Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দিনবদল || Ashutosh Mukhopadhyay

দিনবদল || Ashutosh Mukhopadhyay

বৃন্দাবন পালের পর্যন্ত একজন অনুগত সহকারী আছে। যারা জানে বৃন্দাবন পালকে তারা হাসে। কারণ বৃন্দাবনকেই তারা চিনির বলদ বলে ডাকে। তার সহকারী অমল দাস তাহলে কি?

বৃন্দাবন সীরিয়াস মানুষ। তার কানে তুলো পিঠে কুলো। কারো ঠাট্টা তামাশার ধার ধারে না। একাগ্র নিষ্ঠায় তার মনিবের সেবা করে চলেছে। যে কাজ তাকে করতে হয় তার ঝক্কি অনেক, বিপদও কম নয়। এ যাবত ঝামেলা অনেক পোহাতে হয়েছে, কিন্তু সত্যিকারের বিপদে কখনো পড়েনি। দুই একবার পড় পড় হয়েছে, কিন্তু মনিবই সামলেছে। মনিবের টাকার ওপর ছাতা পড়ছে, তিনি সদয় হলে টাকার ঝাটা মেরেই মুশকিল আসান করে দিতে পারেন।

বৃন্দাবনের খুব আশা, মনিব তার ওপর একদিন সত্যিকারের সদয় হবেন, ওর কদর বুঝে আর প্রভুভক্তি দেখে তার বুকের তলার কোন সূক্ষ্ম যন্ত্রে মোচড় পড়বে। তখন আর বৃন্দাবনকে পায় কে। মনিব তখন একটু হাত ঝাড়লেও যা পড়বে তাতেই বাকিটা কাল পায়ের ওপর পা তুলে সুখে কেটে যেতে পারবে। মনিব লোকটা যেমনই হোক, তার বুকের তলায় স্নেহ মায়া মমতা যে কিছু আছে সে-তো তার কুকুর দুটোকে দেখলেই টের পাওয়া যায়। স্থূল বপুখানা-নরম গদির সোফায় ছেড়ে দিয়ে আর ভারী। ভারী পা দুখানা মস্ত মস্ত দুটো অ্যালসেসিয়ানের পিঠে চাপিয়ে দিয়ে যখন আদর করেন, তখন তার থলথলে মুখে স্নেহ উপছে পড়তে দেখেছে বৃন্দাবন, আর সহকারী অমলকেও দেখিয়েছে।

একটাও ছেলেপুলে নেই, বউটাও মরে ভূত না কি পেত্নী হয়ে গেছে কোন্ কালে-এ-হেন ভাগ্যবান মনিব টাকার আণ্ডিল আগলে বসে থাকবেন আর কতকাল? মা-লক্ষ্মীর কৃপায় কুকুরের প্রতি ওই দরদের বাতাসটুকুও যদি বৃন্দাবনের দিকে ফেরে তাহলেও দিন ফিরে গেল।

সহকারী অমল, অতশত বোঝে না। ভবিষ্যত ভেবে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ে। বৃন্দাবন তখন তাকে ওই সব কথা বলে, বোঝায়, আশ্বাস দেয়। বলে, দিন। ফিরবেই একদিন দেখে নিস, ওই খামখেয়ালী মনিব হঠাৎ দেখবি দয়ার অবতার বনে গেছে। নির্ঘাত তাই হবে, উইল করে আধাআধি না হোক, চার ভাগের। একঙ্গ সম্পত্তি দেখবি আমাকেই দিয়ে গেছে।…বয়েস তো বাহাত্তর পেরুতে চলল, এত সব কাণ্ড মাণ্ডর পর কত দিন আর বাঁচবে–নেহাত পয়সার জোরে শরীরের ক্ষয়-ক্ষতি সামলে আসছে, নইলে কবে অক্কা পেয়ে যেত। কেউ তো বোকা বলবে না তাকে, নিজেই বোঝে সব, এই জন্যেই উকীল অ্যাটর্নির আসা-যাওয়া লেগেই আছে। দেখছিস না?… আর আজকাল কেমন মিষ্টি মিষ্টি হেসে আমার দিকে তাকায় লক্ষ্য করেছিস?

অমল দাস জবাব দেয় না, গুরুটি তার জবাবের প্রত্যাশাও করে না। নিজের অনাগত সুখ-স্বপ্নে বিভোর সে। তার বয়েস এখন উনচল্লিশ। আর এক আধ বছরের। মধ্যে দিন বদলাবে। নিশ্চয় বদলাবে। তখন ভোগের বন্যায় গা ভাসাতে বাধা কোথায়। সমস্ত রকমের কাল্পনিক বাধা একের পর এক নাকচ করে দিয়েছে। টাকা থাকলে সব বাধা জল। আর বয়েসটা তো কোন বাধাই নয়। তার মনিব এই বাহাত্তর বছরেও ভোগী। অবশ্য ভোগের সাধ যত আছে এখন আর সাধ্য তত নেই। তার ফলে যে সব কাণ্ড করে আনন্দ পেতে চেষ্টা করেন ভাবতে গেলে বৃন্দাবনের একটুও ভাল লাগে না। অত বয়সে ভদ্রলোকের একটু ধম্ম কম্মে মতি ফিরলে বরং বৃন্দাবনের সুবিধে হত। না, অত বয়সে বৃন্দাবন মনিবের মত হ্যাংলাপনা করবে না। বড় জোর ষাট বছর পর্যন্ত আনন্দের সময়। চল্লিশে তার দিন ফিরলেও আনন্দের ঢের সময়। পড়ে থাকবে। কম করে বিশটি বছর। অতএব তার হতাশ হবার কিছু নেই।

এ-সব কথা সে হামেশাই অমলকে শোনায়। অমল তার ভোগের ছটকাও কিছু কিছু জেনেছে। যেমন; একটা ভাল বাসায় থাকবে, ভাল জামা-কাপড় পরবে, একটু ভাল খাবে-দাবে, আর মনের মত একটা মেয়ে এনে ঘর বাঁধবে।…ওই পোড়ারমুখি যদি কোথাও থেকে তাকে দেখে তখন, হিংসেয় কালি হয়ে যাবে।

পোড়ারমুখিটা কে তাও অমল ভাল জানে। তারই মাসতুতো দিদি শ্যামা। সম্পর্কে অমল বৃন্দাবনের মাসতুতো শ্যালক। দুজনকেই একসঙ্গে আশ্রয় দিয়েছিল বৃন্দাবন। অমলের তখন পনের বছর বয়েস আর মাসতুতো দিদির একুশ। আর বৃন্দাবন পালের তখন একত্রিশ। অমলের বয়েস এখন তেইশ আর শ্যামাদি আজ যেখানেই থাক– তার উনত্রিশ।…শ্যামাদি বৃন্দাদার ঘর করেছে মাত্র দুটি বছর। তার মধ্যেই অনেকবার ঘর ভাঙার দাখিল হয়েছে, তবু কোন রকমে টিকে ছিল। বৃন্দাবন পাল তার মনিব সুমন্ত চৌধুরীর খাস সরকার আর মোসাহেব ছিল তখন। ফাঁই ফরমাশ খাটা বা হঠাৎ দরকারে ছোটাছুটির জন্য কর্তার ড্রাইভারের পাশে বসে স্টুডিওতেও আসতে হত। স্টুডিওর অনুগ্রহ-প্রত্যাশীদের কাছে সেই কারণে তার কদরও ছিল একটু। কর্তাটি ছবির রাজ্যের নামজাদা প্রডিউসার।

নিজের গুণেই বিশেষ নজরে পড়েছিল সে। দুদুটো ছবির ভবিষ্যত ভেবে কর্তা যখন মুষড়ে পড়েছিলেন, তখন টেকনিশিয়নদের সঙ্গে স্টুডিওতে সেই ছবি তন্ময় হয়ে দেখে বৃন্দাবন ছাড়া ওরকম ভবিষ্যদ্বাণী আর কেউ করেনি, কারণ কর্মকর্তারা মালিকের দুশ্চিন্তার ভাগ নেবার ফলে ভবিষ্যত সম্পর্কে রায় তেমন আশান্বিত হয়ে উঠতে পারেনি। বোকার মত সেই ছবিই হিট করবে রায় দেবার ফলে; তখনকার মত বৃন্দাবন বরং মালিকের বিরক্তিভাজন হয়েছিল। কিন্তু, সত্যি সত্যি সেই দুটো ছবিতেই অপ্রত্যাশিত ভাল লাভ হয়েছিল মালিকের। চৌধুরীমশায় সেইজন্য তাকে পুরস্কারও দিয়েছিলেন। এরপর দুদুটো প্রেস্টিজ ছবি করেছিলেন কর্তা। মালিকের। সঙ্গে সকলে একবাক্যে রায় দিয়েছে–ছবি হয়েছে বটে, একেবারে হাট! চৌধুরীমশাই সাগ্রহে বৃন্দাবনের মতামত জানতে চেয়েছেন। কিন্তু মাথা চুলকে সে বলেছে, আমি সবটা ঠিক বুঝতে পারিনি হুজুর-একটু হাই জিনিস তো…।

অন্য মোসাহেবরা হেসে উঠেছে। কর্তা নিজেও। কিন্তু ছবির ফলাফল দেখে সকলের চক্ষুস্থির। ওই দুই ছবিতে বহু টাকা লোকসান হয়েছিল মালিকের।

ফলে কর্তার কাছে বৃন্দাবনের খাতির আরো বেড়ে গেছে। বৃন্দাবনের ভাল লাগলে তবে তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। এই করেই ছবির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে লাগল বৃন্দাবন পাল। একটা দুটো করে কাজের ভার পড়তে লাগল তার ওপরে। বারকয়েক আধাবস্তি গোছের গরিব মহলে হানা দিয়ে ছবির জন্য কিছু একস্ট্রা মেয়ে সংগ্রহ করে দেবার ফলে এই কাজটাই ক্রমশঃ তার ওপর বর্তাল। নায়িকা বা সহ নায়িকা ছাড়াও এক সীন দুসীনের জন্য অনেক ভদ্র চেহারার মেয়ের দরকার হয়। দিন পিছু তাদের তিন টাকা পাঁচ টাকা রেট আর দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। এই কাজেই দস্তুরমত নাম কিনে ফেলল বৃন্দাবন পাল। সে যে-সব মেয়েদের আনে তাদের বেশির ভাগই মোটামুটি ভদ্র চেহারার, কেউ কেউ কথাবার্তাও কইতে পারে বেশ, আবার দুই একজন সুশ্রী মেয়েও বেরিয়ে যায় তাদের মধ্যে। ছবিতে মেয়েদের কোন ভিড়ের রোল থাকলেই বৃন্দাবন পালের কাজ বাড়ল।

কর্তা এ-কাজের জন্য একটা অল সেকশন ট্রামের মান্থলি টিকিট বরাদ্দ করে দিয়েছেন তাকে। আর মাইনেও কিছু বাড়িয়েছেন, কারণ, এ-কাজে একটু ভদ্র জামা-কাপড় দরকার।

বৃন্দাবন পাল সোৎসাহে এই কাজ করে চলেছিল। কিন্তু মুশকিলে ফেললেন তাকে কর্তা নিজেই। এক্সট্রা মেয়েদের মধ্যে কাউকে মনে ধরলেই ওকে ডেকে কানে কানে কিছু প্রস্তাব করেন। উদার মুখে দশ পাঁচ টাকা আগাম বখশিসও করে ফেলেন। তাকে। ওই প্রস্তাব শুনে গোড়ায় গোড়ায় ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করত বৃন্দাবন পাল। কিন্তু ভগবানের নাম করে সেই দুরূহ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে হয়নি। কর্তার নাম করে ভবিষ্যতের অনেক রকম লোভ-টোভ দেখিয়ে যেভাবেই হোক কর্তার পছন্দের রমণীটিকে বশে আনত। দেরি হলেও লেগে থাকত, কিছু খরচপত্র করত এবং শেষ পর্যন্ত বিফল হত না।

…কিন্তু মালিকের এই রোগ বাড়তেই থাকল। ছবির জন্য একস্ট্রা মেয়ের কোন সীন না থাকলেও কর্তার ঝোঁক চাপলে তার মনের মত মেয়ে সংগ্রহের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় তাকে। সে রকম কাউকে পেলে কর্তা দরাজ হাতে টাকা দেন, আবার সেরকম না হলে তার পছন্দের খোটাও দেন। এই ফরমাশ খাটতে গিয়ে এক একসময় গলদঘর্ম হয়ে ওঠে বৃন্দাবন পাল।

একবার একদঙ্গল মেয়ের মধ্যে থেকে একটি উদ্বাস্তু মেয়েকে আর স্টুডিওতে না নিয়ে গিয়ে সোজা নিজের ঘরে তুলল বৃন্দাবন। সেই মেয়ে অমলের মাসতুতো দিদি শ্যামা। কালোর উপরে দিব্যি সুশ্রী মেয়ে। আর চৌকসও। ঠারেঠোরে তাকাতে জানে, হাসতে জানে। এই মেয়ে কর্তার চোখে পড়লে আর রক্ষা নেই জানে। চোখে পড়তে দিল না। নিজেই বিয়ে করে বসল। দিন কয়েক বাদে শ্যামা তার মাসতুতো ভাই অর্থাৎ অমলকেও তার নিজের সংসারে টেনে নিয়ে এল। অমলেরও আর তিনকুলে কেউ নেই।

কিন্তু বৃন্দাবনের সংসার বেশিদিন টিকল না। তার ঘরে ছবির জগতের নীচু পর্যায়ের কর্মীদের আনাগোনা ছিলই। কিছু দিনের মধ্যেই শ্যামার চোখ খুলে গেল। বৃন্দাবন ওকে বিয়ে করে বঞ্চিত করেছে কানে এমন মন্ত্র দেবারও লোক জুটল। তার ওপর স্বামীটি কি কাজ করে বেড়ায় জানার পর থেকে শ্যামা বীতশ্রদ্ধ তার ওপর। কতদিন আঁঝের মুখে বলে বসেছে, তুমি আবার একটা মানুষ নাকি, কোনদিন তোমার মনিবের হুকুম হলে আমাকেই পাঠিয়ে দেবে তার কাছে-তুমি না পারো কি?

বৃন্দাবন পাল মনে মনে ভাবে মনিবের হুকুম হলে শ্যামা আর তার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে না, ছবিতে নামার আশায় নিজেই ছুটবে তার কাছে। মেজাজ ভাল থাকলে শ্যামা অনেকদিন মালিকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার কথা বলেছে।

যাই হোক, দুবছর না যেতে শ্যামা নিজেই তার ব্যর্থ জীবন সফল করতে ঘর ভেঙে দিয়ে চলে গেল। এক রাত্রিতে বৃন্দাবন ফিরে দেখে বউ ঘরে নেই। আর দিন দুই যেতে বুঝে নিল ওই বউ ঘরে আর ফিরবেও না।

কিন্তু চির অনুগতের মতই অমল দাস থেকে গেল তার কাছে। বউ চলে যাবার পর কিছুদিন পর্যন্ত সমস্ত মেয়ে জাতটার ওপরেই ঘেন্না ধরে গেছল বৃন্দাবনের। সেই ঘেন্নার ভাগ অমল দাসও নিয়েছিল। দুই এক বছর যেতে বৃন্দাবনের মন বদলেছে। আবার সে সুখের সংসার করার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অমল দাসের মন বদলায়নি। বৃন্দাদার কাজে সে যথেষ্ট সাহায্য করে বলেই ঘেন্না তার আরো বেড়েছে। মেয়েগুলোই দুনিয়ায় যত অনিষ্টের মূল ভাবে সে। বৃন্দাদাকে সে সাহায্য করে সম্পূর্ণ নিরাসক্তভাবেই। কসাইয়ের যেমন মাংস কাটা কাজ, অনেকটা সেই রকমই মনোভাব। বৃন্দাদার দিন ফিরলে তারও দিন ফিরবে এটুকুই আশ্বাস। কিন্তু দিন ফিরলেও কোন মেয়েকে নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখে না সে।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন একটা কাণ্ড হয়ে গেল। কলকাতার দিনকাল তখন। খুব খারাপ। হামলা মারামারি কাটাকাটি লেগেই আছে। কিন্তু অমল নিঃশত্রু ভাবে নিজেকে, তাই রাত্রিতেও নিঃশঙ্কে চলাফেরা করে।

সবে রাত তখন আটটা সাড়ে আটটা হবে। স্টুডিওর পিছনের নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছিল। বৃন্দাদার জন্য অর্থাৎ তার মালিকের জন্য একে একে তিনটে মেয়ের কাছে টোপ ফেলেও বিফল হয়েছে। ফলে ভিতরটা তেতে আছে তার। দুনিয়া থেকে মেয়েগুলোকে নির্মূল করে দিতে পারলে দিত। ওই বুড়ো হাঙর অর্থাৎ বৃন্দাদার মালিকের বিকৃত আনন্দের নিবৃত্তি যে কবে হবে তাও জানে না।

উঁচু রাস্তা, দুদিকে পোড়ো জমির ঢল। হঠাৎ অন্ধকারে মেয়ের গলার গোঙানি শুনে থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ, স্পষ্টই একটা চাপা আর্তস্বর কানে আসছে বাঁদিকের ঢল থেকে। অন্ধকারে ঠেকে-ঠোকে নীচু জমির দিকে পা বাড়ালো। আধা-আধি নেমেই সর্বাঙ্গ অবশ। সামনেই পুঁটলির মত পড়ে আছে একটা মেয়ে, অতি যন্ত্রণায় সে-ই কাতরাচ্ছে।

অমল দাস ঝুঁকে দেখল। তারপর পকেট থেকে দিয়াশলাই বার করে হাঁট মডে বসে দিয়াশলাই জ্বালল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই কাঠিটা নিভে গেল আবার।

অমল দাস তার মধ্যে যা দেখার দেখে নিল। বছর উনিশ কুড়ির একটা অপুষ্ট মেয়ে। কিন্তু বেশ সুশ্রী মুখখানা। এক পিঠ চুল। হাত পা গা ছিঁড়ে রক্ত ঝরছে।

কি যে করবে অমল দাস ভেবে পেল না। কিন্তু মেয়েটাই ককিয়ে উঠল, আমাকে তোলো

অমল মেয়েটাকে টেনে বসাল। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একটু বাদে ওকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমাকে বাঁচাও, ছুঁচোগুলো ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আমার হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছে! একটু জল খাব–

কিন্তু জল কোথায় মিলবে সেখানে? অমল টেনে তুলল তাকে। তারপর একরকম আলতো করেই রাস্তায় এনে দাঁড় করাল। পরনের জামা-কাপড় যেভাবে ছিঁড়েছে। আলোর দিকে যাবে কি করে ভেবে পেল না।

অন্ধকারে ভেঁপু বাজিয়ে একটা রিকশা আসছে। অমল দাস অন্য কোন দিশা না পেয়ে তাতেই উঠে বসল মেয়েটাকে নিয়ে। সেও প্রায় কোলে করে তুলতে হল। রিকশাওলাকে কৈফিয়ত দিল, হঠাৎ পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে, তাই

রিকশাওলাটা বিহারী। চাপা গলায় অমল মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাড়ি কোথায়? কোথায় যাবে?

কিছু জবাব পেল না। পিছনে মাথা এলিয়ে বেহুশের মত পড়ে আছে মেয়েটি। ধাক্কা দিল। কোন সাড়া নেই।

অমল ঘামতে শুরু করেছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে রিকশা নিয়ে সোজা নিজেদের ডেরায় চলে এল। দরজা খোলা দেখে আর আলো দেখে বুঝল বৃন্দাদা ঘরে আছে। একলাফে নেমে দু-এক কথায় ব্যাপারটা বলে তাকে টেনে নিয়ে এল। .. অজ্ঞান হয়ে আছে, তাকে নিয়ে এখন কি করা হবে?

কিন্তু বৃন্দাদাকে নিয়ে রিকশার কাছে এসে অমল হাঁ। মেয়েটা রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে যন্ত্রণার ছাপ। নিঃশব্দে কাঁদছেও।

অমল দাস বলল, তুমি না অজ্ঞান হয়ে ছিলে?

জবাব না দিয়ে মেয়েটা করুণ দুটো চোখ মেলে তাকাল শুধু।

বৃন্দাবন তাড়াতাড়ি বাধা দিল, অজ্ঞান হলেও জ্ঞান ফিরেছে দেখছিস না, এস এস, ঘরে এস। হাত ধরে ঘরের দিকে টানল তাকে। কিন্তু মেয়েটা সত্যিই জখম হয়েছে, হেঁটে আর আসতে পারছে না। বৃন্দাদা টেনেটুনে তাকে ধরে এনে বসাল। তারপর সর্বাঙ্গের আঘাত লক্ষ্য করে তক্ষুনি ডিসপেনসারির উদ্দেশ্যে ছুটল।

দুহাত কোমরে তুলে অমল দাস গম্ভীর মুখে তাকে দেখল একটু।

তোমার নাম কি?

অতসী।

ওভাবে ওখানে পড়ে ছিলে কেন?

ওরা চলন্ত গাড়ি থেকে আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।

অমল দাস আঁতকে উঠল, কারা ফেলে দিয়েছিল?

সংক্ষেপে যা শুনল তাতেই চক্ষুস্থির তার। কতগুলো বদমাস ছেলে অতসীকে জোর করে রাস্তা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল–পাড়ার চেনা গুণ্ডা ছেলে সব। সৎ মায়ের সঙ্গে তাদের খুব ভাব ছিল, মনে হয় সৎ মাকে টাকাও দিয়েছে ওরা। অনেক দূরে আসার পরে একটা পুলিশের গাড়ি হঠাৎ পিছু ধাওয়া করতে সেই ছুটন্ত গাড়ি থেকে ওকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ওরা পালিয়ে যায়। তারপর আর কিছু জানে না।

কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা কাটিয়ে অমল দাস বলল, রিকশাতে জ্ঞান ছিল তোমার তবু অজ্ঞানের ভান করে ছিলে কেন?

তুমি তাহলে বাড়ি দিয়ে আসতে চাইতে আমাকে।

বাড়ি যাবে না তো কোথায় থাকবে?

জানি না। বাড়ি গেলে বাবা আর সৎমা এবারে মেরেই ফেলবে আমাকে।

বাবা কি করে?

কলে কাজ করে…ভয়ানক মদ খায়। আর মায়ের কথা শুনে আমাকে মারে। আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসতে চাইলে আমি আত্মহত্যা করব।

মেয়েটাকে খুঁটিয়ে দেখল অমল দাস। রোগা একটু, নইলে মন্দ না। খাইয়ে দাইয়ে পুষ্ট করে তুলতে পারলে বৃন্দাদার লাভ মন্দ হবে না। মরুকগে, বৃন্দাদাই দায় সামলাক এখন, তার ভেবে কাজ কি?

বৃন্দাবন পাল একজন চেনা কম্পাউণ্ডার নিয়ে এল। সে ওষুধপত্র দিয়ে চলে গেল। তারপর অমলের মুখে সব শুনে বৃন্দাবনও খুব খুঁটিয়ে দেখে নিন মেয়েটাকে। তার চাপা আনন্দ গোপন থাকল না। অতসীর আদর যত্নের ব্যবস্থায় কোন রকম। কার্পণ্য করল না। আশ্বাসও দিল, তার সুব্যবস্থা সে-ই করে দেবে।

আর ভাগ্য এমনই, পরদিনই একগাদা ভাল ভাল একস্ট্রা যোগাড় করতে হল নতুন ছবির কাজের জন্য। তাদের মধ্য থেকে কর্তার চোখে লাগা দু দুটো মেয়ে একেবারে জলের মত টোপ গিলল। কর্তা তাদের এক মাসের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন নিজের বাগানবাড়িতে। আর সেই সঙ্গে বৃন্দাবনকে ঝোঁকের মাথায় দুশ টাকা বখশিস করে ফেললেন।

অতসীকে খুব পয়মন্ত মেয়ে ধরে নিল বৃন্দাবন।

এক মাসের মধ্যেই খেয়ে দেয়ে আর শান্তিতে থেকে শ্রী ফিরে গেল অতসীর। বৃন্দাবন দুচোখ ভরে দেখে তাকে আর আরো ভাল দেখার আশায় দিন গোনে। তাছাড়া মেয়েটার মস্ত গুণ, সুন্দর রাঁধতে পারে–খেতে বসে মনে হয় অমৃত খাচ্ছে। অমল আর বৃন্দাবন মাঝারি ঘরটায় থাকে, আর খুপরিটাতে অতসী থাকে।

এক মাসের মধ্যেই অমলের কাছে মনের কথা ব্যক্ত করে ফেলল বৃন্দাবন। অতসীকে বিয়ে করবে। এদিকের খুপরি থেকে অতসী নিজের কানেই শুনল প্রস্তাবটা। অমলের জবাবও। এরা কেউ রেখে ঢেকে কথা বলে না। অমল জবাব দিল, কেন ঝামেলায় পড়বে আবার, তার থেকে আর একটু তরতাজা করে নিয়ে তোমার কর্তার কাছে পাঠিয়ে দাও, এদিকে ফোটো ভাল উঠলে ছবিতে একস্ট্রা করেও রোজগার করতে পারবে–মোট কথা তোমারও পয়সা হবে ওরও হিল্লে হবে।

বৃন্দাবন পাল বিরক্ত। বলল, তুই বড় নৃশংস হয়ে গেছিস। অতসী আমার লক্ষ্মী, ওকে আমি কোথাও পাঠাতে পারব না– দিন-টিন দেখে সামনের মাসেই বিয়েটা করে ফেলব ভাবছি।

এদিকের খুপরি থেকে অতসী তার উদ্দেশে বড়-সড় ভেঙচি কাটল একটা। কিন্তু সেই সঙ্গে কৌতূহলও খুব। অমলদা ওকে কার কাছে পাঠিয়ে পয়সা রোজগারের কথা বলছে? ফোটো ভাল হলেই বা কি করবে?

বৃন্দাবন বেরিয়ে যেতে তার ওপর চড়াও হল। বাড়িতে মাঝে মাঝে দুই একটা মেয়ে এক একটা আবেদন নিয়ে আসে দেখে, কি চায় ঠিক বুঝে ওঠে না। কিন্তু গোড়া থেকেই অমল দাস অতসীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি বড় একটা। কেবল খেতে বসলে খুশি। বলে, তুই রাঁধিস বেশ, না হলে বৃন্দাদার কথায় তোকে কখনো বাড়িতে রাখতুম না–মেয়েছেলের ঝামেলা ভাল লাগে না।

অতসীও ফোঁস করে ওঠে, ঝামেলাটা কি?

ঝামেলা না তো কি, যে দেখে সে-ই জিজ্ঞেস করে কে?

তা জবাব দিলেই পারো?

কি জবাব দেব, বদ ছেলেদের ফুর্তি ফসকে এখানে এসে গেছে?

তা কেন, বলবে ভবিষ্যতে আপনার জন কেউ হবে।

অমল ওকে মারার জন্য তেড়ে আসে। অতসী ছুটে পালায়। যখন তখন এইরকম খটাখটি লেগেই আছে। যা করতে বলে একবারে শোনে না। তর্ক করে, অবাধ্য হয়। শাসন করতে গেলে বৃন্দাদার কাছে পালায়।

সেদিন অতসী সরাসরি এসে কৈফিয়ত তলব করল, কি ব্যাপার তোমাদের বল তো? আমাকে কার কাছে পাঠাবার কথা বলছিলে? আর ফোটোর কথাই বা কি বলছিলে?

অমল খেঁকিয়ে উঠল, তা দিয়ে তোর দরকার কি?

দেখ, বড় ভাইয়ের বউ হতে যাচ্ছি, দস্তুরমত মান্যিগন্যি করবে আমাকে–আর খবদ্দার তুই-তুকারি করবে না। তা আমাকে নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন আমি না শুনলে কে শুনবে?

যা যা এখান থেকে–বৃন্দাদার ভীমরতি ধরেছে

কেন, আমাকে বিয়ে করতে চায় বলে? তা তোমার আপত্তি থাকে তো জোর। দিয়ে বল না?

আমার কি দায় পড়েছে?

তাহলে কুপরামর্শ দিচ্ছিলে কেন?

দিচ্ছিলাম মেয়ে জাতটা অতি অখাদ্য জিনিস বলে।

অতসী হেসে ফেলল।–দুই একটা মেয়ে খেয়ে দেখেছ? বলে হাসতে হাসতেই পালাল সেখান থেকে।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে অতসীর বেশ ভাবনাই ধরে গেল। এখান থেকে নড়ার ইচ্ছে একটুও নেই। কিন্তু বৃন্দাবন পাল বিয়ে করতে চাইলেই বা ঠেকাবে কি করে? তাকে বিয়ে করার ইচ্ছে একটুও নেই। ওদিকে আর একজন তো কাছে গেলেই মারতে আসে।

ইনিয়ে বিনিয়ে বৃন্দাবন প্রস্তাবটা করেই ফেলল একদিন। তার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রায়ই একটু একটু জ্বর আর বুকের ব্যথায় ভুগছে। তাই মাঝে মাঝে আর কাজে বেরোয় না। সেই অবকাশে একদিন কথাটা বলে ফেলল।

শুনে অতসী ভয়ানক বিমর্ষ।–তা তো এখন হয় না। কেন? কেন হয় না?

আমার যে ভয়ানক ফাড়াআছে। জ্যোতিষী আমাকে দেখে মাকে আর বাবাকে বলেছিল। ফাড়ানা কাটতে বিয়ে হলে আমারও ক্ষতি হবে, যে বিয়ে করবে তারও খুব অনিষ্ট হবে। এই জন্যেই তো বাবা ঘরে রেখেছিল–

বৃন্দাবন চিন্তিত। কতদিন ফাড়া আছে?

একুশের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

এখন কত?

এই কুডির মাঝামাঝি।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল বৃন্দাবন, একটা বছর এমন কিছু দীর্ঘ নয়। তার পরেই কি মনে পড়তে পুলকিত। সেও তো গণক ঠাকুর দিয়ে হাত আর ঠিকুজী দেখিয়ে রেখেছে, আরো এক বছরের মধ্যে তার দিন ফেরার কথা। যোগাযোগ একেই বলে, দিন তাহলে সর্বরকম ভাবেই বদলাবে।

অতসীর ফাড়া কাটার কথা আর প্রায় একই সময় নিজের দিন বদলের কথা অমলকে না বলে পারেনি বৃন্দাবন। তুই তো কিছুই বিশ্বাস করিস না, কেমন মেলে দেখ এখন

শুনে অমল ভুরু কুঁচকেছে শুধু। এসব প্রসঙ্গই বিরক্তিকর তার কাছে।

বিরক্তি দিন দিন বাড়তেই থাকল, কারণ ভয়-ডর গিয়ে অতসীর হামলা দিনে দিনে বাড়ছে তার ওপর। কারণে অকারণে ঝগড়া করে, আবার বৃন্দাদার কাছে নালিশ করে ওকে বকুনি খাওয়াতে চেষ্টা করে। ওর কাজের জিনিস লুকিয়ে রাখে, ইচ্ছে করে জামার বোতাম ভেঙে রাখে। নিজেই অবশ্য আবার বার করে দেয়, বা পরিপাটি করে নতুন বোতাম লাগিয়ে দেয়। সেলাই করতে করতে দাতে করে সুতো কাটে যখন, অমলের দেখতে এক এক সময় ভালই লাগে। কিন্তু ভাল লাগার মেজাজ সব সময় থাকে না। উল্টে বেশির ভাগ সময় হাত নিশপিশ করে। কিন্তু গায়ে আঙুল তুললে বৃন্দাদার কাছে দশখানা করে লাগায়।

রেগে গিয়ে অমল বলে, তুই এখন থেকেই চাস না যে আমি এখানে থাকি নিজের একটা পেট আমি চালাতে পারব না ভাবিস, কেমন?

গম্ভীর মুখে অতসী জবাব দেয়, একটা পারবে, দুটো পারবে কিনা আমার সেই ভাবনা।

কি, বৃন্দাদার মত হাঁদা পেয়েছিস আমাকে? আমি যাব ঝামেলা বাড়াতে! বৃন্দাদা ছাড়ছে না বলে, নইলে আমি পালাতেই চাই, বুঝলি? তোর ফাড়া কাটতে আর বাকি কত?

ভাল মুখ করে অতসী-জবাব দেয়, সে-তত তোমার ওপর নির্ভর করছে–কাটিয়ে দাও না চট করে।

অমল দাস ভাবে, পূজো আর্চা দেওয়া বা জ্যোতিষীর কাছে ধরনা দেওয়ার অনুরোধ। জবাব দেয়, আমার দ্বারা কিছু হবে না, আমার সময়ও নেই আর ওসব কিছু বিশ্বাসও করি না। নিজেদেরটা নিজেরা বোঝগে যাও-বড় নিশ্বাস ফেলে অতসী জবাব দেয়, মেয়েছেলে…কত আর পারি।

এক বছরের দরকার হল না, মাস আষ্টেকের মধ্যে বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই দিন বদলের চাকাটা ঘুরে গেল। অতসীর ফাড়া কাটল, কিন্তু এতটা অকরুণভাবে কাটাতে চায়নি সে।

বৃন্দাবন আগের থেকে আরো বেশি ভুগছিল। কিন্তু মনিবের ভ্রূকুটির ভয়ে আর রোজগারের আশায় অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজে বেরুতে হত। এরই মধ্যে অঘটন ঘটে গেল। মনিবের কাছে মোটা বখশিসের ইংগিত পেয়ে একটি মোটামুটি শিক্ষিতা মেয়েকে লোভের টোপে প্রায় আটকে ফেলেছে ভেবেছিল। অদূর ভবিষ্যতে ছবির নায়িকা হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথাও বলেছিল তাকে। আর মনিবের সঙ্গে দেখাসাক্ষংও করিয়ে দিয়েছিল।…মেয়েটার বোধহয় ভালবাসার লোক ছিল একজন, কিন্তু তা নিয়ে বৃন্দাবন মাথা ঘামায়নি। অমন অনেক দেখেছে। কিন্তু সেই ভালবাসার লোক আর দুটো ষণ্ডামার্কা লোকের সঙ্গে দিনমানে খোলা রাস্তায় তার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল–তারপর বেদম মার। মুখে বুকে পিঠে কিল চড় লাথি। নাক মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরুতে লাগল। বৃন্দাবন পাল অজ্ঞান হয়ে মাটিতে গড়াতে লাগল।

তারপর হাসপাতাল। প্রায় সন্ধ্যার মুখে খবর পেয়ে অমল আর অতসী হাসপাতালে ছুটেছে। ওদের দেখে বৃন্দাবন কেঁদে ভাসিয়েছে।

দিন তিনেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আর একটা দিন গেলেই বাড়ি ফেরার কথা। পরদিন বিকেলে তাকে আনতে গিয়ে অমল আর অতসী শোনে বৃন্দাবন পাল মরে গেছে। ডাক্তার জানালো, রাতে করোনারি অ্যাটাক হয়েছিল, দুপুরের মধ্যে শেষ।

দিন তিনেকের চেষ্টায় অমল দাস কর্তা চৌধুরীমশায়ের নাগাল পেল। নতুন ছবি নিয়ে খুবই ব্যস্ত তিনি। বৃন্দাবনের মৃত্যুর খবর কানে এসেছে আগেই। অমলকে পরে। দেখা করতে বলেছিলেন।

বৃন্দাবনের জন্য দুঃখ করলেন একটু চৌধুরীমশাই। বড় কাজের লোক ছিল বললেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ওর বউটার কি দশা?

বৃন্দাবনের বউ পালানোর খবর চৌধুরীমশাই রাখেন না বোঝামাত্র অমল দাস শুকনো মুখে জানিয়ে দিল, পাগলের মত হয়ে আছে–এদিকে ঘরে একটা কপর্দকও নেই।

বাড়ির সেক্রেটারিকে ডেকে চৌধুরীমশাই হুকুম করলেন, বৃন্দাবনের দুশ টাকা মাইনে আর তিনশটা বাড়তি টাকা নিজে গিয়ে বৃন্দাবনের বউয়ের হাতে দিয়ে আসতে। আর অমলকে বললেন, সে ইচ্ছে করলে বৃন্দাবনের কাজ করতে পারে, কিন্তু তার মত খাঁটি হওয়া চাই।

মনে মনে বুড়ো হাঙরের মুণ্ডপাত করতে করতে সেক্রেটারিকে সঙ্গে করে ডেরায় ফিরল। মেয়েজাতটার ওপরে সে এখন মর্মান্তিক ক্রুদ্ধ। তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে অতসীকে টেনে এনে ঘরের মেঝেতে বসিয়ে দিল। পরনের কালো পেড়ে শাড়ির আঁচলে নিজেই ওর মাথা আর মুখ ঢেকে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, খবরদার একটা কথাও বলবি না, মালিকের সেক্রেটারি টাকা দিতে আসছে।

ছুটে গিয়ে সেক্রেটারিকে ডেকে নিয়ে এল। সে ভদ্রলোক মালিকের বক্তব্য শুনিয়ে। সামনে পাঁচশ টাকা রেখে চলে গেল।

অমল দাস ফিরে এসে দেখে অতসী তেমনি ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসে আছে, কিন্তু সামনে টাকা নেই।

টাকাগুলো দে।

এক ঝটকায় ঘোমটা সরিয়ে ফেলে ছদ্মকোপে অতসী বলল, আমাকে বিধবা সাজিয়ে টাকার কথা বলতে লজ্জা করে না তোমার? পাবে না যাও

এই রাগটুকু দেখতে কেন যেন অমল দাসের ভাল লাগল। বৃন্দাদা চলে যাবার পর থেকেই কেন যে অমলের দুচোখ থেকে থেকে ওর দিকে ফেরে ঠিক বুঝে ওঠে না। কিন্তু মেয়েছেলেকে আর এই জীবনে আমল দেবে না ও-বৃন্দাদা অসময়ে চলে গেল, ওরাই যত সর্বনাশের মূল। অতসীকে ওই বুড়ো হাঙরের কাছেই দিয়ে আসবে, তাতে মোটা কিছু টাকাও হাতে আসবে। তারপর এই কাজে ইস্তাফা দেবে।

অতএব অতসীকে না রাগিয়ে একটু ভেবে চিন্তে আপোসের সুরে বলল, ঠিক আছে ওই পাঁচশ থেকে আড়াইশ টাকা আমাকে দে, অর্ধেক তোর অর্ধেক আমার

অতসী জবাব দিল, সবটাই তোমার সবটাই আমার।

বিরক্ত হয়ে অমল চোখ পাকাল, তোর মতলবখানা কি শুনি?

পাল্টা ঝাঁঝে অতসী বলে উঠল, ছোটলোকের মত আর তুই-তোকারি করবে না বলে দিলাম! কোপের মুখেই হাসল আবার-মতলব ভাল, টাকার কথাই ভাবছিলাম দুদিন ধরে, ভগবান জুটিয়ে দিলেন–তোমার বৃন্দাদার মত ওই সব জঘন্য কাজ আর তোমার করা হবে না-ওই মোড়ের মাথায় একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান দাও–আমি তোমাকে পান সাজা শিখিয়ে দেব, আর ফাঁক মত নিজেও দোকানে বধ্ব। ফিক করে হাসল আবার, দোকানে সব পান খাওয়ার হিড়িক দেখবে তখন

অমল দাস তার অবাধ্য চোখ দুটোকে জোর করেই শাসনের গাম্ভীর্যে টেনে আনল।–তারপর?

তারপর নয় তার আগে–তার আগে বিয়ে।

অমল দাস জোর দিয়েই ঝাঁঝিয়ে উঠল, কার সঙ্গে কার বিয়ে?

আমার সঙ্গে শ্রী অমলচন্দ্র দাসের।

অসহিষ্ণু ঝাঁঝে একটা প্রলোভন থেকে নিজেকে ছিনিয়ে আনতে চাইল অমল দাস। ক্রদ্ধ মুখে বলল আমাকে ওই ফাঁদে পা দেবার মত আহাম্মক পেয়েছিস? বৃন্দাদা অকালে চলে গেল তোদের জন্যে–মেয়েগুলোর জন্যেই সক্কলে মরে বুঝলি? আমি ওর মধ্যে নেই।

অতসী তার মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। নির্লিপ্ত মুখ। জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মালিক চৌধুরীমশাইয়ের বয়েস কত?

সঠিক না বুঝেই অমল জবাব দিল বাহাত্তর ছাড়িয়েছে।

আর তোমার বৃন্দাদা কত বছর বয়সে গেল?

চল্লিশের আগে।

তাহলে?

কি তাহলে?

অতসী আরো গম্ভীর জবাব দিল, তাহলে প্রমাণ হল তুমি একটি পয়লা নম্বরের গবেট। মেয়েদের জন্যে মরলে চৌধুরীমশাই আরো তিরিশ বছর আগে মরে ভূত হয়ে যেত–মেয়েদের জন্যে কেউ মরে না, অন্যের জন্য মেয়েদের যাদের তাড়া করে। বেড়াতে হয় তারাই শুধু মরে।

অমল দাস হাঁ করে শুনল। তারপর হঠাৎই যেন কিছু তত্ত্বজ্ঞান লাভ হল তার। প্রশংসা-ভরা চোখে জ্ঞানদাত্রীটির দিকে চেয়ে রইল সে।

অতসী মেঝেতে বসেই ছিল তেমনি। এক লাফে এগিয়ে এসে তাকে আচমকা জাপটে ধরে মেঝের ওপরেই গড়াগড়ি খেতে লাগল অমল দাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress