Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দরশন || Arindam Deb

দরশন || Arindam Deb

প্রায় সাত বছর আগের কথা। গতযৌবনা আষাঢ় মাসের এক মেঘলা দিন। সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়ে সবে ধরেছে যেন! দমদমের নাগেরবাজারের ফ্ল্যাট থেকে আমি ও মালবিকা সল্ট লেকে ফিরছি! মা গত হয়েছেন মাস ছয়েক আগেই। আমার কালাশুচ চলছে!

আমি ফ্ল্যাট থেকে বেরোনো মাত্রই রিকশা পেয়ে তাতে চড়ে পড়েছি – মালবিকা একটু এগিয়ে গিয়েছে, আমি ওকে তুলে নেবো, তখন খানিকটা বিরক্তির সাথে ও বললো –

” আগেই রিক্সা নিয়ে নিলে? আমি ওই মোড় থেকে একটু মাছ কিনতাম কার্তিকের কাছ থেকে! “

” সে রাস্তায় কোথা থেকে কিনে নিও না হয়! “

যাই হোক, রাস্তায় একটা জায়গাতেও, যে জায়গাগুলো মাছের বাজার হয়, খালি! বোধহয়, বেলা হয়ে গেছে বলে মাছওয়ালা বিক্রিবাটা সেরে বাড়ি ফিরে গেছে!

মালবিকা মনঃক্ষুণ্ন, তবু বললো,

” চলো, নাহয় একটু ডিমের ডালনা করে নেবো।মার ফ্রিজে আসার সময় কয়েকটা ডিম কিনে এনেী রেখেছিলাম!”

সল্ট লেক পৌঁছে , মালবিকা একটু পরে, ডিম ফ্রিজ থেকে বের করে দেখে, যে ঠাণ্ডায় তা জমে এমন অবস্থা, যে একেবারেই ভক্ষণ অযোগ্য হয়ে গেছে।

আমি প্রমাদ গুনলাম! একে তো মাছ আমার জন্য কেনা হয়নি – এবার কি বাক্যবাণে বিদ্ধ হবো ভাবছি, হঠাৎ দেখি গিন্নির মুখবয়বে, আকর্ণবিস্তৃত এক হাসি!

অবাক হয়ে ভাবছি…

” ওমা! এই দ্যাখো! ভাগ্যিস!”

আমি হঠাৎ আমার ভাগ্য পরিবর্তনের কারণ ভাবছি, মালবিকা নিজেই বললো

” আরে আজ তো রথের দিন! আমরা তো নিরামিষ খাই এদিন! জগন্নাথদেব আমাকে পাপ করতে দিলেননা, তাই তুমি মাছটা কিনতে পারোনি, আর ডিমটাও নষ্ট হয়ে গেছে!
আহা! প্রভুর কী লীলা! “

এই বলে মালবিকা দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকালো।

আমিও গোবিন্দভক্ত তবু যেন অভিযোগের সুরে তাঁকে বললাম মনে মনে – “হে প্রভু, তুমি করলে লীলা, আর আমি করলেই বিলা? এই কি তোমার সুবিচার?”

যাই হোক, আমি তো নিরামিষের ভীষণ ভক্ত চিরকালই, আজকের বাঙাল বা বাঙালির কলঙ্ক, আমার বাবার মতে, আমি মনে মনে খুব খুশিই হলাম।

আমি বললাম,

” আমি তাহলে একটু জিলিপি আর পাঁপড়ভাজা নিয়ে আসি! “

আমি বেরিয়ে, সেতু পেরিয়ে খালের ওপারে মিষ্টির দোকানে গিয়ে শুনলাম যে সব জিলিপি বিক্রি হয়ে গেছে, একটাও থালায় পড়ে নেই! আর পাঁপড় পেলামনা মুদিখানায়।

মনটা দমে গেলো।সাধারণ কাঁলাকাঁদ ও ক্ষীরকদম নিয়ে একটু বিষণ্ণ মনে খালের সেতুর সিঁড়ি দিয়ে দুইপা উঠেছি – হঠাৎ দেখি এক পূজারী ব্রাহ্মণ, তার মুণ্ডিত মস্তক, একটি স্থূল শিখা, মস্তককেন্দ্রে, পরণে গেরুয়া, খালি গা, একেবারে উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, আমার দিকে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন!

আমিও তাঁকে প্রতিনমস্কার জানালাম, কিন্তু তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি!

কী অপূর্ব তার চেহারা, পৌরুষ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে! আমি সম্মোহিতের মতন চেয়েই রইলাম কেবল!

তিনি ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলেন –
” মাস্টারমশাই, আজ রথযাত্রা, জগন্নাথ বাড়িতে আপনি পদধূলী রেখে, সস্ত্রীক দুটি পলান্ন ও পরমান্ন ভোজন করবেন, তাহলে জগন্নাথ দেবের পূজা সার্থক হবে! “

আমি আগেই বলেছি যে আমি শ্রীগোবিন্দের ভক্ত!.
আমি আহ্লাদিত হয়ে – হ্যাঁ নিশ্চই – বলতে গিয়ে দেখি পূজারী ব্রাহ্মণ সেখান থেকে প্রস্থান করেছেন!

হয়তো পূজায় যোগ দিতে ত্রস্তপদ চলে গেছেন!

আমি সল্ট লেকে তিরিশ বছর আছি, কিন্তু আগে কখনো জগন্নাথ বাড়ির নাম শুনিনি!

কেষ্টপুরের দিকে নেমে গিয়ে আমি ওখানকার রিকশাওয়ালাদের জিজ্ঞেস করলাম – ওরা কেউই বলতে পারলোনা।

একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একজন অঙ্গুলিনির্দেশ করে বাড়িটি দেখিয়ে দিলো!

আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে মালবিকাকে বিষয়টা জানাতে ও বললো

” যাও, একটু নাহয় প্রসাদ নিয়ে এসো, আর শোনো, এই ১০১্ টাকার একটা পূজাও দিয়ো তোমার আমার নামে “

আমি আনন্দের সাথে এগিয়ে গেলাম। জগন্নাথ বাড়িতে দেখলাম এলাহি ব্যাপার! আমি বৈঠকখানায় প্রবেশ করে, মনে হলো বড়োকর্তা যিনি, তাকে আমার পরিচয় দিয়ে, পূজার কথা বলতেই তিনি অন্দরমহলে হাঁক পাড়লেন!

এক লক্ষ্মীপ্রতিমাসম মহিলা বেরিয়ে এলেন, তাঁকে “বড়কর্তা “বললেন –

” বৌমা, ইনি এক শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই! তুমি ওনার কথা শোনো, আর যথাযথ অতিথির মর্যাদাদান কোরো! “

তিনি আমাকে ভেতরে ডেকে নিলেন, আমি তাকে নমস্কার করে বললাম

” মামনি, তুমি আমার ও আমার স্ত্রীর নামে একটু পূজা দিয়ে দেবে? আমার নাম অরিন্দম দেব, ভরদ্বাজ গোত্র!”

এই বলে তার হাতে মালবিকার দেওয়া ১০১্ টাকা ও একটা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিলাম।

মহিলা, আমাকে বললেন –
” অবশ্যই মাস্টারবাবু, এ তো আমার সৌভাগ্য! আপনারা সমাজ গড়ার কারিগর, আমার ছেলেও তো সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র – এই পাশের ইস্কুলেই! আমি নিশ্চয়ই আপনার নামে পূজা দেবো।
তবে আমার একটা শর্ত আছে”!

” শর্ত? কি শর্ত মা?”

” আপনি কিন্তু সপরিবারে, আমাদের সাথে এখানে ভোগ গ্রহণ করবেন! “

আমি তো উৎফুল্ল চিত্তে রাজি হলাম।

” আপনারা তাহলে দুপুর দেড়টায় চলে আসবেন! কেমন! “

আমি বাড়ি ফিরে মালবিকাকে বললাম বিষয়টা!

দুপুরে আবার বৃষ্টি শুরু হলো!
দেড়টার সময় মালবিকা আর যেতে চাইলোনা। একটা টিফিন কৌটা দিয়ে ওর জন্য একটু ভোগ নিয়ে ফিরতে বললো!

আমি সেই জগন্নাথ বাড়িতে পৌঁছাতেই সেই গৃহকর্ত্রী আমার দিকে ছুটে এসে, জোড়হাত করে সলজ্জায় বললেন –

” মাস্টারবাবু, বড্ড ভুল করে ফেলেছি! আমি আপনার নামে পূজাটা দিতে বিস্মৃত হয়েছি, কিন্তু আপনার দক্ষিণাটি কিন্তু গৃহিত হয়েছে, মিষ্টিও প্রসাদ রূপে অর্পন করা হয়েছে!
আমি ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু আপনি আমাদের পরিবারের সাথে একত্রে ভোগ গ্রহণ করুন, আমি নিজে হাতে পরিবেশন করে তৃপ্ত হই! “

এই বলে সে আবার জোড়হাতে মাথা নোয়ালে!

আমি তখন হতবাক! হঠাৎ মনে পড়লো, মাতৃবিয়োগের একবৎসরকাল ব্যতীত হয়নি, এসময় পূজা দেওয়া অধর্ম না হলেও অশাস্ত্রচিত বটে! জয় জগন্নাথদেব, তিনি আমার পূজা নেননি ঠিকই কিন্তু দক্ষিণা ও মিষ্টান্ন গ্রহণ করেছেন!

সকাল থেকে যা ঘটে চললো, সব যেন তাঁর অদ্ভুত লীলা!

আমি জগন্নাথদেবকে মনে মনে ডাকতাম –
” হে প্রভূ, আমি তো অসুস্থ, রোগজীর্ণ হয়ে পড়েছি, এ জীবনে হয়তো আর তোমার দর্শন পাবোনা, কারণ পুরী ভ্রমণ আমার যে নৈব চ নৈব চ! “

সেদিন যেন তিনিই আমাকে তাঁর কাছে টানলেন৷ ভোগপ্রসাদ গ্রহণ পূর্বে আমি মূরতি দরশন করতে আগ্রহী হলাম।ভীড় ঠেলে ওপরে উঠলাম।

তিনতলার বিশাল একটা ঘরে মনিমুক্তাখচিত জগন্নাথদেব, সুভদ্রা দেবী ও বলরামদেবের বিগ্রহ এক সূর্যসম ঔজ্জ্বল্য নিয়ে বিরাজমান!

তাঁর পূজা সমাপন হয়েছে, নানান প্রসাদ ও ভক্তবৃন্দের ভীড়, অনেকে সাষ্টাঙ্গ হয়েছেন। কেউ কেউ বিগ্রহ স্পর্শও করছেন।

আমি এক কোনায় স্থান করে নিয়ে দরজায় মাথা ঠেকালাম প্রণম্যচিত্তে! তাকে স্মরণ করতে করতে যেন ভাবের এক জগতে প্রবেশ করেছিলাম।

মাথায় কয়েকফোঁটা গঙ্গোদক এসে পড়াতে সম্বিত ফিরে পেলাম!

ভোগ বিতরণ পাশের একটি গৃহের ছাদে! সেই বাড়িও ঢেলে সাজানো – ধীরে ধীরে ওপরে উঠলাম। সিঁড়িটি সঙ্কীর্ণ, কিন্তু ওপরে দেখলাম বিস্তৃত জায়গা জুড়ে, চেয়ার টেবিল পেতে প্রায় তিন হাজার লোকের ভোজন স্থান!

শুনলাম এই পূজা একবৎসরকাল চালু হয়েছে।স্বর্ণালংকার ব্যাবসায়ী পিস্তুত মামাতো দুই ভাইয়ের সমবেত পূজা – চন্দ্র এবং সেন বাড়ির!

সেন গিন্নি এসে আমাকে তাঁরই মামাশ্বশুরের পাশে স্থান করে দিলেন। এমন সুমিষ্ট ব্যবহার – যেন আমি পরমাত্মীয়, কতকালের পরিচিত! বনেদী বংশের এই তো আসল পরিচয়!

এবারে ভোজন! পলান্ন, ঘিয়ে মাখা! কি তার স্বাদ ও গন্ধ! ছানার ডালনা, আলুর দম, অারো অনেক সুস্বাদু নিরামিষ পদ! এরপরে পাঁপড় ও চাটনি! সবশেষ অমৃতি – ঘৃতপাক! অভূতপূর্ব এক স্বর্গীয় স্বাদগন্ধযুক্ত! আমার জিলিপি খাওয়ার সেই অপূর্ণ সাধ, শ্রীজগন্নাথদেব পূর্ণ করলেন।

ভোজন সমাপনে আমি সেনবাড়ির বড়পুত্রের সাথে আলাপে রত হলাম।

তাঁর কাকিমার কথা বলতেই, সে ওই টিফিন কৌটা ভরে – আরো নিজেদের কিছু কৌটা ভরে, শ্রদ্ধেয়া কাকিমনির জন্য ভোগ প্রসাদ ভরে দিলেন

তাকে আমি তাঁদেরই পুরোহিতের এই আমন্ত্রণের কথা জানালাম, বললাম তাঁদের এই পূজায়োজনের কথা আমি জানতামই না!

এবারে তার অবাক হবার পালা –

” পুরোহিত? না তো? আমাদের তো এরকম কোনো পূরোহিত আদৌ নেই! আমরা তো আলাদা বিশেষ সম্মানদক্ষিণা দিয়ে পূজা উপলক্ষে পাণ্ডা আনিয়েছি “!

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম – আমাকে তবে কে আমন্ত্রণ জানালেন! আর সেই পুরোহিত জানলেনই বা কিকরে আমি গোবিন্দভক্ত, আমাকে জগন্নাথ বাড়ির কথা আর কেউ তো বলেনি, কারণ তা প্রায় সকলেরই অজানা! আর উনি জানলেনই বা কি করে যে আমি শিক্ষকতা করি?তবে উনি কে.. .?

ওদের বললাম,
” হবে হয়তো! দীর্ঘদিন মাস্টারি করছি, অনেকেই তো আমাকে চেনেন! “

আমি বাড়ির পথে পা বাড়ালাম! আমি ব্রিজের নিচে রিকশাওয়ালাদের প্রশ্ন করলাম সেই পূজারীর বিষয়, সকালে!

একজন বললো –
” হ্যাঁ মাস্টারমশাই! আপনি সকালে মিষ্টি নিয়ে ব্রিজের ওপরে তিনটে সিঁড়ি উঠে দাঁড়িয়ে, একা একা হেসে কি যেন বললেন, যেন কারো সাথে কথা বলছেন, তারপরে হাত নাড়লেন! আমি ভাবলাম, আপনি হয়তো কোন অঙ্কের সূত্র আওড়াচ্ছেন মনে মনে!
আপনার সাথে তো কারোকে দেখিনি, আর ওরকম দেখতে কোন পুরুতমশাইও তো এ তল্লাটেই নেই! কি জানি কার কথা বলছেন? “

আমি বাড়ি ফিরলাম। মালবিকাকে ঘটনাটি বলাতে ও বললো, শিগগীর ওই জায়গার একটু ধুলো তুমি নিয়ে এসো, একটা কাগজে পুরে, হাতে বা পকেটে নয়, মাথায় করে নিয়ে এসো!
এ এক অলৌকিক ব্যাপার, তুমি এখনো বোঝোনি গো? “

মালবিকার চোখে জল। আমারও! আমি উপলব্ধি করলাম, স্বয়ং শ্রীগোবিন্দ আমায় দর্শন দিয়েছিলেন, এই নিয়ে তৃতীয়বার! আমি আবার তাঁকে চিনতে অক্ষম হয়েছি!

অজান্তেই ভক্তকে তাঁর প্রভূ দর্শন দিয়ে অন্তর্ধান করেছিলেন!

এই সত্য ঘটানাটি ঘটে ঠিক তিন বছর আগে, রথযাত্রা তিথিতেই!

জয় জয় জগন্নাথ, জয় জয় গোবিন্দ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *