনা জানা নেই, হনহন করে ঢুকে, থলিটা রেখে আবার বেড়িয়ে গেলেন। দুটি নগ্ন হাত নয়, একহাতে সাদা শাখা, অপর হাতে লাল পলা, লাল রঙটি বড্ড চোখে জ্বলজ্বল করে উঠল—রবি লাল, অস্তমিত হলে সংসারে খাওয়া জুটবে না, সব নিভে যাবে। তারপর হঠাৎই খেয়াল হলো গৌরীকে আর ত দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন পর সেখানে উঠল আর এক দালান, বাড়ি। না, কোন চিহ্ন কোথায়, সেই খিলখিল হাসির সাথে কোলের ভাইদের জন্য রুটি ও নটে শাক রান্না করার সেই রাজকন্যা। হয়ত মনের মতো রাজপুত্রের দেখা পেয়েছিল, অথবা অন্য কোন উচ্চতর দীন আস্তানা, অথবা কানাঘুষায় চলতি খবর যেটা সবার প্রিয় মুখরোচক চানাচুরের স্বাদে —- পতিতা পল্লী। গৌরী কি পতিতা হতে পারে , না, আসলে কোন নারীই পতিতা হয় না, পতিত হয় পুরুষ। জনস্রোতের নদী বয়ে চলেছে—তরতর করে মোহনার দিকে, গৌরীর মাতাল জন্মদাতা, পড়ে আছে পথের ধারে ।লাল পলা হাতে সারাদিন
কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে—- কয়লার দোকানের ধারে স্তুপাকৃতি কয়লাগুড়ো বা দোকানের ফেলে দেওয়া আনাজপাতি , সে গৌরীর গর্ভধারিনী।আর ভাইগুলো সব দেশের ছেলে, প্রতি দুজনের একজন।
শত ঐশ্বর্যের মাঝেও রানির সিংহাসন অধিকার করতে না পারার মানসিকতার অভাব প্রায় সকলের— অথচ চূড়ান্ত দারিদ্রে, কজন মেয়ে হয়ে উঠতে পারে কাঙাল রাজ্যের রাজকন্যা!!!