Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ত্রিধারা || Samaresh Basu » Page 6

ত্রিধারা || Samaresh Basu

২৬.

রাস্তায় বেরিয়ে মনে হয়েছিল সুমিতার, কোথাও যেতে পারবে না এখন আর এ মন নিয়ে। কথা বলতে পারবে না কারুর সঙ্গে।

তবুও যন্ত্রচালিতের মতো পথ চলেছে। ওদিকে অগ্রহায়ণের বেলা যেন লাগিয়েছে লুকোচুরির খেলা। কোন ফাঁকে যেন পাক খেয়ে উঠে এসেছে আকাশের অনেকখানি। চারদিগন্ত উদ্ভাসিত।

রবিদার কাছে আর যেতে পারবে না মনে করেও হাজির হল রবির বাড়ির দরজার। ডাকতেও ভয়। বাড়ির লোকেরা টের পেলে রক্ষে নেই। দেরি তো হবেই। মিনমিনে গলায়, টিপে টিপে অতি আড়ষ্ট ভদ্রতায় প্রাণটা ওষ্ঠাগত হয়ে উঠবে সুমিতার। চাকর থেকে কুকুরটা পর্যন্ত সচেতন হয়ে উঠবে এ বাড়ির বিশেষ ভঙ্গিমায়।

তবু সুমিতা টিপে দিলে বিজলি-ঘণ্টা-বোতামটা। চাকর বেরিয়ে এসে বলল, কাকে চান?

রবিবাবু আছেন?

চকিত মুহূর্তে এক বার সুমিতার আপাদমস্তক দেখে চাকর বলল পরদা তুলে, আপনি বসুন, খবর নিয়ে আসছি। কী নাম বলব?

কিন্তু বাধা দিল সুমিতা। জানে, ওইটি হল চাকরের প্রতি নির্দেশ। আছে কি নেই, কিছুই বলতে নেই বাইরের লোককে। কেবল সংবাদটা নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু বাড়ির ভিতর সংবাদ গেলে অন্তত রবিদার দিদির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। মেজদি-মৃণাল, গোটা কলকাতার বিচিত্র সব সংবাদ পেড়ে বসবেন।

সুমিতা বলল, বসব না। তুমি জান কি না বলো না, তোমার সেজদাদাবাবু আছেন না বেরিয়ে গেছেন?

বোঝা গেল, চাকর বেচারি একটু ফ্যাসাদে পড়ে গেছে। বাড়ির কর্তৃপক্ষের নির্দেশের চেয়েও বড় কথা, সেজদাদাবাবুর সঙ্গে চাকরবাকরদের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। একটু বেশি প্রীতি ও বিশ্বাস আছে সেখানে। এক বার পিছন দিকে দেখে চাকর বলল, একটু আগেই তিনি বেরিয়ে গেছেন।

–কোথায়?

কলেজে নাকি তাড়াতাড়ি যেতে হবে, তাই খেয়েদেয়ে

কথা শেষ হল না। সুমিতা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। বলে নেমে এল। চাকর বলল, ফিরে এলে কিছু বলব?

না।

না, আর কোথাও যাওয়া হবে না। হাতের ঘড়িতে দেখল, ছোট কাঁটাটা প্রায় লাফাতে লাফাতে নয়ের ঘরটা পেরিয়ে গেছে। কলেজের কথা ভাবাও যায় না। সেই উত্তর কলকাতা ঘেঁষে। নিশ্চয়তা বা কতটুকু পাওয়ার।

কিন্তু পা চলল ওর সেইদিকেই, যেদিকে গেলে উত্তরে যাওয়ার ট্রাম বাস ধরা যায়।

বুকের মধ্যে কারা মেতেছে এক প্রলয়ংকর মারামারিতে। যেন এ বুক, এ মন সুমিতার নয়। শুধু মারামারির সমস্ত আঘাতগুলি ক্ষতবিক্ষত করছে ওকে। কোথাও ওকে যেতে হবে, কথা বলতে হবে, হাসতে হবে। বাড়িতে গেলেই একটি কোণ নিয়ে থাকতে হবে মুখ বুজে। তার চেয়ে নিজেদের কলেজে, সঙেঘর অফিসে হিরন্ময় কিংবা যার কাছে থোক, যাওয়া দরকার।

রাগ হচ্ছে, অভিমান হচ্ছে রবিদার ওপর। কিন্তু রবিদাকে যদি পাওয়া যেত–যে কোনও অছিলায়, যে কোনও ছলনার আড়ালে রুদ্ধ কান্নাটাও পারত মুক্ত করে দিতে।

কী ভিড় বাসে! মেয়ে পুরুষের সমান ভিড়। অফিসের সময়। দাঁড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় রইল না। দলে মুচড়ে এলোমলো হয়ে খালাস পেল বাস থেকে। কলেজে ঢুকে প্রফেসর রুমে গিয়ে যাকে প্রথম পেল, তাকে জিজ্ঞেস করল। গুরুগম্ভীর অধ্যাপক ভদ্রলোক নিশ্চয় এই কলেজের ছাত্রী ভেবেছিলেন সুমিতাকে।

স্যার না বলায় কিংবা যে কোনও কারণেই হোক, কেমন একটু রুষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কে?

রবিবাবু।

বলতে পারিনে।

আর একজন ছিলেন, এক তরুণ অধ্যাপক। নতুন বলে কি না কে জানে, ছাত্রী অছাত্রী যা-ই হোক, শুধু মেয়ে বলেই তার নাকের ডগাটি যেন লাল হয়ে উঠল। সুমিতার মুখের গাঢ় হতাশার ছায়াটুকু দেখেও তিনি কিছু বলতে পারলেন না।

সুমিতা এক বার তাকাল সেইদিকে। ভদ্রলোক আরও গভীর মনোনিবেশ করলেন কাগজে। বেরিয়ে আসতে গিয়ে চাপরাশিটাকে জিজ্ঞেস করল।

চাপরাশি বলল, রোটিনটা দেখিয়ে লিন।

মনের সমস্ত রুটিনটাই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। লেখা রুটিন দেখে আর কী হবে। দেখা হবে না। অসহায় অভিমানে ওর গলার কাছে এসে ঠেকে রইল রুদ্ধ কান্না।

বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় একটি মেয়ে ডাকল, সুমিতা না? ফিরে দেখল, ওদের কলেজ থেকে চলে আসা একটি মেয়ে। ফেল করেছিল। এখানে এসে ভরতি হয়েছে। কাছে এসে বলল, এখানে যে?

সুমিতা বলল, রবিবাবুকে একটু খুঁজছিলুম। মেয়েটি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখল সুমিতাকে। বলল, আমাদের রবিবাবুকে।

হ্যাঁ।

-কেন বল তো? প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে বিস্ময়ে রাগে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল সুমিতা। কী বিশ্রী হাসি ও অনুসন্ধিৎসু চাউনি মেয়েটির। বলল, দরকার ছিল একটু।

বলে পা বাড়াল সুমিতা। মেয়েটি বলল, কিছুক্ষণ আগে প্রিন্সিপালের রুমে যেতে দেখেছিলুম।

এই বারান্দার শেষেই প্রিন্সিপালের ঘর। ভিতরটা দেখা যায় না সব। বাতাসে দুলছে পরদা, দরজার মুখে।

কিন্তু সমস্ত আশাটা এমনভাবে মার খেয়ে থতিয়ে গেছে, কোনও ভরসা নেই সুমিতার। তবু পায়ে পায়ে এগুল ও ওই ঘরের দিকেই।

এমন সময়ে পিছন থেকে ডেকে উঠল রবি। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফিরেই হাসতে গিয়ে, চোখ ফেটে জল এসে পড়ল সুমিতার।

রবির স্নিগ্ধ হাসি একটু বিব্রত হয়ে উঠল। বলল, অনেকক্ষণ এসে বসে ছিলে বুঝি? রাগ কোরো না ভাই রুমনো। চলো আমরা বাইরে যাই।

এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দশজনের সামনে চোখের জলটা রোধ করা উচিত ছিল সুমিতার। কিন্তু পারেনি। সেই ভেবে লজ্জা করল নিজেরই। নতমুখেই বলল, চলুন।

রাস্তায় আসতে আসতেই রবি বলল, তোমাকে চিনতে পারিনি। আশ্চর্য! তোমাকে তোমার বড়দি বলে ভুল করে ফেলেছিলুম। তুমি যে এর মধ্যেই অনেক বড় হয়ে গেছ। আর হুবহু সুজাতা।

রবিদার গলার এই অন্তরঙ্গ স্বর যেন অনেক গ্লানি, দুঃখ, অভিমানকে ভাসিয়ে দিল। আর কী আশ্চর্য খুশি খুশি ভাব রবিদার। না তাকিয়েও বুঝতে পারছে, সেই বুদ্ধিদীপ্ত বিষণ্ণ চোখ দুটি কেমন চকচক করছে হাসিতে, তবু হতাশা ও অভিমানের রেশটুকু কাটিয়ে উঠে কথা বলতে পারছে না এখনও।

রবিই বলল, খুঁজে না পেয়ে খুব রাগ হয়েছিল বুঝি?

সুমিতা মাথা নেড়ে জানাল, না।

তবে? কথা বলছ না যে?

লজ্জা কাটিয়ে বলল সুমিতা, ভয় হয়েছিল, পাব না আপনাকে।

রবি হেসে উঠল। কিন্তু সুমিতাই মুখ ভার করল আবার অভিমানে। বলল, আর কেনই বা আপনার সঙ্গে কথা বলব? আপনি তো ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের সংস্রব।

রবির খুশি মুখে একটু বিষাদ উঠল চমকে। বলল, না না, সংস্রব ছাড়ব কেন?

সুমিতা দাঁড়িয়ে পড়ে তাকাল রবিদার মুখের দিকে। বলল, না? অমনি একটা যা তা বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন?

কিন্তু বলতে বলতে ওর মনটা চমকে উঠল বিস্মিত ব্যথায়। রবিদার সেই ভরাট মুখখানি অনেকখানি কৃশ হয়ে গেছে। এখানে ওখানে পড়েছে কয়েকটি রেখা। ওর সেই বিষণ্ণতার মধ্যে একটি সুদূর অবসন্নতার আভাস। বলল, উড়িয়ে দিচ্ছিনে। তা বলে রাস্তায় দাঁড়িও না। চলো এগোই।

তারপর রবি বারকয়েক সুমিতার আপাদমস্তক দেখে বলল, তোমাকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? কখন বেরিয়েছ?

–অনেক সকালে।

–সে কী, কিছু খেয়ে বেরোওনি? এত বেলা হয়েছে

সুমিতার ঠোঁট আবার একটু ফুলল। বলল, কী করে তা বেরুব। তা হলে কি আর আপনার দেখা পেতুম।

একেবারে ছোট রুমনির মতোই বলল সুমিতা, চলুন কোথাও, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।

বলতে হল না, উদব্যস্ত হয়ে উঠল রবি নিজেই। ছি ছি, একেবারে পাগল। কিন্তু পরে পরেই বিদ্যুতের কষাঘাতে চমকে উঠল রবির মন। সুজাতা ঠিক এমনিই ছিল যেন। এমনি খামখেয়ালি, কিন্তু পরিষ্কার কথাবার্তা।

ওয়াই এম সি এর রেস্তোরাঁয় পরদা ঢাকা কেবিনে গিয়ে বসল দুজনে। সুমিতা বলল, মেজদির বিয়েতে না যাওয়া স্থির করেছেন বোধ হয়?

–কে বলল তোমাকে? নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছি, কাকাবাবুও বাড়িতে গেছলেন শুনেছি, যাব না মানে? মৃণালও নিমন্ত্রণ করে এসেছে। তুমি বুঝি অত বড় ঘোটলোক ভেবেছ আমাকে!

–শুধুই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, না?

বলতে বলতে বড় বড় ফোঁটায় জল জমে উঠল সুমিতার চোখে। যে কান্নাটা রুদ্ধ হয়েছিল, কেবিনের এই আড়ালে, তাকে আর সামলাতে পারল না। এর মধ্যে ওর সব সুখ দুঃখই ছিল। ওর যত গ্লানি মনের, এমনকী রবিদাকে পাওয়া, ওর ক্লিন্ন চেহারার বেদনাটুকুও।

রবি কিছু বলবার আগেই আবার বলে উঠল সুমিতা, রবিদা আপনি আমাদের সবাইকে ভুলে গেছেন।

ব্যথিত গম্ভীর মুখে রবি সুমিতাকে সান্ত্বনা দিল মাথায় হাত রেখে বলল, শোনো ভাই রুমনো, কেঁদো না। নিজের সুখ কিংবা দুঃখের জন্যে যাইনি, এমন স্বার্থপর আমাকে মনে কোরো না। আমাকে নিয়ে যদি কারুর অশান্তি হয়, কেউ অপমান বোধ করে, সেখানে যাই কেমন করে এ মুখ নিয়ে। তুমি সত্যি বড় হয়েছ রুমনো, বুঝতে পার তো তুমি।

সুমিতা বলল, সে তো সত্যি নয় রবিদা।

রবি ব্যথিত মুখে দৃঢ় হেসে বলল, সত্যি রুমনো।

সুমিতার এই কান্নার মাঝেও লজ্জা করছিল। তবু বলল, না, তা নয়! রবিদা

বলো।

–আমার বড় কষ্ট হয় আপনার আর বড়দির কথা ভেবে।

বিদ্যুৎ চমক ছাড়িয়ে গুরুগুরু ডাক দিল রবির বুকে। কঠিন পাথর ফেলে বুকের যে জলপ্রপাতটাকে সে রেখেছে বন্ধ করে, রুমনি ধাক্কা দিয়েছে সেই পাথরে। কেঁপে উঠল বুকের মধ্যে। ফ্যাকাশে মুখে বিস্মিত ভয়ে হেসে বলল, ও কিছু নয়

কিন্তু সেদিকে কান দিল না সুমিতা। বলল, রবিদা, বড়দি আপনাকে ভালবাসে।

জলপ্রবাহের তীব্র গর্জনে পাথরটা যেন পিছলে পড়ার উদ্যোগ করল। প্রচণ্ড শক্তিতে নিজেকে শক্ত করে বলল রবি, রুমনো, লক্ষ্মী ভাই, ও সব কথা থাক।

রবিদার মুখের দিকে তাকিয়ে নীরব রইল সুমিতা। জল মুছল চোখের। দুজনেই চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। বয় এসে দিয়ে গেল খাবার সাজিয়ে।

তখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু দুজনেই খুঁটে খুঁটে একটু একটু খাবার মুখে পুরতে লাগল। আবার চুপচাপ। কিন্তু চুপ করে নেই ভিতরটা। এতই উচ্ছ্বাস, উপচে পড়তে চাইছে। নীরব থাকতে পারল না সুমিতা। বলল, কেন এমন হয়, কিছুই বুঝিনে রবিদা।

রবি ততক্ষণে অনেকখানি ধাতস্থ হয়ে এসেছে। সুমিতার এই অসহায় ব্যথিত প্রশ্ন শুনে সেও কথা না বলে পারল না। বলল, মানুষের মনটাই অমনি রুমনো। যেখানে থেকে যেমন তার মনের গড়ন তৈরি হয়েছে, সেখানে অতৃপ্তির বীজটা কোন এক অশুভ মুহূর্তে যেন ছড়ানো হয়ে যায়। বাড়লে পরে

সুমিতা রবির মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখ মেলে রেখেই বলল, রবিদা, সবাই যা বলে, এ সব কি শুধু গরিব বড়লোকেরই ব্যাপার?

–সেটা অনেকখানি। কিন্তু সবটুকু নয় বোধ হয়। সবটুকু হলে কেমন যেন উপন্যাসের কপচানি হয়ে যায়। সেটা জীবন নয়। অমিল? সে তত বড়লোকের ঘরেও দেখা যায়।

দুজনেই চোখখাচোখি করে এক মুহূর্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে চুপ করে রইল। যেন এই কথার অন্তরালে ঢাকা আছে একটি ছবি। আবার বলল রবি, রুমনো, কথায় বলে, মন গুণে ধন, দেয় কোন জন। তার মধ্যেও সব জায়গায় আমরা আজ পঙ্গু হয়ে আছি এই ভয়ের মারেই। আমাদের মন জুড়ে যত লীলা, সব তারই।

-কীসের ভয় রবিদা?

জীবনধারণের ভয়। ভয় জীবনে জীবন যোগ করার।

তবে তো সেই একই কথা হল?

না তো। আর্থিক সমস্যা যেদিন থাকবে না, সেদিন কোথায় থাকবে সমাজের প্রশ্ন। রুমনো, অর্থের কথা ছাড়ো। তুমি যদি ভালবাস সেই মানুষকে, যে সমুদ্রের মাঝি, পাড়ি দেবে ভয়াল অজানা লোকের সন্ধানে, তা হলে সেই সাহসে সাহস যোগ করতে হবে। খাওয়া পরার বাহ্যিক সুখটুকু না হয় রইল তোমার ষোলো আনা, কিন্তু সমুদ্রের সাহস? এ যে কর্ম আর আদর্শের সঙ্গে যোগাযোগ। মন বলো, ভালবাসা বলল, সেগুলো ও সব ছেড়ে নয়। আমি একেই বলি জীবনধারণের ভয়।

-রবিদা, আমাকেও কি তার সঙ্গে যেতে হবে সমুদ্রে?

সমুদ্রের বেলায় সশরীরে না-ই বা গেলে, মনে মনে তো যাবেই। যার তুমি প্রেয়সী, সে সমুদ্রের মানুষ। নিয়ত সংশয় যার প্রাণে, সে তোমার প্রাণের ধন, তোমারও প্রাণে সেখানে নিয়ত সংশয় যে! এ

সুমিতা ওর দু চোখের দৃষ্টি নিয়ে যেন হারিয়ে গেছে কোন সুদূরে। বলল, বুঝেছি রবিদা, বুঝেছি। সে যে বড় কঠিন।

রবি তার বিষণ্ণ চোখ দুটিতে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বলল, কঠিন বইকী ভাই। দুজনের ভালবাসা। একজন জগৎসংসার মিলিয়ে ভালবাসে, আর একজন শুধু মানুষটির সবটুকু মিলিয়েই ভালবাসে। ভালবাসা বটে, কিন্তু এক্ষেত্রে একজনকে পালাতেই হয়। মনে মনে পালায়, পালিয়ে ফেরে একই ঘরে, এক বিছানায়। তবু বলি, অর্থের সমস্যাটাই আজ আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় পাপ। আমাদের ব্যক্তিজীবনের কষ্টিপাথরটা অনেকখানি আড়াল করে রেখেছে ওই পাপ।

সুমিতা তবু বড়দির কথাটি তুলতে পারল না। বলল, রবিদা, যদি রাগ না করেন, তবে একটা কথা বলি।

বলো।

বড়দির এ জীবনটা তবে কী হবে?

মনের দিক থেকে হয়তো কোনও গণ্ডগোেল আছে। হঠাৎ হেসে বলল, কিন্তু একটি সংবাদ তোমাকে দিতে পারি। গিরীনের সঙ্গে তার প্রায়ই দেখা হয়। মনে হয়, খুব শিগগিরই হয়তো কোনও বোঝাপড়া হয়ে যাবে ওদের মধ্যে।

বিস্ময়ে চমকে উঠল সুমিতা। সহসা ওরই মুখটা যেন পুড়ে কালো হয়ে গেল। তবে কী দেখল ও কাল রাত্রে। কেমন করে মনে হয়েছিল এত কথা বড়দির সম্পর্কে। রবিদার ওই দীপ্ত হাসিটা যেন দু চোখে চেয়ে দেখতে পারছে না সুমিতা।

রবিই তাড়াতাড়ি বলল, মুখ ফেরাচ্ছ কেন রুমনো। এতে লজ্জার কিছু নেই, চমকাবারও কিছু নেই। এইটুকুই তো আমরা সবাই চেয়েছি।

সুমিতা তাকাল রবিদার দিকে। এই প্রথম ওর নজরে পড়ল, রবিদার কপালের রগের কাছে, কানের পাশে কয়েকটি চুল সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু চুল পাকার বয়স তো ওঁর হয়নি।

রবি বলল, আর নয়, এবার চটপট খাও।

খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে এক বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সুমিতা। বারোটা বেজে গেছে। বলল, এ কী, আপনাকে কলেজে যেতে হবে না?

না, আমার ক্লাস আছে দুটোয়।

তবে এত সকাল সকাল বেরিয়েছিলেন যে?

–ছাত্রসঙ্ঘের অফিসে একবার যেতে হয়েছিল। তুমি তো শুনেছ রাজেনের ব্যাপারটা। রাজেনও সকালবেলাই আমার ওখানে হাজির। অবশ্যি, অন্যায়টা অজয়েরই, অপরাধ অতি জঘন্য। কিন্তু মুশকিল হয়েছে রাজেনের মতো ছেলেদের নিয়ে।

জিজ্ঞেস করতে চায়নি, তবু আপনি মুখ ফুটে গেল সুমিতার, কী মুশকিল?

সুমিতার বিস্মিত উদ্বেগ দেখে মনে মনে অবাক হলেও, স্নেহের হাসি হেসে বলল রবি, ওই যে, যে ভয় নিয়ে আমার অত বক্তৃতা, সেই ভয়টুকু নেই ও সব ছেলের। আগুন লাগতে দেখলে আর দমকলের মুখ চেয়ে থাকতে রাজি নয়। অমনি ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ওরা নিয়মকানুনগুলির কথা যায় ভুলে। তাতে অনেক সময় গুরুতর বিপদ যায় ঘটে।

সুমিতা উৎকণ্ঠা চাপতে না পেরে বলল, আবার কীসের বিপদ?

রবি বলল, না, আর কোনও বিপদ ঘটেনি। বিষয়টা মিটে গেছে। কিন্তু এদের বিপদ তো পদে পদে। আরও সহ্যশক্তি না থাকলে কখন যে প্রাণটিও যাবে। নিজের প্রাণের ভয় ওদের নেই ঠিক, কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটাও ছোট কথা নয়। তার জন্য শান্ত হওয়া দরকার।

–আচ্ছা রবিদা

বলতে গিয়েও থেমে গেল সুমিতা। রবি বলল, কী বলছ?

রাজেনদার…মানে…অনেকে বলে, সেজন্যেই রাজেনদা ছাত্র ফ্রন্ট ছেড়ে…

একী, এত ধকধক করছে কেন সুমিতার বুকের মধ্যে। ওর কীসের ভয় এত। রবি যেন চাপা সুরে প্রায় ভর্ৎসনা করে উঠল, ছি, ও সব কথায় একদম কান দিয়ো না রুমনো। এই তো আজ সকালেই এ সব বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। এর আগেও অনেক বার হয়েছে। সেদিকে আমিই সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলুম। জিজ্ঞেসও করেছিলুম, রাজেনকে। বললে, রবিদা বিশ্বাস করবেন কি না জানিনে। প্রেম কাকে বলে, সবটুকু বোধ হয় বুঝিনে, আর ঠিক সেইভাবেই ব্যাপারটা বাড়েইনি আমার দিকে। বছরখানেক আগে মনটা কেবলি উশখুশ করত সুগতার কথা ভেবে। ওকে দেখলে খুশি হয়ে উঠতুম। চারদিকে কিন্তু কানাঘুষা শুনে, নিজেও প্রায় বিশ্বাস করেছিলুম, সুগতাকে আমি ভালবাসি। ভাল তো বাসিই। ওর চিঠিগুলি পড়ে অবশ্য আমার সংশয় হত, কেন জানিনে আমার একটু একটু হাসি পেত, কষ্টও হত। সে সব আমার কেটে গেছে অনেক দিন, তা নিয়ে আমার আফসোস নেই। সেটা সম্ভবও নয়।

রবি হেসে উঠল, আর এমন ছেলে, কোনও চাপাচাপির ধার ধারে না। বলল, রবিদা, সুগতা মৃণালকে বিয়ে করবে, এটা বুঝে হঠাৎ আমার কষ্ট হয়েছিল কিন্তু এখন ভাবি, সেটা যে কী অস্বাভাবিক কাণ্ড হত একটা।

সুমিতা বলল, মনে কি একটুও লাগেনি বলছেন?

কী রকম লেগেছে, সেটা তো তোমাকে বললুম। রাজেনের গভীরে সেটা শিকড় গাড়তে পারেনি।

কিন্তু সুমিতার চোখে মুখে কোথায় একটু রং বদলেছে। হয়তো গরম চায়ে চুমুক দিয়েই ওর নাকের ডগা, ঠোঁটের ওপর-তটে দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

রবি বলল, আর একটি কথা বলেছে রাজেন, তোমার কথা।

হাসতে গেল সুমিতা, কিন্তু চায়ের কাপটাই শুধু বেঁচে গেল পড়তে পড়তে। বলল, আমার কথা?

–হ্যাঁ। বললে! সুগতার ছোট বোন সুমিতা বোধ হয় ভেবেছে আমার মতো গোঁয়ার মানুষ খুনও করতে পারে। সেজন্যে, আমার দিকে তাকিয়ে দেখে ওর আর বিস্ময়ের সীমা নেই। মেয়েটি বড় ভাল রবিদা।

এতক্ষণে যেন মনে হল সুমিতার, বড় এলোমেলো হয়ে আছে ওর সবকিছু। আঁচল গুছোল, বিনুনি ঠিক করল। তারপর মূঢ়ের মতো একটু হেসে বলল, ও!

কিন্তু ভিতরে ভিতরে কোথায় একটি বিশাল পাথর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে ওর।

হঠাৎ রবিদা সুমিতার কাঁধে একটি হাত রেখে সস্নেহে বললেন, রুমনো আজ এত কথা তুমি বললে, তাই তোমাকেও একটি কথা বলি। তোমার প্রাণেও দাগ লেগেছে তাই। নয় কি?

হাসতে গিয়েও কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠল সুমিতা। বলল, বুঝতে পারিনি রবিদা।

–আমি শুনেছি আশীষের কথা। লজ্জার তো কিছু নেই।

বলেই যেন লজ্জা দিলে রবিদা। কিন্তু তীব্র হয়ে উঠল আবার বুকের মাঝে সেই প্রলয়টা। কী একটা বলবার জন্য মুখ তুলতে গিয়ে, লাল হয়ে উঠল সুমিতা। সেই মুহূর্তেই ওর বুক ঠেলে আবার একটা ঢেউ আবর্তিত হতে লাগল গলার কাছে।

রবিদা বলল, ভালই তো। তোমার মন চেয়েছে, আর কাকাবাবুরও আপত্তি থাকার কথা নয়। চাকরিজীবী হলেও বিত্তশালী এবং কালচার্ড পরিবার ওদের।

সুমিতাই বাধা দিয়ে বলে উঠল, কিন্তু আপনার যাওয়ার কথা তো কিছুই হল না রবিদা।

যাব তো বললুম।

রবিদার হাত ধরে বলল সুমিতা, শুধু সে যাওয়া নয়। বিয়ের বাড়িতে ভিড় থাকবে, তাই আগেই বলে যাই, মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে কথা বলবার জন্যে বড় হাঁপিয়ে উঠি রবিদা। আপনি আসবেন তো মাঝে মাঝে?

বিষণ্ন চোখ দুটি তুলে এক মুহূর্ত নিশ্ৰুপ রইল রবি। বলল, অন্তত তোমার কথা শুনতে যাব মাঝে মাঝে।

.

বিয়ে হল রেজিষ্ট্রি করে। প্রীতিভোজের আসর বসল রাত্রে। ঘরে বারান্দায়, আসবাবপত্র সরিয়ে চেয়ার টেবিল পাতা হয়েছে। ম্যারাপ বেঁধে বাগানে হয়েছে বসবার বন্দোবস্ত।

এসেছে সকলেই, বাদ যায়নি কেউ। প্রথম প্রথম সবাই কেমন যেন গুচ্ছ গুচ্ছ হয়েছিল এক এক জায়গায়। ছাত্রদল, বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিকেরা, বাবার চেনাশোনা অফিসার দল। মেয়েরাও ছড়িয়ে আছে ওই রকম থাকে থাকে। আশীষের বাড়ির সকলেই নিমন্ত্রিত। আশীষের বাবার সঙ্গে কয়েকবার মহীতোষকে কথা বলতে দেখেছে সুমিতা। চোখাচোখি হয়েছে আশীষের সঙ্গেও। দুজনেরই নজরটা এক জায়গাতেই পড়ছিল বোধ হয় থেকে থেকে।

বাগবাজারের জ্যাঠাইমার সঙ্গে জমেছে মৃণালের বুড়ি দিদিমার। কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেয়েছে সুমিতা দু-একটি কথার টুকরো।হ্যাঁ, অদ্ভুত সব সাহেবি নিয়মকানুন হয়েছে আজকাল। কিন্তু কী করা যাবে, কিছু তো বলবার উপায় নেই।

বটেই তো। নিজেদেরই ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি সব। ফেলবারও উপায় নেই।

আশীষের মা, তাপসীর মা, রবিদার বড়দি ওঁরা সব একখানে। ছাত্রদলের দিকে বেশি কলরোল। শুধু রাজেনকে সেখানে একলা মনে হচ্ছিল। কেউ প্রায় কথাই বলছে না তার সঙ্গে। তারপর দেখা গেল কখন সে সুজাতার সঙ্গে কথা শুরু করে দিয়েছে। কী দুর্বার শক্তি ওখানে টেনে নিয়ে গেল সুমিতাকে। বলল, ভোলেননি তা হলে আসতে?

রাজেন বলল, যার বিয়ে তার তো মনে থাকে না। কিন্তু বাকি আর একজনকে ফাঁকি দেওয়াই মুশকিল।

দুর্জয় অভিমানে উপচে এসেছিল ঠোঁটের তটে একটি কথা, মিথ্যে কথা, শুধু মনে রাখা। কিন্তু বুকের মধ্যে একটি দুর্বোধ্য কোলাহল নিয়েই শুধু পালাতে হল ওকে।

আর মাঝে মাঝে আশীষ ওর ঢুলুঢুলু চোখে ফিসফিস করছিল কানের কাছে, তোমার গিন্নিপনা দেখে, আমিই উঠছি পাগল হয়ে।

আবার এ বাড়িতে এরকম আর একটি দিন আমি কল্পনা করছি।

তারপরে, পরিবেশটা কী জঘন্য হয়ে উঠেছে। এক মুহূর্ত আর ভাল লাগছে না সুমিতার। কী করবে সুমিতা। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

আবার চোখ পড়ল রাজেনের দিকে। বিজলি আলো ওর প্রশস্ত কপালে পাথরের মতো চকচক করছে। আর আপন মনেই যেন হাসছে বিস্ময়কুঞ্চিত চোখে।

ওদিকে অমলা আর শুভেন্দু কাছাকাছি, আশেপাশে, সুজাতাও। রবিদা গেছেন ভিড়ে বয়োজ্যষ্ঠ রাজনীতিকদের মধ্যে। সুগতা আর মৃণাল সকলের কাছে কাছে ঘুরছে। মহীতোষ বয়স্কদের আশেপাশেই বেশি।

হিরন্ময় একবার বলে গেছে, ছাত্র ইউনিয়নের জরুরি মিটিং-এ পরশু তোমাকে থাকতেই হবে।

শুধু দুজন নেই। একজন গিরীন, আর একজন বিনয়। দুজনের জন্যেই সুমিতার মনটা খচখচ করল অন্যমনস্কতার মধ্যেও।

তাপসী ওর ঠোঁটে চোখে নিয়ে বেড়াচ্ছে রং-এর চাবুক। ওরা সপরিবারে নিমন্ত্রিত। বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে তাপসীর। অনেক বার ঠোঁট বেঁকিয়ে, চোখ কুঁচকে নানারকম নিঃশব্দ ইঙ্গিত করছে সুমিতাকে। বলেছে, চোখে চোখে রাখছি তোকে, কোন ফাঁকে আবার তোর লাভারের সঙ্গে মিট করে আসিস। সব টের পেয়েছি ম্যাডাম, পরে বোঝাব।

কিন্তু ও নিজে যে কত জনের সঙ্গে চোখে মুখে মিট করছে, তাই দেখেই অবাক হচ্ছিল সুমিতা।

আর এক জনের কথা মনে পড়ছিল সুমিতার–শিবানী আসেনি, শ্বশুরবাড়ি গেছে।

প্রেজেনটেশনে ভরে গেল টেবিল। খেতে বসার হুল্লোড়ে গুচ্ছ গেল ভেঙে। কে যে কোথায় বসল।

বিদায়ের সময় আরও এলোমেলো। আশীষ যাবার আগে, হাত চেপে ধরে সুমিতার কানে কানে বলে গেছে কাল আসব।

হিরন্ময় গেল, রবিদা গেল, শুভেন্দু, অমলা, তাপসী, বিজলী।

চলি, কেমন?

চমকে ফিরে দেখল, সুমিতা, রাজেন। সহজ হয়ে হেসে বলল, আচ্ছা। আবার আসবেন তো?

–এখন অনেক দূরের মানুষ হয়ে গেছি কলকাতা থেকে। চেষ্টা করব।

উৎসব শেষে নিভল আলো। গভীর রাত্রে বড়দির ঘরে বড়দির পাশে শুয়ে, জ্যোতিষ্কের কেমন এক দুর্বোধ্য শূন্যতায় দু চোখ চেয়ে রইল জেগে সুমিতা।

সুজাতার নিশ্বাসও ঘুমন্ত নয়।

মৃণালের দিদিমা রয়েছেন। হিন্দু প্রথায় কিছু না হলেও তিনি আজকে বাসর হিসাবেই দেখছেন। আগামীকাল কালরাত্রি। পরশু তিনি তাঁর বাড়িতে ফুলশয্যা করবেন। মহীতোষ শুয়েছেন বাইরের ঘরে। জ্যাঠাইমার সঙ্গে মৃণালের দিদিমা শুয়েছেন ওঁর ঘরে।

.

পাঁচ দিন পরে সুগতাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল মৃণাল। সারা ভারতটাই ওদের প্রোগ্রামে আছে। অবশ্য তার মধ্যে সুগতার আছে কিছু সারা ভারত ছাত্র সঙেঘর কাজ।

সব যেন কেমন নিঃঝুম হয়ে রইল কয়েকদিন। পৌষের তীব্র শীত পড়ল ঝাঁপিয়ে কলকাতায়। রস নিংড়ে নিংড়ে ফেলে ছড়াতে লাগল গাছের পাতা।

সুমিতাও যেন কেমন শীত-আক্রান্ত গাছের মতো রইল কুঁকড়ে বাড়িতে, পড়ার বই খুলে রেখে সামনে।

.

২৭.

এ জীবনে সবকিছু সুস্থির হয়ে বসে দেখা বড় কঠিন। দেখা মানেই অনুসন্ধান। মানুষ এমনি জীব, যখন তার নিজের জীবনে উত্তরঙ্গ অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন সে সুস্থির হয়ে সবকিছু দেখতে চায়। বুঝতে চায়, কোথায় কী ঘটছে।

কিন্তু এ যুগ তার নিজের জালে জড়িয়ে বেঁধেছে গোটা সংসারটাকে। এখানে স্থির হয়ে সবকিছু দেখতে গেলে বাড়ে শুধু অস্থিরতার দৌরাত্ম। কেনো, সবকিছু দেখতে যাওয়ার বিড়ম্বনা অনেকখানি।

তবুও সুমিতা সবকিছু দেখতে চাইল। নিজের জীবনে এত জট-জটিলতা জড়িয়েছে পাকে পাকে, তার অভিসন্ধি খুঁজতে গিয়ে, ওর চেনা-অচেনা সবাইকে কেমন যেন এক বিশেষ রূপে দেখতে পেল।

.

নমো নমো করে এ বছরের পড়া-পরীক্ষা সাঙ্গ করেছে।

মহীতোষ গান শুনতে চান। দুঃখ হয় সুমিতার, গান ওর তেমন জানা নেই। রেওয়াজ নেই বলে ভুল হয় প্রচুর। তখন মহীতোষ নিজেই ধরেন, আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে…সুরের ভুল হয় না, অতিরিক্ত আবেগে বিকৃত শোনায় সেই গান। বাইরের লোক শুনলে হাসত। লুকিয়ে হাসতে বাধা ছিল না সুমিতারও। হাসতে পারে না। এমন একটি সকরুণ আকুতি থাকে মহীতোষের গানে, মনে হয়, সত্যি কোথাও নিজের আবেদনকে পৌঁছে দিতে চান। কোনও এককালে একটু-আধটু গান করেছেন। এখন সেটুকু নিয়ে নিয়মিত নাড়াচাড়া করেন। হঠাৎ কেন যে এ ইচ্ছে জাগল, বোঝা দায়। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, যখন উনি নিজে গিয়ে বসেন অগানে। অগ্যানটার রিডে গণ্ডগোেল দেখা দিয়েছে। কোথায় ফুট ধরেছে বেলোটার ভিতরেও। জায়গায় জায়গায় হাঁফ ধরা নিশ্বাসের মতো গলাফাটা শব্দ বেরোয়।

বলেন, এসো রুমনো, আলোকের এই ঝরনা ধারায়.একসঙ্গে গাই আমরা।

সুমিতার লজ্জা করে। কেন যেন টনটন করে বুকের মধ্যে। কেবল মনে মনে অবাক বিস্ময়ে দেখে চেয়ে চেয়ে।

আশীষ আসেই। প্রতি দিন হয়তো নয়, তবু প্রায় প্রতি দিনই। পড়াশুনা ছেড়েই দিল। শ পাঁচেক টাকার একটি চাকরি পাচ্ছে। আশীষ বলে, এটাই ও অ্যাকসেপ্ট করবে। টাকার নাকি ওর বড় দরকার। ঢুলুঢুলু চোখে হেসে যেটুকু বলে, মনে হয়, সুমিতাকে নিয়ে সে একটি আদর্শ নিকেতন গড়ে তুলবে। সেই স্বর্গের ঠিকানাটা জানা যায় না। হয়তো আশীষ নিজেও জানে না। তবে ওর চারপাশের এই পরিবেশ ছাড়িয়ে নিশ্চয়ই। এই নীচতা, ভণ্ডামি ও ভালগারিটির কোনও ছায়াই থাকবে না সেখানে। নতুন যে বইটি লিখতে শুরু করেছে, তার বিষয়বস্তুও সে বেছে নিয়েছে এই পরিবেশের মধ্যে।

সুমিতা ক্লান্তি বোধ করে। কেন, বলে বলে ও অবসন্ন হয়ে পড়েছে। এই ভয় প্রতি মুহূর্তে, আশীষের যন্ত্রণাটা যেন ধরা পড়ে যাচ্ছে ওর কাছে। এ যেন সেই রুগত্ ছেলেটি, যে বিশ্বসংসারের সব ভুলেছে, নজর শুধু মায়ের হাতের কমলালেবুর কোয়াটির দিকে। আর কোনও কিছুতেই যার মন নেই। কিছু না চাক, সুমিতাকে নিয়ে নিজের মনের মতন জীবন গড়বে, সেটা স্থির।

সুমিতা যতই নীরব হয়, করুণ চোখ দুটি তুলে তাকিয়ে থাকে আশীষের দিকে, আশীস ততই তার জীবনব্যাখ্যা শুনিয়ে যায়। যত শোনায়, ততই ওর মুখে একটি তৃপ্তির ছবি ফুটে উঠতে থাকে। সুমিতা ভেবে পায় না, ওর মন কেন এত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

রবি আসে, যেমন কথা দিয়েছিল। তাকে দেখলেই আশীষ কোনও অছিলা করে উঠে চলে যায়। তবু সুমিতার অবসন্ন চোখে হঠাৎ আলো চিকচিক করে ওঠে। রবি আসে সুমিতার কথা শুনতে। কিন্তু কথা যা হয়, সবই অন্য কথা। কখনও কখনও সুমিতার।

সুজাতার কথা উঠলেই রবি কেমন পালাই পালাই করে। মহীতোষের সঙ্গেও তার দেখা সাক্ষাৎ কমই হয়। যে সময়ে সে আসে, সে সময়ে সুজাতা কিংবা মহীতোষ কেউই বাড়ি থাকে না। কোনও কোনওদিন বেরিয়ে পড়ে রবিদার সঙ্গেই। শুধু একটি না বলা কথা অদৃশ্য সেতু রচনা করেছে দুজনের মধ্যে। গিরীনের সঙ্গে সুজাতার মিলন। রবি এ বিষয়ে বিশ্বাস রাখে। সুমিতার সংশয়।

কত কথাই বলে রবিদা। সংসারে কীসে সুখ, কীসে দুঃখ, কোথায় সেই জটিল ঘূর্ণি নিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। রাজনীতি, সাহিত্য, কত কী! তবু কোথায় যেন রবিদা এক ভিন্ন মানুষ। সেখানে একটি ব্যথাতুর একলা মানুষ নিজেকে রেখেছে আড়াল করে।

কলেজে গেলে হিরন্ময় আসে ঘন হয়ে। বলে অনেক কথা। কিন্তু সে শুধু একটি কথা। বাকি কথা শুধুই কথা। সেই একটি কথা বলবার সুযোগ কখনও দেয় না সুমিতা। হিরন্ময় তো জানে না, নিজের জীবনে কী এক দুর্বিষহ জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে সুমিতা। হিরন্ময় বলে, সে ভাগ্যবিড়ম্বিত। ঘরে নিদারুণ অর্থাভাব, পড়তে চায় না। ছাত্র হিসেবে সে অবশ্য ভাল নয়, কিন্তু এখুনি পড়া ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাড়িতে টাকা চায়। সে দিতে পারে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তার অখণ্ড ক্রোধ। সে যেন সবসময়েই আছে লড়ায়ের ময়দানে। নিজের জীবনকে সে উৎসর্গ করতে চায়। তবু সৈনিকেরও থাকে অন্তরে অনেক কথা।

কেমন যেন, মুখস্থ বলার মতো হিরন্ময় কথা বলে। হয়তো এক দিনের দশ মিনিটের কথা বলতে দশ দিন ভাবতে হয়েছে ওকে। কেমন যেন আবোল-তাবোল, ফাঁকা ফাঁকা লাগে হিরন্ময়ের কথা। বিনয় বয়সে ছোট ছিল, কিন্তু ফাঁকা কথা বলেনি কোনওদিন। হিরন্ময় যে দরিদ্র, সেটা নাকি ওর বড় গৌরব। বড় নাকি ভাগ্য ভাল তার, বড়লোকের ঘরে জন্মায়নি। সেইটে ওর জয়তিলক।

সুমিতা শোনে। তাকিয়ে দেখে, কোথায় সেই জয়তিলক। দেখতে পায় না। শুধু একটি কথাই বোঝে। বুঝে শুধু পালাতে হয় সুমিতাকে।

তাপসী আসে। বলে ওর ভাবী বরের কথা। বলে, জানিস সে কেমন মানুষ। তুলনাই হয় না তার। এই ধর, বাস থেকে সে যদি আমার আগে নেমে পড়ে ভুলক্রমে, তবে আবার উঠবে লাফ দিয়ে। কেন না, ওটা ঘোরতর অনিয়ম। আমাকে আগে নামিয়ে তবে যে ওকে নামতে হয়। বলে হাসে খিলখিল করে।

হয়তো এতখানি সত্যি নয়, কিন্তু মানুষটিকে বোঝা যায়। তবু তাপসী বলে, রাস্তায় ওর সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে যদি একটু জোরে হেসে ফেলি, তা হলেই বেচারির চোখ মুখ একেবারে লাল হয়ে যায়। কথা শুনতে হলে তো রক্ষেই নেই। একেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে যেতে হবে। মনে হয়, গলায় যেন গুঁজে কী রেখে দিয়েছে। কী ফর্মাল ভাই। এক ঘরে যখন থাকব, তখন কী হবে?

সুমিতা বলে, কী আবার হবে। তখন সবই ঠিক হয়ে যাবে।

বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে তাপসী, এইটা। লোকটা সব বিষয়েই শেষ পর্যন্ত না অনুমতি প্রার্থনা করে বসে।

তাপসীর কথার ইঙ্গিতে লাল হয়ে ওঠে সুমিতা। তাপসী বলে, তখন আমিও বলব, একসকিউজ মি স্যার। কিন্তু তুই এত লাল হচ্ছিস কেন? আমার জানতে তো কিছু বাকি নেই।

কী জানিস?

তুই বুঝি ভেবেছিস, আশীষই সব জানে।

তা নয়, তুই কী শুনেছিস।

–শুনিনি, দেখেছি।

অবাক হয় সুমিতা। তাপসীর চোখের দিকে তাকায়। সেখানে মিটমিট করে রহস্যের হাসি। বলে, তোদের আড়ালে গিয়ে কি আর আমাকে দেখতে হয়েছে। তোকেই তো দেখছি। চিবুক নেড়ে দিয়ে বললে, ডাইনি, কিছুই যেন জানিসনে। আসলে সবই যে লেখা রয়েছে তোর চোখে মুখে। সে কি সবাই ধরতে পারবে। দেখে তো মনে হবে, ভাজার মাছটিও উলটে খেতে জানিসনে। তা হলে ফাইন্যাল হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে? হাসতে গিয়েও কেমন যেন একটি চাপা উৎকণ্ঠা দেখা দেয় সুমিতার চোখে। তাপসী বলে, কী ব্যাপার বল তো। কোথায় যেন একটু দড়কচা মেরে আছে?

তা কী জানি, একটি সরল রেখা হঠাৎ কোথায় বাঁক নিয়েছে। কিন্তু সে কথা তাপসীর সামনে বলতে বড় কুণ্ঠা। ভয়ও লাগে। বলে, কই, কিছু নেই তো।

তাপসী বলে ঠোঁট টিপে, উঁহু, কোথায় একটা গণ্ডগোল যেন আছে মনে হচ্ছে। আশীষটা তো ডুবেছে, আর কাউকে জজিয়েছিস নাকি?

না না, ছি! কাউকেই তো জজায়নি সুমিতা। যা কিছু, সবই যে ওর নিজের মন জুড়ে। ডোবানো, জজানো, যা কিছু, সব ওর নিজেকেই। বলে, কী যে বলিস। নিজেই আছি জজিয়ে। আমি আর কাকে কী করব।

–ছেলের অভাব তো নেই। যে আগুন নিয়ে বেড়াচ্ছিস তোর রূপে!

তারপরে বলে, আমার ও সব ঢাক ঢাক গুড়গুড় নেই। যার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছে, তাকে ছাড়া সবাইকে আমার ভাল লাগে, সত্যি! সে হাসবে মেপে, কথা বলবে মেপে, প্রেমও করবে মেপে, এ কেমন মানুষ বুঝিনে ভাই। শুনি, সমাজে নাকি সোনার টুকরো। ঘরে বাইরে কোথাও পান থেকে চুন খসবার উপায় নেই।

শুনতে শুনতে চমকে উঠে দেখে সুমিতা, তাপসীর মতো সর্বনাশী মেয়েও কাঁদে।

কাঁদিস কেন, তাপসী?

–ঘেন্নায় কাঁদি। সংসারে এত ছেলে থাকতে ওই সং-এর পেরুটাকে আমাকে বিয়ে করতে হবে। কেন বল দেখি।

কেন, কেন, কী সেই অমোঘ নিয়ম। কে সেই নিয়ন্তা। কত কথাই মনে আসে সুমিতার, কত কথাই বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কী এক ভয় এসে গলা বন্ধ করে দেয়। অথচ ওই ছেলের স্ত্রী হতে পারার জন্যেই হয়তো ওকে কত মেয়ের হিংসার পাত্রী হতে হয়েছে।

.

শিবানী শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে শুনে বাগবাজারে দেখা করতে যায় সুমিতা। দেখে গর্ভবতী শিবানী। চোখের কোণে কালি। মুখখানি করুণ। হাত-পাগুলি রোগা। ক্লিষ্ট বিষণ্ণ মুখখানিতে বয়স বোঝা যায় না। কথাগুলি কেমন ভারী ভারী পাকা পাকা।

বলে, ছোট পিসি এসেছ। চলো ছাদে যাই।

সেই ছাদে। সেদিন শিবানীকে বরের বাড়ির লোকরা দেখতে এসেছিল, এই ছাদে কথা বলেছিল দুজনে। এর মধ্যেই শিবানীকে আর চেনাই যায় না। বলে, ছোট পিসি ইস, তোমাকে দেখতে কী সুন্দর হয়েছে।

রুগণ চোখ দুটি ওর জ্বলে দপদপ করে। চিনচিন করে জ্বলে বোধ হয় বুকের মধ্যেও। ওর স্বামীর চাকরি, ব্যস্ততা, সংসারের ঝক্কি, কত কী বলে।

এক সময় জিজ্ঞেস করে সুমিতা, তোমাকে খুব ভালবাসে, না?

মুখ তুলে হাঁ বলতে গিয়েও, অসহায় চোখ তুলে একটু সময় তাকিয়ে থাকে শিবানী দূরের আকাশে। বলে, আমি কি তার যোগ্য ছোট পিসি?

–এ কথা কি বলে নাকি তোমার বর?

না, সে বলবে কেন। আমারই মনে হয়। সে কত কাজের মানুষ আমি যে অকাজের। স্তব্ধ শিবানীর চোখের কোলের গভীর গর্তে জমে জল।

সুমিতা ভাবে, এ কি শুধু ওরই চোখে পড়ে। এত হাসি, এত কথা, কাজ, খেলা, তার মাঝে এত বিড়ম্বনা, এত ব্যতিক্রম কি শুধু সুমিতার চোখে পড়ার জন্যেই। এই যে বড়দিনের এত উৎসব গেল, বছরের নতুন দিনে এত ফুর্তি হল, বাতি জ্বলল, গান হল, রাজনীতির আসরে এত যে বিষম গণ্ডগোল অবনিবনা, মারধোর, পুলিশ, জীবনের এত সবের মধ্যেও এ ব্যতিক্রমগুলির স্থান কোথায়। না কি, এ সংসারে সুমিতা একটা, শিবানী একটা, আশীষ, রবিদা, হিরন্ময়, তাপসী, সবাই একটা একটা। গোটা সংসারে ওরা কি কেউ নয়। যদি কেউ হয়, তবে এত উৎসব ও নিরুৎসবের মধ্যে মানুষের এত ব্যতিক্রমের সেই জাদুকরটি কে? এ কি শুধু সেই সাহস আর ভয়েরই লীলা।

.

বড়দি, সুজাতার কাছে সে প্রশ্ন আরও জটিল, ভয়ংকর, তীব্র।

জানুয়ারির শীতার্ত রাত্রি পার্ক সার্কাসের ক্লাবে জ্বলছে তীব্র তাপে। ওম করতে করতে হঠাৎ ক্র্যাকারের মতো ফাটছে মত্ত হাসিতে। দাবানল জ্বলছে রক্তে মাংসে।

কারদেজা থেকে বেরিয়ে আজ অমলাকে দেখতে পায়নি সুজাতা। অথচ আসার কথা ছিল। শুভেন্দু বেরোয়নি এখনও। মাঠ ভাল লাগে না, বেড়াতে ভাল লাগে না, পথে ঘুরতে শরীর বহে না। একটি অদৃশ্য হাতছানি শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল ক্লাবে।

অমলা থাকলে তবু নিজেকে বাধা দিতে পারে সুজাতা। অমলাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে যুক্তি আসে মনে। যত একা, তত হতাশ মনে হয়, ততই নিরুপায় মনে হয় নিজেকে। এই প্রথম আরক্ত মুখে, বয়েরকাছ থেকে পানীয় নিয়ে প্রাইভেট কেবিনে গিয়ে বসল একা একা। ক্লাবের এদিকটা নির্জন। তবু কনসার্ট শোনা যায়। নাচের উল্লাস আসে ভেসে। আর আসে উন্মত্ত কণ্ঠের ঝংকার।

কে একটা মেয়ে কোথায় হাসছে খিল খিল করে। যেন কেউ কাতুকুতু দিয়েছে। কারা যেন কেবিনের পাশ দিয়ে চলে গেল আলিঙ্গনাবদ্ধ উন্মত্ত সশব্দ চুম্বনের আবেশে।

চমকে আড়ষ্ট হয়ে রইল সুজাতা। মনে হল, ওরই ঠোঁট দুটি যেন দপদপ করছে। চারদিকে তাকাল সুজাতা। কেবিন ঠিক নয়, প্রায় আলাদা একটি ঘর। স্লিপিং কোচ, তীব্র আলো, নগ্ন শ্বেতাঙ্গিনীর ছবি। কিন্তু দরজাটি ভেজানো! থাক, অমলা আসুক। আসবেই, হয়তো আটকে পড়েছে কোথাও।

তবু সারা শরীরের মধ্যে কী একটা অস্বস্তি ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল। গলা থেকে ক্লোকের ফিতেটা দিল শিথিল করে।

কে যেন কোথায় শিস দিচ্ছে। কে যেন ছুটছে কে যেন ছুটেছে তাকে ধরবার জন্য।

দরজায় শব্দ হল টকটক করে। চেনা ঘর, নিশ্চয় অমলা। সুজাতা বলল, আয়।

বলেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে দাঁড়াল সুজাতা।

–আসতে পারি?

তীব্র আলোয় চকচক করছে গিরীনের সার্জের সুট। সেইজন্যেই কি অমলা আসেনি আজ। এই ক্লাবে কদিনই মুখোমুখি হয়েছে দুজনের। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনি। শুধু অমলা বলেছে, গিরীনকে ডাকা যাক।ওর সেই সর্বনাশা প্রয়াস। এমনি করেই নাকি ওদের মারতে হবে, স্ম্যাশ করতে হবে।

সুজাতা বলেছে, না, তা হলে আমাকে জন্মের শোধ পালাতে হবে।

কিন্তু এমন অভাবিত ব্যাপার কল্পনাও করেনি সুজাতা। আজ অমলা নেই, ঠিক আজকেই গিরীন উপস্থিত। টেবিলের উপর খাবারের প্লেট, শ্যাম্পেনের গেলাস। ক্রোধ ও ভয়, যুগপৎ ধেয়ে এল সুজাতার বুকে। তবু এক বার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল গিরীনের স্থির কিন্তু সংশয়-অপ্রতিভ চোখের দিকে। ক্লোকের গলায় ফিতে চেপে ধরে কঠিন নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী চাই?

আবেদনের ভঙ্গিতে বলল গিরীন, দুটি কথা বলতে চাই, কয়েক মিনিট।

শুধু সংশয়, অপ্রতিভতা নয়, গিরীনের দু চোখ তীব্র-পিপাসা-ক্লিষ্ট।

সুজাতা ওর অদৃশ্য ভয়টার মুখে থাবাড়ি মেরে, অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমার একদম ভাল লাগছে না কোনও কথা বলতে।

ভয়-ভয় গাঢ় গলায় বলল গিরীন, সনির্বন্ধ অনুরোধ, কয়েকটা মিনিট স্পেয়ার করতে বলছি।

বলে, দীর্ঘ শরীর পিছন ফিরে ছিটকিনি বন্ধ করে দিল গিরীন।

.

২৮.

ছিটকিনি বন্ধ করতেই একটা বিচিত্র ভয়ের শিহরন সুজাতাকে যেন অবশ করে দিল। মনে হল, শত অনিচ্ছাতেও ওরই চোখের সামনে হাত-পা বেঁধে, দেহটাকে ছুঁড়ে দিয়েছে কোন অন্ধ কোণে। চোখেমুখে যতই সেটাকে আড়াল করতে চাইছে, ততই সেটা ভিতরে ভিতরে আকুল হচ্ছে, অন্তস্রোতের চোরা বানে।

গিরীন ফিয়ে দাঁড়াতেই বলল সুজাতা, কয়েকটা কথা বলতে কি দরজা বন্ধ করারও দরকার হয়।

অনুনয়ের সুরে বলল গিরীন, বাইরের লোকের সামনে তোমারই আপত্তির কথা ভেবে বন্ধ করলুম। মানুষকে অকারণ অনেক কিছু সন্দেহ করবার অবকাশ দিয়ে লাভ কী। সে শুধু গল্পই হবে, আর তো কিছু নয়।

মানুষ এখানে কে আছে, কে জানে। রাত্রের ক্লাবের মানুষ, নিজেরাই দিশেহারা। তারা কোথায় ঘুরবে অপরের পারিবারিক ছিদ্রান্বেষণে। তবু সে যে শুধুই গল্প হবে, তাতে যেন কোথায় একটু মুক্ত আক্ষেপের সুর বাজল গিরীনের গলায়। সে এসে বসল সুজাতার পাশের সোফায়। মাথা নিচু। বোতাম খোলা কোটের ফাঁক দিয়ে একটি অতিকায় রক্তজিহ্বার মতো গাঢ় লাল টাইটা পড়েছে এলিয়ে টেবিলের ওপর। তার সর্বাঙ্গ, চোখে মুখে একটি অপরাধীর অস্বস্তি। হাসতে চাইছে, পারছে না যেন। আঙুল দিয়ে টেবিল ঠুকছে আস্তে আস্তে।

কীসের এত ভয় সুজাতার। কেন এত ঢিপ ঢিপ ওর বুকের মধ্যে। সবটাই অজানা। কী চায় গিরীন। আর কিছু নয়, কী বলতে এসেছে সে। কোন দিক দিয়ে, কী ভাবে, কী একটা আসবে আচমকা, সেই ভয় সুজাতার। ঠিক এমনি করেই এক দিন এসেছিল গিরীন। এমনি অপ্রস্তুত, লজ্জিত। কিন্তু অপরাধীর ভাব ছিল না, একটি মুগ্ধহাসি, একটা প্রসন্ন আবেগ জড়িয়ে ছিল তার সর্বাঙ্গে। সেটা মিথ্যে ছিল না। কিন্তু গিরীন-চরিত্রের ওটা সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। আজকের এটুকুও হয়তো মিথ্যে ছলনা, কিন্তু সব নয় নিঃসন্দেহে। আরেকজন আছে এর মধ্যে, যে আসল। যে অনেকখানি, বোধ হয় সে-ই সবখানি।

যতই আড়ষ্ট কঠিন হয়ে উঠেছে সুজাতা, ততই বাড়ছে উত্তেজনা। আর যত উত্তেজনা, ততই সেটাকে চাপবার জন্য, ঢেকে ঢেকে নিঃশেষ করছে গেলাস। তাতেও একটা কঠিন লজ্জার মুখে পা দিয়ে, দুর্বিনীতা বিদ্রোহিণীর মতো সতেজ থাকতে চাইছে। চুলে এই বাঁধন, কপালের ওপর ছড়ানো চূর্ণ কেশ। আরক্ত হয়েছে গাল, কানের দুদিক পুড়ছে তীব্র দাহে। ক্লোকের বাঁধনটাই শুধু টিপে টিপে কষুনি দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করছে।

ক্লাবের মত্ততা বাজছে অর্কেস্ট্রার তালে তালে। কে যেন কোথায় গান ধরেছে জড়ানো বেসুরো গলায়। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে হাততালির অসমান শব্দ।

গিরীন মুখ না তুলেই বলল, এখনও তোমার রাগ যায়নি বোধ হয়?

রাগ? নিমেষের মধ্যে সুজাতা ওর সারাটা অন্তর হাতড়ে দেখল। কই, কোথায় রাগ। নিজেরই বিস্ময়ের সীমা নেই। এত ঝগড়া, বিবাদ, হাতাহাতি। কিন্তু রাগ। সে কোথায়? একটি অবোধ শূন্যতার পাশাপাশি শুধু অস্পষ্ট একটা ভয়।

বলল, এ সব প্রশ্ন নিরর্থক।

গিরীন চোখ তুলে তাকাল সুজাতার দিকে। ভীরু ব্যাকুল দৃষ্টি সেই চোখে। বলল, একেবারেই নিরর্থক করে দিতে চাও? রাগ যদি শান্ত হয়ে থাকে, বিরাগ তো আছে নিশ্চয়ই?

তা-ও বা কোথায়। সেইটাই তো সবচেয়ে আশ্চর্য! যদি রাগ-বিদ্বেষ জমা থাকত মনে, তবে কেমন করে আসত সুজাতা এই ক্লাবে। গিরীনের জীবনের সব জেনেও কেমন করে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারত তার চোখের সামনে দিয়ে। একটু অপমানও তো বাজত। তা-ও তো বাজেনি। শুধু চোখের সামনে বলেই একটু অস্বস্তি হয়েছে মনের মধ্যে। তা ছাড়া আর কিছু তো নয়। এই লোকটি তার বিরাট প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়ে ফিরছে। প্রতিষ্ঠান, কর্মচারী, অর্গানাইজেশন, সর্বোপরি ব্যবসায়ের বিরাট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কঠোর নিয়মে চলেছে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে। সেদিকটায় তার চূড়ান্ত জয়। বেসরকারি হলেও প্রায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বই তার প্রেসে। যশ, সুনাম অভাব নেই কোনও কিছুরই। সেখানে সে প্রতিভাধর।

বাইরের জীবনে নিয়মনীতি বিশ্বাস, সবটাই তার নিজের মতো। মূল্য তার কানাকড়িও হয়তো নেই। আছে শুধু একটা বিশ্বগ্রাসী তৃষ্ণা। সুজাতার কাছে এসেছিল সেই তৃষ্ণা নিয়েই। কাজের জীবনের প্রতিভা কোথায় একটা বিধ্বংসী আগুন রেখেছিল জ্বালিয়ে লোকটির প্রাণে। সুজাতার দীপ্ত রূপের কাছে সেইটাকে ছাড় করতে চেয়েছিল।

যে অপরাধের সূত্র ধরে চলে এসেছে সুজাতা, গিরীনের জীবনে সেটা অপরাধই নয়। আজ মনে হচ্ছে সুজাতার, হয়তো একটা বিতৃষ্ণা জেগেছিল ওর প্রাণে। কিন্তু রাগ-বিরাগ কোনও কিছুই তো জমা নেই আজ। এত দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহ, রোষা-ফোঁসা সে সব তবে কীসের জন্য দেখিয়ে বেড়িয়েছে সুজাতা। কই, এই মানুষটির স্বামিত্বে মন লালায়িত হয়ে আর একটি প্রতিদ্বন্দিনীর কথা ভেবে ঘৃণায় ও অপমানে জ্বলে উঠছে না তো আজ। তবে, তবে?

মুখের কাঠিন্য অনেকখানি সরল হয়ে এসেছে সুজাতার। তার পরিবর্তে ওর সারা মুখ কেমন যেন রক্তাভ চকচকে হয়ে উঠছে। ভয়টাও অনেকখানি এসেছে স্তিমিত হয়ে, কিন্তু বুকের কোন সুদূরে কন কন করছে। বলল, রাগ-বিরাগের কথা থাক। আর কোনও কথা যদি থাকে, তবে তা-ই হোক।

গিরীন সুজাতার দিকে একটু ঝুঁকে বলল, রাগ-বিরাগের কথাই তো সর্বপ্রথমে আসে সুজাতা। তাকে বাদ দিয়ে অন্য কথা বলব কেমন করে।

নুয়ে-পড়া, ভাঙা-শির, বিষাদ-শান্ত গিরীন। কিন্তু সুজাতার দিকে তাকিয়ে তার চোখে একটি স্তিমিত দীপশিখা যেন উসকে উঠছে আস্তে আস্তে।

সুজাতা বলল, আমার কথায় বিশ্বাস করার কোনও কারণ আছে কিনা জানিনে। তবু এইটুকু বলতে পারি, রাগ-বিরাগ ও সব কিছুই নেই আমার মনে।

গিরীন বলল, তবে টাকাটাও ফিরিয়ে দিলে কেন তুমি? হয়তো সেটা খুবই কম হয়েছিল। আমি সেটাকে বাড়িয়ে একেবারে এক হাজার করে দেব। তাতে তো তোমার আপত্তি নেই?

সুজাতাও প্রায় চমকে উঠে কঠিন গলায় বলল, না, না, তার কোনও দরকার নেই।

–কেন সুজাতা?

কেন যেন এই কথাটিই মনে হয়েছিল। ঠিক এই টাকার কথাটিই বলবে গিরীন। কিন্তু এই বোধ হয় সবচেয়ে বড় বিচিত্র, গিরীনের ওপর ওর রাগ-বিরাগ কিছুই নেই বলে টাকাটা কোনওদিনই পারবে না নিতে। বলল, আমার দরকার নেই।

দরকার না থাকলে তুমি কারদেজোর শুভেন্দুর পাল্লায় কেন পড়েছ?

–সেখানে আমি চাকরি করি।

-তা জানি। শুভেন্দুকে জানি বলেই এমনি করে বললুম। সেটা আমার বড় বাজে বলেই তোমাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করছি।

–তা হয় না। কারুর মুখ চেয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

–শুধু মুখ চেয়ে থাকা? অধিকার-অনধিকারের কোনও কথা নেই?

না।

—না?

হঠাৎ চুপ করে গেল সুজাতা। কী করে জানাবে ও গিরীনকে, এখানে আজ সমস্ত অধিকার-অনধিকারের প্রশ্ন সত্যি হারিয়ে গেছে একেবারে। রাগ-বিরাগের মতো সেটাও লয় হয়ে গেছে। অথচ সবাই জানে, ওই প্রশ্নগুলি নিয়েই সুজাতার জীবনে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে। এত বড় মিথ্যে হয়ে গেছে সেগুলি কেমন করে। কোনওকালেই কি সেগুলি সত্যি ছিল সুজাতার জীবনে। কী একটা উৎকণ্ঠা চেপে বসেছে মনের মধ্যে। আর এ সব কথা বলতে পারছে না সুজাতা। বলল, এ সব কথা থাক।

এ সব কথা থাকবে, অথচ এই গিরীনই ওর স্বামী। স্বামী ওর পিছনে ফিরছে। ক্ষমা চাওয়ার চেয়েও আত্মদানের আরও বড় রূপ ধরে এসেছে। আর সুজাতার রাগ নেই, দ্বেষ নেই, তবু তাকেই ছেড়ে যেতে চায় ও। জীবনের এই এত বড় ভয়ংকর বিপর্যয়টা কেমন করে জানাবে লোককে। কেমন করে জানাবে, সবচেয়ে বড় ফাঁকিটা ও নিজেকেই দিয়ে বসে আছে। যেটাকে ও সমুদ্রের মোহনা বলে মনে করেছিল, সেটা আসলে অনেক নদীর মুখ। পথ ঘুরে সে ঘন অরণ্যের জালে জড়িয়ে, আর এক ধারায় একা একা বুক চেপে চেপে শুরু করেছে পুনর‍্যাত্রা। আরও কত ভয়ংকর দুর্গম পথ পার হয়ে পাবে সে সমুদ্র-সঙ্গম। তাই আজ তুচ্ছ হয়ে গেছে বাকি আর সবই। অন্তর থেকে চাইতে ওর ভুল হয়নি, প্রাণ ধরে পেতে গিয়ে মেরেছে নিজেকে। এ-যুগে ওই চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটাই সবচেয়ে বড় মান। তারই থাবায় পড়েছে সুজাতা। নিজেকে নিয়ে নকড়া-ছকড়া কেমন করে রোধ করবে ও। ওর সেই পাওয়ার ভুলের পথ ধরেই এসেছিল গিরীন। আজ তাই দায়-দাবি রাগ-দ্বেষ কিছুই আসে না যে। আর এমন করে কোনওদিনই তো এ সব কথা মনে হয়নি। চায়ওনি মনে করতে। শুধু বিপথের মারই খাচ্ছিল পড়ে পড়ে।

আবার বলল সুজাতা, এ সব কথা থাক।

গিরীন বলল, কত দিন থাকবে সুজাতা।

চিরদিন। কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলতে বাধল সুজাতার। প্রশ্ন ক্রমে বাড়বে গিরীনের। বলল, সে কথা কেমন করে বলব?

গিরীন সরে এসে বলল, অতীতটা কি কিছুই নয় সুজাতা।

কিছু হয়তো, তবু যেন কিছু নয়। দুকূল প্লাবিত অন্তরঙ্গ জীবনে সে যেন শুধু আজ বড় জাহাজের ঢেউ কেটে যাওয়া। সেই উত্তরঙ্গ নদী আজ আবার নিস্তরঙ্গ। আপন স্রোতে ও-পথে ধাবিত। গিরীনকে নিয়ে সেখানে আর কোনও আবর্ত নেই। এই কথাটিই সুজাতা আর কারুর সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে না। বাবা নয়, গিরীন নয়, এ-সংসারে কাউকে নয়। ওর নির্বাক প্রাণে শুধু পাক দিয়ে উঠল তীব্র যন্ত্রণা।

গিরীন আবার বলল, জিজ্ঞেস করতেও ভয় হয় সুজাতা। কোনওদিন কি আমাকে ভালবাসনি?

সত্য কথাটা চাপতে গিয়ে যেন চমকে উঠে দাঁড়াতে হল ওকে। ছলনা করতে চাইছে গিরীনের সামনে নীরব থেকে।

কী বলবে সুজাতা। বলবে, জল তো কখনও রত্ন-জাহাজের হালের টানে পথ ঘোরে না। টান তার

হয়েছে সুজাতা। না পেরেছে ওদিকে যেতে, না এদিকে। অমলার মতো হতে পারল না। আর বিবাহিত স্বামী সামনে দাঁড়িয়ে করজোড়ে। কী বিচিত্র! একে তো কিছুই বলার নেই সুজাতার।

গিরীন আবার বলল চাপা থরো থরো গলায়, বলো উমনো।

সুজাতা তাকাল গিরীনের চোখের দিকে। তার গলা যত বিনীত-বিষাদ করুণ, চোখের কোলে ছায়া যত গাঢ় আর ছড়ানো, গভীর আঁকাবুকি, চোখের দীপশিখা তত জ্বলছে দপ দপ করে। সেখানে কোনও রূঢ় বিদ্রোহের ছাপ নেই। ব্যাকুল চঞ্চল একটি পতঙ্গ পুড়ছে নিজেরই দুচোখে। যেখানে ছাপ পড়েছে সুজাতার প্রতি অঙ্গের। মনে-মনে চমকে উঠল সুজাতা। একেবারে কিছুই মনে পড়ে না, তা নয়। গিরীনের সুদীর্ঘ দীপ্ত মূর্তিতে ছায়া ঘনিয়েছে বটে এক বছরের মধ্যেই। তবু এই চোখ মুখ চিনতে ভুল হয় না। হয় না, কারণ গিরীনের কোনও মূল্য থাক বা না থাক, ও নিজে তো মেয়েমানুষ। এমনি মূর্তি নিয়েই হয়তো গিরীন ঘোরে দোরে দোরে। এমনি করেই তাকায় অমলার দিকে, আরও অনেকের দিকে। তারপর গভীর রাত্রে যখন একলা, তখন দু চোখ জ্বলা বিরাট লেফটহ্যান্ড ফোর্ডটা নিয়ে ছোটে বাঘের মতো। তাতে আজ কোনও ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই সুজাতার গিরীনের প্রতি। অমলার কথায়, হয়তো এমনি করেই মারতে হয় গিরীনদের। কিন্তু গিরীনকে কোনও রকমেই যে মারার কিছু নেই সুজাতার। মার খাওয়ার পালা যে শুধু ওরই। আসলে অমলার কাছেও ও যে মিথ্যাবাদিনী। তাই শুধু একটি সর্বনাশের পথেই ঠেলে দিতে পেরেছে অমলা।

পরিষ্কার গলায় বলল সুজাতা, গিরীন। বৃথা আমাকে এ সব জিজ্ঞেস কোরো না। ভালবাসার আমি কিছুই বুঝিনে, তাই আমার কোনও জবাবও নেই।

বলে, সোফা থেকে ব্যাগ কুড়িয়ে নিতে গেল সুজাতা।

গিরীন এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সুজাতার একটি হাত ধরল। চাপা গলায় ডাকল, সুজাতা।

লুব্ধ বুভুক্ষু আর্ত চোখ গিরীনের। বিনীত কিন্তু অসংকোচ কামনায় যেন গলে যাচ্ছে। রক্তবর্ণ টাইটা যেন লকলক করছে ক্ষুধিত জিভের মতো। এক মূহূর্তের জন্য চলন্ত মেশিনের ব্রেক কষার মতো থমকে গেল সুজাতার হৃৎপিণ্ড। পরমুহূর্তেই সেই প্রথম ভয়টা কলকল করে ছুটে এল রক্তের মধ্যে। গলায় স্পষ্ট স্বর পর্যন্তও নেই। হাত টেনে নিয়ে বলল, ছাড়ো গিরীন, আর আমি বসতে পারব না।

হাত ছাড়ল না। ব্যাকুল কম্পিত গলায় বলল গিরীন, আমি তো তোমার কাছে এসেছি নত হয়ে। রোজ আসি, ফিরে যাই। অধিকার না-ই থাক, দয়া করো।

চিৎকার করে উঠতে চাইল সুজাতা, কিন্তু স্বর নেই। সর্বাঙ্গ শক্ত করে, রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠল। দয়া করবার সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছে এ জীবনে। দয়ার পাত্রী সুজাতা নিজে। জোর করতে গিয়ে ওর ক্লোকের বোতাম গেল খুলে। বন্ধ ছিটকিনিটার দিকে তাকিয়ে ও নিজেই নিজের যন্ত্রণায় ফিসফিস করে বলল, তোমাকে কেমন করে বোঝাব গিরীন, এ আর হয় না। তুমি আমাকে দয়া করো, দয়া করো।

ক্রুদ্ধ বিক্রম নেই, কিন্তু যেন নিশি-পাওয়া উন্মাদ গিরীন। দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার উন্মত্ত সর্বগ্রাসী ঠোঁট লুটিয়ে দিল সুজাতার মুখের উপর। এ কী ভয়ংকর বিস্ময় ও বিদ্রূপ সুজাতার জীবনে। এই ওর বিবাহিত স্বামী। তবু যেন মনে হয়, কোন এক সম্পর্কহীন লোক অপমানে ও পীড়নে দলিত করছে। ভয়ার্তস্বরে মাথা বাঁচিয়ে বারবার বলতে লাগল, পায়ে পড়ি তোমার গিরীন, পায়ে পড়ি।

বাঁচতে না পারি, এমনি করে মরতে পারব না। ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।

কিন্তু আশ্চর্য কৌশলে গিরীন হাত বাড়িয়ে সুইচটা দিল অফ করে। ঘোর অন্ধকারে, নিজেরই রক্তাবর্তে নিঃশেষে হারিয়ে গেল সুজাতা। কঠিন পাশ বদ্ধ হয়ে, উজানবাহী রক্তধারা লুপ্ত করে দিল ওর দেহাতি মেয়েটাকেই।

তার পরের একটা ভয়াবহ শূন্যতা, দলা দলা অন্ধকার আর ঘুষঘুষে জ্বরের মতো ক্ষয়িষ্ণু নিস্তেজ সবকিছু। অর্কেস্ট্রা বাজছে, হাসি, গান সবই হচ্ছে, তবু যেন সে কোন সুদূরে।

গিরীন ডাকল, সুজাতা।

জবাব নেই। অনেক বার ডেকেও জবাব না পেয়ে, সহসা শঙ্কিত গিরীন উঠে আলো জ্বালাতে গেল। সেই মুহুতেই মৃত আত্মার মতো ক্ষীণ গলা শোনা গেল, চলে যাও গিরীন।

সুজাতা

তেজোদৃপ্ত নয়, অনুনয়ও নয়। কেমন একটা বেসুরো শূন্য সরু গলা আবার শোনা গেল, কিছু বোলো না, চলে যাও।

কেমন একটা নিশি-ঘোর-দৈববাণীর মতো শোনাল কথাটা। ছিটকিনি খুলে, কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে বেরিয়ে গেল গিরীন। তার পিছনে পিছনেই একটা অদৃশ্য দমকা বাতাস এসে যেন আবার বন্ধ করে দিল ছিটকিনিটা। তারপর প্রকাণ্ড কেবিনটার মাঝখানে প্রেতিনীর মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল সুজাতা। একটা ভয়ংকর অর্থহীন যন্ত্রণা ওকে পাগল করে তুলতে লাগল। চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে কাপড় ছিঁড়তে, সব কিছু ভেঙে ফেলতে, লণ্ডভণ্ড করতে।

সোফার হাতল ধরে দাঁড়াল শক্ত হয়ে। না, কিছু করবে না সুজাতা। এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকুক, যতক্ষণ পারে। অদ্ভুত। এমন ক্লাবের প্রাসাদেও মশা গুনগুন করছে। কোথায় ডাকছে একটা বেড়াল।

যেন সুজাতা সত্যি পাগল, দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। আর এই গোটা যুগটা বিদ্রূপ-অট্টহাসে ওকে ঢিল ছুঁড়ে, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করছে। এই ঠিক। ও না পেয়েছে পুরোপুরি নিজেকে ফাঁকি দিতে, না পেরেছে পরকে। হৃদয় সঁপেছে ও প্রেমের দেবতাকে, আর রত্নহারের জন্য ছুটে গিয়ে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে ঐশ্বর্যের নিত্য সুখের দেবরাজকে। ভয়ে যখন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়েছে ফিরে, তখন দেখছে নিজেকে উইলসনের নাইট ক্লাবে। দেখল, ওর সঙ্গে লড়বার জন্যে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে এই যুগটা। সে আজ গিরীনের বেশে একটা পুরুষ পাঠিয়েছে। কাল যদি পাঠায় আর এক জনের বেশে। ও যে মেয়ে। রং, হাসি, দীপ্তির মাঝেও ওকে যে এমনি করেই মেরে দুর্বল করবে সে। হৃদয় নিয়ে আপস না করে, লড়তে গিয়ে দেখছে, দুয়ের মারে ওর সেই বিপাকে-পড়া মেয়েটিই মরো মরো।

কী করবে সুজাতা। সহসা বুক ঠেলে ওঠা অসহায় আর্ত চিৎকারটা চেপে ধরল সোফার কোলে। আর দু চোখ ফেটে এই কঠিন অন্ধকারটাকে প্লাবিত করতে লাগল অশ্রুজল। বাবার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মায়ের সেই স্নেহস্নিগ্ধ মুখখানি। জীবিত কিংবা মৃত, তাদের কারুর কাছে আর ছোট উমনোটির মতো ফিরে যেতে পারবে না।

যার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে, আবার খেলা করতে গিয়ে মরেছে সুজাতা, আজ এই মুহূর্তে শুধু তার কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু সে যে কত বড় বাধা। আত্মাভিমান, অহংকার, অপমানের বাধা নেই তার কাছে। কিন্তু রবি যদি তার এ যন্ত্রণা একটুও না বুঝে থাকে, তবে কেমন করে যাবে সুজাতা। এত আদর্শ, এত রাজনীতির মধ্যে যন্ত্রণাটাও কি ছলনা বলে মনে হবে চিরদিন।

.

২৯.

মিসেস উইলসনের নাইট ক্লাবের এক অন্ধ কোণে যখন এই ঘটনা ঘটছে, তখন ক্লাবের দোতলার বারান্দায় এক টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে অমলা আর শুভেন্দু। মোটা পরদা ঢাকা বারান্দাটাও পান-ভোজনে, আলাপ-গুঞ্জনে সরগরম।

শ্যামলী অমলার আরক্ত মুখ পেঁয়াজের খোসার মতো রং ধরেছে। আরশোলার পাখার মতো চকচক করছে চোখ। বোঝা যাচ্ছে, পানীয়ের হলকায় তেতে উঠেছে সে। চোখের দৃষ্টি মাতাল বদ্ধ নয়। শুভেন্দুকে ছাড়িয়ে যেন কী দেখছে তার সুদূর তীব্র চোখে। ঠোঁটের কোণে ড্যাগার-তীক্ষ্ণ বাঁকটুকু যেন বহু ইতিহাস-দেখা স্ফিংকসের হাসি। উদ্ধত বন্যতা নিশ্বাস ফুঁসছে তার সর্বাঙ্গে।

মুখোমুখি শুভেন্দু। ধবধবে ফরসা রং এখন রক্তবর্ণ অঙ্গার। ছোট ছোট চোখ দুটিও টকটকে লাল। মত্ত, কিন্তু ক্ষিপ্ততা নেই সেখানে। আছে এক ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। সেটাও পাশবিক কিন্তু পোষমানা। কামনার দীপশিখা দিয়ে সেটা অমলার আরতি নয়। শুধু বোবা অস্থির অনুসন্ধিৎসা। জানুয়ারির রাত্রেও বিন্দু বিন্দু ঘাম তার কপালে। গোটা শরীরটা যেন ফেঁপে ফুলে ফেটে পড়তে চাইছে কোট প্যান্ট ছাড়িয়ে। দৃষ্টি তার এক নিমেষের জন্যেও অমলার চোখ থেকে নামল না।

জানে অমলা, শুভেন্দু তাকিয়ে আছে। জানে বলেই বোধ হয় তার ঠোঁটের কোণ আরও সূক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। চিরদিন এমনি করেই তাকিয়ে থেকেছে, কারদেজোর চিরকুমার ম্যানেজার। অমলাকে পাওয়ার আগে এমনি করে তাকিয়ে থেকেছে সুধার দিকে। সুধার বেলায় মিস মিলারের দিকে। আর কারও দিকে নিশ্চয় মিসেস মিলারের বেলায়।

আজ সুজাতার বেলায় তাকিয়েছে অমলার দিকে।

এটা অভিশাপ কিনা কে জানে, কিন্তু এইটি শুভেন্দুর জীবন। গোটা কারদেজো প্রতিষ্ঠানটা তার কাছে অশেষভাবে ঋণী, মানুষ হিসেবে কাউকে সে এ জীবনে কাছে টানতে পারেনি। সে পেয়েছে অনেককে। ছেলে আর মেয়ে বন্ধু বান্ধবী। সবাই তাকে ছেড়েই গেছে, নয়তে ছাড়তে হয়েছে। টিকে থাকার জন্য কেউ আসেনি। সে দেখেছে, কি বিবাহিত আর অবিবাহিত জীবনে, একসঙ্গে টিকে থাকার জন্যে জোড় বাঁধে না কেউ এ সংসারে। তাই, ওদিকটাকে ছেড়ে এক আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে সে ঘুরে মরছে যৌবনে। যত ঘুরছে, পিপাসাটা বাড়ছে তত। সেই জন্যে লোকে তাকে ঠিকই জানে, অসচ্চরিত্র, লোভী এবং পাপী বলে।

চোখ না ফিরিয়েই অমলা বলল, শুধু শুধু ওরকম করে তাকিয়ে থেকো না শুভেন।

শুভেন্দুর মস্ত বড় লাল মুখখানি এক বার আবর্তিত হল। প্রায় গালফোলা একটি ছেলেমানুষের মতো বলল, কেন?

অমলার ঠোঁটের কোণ আরও তীক্ষ্ণ হল। বলল কোনও কারণ নেই, তাই। কিন্তু শুভেন্দুর চোখের জিজ্ঞাসা ঘুচল না তাতে। বলল, তুমি যে এত পরোপকারী আমি তা জানতুম না অমলা।

ভ্রূ কাঁপিয়ে বলল অমলা, পরোপকারী?

কাঁপা মোটা গলা শোনা গেল শুভেন্দুর, তাই তো দেখছি। স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মিটিয়ে দিচ্ছ তুমি।

নিঃশব্দ হাসিতে বিলোলিত হল অমলার সর্বাঙ্গ। মত্ততার ঘোরে রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছতে গিয়ে, লিপস্টিকের রং লেগে গেল কষে। কিন্তু কোনও কথা বলল না।

শুভেন্দু তেমনি চোখে তাকিয়ে আবার বলল, শুধু আমাকে ঘুরিয়ে মারলে এত দিন।

অমলা বিলোল কটাক্ষ করে বলল, আমার জন্যে কি আর তুমি ঘুরে মর? বলে, শুভেন্দুর নির্বাক রক্তাভ বোকা বোকা মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল খিলখিল করে।তোমাকে একটা হোঁতকা টিকটিকির মতো দেখাচ্ছে শুভেন। প্লিজ, একটু হাসো। অন্যান্য দিন এতক্ষণে তোমার কতরকম খ্যাপামি শুরু হয়ে যায়। জানি, আমার জন্যে তুমি আমার কাছে বসে থাক না। শুধুই আর একজনের আশায়। সেদিক থেকে তোমাকে তো আমি নিশ্চিন্ত থাকতে বলছি।

–এখনও?

–এখনও।

–আজ, এই মুহূর্তেও?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, আজ এই মুহূর্তেও।

অতিকায় গিরগিটির মতো ঝুলে পড়ল শুভেন্দুর থুতনির তলা। বারে বারে ঢোঁক গিলতে গিয়ে, গলায় মাংস দলা পাকাতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আবার নিঃশব্দে। তাকে টিকটিকি বলার জন্যে একটুও বিকৃত হল না মুখ।

অমলার মনে কী হচ্ছে, কিছুই বোঝবার উপায় নেই। শুধু ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু ছাড়া। তার সামান্য হাত পা চালানো দেখে বোঝা যাচ্ছে, ঈষৎ বেসামাল হয়ে পড়েছে। যেন এটা নাইট ক্লাব নয়। ধুধু বালুপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে যুগ যুগ ধরে দেখছে জনপদের দিকে, এমনি সুদূর-তীব্র-শ্লেষ দৃষ্টি ও হাসি।

হঠাৎ বলল, শুভেন, তুমি আর এভাবে কত দিন চালাবে?

শুভেন্দু চমকে উঠে বলল, কীভাবে?

–এভাবে, পরস্ত্রীর পিছনে ঘুরে?

হাতের রুমালটা দলতে দলতে, ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করল শুভেন্দু। বলল, যত দিন স্ত্রীরা এভাবে ফিরবে।

অমলা একটু অবাক হল শুভেন্দুর কথা শুনে। এরকম করে যে শুভেন্দু কথা বলতে পারে, ধারণাই ছিল না। হেসে বলল, স্বামীত্যাগিনীদের জন্যে তা হলে তুমিই আছ। কিন্তু এর চেয়ে একটা রেগুলার লাইফ কাটাওনা কেন?

–এটা কি ইরেগুলার।

–এই রেগুলারিটির কথা বলছি না। তোমার স্বজন নেই, কাউকে পুষতেও হয় না। আঠারোশো টাকা মাইনে পাও, কারদেজোর ম্যানেজার তুমি। একটি ভাল মেয়েকে বিয়ে করে…

বদ্ধ মাতালের মতো শুভেন্দু টেবিলে মুখ চেপে হেসে উঠল। শিশু যেমন করে কেঁদে ওঠে মুখ লুকিয়ে। হাসির দমকে মনে হল, কোর্টের সেলাইগুলি খুলে যাবে পড় পড় করে। একটু সামলে নিয়ে বলল, ঠাট্টা করছ অমলা।

-ঠাট্টা কেন?

নয়?

বলে হাসতে গিয়ে হঠাৎ থেমে, অমলাকেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, এইরকম আর একজন মেয়ের নাম্বার তুমি বাড়াতে বলছ? কিংবা সুধার মতো, মিসেস মিলারের মতো, সুজাতার মতো? অ্যাবসার্ড। আর যে করে করুক, আমার দ্বারা হবে না।

অমলা অবাক হয়ে বলল, সবগুলোকে এক করে দেখছ কেন শুভেন? তুমি অনাদি (অমলার স্বামী) নও, গিরীনও নও। সংসারের সব মেয়ে অমলা সুজাতাও নয়।

মত্ত ভঙ্গিতে ঘাড় দুলিয়ে উঠল শুভেন্দু, না, না। সব এক। আমি সব জায়গায় তাই দেখেছি। আমার বন্ধু বান্ধবী, কেউ বাকি নেই। তাই বিয়ের চেয়ে এত ঘৃণা আমি আর কোনও কিছুকে করিনে। আই হেট। রোদের বুকে বৃষ্টি হলে, লোকে বলে শেয়ালের বিয়ে হচ্ছে। এ সব বিয়ের চেয়ে তাও ভাল, অনেক ভাল লাগে ভাবতে।

অমলার দুচোখে চিকচিক করে উঠল বিস্ময়। দেখল, শুভেন্দু ভয়ংকর উত্তেজিত। কোনওদিন এত উত্তেজিত তাকে দেখেনি অমলা। কোনওদিন এ প্রসঙ্গ ওঠেনি বলেই বোধ হয়। আবার বলল, অকারণ আরেকটা ভাল মেয়ের জীবন নষ্ট আমি করব না এভাবে।

অমলা বলল, ভাল মেয়ে?

হ্যাঁ। আমি জানি অমলা, তোমরা সবাই ভাল মেয়ে। তুমি, সুধা, সুজাতা, সবাই। তোমরা মেয়েরা সবাই বড় ভাল। ছেলেরাও ভাল। অনাদি, গিরীন, কেউ খারাপ নয়। শুধু এ যুগে বিয়ে করলেই সব খারাপ হয়ে যায়। আই হেট। আর যা-ই বলো, বিয়ের কথা আমাকে বোলো না।

দপদপ করে জ্বলছে শুভেন্দুর মুখ। চোখেও একটা বোবা ভয়ংকর। এক বার দাঁড়াল উঠে, আবার বসে পড়ল তখুনি। বয় এল ছুটে উধ্বশ্বাসে। ভেবেছে, তাকেই বুঝি দাঁড়িয়ে উঠে ডেকেছে সাহেব। ডাকেনি বটে, কিন্তু নিরাশ হতে হল না। আবার নতুন ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল শুভেন্দু।

আজ অমলাকে নির্বাক করেছে সে। দেখছে, কী বিস্ময়কর ঘৃণা শুভেন্দুর। অমলার শক্ত বুকেও একটা তরঙ্গের দোলা দিয়েছে সে।

বলল, শুভেন, এ বিট একসাইটেড তুমি।

শুভেন্দু বলল, ননা, না। আমি একেবারেই একসাইটেড নই, খুব নির্লিপ্ত আমি আমার জীবনে। আমি দেখছি, পৃথিবীটা একসাইটেড, এই একসাইটেড পৃথিবীটা। গরিবদের কথা আমি কিছু জানিনে, বুঝিনেও। ওরা কেন বিয়ে করে, আমি জানিনে। তুমি আমি, আমরা কেন করি, তা জানি। আমরা কত হীন এবং শয়তান, শুধু সেটা দেখার জন্য। কার কথা বলব বলো? কোন বন্ধুর কথা বলব? এই ক্লাবে যারা এসেছে, তাদের সংখ্যা কি কিছু কম আছে? কোন সাহসে বিয়ে করব আমি? এ যুগে আমাদের

স্বীকৃতি অস্বীকৃতি, ঠিক কিছুই নেই অমলার। তবু এই সিনিক মাতালটার কথার মধ্যে কোথায় একটা কুৎসিত সত্য গর্জন করছিল।

গলা ভিজিয়ে বলল আবার শুভেন্দু, অমলা।

-বলো।

তুমি ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি-এ পাশ করেছিলে?

বিস্ময়ে চমকে উঠে বলল অমলা, হ্যাঁ, কেন?

–আই.এ-তে তুমি প্রথম হয়েছিলে কলকাতায়, ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হয়েছিলে মেদিনীপুর জেলায়। তুমি ভাল গান গাইতে পার। দুস্থ ছাত্রদের জন্য দল বেঁধে তুমি ভিক্ষে করে বেড়িয়েছ এককালে, জীবনে তুমি কারুর কোনও ক্ষতি করনি। কিন্তু তোমার কেন এমন হল।

অমলার বুকের মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ নিঃশব্দ আর্তনাদ উঠল। এ সব কী বলছে মাতালটা। এটা মিসেস উইলসনের নাইট ক্লাব। আর এই রঙ্গচারিণী অমলা। স্বামীর ওপর শোধ তুলতে গিয়ে, এখন শুধু ওইটাই তার পরিচয়। এই লাল টকটকে গাল-ফোলা বোকা বোকা কিংবা বীভৎস শুভেন্দু কেন তাকে এ সব বলছে।

হাসবার চেষ্টা করে বলল অমলা, ও সব বক্তৃতা রাখো শুভেন।

–কেন রাখব। তুমি আমাকে বিয়ে করতে বললে কেন? এর চেয়ে ভাল মেয়ে আর কোথায় পাওয়া যায়, আমি জানিনে। অথচ তার আজ এই হাল।

বুকের মধ্যে ভিতরে ভিতরে একটা অন্তর্টিপুনি যেন পিষে মারছিল অমলাকে। সেটাকে আড়াল করে হেসে উঠল অমলা। ফুলে ফুলে, আঁচল লুটিয়ে, বুকের দোলনে জামাটাকে তটস্থ করে হেসে উঠল। বলল, তুমি মাতাল হয়ে গেছ শুভেন্দু।

গাল ফুলিয়ে বলল শুভেন্দু, আমি তাও পারি, তোমরা সেটাও পার না।

যেন হেসেই ধমকে উঠল অমলা, কী বলছ তা হলে। বিয়ে করবে না তো, কী করবে সবাই?

–তা কী জানি। বিয়ে যেখানে শেয়ালের বিয়ের চেয়েও জঘন্য, সেখানে বিয়ে হতে পারবে না।

অমলা যেন ভয় পেয়েছে। সে চাপা দিতে চাইছে, শান্ত করতে চাইছে শুভেন্দুকে। বলল, বেশ, হবে না, মিটে গেল। এবার থামো।

কে থামবে। আজ লোকটার আর একটা অনাবিষ্কৃত দরজা গেছে খুলে। বলল, অনাদিটা কত মুখচোরা ছিল, মেয়ে দূরের কথা, ছেলেদের দিয়ে তাকিয়েই কথা বলতে পারত না। ও কেন এমন হল। ওর স্বজন আছে, সব আছে, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির সুপারিনটেন্ডেন্ট, কীসের অভাব ওর।

অমলার সেই ঠোঁটের কোঁচ সহসা ঝরে পড়ে গেল। পেঁয়াজের খোসার চমকানিটুকু ফ্যাকাশে দেখাল যেন। ডাকল, শুভেন।

শুভেন তখন তার টাই-টাই চটকাচ্ছে। বলল, আমি জানি অমলা, অনাদি কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে। জব্বলপুরে কিংবা বোম্বেতে ট্রান্সফার নিচ্ছে সে। আমি জানি তোমাকে সে ফেলে যাচ্ছে—

অমলার মনে হল, কে যেন তাকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে অনেক উঁচু থেকে। দেখছে, সে জানে, জীবনের খুব কাছের আলসেটার পরেই সুগভীর নিচুতে মৃত্যুর মতো এক টুকরো শাণ চকচক করছে।

দাঁড়িয়ে উঠে, তীক্ষ্ণ চাপা গলায় বলল অমলা, শুভেন, আমি চলে যাচ্ছি।

ছেলেমানুষের মতো দু হাত বাড়িয়ে বলল শুভেন, না না, এখন যেয়ো না।

তবে তুমি চুপ করো।

আচ্ছা, আচ্ছা।…

সোফায় এলিয়ে পড়ে, চোখ বুজে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল অমলা। ওর বিস্ত বেশবাস অনেকেই দেখছিল তাকিয়ে তাকিয়ে।

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভীরু দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠল শুভেন্দু। বলল, অমলা, কেন তুমি আমাকে বিয়েটিয়ের কথা বলছ? তুমি কি আমাকে নিরাশ করছ?

অমলার ঠোঁটের কোণে আবার একটু হাসির আভাস উদিত হল ধীরে ধীরে। বলল, না।

–কিন্তু অনেক আশা দিয়েও তুমি গিরীনকে মিট করিয়ে দিলে।

–সেটা তোমারই সুবিধের জন্যে।

শুভেন্দুর মুখের লাল মাংস দলা পাকিয়ে যোবা আর বোকার মতো দেখাতে লাগল। চোখের কোলে লোভী অনুসন্ধিৎসা। বলল, কেমন করে?

–এত কথা বলতে পার আর এটা বোঝ না?

চোখ না খুলেই বলে গেল অমলা, তুমি যা চাও, গিরীনও তাই চায়। সুজাতার কাছে তুমি আর গিরীন এখন একই। কোনও তফাত নেই। কিন্তু ফাস্ট ব্রেকটা গিরীনকে দিয়েই সহজ হবে। তারপর

-তারপর?

অমলা তাকাল। দু চোখ তার রক্তবর্ণ। দেখল, আশায় ও উল্লাসে ভয়ংকর দেখাচ্ছে শুভেন্দুকে।

অমলা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শুভেন্দুকে।

অস্ফুট গলায় শুধু বলল শুভেন্দু, শি ইজ লাইক ফায়ার। ফায়ার! কবে অমলা?

কাম এ্যান্ড ওয়েট।

অমলার গলাও ফিসফিস করছে। বোধ হয় কথা বলতে পারছে না। স্বর নেই গলায়। আবার মাথা এলিয়ে, চোখ বুজে চুপ করে রইল।

বোধ হয়, দুজনেরই মনে পড়ছিল, প্রথম অমলাকে যেদিন নাইট ক্লাবে দেখেছিল শুভেন্দু, সেদিনও সুধার কানের কাছে এমনি করেই কথা বলেছিল সে। সেদিনের তফাত ছিল শুধু সুজাতা আর অমলার তফাত যতখানি।

.

কলেজে যাওয়া হল না সুমিতার। মহীতোষ বেরিয়ে গেছেন একটু সকাল সকাল। বছর শুরুর বেলায় কাজ কিছু বেড়েছে ওঁর।

সুমিতা চান করে খেতে বসেও দেখল, বড়দি বেরোয়নি তখনও ঘর থেকে। সকাল থেকেই বেরোয়নি। কাল রাত্রে খায়ওনি।

বিলাস বলল, বড়দিদিমণি অঘঘারে ঘুমুচ্ছেন।

অঘোরে ঘুমুচ্ছে। সকাল থেকে এত বেলা অবধি! খেতে বসে স্বস্তি পেল না সুমিতা। অনেক সময় অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোয় বড়দি। কিন্তু এত বেলা তো কোনওদিন হয় না। খাওয়া রেখে, বড়দির ঘরে গেল ও। মিথ্যে নয়। সুজাতা তখনও শুয়ে রয়েছে। চোখ বোজা, কিন্তু অঘোরে ঘুমন্ত বলে মনে হল না।

কাছে গিয়ে ডাকল সুমিতা, বড়দি।

এক ডাকেই, ফিরে তাকাল সুজাতা। তাকানো মাত্রই ভয়ে চমকে উঠল সুমিতা। যেন চোখ বুজে ছিল বলেই, চোখের কালিমা এমন গাঢ় হয়ে দেখা দেয়নি। চোখের চাউনি এমন তীব্র মনে হয়নি। সারা মুখে এমন রুণ ক্লিন্নতার ছাপ দেখা যায়নি। চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে সারা বালিশে। রক্তাভ কম্বল জড়ানো গায়ে। সুমিতা উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কী হয়েছে বড়দি?

সুজাতা শান্তস্বরে বলল, কিছু হয়নি তো?

তুমি বেরুবে না আজ?

না।

উঠবে না? অনেক বেলা হয়েছে। বাবা বেরিয়ে গেছেন।

কথায় কথায় সুমিতার খুঁটে খুঁটে দেখাটা বড় অপ্রস্তুত করছিল সুজাতাকে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, উঠব। শরীরটা বড় ভার ভার লাগছে।

সুমিতা উপুড় হয়ে বড়দির কপালে হাত দিল। না, জ্বর নয়। কিন্তু কী যেন হয়েছে। বড়দির চোখ মুখের ভাব দেখে কেমন যেন ভয় করতে লাগল সুমিতার। জ্বর নয়, কিছু নয়, শুধু ভার। কিন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস করাও চলে না। কেনো, আর কিছুর সঙ্গে বড়দির বাইরের জীবনটা শুধু ভয়ের। শুধু ভয় নয়, আরও কিছু।

সুজাতার কপাল থেকে হাত না সরিয়ে, নির্বাক সুমিতা তাকিয়ে রইল শুধু। তারপর বলল, তুমি কিছু খাওনি তো সকাল থেকে। কাল রাত্রেও খাওনি।

সুজাতা উঠে বসল। বলল, এবার স্নান করে খাব। আমি যাচ্ছি, তুই যা।

সুমিতা চলে যাচ্ছিল। সহসা ডাক শুনতে পেল, রুমনি!

ফিরে বলল, কিছু বলছ বড়দি?

সুজাতা মুখ নামিয়েই রেখেছিল। মুখ তুলতে গিয়ে হঠাৎ ওর গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠল। ধকধক করতে লাগল বুকের মধ্যে। এ কী কথা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল সুজাতা। রবি আসবে কি না! কখন আসবে। ছি! তা কেমন করে হয়। তাড়াতাড়ি সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলল, না থাক, আমি উঠছি।

বুকের মধ্যে কেমন একটা অসহজ আড়ষ্টতা নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল সুমিতাএই অসহজ আড়ষ্টতাই আজ জীবনের পায়ে পায়ে। চারদিকে ঘেরাটোপ। নিজেকে নিয়েই দুর্বোধ্য সংশয়। নিজেকে নিয়েই ওর গভীর সন্দেহ, সহস্র প্রশ্ন প্রতি পদে পদে আটকাচ্ছে। নিজেকেই এত নিরর্থক বোধ হচ্ছে, আর সবকিছুই একটা মহাশূন্যের মতো ঠেকছে। মনে করেছিল, বেরিয়ে পড়বে। পারল না। কোনও কারণ নেই। কলেজের টানটাও যেন কেমন নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে।

এক সময়ে সুজাতাই এসে ডাকল ওকে। তুইও খাসনি এখনও? চল খাবি। কলেজে গেলি নে?

ভাল লাগল না।

সুজাতা তাকাল এক বার। খাওয়ার পরে আবার ঘরে ঢুকল সুজাতা।

বাগানের রোদে পিঠ দিয়ে পড়ে রইল সুমিতা সারাটি দুপুর।

বেলা তিনটে নাগাদ ধড়ফড়িয়ে উঠল সুমিতা। বেরুবার জন্যে ছটফট করে উঠল মনটা। বিকেল আসছে, সেই যেন ভয়। বিকেলকে ওর ভয় হল কবে থেকে। এমন সময় দেখা দিল রবি। সুমিতা ছুটে গিয়ে বারান্দায় হাত ধরে বলল, উঃ আপনাকেই মনে মনে চাইছিলুম রবিদা। এত চাইছিলুম, একটু আগেও তা জানতুম না।

রবিও যেন আগের তুলনায় অনেকখানি প্রাণহীন। সেই বুদ্ধিদীপ্ত বিষণ্ণ চোখ দুটি এখন যেন নিয়তই ছায়াঘেরা। বলল, তা যেন চাইছিলে। তোমার চোখ মুখ এত লাল দেখাচ্ছে কেন?

তাই তো! শুকনো ঘাম শাড়িতে, চুলে। এলোমেলো বেশ, খালি পা, মাটি আর পাতা খুঁটে খুঁটে হাত ময়লা। রোদ ওকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে লাল করেছে। বলল, রোদে ছিলুম। সত্যি, আপনাকে মনে মনে যে কত ডাকছিলুম রবিদা, নিজেই বোধ হয় জানতুম না। আপনি কী করে এলেন এত সকালে?

রবি বলল, সে কী, ভুলে গেলে, তুমি আজ বেলা বারোটায় ক্লাস শেষ করে আমাকে ডেকে নিয়ে আসবে, তারপরে কোথায় কোথায় যাবে।

সুমিতা বলল, খুব ভাল হয়েছে, আমি বেরুইনি। বড়দি আজ সারা দিন বাড়িতে রয়েছে। শরীরটা খুব খারাপ, বেরোয়নি। আমিও বেরুইনি।

রবির মুখ হঠাৎ আরক্ত হল। বলল, ও!

সুমিতা সহসা রবির কাছে ঘেঁষে, মুখ তুলে বলল, রবিদা, একটু যাবেন?

আবার! আবার সেই বুকের পাথরটায় আরও জোরে আঘাত করে সুমিতা। ফ্যাকাশে মুখে, হাত টেনে বলল চমকে, কোথায়?

বড়দিকে দেখতে?

বুকের মধ্যে ধকধকিয়ে উঠল রবির। পুড়ে যাওয়া মুখখানিতেও বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে বলল, সব জেনে তুমি কেন এমনি করে বলল রুমনো?

সুমিতা বলল, কিছু জেনে বলিনি রবিদা। আপনাকে না বলে পারলুম না কিছুতেই। কেন জানিনে, বড়দিকে দেখে বড় কষ্ট হচ্ছিল।

রবি সহসা কোনও জবাব দিতে পারল না। সুমিতা হাত ধরে টানল, আসুন।

ঠিক সেই সময়েই, মরিস মাইনরটা এসে দাঁড়াল গেটের কাছে। কালো গগলস চোখে নিয়ে নামল অমলা। রাঙানো ঠোঁটের ফাঁকে ঝিকমিকিয়ে উঠল সাদা দাঁতের সারি।

রবি আর সুমিতা, দুজনেই চোখাচোখি করে থমকে দাঁড়াল। অমলা বারান্দায় উঠে এসে হাসল রবির দিকে চেয়ে। বলল, ভাল আছেন?

রবি হাসবার চেষ্টা করে হাত জোড় করে বলল, হ্যাঁ, আপনি? ঘা

ড় হেলিয়ে বলল অমলা, ভাল।

তার আগেই, আড় চোখে দেখে নিয়েছে সে, রবির প্রায় বুকের কাছে দাঁড়িয়ে শক্ত মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সুমিতা। চকিতে কী একটু ভেবে নিল অমলা। হেসে জিজ্ঞেস করল, তোমার বড়দির ব্যাপার কী? বেরোয়নি আজ, না?

সুমিতা বলল, না। শরীরটা ভাল নয়।

ঠোঁট কামড়ে ধরে হঠাৎ একটু বিচিত্রভাবে হেসে উঠল অমলা। রবির দিকে তাকিয়ে বলল, কাকাবাবু (মহীতোষ) থাকলে সুসংবাদটা দিয়েই যেতুম। গিরীনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত মিটমাট হয়েই গেল বোধ হয়। কাল তো সারা দিন সুজাতার দেখাই পাইনি। ক্লাবে গিয়ে শুনলুম, গিরীনের সঙ্গেই সারা সন্ধ্যা আর অনেক রাত্রি অবধি কাটিয়েছে। আই মাস্ট কংগ্রেচুলেট হার।

এমন আনন্দের সংবাদেও সুমিতার মনে হল ওর বুকের ভিতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কী একটি নিশ্চিত ইঙ্গিত ছিল অমলার কথার মধ্যে। বার বার বড়দির কালিমাচ্ছন্ন চোখ দুটির কথা মনে পড়ল সুমিতার।

অমলা আবার বলল সুমিতাকে, সুজাতাকে একটু ডেকে দাও না ভাই তুমি। মুহূর্তে যেন আরও শক্ত হয়ে উঠল সুমিতা। বলল, আপনি যান, বড়দি ওর ঘরেই আছে।

আচ্ছা।

শরীরের একটি বিচিত্র দোলন দিয়ে, বাইরের ঘরে ঢুকে, ভিতরের দালান দিয়ে সুজাতার ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঠোঁটের কোণ দুটি অমলার কুঁকড়ে উঠছে তখন।

সুমিতা এক মুহূর্ত নির্বাক থেকে বলল, চলুন রবিদা, একটু বেরুই।

দুটিই লজ্জার। এখন যেন থাকাও লজ্জার, বেরিয়ে যাওয়াও লজ্জার। একটা ভয়ংকর অপমানা ও বেদনা, তাকে স্থাণুর মতো নিশ্চল করে দিল কয়েক মুহূর্ত। এক নিমেষের জন্য সুমিতার ওপরেও বিরূপ হয়ে উঠল মনটা। রবি সৎ, বলিষ্ঠ তার জীবনাদর্শ, সবই ঠিক ছিল। মন তার এত হীন কি না কে জানে যে, সে খুশি হয়েছিল সুজাতার দাম্পত্য বিচ্ছেদে। কিন্তু নিজের মনকে মানুষ ফাঁকি দেবে কত। মনের সেই গহনদেশে, যে আজ সুমিতার হাত টানে কেমন একটু সুর-বিলোলিত হয়ে পা বাড়িয়েছিল, সেও যেন আজ নির্লজ্জ দুরমুশে গেছে ঘেঁচে, সুজাতার সুসংবাদে। নিজেরই কাছে, লজ্জায় বার বার মরে যেতে লাগল রবি।

সুমিতা এর আংশিক অনুমানে নিজেও পুড়ছিল মনে মনে। তাই পালাতে চায় রবিদাকে নিয়ে। ওর অপরাধের যে সীমা নেই। বলল, চলুন, যাই।

রবি শান্তভাবে বলল, থাক না রুমনো। এসো বসি।

না না, চলুন বেরুই।

তবে তুমি থাকো, আমি বরং যাই।

না, আমিও যাব।

বলতে বলতে কণ্ঠরুদ্ধ হল সুমিতার। বলল, চলুন, পায়ে পড়ি রবিদা, চলুন বেরিয়ে যাই।

একটি কঠিন বস্তু রবির বুকেও ঠেকেছিল। লজ্জা ও অপমানকে যেন স্বীকৃতি দিয়েই সুমিতার সঙ্গে বেরুতে হল তাকে।

.

অমলার ঘরে ঢোকা টেরও পেল না সুজাতা। দাঁড়িয়ে ছিল নিশ্চল হয়ে বাগানের জানালার কাছে। ডাক শুনে ফিরে তাকিয়েই চোখ দুটি জ্বলে উঠল এক বার। পরেই ছায়া ঘনিয়ে এল আবার। মার খেয়েও মার ফিরিয়ে দিতে তো পারবে না সুজাতা। কী লাভ আজ আর অমলাকে ঝাঁঝ দেখিয়ে। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, কী খবর অমলা?

অমলা সপ্রতিভভাবে হেসে বলল, কী আবার। সারাদিন ফোন করে করে আমার কান ঝালাপালা করে ফেলল শুভেন। তুই অফিসে যাসনি কেন?

সুজাতা বলল, কাল থেকে আবার যাব। বোস, চা খাবি?

আশ্চর্য! সুজাতাকে নিয়ে খেলা করবার বাসনা অমলার। তবু কালকের কথা জিজ্ঞেস করতে পারছে না। বলল, খাব।

একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, রবি এসেছে, দেখলুম।

সুজাতা ফিরে তাকাল। শান্ত স্বরেই বলল, এসেছে নাকি?

বলেও খানিকক্ষণ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে সুজাতার। আবার বলল, চল, বাইরের ঘরে গিয়ে বসি।

বাইরের ঘরে এল দুজনে। সুজাতা নত-চোখ। কিছুতেই সামনে তাকাতে পারছে না। যেন কার সঙ্গে চোখখাচোখি হওয়ার ভয়।

বারান্দার সামনে ছায়া দেখে চোখ তুলতেই দেখল বিলাস। কেমন যেন চমকে উঠে, বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, রুমনো কোথায়?

–ছোটদিদিমনি রবিদাদাবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেছেন।

ও!

অমলা দেখল, সুজাতার মুখখানি হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল। সময়ের মুখ চেয়ে সেদিন বিদায় নিল সে চা খেয়ে। সন্ধ্যা ঘনাঘন আশীষ এসে দেখল সারা বাড়িটা একেবারে নিঝুম।

কোনও কথাই জমল না আজ দুজনের। অধিকাংশ সময়েই নীরব রইল রবি। কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিল না যেন। সুমিতাও তাই।

শীতে কোঁকড়ানো, বিষণ্ণ আলো, নিঃশব্দ ফোর্ট এলাকা ছেড়ে দুজনেই আবার জনমুখর পথে এসে পড়ল।

সুমিতা বলল, অরুণাদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন না রবিদা?

অরুণা রবির সহপাঠিনী ছিল এককালে কলেজে। এখন চব্বিশ পরগনার মফস্বলের বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী। শোনা যায়, কোন এক কালে সে ভালবাসত রবিকে। রবি বলেছে সুমিতাকে, সে সব কিছু নয়। খুব ভাল মেয়ে যদি চায় সুমিতা আলাপ করতে, পরিচয় করিয়ে দেবে। রবি বলল, দেব, এখন দেরি হয়ে গেছে। তা ছাড়া, অরুণার চাকরিটাও গেছে শুনেছি।

-কেন?

–পলিটিকসের জন্যেই।

–ও।

আবার চুপচাপ। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মনুমেন্টের কাছে এসে ডাকল রবি, রুমনো।

বলুন।

স্বর শুনে চমকে, হাত ধরে কাছে টানল সুমিতাকে রবি। দেখল, দু চোখ ভেসে গেছে সুমিতার। রবি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ছি রুমনো, তুমি কাঁদলে যে আমার লজ্জা বাড়ে।

সুমিতা ফিসফিস করে বলল, আমি মূর্খ রবিদা, কিছু বুঝিনে, কিছু না।

রবির সমস্ত অপমানের জ্বালাটা বিষাদ-ভার হয়ে উঠেছে। তাই সে স্বাভাবিকভাবেই বলল, তুমি যা বুঝেছ রুমনো, ঠিক বুঝেছ। সবকিছুকে সহজভাবে না। আমরা মানুষ, সুখ দুঃখ ভুল ত্রুটি, এ না হবে কেন। তাতে নিজেকে গাল দিলে, বাড়াবাড়ি করলে যন্ত্রণা বাড়েই।

ফিরে গেল দুজনে, যে যার পথে।

কিন্তু কোথায় সেই সহজ জীবন। বাবা যান কাজে। বড়দি আজকাল চলে আসে তাড়াতাড়ি বাড়িতে। কিন্তু চেহারাটা কী দ্রুত ভাঙছে ওর। রক্তশূন্য, রুগ্ন। প্রায়ই অফিস কামাই করে।

মাঘ শেষ না হতেই বাতাসে পাগল হয়ে গেল কলকাতা। পার্ক আর ফুটপাথ থেকে শুকনো পাতা ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল ট্রাম লাইনে আর পথে।

এখানে সেখানে হঠাৎ শিমুলের রক্তজটা, কৃষ্ণচূড়ার রক্তমুকুট, শহরটাকে করছে উল্লসিত।

.

বোম্বের একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকে সুগতার ফটো আর বক্তৃতা ছাপা হয়েছে। নীচে লেখা আছে, যৌবন কখনও মিথ্যা বলে না–আমরা সত্যকে কায়েম করতে চাই সারা বিশ্বে, বলেন বাংলার যুব-নেত্রী সুগতা। সুগতা হাসছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে কারলেকর।

সুগতা চিঠি দিয়েছে; মৃণাল আর ও ফিরে আসবে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই।

বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্দাম বাতাস যতই এসে ঝাঁপ দেয় এই কংক্রিটের রাজ্যে, থুবড়ে পড়ে অ্যাসফল্টের কঠিন বুকে, ততই যেন সুমিতার জীবনের ঘেরাটোপটা আসে কুঁকড়ে, জড়িয়ে, ছোট হয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে।

আশীষ আসে, সুমিতা মুখ খুলতে পারে না। জবাব দিতে পারে না আশীষের সেই একই কথার। সেই একঘেয়ে কথার ঘ্যানঘ্যানানি, রুণ পরিবেশ থেকে আজকাল পালাতে মন চায় সুমিতার। তার জন্যেও ধিক্কার হানে ও নিজেকে। একা, কী ভয়ংকর একা আশীষ।

কিন্তু কোথায় সেই সহজ জীবন। তারপর এক একসময় ভয়ে চমকে তাকিয়ে দেখে মনের দিকে, আশীষ নেই সেখানে। কে ওকে এমন করে এলোমেলো করছে। কে ওকে নিয়ত ডাক দিয়ে ফিরছে খোলা আকাশের তলায়। না, ছি, কেমন করে যাবে ও সেখানে। দু হাত দিয়ে ঠেলে ও বন্ধ করে রাখে ভিতরের দরজা। সেটা খোলা পেলেই বাইরের দরজাটাও মড়মড় করে ওঠে।

এই কি জীবন। নিজের সঙ্গে এ কী ভয়াবহ মারামারি সুমিতার। শেষটায় যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন ভগবানকে ডাকে। উনিশ বছরের এই সর্বাঙ্গে আশীষের পুরুষ-দাগটা কিছুই নয়। কিছুই নয়। সেটা তবে কী। এই দেহের সত্য কি কিছুই না। এ ও কেমন মেয়ে। বলে, ভগবান, তুমি আশীষকে ওর ব্যর্থতা থেকে, মিথ্যে থেকে মুক্তি দাও, নইলে ওর মৃত্যু শুধু আমাকেই নিমিত্ত করবে। তারপরে সুমিতা আবার স্তব্ধ হয়। আশীষ আসে। বলে, জনমতটা একটা রাক্ষস। মস্তিষ্ক নেই, আছে একটা ভয়ংকর ক্ষুধা। কী কুৎসিত! জান রুমনি (আজকাল রুমনি বলে) এ দেশে জনমত মানে একটা ক্রুড, ভালগার উল্লাস। এরা ভাল জিনিস নেয় না কখনও, মাতালদের মতো পচা চাট এদের উপাদেয়।

এখানে কিছুই ভাল নেই। সুতরাং এখানকার কোনওকিছু দিয়েই কিছু হয় না।

পালাবার জন্যে ছটফট করেও সুমিতা বসে থাকে শক্ত হয়ে।

থেকে থেকে কেমন যেন গভীর সুরে বলে আশীষ, আমি মনে-প্রাণে কোনওকিছুতেই এ দেশের কেউ নই।

–কেন আশীষ, কেন বলছ তুমি এ কথা।

কী ভয় সুমিতার। মনে হয়, চেঁচিয়ে উঠবে বুঝি।

আশীষ–এ দেশে আর আমার মধ্যে কোথাও আমি ভালবাসা খুঁজে পাইনে।

–কেন?

কেন। আশীষ নীরব। সুদূর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সুমিতা দু চোখ ভরে ভয় নিয়ে দেখে, শুধু

সুমিতা ওর নিজের মনটাকেই ভগবান ভেবে বলে, ওকে শান্ত করো, ধৈর্য দাও, শক্তি দাও।

কিন্তু বিষণ্ণ নিঝুম সন্ধ্যায় আবার আশীষ আবেগ-ফিসফিস গলায় বলে, রুমনো টাকা জমিয়ে আমরা বিলেত যাব। তুমি আর আমি। সেখানকার অধিবাসী হয়ে, চাকরিবাকরি করে থাকব।

সুমিতা চাপা বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করে, বিলেতে?

–হ্যাঁ, লন্ডনে। কী দরকার আমার এ দেশকে।

কেন শব্দটা একটা ভয়ংকর চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চায়। পারে না। শুধু হাঁসের গায়ে জলের ছিটার মতো ওর দেহের পালকে পালকে আশীষ খেলা করতে থাকে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুমিতা ওর ভিতর দরজার ডাকটা সামলাতে পারলে না। সে বাইরের দরজাটাকে ভেঙে দিয়ে নিয়ে গেল ভাসিয়ে। ঘোর সন্ধ্যায় নিজেকে ও দেখল হাওড়া স্টেশনের কাছে। বাস ধরে এসে নামল হাওড়ার একটি ঘিঞ্জি রাস্তার লোকারণ্যের ভিড়ে। ঠিকানাটা কবে থেকে লটকানো ছিল ওর ভিতর-দরজায়। লেখা ছিল নানান জনের কাছে শুনে শুনে পথের নির্দেশ।

একটি সরু গলিতে ঢুকে, ভিড় ঠেলে অগ্রসর হতে লাগল! স্বল্পবাতি আলো-আঁধারি পথ। মানুষগুলিকে কীরকম ভাঙাচোরা, কুৎসিত দেখাচ্ছে। পচা তেল পোড়র দুর্গন্ধ, তার সঙ্গে চকিতে চকিতে ফুলের গন্ধ। কে একটা লোক গায়ে পড়তে পড়তে পাশ কাটিয়ে গেল। মোটা গলায় কে একটা অশ্লীল গান গাইছে। তারপরেই সরু কাঁসরভাঙা গলায় হেসে উঠল একদল মেয়ে।

চমকে পাশ ফিরে দেখল সুমিতা, একটা মেয়েকে একটি ভয়ংকর দর্শন লোক বুকের মধ্যে ফেলে ঝুলিয়ে নিয়ে চলেছে। মেয়েটা হাসতে হাসতে গালাগাল দিচ্ছে অশ্রাব্য ভাষায়।

একটা লোক শিস দিয়ে উঠল সুমিতার দিকে তাকিয়ে। একটি এক চিলতে জামা গায়ে দেওয়া মেয়ে সুমিতাকে ডেকে বলল, কে গো?

কোথায় এসে পড়ল সুমিতা। এই কি সেই পথ। এই পথে কি সেখানে যাওয়া যায়। মনে হল, চারদিক থেকে ওকে কারা যেন ঘিরে আসছে। ও যতই আশেপাশে চাইছে, ঘামছে দরদর করে, ততই পথটা সুদূর অন্ধকার হচ্ছে। ততই একটা নিদারুণ ভয় ওর পায়ের তলার মাটি নিচ্ছে সরিয়ে

বেলফুল, চা, তেলেভাজা আর কেরোসিন আলোর দলাদলা কালি। আর মদমত্ত ধ্বনি।

জীবনে এ পথ কোনওদিন দেখেনি সুমিতা, এ মানুষদের এ পরিবেশের একটি আবছা কল্পনা ছাড়া আর কিছু নেই।

ভয়ে ও আরও তারাতাড় চলতে লাগল। ততক্ষণে কান্নায় ওর বুক ভরাট হয়ে উঠেছে। এ কী করল ও। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই যে দেখা যায় না। একটা লোক পাশ থেকেই হেসে উঠল খ্যাল খ্যাল করে। দৌডুতে উদ্যত হল সুমিতা।

সামনে কালাপাহাড়ের মত বিরাট গোফওয়ালা একটি কালো মুর্তি দাঁড়াল। আশ্চর্য শান্ত ও নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনি কাঁহা যাইবেন বেটি?

সুমিতা নিজেকেই যেন আঁকড়ে ধরল আঁচল জড়িয়ে। নামটা বলে ফেলল।

লোকটা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, তোব তোবা। ভুল পথে আসিয়েছেন বেটি মা। আমার সাথ, চলে আসুন। ই রাস্তা খারাব, আপনার যানা আনা চলে না। আসুন।

ভয়ংকর-দর্শন হলেও লোকটির গলায় কোথায় একটি পরম আশ্বাসের সুর ছিল। ঘেমে দুর্বল হয়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো কয়েকটি অলিগলি পার হয়ে হঠাৎ একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল লোকটি। দরজা খোলা, সামনের বারান্দায় মাদুর পেতে একটি লোক আর দুটি লোককে কী যেন বলছে।

সেই একটি লোককে দেখিয়ে সুমিতার বিভীষণ-দর্শন সঙ্গী বলল, উনকে আপনি চান তো বেটিয়া।

দেখতে দেখতে সুমিতার দু চোখ জলে ঝাপসা হয়ে গেল। দেখল, সেই লোকই, সেই কপালে ও চোখে বিস্ময় বিদ্যুৎ চমক।

লোকটি ওর কান্না দেখে, সস্নেহ গলায় বলল, হ্যাঁ, রোবেন না, আপনার তখলিফ হয়েছে বেটিয়া। উন আদমি আমাদের রাজিন্দর বাই আছেন।

.

৩০.

পথপ্রদর্শক কালপাহাড়তুল্য লোকটিই বাড়ির ভিতরে ঢুকে ডেকে নিয়ে এল রাজেনকে। অনেক দূর এসেছে সুমিতা। না ডেকে নিলে এ বাড়ির চৌকাট ডিঙিয়ে ঢুকবে কেমন করে। জলভরা ঝাপসা চোখে ও দেখল রাজেন এগিয়ে আসছে। সুমিতার লজ্জা বাড়তে লাগল। লজ্জা আর কান্না, দুইই ওকে তুলল অবশ করে। কে বলবে, ও কী বলবে। কী জবাব দেবে এই বিস্ময়কর নির্লজ্জতার।

গম্ভীর সপ্রশ্ন গলায় শোনা গেল, কে ইনি ইয়াকুব?

জায়গাটা অন্ধকার। রাজেন চিনতে পারল না। কী বলবে সুমিতা। কে ও! নাম বলে পরিচয় দিতে হবে নাকি?

সেই বিভীষণ দর্শন ইয়াকুব জবাব দিল, হাম তো পয়চানা নহি। ই তল্লাটে কভি দেখে নাই। দেখলাম, ভামী গোয়ালনীর গল্লি ভিতরে আসছেন। খারাব গল্লি, চেহারা দেখে মালুম করলাম, ই দুসরা দুনিয়ার মানুষ। তাই আমি বললাম–

কথা শেষ হওয়ার আগেই দুপা এগিয়ে এসে রাজেন বিস্ময় চকিত হয়ে বলে উঠল, সুমিতা নাকি?

অন্ধকারেও মুখ নামিয়ে রেখেছে সুমিতা। বলল, হ্যাঁ।

এক মুহূর্ত রাজেনও বিমূঢ় হয়ে রইল। শুধু বলল, আশ্চর্য!

কিন্তু কিছু ভাববার অবকাশ ছিল না। পরমুহূর্তেই ব্যস্ত হয়ে বলল, এসো ভেতরে এসো। কী আশ্চর্য!

শুধু আশ্চর্য! পরমাশ্চর্য।। রাজেনের পিছনে পিছনে ঢুকল সুমিতা। ইয়াকুব বিদায় নিল। আর যে দুটি লোক বসেছিল মাদুরের ওপর, তারা উঠে দাঁড়াল। তেল কালি মাখা জামা আর প্যান্টে, এবড়োখেবড়ো মুখে আর উদ্দীপ্ত নির্বোধ চাহনিতে অর্ধেক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল লোক দুটিকে।

একজন বলল, আমরা তা হলে আজ চলে যাই রাজেনদাদা।

চলে যাবে? একটু অনিচ্ছার সুর বেজে উঠল রাজেনের গলায়। বলল, আচ্ছা, তাই যাও। কাল আমি স্কুলে দেখা করব।

চলে গেল লোক দুটি। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখে গেল সুমিতাকে। গালে কপালে ছড়ানো চুল সুমিতার। যেন অনেক দূরের যাত্রা শেষ করে, রাত জেগে এসে পৌঁছেছে। কোনও সাজ নেই ওর অঙ্গে। তবু যেন কী এক সাজ রয়েছে সর্বাঙ্গে। পথের দুঃখ মনের লজ্জায়, বাতাসের দাপটে, ধুলোর প্রলেপে, এই অসাজের ভূষণ ওকে যোগিনীর বেশ দিয়েছে। আসবে বলে তো আসেনি সুমিতা। তৈরি হওয়ার সুযোগ কোথায় ছিল। দেহে মনে, কোথাও ওর অবকাশ মেলেনি সাজবার। ও যে বিরাগিণী হয়ে এসেছিল। সব ছেড়ে সব রেখে, লুটিয়ে পড়েছে এসে ভিতর দুয়ারের নির্দেশে। চোখের কোলে এখনও জলের দাগ। এখনও শঙ্কা, এখনও প্রাণ দুরুদুরু। তবু কী লজ্জা! কী লজ্জা!

রাজেন বিস্মিত হেসে বলল, কী ব্যাপার। কোনও খবরই নেই, আসনি কোনওদিন, কী বলে পা দিলে এ পথে।

কী বলে সুমিতা পা দিয়েছে এ পথে! কোনও আয়োজনই তো ছিল না। অনেক আয়োজন করে আসারই পথ যেন এটা। হঠাৎ আবার ঝাপসা হয়ে উঠল সুমিতার চোখ। নতমুখেই রুদ্ধগলায় বলল, কী ভয়ংকর পথ।

কান্না দেখে এক নিমেষ বিমূঢ় নির্বাক হয়ে রইল রাজেন। চোখে তার বিস্মিত অনুসন্ধিৎসার আলোছায়া। বলল, জানা থাকলে পথের আগে বেড়ে নিয়ে আসতুম তোমাকে। কিছুই যে জানিনে। তুমিও জান না, আরও পথ ছিল। ইয়াকুব না থাকলে আরও ঘুরতে হত।

সান্ত্বনা আছে, শঙ্কা নেই রাজেনের গলায়। একটু হেসে বলল, যাক, ওতে আর মন খারাপ করে লাভ নেই। এসে তো পড়েছ। বোসো।

সুমিতা বারান্দায় উঠে বসল মাদুরে। চোখ মুছল আঁচল দিয়ে।

রাজেন বলল, কিন্তু কী ব্যাপার বলো তো?

সুমিতার বুকের মধ্যে ধুকধুক করে উঠল। সত্যিই তো। কী ব্যাপার। কী বলবে। কেন জানি ওর কেবলি সেই ঝড়ের দিনটির কথা মনে পড়ছে। সেই বাতাসের হুংকার, হুড়মুড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়া তাণ্ডব। তারপর ঝড় থামা নিঃশব্দ শান্ত সন্ধ্যাটা অনেকগুলি পায়ের শব্দে হকচকিয়ে উঠেছিল। বাইরের ঝড় থেমেছিল, কিন্তু সেইক্ষণেই ঝড় উঠেছিল সুমিতার বুকে। সেই মুহূর্তে। বুকের সেই ঝড় নিয়ে কত দিগন্ত পার হয়ে এসেছে। পার হয়ে আজ এসে পৌঁছেছে এখানে। জীবনের কোনওখানেই কোনও যুক্তি নেই সুমিতার। কী ব্যাপার, কী বলবে ও। এই তো সেই রাজেন, আজও যার প্রশস্ত কপালে এলানো চুল সাপের ফণার মতো। সেই পাঞ্জাবি গায়ে, ভোলা বোতাম। নিয়ত বিস্মিত দৃষ্টি চোখে।

মুখ নামিয়ে রেখেই বলল সুমিতা, কীসের ব্যাপার?

রাজেন বলল, হঠাৎ এলে যে?

চোখ তুলতে গিয়েও পারল না সুমিতা। বলল, আসতে নেই?

রাজেনের চোখে মুখে দুর-দর্শনের হিলি-বিলি। বলল, মন চাইলে নিশ্চয় আছে। কিন্তু ঠিক করে বলো তো। তোমাদের বাড়ির খবর সব ভাল।

-হ্যাঁ।

–তোমার বাবা, দিদিমা–

ভাল। মেজদিরা ফেরেনি এখনও। ফিরবে শিগগিরই।

–ও! তুমি ভাল তো?

সুমিতা আরক্ত হয়ে উঠল। চোখ তুলতে গিয়ে দৃষ্টি বিনিময় হল রাজেনের সঙ্গে। হেসে নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।

তারপর এদিকে ওদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, আর কেউ নেই এ বাড়িতে?

জিজ্ঞাসা মিটল না রাজেনের। বলল, হ্যাঁ আছে, অনেকে আছে, দেখতে পাচ্ছ না।

সুমিতা অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। কোথায় অনেক লোক। বাড়িটার শেষ কোথায়, তাই খুঁজে পেল না। উঠোনটাও হারিয়ে গেছে কোথায়। এখানে সেখানে আগাছার ভিড়। এদিকে ওদিকে বুড়ো আম-জাম নারকেল গাছ দুলছে বাতাসে। ভাঙা জীর্ণ খসা ক্ষওয়া দোতলা বাড়ি। সেকেলে খিলান, খসা পলস্তারা, নোনাধরা সহস্র সহস্র ইট যেন নোংরা দাঁত-বিকশিত নিঃশব্দ হাসির মতো। খাঁ খাঁ নিরালা পোড়োবাড়ি যেন।

কেমন একটু উৎকণ্ঠিত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল সুমিতা, এটা কি আপনাদের বাড়ি?

হ্যাঁ। কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?

রাজেনের দিকে তাকিয়ে, আবার বাড়িটার দিকে ফিরে বলল সুমিতা, বিশ্বাস হবে না কেন? কিন্তু লোকজন কোথায়?

–সবাই অন্যদিকে থাকে। যেদিকটা এখনও বাসোপযুক্ত আছে। এদিকটার এক এক জায়গা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। খুব বড়লোকের বাড়ি ছিল তো।

তাই নাকি?

সুমিতা রাজেনের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা খুব বড়লোক ছিলেন বুঝি?

রাজেন ঠোঁট কুঁচকে হেসে বলল, হ্যাঁ খুব বড়লোক। দেখে বুঝতে পারছ না। তবে এখন এটা দু-তিন পুরুষ ধরে চটকলের মিস্তিরি আর কেরানিবাবুদের বাড়ি হয়েছে। এক এক ঘরে, এক এক পরিবারের বাস। পায়রার খোপ বলতে পার।

–তারা কারা?

–সেই বড়লোকদের বংশধরেরা। এই আমার মতো আর কী! আমারই কাকা জ্যেঠা ভাইবোনেরা আছে।

সুমিতা বলল, আর আপনার মা। তিনি কোথায়? ৪০৪

–মাও অন্যদিকে।

সুমিতা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ওঁকে আমি একটু দেখব।

ঠিক এমনি করেই যেন এক দিন সুগতাও উৎসুক হয়ে উঠেছিল। কৌতূহলের বান ডেকেছিল চোখে। কত না বিস্ময়। কী বিচিত্র পরিবেশ। সব দেখবে খুঁটে খুঁটে। মাকেও দেখবে। তবে সুগতা এমন আচমকা এক বিস্ময়কর পথ ধরে আসেনি সুমিতার মতো। এমন না বলে কয়ে, এলোমেলো হয়ে।

হেসে বলল রাজেন, বেশ তো দেখবে। দেখার কিছু নেই, আমার মা আমারই মতো।

–আপনার মতো?

রাজেন বলল, মানে, আমারই মায়ের মতো।

সুমিতা হেসে ফেলল। হেসে, মুখে আঁচল চেপে বলল, গোঁয়ার?

রাজেনও হেসে বলল, তা বলতে পার। কোনও অংশে কম নয়। মাঝে মাঝে আমাকে এমন বয়কট করে দেবে, কিছুতেই আর কথা বলানো যাবে না। আমি তো একেবারে ছটফটিয়ে মরি।

সুমিতা হাসতে গিয়েও অবাক হয়ে তাকাল রাজেনের মুখের দিকে। ভাবতেও পারে না, মা দুদিন কথা না বললে এ মানুষ আবার ছটফটিয়ে মরে। কিন্তু কোথায় একটি আশ্চর্য কোমলতা, শিশুর আভাস রয়েছে লেগে চোখেমুখে। বলল, তবে চলুন, আগে দেখেই আসি।

চলো। সে প্রায় আর এক পাড়ায়। কিন্তু রাজেন তাকিয়ে দেখল সুমিতার আপাদমস্তক। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে সুমিতা নিজেকে দেখে, আঁচল টেনে বলল উৎকণ্ঠিত হয়ে, কী হয়েছে?

রাজেন বলল, তুমি তো আমার কথার জবাব দিলে না সুমিতা।

আবার দুরু দুরু বুকের মধ্যে। আবার আরক্ত হল মুখ। একটা বিচিত্র অভিমান বিষণ্ণতাও ফুটে উঠল। বলল, জবাব আবার কীসের। অপরাধ তো করিনি কিছু?

রাজেন কোনও কথা না বলে, হ্যারিকেনটি হাতে নিয়ে বলল, চলো।

সহসা মুষড়ে পড়ল সুমিতার মন! রাজেনকে যেন গম্ভীর মনে হল। সমস্ত ভঙ্গিটার মধ্যে কেমন একটি নির্বাক কাঠিন্য উঠল ফুটে। কিন্তু কী কথার জবাব দেবে ও? কিছু বলতে হবে ভেবে তো সুমিতা আসেনি।

রাজেনের পিছনে পিছনে চলল ও নিঃশব্দে। বারান্দা দিয়ে খানিকটা গিয়ে বাঁদিকে একটি গলির মধ্যে ঢুকল। দুদিকেই ঘর। পুরনো রাবিশের গন্ধ, ঠাণ্ডা কিন্তু তবু যেন দম চেপে আসে। ঘরগুলির কোনওটির দরজা খোলা, বন্ধ কোনটি। কিন্তু তোক নেই একটিও। তারপরে একটি শিশুর কান্না শুনতে পেল। কোথায় কী নিয়ে মেয়ে-পুরুষ গলার তর্কাতর্কি, কে যেন কোনও শিশুকে ডাকছে, আর কোথায় বাজছে একটি বেলোফাটা হারমোনিয়াম। সেই সঙ্গে একটা সিনেমার গানের আপ্রাণ চেষ্টা।

কেমন যেন পৃথিবীর ছেড়ে আসা কোন এক সুদূর জগতে এসেছে সুমিতা। ভয়, বিস্ময়, কৌতূহল, সব মিলিয়ে একটা স্বপ্ন বলে বোধ হচ্ছিল। দুপাশেই স্বপ্নলোক ঘর, মানুষগুলি অস্পষ্ট ছায়া-ছায়া কিস্তৃত। বাড়ির মধ্যেই, তবু ফিরে চেয়েও দেখছে না, কে যায়, কারা যায়। এরাই কি রাজেনের সেই আত্মীয়স্বজনেরা।

প্রায় রাজেনের গা ঘেঁষে চলেছে সুমিতা। এক বার বলল রাজেন, হোঁচট খেও না যেন।

ঠিক তখুনি হোঁচট খেল সুমিতা। বাঁচিয়ে দিয়েছে স্লিপার জোড়া। আবার বলল রাজেন, ভয় করছে না তো?

অস্পষ্ট, প্রায় চাপা স্বরে বলল, কেন ভয় করবে?

কেন ভয় করবে। রাজেন মনে মনে হাসল। ভয় পেয়েছে সুমিতা। তাই জিজ্ঞেস করছে কেন ভয় করবে। আবার এল ঠিক তেমনি একটি বারান্দা। বাঁ পাশ ফিরে একটি কোণের ঘরের কাছে আসতেই, চাপা মিষ্টি একটি সরু গলার গান শুনতে পেল সুমিতা।

আমাকে না দিয়েছ ধনজন,
দিয়েছ তো প্রাণমন
বুক ভরে আছে আমার
সে নীল রতন ॥

সুমিতা অবাক হয়ে বলল, কে গান গাইছে?

হ্যারিকেনের আলোয় ভাল করে মুখ দেখা যায় না রাজেনের। বলল, দেখতে পাবে এখুনি। এসো, ভেতরে এসো।

ঘরের পাশে আর এক ঘর। সেখানে উনুন জ্বলছে গনগন করে। উনুনের পাশেই বসে কুটনো কুটছিলেন সুধা। রাজেনের মা। ইলেকট্রিক নেই, তার ওপরে ঘরের পাশেই গুমটি ঘরের মতো বদ্ধ কূপে উনুন জ্বলছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল সুমিতার। কিন্তু কৌতূহল আর বিস্ময় সে সব টিকতে দিল না। দেখল সেই মহিলাই গান করছেন।

রাজেন ডাকল, মা, এদিকে এসো।

সুধা বঁটি কাত করে বললেন, এত তাড়াতাড়ি এলি যে?

তারপর ঘরে এসে এক মুহূর্ত সুমিতাকে দেখেই, বিস্মিত-উল্লাসে বলে উঠলেন, ওমা, কী সুন্দর মেয়ে। কোত্থেকে নিয়ে এলি খোকা।

রাজেন বলল, নিয়ে আবার আসব কোত্থেকে? ও নিজেই এল। সুগতার ছোট বোন ও।

ততক্ষণে সুধা কাছে এসে পড়েছেন সুমিতার। সুমিতার বড় আশ্চর্য লাগছিল সুধাকে দেখে। হঠাৎ মনে হয়, বড়দির সমবয়সি যেন। দেহে একটু খাটো, দোহারা মানুষ। কিন্তু এখনও যেন নিটুট কুমারী মেয়েটি। থান পরেছেন। কাজের ফাঁকে, ঘোমটা গেছে খসে। কালো কুচকুচে চুলের মাঝখানে ধপধপে সাদা সিঁথি। ঠিক রাজেনেরই মুখের ভাব। কিন্তু রাজেনের চেয়েও যেন কাঁচা, কচি ঢলঢলে মুখখানি। সারা অঙ্গে যেন মাখা স্নিগ্ধ হাসি। তার পাশে রাজেন অনেক লম্বা, গুরু গম্ভীর পুরুষ।

কথা শুনে, কী বলবে ভেবে পেল না সুমিতা এক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ সুধার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

সুধা দুহাতে সুমিতার হাত চেপে ধরে বললেন, ছি, মা, ছি। বামুনের মেয়ে হয়ে অমন করে যেখানে সেখানে পায় হাত দিয়ো না। তাতে যে আমাদের অকল্যাণ হয়।

অকল্যাণের কথা শুনে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল সুমিতা। কিন্তু রাজেনও মনে মনে কম অবাক হল না। জাত বিচারে নয়, প্রণাম করাটা সুমিতার স্বভাববিরুদ্ধ ছিল একেবারে! বোধ হয় নীতিবিরুদ্ধও বটে। জীবনের পরিবেশ বলেও একটা জিনিস আছে। বাঙালিপনার এ কারুমিতিটুকু সুমিতা আয়ত্ত করল কেমন করে।

সুধার কথার জবাবে সুমিতা অস্পষ্ট ভীরু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কেন?

হেসে বললেন সুধা, কেন আবার কী? সংসারে ধর্মটাকে মানতে হয় যে। তার জন্যে তোমাকে অত মুখ চুন করতে হবে না। তোমার নাম কী মা?

-সুমিতা।

বাঃ, সুগতার বোন সুমিতা।

বলে রাজেনের দিকে ফিরে বললেন, কিন্তু দ্যাখ খোকা, সুগতার চেয়ে সুমিতা আরও সুন্দর।

সুমিতা একবারে লাল টুকটুকে হয়ে উঠল। কিন্তু এমন করে বলেন সুধা, কোনও গ্লানি নেই। কিছু মনে করাকরির তুচ্ছতা নেই। সবই ভাসিয়ে নিয়ে যান স্নিগ্ধ তরল স্রোতে।

রাজেন বলল, তা বলে ওর সামনে তুমি ওর দিদির নিন্দে কোরো না।

সুধা চোখ কপালে তুলে বললেন, ওমা! আমি কি ওর দিদির নিন্দে করলুম নাকি? ছি, ছি, তুই যেন কী? সুগতা তো সুন্দরই, সুমিতা যেন আরও সুন্দর। এতে আর নিলে কী করলুম। হ্যাঁ মা, নিন্দে করেছি।

আরও আড়ষ্ট হয়ে উঠল সুমিতা লজ্জায়। শুধু ঘাড় নাড়ল নিঃশব্দে।

সুধা ছুটে গেলেন রান্নাঘরে, বোসোমা, উনুন জ্বলে যাচ্ছে আমার। তরকারিটা চাপিয়ে দিয়ে আসি।

সুমিতা যেন কোথায় ভেসে গেছে। অবুঝ যে কত রকমের হয়, তাই ভেবে ওর বিস্ময়ের সীমা নেই। বাগবাজারে জ্যাঠাইমার বাড়ির মানুষও একরকমের মানুষ। সেখানে শহরের এক গ্লানিকর অপরিসরতা। তবু শহর, ইলেকট্রিক আলো, সবকিছুর মাঝখানে মানুষগুলিকেও কেমন যেন অপরিসর মনে হয়। এখানে, কোন মান্ধাতা আমলের বুকচাপা হেলে-পড়া বিবর্ণ বাড়িটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আর কোথায় কী আছে কে জানে। কিন্তু এ ঘরে অদৃশ্য এক প্রসন্নময় মহানন্দ প্রাণের এক বিচিত্র স্বাদ নিয়ে বসে আছে।

সুমিতার ছুটে আসার গ্লানি খানিকটা মিটেছিল রাজেনকে দেখে, বাকিটুকু সুধাময়ীকে পেয়ে কোথায় উবে গেল বাষ্পের মতো। কোথাও আড়ষ্টতা নেই, চাপাচাপি, রাখঢাক নেই। যা আছে, এই তার সবটুকু। নবাগতের সংকোচ যদি হয়, হল। এ গৃহের সংকোচ নেই।

চেয়ে দেখল সুমিতা সারা ঘরের দিকে। পুরনোর দৈন্যে ভরা, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ফিটফাট। কুলুঙ্গিতে মিটমিট করে প্রদীপ জ্বলছে। সেখানে কাঁচে বাঁধানো ঠাকুরের ছবি, তার পাশে একটি ফটো। প্রাচীন একটি উঁচু খাট পাতা এক কোণে। সামান্য পাতলা বিছানাটা চোখেই পড়ে না। খান দুই-তিনেক কাঁসার থালা ঝকমক করছে এক পাশে।

তারপরে হঠাৎ চোখে পড়ল রাজেনকে। সুমিতার দিকেই তাকিয়ে ছিল সে।

সমস্ত প্রসন্নতা যেন রাজেনের মধ্যে গম্ভীর ও চিন্তাশীল হয়ে উঠেছে। তবু ঠোঁটের কোণে মিটমিট করছে হাসি।

রাজেন বলল, বেরুবে?

অবাক হয়ে বলল সুমিতা, কেন?

রাজেন বলল, এমনি, যদি তোমার ইচ্ছে হয়ে থাকে। মা হয়তো তোমাকে সহজে ছাড়বে না।

আহত হল সুমিতা মনে মনে। বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল অভিমানে। যেন ও সহজে ছাড়া পেতে চেয়েছে। ওকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে দিতে চায় রাজেন। আর কেউ হলে এত সহজে অভিমান করতে পারত কি না নিজেও জানে না সুমিতা। বলল, যেমন আপনার ইচ্ছে।

রাজেন বিস্মিত হয়ে বলল, আমার আবার ইচ্ছে কী? সবটা তো তোমারই ইচ্ছেয় হচ্ছে। আমি তো কিছুই জানিনে।

সুমিতা তাকাল রাজেনের দিকে। রাজেনও তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে বলল, ওঁর সঙ্গে দেখা না করে কেমন করে যাব।

বলতে বলতেই সুধাময়ী এসে পড়লেন। বললেন, ওমা, খোকা ওকে একটু বসতেও দিসনি। এসো মা, বোসো, একটু শুনি তোমার কথা। তাড়া নেই তো।

সুমিতা বলল, না, তাড়া কীসের। কিন্তু আপনার রান্না

ভারী তো দুটি পেটের রান্না। তুমি বোলো। খোকাও বোস না, ফিরেছিস যখন তাড়াতাড়ি।

মা নয়, দেখায় যেন রাজেনের দিদির মতো।

রাজেন নিরুপায়। বসল খাটের একপাশে। আর একপাশে সুমিতাকে নিয়ে বসলেন সুধাময়ী। যেন কত দিনের চেনা, এমনি করে জিজ্ঞেস করলেন সুধা সুমিতাদের বাড়ির কথা, বাবার কথা, দিদিদের কথা, সুমিতার পড়াশুনার কথা।

তারপর সুমিতা সলজ্জ হেসে বলল, আপনি বুঝি গান করছিলেন?

সুধাময়ী হেসে উঠে তাকালেন রাজেনের দিকে, রাজেনের ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু আছে, কিন্তু তাকিয়ে আছে অন্যদিকে।

সুধাময়ী বললেন, তুমি শুনছে বুঝি? তাতে কি মনে হল, আমি গান জানি!

–গলাটা বড় মিষ্টি লাগছিল।

কথাগুলো শুনেছিলে তো?

রাজেন বলে উঠল, এই, এই তুমি শুরু করলে তো মা?

সুধাময়ী বললেন, শুরু আবার কী? ও ভাববে আমি বুঝি গায়িকা–সে-ভুল ওর ভেঙে দিই।

বলে সুমিতার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মুখখানি যেন করুণ হয়ে উঠল। বললেন, দেখ না, আমি এক দণ্ড ছেলে ছেড়ে থাকতে পারিনে। আমার তো দশটা-পাঁচটা নেই, একটি। কিন্তু এক দণ্ডও আমি ছেলেকে কাছে পাইনে। তাই এখন ধরেছি। ওকে নিয়েই আমার গান।

রাজেন বলল, উঃ, এমন করে বলো কথাগুলো, শুনলে হাসি পায়। সুমিতাও মনে মনে হেসে মরে যাবে।

হাসবে কী, দুজনকে দেখে সুমিতার বিস্ময়ের শেষ নেই। একী বিচিত্র মা আর সন্তান।

সুধা বললেন, হাসল তো হাসল। আমার জায়েরা তো জ্বলে যায় আমার কথা শুনলে। তোরা হাসবি, এ আর বেশি কথা কী। কিন্তু আমার নিজের কাছে তো কোনও ফাঁকি নেই।

বলতে বলতে সুধাময়ীর চোখে জল এসে পড়ল। কিন্তু চোখে জল নিয়েও হেসে ফিসফিস করে বললেন সুমিতার দিকে ফিরে, আর ছেলে তো আমার যেমন তেমন ছেলে নয়।

রাজেন কুঁকড়ে, ছটফটিয়ে উঠল। উঃ মা, থামো, থামো।

–ওরে না, না, তোকে আমি মস্ত বড় লাট-বেলাট বলিনি। তুই আমাকে এত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাস। তোর জ্বালায় আমি পাগল, পাগল। আমি সেই কথাই বলছি। তোর ঘর নেই, বাড়ি নেই, ছিরি নেই, ছাঁদ নেই। মস্ত বড় চাকরিও নেই। কতখানি পড়েছিস, তা-ও বুঝিনে। লোকে বলে, তুই নাকি বড় বিদ্বান, কিন্তু কুলিমজুর খেপিয়ে বেড়াস। আমি শুনি। আমার কথা তুই কী বুঝবি খোকা। তোকে নিয়ে নাকি আমার বড় অহংকার। তার চেয়ে যে কত বেশি যন্ত্রণা, তা তো কেউ জানে না।

সুমিতার দিকে ফিরে আবার বললেন, গান জানিনে মা, পাগলের মতো গুনগুন করে বেড়াই। তবু মনটায় শান্তি থাকে। খোকাকে পাইনে, কিন্তু এ দেশটায় মায়েদের এত গান আছে, থই পাওয়া যায় না। কথা বলা অভ্যাস। তা-ও বলতে পাইনে। ছেলে না হলে থাকতে পারিনে, তাই ওকে ভেবে ভেবে গাই।

রাজেন বলে উঠল হেসে, আর রাগ করলে কথা বন্ধ।

কে আর সুমিতাকে দেখে। আর সুমিতাই বা সে দেখাদেখির কথা ভাববে কখন।

সুধাময়ী বললেন, বটেই তো। ওটা আমাদের রীতি। যেখানে অন্যায় বলে মনে হবে, সেখানে অসহযোগ। অন্যায় রাগ তো আমি করিনে।

রাজেন বলল, তা হলে, আমিই বুঝি শুধু অন্যায় করি?

সুধাময়ী বললেন, যার অন্যায়, তার তার কাছে।

কত বিস্মিত প্রশ্ন যে সুমিতার মনে জেগে উঠেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য মা আর ছেলে। অপরকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নিজেদের কথা। তবু না বলে পারল না ও, আপনাদের ঝগড়া হয়?

সুধাময়ী হেসে উঠলেন। বললেন, তোমার বুঝি ভয় হচ্ছে।

না, না। আরক্ত হেসে বলল সুমিতা, বড় শুনতে ইচ্ছে করছে।

সুধাময়ী বললেন, খুব ঝগড়া হয় মা। সে ঝগড়া দেখলে তুমিও শিউরে উঠবে। মনে হবে এ ঘরটা এখুনি দম ফেটে মরে যাবে।

তারপরেই আবার ছুটলেন রান্নাঘরের দিকে। ও মা, একটু চা খাওয়াব ভাবলুম। বোসো, জলটা চড়িয়ে দিয়ে আসি।

রাজেন বলল, তোমার দেরি হয়ে যাবে সুমিতা।

সুমিতা যেন প্রায় সুধাময়ীর মতো তাকাল রাজেনের দিকে। বলল, হোক আর একটু বসি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress