দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 14
সরলাবালা পাঁচালি পড়ছেন :
সরোবালা সুশীলার কইল সংবাদ।
জ্বরে জরোজরো সুশী গণে পরমাদ॥
সরো বলে খ্যাপা স্বামী দুর্বাসার রাগ।
তিন সত্য করি সুশী তারে দিব ত্যাগ॥
ত্যাগ দিয়া কী করিবি সুশী ভয়ে কয়।
আবার বিবাহ সুশী করিব নিশ্চয়॥
সরলাবালা সরি-সুশীর ঢিপি-ঢাপা মূর্তিতে একটু ফুলবেলপাতা ফেলে দিলেন। ভজমামা ঢুকে বলল— শীতকালে কিসের শিবপুজো বুঝিনে বাপু! শিবপুজো করতে হয় বোশেখ মাসে। মায়ের সবই কেমন এলাকাঁড়ি।
সরলা ভজমামার কথায় কানও দিলেন না আবার পাঁচালি আরম্ভ করলেন :
সুশী কয় পোড়ামুখী মুখে নাই আঁট
কথাবাত্রা ছোট্ট হতে বড্ড কাঠ-কাঠ।
ভজমামা বলল—তা ভূতনাথ ভৈরব। তার কথা তো কাঠকাঠ হবেই।
সোয়ামিরে ত্যাগ দেওয়া কোন শাস্ত্রে কয়?
সরি বলে আমাদের নিশ্চিত প্রত্যয়॥
শাস্ত্রে যথা লিখিতং বিধবার বিয়ে
তথা নানা কথা আছে বদ স্বামী নিয়ে॥
শুধু বদ নয় এ যে বদখত বুড়ো
ইচ্ছে করে মুখে তার জ্বেলে দিই নুড়ো॥
—ভজমামা উবু হয়ে বসে বিড়ি ধরিয়ে বললে— পাঁচালি শুনতে বেড়ে লাগে, খাসা লাগে, উমার মা শিবঠাকুরকে একেবারে গোবেড়েন দিচ্ছে। জামাই বলে রেয়াৎ করছে না। সব শাউড়িদের ব্যাপারটা শিকে নেওয়া উচিত। ওহ! জামাই বলে সব যেন মাথা কিনে নিয়েছে। রাতবিরেতে পাঁঠার মাংস আনো, দই আনো, রাবড়ি আনো, পেস্তাবাদাম-কাজু-খোয়া। একেবারে এলাকাঁড়ি কাণ্ড!
এই সময়ে কাজল ঝড়ের মতো ঢুকে বলল— আহা হা হা, তোমাদের জামাই কি একবারও বলেছে এই আনো ওই আনো, সে তো খেতেই চায় না, যদি বা চায় বলে যা রয়েছে ঘরে তাই দাও।
ভজমামা বলল— আ-হা! ও তো মায়ের নাতজামাই! আমি বলছি জামাইদের কথা। তুইও যেমন!
কাজল বলল— দিদিমাসি গো তোমার বাড়ি অনেক অতিথি আসছে যে!
সরলাবালা পড়ে চললেন :
পিতৃধাতু পায় বড় পুত্র নরহরি
ভয়ে তার কাঁপে সারা গ্রাম থরহরি॥
মেজপুত্র করিলেক অকালে প্রয়াণ
ভজহরি সেজপুত্র ভ্যাবাগঙ্গারাম॥
তারও পরে গৌরহরি বিবাহ করিলা
দিবারাত্র নাকি তার সংসারেতে জ্বালা॥
লোটা কম্বলধারী গৌর হিমালয়ে যায়
সেথা বড় শীত দেখে কন্খলে পালায়॥
গজহরি চতুর্থটি রাঙামুলো ছিল
বলহরি ছোটছেলে কোথা পলাইল॥
অবধান করো সবে সুশী সরি কথা
বসুজায়া কহে, শুনে পুণ্যবান যথা॥
আবার কতক ফুলবেলপাতা অঞ্জলি দিয়ে সরলাবালা পাঁচালি বন্ধ করলেন। ভজমামা ঢুলতে ঢুলতে বললেন দেখিচিস কাজলা, মা শিবের পাঁচালিতে আমার নামটা ঢুকিয়ে দিয়েচে কেমন। একেই বলে মায়ের মন!
সরলাবালা পাঁচালি থামিয়ে বললেন— বল এবার কী বলবি!
কাজলের উত্তেজনা পাঁচালির কারণে এখন অনেক থিতিয়ে এসেছে। সে বলল— তোমার বাড়ি যে মেম আসছে গো!
দিদিমাসি ধীরেসুস্থে সব গুছিয়ে তুলতে তুলতে বললেন— এখন আর আমায় কী মেম দেখাবি কাজলা, আমার বাপেরবাড়িতে কত মেম এয়েচে। মিস অ্যানাবেল, মিস শার্লট, মিস মাগারেট…স্কটল্যান্ডের প্রেজবিটেরিয়ান চার্চের মিশন থেকে কত মেম ইন্ডিয়া দেখতে আসত। আমাদের সঙ্গে ডেকে ডেকে আলাপ করত। শ্বশুরবাড়িতেও এয়েচে। ম্যাজিস্ট্রেটের মেম, পুলিস-সুপারের মেম, মেম কি একটা? এসে এসে সব জিজ্ঞেস করত তোমার ইন-লজ খাইসি, করসি কথা কয় তুমি কেন আলাদা? আমি বলতুম— আ অ্যাম আ ক্যালকাটান ম্যাডাম, দা ডায়ালেক্ট আই স্পীক ইজ দা মোস্ট পলিশ্ড্ ইন বেঙ্গল।
কাজল বলল— জীবনের অনেকটা সময়ই তো বাঙাল দেশে কাটালে। তাও কী করে কলকাতিয়া ভাষা বলে জানিনে বাপু, আমরা ঘটিরাও তো আজকাল হালুম হুলুম গেলুম করলুম বলি না। তুমি তো নেবু, নুচি পজ্জন্ত ধরে আছে।
—আছি, থাকবও, বুজলি! ভাষাটা লুপ্ত হয়ে যাবে নাকি শেষে? ভজটাকে ছোট্ট থেকে কলকাতার ভাষা রপ্ত করিয়েছি। মেয়েগুলোর বেলায় একেবারে ফেল। সবসময়ে ঠাকুমা পিসিমাদের সঙ্গে ঘুরঘুর করতো তো! শেষে এমন হল নবটার চাটগাঁয়ে বে হল। ফিরে এল যখন আমি তার মা তার কথা বুঝতে পারি না। বলে হেই দ্যাহো, হালার পুতে লইঠ্যা শুঁটকি বুজে না। ললিতাটাকে কত ‘ও ললিতে চাঁপাকলিতে’ বলে ভুলিয়েছি দোল দিয়েছি, কিন্তু মুখ দিয়ে ভাষা বেরোল পিতৃভাষা।
তোমার নাতজামাই কিন্তু বলে—ভ্যারাইটি, বাংলা ডায়ালেক্টের এত ভ্যারাইটি তাই ভাষাটা এত রিচ।
—তা থাক গে না, আমি কি বারণ করেচি? তবে আমার আঁব, নুচি, গেলুম খেলুমও কেড়ে নিতে দোব না।
এই সময়ে ভজমামা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে বললে— মা, তোমার পাঁচালি থামাও। জৈল সিং। জৈল সিং এয়েচে।
—সে কি রে? জৈল সিং যে কদিন আগে মারা গেছেন!
—মারা যেতে পারে কিন্তু এয়েচে।
ভজমামার ছেলে নুটু শ্যামবাজার অঞ্চলের নামকরা গেঁজেল; সে ঢুকে বলল— সরলাবালা কি আমার ঠাকুমার নাম না মার নাম? যে-ই হোক তাকে এখন লুকিয়ে পড়তে হবে কারণ পুলিস এসচে।
—পুলিস? কাজল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়াল।
—ও ভজমামা, পুলিশ কেন আবার? এই বললে জৈল সিং!
আর ভজমামা। ভজমামা হাওয়া। নুটু বলল— আমি চললাম, আমার কাজ আছে। সরলাবালা যদি ভালো চাও তো লুকোও।
দিদিমাসি তেরিয়া হয়ে বললেন— কেন? আমি খুন করেছি না রাজদ্রোহ করেচি যে নুকোবো? আজকের দিনের শাউড়ি হয়ে একটা বধূহত্যা পজ্জন্ত করিনি, নুকোতে হয় তারা বাপ-বেটায় নুকোগে যা।
ভজমামির পেছন পেছন যশজিৎ আর গোপাল এসে ঘরে ঢুকল।
—ওঃ তুমি! সেই যশ না রস না? কাজল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল।
—আজ্ঞে আমি সেই যশই। রসটস কিছু না।
—অমন লাল পাগুড়ি পরেছ কেন? আমার নুটুদাদা তোমায় পুলিস ভেবেছে যে?
গোপাল জিভ কেটে বলল— এ ছি ছি কাজলামাসি, লাল পাগড়ি পুলিসেরা পরত ব্রিটিশ আমলে, সে-সব আমরা দেখিইনি।
—তোমাকে কি আমি ফোড়ন কাটতে বলেছি? পাঁচফোড়ন কোথাকার!
—কিন্তু কাজলামাসি আপনি যদি খামখা একটা ঐতিহাসিক ভুল করেন, তা হলে…
যশ বলল— তা ছাড়া এটা ঠিক লাল কি? ব্রিক রেড নয়?
—আজ্ঞে না। রঙের ব্যাপারে আমাকে শিক্ষা দিতে এসো না। একে বলে খুন-খারাপি লাল। আমার বিয়ের বেনারসীখানা ঠিক এই রঙের।
—আচ্ছা আচ্ছা, খুনখারাপিই আছে। আমি এ পাগড়ি আর পরছি না, যদি সবাই এত ভয় পান, যশ বলল।
—ভয় মানে? —পালঙ্ক থেকে বলে উঠলেন দিদিমাসি, —ভয়ের কথা হচ্ছে না। লাল পাগুড়ি আমাদের সে যুগের মানুষের কাছে একটা অপমান, একটা অত্যেচার, একটা জঘন্য সরকারি চক্রান্তের প্রতীক। তা জানো থোকন! এই কাজলা নাতনিরা তারই শেষমেষ দেকেচে।
এমন সময়ে ভজমামি সালোয়ার-কামিজ পরা রাংতাকে নিয়ে ঢুকলেন। সে ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বলল— আমি কি সময়ের আগেই এসে পড়েছি?
কাজল এগিয়ে গিয়ে বলল— শোনো রাংতা এই হলেন আমার মাসি-দিদিমা বা দিদিমাসি। উনি খুব আপ-টু-ডেট হতে পারেন। কিন্তু ওঁর নাতনি হওয়া সত্ত্বেও আমি অতটা নই। আমার মামারবাড়ি তোমাদের মিটিং প্লেস না ডেটিং ভেনু হওয়ায় আমার খুব আপত্তি। খুব খারাপ লাগছে আমার। তুমি একা এসো, যশ একা আসুক, কিন্তু আগে থেকে চক্রান্ত করে দুজনে এখানে ঠোকাঠুকি হয়ে যাওয়া, যেহেতু আমার দিদিমাসি খুব লিবর্যাল—এ আমি সহ্য করব না। ইট উইল সেট এ ব্যাড প্রিসিডেন্স, কোনও কোনও দুষ্কৃতকারী এর সুযোগ নিতে পারে। রাংতা অপমানিত লাল মুখে বলল— আমি এখুনি চলে যাচ্ছি। তীর্ণা আমাকে ফোন করে জানাল বলেই না খুঁজে খুঁজে…
গোপাল বলল— ব্যাড প্রিসিডেন্সের ব্যাপারটা কাজলামাসি যদি আমাকে কটাক্ষ করে বলে থাকেন তা হলে সেটা মাঠে মারা গেল কারণ কাজলামাসির মামারবাড়িতে কারুর সঙ্গে মিট করবার কোনও বাসনাই আমার কোনদিনও ছিল না, আজও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না।
কাজল বলল— সবার মাঝে পড়ল কথা যার কথা তার গায়েই বাজে। আমি কি তোমাকে কানে ধরে বলতে গেছি গোপাল, গোপাল, তুমি ঠাকুরঘর থেকে কলা খেয়েছ!
রাংতা রাগত মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিল এমন সময়ে উদভ্রান্ত অনীকের সঙ্গে তার চৌকাঠের ওপর ঠোক্কর লেগে গেল।
অনীক বলল— আরে রাংতা তুই? এইসব চৌকাঠ-ফৌকাঠ একেবারে থার্ডক্লাস ব্যাপার? এ কী? দিদিমাসি! তীর্ণা কই? তীর্ণা ছাড়া তো দেখছি সব্বাই আছে!
দিদিমাসি বললেন— ও নাতকুড় আমার, সাত রাজ্যের ধন এক মানিক, কবে থেকে ডাক পেড়ে বসে আছি, পিঠে-পাঠা তোয়ের করে, তা সেই বলে না কথায়—হায়রে সাধের তুমি। তোমার জন্যে চাল ভিজিয়ে চিবিয়ে মলাম আমি॥ কেন্রে এমন নিঠুর কঠোর কেন তুই?
অনীক লজ্জা পেয়ে দিদিমাসিকে একটা পেন্নাম ঠুকল গিয়ে। দেখাদেখি যশ, গোপাল আর রাংতাও ঠুকল। অনীক বলল— ব্যাপারটা খুবই মিস্টিরিয়াস। সাম আননোন পার্সন আমাকে ফোন করে বলল— দিদিমাসির বাড়িতে এলে তীর্ণাকে পাবো। তাই..
—তিনুর খোঁজে এইচিস! তবে রে মুখপোড়া! আমি বলি আমার জন্যে নাতকুড়টা হেদোয়।
—দিদিমাসি তুমি জানো না তীর্ণা হাওয়া হয়ে গেছে। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার দিনেরাতে ঘুম নেই। আর এদিকে তোমার নাতনি আমাদের এই কাজলামা দিব্যি খাচ্ছেন-দাচ্ছেন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন।
ভজমামি বললেন— আহা আমাদের কাজললতা ভাগ্নীকে খাওয়ার খোঁটা দিও না নাতি, কে আর আমাদের সেকালের রান্নার অত কদর করবে তা হলে?
এইবারে ঢুকলেন গৌরমামি— মা, কতকগুলান সাহেব-মেম লইয়া নাতজামাই আসে। সব্বগোরা ধইরলে অনেকগুলান মানুষ। সা পাতা লাগব। ভাঁরার গরের সাবি দিয়া থুন।
দিদিমাসি আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে গৌরমামির হাতে দিলেন। ভজমামা পালঙ্কের তলা থেকে মুখ বার করে বললেন— আমি তা হলে বেরুই? কি গো মা!
অনীক ভজমামা অর্থাৎ তার ভজদাদুকে বেরোতে সাহায্য করল।
দিদিমাসি বললেন— সিঙাড়াগুলো গরম দেখে আনবি, আর স্পঞ্জ রসগোল্লা। ভজমামা খাবার কিনতে বেরিয়ে গেলেন।
—আমরা কি আসতে পারি? গঙ্গাপ্রসাদ দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন।
—আপনারা জুতোগুলো খুলুন বাবা জেনকিন্স্! ওহে টিকটিকিরা তোমাদের ওই কায়দার জুতো সব খুলে-টুলে ঢোকো। —গঙ্গাপ্রসাদ পেছন ফিরে বললেন।
প্রথমে ঢুকল তীর্ণা, পরনে ছাপা শাড়ি, সে নেংচাতে নেংচাতে ঢুকল।
কাজল বলল— ও কি রে তীর্ণা। তোকে অমন জখম করলে কে?
অনীক তার জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে বলল— বোধ হয় কারুর বাড়ি ল্যাং ল্যাং করে গিয়েছিল। সেই ভেঙেছে ঠ্যাং।
তীর্ণা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে দাদার দিকে তাকিয়ে তারপর রাংতার দিকে চাইল। রাংতা চোখ নামিয়ে নিল।
তীর্ণা বলল— থ্যাঙ্কস্ রাংতা।
রাংতার মুখের ভাব এখন এমন কাঁচুমাচু যে ঘরে উপস্থিত অনেকেই ভাবল তীর্ণার জখম পা-এর পেছনে রাংতার কিছু অবদান আছে। মামিদ্বয় তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন।
ওদিকে ফাদার জেনকিনস, অশোক সাঁতরা আর গোপালগোবিন্দকে একরকম ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
কাজল ফিসফিস করে তীর্ণাকে বলল— কি রে আরও ক্যানডিডেট? তোর টেস্টের প্রশংসা করতে পারছি না বাপু।
তীর্ণা বলল— উঃ মা! তুমি একটু থামবে!
অভিমানহত কাজল থমথমে মুখে চুপ করে গেল।
এইবার গঙ্গাপ্রসাদ এডিথকে নিয়ে ঢুকে বিজয়গর্বে চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন— মাসিদিদিমা, (দিদিমাসি ডাকটা তিনি কোনদিনই পছন্দ করেননি, যদিও অভিধানে ঢোকাবেন কি না ভাবছেন) একে চিনতে পারেন?
একটা কালো স্কার্ট আর সাদা টপ পরা এডিথ সিং কাপুর আর সাদা ধবধবে থান পরিহিতা সরলাবালা বসু এখন মুখোমুখি।
উপস্থিত সকলেই একটা প্রচণ্ড বিস্ময়ের আওয়াজ করল গলা দিয়ে। সমস্ত ঘরে এমন নিস্তব্ধতা যেন রাতদুপুরের কবরখানা। কয়েক মিনিট পরে দিদিমাসির পরিষ্কার গলা শোনা গেল : চিনব না কেন? এ নিশ্চয়ই আমার সেই হারানো জিন। বোতলে ভরে কালসমুদ্দুরে মুখপোড়া বিধাতা ফেলে দিইছিল। তা কোন সাগরের তীরে উঠল শুনি?
—অ্যাটল্যান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর— গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, গালফ অফ মেক্সিকো, কি আর্কটিক ওসান যদি না-ই ধরেন। মানে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
—তুই কি আমার কুট্টির মেয়ে? মেয়ে না নাতনি?
—আমার পিত্রিদেব শ্রীল শ্ৰীযুত ব্যলহরি ভোস মাত্রিদেব মাদাম আনেৎ ভোস। মাদাম সরলাওবালা ভোস আমার পিটামহীর নাম। —বলতে বলতে এডিথ দু পা এগিয়ে পালঙ্কে উঠে পড়ল এবং দিদিমাসির গলা জড়িয়ে চক্চক্ শব্দ করে চুমু খেতে লাগল।
—মাই ওনলি লিভিং রিলেটিভ। সে চুমুর ফাঁকে ফাঁকে বলতে লাগল, বোঝা গেল সে আবেগে ফোঁপাচ্ছে।
তীর্ণা আর অনীক প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল—তাই গোড়ার থেকেই ওকে এত চেনাচেনা লাগছিল। যেন কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি।
কাজল বলল— তা যদি বলো এডিথ আমরাও তো তোমার আত্মীয় বাপু, একা সরোবালা কেন? তুমি তো তা হলে আমার মাসতুতো মামাতো বোন হলে! না কী?
তখন এডিথ দিদিমাসিকে ছেড়ে চোখের জল রুমাল দিয়ে মুছে কাজলকে চুমু খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
তীর্ণা বলল— তুই আবার ওকে দেখলি কোথায়?
অনীক বলল— কেন? মনোহরদাসের আসরে, বোষ্টুমী না বাউলনী সেজে বসে ছিল!
—চতুর্দিকে চকচক চুমু খাওয়ার শব্দ। খালি যশজিৎ ভারি খুঁৎ খুঁং করতে লাগল—
—তাহলে আমার ফাংশানটা কী দাঁড়াল? এডিথ আমার হচ্ছে টা কে?
এডিথ ভজমামার খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি ভরা গালে চুমু খাচ্ছিল। শেষ করে ভজমামীর দিকে যেতে যেতে বলল— তুমি আমার কেউ হয় না। আমার পিতা শ্ৰীযুট ব্যলহরি ভোস আমার মাতা মাদাম আনেৎকে বিচ্ছে … বিচ্ছে … ও মাই গড ডিভোর্স করলে মাদাম আনেৎ বিভা করেন মিঃ রাদারফোর্ডকে। জিম রাদারফোর্ড। জিম আমার স্টেপ ফাদার। আনেৎ মারা গেলে আমি পা ব্যলহরির কাছে ফিরতে চাচ্ছে— কিন্তু খোজ পাচ্ছে না। জিম তোখন বিভা করে মাধু কাপুরকে। কী করতে পাচ্ছে, আমাকে ওদের সঙ্গেই থাকতে হচ্ছে। জিম মাধুকে বিছে-বিচ্ছে ও মাই গড ডিভোর্স করে নাইজিরিয়া চলে যাচ্ছে। আমার নাইজিরিয়া ভালো লাগছে না। মাধু কাপুর বিভা করছে দলজিৎ সিংকে। কী করতে পাচ্ছে, ওদের সঙ্গেই থাকছে। দো শী ইজ আ বিচ, দলজিৎ ইজ আ ডার্টি অ্যাডভেঞ্চারার। আমি মাইনর আছে, আনেতের ডলার আছে, ওরা আমাকে ছাড়ছে না, দলজিৎ মোটেল চালাচ্ছে, ফ্রেন্ডের সঙে ডেলিক্যাটেসিনে কাজ করে, আনেতের ডলার ওদের চাই। ওদের তিনটে ছেলে, বডমাস। আমি স্কুল থেকে এসে কুকিং ক্লীনিং, ভ্যাকুয়াম এভরিথিং করি। একদিন স্কুলে এক সলিসিটর ফোন করছে।
—তুমি এডিথ ভোস?
আমি বলছি— আমি এডিথ সিং কাপুর।
—নো-ও তুমি ভোস, তোমার বাবার নাম ব্যলহরি ভোস কী?
—তোখন মনে পড়ছে, বলছি— রাইট।
—তো কাম কুইক।
—তোখন আমার হাই স্কুল হচ্ছে। সলিসিটর তার লোক্যাল অফিসের অ্যাড্রেস দিচ্ছে। আমি যাচ্ছি। সলিসিটর বলছে— তুমার বাবা ব্যলহরি আর বিভা করছেন না, তিনি মরছেন। তাঁর অনেক সম্পাটি, থ্রি মিলিয়ন ডলার্স মতো হোবে। তুমি পাচ্ছে। সো য়ু আন্ডাস্ট্যান্ড ইয়শ্ তুমি আমার কেউ হচ্ছে না!
যশ বলল— ওয়েট এ মিনিট। তুমি দলজিৎ আঙ্কলের স্টেপ-ডটার ঠিক?
অশোক সাঁতরা বলল— উঁহুঃ, ও দলজিৎ সিঙের বউ মাধু কাপুরের স্টেপ-ডটার।
গোপালগোবিন্দ বলল— মোটেই না। ও হল জিম রাদারফোর্ডের স্টেপ-ডটার।
রাংতা বলল— সে ক্ষেত্রে এডিথ দলজিৎ আঙ্কলের স্টেপ-স্টেপ-স্টেপ ডটার। থ্রি টাইমস রিমুভড। অর্থাৎ কেউই হয় না।
এডিথ তখন ছুট্টে গিয়ে রাংতাকে চুমু খেয়ে বলল— রাইট। রাইট য়ু আ রুংটা ডার্লিং। তাপর হাই স্কুল করে আমি প্রিটেন্ড করছি কি ইন্ডিয়ায় পেপার করতে আসছি। ভীষণ আসছি।
মানে?— তীর্ণা জিজ্ঞেস করল। ভীষণ আসছ মানে?
ফাদার জেনকিনস উদ্ধার করলেন। বললেন— মানে আসতে চাইছে, তাই না। এডিথ, সোনাটি?
—রাইট। এডিথ উজ্জ্বল মুখে ফাদার জেনকিনসের দিকে তাকায়।
—তারপর?— যশের জিজ্ঞাসা।
—তার পোরে, সলিসিটার ফাদার জেনকিনসের সঙ্গে করেসপন্ডেন্স করতে বলছে। ফাদার জেনকিনস ভাবছে আমাকে সাবজেক্ট দিতে হোবে স্টাডির। তো বাউল দিচ্ছে। দলজিৎকে বলছি। দলজিৎ ভাবছে ভালো হচ্ছে, আনেতের ডোলার ছলে-কোশলে বার করবে। আমাকে নেফিউর কাছে পাঠাচ্ছে। আমার ভালো। আমি ভালো বাংলা শিকচি, মেলা যাচ্ছি, কোতো দেকছি, জানছি। ওদিকে, সলিসিটর পা-র নোটবুক দিয়েছে, বাস সেটা ফেলে আসছি। দলজিৎ-মাধু পোড়েছে, সোব জানছে। আর আমার সরলাওয়ালা ভোস আর সিয়ামবাজা ছারা কিছু মনে নেই। ট্রাম্প কার্ড দলজিতের হাতে। আনেতের সম্পাটির পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি মাধুর। চারদিকে গোয়েন্দা পাটাচ্ছে। ফিরতে পাচ্ছে না, থাকতেও পাচ্ছে না, ঘুরে ঘুরে বেরাচ্ছে। থাকার জন্য ডলার চাই। ওদের লিখতে হচ্ছে। এমন সোময় টিনা অ্যান্ড আঙ্কল গাঙ্গা গাঙ্গা ও মাই গড আংকল পরসাদ সরলাওয়ালার আড্রেস দিচ্ছে। আমি গ্রেট ফুল, সো গ্রেটফুল টু দেম।
কাজল বলল— তুমি আবার টিনার বাবাকে আঙ্কল বলছো কেন? ও যে তোমার ব্রাদার-ইন-ল হল। আমি তোমার কাজিন।
এডিথ ঝকঝকে মুখে বলল— থ্যাংকস, মেনি থ্যাংকস। তো ব্রাদার ইন ল’র বাংলা আমি বালো জানছে। এখন থেকে শালা পরসাদ বলবে।
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— আমি বাড়ি যাচ্ছি। কাজল চাবিটা দাও।
কাজলই সবচেয়ে বেশি হাসছিল, বলল— ধ্যাৎ, এখন যেতে আছে, নাকি, তুমি ওই চেয়ারটায় চুপটি করে বোসো। আরও কত মজা হবে।
ফাদার জেনকিনস হাসি-হাসি মুখে বোকার মতো বললেন— মোজ মোজা, সকস আই নো। অলসো ফান।
দিদিমাসি বললেন— ওরে এডিথ, আমার নাতজামাই গোঁসা করেছে। কাজলা যদি রাগ না করে তো ওকে আরেকটা …
গঙ্গাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন— এডিথ, তোমার গল্প শেষ হয়েছে?
—দ্যাট্স্ অ্যাবাউট ওল—বলে এডিথ দিদিমাসির গা ঘেঁষে বসে পড়ল। তার চোখ ছলছল করছে।
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— তাহলে অশোক সাঁতরা, গোপালগোবিন্দ! তোমরা দলজিৎ সিঙের অ্যাপয়েন্টেড গোয়েন্দা! তা এডিথকে স্মাগলার, স্পাই এ সব বলছিলে কেন শুধু শুধু?
এডিথ পালংকের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে লিবার্টির স্ট্যাচুর ভঙ্গিতে বলল— আমি ওদের স্যু করবো। অ্যানাদার মিলিয়ন ডলার্স।
গোপালগোবিন্দ শুকনো মুখে বলল— এটা ভারতবর্ষ, এখানে লোকেরা ক্ষমাশীল। কোয়ালিটি অফ মার্সি ইজ নট স্ট্রেইন্ড।
অশোক সাঁতরা বলল মুখ বেঁকিয়ে— এটা তো অ্যামেরিকা নয়, এখানে অত সহজে স্যু ধরা যায় না। মিলিয়ন ডলার্স তো দূরের কথা। বড় জোর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটু সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে বা পঞ্চাশ টাকা ফাইন। তাতে তোমার লাভ?
এডিথ বলল— ইজ দ্যাট সো?— তার দিদিমাসির দিকে মুখ। দিদিমাসি সারাক্ষণ হাসি-হাসি মুখে এডিথকে লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। এবার আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়লেন। তারপর বললেন— দ্যাখ দ্যাখ দেখে নে কাজলি, ওই বয়সটায় তোর দিদিমাসি কেমনটা ছিল। ছ’টা তখনই হয়ে গেছে। দুটো অক্কা। নব, নর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সইয়ের ভাই রঞ্জিতের সঙ্গে কলকাতা পালিয়ে যাবো সব ঠিকঠাক, তো রঞ্জিত ব্যাটা ভয়ে পেছিয়ে গেল।
ভজমামা বিরক্ত হয়ে বলল— আঃ, এখন আর ওসব ফ্যামিলি-কেচ্ছা কেন?
—কেচ্ছা নয়, কেচ্ছা নয় রে, অ্যাডভেঞ্চার। আমি ডাফ স্কুলে মিস অ্যানাবেলের কাছে পালাতে চেয়েছিলুম। মিস অ্যানাবেল আমায় নিউ ইয়র্কে পাঠাবেন সব ঠিক-ঠাক করছেন। তা দ্যাখ সেই মার্কিন দেশেও তো মেয়েটার কম খোয়ার হল না, বলে তিনি এডিথকে কোলে টেনে নিলেন।
এডিথ ছলছল চোখে বলল— কেউ আমাকে কোখনও আদর করছে না। পা বিষণ মারছে দোষ হলেই। আনেৎ বাড়িতে থাকছেই না। তার পোরে তো ইট ওয়াজ আ ডগস লাইফ!
—বলহরিটা ঠিক ওর বাপের মতো উগ্রচণ্ডা মারকুটে ছিল বটে, দিদিমাসি বললেন।
—আনেৎকেও মারত। এডিথ বলল।
—মারবেই, জিন যাবে কোথায়! তার বাবা তার মাকে মেরে ধামসে দিয়েছে। সেও তার বউকে মেরে ধামসে দেবে।
ভজমামা বললেন, আঃ মা ছাড়ো না ওসব ফ্যামিলি-কেচ্ছা। সিঙাড়াগুলো যে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
তখন কাজল আর ভজমামি মিলে রসগোল্লা আর সিঙাড়া পরিবেশন করল, দিদিমাসি তাঁর কৌটো থেকে সরেস নারকোল নাড়ু বার করে দিলেন। গৌরমামি বিরাট কেটলিতে চা নিয়ে এসে বললেন, পটে সব্ব গোরা বারো কাপ আসে। আর লাগব?
ধীরে ধীরে বাইরের লোকেরা সব চলে গেলে দিদিমাসি বললেন— হ্যাঁ রে এডিথ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বলহরিটা অত টাকা কি করে রোজগার করল রে? আমি তাকে যদ্দুর জানি সে খালি ওড়াতে জানে। এত টাকা! আমার হিসেব যে সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে!
এডিথ বলল— পা’র তোতো কথা তো আমি জানে না। হী ওয়াজ ভেরি হ্যান্ডসাম। আনেৎ মডলিং করে অনেক টাকা আর্ন করতো। পা কী করত জানি না। কিন্তু থ্রি মিলিয়ন ডলার পা পেয়েছিল ডক্টর্সদের স্যু করে। একটার পর একটা স্যু করত। বেশির-টাই আসে পার ডেথের পোর। শেষে, ক্যানসার হচ্ছে তো কেনো এই থেরাপি ওই থেরাপি কোরছে না, ডক্টর বলছে ইউসলেস। আর এক ডক্টরকে উইটনেস ধরছে, সে বলছে—কোরে দেখা কোর্তব্য আছে। সো হী গট পটস অ্যান্ড পটস ভ ডলার। বাট মোস্টলি আফটার হিজ ডেথ।