দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 08
অনীকের হঠাৎ একটা কেমন সটকায় ঘুম ভেঙে গেল। নিশুতি রাত। মাথার ওপর এমনভাবে তারা জ্বলজ্বল করছে, এত অগণিত, এত ঘেঁষাঘেঁষি এবং এত নিচে যেন মনে হচ্ছে সে আকাশেই বসে আছে। কনকন করছে শীত। তার গায়ে ছিল বাবার একটা খুব গরম কুলুর শাল। সেইটা দিয়ে কান-মাথা ঢেকে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল জি.জি-র গায়ে ঠেস দিয়ে। প্রায় তৎক্ষণাৎ ঘুম ভাঙার কারণটা বুঝতে পারল অনীক। কেউ তার শালটা হাতিয়েছে। জি.জি. ভাগলবা। অর্থাৎ জি.জি-ই সেই শাল চোর। ছিঃ! তার গায়ের কোট স্লিপোভার ইত্যাদি ভেদ করে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ শীতের ছুঁচ গায়ে বিঁধছে। আশেপাশে বেশির ভাগ লোকই ঘুমোচ্ছে। আবার অনেকে জেগে জেগে। বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে এক বৃদ্ধ বাউল মৃদুস্বরে গান করে যাচ্ছেন। বাউলনী খুব ফর্সা, যদিও চুলগুলো একেবারেই পাকা। তিনি শুধু তাল দিয়ে যাচ্ছেন হাতের যন্তরটা দিয়ে। কাছেই কোথাও মাইক লাগানো হয়েছে, বেশ আলোকিত মঞ্চ। সেখান থেকেও গান ভেসে আসছে। সে কণ্ঠটি কচি।
—এ ছোকরা আজকাল শহর-বাজারে খুব নাম করিচে—পাশের লোকটি অনীককে বলল—তবে কী জানেন? আসল ধারাটি এ নয়, বাউল গান সাধনের অঙ্গ তো। সে তো আর কণ্ঠের ক্যারদানি—কসরৎ দেখাবার জন্যে সিষ্টি হয়নিকো। এই সব ছোকরা-ছেলেরা দুটো দিন খুব গাইবে, তাপর আজ্ঞে ডুবে যাবে। হদিশ পাওয়া যাবে না।
উঠতে গিয়ে অনীক দেখল সে যেন জমে গেছে। সারা শরীরে খিল ধরে গেছে। পাশের লোকটি তার অবস্থা বুঝে বলল—আমি আপনার পায়ের আঙ্গুল চেপে ধরচি, আপনি আস্তে আস্তে পা ঠুকুন।
—আপনি পা চেপে ধরলে আমি কী করে পা ঠুকব?
—তা-ও তো বটে! তয় আপনি পা ঠুকুন। আমি আপনাকে ধরে আছি।
—আমার পাশে একটি ছেলে বসেছিল, সে কতক্ষণ উঠে গেছে, জানেন?
—কত জনা আসে, কত জনা যায়, কে কার খপর রাখে দাদা।
পা ঠোকার ফলে তখন অনীকের সর্বাঙ্গে ছুঁচ ফুটছে। সে রেগে-মেগে বলল—আমার শাল চুরি করে নিয়ে গেছে! জানেন?
—বন্ধুতে বন্ধুর শাল-চাদর চুরায় এই পেরথম শুনছি।
—বন্ধু না আরও কিছু, একটা গোপালগোবিন্দ কোথাকার। বলতে বলতে টলে টলে অনীক ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে গ্রামের পথ দিয়ে চলেছে অনীক। মনের ভেতরে ভীষণ রাগ। কারবাইডের আলো জ্বলছে একটা আসরে, তার তীব্র আলো তার ঘুমপিয়াসী চোখে পড়ে বিঁধছে বিশ্রীভাবে। কয়েকবার জগিং করে সে শরীরটা একটু গরম করে নিল। আলো জ্বলা আসরটা থেকে যশ আর গোপাল বেরিয়ে এলো। দিব্যি চামড়ার উইন্ডচিটার পরা দুজনের। কদম কদম চলছে, কোনও ক্লান্তি-ফান্তি নেই। আসরের আলোয় বোধ হয় চোখ ঝলসে আছে। অনীককে দেখতেও পেল না। নিজেদের কথাতেই মগ্ন হয়ে চলেছে।
উত্তুরে হাওয়া ওদের দিক থেকে সনসনিয়ে বয়ে আসছে অনীকের দিকে। কানে এলো যশ বলছে—আগের দুবার তবু দেখতে পেয়েছি। এবার যেন হাওয়া হয়ে গেল, অথচ আংকলকে আমি কথা দিয়েছি। তা ছাড়া আমারও তো একটা রেসপো আছে।
—কথা বলেছিস?
—আরে বাবা, আমার কাছেই তো আংকল-এর রেফারেন্সে এসেছিল। রিসার্চ করছে বাংলার বাউলদের ওপর।
গোপাল বলল—আচ্ছা যশ, একটা জিনিস লক্ষ করেছিস আজকাল এই সাহেব মেমদের বাংলার এটা-ওটা নিয়ে রিসার্চের ব্যাপারটা অদ্ভুতভাবে বেড়ে গেছে! তুই এখন যে কোনও ইউনিভার্সিটিতে ঝোলা তাপ্পিমারা বারমুডা আর ফতুয়া পরা কটাশে চোখ-নীল চোখ পশ্চিমাদের ঘুরতে দেখতে পাবি। কাজ চালানোর মতো বাংলাও এঁরা জানেন। কেউ শিশু সাহিত্যের ওপর, কেউ জীবনানন্দ, কেউ সেই রবীন্দ্রনাথ, তারপর ভাদুগান, আলকাপ, পটুয়া—এসবও আছে, প্রচুর প্রচুর। কেন বল তো?
যশ বলল—আরে, ওদের নিজেদের তো কোনও হিসট্রি নেই। নিজেদের নিয়ে কত আর করবে? ওদিকে অ্যালেক্স হেইলির পরে এখন সব রুটস খোঁজার ফ্যাশন হয়েছে। আসল আমেরিক্যান বলতে যে রেড ইন্ডিয়ান তাদের তো মেরে তুবড়ে দিয়েছে। যারা রয়েছে তারা রাশিয়ান, জাপানি, আইরিশ, স্কটিশ, স্প্যানিশ, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান, ইটালিয়ান, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, ইরানি—কে নয়? সব এখন সুড়সুড় করে যে যার শেকড় খুঁড়ছে। কিংবা গুরু খুঁজছে। সাবজেক্ট সব একজস্ট করে ফেলেছে, কাজেই এখন ইন্ডিয়ার দিকে ফিরছে—এরকম একটা রিচ হিসট্রি—এত লোকশিল্প …
—আর কোথাও নেই বলছিস? গোপাল বিদ্রূপের সুরে বলল—তোদের এই বাঙালিদের আত্মগরিমার অভ্যেস আর গেল না।
—হেই হেই আমি বাঙ্গালি নই, শিখ আছি—যশ বলল। গোপাল বলে উঠল—শিখ তুই ধর্মে, কিন্তু তোরা তিন পুরুষ ভবানীপুরে বাস করছিস, বুকে হাত দিয়ে বল তো একবার তুই বাঙালি নয়! পাঞ্জাবি!
—আরে তা যদি বলিস পাঞ্জাবে লাহোরে দাঙ্গা হল আমাদের ফ্যামিলি তো ভাই দিল্লি গিয়ে এখানে চলে এলো। বললে সিকিওর জায়গা, বঙ্গালি বহুৎ অচ্ছা ইনসান আছে। দ্যাখ গোপাল রুটস খুঁজতে গেলে দেখব পঞ্জাবে আমাদের কমসে কম একটা খেতি-বাড়ি ভি নেই। তো আমরা কী?
—আহা দুঃখু করিস কেন? তুই বাঙালি রে।
অনীক ওদের পায়ে পায়েই হাঁটছিল। যশকে বলতে শুনল—আর একটা কথা গোপাল—আত্মগরিমা বললি না? পৃথিবীতে এমন কোনও জাত নেই যে আত্মগরিমা করে না। জার্মান বলল—আমরা শ্রেষ্ঠ, য়িহুদি বলল—আমরা চোজ্ন্ রেস। ইংরেজদের তো কথাই নেই। সবাই গর্ব করে, তবে আমরা বাঙালিরা বড্ড আত্মগ্লানিও করে থাকি। এটা ভালো নয়, একটা জাতিকে জুজুবুড়ি করে দেয়।
—তা বলে আত্মসমালোচনা থাকবে না?
—অবশ্যই থাকবে, এবং লাইক চ্যারিটি, সেল্ফ ক্রিটিসিজম শুড বিগন ফ্রম হিয়ার, দ্যাট ইজ হিয়ার অ্যান্ড নাউ—বলতে বলতে অনীক সামনে এগিয়ে গেল।
—আরে অনীক, শালা উল্লু কাঁহিকা। কুথাকে ছুপিয়ে ছিলি বাবা?
—আমরা তো ভাবলুম অনীক শালা আবার সেই পথের ধারে ফিরে গেছে। ঢুকু ঢুকু চালাচ্ছে—মাইরি তুই দেখালি বটে!
—কী দেখালুম? দেখাচ্ছিস তো তোরা—একটা হাফনোন সন্দেহজনক চরিত্রের সঙ্গে আমাকে ভিড়িয়ে দিয়ে নিজেদের গোপন মিশন নিয়ে অভিযান চালিয়েছিস। বাদই যদি দিবি, তো আনলি কেন?
—আরে বাদ দোব না বাদ দোব না, ইউ মিসআনডারস্ট্যান্ড আস। আগে একটা কথা বল—এখানে এত আসরে তো ঘুরলি কোথাও অল্পবয়সী গোরী গোরী বাউলনী দেখলি?
ভেবেচিন্তে অনীক বলল—গোরী গোরী তো দেখেছি, কিন্তু অল্পবয়সী নয়। মাথার চুল রীতিমতো পাকা। কিন্তু সব কিছু আমায় খুলে না বললে আমি তোমাদের সঙ্গে আর নেই। একটি কথাও আর বলছি না। মুখে কুলুপ।
ভীষণ ধাক্কায় তীর্ণার ঘুম ভেঙে গেল। দেখে আধো অন্ধকারের মধ্যে রাংতা তাকে প্রাণপণে ঠেলছে। তীর্ণা চোখ মেলেছে কিন্তু ভালো করে মেলতে পারছে না। ঘুমের মাসি ঘুমের পিসি চোখ জুড়ে পিঁড়ি পেতে বসে এখনও। শরীরটাও কীরকম শিথিল হয়ে আছে।
রাংতা বলল—তীর্ণা, তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারছো না, এখানে কোনও বাথরুম নেই। মাঠে-ঘাটে যেতে হবে।
মুহূর্তের মধ্যে তীর্ণা টানটান, ঘুম চোখ থেকে এক লাফে নেমে পালিয়েছে। সে ভারী-ভারী ধরা গলায় বলল—তা হলে উপায়?
—উপায় একটা নির্জন স্থান খুঁজে বার করা। শিগগির চল বেরিয়ে পড়ি।
একটা ব্যাগে ওরা নিজেদের জামাকাপড় তোয়ালে সাবান পেস্ট সব গুছিয়ে নিল। তীর্ণা বলল—চান করার তো প্রশ্নই নেই। সারা দিনই প্রকৃতি আমাদের ঠাণ্ডা জলে চান করিয়ে চলেছে।
দুজনে বেরিয়ে পড়ে খানিকটা এসেই ভীষণ ঘেন্নার দৃশ্য দেখতে পেল। অন্ধকারের মধ্যে রাস্তার দুধারে মেয়েপুরুষ সব বাথরুম সারছে। তীরবেগে ওরা মেলার চত্বর থেকে বেরিয়ে এলো। রাংতা বলল—ছেলেগুলো কোথায় গেল বল তো? এত সংগীতভক্ত ওরা কিন্তু আগে ছিল না।
তীর্ণা বলল—তুই কাদের কথা বলছিস। আমি যদুর জানি আমার দাদা খুবই সংগীতভক্ত, আর গোপাল এইসব লোকসংগীতের নাম শুনলেই লাফিয়ে ওঠে। তা হলে? যশ? যশ সম্পর্কে অবশ্য আমি কিছু জানি না।
রাংতা খুব কায়দা করে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।
ক্রমশ ওরা কেঁদুলি ছাড়িয়ে ধানক্ষেতে ভরা অন্য কোনও গাঁয়ে এসে পড়ল। দিগন্ত পর্যন্ত শুধু ধানক্ষেত, তা-ও বেশির ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে, ক্ষেতময় নাড়া উঠে উঠে আছে। কোথাও কোথাও আবার কপিক্ষেত, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন।
পরস্পরের দিকে ওরা হতাশ চোখে চেয়ে রইল। এরকম ঝোপঝাড়হীন প্রকৃতি ওরা আগে কখনও দেখেনি।
তীর্ণা বলল—থেমে কী হবে? চল।
গ্রামের পরে গ্রাম পেরিয়ে চলেছে। ক্রমশই ওরা অজয়ের তীর ঘেঁষে চলছে। অজয়ে বড় বড় বালির চড়া। মাঝে মাঝে পরিষ্কার জল।
যেতে যেতেই ওরা সূর্য ওঠা দেখল। অবশ্য দেখল যখন বেশ কিছুটা উঠে গেছে।
তীর্ণা বলল—কখন কোথা দিয়ে ভদ্রলোক উঠলেন। টের পেলুম না।
রাংতা বলল—কেস আরও খারাপ হয়ে গেল।
এমন সময়ে ওরা দেখল সামনে দিয়ে হন হন করে একটি মেয়ে আসছে। তাদেরই মতো সালোয়ার কামিজ পরা। রংটা খুব ফর্সা। পাঞ্জাবি-পাঞ্জাবি চেহারা। ওদের দেখে মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছাকাছি হতে বলল—বেড়াচ্চে?
রাংতা বলল—বেড়ানোটা ইনসিডেন্টাল, উই আর লুকিং ফর আ বুশ। তার মুখে অপ্রস্তুত হাসি।
—জোপজাড় আছে, একটু এগোচ্চে, নদীর ধারে। সুবিদে আচে। আচ্চা, বিদায়, নোমোস্কার।
মেয়েটি হাসিমুখে নমস্কার করে চলে গেল।
তীর্ণা বলল—কীরকম আড়ষ্ট উচ্চারণ, ও কোন দেশি বলো তো?
রাংতা বলল—কীরকম দোআঁশলা দোআঁশলা টাইপ।
যাই হোক ওরা ওদের প্রার্থিত ঝোপঝাড় পেয়ে গেল।
রাংতা বলল—অজয়ের জল আমাকে টানছে কিন্তু।
তীর্ণা বলল—আমাকেও।
—দুজনে একসঙ্গে নামলে আমাদের ব্যাগ কে দেখবে?
—দুর, কে নেবে এখানে? বলতে বলতে রাংতা নামতে লাগল, এবড়ো-খেবড়ো পাড় বেয়ে বেয়ে। খানিকটা চড়া তারপর জল, তারপর আবার চড়া। জলটা এত স্বচ্ছ যে তলার নুড়ি, মাছের খেলা সবই দেখা যাচ্ছে। দুজনে মুখ হাত ধুতে গিয়ে, জলে একেবারে শুয়ে পড়ল।
—ঠিক একটা বাথটাবের মতো জায়গাটা। দেখেছিস?
—একটুও শীত করছে না দেখেছিস!
—কী আরাম!
—এত বড় বাথরুম, এত বড় বাথটাব জীবনে দেখিনি। কী অপূর্ব, না রে?
দুজনে আরামে সাঁতার দিতে লাগল।
—কোনটা বেশি ভালো? রাংতা জিজ্ঞেস করল—কাল রাত্তিরের গান না আজ সকালের চান?
তীর্ণা হেসে বলল—তুই তো পদ্য করে ফেললি একটা। সাধে কি আর কবিরা ইনসপিরেশনের জন্যে প্রকৃতির কাছে যান। ও মা আবার পদ্য হয়ে গেল। দুজনে খিলখিলিয়ে হাসল।
রাংতা বলল—আমার কথাটার জবাব দে!
—দুটো দুরকম ভালো। রাংতা। এটা দেখ শরীরের আরাম। ওটা ইসথেটিক…
—আমি তা মানি না। এই নদীতে চানটাও ইসথেটিক। ওই গান আর এই চান আমাকে অন্তত একইভাবে স্টিমুলেট করছে।
—তুমরা তো বাঙালি?
ওরা অবাক হয়ে দেখল সেই মেয়েটি কোথা থেকে সাঁতার দিতে দিতে ওদের খুব কাছে এসে পড়েছে।
—তুমি এখানে?
—আমি অজয় জলে সাঁতার দিতে বালোবাসছে।
—আমরাও ভালোবাসছে। বলে তীর্ণা হাসতে লাগল
রাংতা বলল—আমি রাংতা, ও তীর্ণা, তুমি?
—রাং রুং রুংটা অ্যান্ড টির্না, টিনা নোয় মাঝকানে আর, টির্না। রুংটা টাইট্ল হয়, জানে।
—আমারটা টাইটল নয়, নাম। আমার টাইটল চ্যাটার্জি।
—রুংটা চ্যাটার্জি।
রাংতা ওর নামের উচ্চারণ সংশোধন করে দিল না আর।
মেয়েটি বলল—তুমরা বাঙ্গালিরা এ তো ইংরেজি মসালা দিয়ে কথা বলো কেন? তখন বলচিলে ইসথেটিক। নান্ডনিক বললে কী হোয়? স্টিমুলেট না বলে প্রেরণা দিচ্ছে বলতে পার তো।
ওরা অবাক হয়ে গেল। অবাক মানে একেবারে অ-বাক।
—আমি বাংলা পড়ছি—ফাদার জেনকিনসের কাছে। আমি টেগোর বলি না, বলি—টাকুর।
তীর্ণা চুপি চুপি বলল—কী রে ইমপ্রুভমেন্ট হল কিছু? এ যে ঢেঁকুর ঢেঁকুর শোনাচ্ছে।
মেয়েটি আপন কথায় মশগুল, বলল—
আজি এ প্রভাটে রবিড় কড়
কেমনে পশিল প্রাণেড় পড়
কেমনে পশিল গুহাড় আঁধাড়ে প্রভাট পাখিড় গান
না জানি কেন ড়ে, এটদিন পড়ে ঝাগিয়া উটিল প্রাণ
—বিস্ময়কর! অদ্ভুত! বলতে বলতে তীর্ণা হাততালি দিতে লাগল, রাংতাও তাতে যোগ দিল।
—আমি আঢুনিক কবিও জানি
আলো অনঢকারে যাই মাঠার ভিতড়ে
কোনও এক বোঢ কাজ কড়ে
বলতে বলতে মেয়েটি সাঁতরাতে লাগল। দূর থেকে ভেসে এলো—বোঢ জন্ম লয় বোঢ জন্ম লয়। কোনও এক বোঢ …
ওরা দুজনেই এত আশ্চর্য আর অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে জল থেকে উঠতে মনে ছিল না। বাথটাবের মতো জায়গাটাতে মুখোমুখি শুয়ে শুয়ে ওরা পরস্পরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।
তীর্ণা বলল—রাংতা তুমি খুব সুন্দর।
রাংতা বলল—আশ্চর্য, আমি এই কথাটাই তোমায় বলতে যাচ্ছিলাম। ইউ আর লাভলি।
—ধুর, আমি তো কালো।
—তাতে কী হলো, তাতে তোমাকে আরও ভালো দেখায়। দা বিউটি অফ আ স্পেশ্যাল কাইন্ড। আমি যদি ছেলে হতাম তো ঠিক তোমার প্রেমে পড়তাম।
তীর্ণা হেসে বলল—সত্যি-সত্যি ছেলে হলে আর কথাটা বলতে না। তখন গোরে গোরে মুখড়েপে কালা কালা চশমা …
দুজনেই হেসে উঠল। এবং তখনই ওদের খেয়াল হল ওই অদ্ভুত পাঞ্জাবি না সিন্ধি মেয়েটির কোনও পরিচয়ই নেওয়া হয়নি, এমনকি নামটা পর্যন্ত জানা হয়নি।
তীর্ণা বলল—মেয়েটিকে আমি যেন কোথায় দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। ভীষণ চেনা মুখ। বলতে বলতে সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল। যেন স্মৃতির অতলে ডুব দিয়েছে মেয়েটির মুখের খোঁজে।
ওরা জল থেকে উঠছে দূর থেকে তিন পুঙ্গবকে আসতে দেখা গেল। ওদের দেখে দূর থেকেই মুখের দুপাশে হাত রেখে ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠল।
তীর্ণারা ভাব দেখালো যেন ওদের দেখতেই পায়নি।
শীতের বাতাস ভিজে শরীরে লেগে ওরা তখন হি-হি করে কাঁপছে। রাংতা বলল আমি ঝোপের পেছনে যাচ্ছি, তুই আমায় গার্ড কর।
দুজনেই জামাকাপড় বদলে, ঘাসের ওপর বসে আয়না বার করে চুল আঁচড়াচ্ছে। তিন পুঙ্গব লেফ্ট-রাইট লেফ্ট-রাইট করতে করতে এগিয়ে এলো।
—কী রে? ইন্ডিপেন্ডেন্ট?
—আমাদের সঙ্গে কথা বলবি না?
—হঠাৎ লেডিজ সিট হয়ে গেলি যে!
এতক্ষণে উত্তর দিল রাংতা—আমরা হইনি, আমাদের করা হয়েছে, ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তো আমরা নিজেদের পথ নিজেরা দেখে নিচ্ছি।
যশ উবু হয়ে বসে বলল—কসুর মাফ কিজিয়ে মেমসাব।
—বাঙালি মেয়েকে মেমসাব বললেই খুশি করা যায় না। মার্জনা ভিক্ষাও হয় না।
—যাব্বাবা—গোপাল বলে উঠল কর্নার কিকে গোল করে দিলে বাবা। একটা চান্স দিলে না?
অনীক বলল—মার্জনা ভিক্ষা? অদ্ভুত তো? কনভেন্ট-এডুকেটেড নব্য বঙ্গ মেমরা কথাটা জানে?
রাংতার হাতে একটা ছোট পার্ফুমের শিশি ছিল, সেটা সে জোরে ছুঁড়ল অনীককে লক্ষ্য করে।
অনীক সেটা লুফে নিয়ে বলল—
বাঁচিয়ে দিলুম রাংতার গায়ে অভ্রের কুচিগুলকো
আজ প্রাতরাশে জুটবে বোধহয় ময়দার লুচি ফুলকো।
গোপাল বললে—তুই তো সত্যি-সত্যি কবি হয়ে গেলি রে অনীক। শালা! আজ তো মহুয়া-টহুয়া …
যশ তাকে চোখ টিপে থামিয়ে দিল।
রাংতা গম্ভীরভাবে বলল—আমি অবশ্য কনভেন্টে পড়া কালো মেম, কিন্তু ‘গুলকো’ কী জিনিস তা আমার জানা দরকার।
—হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক—গোপালও বলল—গুলকোটা কী?
অনীক বলল—পরের লাইনটা আগে মনে এসেছিল বুঝলি? ফুলকোর সঙ্গে মিল দিতে তাই গুলোটাকে ‘গুলকো’ করে দিলুম।
যশ উদারভাবে বললে—গ্রান্টেড। ‘গুলকো’ ইজ গ্রান্টেড। অনীক সত্যি-সত্যি কবি হয়ে উঠছে। ওকে আমাদের একটা প্ল্যাটর্ফম যোগাড় করে দেওয়া দরকার। ইট ইজ আর্জেন্ট।
রাংতা বলল—আমি না হয় কালো মেম, কিন্তু তোরা বাঙালির ছেলে হয়ে কথায় কথায় এত ইংরেজি বুকনি ঝাড়িস কেন? ‘গ্রান্টেড’ না বলে ‘অনুমতি দেওয়া হল’ বলা যেত না? প্ল্যাটফর্মের জায়গায় বরং রঙ্গমঞ্চ, আর্জেন্ট-এর জায়গায়—দরকারি কি জরুরি বলা যেত না?
অনীক বলল—রঙ্গমঞ্চ? ওহ আয়্যাম বোল্ড। মাঠের ওপর সে একটা ডিগবাজি খেয়ে নিয়ে বললে—
রাস্তা তুমি তো চোস্ত বুলির বস্তা ঝাড়তে ব্যস্ত
এই সুযোগেতে আমরা তিস্তা খেয়ে আসি রুটি-গোস্ত
অনীককে উঠতে না দিয়ে গোপাল তাকে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে বলল—কবি হতে পারিস, কিন্তু তুই একটা দুঃকবি, রাস্তা আর তিস্তা শব্দের প্রয়োগ যদি বোঝাতে না পারিস তোকে আজ এইখানে বেঁধে রেখে যাবো।
অনীক বললে—আহ্, ছাড় ছাড় লাগছে, এটা কি ডানলোপিলোর গদি পেয়েছিস? চতুর্দিকে কাঁকর, কাঁটা …। আমি সোলোকটা এখুনি ব্যাখা করে দিচ্ছি—রাংতাকে রাস্তা বানিয়েছি অনুপ্রাসের খাতিরে। রাস্তা, চোস্ত, বস্তা, ব্যস্ত। অনুপ্রাস কনটিনিউড ইন দা নেক্সট লাইন। আমরা তিনজন ‘ত্রয়ী’ বলতে পারিস তিস্তা বললেই বা ক্ষতি কী? অনুপ্রাসটা যখন হচ্ছে!
যশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে—ব্যস্তর সঙ্গে গোস্ত্ কী করে মিলবে?
—স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মেলাচ্ছেন, আর আমি মেলালেই দোষ, না? আরে বুঝলি না মেলাবেন তিনি মেলাবেন—কবিরা সব বলছেন। আমরা যতই গুবলেট করি সব মিলে যাবে।
গোপাল বলল, যাই হোক একটা জিনিস খুব স্পষ্ট। এই কবি দুঃকবি হলেও এর খিদে পেয়েছে, এ প্রথমে ফুলকো লুচির কথা বলেছিল, এখন রুটি-গোস্তের কথা বলছে, এরপর যদি আরও শক্ত কিছুর কথা বলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। বাবা রাংতা ক্ষ্যামা দে। মা তীর্ণা!
—এঃ, তীর্ণাকে মা বলে ফেললি? তোর আর কোনও চান্স রইল না—অনীক বলল।
—যেন কোনদিন ছিল! বলে তীর্ণা পা চালাল, শিগগির চলো, আমার কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছে।