বাড়ি অন্ধকার
০৮.
বাড়ি অন্ধকারই ছিল। জানলার পরদা অল্প সরিয়ে হিমাদ্রি এবার-ওধার তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, কাউকে তো দেখছি না।
সর, আমি দেখছি। শ্যামলাও রাস্তার দুধারে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে না। জানলার ধার ঘেঁষে মাথাটা চেপে, এক চোখ দিয়ে বাঁ দিকটা দেখতে দেখতে সে এবার অস্ফুট শব্দ করে ছিটকে সরে এল।
কী কাণ্ড! ওরা আমাদের বাইরের বারান্দায় শুয়ে রয়েছে।
ভালই হয়েছে। পাঁচজনই আছে কি? হিমাদ্রির গলায় খুশি ফুটে উঠল।
সবটা তো দেখা যায় না, তা ছাড়া রাস্তার আলোও তো কম। শ্যামলার চাপা স্বর।
দরজা জুড়ে শুয়েছে পালানোর পথ বন্ধ করার জন্য। এভাবেই যেন শুয়ে থাকে। দাদা, চটপট এবার রেডি হয়ে নে।
রেডিই আছি। এই স্লিপিং সুট পরেই চলে যাব। একটা বেডকভারেই তো হয়ে যাবে, আর-একটা জোড়ার দরকার কী?
দরকার আছে। কানু ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দেখেছে জমির অনেক ওপর পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে। লাফিয়ে পড়লে শব্দ হবে। রেখা গুপ্ত বেডকভারটা আঁকড়ে বললেন, আমি আর-একটা বেঁধে নিয়েছি। ছাদে চল। আর শোন, যেখানেই যা, পোঁছেই ফোন করে জানাবি কিন্তু।
সুনীলবরণের ঘরের দরজা বন্ধ। চারজন নিঃসাড়ে ঘরটা পেরিয়ে পাঁচিলের ধারে এল। নীচেই বাড়ির পেছনে সরু গলি। তারপর পাঁচ ফুট উঁচু সীমানার পাঁচিল। ওটাও সমীরণকে টপকাতে হবে এবং বহুবারই সে এটা করেছে মাঠে যাওয়ার জন্য শর্টকাট করতে গিয়ে।
বেডকভার ঝুলিয়ে হিমাদ্রি আর শ্যামলা ধরে রইল। কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে সমীরণ কার্নিসে নেমে বেডকভার আঁকড়ে সন্তর্পণে একটা পা প্রথমে ঝোলাল। পা রাখার মতো জায়গা নেই।
দুর্গা, দুর্গা। পাঁচিলে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে রেখা গুপ্ত ভাইপোর মাথা স্পর্শ করলেন।
হিমাদ্রি ও শ্যামলা প্রাণপণে টেনে রয়েছে। প্রায় সত্তর কেজি ওজনের টান সামলাতে দুজনেরই দাঁতে দাঁত লেগে গেছে।
আহহ, সমীরণ কাতরে উঠল।
কী হল নাকু? রেখা গুপ্ত ঝুঁকে পড়লেন।
একটু টেনে তোলো, একটা শিক, তাড়াতাড়ি, লাগছে।
রেখা গুপ্ত প্রায় লাফিয়েই এসে বেডকভার ধরলেন। তার ধাক্কায় হিমাদ্রির মুঠো আলগা হয়ে গেল। অবশ্য পিসির মুঠো ততক্ষণে শক্ত করে ধরে ফেলেছে। একটা টানেই তিনি সমীরণকে প্রায় দু হাত তুলে নিলেন।
কানু জিজ্ঞেস কর, আর তুলব?
হিমাদ্রি পাঁচিলে ঝুঁকে ফিসফিস করে ফিরে এল। এইভাবে ধরে থাকতে বলল।
রেখা গুপ্ত বেডকভার ধরে শরীরটা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি পেছনে হেলিয়ে দিলেন। টানটান বেডকভার হঠাৎই ঢিলে হয়ে গেল, আর রেখা গুপ্ত ছাদের ওপর চিত হয়ে পড়লেন, শ্যামলাকে বুকের ওপর নিয়ে।
নাকু তা হলে এখন মাটিতে! রেখা গুপ্তর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় আশ্বস্তের ভাগটাই বেশি। ধড়মড়িয়ে উঠে তিনি পাঁচিলের কাছে যাওয়ার আগেই, বেড়ালের মতো লাফিয়ে পাঁচিল টপকে সমীরণ ইলেকট্রিক মাঠে নেমে পড়েছে।
তিনজন তীক্ষ্ণ নজরে অন্ধকার চিরে চিরে সমীরণকে খুঁজে পেল না। একটু পরে মোটর স্টার্ট দেওয়ার ক্ষীণ শব্দ পেয়ে শ্যামলা তালি দিয়ে উঠল। হিমাদ্রি বলল, সেফলি পৌঁছে গেছে। রেখা গুপ্ত জোড়হাত কপালে ঠেকালেন।
কী বা অন্ধকার কী বা আলো, ইলেকট্রিক মাঠটাকে সমীরণ চেনে তার হাতের রেখাগুলোর মতো। তার একটাই শুধু ভয় ছিল, কাছাকাছি কুকুরগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না। রাস্তার দিকে এগোতে এগোতে সে খুঁজল মোটরগাড়ি। যে মারুতিটায় ঘুনুদা এসেছিলেন নিশ্চয় সেটাতেই আসবেন। কুকুরের ডাক উঠল না, তবে ছোট্ট করে একবার হর্ন বেজে উঠল। অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা মোটরের ছায়া দেখে সে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল।
ঢুকে পড়।দরজা খুলে মিষ্টি স্বরে ডাক দিলেন। গাড়ির এঞ্জিন চালু হয়ে গেছে। সমীরণ পেছনের সিটে বসে দরজা বন্ধ করার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
কোনও ঝামেলা হয়নি? ঘুনু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন। ভি আই পি রোডে পড়ে ডান দিকে সবেগে বাঁক নিয়েই নির্জন রাস্তায় মারুতি প্রায় উড়ে চলল।
ছেলেগুলো আমাদের বাইরের বারান্দায় ঘুমোচ্ছে। কাল সকালে যখন জানতে পারবে, কী যে তখন করবে কে জানে।
কিছু করতে পারবে না। তোর পিসিকে যতটুকু বুঝেছি তাতে এটুকু বলতে পারি, হাড়গোড় আস্ত রেখে সবকটা যদি ফিরে যেতে পারে তা হলে সেটা হবে ওদের বাপের ভাগ্যি।
ঘুনুদা, এখন কোথায় যাচ্ছি?
যেখানে তুই সবথেকে নিরাপদ থাকবি, পতুর বাড়ি।
এতক্ষণে সমীরণের খেয়াল হল, পেছনের সিটে আর-একজন বসে রয়েছে। অন্ধকারে তাকে চিনতে পারল না।
আমি দুলালদা।
সমীরণ অ্যা বলে চমকে উঠতে যাচ্ছিল। সামলে নিয়ে বলল, তুমিও সারথি ছাড়লে?
হ্যাঁ। নির্মাল্যদার জেতার কোনও আশা নেই। দুলাল মৃদুস্বরে কথাটা বলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
উল্টোডাঙা মোড়, ফুলবাগান, বেলেঘাটা রোড, কনভেন্ট রোড হয়ে সি. আই. টি. রোড় এবং পতু ঘোষের বিরাট পাঁচতলা বাড়ির গেট দিয়ে মারুতি যখন ঢুকল তখন রাত আড়াইটে।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে পর পর দুটো দরজা। বাঁ দিকেরটির ডোর বেল বাজিয়ে ডান দিকের দরজাটি দেখিয়ে ঘুনু বললেন, পতুর প্রাইভেট ড্রইংরুম। অবশ্য ভেতর দিয়েও ওদিকে যাওয়ার দরজা আছে।
ঘুম-চোখে দরজা খুলল অল্পবয়সি একটি ছেলে। ভেতরে ঢুকে সমীরণ ঘরটা দেখল। দেয়াল থেকে দেয়াল কার্পেট, তাতে পা ডুবে যায়, এত পুরু আর নরম। নিচু টেবিল, কোচ, সোফা, টিভি, টেবিল ল্যাম্প, এয়ার কুলার, আলমারিতে বই, দেয়ালে কয়েকটা পেইন্টিং, রেফ্রিজারেটর, ইনভারটার, জানলায় মেঝে-ছোঁয়া ভারী পরদা। তার দেয়ালে বিচিত্র লাইট শেড। এটা বসার ঘর। এর একদিকের দেয়ালে পাশাপাশি দুটি ঘরের দরজা।
ঘুনু ব্যস্ত হয়ে বললেন, দেবু, খাবারদাবার কী আছে?
বিরিয়ানি আর কড়াপাকের সন্দেশ আছে।
নাকু?
না, না, ঘুনুদা, আমি খেয়ে এসেছি।
লজ্জা করিস না। এখানে অঢেল ব্যবস্থা। যা খেতে ইচ্ছে করবে দেবুকে বলবি। তুষার তো কাল থেকে শুধু ফিশফ্রাই আর চিনে খাবারই খেয়ে যাচ্ছে।
তুষারদা এখানে?
বুকুও তো রয়েছে। কড়াপাক বোধ হয় ওর জন্যই আনা? ঘুনু তাকালেন দেবুর দিকে।
আজ পঁচিশটা এনেছি, বুকুদা পনেরোটা খেয়ে নিয়েছে।
ভাল। গরিবের ছেলে তো, একটু খাই খাই ভাব রয়ে গেছে। নাকু তুই দুলালের সঙ্গেই এক ঘরে থাক। পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করলেন।
আগে একটা টেলিফোন করব পিসিকে।
টেলিফোন? কিন্তু ওটা তো ওদিককার ড্রইং রুমে। দরজার চাবি দেওয়া। ঘুনু আমতা আমতা করলেন। কাল সকালে করিস।
দেবু একবার ঘুনুর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ সিলিংয়ে তুলল। দুলাল বলল, ঘুম পাচ্ছে, আয়।
আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি, কথাটথা কাল হবে। অবশ্য বলার মতো কথা আর কীইবা আছে। নিজেই এলি, এতে আমার কী আনন্দই যে হচ্ছে। তোর কোনও ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হবে না। ক্লাব পলিটিক্স কলকাতায় কী রকম হয় তা তো জানিসই! সুবোধ কি সীতেশ চেষ্টা করবে তোকে খচাবার, কিন্তু পারবে না। যা এখন, শুয়ে পড়।
ঘুনু চলে গেলেন। দুলালের সঙ্গে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই সমীরণের মনে হল। কোনও ফাইভ স্টার হোটেলের ঘরে যেন সে ঢুকল।
পতুদার গেস্টরা এসে এখানে থাকে, সেইভাবেই সাজানো। কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার, কয়লা আর স্টিল…কোটি কোটি টাকা।দুলাল সসম্রমে বলল পাজামা পরতে পরতে। কিন্তু মানুষটাকে দেখে তোর মনেই হবে না, এত টাকার মালিক। ব্যবসার কাজে এখন কানপুর গেছে…তুই কতয় এলি?
দুই-দশ অফার দিয়েছেন ঘুনুদা।
রাজি হয়ে ভালই করেছিস। সারথিতে থাকলে পুরো টাকা কখনওই পেতিস না। আমি এখনও পনেরো হাজার পাব, কিন্তু বটা বিশ্বাস আটকে রেখেছে। যাত্রী দেবে পৌনে দুই, ওখানের থেকে পঁচিশ বেশি।
দুলালদা, এখন এসব টাকাপয়সার কথা থাক। তিনটে বাজতে চলল, এবার শোব। সমীরণ বালিশটা কার্পেটের ওপর ছুড়ে দিয়ে বিছানা থেকে বেডকভারটা তুলে নিল।
তুই মেঝেয় শুবি?
নিশ্চয়ই। ওই ফোম রবারের ওপর শুলে আরাম পাওয়া যায়, কিন্তু শরীরটার। তেরোটা বাজবে। এই এয়ার কুলারের ঠাণ্ডাটা খুবই আরামের, তবে আমার পছন্দ পাখার হাওয়া।
এয়ার কুলার কিন্তু আমি বন্ধ করব না। দুলাল বেশ কড়া গলায় সমীরণকে জানিয়ে দিল।
আলো নেভাব?
হ্যাঁ।
আলো নিভিয়ে, স্লিপিং সুট পরা সমীরণ বেডকভারটা গায়ের ওপর টেনে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর দুলাল বলল, সমীরণ, একটা কথা বলব?
হুঁ, বলো।
তুই কেন জানি একটু অন্যরকম। সেজন্যই তোকে আমার ভাল লাগে। লেখাপড়া করা প্লেয়ার বা আমার মতো কি-অক্ষর গোমাংস প্লেয়ার কম তো দেখলাম না, কেউ কিন্তু গভীর শ্রদ্ধা ফুটবলকে দেয় না। দিলে সে সবার আগে শরীরের যত্ন নিত, ক্ষমতা বাড়াত, স্কিল বাড়াত, ডিসিপ্লিন লাইফ লিড করত। কিন্তু শ্রদ্ধা যে আনব বা দেব তারও তো একটা সঙ্গত কারণ থাকা চাই। বেশিরভাগই আমার মতো গরিব ঘর থেকে এসেছে, অশিক্ষিত। সবার আগে নিরাপত্তা, টাকা, এটাই আমাদের মাথায় থাকে। এটা কি অন্যায়?
অন্যায় তো নয়ই, প্রফেশনালিজমের এটাই আসল ভিত।
বলছিস?
হুঁ। টাকার জন্যই মারাদোনা, গাওস্কর, লেন্ডল, কার্ল লুইসরা ফর্ম ধরে রাখতে প্রাণপণ করে গেছেন আর সাকসেসও পেয়েছেন। তুমি-আমি তো কোন ছার। টাকাকে অশ্রদ্ধা কোনওমতেই করা উচিত নয়। আসলে আমাদের পরিবেশটাই এত খারাপ যে, এক লাখ কি দুলাখ পাচ্ছি শুনলেই লোকে চমকে ওঠে। এরা একবারও ভেবে দেখে না টিভি-তে যাদের খেলা দেখে আহা আহা করে তারা বছরে কোটি টাকা পায়। তাদের একটা নিরাপত্তা আছে। এখানে আমার কী আছে?
কিচ্ছু নেই। আর সেজন্যই আমাকে উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়।
তা হলে এবার তুমি ঘুমোও।
সমীরণ ডেকভার টেনে নিজেকে ঢেকে দিল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে দেবুর দেখা পেল।
চা দেব?
হ্যাঁ, তার আগে ফোন করব।
যান না ও-ঘরে, ঘরের দরজা তো শুধু বন্ধ করা।
চাবি দেওয়া নয়?
কালকের মতো সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেবু বলল, ঘুনুবাবুর কথার ওপর কথা বলা বারণ।
সমীরণ দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, চিরটাকাল একই রকম থেকে গেল।
তিক্ততায় ভরে উঠল সমীরণ। এত টাকা খরচ করছে যাত্রী ভাল একটা দল গড়ার জন্য, অথচ এইসব ক্ষুদ্রতা নীচতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না।
পতু ঘোষের ব্যক্তিগত ড্রইংরুম তার গেস্টরুম থেকে একটু বেশি সমৃদ্ধ। পরদার এবং সোফার কাপড় আরও দামি, কার্পেটের নকশা আলাদা, দেওয়ালে পেইন্টিং তো আছেই। তা ছাড়া করাত দিয়ে কাটা বাকলসহ বিশাল একটা গাছের গুঁড়ির টুকরো রাখা হয়েছে, ঘরের একধারে। ফোনের রিসিভারেই ডায়াল বাটন।
হ্যালো, কে মলা?
দাদা?
খবর কী, ওই ছেলেগুলো—-
আর বলিসনি। পিসি তো আজ বেগিংয়ে বেরোয়নি। কাল ছাদে পড়ে গিয়ে কোমরে লেগেছে। এখন বিছানায়। আমি মাদার ডেয়ারির বুথ থেকে দুধ আনতে যাব বলে দরজা খুলে বেরিয়েই দেখি পাঁচ মূর্তি বসে রয়েছে বারান্দায়। বললাম, এ কী আপনারা বাড়ির মধ্যে কেন? একজন বলল, পিসির সঙ্গে সমীরণদা কথা বলা কি শেষ হয়েছে? তাড়াতাড়ি আসতে বলুন। বললাম, কাকে আসতে বলব? বলল, সমীরণদাকে। বটাদা বলে দিয়েছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে। তখন বললাম, দাদা তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে চলে গেছে। তাই শুনেই তো ওদের চক্ষু চড়কগাছ। ভেতরে ঢুকে সব ঘর, ছাদ তন্নতন্ন করে দেখে প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, কোথায় গেছে সমীরণদা, বলুন কোথায় গেছে? কানু বলল, কলকাতার ফুটবলের হাল দেখে বোধ হয় সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয় চলে গেছে। আমি বললাম, দাদা তো সন্ন্যাসী হওয়ার লোক নয়, দেখুন গিয়ে তারামায় বসে হয়তো জিলিপি খাচ্ছে। শোনামাত্র পড়িমড়ি দৌড়ল তারামার দিকে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল চলে যাওয়ার সময় ওদের মুখ দেখে।
মলা শোন, আমি এখন পতু ঘোষের বাড়িতে। ফোন নাম্বারটা রেখে দিস, দরকার হলেই ফোন করবি।
জায়গাটা কেমন?
ফুটবলারদের ধ্বংস করার জন্য যা দরকার সেটা এখানে ভালমতোই আছে, প্রচুর টাকা, প্রচুর আরাম। ভাল কথা, কানু যেন প্লেনের টিকিটটা কেটে রাখে।
ওখানেও কি জেলখানা?
বুঝতে পারছি না, কয়েক ঘণ্টা তো এসেছি। আজকের দিনটা দেখে বুঝতে পারব।
পিসিকে কিছু বলতে হবে?
না, না, কিছু বলার দরকার নেই। শুয়ে থাকতে দে। মনে হয় না বটা বিশ্বাস বাড়িতে এসে গোলমাল করবে, এখন রাখছি।
গেস্টরুমগুলোর লাগোয়া, ঘরের মাপের একটা ডাইনিং স্পেস। ছজনের জন্য একটা টেবিল। পরদা টেনে দিলেই এই খাবার জায়গাটা বসার জায়গা থেকে আলাদা হয়ে যায়। টেবিলে দেবু থরে থরে খাদ্য সাজিয়ে রেখেছে। বিশাল এক বৌলে স্যালাড। আপেল, কলা, আঙুর স্তৃপ করা। বাটিভরা মাখন আর জেলি। প্লেটে দুধে ডোবানো কর্নফ্লেকস। থরে থরে সাজানো সেঁকা পাউরুটি। কড়াপাকের সন্দেশ।
দুলাল ছুরি দিয়ে মাখন লাগাচ্ছে রুটিতে, এক একটা স্লাইসে প্রায় একশো গ্রাম। তুষার বিরক্ত চোখে মাখনের বাটিটা পাওয়ার জন্য তাকিয়ে রয়েছে দুলালের দিকে। বুকু অবাক হয়ে গেল সমীরণকে দেখে।
তুই! এখানে?
কাল রাত্তিরে এসেছে, তুষার একদৃষ্টে মাখনের বাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কীরে দুলে, রুটির ওপর মাখনের ড্রিবলিং অনেকক্ষণ তো চালাচ্ছিস, এবার পাসটা বাড়া।
তুই জেলি মাখানো শুরু কর না। ওভারল্যাপটা কখনওই ঠিক সময়ে তোর দ্বারা আর হয়ে ওঠে না। আচ্ছা এই নে।
দুলালের ঠেলে দেওয়া মাখনের বাটিটার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে তুষার বলল, এটা নিয়ে করব কী! কিছুই তো রাখিসনি। চিরকালই তোর ফাইনাল পাসটা এমন জায়গায় হয় যে, গোল আর করা যায় না। সন্দেশের প্লেটে কিন্তু হাত দিবি না বলে রাখলুম।
ওটা বুকুর সঙ্গে বোঝাপড়া করে নে। গোলমরিচের গুঁড়ো রুটিতে ছিটিয়ে কামড় বসাবার আগে দুলাল বলল।
নাকু, তুই তো সারথিতেই থেকে যাবি শুনেছিলাম! বুকুর বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি।
মত বদলালাম।
কেন? দরে পোষাল না?
সমীরণ উত্তর দিতে গিয়েও দিল না। শুধু মাথা নাড়ল। বুকু চোখ সরু করে তেরছা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল। সমীরণ প্লেটে স্যালাড তুলতে তুলতে সেটা লক্ষ করে হাসল।
নাকু তুই হাসলি যে? দুলাল বলল।
সারথির পাঁচটা ছেলে বাড়ির সামনে পাহারা দিচ্ছিল কাল রাতে। এখন বটাদা তাদের কী বলছে সেটা মনে করেই হাসি পেল। আচ্ছা দুলালদা, পৃথিবীতে আর কোনও দেশে কি এইভাবে দলবদলের আগে ফুটবলারদের গাধা-গোরুর মতো খোঁয়াড়ে পোরা হয়?
একটা দারুণ কথা নাকু তুই বললি। তুষার মুখভরা রুটির মধ্যে একটা ফাঁক তৈরি করে বাক্যটি বের করে আনল। মানুষকে গাধা-গোরু কখনওই বানানো যায় না যদি না সে নিজেই তা হতে চায়। আমরা হতে চেয়েছি তাই ওরা বানিয়েছে। না চাইলে বানাতে পারত না। এখানে লাস্ট চারটে ওয়ার্ল্ড কাপের সাত-আটটা ম্যাচের ক্যাসেট আছে। তুই তার যে-কোনও একটা ম্যাচ দ্যাখ। তোর মনে হবে গাধা-গোরুরা নয়, বাঘ-সিংহের লড়াই হচ্ছে। ওদের খোঁয়াড়ে ভরার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাববে না।…দুলে কড়াপাকের দিকে আর তাকাসনি বাবা। আগের সিজনে বুকু যে কটা সিটার মিস করেছে ঠিক সেইকটাই এখন রয়েছে। ওর থেকে যদি খাস—। তুষারের কথা থেমে গেল। রাগ করে বুকু উঠে পড়েছে।
সব সময় পেছনে লাগার স্বভাবটা তোমার আর গেল না। আমি কটা মিস করেছি তার ফর্দ তুমি রেখেছ, আর তুমি কটা গলিয়েছ তার হিসাবটাও কি রাখো?
রাখি। নির্বিকার মুখ তুষার বলল। যত্নভরে কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে সে আড়চোখে একবার সমীরণের দিকে তাকাল! কলকাতার মাঠে লাস্ট সিজনে চারবার বিট হয়েছি শুধু নাকুর কাছে। কিন্তু ও গোল দিতে পারেনি। হ্যাঁ মানছি, চারবারই সারথির পেনাল্টি পাওয়া উচিত ছিল। এবার আর নাকুকে মেরে থামাতে হবে না ভেবে পুণ্য অর্জনের সম্ভাবনায় ঠিক করেছি স্যাক্রিফাইস করব।
তিনজোড়া চোখ তুষারের ওপর গেঁথে গেল।
সন্দেশগুলো, বুকু তুই একাই খেয়ে নে।
আমার মুশকিলটা কী জানো তুষারদা, তোমার এগেনস্টে খেলার সুযোগ একবারও পেলাম না। পেলে তোমাকে বুঝিয়ে দিতে পারতাম…। বুকু অর্থপূর্ণ হাসি তিনজনকে উপহার দিল।
তুষার ভ্রূ তুলে বলল, কী বুঝিয়ে দিতিস?
বুঝিয়ে দিতাম তোমার রিটায়ার করার সময় এসে গেছে।
বুকু কথাটা বলেই টেবিল থেকে উঠে বসার জায়গায় গিয়ে টিভি সেটের সুইচ টিপল। ধীরে ধীরে তুষারের মুখ থমথমে হয়ে উঠল।
খবরের কাগজ কখন আসে? সমীরণ বলল প্রসঙ্গটা সহজ করার জন্য দুলালকে লক্ষ্য করে। এইসব আকচাআকচি, হিংসা, মনোমালিন্য তার মনটাকে ঘুলিয়ে দেয়। সে শুনেছে ক্লাবে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এই দুজনের মধ্যে লড়াই চলছে। দুজনে দুই কর্তার প্লেয়ার।
আসে না।
মানে? তোমরা কাগজ পড়ো না?
পড়ি।
তা হলে?
তা হলে আবার কী? দুলাল বিরক্তিভরে বলল, আমাদের খবরের কাগজ পড়া বারণ, তাই আসে না।
স্তম্ভিত হয়ে গেল সমীরণ। সে বুঝে উঠতে পারছে না কাগজ পড়ার মতো একটা সাধারণ ব্যাপারে আপত্তি কেন?
দুলাল ওর মনের কথাটা আন্দাজ করেই বলল, ক্লাব অফিসিয়ালদের বিবৃতি, ইন্টারভিউ, প্লেয়ারদের হাম্বা হাম্বা, কে কাকে ধরতে গিয়ে ফসকে গেল, কে বলছে অমুক ক্লাবে খেলব তমুক ক্লাবে যাব না, কাকে কত টাকা অ্যাডভ্যান্স দেওয়া হল আর কে অ্যাডভান্স নিয়েও বিরোধী ক্যাম্পে গিয়ে উঠল, অফিসিয়ালদের কে নিজের ক্লাবের বিরুদ্ধেই কথা বলল-এইসব যাতে আমরা জেনে না যাই সেজন্যই খবরের কাগজ দেওয়া হয় না। দুলাল ফিক ফিক হেসে চামচে কর্নফ্লেক্স তুলে মুখে দিল।
এটা অত্যন্ত অন্যায়, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। সমীরণ রেগে উঠল।
দুলাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল দেবু এসে তাকে বলল, বউদির ফোন।
দুলাল ব্যস্ত হয়ে উঠে গেল। তুষারও উঠল। সমীরণ টেবিলে একা বসে রুটি চিবোতে চিবোতে দেবুকে বলল, চা দাও।
চা নয়, হরলিকস খেতে হবে।
শুনেই সমীরণ চোখ সরু করল। খেতে হবে। যাক, দরকার নেই।
পাংশু মুখে ফিরে এল দুলাল। সমীরণের সামনের চেয়ারে বসে নার্ভাস স্বরে বলল, মুশকিলে ফেলল দেখছি। বটা বিশ্বাসের ষাট-সত্তরটা ছেলে বাড়ির সামনে। চিৎকার করছে, গালাগাল দিচ্ছে আমার নামে। কী করা যায় বল তো। অস্থিরভাবে দুলাল সোফায় বসা তুষারের কাছে চলে গেল।
তুষার, এখন কী করি বল তো?
কী আবার করবি। বউকে বল দরজা জানলা বন্ধ করে, কানে তুলো দিয়ে বসে থাকতে। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে ওরা আপনা থেকেই চলে যাবে।
তাইই বলেছি। কিন্তু বটাদা টেলিফোন করে বউকে বলেছে দেখা করতে আসবে। এটাই তো ভয়ের কথা। ছন্দা তো বটাদা বলতে অজ্ঞান।
হোক না অজ্ঞান! তোর জ্ঞানটা ঠিক থাকলেই হল।
ছন্দাকে তো চিনিস না, ও অজ্ঞান হলে আমাকেও যে অজ্ঞান হতে হবে এটা বটাদা জানে। গত বছর ওকে দিয়ে বটাদা এমন প্রেশার দেওয়াল যে, যাত্রীর অ্যাডভান্স নিয়েও সারথিতে যেতে হল।
সমীরণ এসে দুজনের সঙ্গে বসল। বুকু সঙ্গে সঙ্গে টিভি বন্ধ করে ঘরের মধ্যে চলে গেল। ডোরবেল বেজে উঠল। দেবু দরজা খুলে দিতেই সুবোধ ধাড়া, সীতেশ রায় এবং সাত-আটজন যুবক ও মাঝবয়সি লোক ভেতরে ঢুকল।
সমীরণকে দেখেই সুবোধ ধাড়া একগাল হাসল।
বটাকে ম্যাজিক দেখালি? ভাল, ভাল, এবার মাঠে নেমে পায়ের জাদুটাও দেখাস।
সমীরণ চুপ করে রইল। দুলাল ইশারায় সুবোধ ও সীতেশকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। ওদের সঙ্গে আর যারা ঢুকেছে তারা সোফায় বসে নিজেদের মধ্যে জোর গলায় কথা বলা শুরু করল—কোন প্লেয়ারকে আনা দরকার, কার কত দর হওয়া উচিত, আর পঁচিশ হাজার বাড়ালেই কাকে পাওয়া যাবে, কাকে একদমই বিশ্বাস করা যায় না, কে ল্যাজে খেলাচ্ছে, এইসব কথার থেকে সরে যাওয়ার জন্য সমীরণ বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়াল।
মরক্কো চামড়া বাঁধানো ইংরেজি এবং বাংলা নানাবিধ বই থেকে সে অনুমান করল পতু ঘোষ লোকটা উটকো এবং সাজানো বনেদি নয়। শিক্ষা, রুচির একটা ভিত পরিবারে আছে। আলমারির পাল্লা টানতেই খুলে গেল। সে বঙ্কিম গ্রন্থাবলীর একটা খণ্ড বের করে পাতা ওলটাল। কয়েকটা উপন্যাস রয়েছে এই খণ্ডে। বইটা নিয়ে সে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে পরদা টেনে দিল। জানলার পরদা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা অফিসবাড়ি। দোতলায় ব্যাঙ্ক। রাস্তার কিছুটা চোখে পড়ে। বাস, মোটর ইত্যাদি চলছে। আকাশ কষ্টেসৃষ্টে দেখা যায়। সে একটা চেয়ারে বসে আর-একটায় দুটো পা তুলে দিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সে কপালকুণ্ডলায় ডুবে গেল।
উপন্যাসটা যখন প্রায় শেষ করে এনেছে, হঠাৎ একটা মেয়েগলার চিৎকারে। সমীরণ বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল।
কোথায় দুলাল চক্রবর্তী? তাকে কোথায় রেখেছেন, বের করে দিন।
কে আপনি?
আমি ওর বউ মধুছন্দা।
এখানে দুলাল চক্রবর্তী নেই।
নেই মানে, আজ সকালেই ফোনে কথা বলেছি। আমায় বলল, এখানে ওকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। আমি সব ঘর সার্চ করব।
বলছি তো এখানে নেই। আপনি যেতে পারেন।
সমীরণ পরদার ওপারের সংলাপ শুনে বুঝল সুবোধ ধাড়াদের সঙ্গে আসা সেই লোকগুলি ছাড়া ওখানে আর কেউ নেই। নিশ্চয় আগাম জেনেছে মধুছন্দা আসছে তাই কেটে পড়েছে।
আমায় আটকাবেন না বলছি। নীচে একশো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা আমার স্বামীকে অবৈধভাবে এখানে ধরে রেখেছেন।
আপনি যদি ঘর দেখতে চান, দেখতে পারেন, কিন্তু অন্য কাউকে ঢুকতে দেব না, সেটাও তা হলে অবৈধ ব্যাপার হবে।
ঠিক আছে, এই তোমরা এখানে দরজার বাইরেই থাকো।
না বউদি, আমরাও আপনার সঙ্গে থাকব।
আপনাকেও যদি আটকে রেখে দেয়?
অ্যা অ্যা অ্যা, আটকাবে আমাকে? জ্বালিয়ে দেব না সারা বাড়ি। আমি একাই দেখছি, তোমাদের ঢুকতে হবে না।
বটা বিশ্বাস তা হলে এর মধ্যেই অর্গানাইজ করে ছেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। সমীরণ পাতার সংখ্যাটা দেখে বই বন্ধ করল। কিন্তু যদি তাকে এখন দেখে ফেলে? যদি জবরদস্তি চ্যংদোলা করে তুলে নিয়ে যায়? তারপরই মনে হল, প্লেয়ার তোলা এভাবে হয় না। যাকে তোলে সে স্বেচ্ছায়ই হাজির হয়।
ঘরের দরজা খোলা আর বন্ধের শব্দের সঙ্গে মধুছন্দার গলা ভেসে এল। কোথায় ওকে সরিয়েছেন আপনারা বলুন, নয়তো কুরুক্ষেত্র বাধাব বলছি।
বললাম তো আপনাকে, দুলাল চক্রবর্তী আধঘণ্টা আগে ওর জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। হঠাৎ, নিজের থেকেই। যাওয়ার সময় শুধু বলল, এখানে থাকব না, বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। যদি বউ খোঁজ করতে আসে—, কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সমীরণ শুনল তুষারের গলা, তা হলে বলে দেবে, বটাদা এবার কত ভরির হার দেবে সেটা জেনে নিয়ে যেন বাড়িতে বিকেলে ফোনের পাশে বসে থাকে। পাঁচ ভরির কম হলে সারথিতে থাকব না।
তুষারদা, আপনি তো একজন বড় প্লেয়ার, আপনিই বলুন, ফুটবলারদের কি বিশ্বাস করা যায়? ওদের কথার কি কোনও দাম আছে?
ছন্দ, আমিও কিন্তু একজন ফুটবলার।
না, না, আপনাকে বলছি না, আপনি বাদে আর সবাই। আমাকে বলল একটা হিরের নাকছাবি করিয়ে দেবে সারথির টাকাটা পেলেই। এক বছর হয়ে গেল, কোথায় নাকছাবি? এবার বলল যাত্রীর অ্যাডভান্স পেলেই না, না, আমি আর বিশ্বাস করছি না। বলুন না তুষারদা ও কোথায়? বটাদা বলেছেন মামনকে লরেটোয় ভর্তি করিয়ে দেবেন। উনি এককথার মানুষ, যা বলেন তাই করেন।
লরেটোয় তো পতুদাও ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন।
পারেন? আপনি একটু বলবেন তুষারদা?
তুমি নিজেই বলো না।
ঠিক আছে আমিই বলব। জানেন, আমার বড়দির মেয়ে কী ফটাফট ইংরিজি বলে! মেমসাহেবদের মতো উচ্চারণ। শুনলুম পতুদা এখানে নাকি নেই?
কাল-পরশুই এসে যাবে, তুমি বরং পরশুই এসো।
সমীরণ ভেবে পাচ্ছে না, হাসবে, না, রাগবে। একটা ফুটবলারকে জীবনে কতজনের কতরকমের স্বার্থ, লোভ দেখে চলতে হয়। দুলালদা প্রায়ই বলে, গুছিয়ে নে, নাকু, গুছিয়ে নে। এই খেলা চিরকাল তো থাকবে না, যা পারিস বাগিয়ে নে। দুলালদা বাগিয়ে নেওয়ার জন্য যাত্রী আর সারথির মধ্যে লাথি খাওয়া বলের মতো যাতায়াত করছে।
বইটা খুলে আবার সে পড়তে শুরু করল। কয়েক মিনিট পর দেবু পরদা সরিয়ে মুখ বাড়াল।
দুপুরে কী খাবেন?
যা হোক।
তুষারদা ইলিশ খাবে বলেছে, বুকুদা চিকেন। যে যা খেতে চাইবে তাই দেওয়া হবে। বুকুদা তো কাল এগারোটা ক্যডবেরি চকোলেট খেল।
আমি খাব ভাত, ডাল, তরকারি আর যে-কোনও একটা মাছের ঝোল।
আর?
আবার কী? সমীরণ তাকাল দেবুর বিড়ম্বিত মুখের দিকে। রোজ যা খাই তাই খাব, তবে ইলিশভাজা পেলে ছাড়ি না আর দই পেলে তো খুবই ভাল হয়।
দেবুর স্বস্তি পাওয়া মুখ দেখে সে বলল, বউদিটি চলে গেছেন, না দলবল নিয়ে নীচে বসে আছেন?
বসেটসে নেই, একদমই চলে গেছেন। এদিকে এরাও সব তুষারদাকে নিয়ে বড়বাবুর ড্রইংরুমে গিয়ে বসেছে। মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরের দরজাও লক করে দিয়েছি। বড়বাবুর কড়া অর্ডার প্লেয়ার ছাড়া এদিকে কেউ থাকবে না। ঝামেলাটামেলা হলে ওদিককার ঘরেই হোক। কাল গৌরবন্ধু বেরা-র বাবা এসে যা চেঁচামেচি করল।
গৌরবন্ধু, মানে সারথির তিন নম্বর গোলকিপার?
হ্যাঁ। ওকে সত্তর হাজার দেওয়ার কথা হয়েছে। লোকটা এসে বলে একলাখ পঁচিশ চাই। ভাবুন একবার, জুনিয়ার বেঙ্গলে একটা ম্যাচ শুধু খেলেছে, সিনিয়ার বেঙ্গল টিমের রিজার্ভে ছিল, সারথিতে গত বছর চারটে একজিবিশন ম্যাচে নেমেছে, আপনি তো আমার থেকেও ভাল জানবেন, এই প্লেয়ার কিনা চাইছে সোয়া লাখ! দু ঘণ্টা ধরে ওর বাপ চেঁচাল, রাগ দেখাল, তারপর কান্নাকাটি, হাতজোড়, মানে শান্তিগোপাল, স্বপনকুমারও হার মেনে যাবে!
চাইবে না কেন? সারা ময়দানে রটে গেছে টাকার বস্তা নিয়ে পতু ঘোষ প্লেয়ার কেনার দোকান খুলেছে। কানা, খোঁড়া, নুলো, খোকা, বুড়ো যাকে পারছে অ্যাডভান্স ধরাচ্ছে। গৌরবন্ধুর কতয় রফা হল?
আশি হাজার।
অ্যাাঁ। ওর দাম তো আশি টাকাও নয়, আর কিনা পাবে আশি হাজার!
আপনি অ্যাডভান্স নিয়েছেন? দেবুর স্বরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা।
না। সমীরণ হুঁশিয়ার হল। এইসব বিষয় নিয়ে এই পর্যায়ের লোকের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়।
চাইলে অ্যাডভান্স কেন, পুরো টাকাটাই আপনাকে দিয়ে দেবে। আপনি যাত্রীর বড় ক্যাচ, আপনাকে যে পাব এটা তো আমরা আশাই করিনি।
এই সময় চেঁচিয়ে একজন বলে গেল, সমীরণ তোমার ফোন এসেছে।
নিশ্চয় বাড়ি থেকে। আর তো কেউ জানে না সে এখানে! সমীরণ প্রায় ছুটেই ড্রইংরুমে গেল।
কে, দাদা? আমি কানু।
পিসি স্কুলে গেছে?
যায়নি। হটওয়াটার ব্যাগ নিয়ে সেঁক দিচ্ছে। শোন, এইমাত্র বাঙ্গালোর থেকে তোর ফোন এসেছিল।
মাথার মধ্যে ঝনাৎ শব্দ করে সমীরণের শরীর শক্ত হয়ে গেল। কে করেছে?
পদ্মনাভন, এ. আই. এফ. এফ. সেক্রেটারি। এক্ষুনি তোকে রওনা হতে বলল।
এক্ষুনি রও— সে থেমে গেল। সারা ঘর কান পেতে, সব চোখ এখন তার দিকে। খোলাখুলি কথা বলা নয়।
কেন বলল?
নাগজি টুর্নামেন্টে তোরা খেলছিস না, কারণ চেকোশ্লোভাকিয়া ট্যুর গভর্নমেন্ট স্যাংশন করেছে। দশদিনের মধ্যেই টিম রওনা হবে। তোর জন্য নোভাচেক অপেক্ষা করছে। মিনিটখানেক কথা হল।
সমীরণের হাতের ফোন থরথর কাঁপছে। তার জীবনের স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ফোনের মধ্য দিয়ে সারা শরীরকে সুখে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটা সন্দেহ কাঁটার মতো তার মগজে বিধল। ফোনটা বাঙ্গালোর থেকে, না কি শোভাবাজারের অভয় কুণ্ডুর বাড়ি থেকে? এটা আগে যাচাই করে নেওয়া দরকার। কলকাতার ফুটবলে নোংরামির তো অন্ত নেই।
কানু, তুই একবার পদাকে ফোন কর, এক্ষুনি? নম্বরটা লেখা আছে ফোন-গাইডে।
পদা কে?
আহা, একটু আগেই তো বললি তোকে ফোন করেছিল পদা। সমীরণ আড়চোখে ঘরের লোকেদের দিকে তাকাল। আমার সুটকেসের একটা নোট বইয়ে নোভুদার ফোন নাম্বার আছে। ওখানে করলেও হবে।
পদ্মনাভন, নাকি নোভাচেক, আগে কাকে করব?
যাকেই হোক, জিজ্ঞেস করে আগে কনফার্মড হয়ে নে। অন্য কেউ ধাপ্পা দেওয়ার জন্য এভাবে বলছে কি না সেটা ভজিয়ে নেওয়া দরকার। যদি সত্যি হয় তা হলে যা কিনতে বলেছি সেটা কিনে ফেল।
কিনতে মানে প্লেনের টিকিট কাটতে বলেছিলিস।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। তবে বো নয় বা।
আরে বাঙ্গালোরেরই কাটব। আমার বন্ধুর দাদা, সারথির পাগল সাপোর্টার, এখনও জানে না তুই যাত্রীতে উঠেছিস, তিনি এয়ারলাইন্সের অ্যাকাউন্টসে আছেন। তাঁকে ফোন করে কালকের বোম্বাইয়ের টিকিট চেয়েছিলাম, বললেন হয়ে যাবে। এখন আবার বাঙ্গালোরের চাইতে হবে। অবশ্য প্রথমে পদার কাছ থেকে জেনে নিয়ে।
জেনেই আমাকে জানাবি, এক সেকেন্ডও দেরি করবি না। ভীষণ ক্রুশিয়াল এটা আমার কাছে।
সমীরণ রিসিভার রাখতেই প্রশ্ন হল নাকু, কোনও খারাপ খবর?
অ্যাকসিডেন্ট নাকি সমীরণ?
তোমার পিসিমার?
দুর্ভাবনা-পীড়িতের মতো দেখাচ্ছে সমীরণকে। এখন তাকে এই ভাবটা দেখাতেই হবে। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া সহজ কর্ম নয়। তাকে আটকে দেবেই। যাত্রীর সে বড় ক্যাচ।
হ্যাঁ, তুষারদা, একজন ফোন করে ভাইকে বলেছে স্কুলের সামনে বাস থেকে পিসিমা পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়ায় চোট পেয়েছে। কথাটা সত্যি কি না কমফার্ম করার জন্য ভাইকে বললাম, পদাদা, আমার এক মামাতো দাদা, পিসিমার স্কুলের পাশেই থাকেন, তাকে ফোন করে জেনে নিয়ে আমাকে জানাতে। কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না, বাড়িতেও কেউ নেই যে—। সমীরণ ক্লিষ্ট মুখে ধীরে ধীরে তুষারের পাশে বসে পড়ল।
অভিনয়! এখন সে স্টেজের ওপর। ঘাগু দর্শকদের সামনে তাকে অভিনয় করতে হচ্ছে। একটু এধার-ওধার হলেই এরা ধরে ফেলবে। বাসব কী যেন বলেছিল? কী গলা, কী ডেলিভারি, কী পিচ কন্ট্রোল! এসে একবার দেখে যাক সমীরণ গুপ্তর অভিনয়।
পিসিমার তো দারুণ স্বাস্থ্য, প্রচণ্ড ফিট। শুনেছি এককালে রেগুলার বাস্কেট খেলতেন। তুষার সমীহ করে বলল।
জবাব না দিয়ে সমীরণ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল টেলিফোনটার দিকে। তার। মাথায় এখন অন্য চিন্তা। কানু কি সুটকেস থেকে নোটবইটা পেয়েছে?…ট্রাঙ্ককলে লাইন পেতে কত সময় লাগবে?…নোভাচেক কি পদ্মনাভন এখন যদি কোথাও বেরিয়ে গিয়ে থাকে? অন্য কেউ ফোন ধরলে সে নিশ্চয় বলতে পারবে ইন্ডিয়া টিম ট্যুরে যাচ্ছে কি না। যদি যায় তা হলে অবশ্যই তাকে জলদি যেতে বলবে। যেতে। হলে প্রথমে এখান থেকে তাকে বেরোতে হবে।
পিসিমার যদি কিছু হয়ে থাকে তা হলে আমাকে তো যেতেই হবে। সমীরণ ব্যকুল হয়ে বলল।
যাওয়া তো দরকারই। তুষার সমর্থন করল।
রুগণ, লম্বা মাঝবয়সি লোকটি, সমীরণ যাকে আগে কখনও দেখেনি, বলল, ঘুনুদা না বললে তো যাওয়া সম্ভব নয়।
আর-একজন বলল, তোমার ভাই, কনফার্মড হয়ে আগে তো তোমাকে জানাক, তারপর দেখা যাবে।
দপদপ করে উঠল সমীরণের কানের দুপাশ। কিন্তু সে জানে রাগারাগি করে কোনও লাভ নেই। সবার আগে তাকে কাজটা হাসিল করতে হবে।
আমি ঘরে যাচ্ছি, ফোন এলেই খবর দেবেন। এই বলে সে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এসে খাবার টেবিলে রাখা বঙ্কিম গ্রন্থাবলীটা তুলে নিয়ে, নিজের ঘরে এসেই অবাক হল। বুকু শুয়ে রয়েছে, দুলালের শূন্য বিছানায়। বুকের ওপর টেপ রেকর্ডারে নিচু স্বরে বাজছে হিন্দি গান।
কী ব্যাপার, এখানে? সমীরণ বলল।
তুষারদার সঙ্গে থাকব না, অত্যন্ত বাজে লোক।
সমীরণ আর কথা না বলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। কপালকুণ্ডলা শেষ করার বাসনা এখন আর তার নেই। তার মাথায় এখন চেকোশ্লোভাকিয়া ট্যুর, বাঙ্গালোর, কানুর ট্রাঙ্ককল, প্লেনের টিকিট, পতু ঘোষের বাড়ি থেকে বেরোনো, ঘুনু মিত্তিরের অনুমতি এবং নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ পর-পর খেলে চলেছে।
তোদের ক্যাম্পে ছিল নাগাল্যান্ডের খাংমা, ঘুনুদা তাকে আনতে কোহিমা যাচ্ছে। টেপরেকর্ডার বন্ধ করে বুকু বলল।
সমীরণ নিজের ভাবনার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তার মধ্যেই বুকুর কথাটা তার মগজে আঘাত করল। অবাক হয়ে বলল, খাংমা মানে সেই স্টপারটা? নোভাচেক তো ওকে তিনদিন দেখেই ক্যাম্প থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়!
হ্যাঁ, ওকেই আনতে যাচ্ছে। অজয় তালুকদার ওকে চেয়েছে। ওর মধ্যে নাকি ভারতের সেরা স্টপারটা লুকিয়ে আছে, অজয়দা তাকে বের করে আনবে। অতএব ব্রিফকেস নিয়ে ঘুনু মিত্তির এবার প্লেনে উঠবে।
একটা হাতির ঘুরতে যে সময় লাগে খাংমার লাগে তার আটগুণ সময়। বিনু কি আলবু তো তাস খেলতে খেলতে ওকে বিট করবে!
তাতে কী হয়েছে, ছফুটের ওপর লম্বা, পঁচাশি কেজি ওজন, এটাই তো যথেষ্ট দেড় লাখ টাকার পক্ষে। গৌরবন্ধু, খাংমা, এইসব নিয়ে গোল খাবে আর সেই গোল শোধ করতে হবে আমাকে, এবার থেকে তোকেও। আৱ না পারলে কী অবস্থাটা আমাদের হবে..পাবলিক জানে অলরেডি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা যাত্রী খরচ করে বসে আছে। বুকু টেপরেকর্ডারটা আবার চালিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্বরগ্রাম কমিয়ে বলল, তুই আসায় আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত নই।
সমীরণ বিছানা থেকে উঠে ঘরের বাইরে এল। ঘরের কোণে টেবিলের ওপর রাখা ঘড়িটা টুংটাং শব্দ করল। এগারোটা। সমীরণ অস্থির মনে পায়চারি করতে করতে একসময় ড্রইংরুমে ঢুকল। লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে। তাদের মধ্যে তিন-চারজনকে মস্তানগোছের বলে তার মনে হল। যাত্রীর দুজন ফুটবলারও রয়েছে এর মধ্যে, বোধ হয় দরাদরি করার জন্য এসেছে। ট্রেজারার মহাদেব সামুই একটা বালিশ বগলে রেখে সোফায় কাত হয়ে আধশোয়া।
ফুটবলারদের একজন সামুইকে তখন বলছিল, সারথির নির্মাল্য রায় কাল এসেছিল।
চুচড়োয়? তোর বাড়িতে?
হ্যাঁ, বললেন ফুড কর্পোরেশনে, নয়তো কোল ইন্ডিয়ায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন।
ভাল কথা, তা হলে সারথিতেই চলে যা।
ফোন বেজে উঠল। সামুইয়ের হাতের কাছে ফোন, তিনি তুললেন, শুনলেন এবং উদগ্রীব সমীরণের দিকে সেটি বাড়িয়ে ধরলেন।
কে, কানু?
কারেক্ট খবর। নোভাচেককেই ফোন করেছিলাম, বলল টুরটা হঠাৎই ক্লিয়ারেন্স পেয়ে গেছে। সম্ভব হলে স্যাম আজই ফ্লাই করুক, নয়তো পজিটিভলি যেন কাল করে। একদিন দেরি হলে ওকে বাদ দেব। হাতে একদমই সময় নেই। দাদা, আমি এখন টাকা নিয়ে এয়ারলাইন্স দৌড়চ্ছি।
কিন্তু আমি যাব কী করে কানু, এখানে আমায় নজরবন্দি করে রেখেছে, ধরে রেখেছে। আই অ্যাম ইন এ জেইল। সমীরণ চিৎকার করে উঠল। ঠকঠক কাঁপছে তার দেহ। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঘাম ফুটেছে কপালে। যেভাবে পারিস উদ্ধার করে নিয়ে যা। আমি ভারতের ক্যাপ্টেন হয়ে খেলতে চাই, সবার আগে আমি একটা মানুষ হতে চাই।
সমীরণ আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েছে মহাদেব সামুই।
কী আজেবাজে কথা বলছিস সমীরণ! এটা কি জেলখানা? যাত্রীর সেক্রেটারির। বাড়িকে তুই জেলখানা বলছিস? তুই আছিস যাত্রীর গেস্ট হয়ে, পতুর গেস্ট হয়ে, আর বলছিস কিনা…এমন বদনাম…ছি ছি ছি, কেউ দেবে না।
তা হলে আমাকে যেতে দিন। সমীরণ দরজার দিকে পা বাড়াল। তিন-চারজন যুবক ছুটে গিয়ে দরজা আগলে দাঁড়াল। সমীরণ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মুখটা নামাল। কাঁধ দুটো হতাশায় ঝুলে সে কুঁজো হয়ে গেছে। পায়ে পায়ে নিজের ঘরে ফিরে এল। টেপরেকর্ডারে তখনও হিন্দি গান হয়ে চলেছে।
.
০৯.
কী বলল? খাটের ওপর ধীরে ধীরে উঠে বসলেন রেখা গুপ্ত। যেভাবে পারিস উদ্ধার করে নিয়ে যা!..আমায় ধরে রেখেছে। আমার নাকুকে ওরা ধরে রেখেছে? আমি যাব।
খাট থেকে নামলেন রেখা গুপ্ত। পিসির চোখমুখ দেখে শ্যামলা জড়িয়ে ধরে টেনে এনে তাঁকে খাটে বসাল।
কোথায় যাবে তুমি?
যেখানে নাকুকে ধরে রেখেছে। কত ক্ষমতা আছে ওই ঘুনু মিত্তিরদের, আমি দেখব।
ওখানে গিয়ে কোনও লাভ হবে না পিসি। দাদাকে যদি বের করে আনতে হয় তা হলে অন্য উপায় ভাবতে হবে। শ্যামলা ঠাণ্ডা গলায় বলল।
কী উপায়? রেখা গুপ্তর চোখের আগুন অল্প স্তিমিত হল।
ভাবতে হবে।
তা হলে তাড়াতাড়ি ভাব।
এসব কি একা ভাবা যায়? তুমিও ভাবো।
আমি কী ভাবব, আমার মাথার কিছু ঠিক নেই এখন। এখন ইচ্ছে করছে জেল ভেঙে, ওদের হাত-পা গুঁড়িয়ে, মাথা ফাটিয়ে নাকুকে বের করে আনতে। এছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। ভটচাদের মতো ঠাণ্ডা মাথা তো আমার নয়।
হয়েছে। শ্যামলার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল চিচিংফাঁক হওয়া গুহাটা। ওকেই বলে দেখি। তুমি চুপ করে এখন শুয়ে থাকো। কানুর এয়ারলাইন্স অফিস থেকে ফিরতে দেড়-দুঘণ্টা তো লাগবেই, ততক্ষণে আমি ভটচায-জেঠুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
দত্তবাবুকেও ব্যাপারটা বলিস। পুলিশে ছিলেন তো, বদমাইশ লোকেদের শায়েস্তা করার ব্যাপারটা জানেন।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ডাইনিং টেবিল ঘিরে বসে গেল বেগারদের শলাপরামর্শের অধিবেশন। সরোজ বসাক কাজে বেরিয়েছেন, তাই অনুপস্থিত। সমস্যাটা বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়ে শ্যামলা বলল, তা হলে কী উপায়?
শঠে শাঠ্যং ছাড়া কোনও উপায় তো দেখছি না। ভটচায় চিন্তিত চোখে ব্যান্ডেজ জড়ানো পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মালবিকা ইতস্তত করে বললেন, মলা তুমি বলছ বিনু না পিনু জন, তাকে পাওয়ার জন্য এই ঘুনু মিত্তির দু-দুবার এর্নাকুলম পর্যন্ত ছুটেছিল?
কাল রাত্তিরে মশারি গুঁজে দেওয়ার সময় দাদা বলল, টুলে বসে একটু কথা বল যাতে বাইরে থেকে ওরা বুঝতে পারে আমি রিল্যাক্সড আছি। তখনই তো দাদা বলল, বিনু জনকে পাওয়ার জন্য ঘুনুদার এত ছোটাছুটি, পয়সা খরচ হল, অথচ সে এখন কিনা চন্দননগরে সারথির কবজায়।
নাকুর সঙ্গে বিনুর আলাপ কেমন? ভটচায জানতে চাইলেন।
খুব আলাপ। দাদা বলল, ও তো আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসতেও চেয়েছিল।
হুমম।ভটচাযের আঙুলগুলো টেবিলের কাঠে ঢাকের বোল তুলল। সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে।
বিনু জনকে দিয়ে এখন কী হবে! জি. সি. দত্ত অধৈর্য হয়ে পড়লেন। এখন দরকার কুইক অ্যাকশন। বহুদিন হাত-পা গুটিয়ে রেখে শরীরটা আমার মাখন মাখন হয়ে পড়েছে। আমি বরং রেইড করতে যাই পতু ঘোষের বাড়িতে। যা হওয়ার হবে।
কাল রাতে তিনটে গুণ্ডাকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন বলে কি ভেবেছেন, সবাই আপনাকে ভয় পাবে? মালবিকা প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসল।
হাত তুলে, চেয়ার থেকে ওঠা দত্তর চ্যালেঞ্জ গ্রহণটাকে বসিয়ে দিয়ে ভটচায বললেন, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। যাত্রীর কাউকে আমরা যদি হোস্টেজ রাখতে পারি তা হলে বন্দি বিনিময়ের মতো—
কাশ্মীরে যা হচ্ছে? মালবিকা বললেন।
আসামেও তো হচ্ছে। দত্ত জানিয়ে দিলেন তিনিও ওয়াকিবহাল।
মলা তুমি একটু পাশের ঘরে এসো, কথা আছে।
পাশের ঘরে ওরা দুজন মিনিটসাতেক ফিসফিস করে বেরিয়ে এল।
এটা কিন্তু ঠিক হল না মিস্টার ভটচায। জি. সি. দত্ত দেরিতে হলেও তাঁর ক্ষোভটা জানালেন। আমাদের সামনে কি কথা বলা যেত না?
যেত, তবে কিনা আমি অত্যন্ত গুরুতর একটা ব্যাপার নিয়ে, মানে একটি তরুণের বড় হওয়ার চেষ্টাকে সাহায্য করার একটা কাজ নিয়ে ফেলেছি। তাই বুদ্ধিটাকে থিতিয়ে নিয়ে, মানে অবান্তর কথাবার্তা থেকে সরে গিয়ে এখন কাজে নামা দরকার। ভটচায এত আন্তরিক ও গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বললেন যে, দত্ত পর্যন্ত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে ফেললেন, তা তো বটেই।
মলা, তা হলে ফোন করো। ভটচায় নির্দেশ দিয়ে চেয়ারে টান হয়ে বসলেন।
শ্যামলা ডায়াল করে ঘরের সকলের দিকে নার্ভাস চোখে একবার তাকাল।
হ্যালো, এটা কি ঘুনু মিত্তিরের বাড়ি?…তিনি কি আছেন?…আমি? আমি সমীরণ গুপ্তর বাড়ি থেকে বলছি, ওর বোন।…ঘুমোচ্ছেন? খুব জরুরি একটা দরকার, যাত্রীর জন্য একটা ইনফরমেশন দেব যেটা ওঁর খুব কাজে লাগবে…আচ্ছা ধরছি।
শ্যামলা ঘরের ওপর চোখ বুলিয়ে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ল। প্রত্যেকের চোখমুখ, এমনকী বসার ভঙ্গিতে সিটোনো ভাব। যেন তার ওপরই নির্ভর করছে সমীরণের মুক্তি।
হ্যালো কাকাবাবু, আমি নাকুর বোন মলা। আমাদের বাড়িতে ঘণ্টাখানেক। আগে, শ্যামলা ঝপ করে গলার স্বর নামিয়ে বলল, বিনু জন এসেছে।…বিনু জন, বিনু জন কেরলের। বাঙ্গালোর ক্যাম্পে দাদার সঙ্গে তো ওর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। অনেকবার বলেছে তোমাদের বাড়িতে যাব, কয়েকদিন থেকে কলকাতাটা দেখব। তা সারথির লোকেরা তো তিন-চারবার ওর কাছে গেছল। শেষে ওর বাবার হাতে অ্যাডভান্স ধরিয়ে দিয়েছে…দাদার কাছেই এসব কথা কাল রাতে শুনেছি। তা সেই বিনু জন সই করার জন্য চলে এসেছে। কিন্তু এয়ারপোর্টে সারথির কেউ ছিল না। বোধ হয় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমাদের ঠিকানাটা ওর কাছে ছিল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা আমাদের বাড়ি চলে এসেছে।…কাকাবাবু, আমার মেজো ভাই কানু, ও বলল, তুই লুকিয়ে চট করে ঘুনুদাকে ফোন করে ব্যাপারটা বল। সারথির হাতে পড়ার আগেই বিনু জনকে যেন যাত্রীর ক্যাম্পে উঠিয়ে নিয়ে যায়…য়্যাঁ, ফোনটা বিনু জনকে দিতে বলছেন? শ্যামলা ঢোঁক গিলল। ভটচার্য ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে, নিজের বাড়ির দিকে আঙুলটা তুলে, কানে অদৃশ্য ফোনের রিসিভার ধরলেন।
কাকাবাবু, আমি এখানকার ভটচাবাড়ি থেকে ফোন করছি।..কী বললেন? বিনু সম্পর্কে আর ইন্টারেস্টেড নন? অ, আচ্ছা…না না আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, ভাবলাম যাত্রীর যদি এতে লাভ হয়, অন্তত ওকে আটকে রেখেও সারথিকে বঞ্চিত করে…হ্যাঁ, নমস্কার।
শ্যামলা হতাশ চোখে সবার দিকে তাকিয়ে রিসিভার রাখল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন রেখা গুপ্ত। ভটচায মাথা চুলকোচ্ছেন, মালবিকা কপালে ঠুকলেন হাতের মুঠি। জি. সি. দত্ত ঘোঁত ধরনের একটা শব্দ মুখ থেকে বের করে কী একটা বলতে যাচ্ছেন তখনই ফোন বেজে উঠল।
শ্যামলা রিসিভার তুলতে যাচ্ছে, ভটচায চিৎকার করে উঠলেন, না, না, তুমি নও। হয়তো ঘুনু মিত্তিরই ফোন করে তোমার কথাটা যাচাই করতে চায়। মিস গুপ্ত, আপনি ধরুন, বলবেন বিনু জন এখন বাড়ি নেই, রান্না করা কিছু নেই, কানু ওকে খাওয়াবার জন্য তারামায় নিয়ে গেছে। মহা ঘাঘু লোক, এটা মনে রাখবেন।
মিথ্যে কথা বলব? রেখা গুপ্ত অসহায়ভাবে তাকালেন।
হ্যাঁ মিথ্যে বলবেন, নাকুর জন্যই বলবেন। জি. সি. দত্ত-র দারোগাগর্জনে তিনটি হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠলেও চতুর্থজন সটান হয়ে ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
হ্যালো…ওহ নমস্কার, আমি নাকুর পিসিমা বলছি।..ফোন ধরার তো কেউ নেই, আমি শয্যাশায়ী, কাল ছাদ থেকে নামবার সময় আমি নিজেই পড়ে গিয়ে…এখন একটু ভাল আছি। সকালে উঠতে পারিনি, রান্নাবান্নাও কিছু হয়নি, এদিকে নাকুর এক বন্ধু, কী যেন নাম বলল পিনু না বিনু, সে এসে হাজির। ঘরে খাবারদাবার নেই, তাই কানুকে বললাম তারামা থেকে কিছু এনে দে, বেচারা কখন প্লেনে উঠেছে, উপোস করে আছে…ছেলেটি তো এখন বাড়ি নেই, কানুর সঙ্গে বেরিয়েছে। বাঙালির মিষ্টি কত রকমের, কেমন চেহারার হয় দেখার খুব ইচ্ছে, তাই ওর সঙ্গে দোকানে গেছে। মলাটাও যে শুট করে কোথায় বেরোল। তা কী জন্য ফোন করছেন? নাকু ভাল আছে তো?…অ, আচ্ছা আচ্ছা, কানুকেই বলব পিনু জনকে যাহোক করে বসিয়ে রাখতে, আপনি এসে ওকে নিয়ে যাবেন…নমস্কার।
রেখা গুপ্ত কাঁপা হাতে রিসিভারটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলা পিসি…গো-ও-ওল। বলে দুহাত তুলে ভাংরা নাচের মতন শরীরটা ঝাঁকাল।
মালবিকা জড়িয়ে ধরলেন রেখা গুপ্তর দুটি হাত। আমি এতক্ষণ ভগবানকে ডাকছিলাম, হে ভগবান রেখা যেন গুছিয়েগাছিয়ে মিথ্যে কথাটা বলতে পারে।
মনে হচ্ছে খুব আন্তরিকভাবেই ডেকেছেন। আমারও ভয় হচ্ছিল এই বুঝি গুবলেট করলেন। তবে এজন্য দত্তবাবুই ক্রেডিট পাবেন। নাকুর নামটা না করলে উনি এত শক্ত হতে পারতেন না। ভটচাযের সপ্রশংস নজরে দত্তর বুকের ছাতি ও বাইসেপস ফুলিয়ে দিলেন।
আর দেরি নয়, দেরি নয়, আমাদের জেলখানা কোনটে হবে? মালবিকা তাড়া দিলেন।
সবাই তাকাল দত্তর দিকে। এ ব্যাপারে পুলিশের অভিজ্ঞতার কাছে তাদের হাত পাততেই হবে। জি. সি. দত্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, ঘরগুলো আগে দেখব।
শ্যামলাকে নিয়ে তিনি তিনটি শোবার ঘর, তাদের গ্রিল, জানলা, দরজা, মায় দেয়াল পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে পরখ করলেন। রান্নাঘরে, এমনকী বাথরুমেও ঢুকলেন। দোতলায় উঠে সুনীলবরণের ঘর দেখলেন।
ছাদের ঘরটাই মনে—
না। দাদার ঘরে ওইসব পাজি লোক ঢোকাব না। রেখা গুপ্তর কঠিন গলা দত্তকে দ্বিতীয় নির্বাচনে ঠেলে দিল।
তা হলে কোণের ওই ছোট ঘরটা। দত্ত অনুমোদনের জন্য রেখা গুপ্তর দিকে তাকালেন।
কানুর ঘর, হ্যাঁ হতে পারে।
এর পর দত্তর নির্দেশে দালানের জানলা বাদ দিয়ে সব ঘরের জানলা বন্ধ করা হল। চাপা গলায় তিনি বলতে লাগলেন, ফটক খোলা থাক। বেল বাজলে মলা দরজা খুলে ওকে সোজা নিয়ে যাবে কানুর ঘরে। এই সময়টা খুবই ক্রুশিয়াল, একটু সন্দেহ হলেই কিন্তু পালিয়ে যেতে পারে। বিছানায় শুয়ে থাকবেন মিস গুপ্ত, চাদর মুড়ি দিয়ে। লোকটা ঘরে ঢুকলেই আমি ছুটে এসে দরজা বন্ধ করে দেব।
তারপর আমি কী করব? রেখা গুপ্ত ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন।
দরজা বন্ধের শব্দ পেলেই আপনি চাদর ফেলে লাফ দিয়ে উঠবেন। তারপর আপনি জাপটে ধরবেন লোকটাকে।
এ আপনি কী বলছেন, রেখা জাপটে ধরবে? মালবিকা প্রতিবাদ এবং ভৎসনা করলেন।
খোকাকে তো আমি জাপটেই—
দত্তবাবু এ খোকা নয়, খোকার জ্যাঠা। অন্যভাবে ধরার প্ল্যান করুন। ভটচার্যকে বিরক্ত দেখাল।
তা হলে একটা ডাণ্ডা হাতে রাখুন। লাফ দিয়ে উঠেই সেটা মাথায়—।
তারপর সত্যিকারের থানা, পুলিশ, জেল হোক রেখার। মালবিকা হাত তুলে মনে হল ডাণ্ডাটা ধরলেন।
আচ্ছা আমরা তো তখন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে ঘুনু মিত্তিরকে ঘিরে ধরতে পারি, গায়ে হাতটাত না দিয়েই।
শ্যামলা সমাধানের পথ বাতলাল।
হ্যাঁ, তাও হতে পারে। দত্ত হাঁফ ছাড়লেন।
অতঃপর রেখা গুপ্ত একটা চাদর নিয়ে কানুর ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অন্যরা দরজা ভেজিয়ে নাকুর ঘরে বসে রইলেন। দালানে পায়চারি করতে লাগল। শ্যামলা।
অবশেষে পতু ঘোষের সবুজ মারুতি ফটকের সামনে থামল। শ্যামলা পরদা ফাঁক করে জানলায় উঁকি দিয়ে দেখল ঘুনু মিত্তির ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে নামলেন এবং পেছনের সিটে বসা দুটি লোককে কী যেন বললেন। তারপর পকেট থেকে ডিবে বের করে নস্যি নাকে দিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে ডিবেটা ড্রাইভারের হাতে জমা দিলেন।
সঙ্গে দুটো লোক! শ্যামলা রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। এটা তো হিসাবের মধ্যে রাখা হয়নি। লোক দুটো যদি অপেক্ষা করে করে ঘুনু মিত্তিরকে বেরিয়ে আসতে না দেখে তখন তো খোঁজ করতে বাড়ির মধ্যে আসবে। সঙ্গে নিশ্চয় চেম্বার আছে। প্লেয়ার তুলতে এসব তো সঙ্গে রাখতেই হয়। তা হলে উপায়?
শ্যামলা দৌড়ে কানুর ঘরে এসে দেখল চাদর ঢেকে শুয়ে থাকার বদলে পিসিমা খাটের ওপর কাঠ হয়ে বসে, হাতে চাদর।
সব্বোনাশ হয়েছে পিসি, লোকটার সঙ্গে আরও দুটো লোক। তারা অবশ্য গাড়িতেই বসে।
ডোরবেল বাজল।
মলা আমি কী করব? করুণ মুখে রেখা গুপ্ত বললেন।
যা বলা হয়েছে তাই করো, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ো। শ্যামলা ঠেলা দিয়ে রেখা গুপ্তকে বিছানার ওপর ফেলে চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দিল।
দ্বিতীয়বার বেল বাজার সঙ্গেই দরজা খুলল শ্যামলা। ওহ আপনি এসে গেছেন। গলা নামিয়ে এর পর বলল, খুব টায়ার্ড, ও ঘরে ঘুমোচ্ছে। আপনি এখন এখানেই বসুন।
সব বন্ধ কেন, অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। ঘুনু মিত্তির চেয়ারে বসলেন হাসি হাসি মুখে। তুমি মা খুব বুদ্ধিমতী। ছেলে হলে তোমাকে ট্রেনিং দিয়ে যাত্রীর রিক্রুটিং অফিসার করে নিতাম। এমন সব বোকাহাবাদের নিয়ে কাজ করতে হয়। বিনু জন যে কলকাতায়, এটা তুমি না জানালে আমি জানতেই পারতাম না।
ওকে এখন কোথায় নিয়ে যাবেন?
দেখি কোথায় রাখা যায়।
কিন্তু ও তো সারথিতে খেলবে বলে এসেছে, আপনার সঙ্গে যাবে কেন?
আহা আমি তো সারথিরই লোক। ঘুনু মিত্তির ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ টিপলেন। ও কি আর চেনে কে যাত্রীর আর কে সারথির! সইসাবুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও আমাদের কাছে থাকবে।
যেমন দাদাকে আপনারা রেখে দিয়েছেন। কিন্তু কাকাবাবু, দাদাকে এই মুহূর্তেই যে আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে। বাঙ্গালোর থেকে আজ ট্রাঙ্ককল এসেছে, ইন্ডিয়া টিম চেকোশ্লোভাকিয়া ট্যুরে যাচ্ছে। দাদাকে এক্ষুনি বাঙ্গালোর ফিরে যেতে হবে। সুতরাং সমীরণ গুপ্তকে এখনই বাড়িতে পাঠিয়ে দিন, কাল ভোরের ফ্লাইটে সে বাঙ্গালোর যাবে।
ইম্পসিবল। নাকুকে আমি ছাড়ব না। ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন হয়ে, ইন্ডিয়ার হয়ে খেলে ওর কি ল্যাজ গজাবে? কী পাবে ও? তোমরা অত দেশ দেশ করে চ্যাঁচাও কেন? চেকোশ্লোভাকিয়ায় গিয়ে দশটা ম্যাচ খেলে তো চল্লিশটা গোল খেয়ে আসবে। কটা টাকা পাবে দেশের হয়ে খেলে? এসব চিন্তা ও ছাড়ুক। তার থেকে ক্লাবে খেলুক, টাকা কামাক, অর্জুন ফর্জুন হোক, তারপর কোচিংয়ে নামুক। তাতেও ভাল পয়সা, অফিসেও উন্নতি করুক, অফিসার হোক ব্যস বাঙালির ছেলের জীবনে আর কী চাই?
হ্যাঁ, আরও চাই। মনের গভীরে একটা সুখ, যেটা লাখ লাখ টাকা আয় করেও মেলে না। এটা আমার নয়, দাদার কথা। আপনি আমার দাদাকে এনে দিন।
নাকু আমার অনেকদিনের টার্গেট, ওর আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভগবান যখন পাইয়ে দিয়েছেন তখন আর হাতছাড়া করব না।
সেক্ষেত্রে, আপনিও আর এ বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না। শ্যামলা দাঁড়িয়ে কথা বলছিল এবার চেয়ারে বসল।
তার মানে?
যেভাবে দাদাকে আটকে রেখেছেন, সেইভাবে আপনিও এই বাড়িতে আটকা থাকবেন। সে ছাড়া পেলে আপনিও পাবেন।
তা হলে বিনু জনের ব্যাপারটা ধাপ্পা?
পুরোপুরি।
তা হলে জেনে রাখো, নাকুকে আমি ছাড়ব না। তোমরা যা করতে পার করো।
তা হলে যেটা পারি তা হল, একটা একটা করে আপনার হাত, পা আমি ভাঙব, চোখ দুটো উপড়ে নেব।
ঘুনু মিত্তির আর শ্যামলা চমকে চেয়ার থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। রেখা গুপ্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর দু চোখে ঠাণ্ডা চাহনি। অত্যন্ত ঠাণ্ডা চাহনি। ঘুনু মিত্তিরের দুহাতে কাঁটা উঠল। ঘাড়টা সিরসির করছে।
নাকুর জীবন যাত্রীর নয়, সারথির নয়, আপনার নয়, আমারও নয়, নাকুর জীবন নাকুরই। সেই জীবন যা চায় তাইই করবে। আপনি তা করতে দেবেন না। তা হলে আমিও। রেখা গুপ্ত দু হাতে ঘুনু মিত্তিরের কলার ধরলেন, আমিও আপনার স্বাধীনতা কেড়ে নেব।
একটা হ্যাঁচকা টানে ঘুনু মিত্তির টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়লেন। তাঁর দুটি হাত পিছমোড়া করে ধরে একটু ঝুঁকে ঘুনুর কানের কাছে মুখ এনে, রেখা গুপ্ত বরফের মতো গলায় বললেন, প্রথমে দুটো হাত, তারপর দুটো পা। সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে। বলেই তিনি হাতে মোচড় দিলেন।
ঘুনু মিত্তির যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলেন। শ্যামলা চোখ বন্ধ করে ফেলল। পিসির এই মূর্তি সে আগে কখনও দেখেনি। নাকুর ঘরের দরজার পাল্লা ঈষৎ ফাঁক হল এবং বন্ধ হয়ে গেল।
আমার দুটো ছেলেকে মোটরে রেখে এসেছি, আমি কিন্তু এবার চ্যাঁচাব।
তা হলে ঘাড় মটকে দিয়ে চেঁচানি বন্ধ করে দেব। রেখা গুপ্ত কথার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আবার মোচড় দিলেন। আবার আর্তনাদ।
ফুটবল টুটবল আমি বুঝি না। এই তিনটে ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছি। এরা আমার বুকের তিনটে পাঁজর। এর একটা ভেঙে দিলে আমি মরে যাব। আর জেনে রাখুন, মরতে যদি হয় তো মেরে মরব, ফাঁসিতে যেতে হয় তো যাব।
তাঁর গলার দুপাশের পেশি ফুলে উঠেছে। রক্ত জমে মুখ লাল। চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে দাঁতে দাঁত চাপার জন্য। রেখা গুপ্ত শেষবারের মতো একটা মোচড় দিয়ে ঘুনু মিত্তিরকে ছেড়ে দিলেন। ঘুনু নিথর হয়ে টেবিলের ওপর থুবড়ে পড়ে রইলেন। দুটো হাত ঝুলছে।
এখুনি টেলিফোন করে বলে দিন, নাকুকে যেন পৌঁছে দিয়ে যায়, নইলে— এবার দুটো তালু সাঁড়াশির মতো ঘুনুর ঘাড়ে এঁটে বসল। আমার শরীরে অল্পস্বল্প জোর আছে। এই ঘাড়টা ইচ্ছে করলেই—। দশটা আঙুলের ব্যুহ ছোট হয়ে এল ঘুনুর শীর্ণ গলাটি ঘিরে।
এবার আর আর্তনাদ নয়, চাপা কান্নার মতো আওয়াজ হতেই হুঁশ ফিরে এল। শ্যামলার। এগিয়ে এসে রেখা গুপ্তকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ধমকে উঠল, পিসি, তুমি কি পাগল হলে? এখনি দমবন্ধ হয়ে মরে যেত। তারপর ঘুনুকে। মিনতির সুরে সে বলল, কাকাবাবু, পিসিকে থামানো যাবে না। আপনি ওর কথা শুনুন, ফোন করে দিন।
ঘুনুর চোখ বন্ধ, মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না। শুধু মাথাটা নাড়লেন।
ফোন করবেন?
হ্যাঁ। আমার হাতে কোনও জোর নেই, নাড়াতে পারছি না। হাঁপাচ্ছেন। দুই। চোখে ছেয়ে রয়েছে আতঙ্ক।
আপনি বসুন, আমি ডায়াল করে রিসিভারটা আপনাকে দিচ্ছি।
শ্যামলা যখন ডায়াল করছে, রেখা গুপ্ত তখন প্রায় ছুটেই কানুর ঘরে চলে গেলেন।
হ্যালো, এটা কি পতু ঘোষের বাড়ি?…একটু ধরুন, ঘুনুদা কথা বলবেন…হ্যাঁ ঘুনু মিত্তির।
রিসিভারটা ঘুনুর হাতে তুলে দেওয়ার সময় শ্যামলা মুখ ঘুরিয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল, চাদরে নিজেকে ঢেকে নিয়ে পিসি বিছানায় উপুড় হয়ে। ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ।
কে, মানু নাকি?…শোন, নাকু কোথায়?…আচ্ছা, ওকে এখনি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যা। ঘুনু আড়চোখে শ্যামলার মুখটা দেখে নিলেন। শ্যামলা মাথা নাড়ল। একটা ট্যাক্সি করে নে, ওর যা জিনিস আছে সে সবও যেন নিয়ে আসে। তাড়াতাড়ি করিস, নইলে—। ঘুনু রিসিভারটা তুলে দিলেন শ্যামলার হাতে।
কাকাবাবু আপনি একটু চা খান, আমি করে আনছি।
ঘুনু সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন কথা না বলে। তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা নামিয়ে টেবিলে কপাল রাখলেন। শ্যামলা রান্নাঘরে গেল। তখন নাকুর ঘরের দরজার একটা পাল্লা সন্তর্পণে খুলে পা টিপেটিপে তিনজন বেরিয়ে এলেন। ফটক পার হয়েই বেগিংয়ের থেকে দ্রুত গতিতে তাঁরা বাড়ির পথ ধরলেন।
.
আই সি ফ্লাইট নাম্বার সেভেন সেভেন ওয়ান ফর বাঙ্গালোর আর রিকোয়েস্টেড টু প্রসিড.. সিকিউরিটি চেকিংয়ের জন্য ঘোষণা হচ্ছে।
শ্যামলা তাড়া দিল, দাদা লাইন পড়ে গেছে।
পড়ুক। সমীরণ ব্যস্ততা না দেখিয়ে বইয়ের দোকানের দিকে এগোল। ওখানে খবরের কাগজও বিক্রি হয়। সাড়ে পাঁচটা এখন। এত ভোরে এয়ারপোর্টে কাগজ পাওয়া যাবে কি না তাই নিয়ে সে উদ্বিগ্ন থাকায় লক্ষ করেনি লোকটিকে।
দাদা।
শ্যামলার দৃষ্টি অনুসরণ করে সমীরণ অবাক হয়ে দেখল, লাউঞ্জের একটা চেয়ারে ঘুনু মিত্তির বসে রয়েছেন। কোলে ব্রিফ কেস। বাঁ হাতের কনুইয়ের মোটা ব্যান্ডেজ, হাতটা গলায় বাঁধা ব্যান্ডেজে ঝুলিয়ে বুকের কাছে তুলে রাখা। ঘুনু তাদের দিকেই নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রয়েছেন। আপনি এখন এখানে? সমীরণ বলল।
খাংমাকে ধরতে যাচ্ছি। আমার প্লেন আটটা-চল্লিশে, একটু আগেই এসে গেলাম।…তুই সত্যি সত্যিই বাঙ্গালোর যাচ্ছিস, না ধাপ্পা মেরে বটার ঘরে উঠছিস সেটা তো দেখতে হবে।ঘুনু মিত্তিরের গলায় কোনওরকম আবেগ নেই। বারো ঘণ্টা আগে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, মনে হচ্ছে না তার কণামাত্রও তিনি মনে করে রেখেছেন।
টুর থেকে ফিরে এসেও তো দাদা সই করতে পারবে আর করলে পিসি যা বলেছে, সেই ক্লাবেই করবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাঁসফাঁসানিটা শ্যামলার গলা থেকে বেরিয়ে এল।
তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে বলছ? ঘুনু মিত্তিরের মুখের নির্বিকারত্ব মুছে গিয়ে হাসি ফুটে উঠল।
ভি আই পি রোডের ওপর নিলডাউন হয়ে থাকার থেকে আপনার হাতে ধরা দেওয়া অনেক ভাল। সমীরণের মুখও নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল।
ঘুনু মিত্তির ডান হাতটা সেলামের ভঙ্গিতে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, তোর পিসিকে নমস্কার।
সিকিউরিটি চেকিংয়ের জন্য দ্বিতীয় ডাক শোনা গেল।
নাকু, একটা কথা বলে রাখি, তোর কাছে দেশ যেমন বড়, আমার কাছে তেমনই ক্লাব…আমি ক্লাবের কাজ হাসিল করার জন্য নিজেকে যতটা ঢেলে দিই, আশা করব তুইও দেশের কাজটা সেইভাবে করবি। তারপরেই চোখ টিপে নিচু গলায় বললেন, কিন্তু, পা বাঁচিয়ে।