দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 05
গঙ্গাপ্রসাদের মেজাজ খুব খারাপ। সাধারণত তিনি মেজাজ খারাপ করেন না। কিন্তু কিছুদিন ধরেই তাঁর মেজাজটা ভেতরে ভেতরে চড়ছে। যা প্রথমে হাসির বিষয় ছিল, তা ক্রমশ জটিল হয়ে ধোঁয়ার জট পাকিয়ে মনের আকাশ ছেয়ে ফেলছে।
কিছুদিন আগে টেস্ট গেল। গঙ্গাপ্রসাদ ইনভিজিলেশন দিচ্ছেন। তত্ত্বগতভাবে এই ডিউটিটিকে স্বীকার করেন না গঙ্গাপ্রসাদ। ইনভিজিলেশন আবার কী? তিনি প্রথমেই ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেন—আমি এখানে তোমাদের কাগজ-টাগজ সাপ্লাই করবার জন্যে বসে আছি। প্রশ্নপত্র সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। কিন্তু প্রশ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন নয়। বলে, তিনি পরীক্ষার্থীদের ভীতি উৎপাদন করবার জন্যেও বটে, নৈতিক সাহস জোগাবার জন্যেও বটে, আবার এগজাম্প্ল সেট করবার জন্যেও বটে—একটি অতিশয় মোটা বই খুলে দাগ দিয়ে দিয়ে পড়তে থাকেন। কিন্তু পড়তে কি ওরা দেবে? কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই একজন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে ডাকতে থাকে।
—কী ব্যাপার?
—সার অ্যাডমিট কার্ড আনতে ভুলে গেছি, কী হবে?
—টেস্টের আবার অ্যাডমিট কার্ড কী?
—ওই ফি-বইটা সার। বাড়ি খুব কাছে সার, ছুট্টে যাবো আর আসবো। যাবো?
—না-বলে বইয়ের পাতায় তিনি চোখ নামান।
ছেলেটি গুনগুন করে বলতে থাকে—আমি যে ডিফল্টার নই সেটা প্রমাণ করার একটা সুযোগ সার …
গঙ্গাপ্রসাদ আধখানা চোখে চেয়ে বললেন—কালকের পরীক্ষায় আনলেই হবে, আমি নোট করে রাখছি।
আবার তিনি পাতা উল্টোন। উল্টে দেখেন, বুঝতে পারছেন না। অর্থাৎ আগের পাতাটা পড়া হয়নি। এতক্ষণেও! ছিঃ! বিবেকানন্দ, আশুতোষের দেশের ছেলে তিনি! ছেলে আর নন, ভদ্রলোক। যাই হোক, তিনি নিজেকে ছেলে ভাবতেই অভ্যস্ত। রাস্তায়-ঘাটে কেউ যদি ‘অ মশায়’ বলে ডাকে, তিনি সাড়া দেন না। বাড়িতে কাজের লোক তাঁকে বাবু পর্যন্ত বললে কিছু অসুবিধে নেই। কিন্তু একজন বাবা ডাকাতে তার চাকরি গিয়েছিল। কাজল অনেক বোঝায়, কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ বোঝেন না, তিনি একমাত্র তাঁর নিজের ছেলেমেয়েরই বাবা, কিংবা বুড়ো-বুড়ি মানুষরা স্নেহার্থে তাঁকে বাবা ডাকতে পারেন, কিন্তু অন্য কারও বাবা হতে তিনি একেবারেই রাজি নয়। তাঁর মনোগত ইচ্ছে এরা তাকে দাদাবাবু ডাকে, যেমন বাবা-মা বেঁচে থাকতে ডেকে এসেছে। কাজল তাঁর এই মনোগত ইচ্ছে খুব ভালোই বোঝে, বলে, ঠিক আছে, এর পর থেকে ওরা তোমাকে খোকাবাবু ডাকবে। তাহলে খুশি হবে তো?
কাজল একটা কথা বুঝি-বুঝি করেও বোঝে না। এখন গঙ্গাপ্রসাদের বাবা-মা নেই। মাসি-মেসো, পিসি-পিসে, এঁরাও নেই। এখন গঙ্গাপ্রসাদ নিজেই বাবা, মেসো, পিসে। কিন্তু একজন বাবাকে ভীষণ দায়িত্ববান হতে হয়, এত গুরুদায়িত্ব দিবারাত্র কাঁধে বয়ে বেড়ানো, সে একরকম, কিন্তু অনবরত বাবা-বাবা ডাকে সবাই যদি তা মনে করিয়ে দিতে থাকে? নাই বা থাকলেন বাবা-মা, দাদাবাবু ডাকলে একটা স্বপ্ন-জগৎ সৃষ্ট হয় যেখানে মাথার ওপরে বাবা-মারা এমনকি ঠাকুর্দা-ঠাকুমারাও আছেন, দায়িত্বটা হালকা হয়ে যায়। এত কথা কাজল বোঝে না, খালি বলবে গঙ্গাপ্রসাদ খোকা সাজতে চান। অথচ সত্যি-সত্যি খোকা সাজতে চাইলে কি গঙ্গাপ্রসাদ গত দশ বছর ধরে এক কালো লাইব্রেরি-ফ্রেমের চশমা পরতেন? ঠাট্টা-ইয়ার্কি ফাজলামি বাদ দিয়ে অমন গুরু-গম্ভীর হয়ে থাকতেন?
যাই হোক, আরেকটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়েছে।
—কী চাই?
—কাগজ স্যার?
—পনের মিনিট গেল না, এর মধ্যে কাগজ! —গঙ্গাপ্রসাদ হৃষ্ট হবেন না রুষ্ট হবেন, ভেবে পান না। কাগজ দিতে গিয়ে বললেন—দেখি, কেমন লিখেছ? তিন পাশে এক বিঘত করে মার্জিন রেখে ছেলেটি পরপর আট আনা সাইজের সিঙাড়া বসিয়ে গেছে। তার যে আরও আগে কাগজ প্রয়োজন হয়নি এটাই আশ্চর্য। কাগজের বর্তমান রিম প্রতি দাম এবং অপচয়ের বদভ্যাস সম্পর্কে একটি ছোট্ট বক্তৃতা দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসেছেন, এমন সময়ে দুটি ছেলে কথা বলছে লক্ষিত হয়। কয়েকবার সতর্ক করে দেবার পরও যখন তারা নিচু গলায় কথা বলেই যায় তিনি উঠতে বাধ্য হন।
—কী ব্যাপার!
—না স্যার, আসলে আমাদের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে তর্ক হচ্ছিল।
—তর্কের জন্যে বিতর্ক সভা আছে।
—তা তো ঠিকই সার … তবে এটা, এ ব্যাপারটা আর্জেন্ট কি না!
—কী রকম আর্জেন্ট শুনি?
—প্রশান্ত বলছে শেষের কবিতাটা একটা কবিতা। রবীন্দ্রনাথের শেষ, সর্বশেষ কবিতা।
—আর তুমি কী বলছো?
ছেলেটি হাসে—আমি সার ন্যাচারালি বলছি ওটা একটা প্রবন্ধ—ঠিক বলেছি না?
—ঠিক বলেছ এবং চমৎকার বলেছ, উভয়েই। গঙ্গাপ্রসাদ রেগে মেগে বলেন।
ছেলেটি বোদ্ধার মতো হেসে প্রশান্তর দিকে তাকায়—কী রে, কী বলেছিলুম!
পাশের বেঞ্চের আর একটি ছাত্র এতে সাহস পেয়ে বলে—একটা প্রশ্ন করবো সার?
—প্রশ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারো, বুঝতে না পারলে। তার বেশি কিছু নয়। গঙ্গাপ্রসাদের থমথমে গলা।
—না সার প্রশ্ন সম্পর্কেই, প্রশ্ন সম্পর্কেই।
গঙ্গাপ্রসাদ গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, আশপাশের ছেলেরা কলম হাতে উদগ্রীব, ছাত্রটি জিজ্ঞেস করল—সাহিত্যের ইতিহাসের প্রশ্নটা সার। স্বামী বিবেকানন্দর রচনা সম্পর্কে। উপন্যাস, কবিতা সব কিছুরই নাম করতে পেরেছি, খালি নাটকটা যদি সার বলে দিতেন, অন্তত পক্ষে একটা।
—কোনও নামই কি তোমার মাথায় আসছে না?
গঙ্গাপ্রসাদের মুখ দেখলে যে কোনও লোক ভয় পাবে, কিন্তু পরীক্ষার্থী ছেলেরা মরিয়া টাইপের হয়। সে ভয় পেল না, বলল—মনে এসেছে সার, কিন্তু শিওর হতে পারছি না, নীলদর্পণটা মাইকেল মধুসূদন দত্তর না নরেন্দ্রনাথ দত্ত মানে স্বামী বিবে…
গঙ্গাপ্রসাদ ছেলেটির খাতা কেড়ে নিলেন। পরক্ষণেই আবার ফেরত দিয়ে দিলেন। খাতা কেড়ে নেওয়ার কোনও বৈধ কারণ আপাতত নেই।
যাই হোক সেই থেকে তাঁর মেজাজটা খারাপ হচ্ছিল। আজ বঙ্কিমচন্দ্রের নামে শেষ বেঞ্চের কোন অজ্ঞাত ছাত্র সিটি দিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রে হিন্দি ফিলমি নৃত্য-গীতের মতো সিটিযোগ্য কোনও ব্যাপার আছে কি না তিনি স্টাফরুমে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাতে তাঁরই বিভাগের এক কলিগ বলেন—সিটি কলেজের ছেলেরা তো সিটি দেবেই।
—আ-আ আপনি … এর চেয়ে বেশি কথা স্বভাবতই গঙ্গাপ্রসাদ বলতে পারেননি।
তাতে আরেকজন কলিগ বলেন—এতে রাগ করবার কী আছে গঙ্গাপ্রসাদবাবু! সারা দেশটাকে যখন শুদ্ধু ফিল্ম স্টারের নাম ধাম দিয়ে মগজধোলাই হচ্ছে আর গুটিকতক ভাগ্যবান মিনিস্টার, মিনিস্টার অফ স্টেট, তখন আপনি কী করে আশা করেন ছেলেরা বঙ্কিমকে জানবে এবং মানবে! তার ওপরে আজকাল জোর প্রচার, বঙ্কিম কোনও কম্যুন্যাল রাজনৈতিক দলের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্লাস থিংক-ট্যাঙ্ক।
আরেকজন কলিগ বললেন—আচ্ছা আপনি সঞ্জয় বলতে কী বোঝেন?
—ন্যাচার্যালি মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের সচিব সঞ্জয়, যিনি দিব্যদৃষ্টি পেয়ে পুরো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা …
—বাস বাস ঠিক আছে। আপনাকে পরীক্ষা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু আজকালকার জেনারেশন সঞ্জয় বলতে সঞ্জয় দত্তকে বোঝে।
—কে সঞ্জয় দত্ত?
—একটি লম্বা চুল ফিলম স্টার, টাডায় ধরা পড়ে যে আরও জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে, গঙ্গাপ্রসাদ অর্জুন বলতে তুমি কী বোঝ?
—স্বভাবতই তৃতীয় পাণ্ডব,
—আজকালকার ছেলেরা বোঝে অর্জুন সিং।
—আচ্ছা, আমীর খান বলতে তোমার কার কথা মনে আসে?
—আহা আমীর খাঁ, অসাধারণ গায়ক, সদারঙ্গে ওঁর মালকোষ আমি কখনো ভুলব না—গঙ্গাপ্রসাদ খানিকটা আবেগে খানিকটা উৎসাহে মুহুর্তকালের জন্য টগবগ করে উঠেছিলেন।
—আজ্ঞে না, আমীর খান আর একটি ফিলম স্টার যার হিট ছবির নাম কিউ.এস., কিউ.টি।
—কোনও ছবির নাম এরকম হয় না কি?
—হয়, হয় গঙ্গাপ্রসাদ, পপুলারিটির জোয়ার, নতুন যুগের নতুন ডায়ালেক্ট—সবই সম্ভব। ছবিটির নাম কেয়ামৎ সে কেয়ামৎ তক্। কিন্তু ভারতের আপামর জনসাধারণ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে, কেবল তুমি ছাড়া এই নামেই ছবিটাকে জানে। এখন ধরো ঢোঁড়াই চরিত মানসকে কেউ কখনও ঢো.চ.মা. বা ডি.এইচ.এম বানিয়েছে? কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথাকে পি.এন.ই.সি? এসব পপুলারিটিতে হয়। বুঝলে গঙ্গাপ্রসাদ? আমি প্রেডিক্ট করছি, আর গোটা পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের তেত্রিশ কোটিতে আরও দুটি দেবদেবী যোগ হবেন। বেশিও হতে পারেন। তবে দুটি হবেন। তাঁরা কারা জানো?
—বলল শুনছি—গঙ্গাপ্রসাদ অবশেষে টিফিন খাওয়া শুরু করেছেন লুচি আলুর দমে তাঁর গাল ফুলে উঠেছে—
কলিগ বললেন—মুম্বইতে দেব অমিতাভ বচ্চন আর তামিলনাড়তে দেবী জয়ললিতা।
গঙ্গাপ্রসাদ এইসা বিষম খেলেন যে টিফিন খাওয়া তো তাঁর মাথায় উঠলই, বেয়ারা রজনী দয়াপরবশ হয়ে তাঁর মাথায় ঘাড়ে জায়গা মতো থাবড়া-থুবড়ি দিয়ে না দিলে সহকর্মীরা তাঁকে চ্যাংদোলা করে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ অর্থাৎ স্বয়ং কালসদনে নিয়ে গিয়ে তাঁর দফা সেরে দিত।
গঙ্গাপ্রসাদ চশমা ছাড়া উশকো খুশকো চুলে, ভিজে জহর কোটের ওপর শাল চাপিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তাঁকে দুরস্ত করবার জন্য রজনী জল থাবড়েছিল। সহকর্মীরা জোর করে চশমা খুলে শুইয়ে দেয়। মেয়েদের কলেজ তো আর নয় যে, বাড়ি ফেরবার সময় সব সাজিয়ে গুছিয়ে দেবে। জহরকোট ভিজে যাওয়ায় প্রবল শীত করছিল, তিনি শালটাকে ভাল্লুকের মতো জড়ালেন। চশমা স্টাফরুমের টেবিলে ফেলে কোনও বাসের নম্বর দেখতে পান না। চারদিকে হাতড়াচ্ছেন দেখে একটি ইয়াং ম্যান এগিয়ে এসে হাত ধরে বলল—অন্ধ মানুষকে কি কেউ একটু দয়াও করবে না? চলুন, চলুন দাদু, আমি আপনাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসছি।
রেগে মেগে গঙ্গাপ্রসাদ তৎক্ষণাৎ একটা ট্যাকসি ধরলেন, ছেলেটিও উঠতে যাচ্ছিল, তাকে প্রায় ঠেলে ফেলে দিলেন। এবং জবুথবু অবস্থায় বাড়ি ফিরতে তাঁর চব্বিশ বছরের পরিণীতা স্ত্রী কাজলরেখা প্রথম প্রশ্ন করল।
—কী ব্যাপার? এরকম শালপ্রাংশু চশমখোর হয়ে কোথা থেকে ফিরলে?
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন—আমার চশমা?
—দ্বিতীয়টা এনে দিচ্ছি—বলে কাজল দ্রুত তাঁর চশমা নিয়ে ফিরে আসে। তিনি গর্জন করে বলেন—সঞ্জয় কে?
—হঠাৎ কুইজ আরম্ভ করলে যে!
—বলোই না।
—দত্ত না কাপুর?
—অর্জুন কে? দ্বিগুণ গর্জন করলেন গঙ্গাপ্রসাদ
অরুণ না অর্জুন? অর্জুন সিং-এর কথা বলছো? অরুণ নেহরু তো সেই কবেই ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে গেছে। পলিটিকস আমার গুলে খাওয়া।
—আর আমীর খান?—ত্রিগুণ গর্জন।
উত্তর এলো কিউ.এস.কিউ.টি-র হিরো। গানগুলো দারুণ।
—কী? পাশ করেছি? কাজলের সহাস্য জিজ্ঞাসা।
তুত তুত্ তুমি…একটা অনার্স গ্র্যাগ্ গ্র্যাজুয়েট? এ ছাড়া গঙ্গাপ্রসাদ আর কিছুই বলতে পারলেন না।