কয়েকটি বাঙ্গালী ভদ্রপরিবার
শহরের যে পাড়াটায় আমাদের বাস তাহা শহর-বাজার হইতে বেশ একটু দূরে বলিয়া সকল সময়েই বেশ নির্জন এবং কোলাহলশূন্য। আমাদের কয়েকটি বাঙ্গালী ভদ্রপরিবার লইয়া এই ক্ষুদ্র নিভৃত পাড়াটি গঠিত। স্থানটিও খুব মনোরম। পাড়ার গৃহগুলিকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া দীর্ঘ ঋজু পথ চলিয়া গিয়াছে। পথের দুইধারে বড় বড় পুরাতন নবাবী আমলের গাছ পথটিকে ছায়ায় ঢাকিয়া রাখিয়াছে। বাড়িগুলির পিছনও বিস্তর পতিত জমির উপর ঐরূপ গাছ সুনিবিড় কাননের সৃষ্টি করিয়াছে।
ছেলেবেলায় এই তরুবীথিকার মাথার উপর কত স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে কত জ্যোৎসাপ্লাবিত নিশিতে কোকিল বারবার কুহরিয়া উঠিয়াছে শুনিয়াছি। কত অন্ধকার রাত্রে বাড়ির পিছনকার বনের দিকে তাকাইতে ভয় করিয়াছে। এখন সেই সব কথা মনে পড়ে। বৃদ্ধ লম্বিতজট বটগাছগুলাকে পথের পাশে সারি সারি দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া মনটা শতবর্ষ পূর্বেকার কত অসংলগ্ন স্বপ্নে বিজড়িত হইয়া যায়।
বাড়ির পিছনে ফাঁকা জমি পড়িয়া থাকায় আর কিছু না হোক, বাড়ির মেয়েদের খুব সুবিধা হইয়াছিল। তাঁহারা স্বচ্ছন্দে সকল সময় খিড়কি দিয়া এবাড়ি ওবাড়ি যাতায়াত করিতে পারিতেন।
এবার আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একটি পরিবারের পরিচয় দিব। ক্ষিতীন্দ্রবাবু পূর্বে সাবজজ ছিলেন। পঞ্চাশ বৎসর বয়সে তিনি কার্যে অবসর গ্ৰহণ করিয়া আজ সাত বৎসর এখানে ঘরবাড়ি করিয়া বাস করিতেছেন। আমাদের বাড়ির কয়েকখানা বাড়ি পরেই তাঁহার গৃহ।
ক্ষিতীন্দ্রবাবুর এক পুত্র অনিল, সেই জ্যেষ্ঠ। তাহার পরে দুই কন্যা-সরস্বতী ও বীণা। ক্ষিতীনবাবু যদিও সাত বৎসর কার্যে অবসর লইয়াছেন তথাপি তাঁহার স্বাস্থ্য খুব ভালই আছে। চুল এখনো অর্ধেক পাকে নাই। তাহার প্রধান কারণ বোধহয় এই যে তিনি এ–কায় বৎসর সাংসারিক সকল আলোচনা পরিত্যাগ করিয়া কেবল বেদান্ত চচা করিতেছেন। এ বিষয়ে তাঁহার জ্ঞান অসামান্য।
ক্ষিতীনবাবু যখন প্রথম এখানে আসেন তখন সরস্বতীর বয়স আট বৎসর এবং বীণার পাঁচ। প্রথম হইতেই আমাদের সঙ্গে ক্ষিতীনবাবুর পরিবারবর্গের খুব মাখামাখি হইয়া গেল। কিছুদিনের মধ্যেই মা ঠিক করিয়া ফেলিলেন যে বীণাকে তাঁহার বধু করিবেন। মার বিশ্বাস তাঁহার ফুটফুটে ছেলের পাশে এই টুকটুকে মেয়েটি দিব্য মানাইবে। অতএব সকলেই আমাকে বীণার ভবিষ্যৎ বর বলিয়া জানিত। এবং এ পর্যন্ত কোনদিক হইতেই এবিষয়ে কোন ওজর-আপত্তি উঠে নাই। সরস্বতী বেচারীর এ পর্যন্ত বর লাভ ঘটিয়া উঠে নাই। কেন জানি না। মেয়েটি বেশ-সময় সময় মনে হয় আমারটির মতই যেন সে ভাল। বলা বাহুল্য, ইহাকে দেখিয়াই আমার দাদাটি পুষ্পধন্বার কোপে পড়িয়াছেন।
আন্দাজ পৌনে আটটার সময় গিয়া সরস্বতীদের বাড়ির পিছনকার তেঁতুল গাছে উঠিলাম। গাছটা বড় নয়—অপেক্ষাকৃত খবাকৃতি। গাছে উঠিয়া জমি হইতে প্রায় দশ ফুট উর্ধের্ব একটা মজবুত ডালের দুইদিকে পা ঝুলাইয়া বসিলাম। তারপর পিঠ আর একটা ডালে হেলান দিয়া নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট টানিতে লাগিলাম। দাদা চিঠি পাইয়াছেন দেখিয়াছি-অতএব নিশ্চয় আসিবেন। পাছে অস্থিরতা হেতু কিছু আগে আসিয়া পড়েন এই ভয়ে সকাল সকাল পাহারা আরম্ভ করিলাম। দাদাকে দেখিবামাত্র কিরূপে তাঁহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িব তাহা ঠিক করিয়া রাখিলাম। অমূল্য নিশ্চয় নিকটেই কোনখানে লুকাইয়া উৎকৰ্ণভাবে আমার শিসের প্রতীক্ষ্ণ করিতেছে। ফাঁদ প্রস্তুত, এখন শিকার আসিলেই হয়।
কিয়ৎক্ষণ এইরূপ অন্ধকারে বসিয়া মশা তাড়াইতেছি এমন সময় পদশব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। দেখি দুইজন লোক আসিয়া গাছের তলায় কয়েকটা চেয়ার রাখিয়া গেল। কিছু বুঝিতে পারিলাম না। পরীক্ষণেই ক্ষিতীনবাবু তাঁহার পুত্রকন্যা ও পত্নীর সহিত আসিয়া চেয়ারগুলি অধিকার করিয়া বসিলেন। আমি প্ৰমাদ গণিতে লাগিলাম। কি ভয়ানক! কে জানিত যে ইহারা এই সময় এই গাছের তলায় আসিয়া বসেন। যদি এই সময় ইহারা থাকিতে থাকিতে আমার বুদ্ধিমান দাদাটি আসিয়া দর্শন দেন তাহা হইলে কি হইবে ভাবিয়া আমি ঘামিয়া উঠিলাম। আমি যদি এই গাছের উপর ধরা পড়ি তাহা হইলে অবস্থােটা কিরূপ দাঁড়াইবে মনে করিয়া আমার সবঙ্গে কাঁটা দিল। অসংখ্য মশা অবাধে আমাকে কামড়াইতে লাগিল, আমি হাত নাড়িয়া তাহাদের তাড়াইতে পারিলাম না। কি জানি, যদি শব্দ হয়। আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিলাম-ভয়ে তালু পর্যন্ত শুকাইয়া কাঠ হইয় গেল। নিজের দুরবস্থা দেখিয়া নিজেরই কান্না আসিতে লাগিল।
গৃহিণী বিস্তর গল্প করিতে লাগিলেন। সংসারের কথা, বাহিরের কথা, মেয়েদের বিবাহের কথাও দুএকবার তুলিলেন। অনিল মাঝে মাঝে মার কথায় যোগ দিতে লাগিল।
রাত্রি যখন পৌনে নয়টা তখন ক্ষিতীনবাবু শেষ এক হাই তুলিয়া উঠিয়া গেলেন। যাইবার সময় অনিলকে বলিয়া গেলেন, অনিল, তুমি এখন থেকে একটু করে বেদান্ত পড়।
ক্ষিতীনবাবুর সঙ্গে গৃহিণী এবং অনিলও উঠিয়া গেল। আমি মনে মনে কতকটা আশ্বস্ত হইলাম।
আর সকলে চলিয়া গেলে বীণা সরস্বতীর পাশের চেয়ারে গিয়া বসিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, দিদি, তুমি আজকাল কবিতা লেখা। আমায় দেখাও না তো
সরস্বতী। দেখাই না?
গভীর অভিমানের সুরে বীণা বলিল, কই দেখাও।
সরস্বতী অপরাধীর মত চুপ করিয়া রহিল। দিদি দোষ স্বীকার করিল দেখিয়া বীণার আর রাগ রহিল না। সে হাসিয়া বলিল, বুঝেছি, বরের কথা লেখা হয়। কিনা। ভালবাসার কথা যে বর ছাড়া আর কারও বিষয় হইতে পারে না। তাহা বীণা বিলক্ষণ জনিত।
সরস্বতী বলিল, মাথা নেই মাথাব্যথা। বলিস তো তোর বরের কথা লিখে দিতে পারি।
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বীণা বলিল, হুঁঃ, কি লিখবে? তাহার কণ্ঠস্বরে লজ্জার সহিত কৌতূহলের যে একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছিল গাছের উপর থাকিয়াও আমি তাহা বুঝিতে পারিলাম। সরস্বতী বলিল, প্ৰথমেই তাঁর রূপ-বৰ্ণনা করা যাবে। তার খানিকটা উদাহরণ শোন–
মুণ্ডখানি কেশমাত্ৰ হীন রে
ইন্দ্রলুপ্ত অতীব মসৃণ রে
ব্যোমবৎ দিগন্তে বিলীন রে!
টিকিট বিশাল বৈজয়ন্তী রে
বর্ণ জিনি আসামেরি দন্তী রে
রাতকানা এমনি কিম্বদন্তী রে।
প্রকৃতপক্ষে আমার দিগন্তব্যাপী টাকিও নাই, টিকিও নাই, আসামের হাতির মত বৰ্ণও নয় এবং রাতকানার কিম্বদন্তীটা নিতান্তই ভিত্তিহীন। সরস্বতীর বর্ণনাটা যে আগাগোড়াই একটা মস্ত ভুল তাহা বোধকরি কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। কারণ যেখানে মুণ্ডখানি কেশমাত্রহীন, সেখানে বিশাল বৈজয়ন্তীর মত টিকির স্থান কোথায়। টাক কিছু টিকির জন্য সংস্থান রাখিয়া পড়ে না।
বীণা বরের এইরূপ বর্ণনা শুনিয়া চটিয়া গেল। কাহারই বা সহ্য হয়! বলিল, ওই রকম বুঝি? ভারি তো জান তুমি
সরস্বতী বলিল, না সবই তুই জানিস। তোর বর বলে শুধু তুই দেখিস আমরা তো দেখতে পাই না।–আচ্ছা বীণা, তাকে তো সেই কবে দেখেছিস, আজকাল তো বাড়ির ভেতরে আসেও না। কি করে জানালি যে সে ওইরকম হয়ে যায়নি।
বীণা বলিল, বাঃ, রোজ বাড়ির সুমুখ দিয়ে কলেজ যায়।
সরস্বতী। আর তুমি বুঝি লুকিয়ে লুকিয়ে তার মুখখানির ওপর দৃষ্টি দাও? দাঁড়াও না, কালই আমি তাকে সাবধান করে দিচ্ছি যেন এ রাস্তা দিয়ে আর কলেজ না যায়।
ধরা পড়িয়া গিয়া বীণা দিদির গলা জড়াইয়া ধরল। তাহার বুকে মুখ লুকাইয়া বলিল, না ভাই দিদি! তাহার বোধহয় বিশ্বাস যে সরস্বতী সত্যসত্যই আমাকে ও-পথ দিয়া কলেজ যাইতে বারণ করিবে। করিলেও সে বারণ কতদূর গ্রাহা হইত বলা নিষ্প্রয়োজন।
সরস্বতী বলিল, বেশ ভাই দিদি, বরং তাকে বলে দেব যেন রবিবারেও কলেজ যায়।
রবিবারে কলেজ না থাকা যে কতদূর ক্ষতিকর তাহা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে লাগিলাম।
সরস্বতী বলিল, আচ্ছা বীণা, তুই যে এখন ভারি বর বর করে লাফাচ্ছিস (সরস্বতীর সস্নেহ কৌতুকের স্বর আরও স্নেহ-কোমল হইয়া আসিল) তুই যখন বিয়ে হয়ে বরের কাছে চলে যাবি, আমার জন্যে মন কেমন করবে না?
ঠোঁটফুলানো সুরে উত্তর হইল, করবে না বুঝি? মুহূৰ্তপূর্বের হাস্যোজ্বল চক্ষু যে জলে টলটল করিতেছে রাত্রির অন্ধকারেও তাহা আমার কাছে গোপন করিতে পারিল না।
সরস্বতী ছোটবোনের গলা জড়াইয়া ধরিয়া একটি চুম্বন করিল। তারপর সেই ভাবে উভয়ে উভয়ের গলা জড়াইয়া বসিয়া রহিল। তাহাদের মনের মধ্যে যে গভীর ভালবাসার স্রোত বহিতেছিল কথা কহিয়া কেহ তাহাতে বাধা দিল না।
কিয়ৎক্ষণ এইরূপে থাকিয়া বীণা হঠাৎ সজোরে বলিয়া উঠিল, দিদি, একটা কাজ করলে হয়। না। কথাটা এরূপভাবে বলিয়া ফেলিয়াই আবার লজ্জায় চুপ করিয়া গেল।
সরস্বতী বলিল, কি কাজ?
কোনরূপে লজ্জা দমন করিয়া বীণা থামিয়া থামিয়া বলিতে লাগিল, তুমি যদি ওর দাদাকে-ঐ যিনি নতুন এসেছেন তাঁকে বিয়ে কর—তাহলে কিন্তু—
সরস্বতী হাসিল, বলিল, তাহলে কিন্তু তোমার মুণ্ডু। তুই ভারি বোকা বীণা।
এরূপ অপবাদেও বীণা দমিয়া গেল না, বুদ্ধির পরিচয় দিয়া বলিল, কোন দিদি, দেখতে তো মন্দ নয়।
সরস্বতী বলিল, তোর বরের চেয়ে ভাল!
কথাটা বীণা স্বীকার করিল কিনা জানি না, কিন্তু বলিল, তবে কেন বিয়ে কর না।
সরস্বতী দুষ্টামির হাসি হাসিয়া বলিল, আমাদের সুর্য্যুয়া চাকরও তো তোর বরের চেয়ে দেখতে ভাল, তবে তাকেই বিয়ে করি না কেন?
তুলনা শুনিয়া বীণা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। যতই তাহার সুর্য্যুয়া চাকরের সমতল নাসা, সম্মার্জনীর ন্যায় গুম্ফ এবং আলুচেরা চোখ মনে পড়িতে লাগিল ততই তাহার হাসির উৎস উছলিয়া উঠিতে লাগিল। শেষে অনেক কষ্টে হাসি থামাইয়া একটু স্থির হইয়া বলিল, না দিদি, তোমায় ওঁকে বিয়ে করতেই হবে। তাহলে কেমন আমরা একসঙ্গে থাকবো।
আমার কিন্তু ধৈৰ্যচ্যুতি ঘটিতেছিল। ইচ্ছা হইতেছিল গাছ হইতে নামিয়া গিয়া বলি, মহাশয়াদ্বয়, আপনাদের সৎপরামর্শ আমি শুনিয়া ফেলিয়াছি। এখন শীঘ্র এ স্থান হইতে পলায়ন করুন, নহিলে আসন্ন বিপদ।
সরস্বতী বীণার কথার উত্তরে হাসিয়া বলিল, আচ্ছা আচ্ছা, সে হবে এখন। মা ডাকছেন শুনতে পাচ্ছিস?
বীণা জিজ্ঞাসা করিল, তুমি যাবে না?
সরস্বতী বলিল, তুই যা, আমি যাচ্ছি।
বীণা চলিয়া গেল। ঘাসের উপর তাহার পদশব্দ মিলাইয়া গেলে পর সরস্বতী চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তারপর সেই তৃণাবৃত ভূমির উপর নতজানু হইয়া বসিয়া যুক্ত করে গাঢ়স্বরে ডাকিল, ভগবান, বীণার আমার মঙ্গল কর। ছোট বোনটি যেন তার স্বামীকে পেয়ে সুখে থাকে।
গাছের উপর আমি স্তম্ভিত। আর একটু হইলেই পদস্থলন হইয়া পড়িয়া যাইতাম।
এমন সময় পদশব্দ। অনর্থ সম্ভাবনায় আমি শিহরিয়া উঠিলাম। অতি সাবধানে পা টিপিয়া টিপিয়া কে ঠিক গাছতলায় আসিয়া দাঁড়াইল। বুঝিতে বাকি রহিল না যে দাদা আসিয়াছেন। তাঁহার গায়ে কালো কোট, পায়ে বার্ণিস পাম্পসু। পরিধানে কালাপেড়ে ধুতি—আগাগোড়া অভিসারের সাজ।
সরস্বতী চকিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কে?
দাদা একবার কাশিয়া গলা সাফ করিয়া একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, আমি।
তীব্ৰকণ্ঠে সরস্বতী বলিল, কে তুমি?
দাদা সশঙ্কে উত্তর করিলেন, আমি–কেদার।
সাশ্চর্যে সরস্বতী জিজ্ঞাসা করিল, আপনি এখানে-এত রাত্ৰে! বিস্ময় তাহার স্বাভাবিক লজ্জাকে পর্যন্ত অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছিল।
দাদা দ্বিধাকম্পিত স্বরে বলিলেন, কেন, তুমি–আপনি আমায় ডাকেননি?
সরস্বতী শুধু বলিল, আমি? আপনাকে?
দাদা ভীত হইলেন, বলিলেন, তবে এ চিঠি কার? চিঠি?
দেখি! বলিয়া সরস্বতী অগ্রসর হইয়া দাদার হাত হইতে চিঠিখানা লইল। একটু দাঁড়াইয়া কি ভাবিল। তারপর চিঠি লইয়া ধীরপদে চলিয়া গেল। দাদা দাঁড়াইয়া রহিলেন, নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখেব।
আমার অবস্থা দাদার অপেক্ষাও শোচনীয় যেহেতু আমি গাছের উপর। শিথিল হস্ত হইতে গাছের ভাল ছাড়িয়া গেল। আমি পড়িয়া যাইতেছিলাম, হঠাৎ মনে হইল পড়াটা ভাল দেখায় না। তাই পতনকে লম্ফনে পরিণত করিয়া দাদার ঘাড়ের উপর পড়িলাম। দাদা সবেগে আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া ছুটলেন। কিন্তু তখনি চেয়ারে লাগিয়া আছাড় খাইলেন। গড়াইতে গড়াইতে উঠিয়া আবার ছুটিলেন। এবার ভাগ্যের পরিহাস আরও নির্মম। একটা প্রাচীর তুলিবার জন্য খানিকটা কাদা তৈয়ারি করা ছিল। দাদা সেই কাদায় পড়িয়া গড়াগড়ি খাইলেন। কিন্তু ইহাতেও তাঁহার পলায়নস্পৃহা কমিল না। কর্দমমুক্ত হইয়া দ্রুতগতিতে পলায়ন করিলেন।
অমূল্য শব্দ শুনিয়া আসিয়া পড়িয়াছিল। তাহাকে দু কথায় ঘটনাগুলি বুঝাইয়া দিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরিয়া দেখি দাদা আঙ্গুল হইতে নাকের ডগা পর্যন্ত কাদা মাখিয়া বসিয়া আছেন। এক পাটি জুতা ফিরিয়াছে—তাহাও ছিন্নভিন্ন। বড় বৌদিদি জল দিয়া কাদা ধুইয়া দিতেছেন, কিন্তু যত না কাজ করিতেছেন তাহার চতুর্গুণ হাসিতেছেন।
দাদা রাগিয়া বলিতেছেন, তুমি তো হাসবেই বৌদি।
কি যাতনা বিষে জানিবে সে কিসে
কতু আশীবিষে দংশেনি যারে!
আমার মত অবস্থা হলে বুঝতে পারতে।
এমন সময় আমি গিয়া উপস্থিত, বলিলাম, একি দাদা, তোমার এ মুর্তি হল কি করে?
বৌদিদি কষ্টে হাসি থামাইয়া বলিলেন, ষাঁড়ে তাড়া করেছিল! বলিয়াই আবার অপরিমিত হাসিতে লাগিলেন।
আমি বলিলাম, ষাঁড়ে তাড়া? বল কি? আমাদের পাড়ার সেই কালো ষাঁড়টা বুঝি? ওটা যখন ভাল থাকে তখন বেশ থাকে। কিন্তু রাগলে আর রক্ষে নেই। আচ্ছা দাদা, ষাঁড়ে তাড়া করেছিল তো একটু আস্তে দৌড়লে না কেন? Shakespeare বলেছেন, They stumble that run fast!
দাদা দেখিলেন রাগ করা বৃথা। ক্রোধের শিখাকে যতই তিনি প্ৰদীপ্ত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, আমাদের হাসির উচ্ছাসে ততই তাহা নিভিয়া যাইতেছিল। নিরুপায় হইয়া দাদা ঔদাসীন্য অবলম্বন করিলেন। বলিলেন, He laughs at scar that never felt a wound. তোমাকে ষাঁড়ে তাড়া করলে দেখব কেমন Shakespeare-এর উপদেশ মনে থাকে।
আমি বলিলাম, দুঃখের বিষয় আমায় কখনো ষাঁড়ে তাড়া করবে। কিনা তা কেউ জানে না। যদিই বা করে তুমি হয়তো তখন উপস্থিত থাকবে না। যাক, কিন্তু তুমি তখন কেন একটা গাছের ওপর উঠে পড়লে না?
দাদা একে আমাদের বিদ্রুপবাণে একটু কাবু হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাহার উপর মনের মধ্যে ঘোরতর একটা উত্তেজনা ছিল। তিনি তাড়াতাড়ি বলিয়া ফেলিলেন, গাছ থেকেই তো ষাঁড়টা– বলিতে বলিতে থামিয়া গেলেন।
আমি বলিলাম, কি রকম, গাছ থেকে ষাঁড় নামল? আজকাল কি ষাঁড়গুলো গাছে উঠতে আরম্ভ করেছে নাকি?
বৌদিদি কিন্তু এতক্ষণ হাসিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িতেছিলেন।
দাদা বেফাঁস কথাটা বলিয়া ফেলিয়া বিষম বিপদে পড়িয়াছিলেন। তাঁহার সবঙ্গে ঘোর অস্বস্তির লক্ষণসকল স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। তোয়ালে দিয়া গা মুছিতে মুছিতে বৌদিদির উদ্দেশ্যে বলিলেন, —
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও
কুলকুল কল নদীর স্রোতের মত।
শুধু হাসতেই জান।
কৌতুকছটা উছলিছে চোখে মুখে–
কেবল চালাকি করতেই পার। বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা তো আর কিছুই হল না। বলিতে বলিতে পৃষ্ঠ প্ৰদৰ্শন করিলেন।