অভূতপূর্ব নতুন সমস্যা
০৬.
একটি কথা, এক অভূতপূর্ব নতুন সমস্যা নিয়ে এল সুমিতার জীবনে। সে কথাটি, ভালবাসা। ভালবাসা! ভালবাসা!
অবশ্য বাইরে থেকে মনে হচ্ছে কিছুদিনের জন্যে সুমিতা কোনওদিকে চেয়ে দেখবার অবসর পাচ্ছে না। হঠাৎ একযোগে সকলেরই মনে পড়ে গেল, রাত পোহালেই রুমনির ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা। যদিও রাত পোহালেই নয়। তখনও দেরি ছিল প্রায় দিন আঠারো। কিন্তু আঠারো দিন কাটল দেখতে দেখতে। এক মুহূর্ত এদিক ওদিক করবার সময় পায়নি। পরীক্ষার হলের মধ্যে এসে ওর বুকের ভিতর দুরু দুরু করে উঠল। কোনওদিন এরকম হয়নি। জীবনে এই একটি জায়গাতে ও চিরকাল নির্ভয় ও চিন্তাহীন ছিল। এখানে সবকিছুই সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো ছিল পরের পর।
এখন দেখল, সবকিছুই কখন লণ্ডভণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। যেটাকে শুধু ভয় ও কান্না বলে মনে হয়েছিল, সেটা আসলে ঝড়। সেই ঝড়ে কিছু খোয়া গেছে কি না টের পাওয়া যায়নি, কিন্তু চোখের ও হাতের সামনে চেনা জিনিসগুলি একটিও পেল না খুঁজে। সবই ইতস্তত, বিক্ষিপ্ত ছড়ানো।
চেনা জিনিসগুলি তো পরীক্ষার তালিকার বিষয়বস্তু শুধু নয়। সেগুলি প্রত্যহের জীবনধারণের ওর নিত্যধন, নিত্যজন, নিত্যকাজ। আঠারো দিন ধরে যতই সেগুলি কুড়িয়ে নিতে গেল পড়ার ফাঁকে, ততই ফাঁকি গেল পড়া। অঙ্ক, সাহিত্যের ফাঁকে ফাঁকে দেখল, এ বাড়ির সবকিছুতেই কোথায় একটি ভাঙন ধরে গেছে। ওপর থেকে বোঝা যাচ্ছে না তাকে, ভিতরের স্বরূপটিও ধরা পড়ছে না ঠিক।
বাবা ঠিক তেমনি ভোরবেলা বাগানে ঢোকেন, ডাকেন বড়দি মেজদিকে। নানান কথা হয়। তবু আগের মতো যে আর এই তিনজনের জমে না, সেটুকু ধরা পড়েছে সুমিতার চোখে।
একদিন ওদের তিনজনের মিলিত গলার হাসিতে হঠাৎ চমকে উঠল সুমিতা পড়ার ঘরে। উঁকি দিয়ে দেখল, বিলাসটা দাঁড়িয়ে আছে বোকা-হাসি মুখে। আর বলছে, আজ্ঞে হ্যাঁ, ওগুলোকে তো মেড়ো পোকাই বলে।
আবার হেসে উঠল তিনজনেই। বাবা বললেন, মেড়ো পোকা কীরে? এক তো মেড়ো কথাটা-ই পশ্চিমের লোকের পক্ষে অপমানকর। তার ওপরে এই পোকাগুলোর নামও তোরা ওই বলবি?
মুখ দেখে মনে হল, বিলাস বেচারিও কেমন যেন নিজেকে অপরাধী বোধ করছে। সত্যি, কপির পাতায় বিন্দু বিন্দু কালো পোকাগুলিকে কেন যে ওই নামে ডাকা হয়, তা তো সে জানে না।
হঠাৎ হাসির একটি কারণ খুঁজে পেয়ে তিনজনেই হাসিটা আর সহজে ছাড়তে চাইলে না। ডাকা হল ঝি অচলাকে। অচলা বলল, হ্যাঁ, একে মেডো পোকা-ই বলে।
কেন?
তা কী জানি।
আবার হাসি। এ হাসির জন্যে এক সময়ে পাশের বাড়ির ডেপুটি গিন্নি ঠোঁট বাঁকিয়ে আড়ালে গালাগালি দিতেন। মেয়ে তাপসী অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখত। আর ওর এম-এ পাশ দাদা নবেন্দু ওর পেছনে, একটু আড়াল নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বলত, ননসেন্স। বলেও অবশ্য সুজাতা সুগতাকে দেখত তাকিয়ে তাকিয়ে। দেখতে যে খারাপ লাগত তা নয়। কিন্তু বড় অহংকারী বলে মনে হত নবেন্দুর।
সেদিনের হাসি শুনে তাপসী পর্যন্ত উঁকি মেরে দেখল। নবেন্দুও। কিন্তু, সুমিতা স্পষ্ট দেখল, সবটাই মিথ্যে, একেবারে ফাঁকি। এত বড় ফাঁকি যে, চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে বলতে ইচ্ছে করল, ফাঁকি, ফাঁকি, ফাঁকি দিচ্ছ তোমরা নিজেদের। তোমাদের হাসিকে তো আমি চিনি। কী নিষ্ঠুর হাসি তোমাদের, রুমনির কথা একটু মনেও থাকত না। তোমাদের ওই হাসি বাগান থেকে শুরু হয়ে হয়ে বাইরের ঘর, শোবার ঘর, খাবার টেবিল, বারে বারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গিয়ে। কোনও ছল খুঁজতে হত না। বিশ্বজোড়া হাসি তোমাদের ঠোঁটের কোণে এসে দাঁড়িয়ে থাকত দীনের মতো। আর আজ বিষয় পাওয়া যায় না হাসির। ছল খুঁজতে হয়, জোর করে হাসতে হয়, টেনে রাখতে হয়। কী বিশ্রী আর খাপছাড়া।
কে যে কী ভাবছিল, সেটা সঠিক আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না সুমিতার পক্ষে। কিন্তু ভাবান্তরটা পরিষ্কার। মেজদির বৈরাগ্যের মাঝে যে একটি নতুন রং-এর স্পষ্ট ছোঁয়া লেগেছে, সেটা মেজদি নিজেই বোধ হয় জানে না যে রং ওর ভাব-গম্ভীর মুখে কখনও কখনও দেখেছে সুমিতা আড়ালে আবডালে। মনে হয়, সবসময়েই মেজদি মৃণালের কথা ভাবছে। কেন যে এ কথা সুমিতার মনে হচ্ছে, তার কোনও যুক্তি নেই। অথচ মেজদির পাশে পাশে সবসময়েই সেই আজানুলম্বিত বাহু দীর্ঘ একহারা সুন্দর মৃণালের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। এ ছায়া স্পষ্ট। আর একটু দুরে আর একটি অস্পষ্ট ছায়া রাজেনদার। মেজদিদের ছাত্র নেতা বলা যায় রাজেনদাকে। মৃণাল সুন্দর। রাজেনদাও সুন্দর। কিন্তু কেমন একটি রূঢ় তীব্রতা রাজেনদার চোখেমুখে। মেজদির পাশে মৃণালের ছায়া দেখলেই রাজেনদার : মুখটিও আপনিই ভেসে ওঠে সুমিতার চোখে।
.
আর এই দুজনের মাঝখানে যখন মেজদিকে দেখতে পায়, তখন কেবলি মনে হয়, মেজদি যেন জোর করে ওর গাম্ভীর্যকে রেখেছে ধরে। তার পাতলা লাল ঠোঁট দুটির কোণে হাসির আভাস দেখা যায় না বটে। সাজহীন বেশের মধ্যে একটি আত্মভোলা চিন্তাশীল মেয়ে যেন সবসময়েই গুরুতর কিছু ভাবছে। কিন্তু সুমিতার মনে হচ্ছে, ওই ভাবের তলে এক ফল্গুধারা উচ্ছ্বাসে উঠছে ছাপিয়ে। সেখানে তরতর গতি নিঝরিণী দুলে দুলে এঁকেবেঁকে চলেছে খিলখিল করে হেসে। সেখানে কী এক বিচিত্র খেলা। যেন দুটি আদিগন্ত মনের মাঝে মেজদি এক নিঝরিণী। কার তটে যে ঢেউ লেগেছে বেশি, সেটা সহসা বোঝা যায় না।
কিন্তু মেজদি, বড়দি নয়। একটু চাপা মেয়ে। সহসা কিছু বোঝা যায় না দেখে। মেজদি ওর ফক্ষুধারার উচ্ছ্বসিত প্রাণ নিয়ে কেবলি বাইরে ছুটে যেতে চাইছে। বড়দি আর বাবার মাঝখানে যে এক ভুলের কাঁটাতার জুড়ে বসেছে, সেখানে সহজ হতে বাঁধছে মেজদির। তাই কেবলি পালাচ্ছে। যেন জোর করে ওকে ধরে রেখেছে কেউ এ বাড়িতে। এখানকার কোনও কিছুতেই তেমন মনোযোগ নেই। তাই মেজদির হাসি, কথা যে জমে না, তার কারণ জমাবার ইন্ধনটা রেখে এসেছে অন্যত্র।
জ্যাঠাইমার সঙ্গে কথা বলে আসার পর বাবার ভয় ও সংশয় বেড়েছে নিদারুণভাবে। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই বড় কথা নয়, তার বাইরেও জীবন অনেকখানি। সেই অনেকখানি জীবনটাকে নিয়ে সুজাতা কী করবে! আশৈশব যে মানুষ হল ওঁর নিজের হাতে, যার সঙ্গে ভাবের মধ্যে কোনও ফাঁকি ছিল না বলে জানতেন, তাকেই আজ সবচেয়ে বেশি ঝাপসা মনে হচ্ছে। সুজাতাকে আর একটুও বুঝতে পারছেন না উনি। অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে মেয়েদের যে বলিষ্ঠ জীবনের কল্পনা করেছিলেন, সেখানে এমন ভয়াবহ অন্ধকার গর্তটি যে হা করে আছে, তাকে এক বারও দেখতে পাননি।
ওঁর চোখেমুখে যত উৎকণ্ঠা ভয়, বড়দি ততই যেন গুটিয়ে শক্ত করে নিচ্ছে নিজেকে। নিজেকে অপমানিত বোধ করে, নিয়ত ফিরছে ও একটি নিষ্ঠুর শ্লেষ নিয়ে। বাবার ব্যথাটা বুঝতে পারছে না বলেই লোকটিকে ভুল বুঝে, অকারণ জ্বলে মরছে নিজে। ভাবছে, বাবার এত কীসের উৎকণ্ঠা, এত ব্যাকুলতা কীসের। কী দেখছেন আমার দিকে চেয়ে চেয়ে অমন ভীত সন্দিগ্ধ চোখে। যত ভাবছে, ততই ভিতরের জ্বালাটা একটি অদ্ভুত তীক্ষ্ণ ধারে ফুটে উঠছে তার চোখে, ঠোঁটে, চলায় ফেরায়।
কিন্তু বড়দি তো ঠিক এমনটি ছিল না। সেই যে কোর্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিল এক তরল আগুনে ডুব দিয়ে, সেই গলিত আগুনের ঢেউ নিয়ে ফিরেছে ঘরে। আজও তা ধুয়ে শীতল হয়নি, বরং বেড়েছে। কোথায় যায়, কাউকেই কিছু বলে না। জিজ্ঞেস করলে, যা হোক একটা কিছু বলে দেয়। সুমিতা বোঝে, তার মধ্যে সত্য খুব কম আছে।
এ সব কথা ভাবতে ভাবতেই, শিবানীর সেই কথাটি মনে পড়ে সুমিতার। শিবানী আর ও, দুজনে ওরা দুটি নদী। ভিন্ন গতিতে চলেছে, ভিন্ন পথে। স্রোতে, বাঁকে, গভীরতায়, কোথাও মিল নেই দুজনের। কিন্তু শিবানীর একটি কথা সুমিতার সবকিছুই একেবারে গণ্ডগোল করে দিয়েছে। শিবানী বলেছিল, তা কেন হবে। সে তো আমাকে ভালবাসবে। যেন ওই একটি কথা, সব কথা, সব সমস্যা, সমস্ত প্রশ্নকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। এর ওপরে সুমিতার নিজেরও কোনও যুক্তি নেই। যদি ভালবাসা থাকবে, তবে আর বাকি রইল কী! সে তো সবার ওপরে।
গিরীনদা আর বড়দির মাঝে এই ভালবাসা কি ছিল না তবে? ভেবে ও অবাক, কান্নার সীমা নেই ওর। এত দিনের এত হাসি, এত কথা, সে সব তবে কী।
সুমিতা জানে না, ওই কথাটিই আরেকরকমের জ্বালাধরা যন্ত্রণায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বড়দিকে। ঘরে বসে, বড়দির জন্যে যখন এত ভেবে ওরা আকুল হচ্ছে, তখন, সেই চৌরঙ্গির দিনান্তের রূপোপজীবিনী-সাজ সন্ধ্যায় একটি দিশেহারা মেয়ের মতো সুজাতা ঘুরে মরছে একাকিনী। বাবার উপরে রুষ্ট হয়েছে যতখানি, ঠিক ততখানি বিমুখ হয়েছে ওর মন রবির প্রতি। কেবলি মনে হচ্ছে, ওর এই দুর্দশায় খুশি হয়েছে রবি। খুশি হয়ে ভাবছে নিশ্চয়, এত দিনে বুকের কাঁটাটি খসে গেল সব বিষ নিয়ে। সুজাতাকে পাবে, এবার আরও কাছাকাছি। এ ভাবার মধ্যে কোনও যুক্তি নেই, কিন্তু মন সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করেছে। রবির বিষণ্ণ চোখের চাউনির অর্থ তো অস্পষ্ট নয়। বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্যে তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগেও যেমন এসেছে, এখনও আসে তেমনি। কিন্তু এখন যেন রবি আসে কোনও বিশেষ আশা নিয়ে। না-ই বা সেটুকু দশজনের সামনে ধরা পড়লযত ছদ্মবেশ নিয়েই থাকুক রবি সুজাতার সামনে নিজে কি কিছুই বুঝছে না। রবিকে ও মনে মনে ধুলোয় লুটিয়ে দিল। সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে বিকৃত করে ফেলল একেবারে। তাতেও বিতৃষ্ণাটুকু পূর্ণ হয় না। রবির হীনতার কোনও শেষ দেখতে পাচ্ছে না।
বিরক্তি ও বিদ্রুপে রবিকে আঘাতের পর আঘাত করছে আর ভাবছে, আমি আমার নিজের জন্যে যা করেছি, তা নিজেরই শান্তি ও সম্মানের জন্যে। যে মূর্খ এবং হীন এর মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পেয়েছে, সেখানে ঘৃণা ছাড়া আর কী থাকতে পারে।
কিন্তু এ সব ছাড়াও, জীবনের আর সবটাই কেমন অর্থহীন হয়ে গেছে। মন কী চায়, কী পেলে যে ঠিক সহজভাবে চলতে পারত, সে সবই এলোমেলো হয়ে গেছে মাথার মধ্যে। গিরীনকে ছেড়ে আসার মধ্যে যুক্তির কোনও অভাব নেই। সেখানে সম্পূর্ণ অবিচল। যুদ্ধের সময়ে একটি মেয়ের উপকার করতে গিয়ে, তার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো বাস করেছে গিরীন। সুজাতার কাছে, এটাই একটি মস্ত বড় অপমান। বিয়ের আগে একটুও জানতে পারেনি। আরও জানতে পেরেছিল, চরিত্রের কোনও বালাই নেই তার। সহসা জানতে পেরে, নিদারুণ ধাক্কায় স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল। মানুষের এই মুহূর্তে বেদনাটা তো বড় হয়ে দেখা দেয় না। প্রথমে ছুঁড়ে দেয় ক্রোধের অগ্নিবাণ। গিরীনের অহমিকায় আবার লেগেছিল সেটা। কোণঠাসা হতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়েছিল খেপে। সেই মুহূর্তেই মনে হয়েছিল, একেবারে ভুল করে ফেলেছে ও গিরীনকে বিয়ে করে। অর্থ ও প্রতিপত্তির দম্ভে গিরীন ওর কাছে ক্ষমা চাইতেও ভুলে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে সন্ধির যে ক্ষীণ চেষ্টা করেছিল সে, সেটুকুও নিতান্ত পারিবারিক সম্মানরক্ষার্থে।
ভালবাসা! কী জানি! কিছুই আজ আর বুঝতে পারছে না সুজাতা। ও নিজে ভালবেসেছিল কি না, গিরীন ভালবেসেছিল কি না, এ সবই ওর কাছে এক অস্পষ্ট ধোঁয়াটে রুদ্ধশ্বাস অথচ যন্ত্রণাদায়ক প্রশ্ন। আগাগোড়া ভাববার ক্ষমতা নেই সুজাতার। শুধু এক রক্তাক্ত বেদনা অভিমান ও অপমান ঘিরে আছে ওকে। এই যন্ত্রণাকে বাড়িয়েছে আরও অমলা।
অমলা অনেক দিনের বন্ধু। তাই কোর্ট থেকে সেদিন প্রথমে সে সত্যি ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। মাঝে বহু দিন অমলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। সেদিন সুজাতার নিয়তি যেন টেনে নিয়েছিল সেখানে।
অমলার স্বামী একটি অর্ডন্যান্স ডিপোর সুপারিন্টেডেন্ট। বাড়ি, গাড়ি, সবই আছে। কিন্তু জানত, অমলার স্বামী পুরোপুরি বিশ্বাসী ছিলেন না। দুঃখে ও অপমানে, অমলার জীবনে গৃহকোণটাই একমাত্র ঠাঁই হয়েছিল। কিন্তু সেদিন অন্য এক অমলাকে দেখতে পেল ও।
সেদিন সুজাতাকে দেখে অমলা ওর লিপস্টিক ঘষা ঠোঁট বিস্ফারিত করে বলে উঠল, এসেছিস? খালি মনে হত, তুই আমার কাছে আসবিই একদিন।
সুজাতা বিষণ্ণ হেসে বলল, কেন বল তো?
অমলা কাজল টানা চোখে বিচিত্র কটাক্ষ হেনে বলল, তার আগে বল, তোর স্বামীর সঙ্গে ব্যাপার কদ্দূর গড়াল।
সুজাতা–যতটা গড়াবার, ততটাই গড়িয়ে গেছে।
ভ্রূ কুঁচকে বলল অমলা, মানে?
সুজাতা নরম সুরেই বলল, মানে, আজই সব শেষ হয়ে গেল।
অমলা ডুকরে উঠল প্রায়, সেপারেশন? ফিনিশ?
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল দুজনেই। অমলার বাইরে বেরুবার সাজ-সজ্জা রয়েছে বেশে। নিপুণভাবে রং মেখেছে ঠোঁটে, চোখে দিয়েছে কাজল। গলাবন্ধ ব্লাউজের বুকটা স্তনান্তরের কাছে খানিকটা কেটে দিয়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যেন হঠাৎ একটি শ্যামচিকন বঙ্কিম-রেখা-আলোর জানালা দিয়েছে খুলে। চাঁদহার পরেছে গলায়। আলুলায়িত চুল শুধু ফিতে দিয়ে রেখেছে বেঁধে, স্কুলের মেয়েদের মতো।
নীরবতা ভেঙে বলল, এটা কিন্তু ছেলেমানুষি করে ফেলেছিস সুজাতা।
শুনে নিজেকে বড় দুর্বল মনে হল সুজাতার। বলল, ছেলেমানুষি?
নয়? তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, কার জন্যে এ সব করতে গেলি, শুনি?
সুজাতা বিস্মিত হয়ে বলল, ছিঃ! কী যে বলিস। কার জন্যে আবার! নিজের জন্যেই, এও আবার। জিজ্ঞেস করতে হয়?
কিন্তু অমলার যেন সন্দেহ ঘুচল না। বলল, তোদের সেই রবির কোনও উৎসাহ ছিল না?
অমলার কথার মধ্যে কী একটা বিশ্রী সুর ছিল। অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়াতে হল ওকে। বিরক্ত হয়ে বলল, কী যা তা বলছিস অমলা।
অমলা জবাব দিতে গিয়ে থেমে গেল। নয়? তা হলে তো আরও ছেলেমানুষি বলতে হবে।
সুজাতা এবার সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, কেন বল তো?
অমলা জবাব দিতে গিয়ে থেমে গেল। ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে যখন ফিরে দাঁড়াল, তখন ওর কাজলমাখা চোখ জ্বলছে দপদপ করে। বলল, দ্যাখ সুজাতা, যে পুরুষ মেয়েদের ঘরে এনে পুরে বাইরের মেয়েদের কাছে ঘোরে, তাদের কাছে ঘরের আর স্ত্রীর কোনও আদর্শের বালাই-টালাই নেই। ও সব এককালে বিশ্বাস করা যেত, এখন আর যায় না। কিন্তু তুই যেরকম আদর্শবতীর মতো জবাব দিয়ে এসেছিস, সেটা আরও ভুল। তাতেও ওদের কিছু যায় আসে না। রাগের বশে শুধু শুধু যেটা করলি, সেটা সেই চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো। কী দরকার ছিল তার?
অমলার কথার অলিগলিগুলি এমন চোরাপথে চলেছে যে, কিছুই বুঝতে পারছিল না সুজাতা। বলল, তবে কী করব?
অমলার রাঙানো ঠোঁট বিদ্বেষ ও শ্লেষে যেন লকলক করছে। বলল, জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে গাড়ি বাড়ি টাকা সবই দরকার। কিন্তু কী করতে হয় জানিস? ওদের মতো করেই ওদের শোধ নিতে হয়।
আচমকা আঘাতে পাংশু হয়ে উঠল সুজাতার মুখ। শিউরে উঠে বলল, ওদের মতো?
অমলা: হ্যাঁ, ওদের মতো। ঠিক ওদের মতে, ছদ্মবেশ, ছলনা, সবকিছু। পুরুষ পারে আর মেয়েরা পারে না? পারে আরও বেশি করে পারে।
সুজাতা রুদ্ধশ্বাস হয়ে বলল, একসঙ্গে থেকে?
সাপিনীর মতো ফণা কাত করে বলল অমলা, হ্যাঁ, ঠিক ওদের মতো। একসঙ্গে, এক ঘরে, এক বিছানায় থেকে ওরা যা করে, ঠিক তেমনি।
সুজাতা: তা কী করে হয়?
রক্তমাখা ছুরির মতো ঝিলিক দিয়ে উঠল অমলার ঠোঁট। সুজাতার প্রশ্নের শাণিত ও সুস্পষ্ট জবাবের মতো অমলা নিজেকে যেন দেখিয়ে দিল ওর হাসি দিয়ে, কোনও ইঙ্গিত না করেও। আবার বলল, কী দরকার ছিল গিরীনকে ঘাঁটিয়ে। ওইটিই বেশি অপছন্দ করে ওরা। তুই অকারণে বিড়ম্বনা ডেকে আনলি। কী করবি তুই এখন। পায়ে ধরে ফিরে যাবি, নাকি আবার প্রেমে পড়বি, নাকি চাকরি করে বিবাগী হয়ে জীবন কাটাবি চিরকাল?
অপমানে অস্বস্তিতে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল সুজাতার বুকের মধ্যে। এ কোথায় এসে পড়েছে ও। এর পরে আরও না জানি কী জিজ্ঞেস করবে অমলা। কিন্তু সমস্ত অনুভূতি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ার পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট। কাঁপছে সুজাতার বুকের মধ্যে। ভয় করছে অমলাকে। সত্যি কী করবে এবার, কী করবে সুজাতা।
তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গে এসে পড়ল সুজাতা। বলল খানিকটা কপট ভীতস্বরে, তোর স্বামী আসবেন কখন?
অমলা এবার সশব্দে হেসে উঠল। বলল, যখন তাঁর প্রাণ চাইবে। কিন্তু তুই খুব ভয় পেয়ে গেছিস, না?
ঢোঁক গিলে বলল সুজাতা, না, ভয় পাইনি। কিন্তু তুই কীরকম বদলে গেছিস একেবারে। তবু অমলার আর ওর স্বামীর কথা, সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করতে সাহস করল না।
অমলা বলল, ভেবেছিলি, এসে দেখবি, যক্ষিণীর মতো বসে আছি চোখে জল নিয়ে, না? তাও তো ছিলুম অনেক দিন। বোধ হয়, মরেই যেতুম অমনি করে। তারপর, সবটাই কেমন যেন ন্যাকামো বলে মনে হতে লাগল নিজের কাছেই। দেখলুম, সংসারে আমারও অনেক বন্ধুবান্ধবী আছে।
কথার মধ্যেই ফিক করে হেসে উঠে বলল, আর তারা সকলেই সমব্যথী। কী দুঃখ আছে আমার। বেশ আছি, বেশ আছি।
বলে সারা ঘরে ওর লাল টকটকে শাড়ির রক্তাভা ছড়িয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। কোনও দুঃখ, বেদনার চিহ্ন নেই অমলার কোথাও। অনেক হাসি, অনেক আলো ওর চারপাশে আছে ঘিরে। যদিও তার মধ্যে রয়েছে কেমন একটি রহস্যের আমেজ। সেইটিই যেন সুজাতার দিশেহারা অর্থহীন জীবনে একটি তীব্র আকর্ষণের মতো বোধ হল।
দরজা খুলে দিয়ে অমলা বলল, হিন্দু বিয়েতে ডাইভোর্সও নেই।
সুজাতা বলল, সে সব কথা আমি ভাবছিনে।
তবে এখন কী করবি?
আবার সেই এক সুর, এক কথা। বলল, এখনও স্থির করিনি কিছু।
সুজাতার চোখের দিকে তাকিয়ে, ঢুলু ঢুলু চোখে একটু হাসল অমলা।
সুজাতা বলল, কী হল?
অমলা বলল, না, দেখছি তোকে। তুই হয়তো ভাবছিস, এ দুঃখের সময় এলুম, অমলাটা কোথায় একটু সান্ত্বনা-টাত্বনা দেবে
না না, ও সব মোটেই ভাবিনি।
ভাবলেও অন্যায় হত না কিছু। কিন্তু আমি ভাই জীবনটাকে চিনে নিয়েছি অন্যভাবে। তোকে দেখে, নিজের কথাটাই ভেবে নিলুম আর একবার। আর দেখছি, সত্যি, রূপসী বটে তুই।
অমলার চাউনির মধ্যে কীসের একটি অদৃশ্য ইশারা দেখে লাল হয়ে উঠল সুজাতা। এই দুজনের বন্ধুত্বের মধ্যে এক সময়ে অমলা সুজাতাকে খানিকটা শ্রদ্ধাও বোধ হয় করত। আজ সে সব কোথায় কোথায় চলে গেছে অমলা, কোন এক বিচিত্রলোকে। বড় কৌতূহল হচ্ছে সুজাতার। অমলা যেন কত অভিজ্ঞ, তীক্ষ্ণ, তীব্র হয়ে উঠেছে।
তেমনি ঢুলুঢুলু চোখেই ভ্রূ কাঁপিয়ে বলল অমলা, রবিটা কিন্তু বেশ। একটু বেশি সিরিয়াস, এই যা।
রবির উপর একটি অবুঝ তিক্ততা পেয়ে বসেছে সুজাতাকে। কঠিন গলায় বলল, বোধ হয় রবিও তাই ভাবছে।
বলে হাসতে গিয়েও রাগে ও বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠল। তারপর আবার প্রসঙ্গ ফিরিয়ে বলল, কিন্তু তোর কথা তো কিছু বললিনে। স্বামীর সঙ্গে তোর যে–
সঙ্গে সঙ্গে অমলা বলে উঠল, কিছু না, কিছু না–বোঝাবুঝিতে একটু ভুল হয়েছিল। বুঝতে পারিনি, ওরা মানুষগুলি একদিকে বেশ উদার। কোনও বাঁধাবাঁধি নেই। সুখ নিয়ে কথা! যে যেখানে সুখ পাও, টেনে নাও, ছিনিয়ে নাও, যেমন প্রাণ চায়। তবে তোর মতো সব ভেঙেচুরে ফেললে হবে না।
বলছে অমলা, হাসছে, কিন্তু চোখ যেন জ্বলছে দপ দপ করে। মনে মনে পালাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল সুজাতা।
অমলাও বেরুল ওর সঙ্গে। সন্ধ্যার মুহূর্তে একটি রেস্তোরাঁর দরজায় সুজাতাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল অমলা।
আলো আর মেয়ে, পুরুষ আর গাড়ি, চৌরঙ্গির সেই সবে ঘোমটা খোলা মুখের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় একলা মনে হতে লাগল সুজাতার। ওর গলার কাছে একটি কথা এসেও আটকে ছিল। মাতালের গলায় যেমন মদ আটকে থাকে, বমি হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল অমলাকে; তুই কি তোর স্বামীকে ভালবাসিসনে?
পারেনি জিজ্ঞেস করতে। প্রশ্নটা যদি পালটা আসত! ভালবাসা।
ওর নিজের কি ভালবাসা ছিল গিরীনের প্রতি? কই, কিছুই তো মনে হচ্ছে না। কাকে বলে ভালবাসা? ভালবাসা! ভালবাসা!
ওর রূপ, ওর শুভ্র-সজ্জা, মুক্ত বাহু, উন্মুক্ত কাঁধ আর পোশাকের অন্তরালে নিটোল শরীর, অজস্র চোখ নানান স্বাদে লেহন করে করে কুঁকড়ে তুলল আজ। দুরে মাঠের অন্ধকারে দিগন্ত উঠছে ভেসে। এই চোখ ধাঁধানো আলোর কাছ থেকে মাঠের গাছগুলিকে দেখাচ্ছে অন্ধকারের আততায়ীর মতো। আরও দূরে ফোর্ট উইলিয়মের আভাস। সুজাতার চোখদুটি জ্বালা করে উঠছে। তখনও ওই কথাই ভাবছে। কিন্তু, ভালবাসাটা অর্থহীন শব্দের মতো ভাসছে ওর কানের পরদায়। আর কত কথাই যে মনে পড়ছে এই সঙ্গে, আর কত মুখ পড়ছে মনে। আর একটি মুখ বারে বারে উঁকি দিচ্ছে মনে। সুজাতা তাকে ফুঁসে উঠছে, চোর, চোর! চোরের মতো উঁকি মারছ তুমি এখানে।
সেই মুখটি রবির।
দিনের পর দিন সুজাতা ওর যত বন্ধুর কাছে গেল, সবাই ওকে দেখলে করুণভাবে হাসে। বিষণ্ণভাবে কথা বলে। রাগে দুঃখে অপমানে, সমস্ত বন্ধুবান্ধব সমাজটার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছে ওর মন। আর চারদিক থেকে একটি অর্থহীন শূন্যতা আসছে ওকে ঘিরে। আজকে যদি সবই এমন অর্থহীন, তবে সেদিন গিরীনকে কী ভেবে বরণ করেছিল। না, কিছুই বুঝতে পারছে না আজ।
যাকে ওর সবচেয়ে বেশি ভয়, সেই অমলার প্রতি তীব্র আকর্ষণ কিছুতেই রোধ করতে পারছে না। কী এক দুর্নিবার আকর্ষণ যে অমলা। অমলার আলোক-দীপ্ত, ভয় ধরানো, সুখের এক রাজ্য বার বার টেনে নিয়ে যায় সুজাতাকে।
অমলা ওর স্বামীকে ভালবাসে কি না, সে কথা যেমন কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারল না, নিজের কথাটাও কিছুতেই পরিষ্কার করতে পারল না মনের সামনে এনে। কোনও কার্যকারণে বিচারশক্তিটাই যেন চলে গেছে নাগালের বাইরে। কেবল কানের কাছে দিনের পর দিন বাজতে লাগল, ভালবাসা! ভালবাসা!
কী করে জানবে সুমিতা ওর বড়দির কথা। কী করে সবটা বুঝবে! কী কথা যে বলল শিবানীটা! ওই কথাটি দিয়ে, যতই ও বড়দিকে বিশ্লেষণ করতে গেল, ততই অবুঝ ভয়ে ও দুঃখে, ব্যাকুল কান্না নিয়ে লুটিয়ে পড়ল ওর অ্যাডিশনাল সবজেক্টগুলোর উপরে। আর অলক্ষিত ভয়-বিলুলিত লতাটি এবার উন্মুক্ত করতে বসল নিজেকে।
.
০৭.
সুমিতা যে নিজেকে উন্মুক্ত করতে বসল, সেটাও ইচ্ছে করে নয়। কী এক অপ্রতিরোধ্য দুর্বার শক্তি ওর ভিতর-দুয়ারের কপাট খুলে দুর্বিনীতের মতো সব ছড়িয়ে উড়িয়ে তছনছ করে দিলে। কত কাজ, কত কর্তব্য। কোনওটাকেই রেয়াত না করে যেমন বড়দির ব্যাপারে ভয় জুড়ে বসেছে বুকে, কান্না উঠছে ঠেলে ঠেলে বাড়ির সবাইকে দেখে, এ-ও ঠিক তেমনি এসেছে। অথচ এর সঙ্গে লেখাপড়া, পরীক্ষা, ভয়-বেদনা কান্না, কোনওটিরই যেন সাক্ষাৎ মিল নেই।
এখানে দোলা লেগেছে ওর রক্তের মধ্যে। কাঁচা রক্তের শিরায় শিরায় কী এক বিচিত্র শিহরন। কী এক অভূতপূর্ব ঝংকারে সেখানে নতুন সুরের ঢেউ লেগেছে। ভেবে ভেবে সুমিতার নিজেরই বিস্ময়ের সীমা নেই। এ কেমন সৃষ্টিছাড়া মেয়ে ও মানুষের মনে যখন এত দুর্ভাবনা, ভয়, ব্যথা, ঠিক তখুনি তার রক্তের মধ্যে নতুন সুরের গুঞ্জন। এই নতুন সুরই আরও বেশি করে সব ভণ্ডুল করে দিলে। সেই জন্যেই চেনা জিনিসগুলি সব হারিয়ে গেছে হাতের কাছ থেকে।
এই সুর নিয়ে ফিরেছিল সুমিতা, শিবানীর কাছ থেকে। যার সঙ্গে জীবনের কোথাও মিল নেই, অথচ ছোঁয়াচে কীটের মতো কখন সে সুমিতার ডালপালায় ছড়িয়ে পড়ছে। সেই ছাদ, সেই পড়ন্ত বেলার রক্তিম বরাদ। সেই রোদের আভায় উদ্ভাসিত শিবানীর দুটি চোখের বিচিত্র ঝিকিমিকি, রহস্যঘন হাসি, কুহেলি-মাখা লজ্জাজড়িত ভঙ্গি আর একটি কথা ভালবাসা।
সুমিতার মনে তখন বড়দির দুর্ঘটনার বেদনাময় সুরই ছিল বাঁধা। শিবানীর কথাগুলি ভাবিয়ে তুলেছিল বড়দির জন্যেই। কিন্তু সে কখন ওর নিজেরই ভিতর দরজার আগল খুলেছে টের পায়নি। আসলে, শিবানীকে দেখে যতই বিস্ময় জুড়ে বসেছিল ওর মনে, ততই ভাবছিল, শিবানী তো সব বিষয়েই কত ছোট। কিন্তু সুমিতার চেয়ে এত বড় হয়ে গেছে ও কবে। সুমিতা নিজেই জানে না, নতুন যৌবনের অন্তস্রোতে এই প্রথম ও যুদ্ধ ঘোষণা করে বসল। এই প্রথম ওর যৌবন, শিবানীকে উপলক্ষ করে নামল প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। যে মন বাইরের জগতে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল, সে-ই মন শামুকের গুঁড়ের মতো ভিতরে ঢুকিয়ে হাতড়ে বেড়াতে লাগল। কোথায় শিবানীর সেই হাসি, চাহনি, ভঙ্গি। কোথায় সেই ভালবাসা!
যত খুঁজল, তত ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। এত রকমের ভয়ও আছে এই সংসারে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে, মনের মধ্যে এ কী বিচিত্র খুশির গুঞ্জন! এ কীসের নেশায়, কোন আমেজে নাচে রক্তধারা। ভাল লাগে, ভয়ও লাগে।
ভাল লাগাটাকে সুমিতা একটি অবৈধ অনুভূতির পর্যায়ে ফেলে দিলে। ছি ছি ছি! এ কোন ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে এল শিবানীর কাছ থেকে। বাবা, বড়দিদের জন্যে যে দুর্বহ বেদনা রয়েছে বুকে, তাতে সংসারের পক্ষে সেটা অবৈধ হতে পারে, ওর নিজের কাছে নয়। কিন্তু তার মাঝে এই দুর্বহ আনন্দ সবকিছুকে আরও জটিল আরও বিস্মিত লজ্জিত করে তুলল। ছি ছি, একটি মানুষের কতগুলি মন থাকে। সুমিতার মনে হল, ও মন্দ হয়ে গেছে। ওর সবই অমিয় গরল ভেল।
কিন্তু সে ছাড়বার পাত্র নয়। যে দুর্বিনীত অনুভূতিটা নিজে সৃষ্টিছাড়া তার রীতিনীতি কাউকে মানে না। সে ওর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, পরীক্ষার ফাঁকে, বেদনার ফাঁকে, জায়গা করে নিয়েছে অসীম শক্তিতে। ঘেঁটে ঘেঁটে বেড়াচ্ছে বুকের চারপাশে। কোথায়, কোথায় সেই লজ্জার জড়িমা, কুহকী হাসির রেশ ওর নিজের প্রাণে। কোথায় সেই, সেই…কী যেন বলে! হ্যাঁ, ভালবাসা, ভালবাসা! এই তো লজিক, ওই তো ফিজিকস, ওই যে সাহিত্য, এই যে বসে আছেন বাবা, ওই চলে যায় বড়দি, এই ভিড়ের মধ্যেই কে ওকে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলে আপনার কাছে।
নিজের দিকে চেয়ে হেসে ফেলল সুমিতা। হাসিটা লজ্জা ও বিরক্তি মেশানো। কিন্তু এত ভাল লাগছে কেন নিজেকে দেখতে। ওর চেয়ে সংসারে সুন্দরী বুঝি কেউ নেই আজ আর! ওকে যে দেখবে, সে-ই…?
অমনি বৈধ মন উঠল চোখ রাঙিয়ে। ছি! ও কী হচ্ছে। সবকিছুরই সময় আছে একটা। কিন্তু কে বলে দেবে সেই সময়ের কথা। সুমিতা? তা তো হয় না। আসলে, মনে যত বেদনা বাড়ে, দুঃখ বাড়ে, পরের জন্য বাড়ে কান্না, ওই অনুভূতিটুকু ততই ওঠে মাথা চাড়া দিয়ে। সেই অদৃশ্য লতা, যখন ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে দিগদিগন্তে, তখনি তার ডগায় শীর্ষবিন্দুর মতো ধরেছে কুঁড়ি। সৃষ্টি সুখের মধ্যেই যত বেদনা সংশয় ভয়।
আয়নাতে নিজেকে দেখে, নিজেই বিহ্বল হয়ে পড়ল সুমিতা। একি সেই? ওই রক্তাভ তীক্ষ্ণ রেখাঙ্কিত ঠোঁট, নিখুঁত উন্নত নাক, ঈষৎ প্রশস্ত কপালের দুপাশ দিয়ে বেয়ে পড়া স্বল্প কুঞ্চিত চুলের রাশি। ওই নিটোল গ্রীবা, প্রশস্ত কাঁধ, পুষ্ট দুটি হাত। তরল চোখের কালো মণি দুটি ভয়ে ও আনন্দে দেখতে লাগল নিজেকে। কাপড়ের আঁচল গেল খসে। স্বপ্নন্ধের মতো দু চোখ বুজে, দু হাত রাখল বুকে।
এক তীব্র অনুভূতি ওর সর্বাঙ্গে কিলবিল করে বেড়াতে লাগল সাপের মতো। সহসা আয়নার দিক থেকে ফিরে তাকাল দেয়ালের ছবির দিকে। মনিয়েরের ন্যুড-ইনকুশান। প্রশস্ত কাঁধের নীচে, ওখানে কোনও বুটি-ছাপা ঘটিহাতা ব্লাউজ নেই। লাল শাড়ি নেই কলকাতা-ছাপা। উত্তুঙ্গ উদ্ধত বুক, অস্পষ্ট উতরাই নেমেছে নাভিস্থলের দিকে। সুনাভা নিতম্বিনী অসঙ্কোচ উরুতের বাঁক সীমায়, একটি পা ফেলে দিয়েছে কুশানের নীচে।
আবার আয়নার দিকে তাকাল ভ্রূ কুঁচকে হেসে। এত সুন্দরী ও নিজে! ওকে যে দেখবে, সে-ই নয়, যে দেখেছে, সে-ই..আ, সে-ই কী দেখেছে? শিবানীর ওই হাসি ও ভঙ্গি দেখেছে নাকি? ছি!
ছি বললে কী হবে। যৌবনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার নিজের অধিকারে দেখতে লাগল সব উলটে পালটে। সহসা মনে হল সুমিতার, কবে কোন এক কুয়াশাঘন ভোর থেকে নিজেকে দেখছে এমন করে। কিন্তু তার ছিল রকমফের।
আপনা থেকেই ওর মনে পড়ে গেল সেই দিনটির কথা। ম্যাট্রিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে। ডাচ-লেডি-ফ্রকটি উড়িয়ে বাগান থেকে ছুটে আসছিল ঘরে। কী একটা জিনিস নিতে এসেছিল। হঠাৎ মাকড়সার মুখের কাছে আটকা পড়া মাছির মতো দাঁড়াতে হল মেজদির সামনে। কেমন একরকম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মেজদি ওর দিকে। কোমরে ছিল না বেল্ট আটকানো। ভাবল, মেজদি ধমকে উঠবে এখুনি।
কিন্তু মেজদি সুমিতার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, পাশের ঘরে চল।
কী ভয় পেয়েছিল সুমিতা। পাশের ঘরে এসে মেজদি বললে, ফ্রক পরা আর তোর চলবে না।
ফ্রকের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল, কেন মেজদি?
মেজদি গম্ভীর গলায় বলল, কিছু নয়, তুই বড় হয়েছিস।
বড় হয়েছে! এ কেমন বড় হওয়া। আলমারি খুলে কী খুঁজতে খুঁজতে মেজদি খাপছাড়াভাবে কয়েকটি কথা বলে গেল। তারপর হঠাৎ একটি শাড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা পরে নিস।
বলে, ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে আবার বলল, এরকম হয়।
কিন্তু বিস্ময় তখন কিছুতেই গেল না সুমিতার। মেজদির কথামতো সব করেও সহস্র প্রশ্ন উঠতে লাগল বুক ঠেলে। একলা একলা শাড়ি পরতে গিয়ে কেঁদে আকুল হল। কিছুতেই ঠিক হয় না। শেষ পর্যন্ত হাত লাগাতে হল মেজদিকেই।
শাড়িপরা রুমনোকে দেখে বাবা তো হেসেই খুন। বললেন, নাইস, ইয়ং লেডি। হাউ বিউটিফুল ইউ আর।
সেইদিন বাবার দিকে তাকিয়ে কি সুমিতা শিবানীর মতো হেসেছিল লজ্জাজড়িতভাবে! সেদিন বাবাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, যাঃ!
সেই তো একজন প্রথম পুরুষ বাবা, যাঁর সামনে ও ত্রিভঙ্গ হয়ে উঠেছিল লজ্জায়। তারপর রবিদা, গিরীনদা, মৃণালদা, রাজেনদা, কত, কত ছেলে। তখন মনে একটি তীব্রতা এসেছিল ওর। সব বিষয়ে ওর অনুসন্ধিৎসা সকলের সুখে দুঃখে ওর নিজের সুখ দুঃখানুভূতি, তেমন করে আগে আর বাড়েনি। নিজেকে এসে দেখেছে তখন আরশিতে। দেখেছে শরীরের বৈলক্ষণ্য। কিন্তু সুপ্ত ছিল আজকের এই মন। শুধু বড়দির ঘরের ছবিগুলি দেখে, নিজের দিকে চেয়ে দেখতে লজ্জায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছে। মেজদি বলেছিল, তুই বড় হয়েছিস। দুদিন বাদেই ভুলে গিয়েছিল সুমিতা সেই কথা। ভুলে গিয়েছিল বাড়ির লোকেরাও। যে ছোট সেই ছোট রুমনিই থেকে গিয়েছিল ও।
কিন্তু মেঘসমারোহ এই ঝড়ের দিনে, ব্যাকুল ভয় ও কাজের মাঝে শিবানী দিলে সব উতল এলোমেলো করে। শিবানী বলে, ভালবাসা! ওকে ভালবাসবে একজন। কীসের একটি স্বাদ পেয়েছে ওর মন। যেন বলছে ঠোঁট উলটে, ছোট পিসি তুমি এখনও কিছুই বোঝ না।
অমনি সুপ্তোত্থিতের মতো জেগে উঠেছে মন। মন ঢুকিয়ে দিয়েছে মত্তহস্তীর শুড় বুকের মধ্যে। কোথায়, কোথায় ভালবাসা। কাকে বলে? কে ওকে ভালবাসবে। নাকি ভালবেসেছে! সে কে, কে?কার সামনে ওর ভিতর-দুয়ারের রং হয়ে উঠেছিল শিবানীর মতো রহস্যময়ী, লজ্জাবিব্রত বিচিত্র ভঙ্গি।
নিজেকে দেখল সুমিতা কলেজ প্রাঙ্গণে। ওই যে, ওই হিরন্ময় নাকি! সেই ছেলে? থার্ড ইয়ার, বিজ্ঞানের হিরন্ময়, অবাক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে সুমিতাকে। চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিলে ও তো রাজেনদার চেলা। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। ওদের নেত্রী সুগতাদির বোন বলে কেমন যেন একটু সম্ভ্রম করে সুমিতাকে। কখনও জামার হাতা বন্ধ করবে না, রাখবে হাত গুটিয়ে। চুলগুলি ওর চরিত্রের মতো, আঁচড়ালেও সাপের মতো ফণা তুলে থাকবে কপালের কাছে। সবসময়েই দ্রুত, ব্যস্ত, বকবক করছে। হাত মুঠি পাকিয়ে উত্তেজিতভাবে বলছে, কলেজ কর্তৃপক্ষের এ বিজাতীয় মনোবৃত্তি আমরা কিছুতেই সহ্য করব না।
সুমিতার দিকে চোখ পড়লেই ঠোঁটের কোণে একটি অস্পষ্ট হাসির আভাস ফুটে ওঠে। অনেক দিন নিজে এসেছে সুমিতার সই নিতে, কলেজের বিষয় বলতে। ডেকে নিয়ে গেছে কফি হাউসে। কফির গন্ধে, সিগারেটের ধোঁয়ায় রুদ্ধ বাতাস, অজস্র কণ্ঠের কলকলানির মধ্যে হিরন্ময়ের দীপ্ত স্বর হঠাৎ মিষ্টি হয়ে উঠেছে, কফি খাবে তো?
আগে হিরন্ময় আপনি বলত। কী যে হাসি পেত সুমিতার। সুমিতা কফি খেয়েছে, আর হিরন্ময় বকবক করে গেছে। কী যে বলেছে, মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেনি সুমিতা। হিরন্ময়ের দৃষ্টির সামনে লজ্জাবিব্রত হাসি নিয়ে, চোখ নামিয়ে রেখেছে ও। যদি সে সময়ে পড়ন্ত বেলার রোদ পড়ত ওর মুখে, তা হলে কি শিবানীর মতো দেখাত ওকে। ও বলত নাকি, সে তো আমাকে ভালবাসে।
কিন্তু কই, শিবানীর মতো বুকের ভিতর থেকে তো কেউ কিছু বলে ওঠে না। কিছুই তো মনে হয় না ওর হিরন্ময় সম্পর্কে। কেবল হঠাৎ লজ্জা করে ওঠে।
তবে কি সুমিতারই সহপাঠী সেই বিনয়, সে খুব সেজেগুজে আসে; কোঁচা লুটিয়ে অধ্যাপকদের মতো পাঞ্জাবি পরে। কলেজের অনুষ্ঠানে গান গায় গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে। আর এদিক-ওদিক খুঁজে ঠিক সুমিতার কাছে বসে বলে, আপনার ভাল লেগেছে?
সুমিতা লজ্জায় হাসে নিঃশব্দে। ঘাড় নেড়ে জানায়, হ্যাঁ। গলার কাঁপানো শুনে সত্যি কেমন মজা লাগে সুমিতার। যখন হ্যাঁ বলে, তখন সুমিতার দিকে কেমন বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বিনয়। তখন আরও লজ্জা করে সুমিতার। পায়ের স্লিপার দিয়ে মাটি ঘষতে থাকে নিচু চোখে। আর বিনয় গান সম্পর্কে নানান কথা যায় বলে।
এই কি তবে সেই? কিন্তু কই, বুকের মধ্যে তো সুমিতার কোনও সাড়া-শব্দ নেই। ওর নম্র লজ্জা তো উচ্চারিত হয়ে উঠছে না সেই ভাষায়, ভালবাসা! তবে ফোর্থ ইয়ারের সেই গল্প লিখিয়ে ছেলেটি নাকি? যার চোখের দিকে তাকালে সুমিতাকে আঁচল ঘষতে হয় বুকে। কী চাউনি। কী নাম যেন ওর। আশীষ! চিলের মতো ছোট তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু ভাবে ঢুলুঢুলু। ওর সামনে পড়লেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে সুমিতা। আর সেই মুহূর্তে কেমন একটু হাসি ফুরিত হয়ে ওঠে ঠোঁটের কোণে। তারপর আড়ালে এলেই ভ্রু কুঁচকে ওঠে ওর। আলাপও আছে আশীষের সঙ্গে। কিন্তু কেন ও তাকায় অমন করে?
ও-ই কি সেই? কিন্তু কোনও উচ্ছ্বাস তো নেই। বরং বিব্রত বিরক্তি বোধ করে। তবে তো কত লোকই ওইরকম করে তাকিয়েছে, ট্রামে বাসে।
আচ্ছা, সেই লোকটি নয় তো, গত বছরে যে ট্রামের ভিড়ে ওর বুকের কাছ ঘেঁষে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সারাক্ষণ। কিংবা যে ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে বাসে জায়গা ছেড়ে উঠে পড়েছিল? একটি সশ্রদ্ধ মিষ্টি গলা, আপনি বসুন। সে?
বেচারি সুমিতার এ কী দুর্দৈব জীবনের ও মনের। ছুটে গেল পড়ার টেবিলে। আড়াল থেকে দেখল বাবার ভীত ব্যাকুল মুখ, বড়দির দৃপ্ত গতিভঙ্গি, দিকহারা স্রোতস্বিনী মেজদিকে। এ সবকিছুর মধ্যে বুকের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়েছে পুরুষেরা।
বুকের ওই দুর্বিনীত অনুভূতি দাঁড় করিয়ে দিল সুমিতাকে, মৃণালের সামনে। মৃণালদা! সুদীর্ঘ একহারা, টানা টানা চোখ মৃণালদা ওকে অনেকটা বন্ধুর মতো দেখে। বলে, তোমার চেহারাটি ঠিক সুজাতাদির মতো হয়ে উঠেছে।
সুমিতা হাসে লজ্জিত মুখে। মৃণালদা বলে, বড় হয়ে উঠলে তুমি। কীসব অর্থহীন কথা। বলে, সেদিন তোমাকে স্কোয়ারের সামনে, স্টপেজে দেখে চিনতেই পারিনি।
কথার মধ্যে কী একটা সুর, যেন মৃণালদার সামনে সুমিতা মেজদির মতোই একটি বড় মেয়ে। বলে, চলো, সংসদের সাধারণ সভায় যাই, যাবে?
লজ্জিত হেসে ঘাড় নাড়ে সুমিতা, যাব।
বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মৃণালদা। ওর নামে নানান রকমের কানাঘুষা চলিত আছে ছাত্রদলে। হিরন্ময় বলেছে, মৃণাল মদ খায়, পিছনে ঘোরে মেয়েদের। ওর স্বদেশি করার পিছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে নিশ্চয়ই। হঠাৎ একেবারে সাধু সেজে বসেছে লোকটা।
হিরন্ময়ের কথা শুনে রাগ হয়েছিল ওর। মৃণাল যে মেজদির সঙ্গে সুমিতাদের বাড়ি যায়। বাবার সঙ্গে, রবিদার সঙ্গে, বাড়ির সকলের সঙ্গেই, ওর কিছু অন্তরঙ্গতা আছে। মিটিং করে, বক্তৃতা দেয়, ছাত্র নেতাদের মধ্যে নামও দেখা যায়।
তবু ওর বুকের ভিড়ে যখন মৃণালদার মূর্তি দেখতে গেল, অবাক হল, ভয় পেল, মাথা নেড়ে উঠল হেসে, না না না। মৃণালদাকে ও শ্রদ্ধা করে, কথা শুনলে লজ্জা পায়। কিন্তু ওর সুপ্তোত্থিত বুকের আলোয় মৃণালদা নেই একেবারেই। সেখানে অস্পষ্টতা আর অপরিচয় ছাড়া আর কিছু নেই।
তবে কে? রাজেনদা? শান্ত কিন্তু রূঢ়। চোখের চাউনিতে কেমন একটি কঠিন নিষ্ঠুরতা, তবু যেন বিষণ্ণ। রাজেনদা হাসলে অবাক হয়ে দেখতে হয় সেই হাসি। এমন শিশুর সারল্য লুকিয়ে থাকে কোথায়? মেজদি ওর সামনে যেন ভক্তিমতী শিষ্যা, কিংবা দুজনের বন্ধুত্বের তল অতল গভীরে। ওই একটিমাত্র লোক যার সামনে মেজদিকে কেমন যেন বিব্রত, অপ্রতিভ, কোমল এবং থরো থরো মনে হয়। মেজদি যখন রাজেনদার কাছে, মৃণালদা তখন অস্পষ্ট ছায়ার মতো মেজদির পেছনে। যখন একলা মৃণালদার সঙ্গে মেজদি, তখন মেজদি সেই রাজেনদার সামনের মেয়েটি নয়। আরও গম্ভীর, কিন্তু একটি অস্পষ্ট হাসির আভাস কাঁপে ওর পাতলা রক্তাভ ঠোঁটের কোণে। তখন রাজেনদাকে অস্পষ্ট দেখে সুমিতা।
ছি ছি, সুমিতার বুকের মত্ত রক্তধারা রাজেনদাকেও বাদ দিলে না। যাকে ও দূর থেকেই দেখেছে বেশি, সে ওর সঙ্গে আজ পর্যন্ত তিনটি-চারটির বেশি কথাও বলেনি। সুমিতার উত্তাল হৃদয়, সভয় শ্রদ্ধায়, পাশ কাটিয়ে এসে, দূর থেকে তাকিয়ে দেখল পর্বতপ্রমাণ বিশাল রাজেনদাকে। মনের কোথাও তো শিবানীর সেই ভালবাসার লজ্জাজড়িত হাসির ছোঁয়া নেই সুমিতার মুখে।
যত ভয়, যত কান্ন, ততই এই প্রমত্ত খেলায় কেউ বাদ গেল না। কেউ নয়। এমনকী, পাশের বাড়ির তাপসীর দাদা নবেন্দুও নয়। তাপসীদের বাড়িতে কয়েক বার গিয়েছে সুমিতা। নবেন্দু ওকে তাকিয়ে দেখে দুর থেকে। বয়স খুব বেশি নয় ওর, ভাবটা মস্তবড়। সামনে গেলে এমন অদ্ভুতভাবে তাকায়, যেন দার্শনিকের স্থির ভাবলেশহীন ঠাণ্ডা দৃষ্টি। সুমিতা ওর চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু নবেন্দুর ভাবখানা যেন, ছোটর সঙ্গে ছোট কথা ওর মুখেই আসে না। তবে ওরকম করে কী দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে। চশমার লেন্সের ফাঁকে কেমন একটি বোবা দুর্বোধ্য দৃষ্টি, অথচ ঠোঁটের কোণটা বেঁকে থাকে একটু হাসির মতো। কিংবা, ছেলেটার ঠোঁটই অমনি, কে জানে।
তাপসী একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগেরে আমার দাদাকে?
সুমিতা অবাক হয়ে বলেছিল, আমার? কেমন আবার ভালই।
অথচ সুমিতা কেমন একটি অস্বস্তি বোধ করে নবেন্দুর সামনে। কিন্তু তার মধ্যে হৃদয়ের কোনও আবেগ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না। যাকে খুঁজছে মনের গোপন গুহায়, তার দেখা পাওয়া গেল না। যাদের মূর্তি নানান রকমে ভেসে উঠল চোখের সামনে, তারা সকলেই ওর পরিচিত। কেউ কেউ নিকটতর, আপনজনের মতো। কিন্তু সেই মানুষটির দেখা পেল না।
ভাবল, তবে কে, কে সেই মানুষ। কোন জনারণ্যের ভিড়ে মিশে আছে সে।
তাকে দেখতে পেল না সুমিতা, চিনতে পারল না বটে? কিন্তু, এতগুলি ছেলের একটিকেও হারাতে পারল না মন থেকে। সবাই রইল ভিড় করে চারপাশে। নতুন যৌবনের খেলাঘরে এরা যেন সব এক একটি পুতুল। সাজানো রইল সব সুমিতার মনের রং-এ রঙিন হয়ে। কাউকে যেন প্রাণ ধরে ছাড়তে পারবে না।
.
শেষ পরীক্ষা শেষ করে যেদিন সুমিতা বেরিয়ে এল কলেজ থেকে, ফায়ূন শেষ হয়ে এসেছে। বাতাসে চৈত্রের উন্মাদনা। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথেও শুকনো পাতা এসেছে উড়ে। রাস্তার ধারে, পার্কে, কলেজে, হাসপাতালের গাছগুলি প্রায় পত্রহীন। তাতে আসলে নীল আকাশটাকেই কেমন ন্যাড়াবৈরাগী মনে হচ্ছে।
সুমিতার চোখে মুখে ক্লান্তি মাখানো। কিন্তু চলার ভঙ্গিতে তার চিহ্নও নেই। বাস স্টপেজে এসে দাঁড়াতেই, বিনয় এসে দাঁড়াল ছুটে। গায়ক বিনয়। বাসে উঠে বসল ওর পাশেই। বলল, আপনাকে দেখেই উঠলুম। একটু এসপ্ল্যানেড যাব। কেমন হল পরীক্ষা?
সুমিতার লজ্জা করছিল। বলল, ভাল নয়। আপনার?
বিনয় খুব গম্ভীরভাবে বলল, ফেল করব।
বিনয়ের বলার ভঙ্গিতে সুমিতার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু কোনওরকমে চেপে বিনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ভীষণ ছেলেমানুষ মনে হতে লাগল বিনয়কে। কী যেন বলতে চাইছে সুমিতাকে। ওর আঁচলটা বারবার বিনয়ের গায়ে পড়ছে। কপালের সামনের চূর্ণ কুন্তল প্রায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে বিনয়ের মুখে।
হঠাৎ বিনয় বলল, আমার দ্বারা লেখাপড়া কিছু হবে না। যদি পাশ করি, পড়ব। ষোলো আনাই ফেল করবার চান্স। তা হলে এই শেষ। আর কোনওদিন…
বিনয়ের নিম্নস্বর কেমন ভারী শোনাল। ওর দিকে কাত হয়ে ফিরে তাকাল সুমিতা। দুজনের দেহের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠল। বড় করুণ আর দুঃখী মনে হচ্ছে বিনয়কে।
বিনয় আবার বলল, আর হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা-ই হবে না।
অবাক হয়ে বলল সুমিতা, কেন?
বিনয়–আর তো কলেজে আসব না।
সুমিতা কলকাতায় তো থাকবেন?
বিনয় করুণ গলায় বলল, থাকলেও আপনার সঙ্গে তো দেখা হবে না।
সুমিতা এবার সত্যি হেসে ফেলল। বিনয়কে ওর তুমি করে বলতে ইচ্ছে করছে। হয়তো বিনয় ওর সমবয়সি, কিংবা বছরখানেকের বড়। কিন্তু ছেলেরা সবাই এত ছোট। একটি জায়গায় ওরা কোনওসময়েই বোধ হয় বড় হয় না। বলল, কেন, আমাদের বাড়িতে আসবেন আপনি।
বিনয়: আমি?
বিনয়ের কপালে কোঁচকানো বিস্ময় দেখে অবাক হল সুমিতা। বলল, তাতে কী হয়েছে? আমাদের বাড়িতে তো সবাই যায়।
হঠাৎ কৃতজ্ঞতায় কেমন ছটফট করে উঠল বিনয়। কী বলবে ভেবে পেল না। একটু পরে বলল, সুগতাদি কিছু মনে করবেন না তো?
আরও অবাক হয়ে বলল সুমিতা, কেন?
সহসা নতুন অনুপ্রেরণায় বিনয় ওর গানের বিষয় তুলে ফেলল। বেশি দূর এগুবার আগেই, এসে পড়ল এসপ্লানেড। তাতে ওর ক্ষোভ হল না। যেন কী পেয়েছে বুক ভরে। তাকে বুকে নিয়ে পালাতে পারলেই বাঁচে। নামবার আগে, বিদায় নিল সুমিতার কাছে।
সুমিতার বুকের ভিতরে বিস্মিত হাসির নিঃশব্দ নিক্কণ। কী হয়েছে বিনয়ের। এমন করে তো কোনওদিন আসেনি সুমিতার কাছে।
ভালবাসা! এই কি ভালবাসা। আশ্চর্য! সে যে কী এক অস্পষ্ট দুর্বোধ্য জিনিস, যার স্বরূপ কিছুতেই ধরা পড়ছে না ওর কাছে। সে কেমন করে, কখন আসে, কেমন করে তাকে টের পাওয়া যায়, হৃদয়ের কী বৈলক্ষণ্য ঘটে, কিছুই বোঝে না। বুঝলে, ওর নিজেকে চিনত, বড়দিকে বুঝত। বুঝত, কী ছিল বড়দির আর গিরীনদার মাঝে। ভালবাসাকে জানতে চায় সুমিতা।
বাড়ি এসে দেখল, বাবা আর রবিদা বসে আছেন বাগানে দুটি চেয়ার নিয়ে। মুখোমুখি দুজনে। কথা নেই কারুর মুখে। যেন কীসের এক উৎকর্ণ প্রতীক্ষায় নীরব দুজনেই।
সুমিতার মনে হয়, ওঁদের দুজনের এই মুখোমুখি নৈঃশব্দের মধ্যে ভালবাসা একটি গুঢ় অর্থ নিয়ে রয়েছে দাঁড়িয়ে। ওদের গভীর নৈঃশব্দের অতলান্তিক শূন্য পরিবেশের সবটাই যেন ভালবাসায় ভরা।
.
০৮.
সহজের সাধনা যে কী বস্তু, সুমিতা তা জানে না। জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করা যে আবার সাধনার বিষয়বস্তুও হতে পারে, এ ধারণাও নেই। কিন্তু নিজের জীবনকে, মনকে, হৃদয়ের অনুভূতিকে বড় সহজ বলে মনে হল। আর যত অসহজ সর্পিল, ঘোরালো প্যাঁচালো জীবন ওর চারপাশে রয়েছে ঘিরে। এই অসহজ জীবন ছড়িয়ে আছে ঘরে বাইরে। বাবা, দিদিরা রয়েছে ঘরে, বাইরে রয়েছে যুদ্ধ ও দাঙ্গা-প্রহার-জর্জরিত, ভারত স্বাধীন হওয়ার সংশয় ও উত্তেজিত সংসার, বিচিত্র ও অচেনা সব মানুষ, যাদের কথা ও কাজ সুমিতা ভাল বোঝে না। আর একদিকে নিজের গোপন কাঁচা প্রাণের সরলতা। সেখানে সবই সহজ। কোনওকিছুই ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। কোনও অন্ধকার নেই, অস্পষ্টতা নেই, নেই কোনও দুঃখ কষ্ট ভয়। এখানে ওর বিবেক বুদ্ধি সবই কখনও মুগ্ধ, বিহ্বল। এ যেন সব কর্তব্যের বাইরে, কীসের এক খেলা। এখানে আছে কখনও খেলার আমেজ ও উত্তেজনা। এখানে মনের এই বিশ্বমাঝে জুড়ে আছে বিনয় হিরন্ময় আশীষেরা। সুমিতা নিজে এখানে যা বোঝে, তাই বলে। যতখানি খুশি, ততখানি হাসে। যা করতে ইচ্ছে করে, তাই করে। ভাবছিল, এইটিই বুঝি ওর ভালবাসার স্বরূপ উদঘাটনের ক্ষেত্র।
এ দুয়ের মাঝে, কোনওখানেই মনের ফাঁকি ছিল না একটুও। সংসারের অসহজ কঠিন বেড়া থেকে নিজেকে মুক্ত করে আনতে পারেনি, কোনওদিন চায়নি। সেখানে রয়েছে ওর স্বজনেরা। আর এই সহজ জীবনের অদৃশ্য নির্মেঘ আকাশের আকর্ষণটাও রেহাই দিল না।
এ দুয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে, চারপাশের কঠিন পরিবেশের মধ্যে ও একটি সতেজ পাতাবাহারের গাছ। সূর্যস্নাত সেই গাছের পাতায় পাতায় কত রং। এই তো স্বাভাবিক, পাতাবাহারের এ বর্ণবাহুল্য। ওর এই বর্ণাঢ্য ঝড়ে উড়ে উড়ে আসে কত ছোট বিহঙ্গেরা। যার যা রং, সবই এখানে এসে মিশে যায়। সবাই উড়ে আসে, দল বেঁধে কিংবা একা একা। খানিকক্ষণ কিচিরমিচির করে, একটু মনকাড়া শিস দেয়। তারপর, চারপাশের কঠিন বেড়াটির দিকে নজর পড়লেই পালায়। কিংবা অল্প বাতাসেই যখন পাতাবাহারের ঝাড় দোলে, পালায় তখন ভয়ে। আবার আসে, হয়তো স্বপ্ন দেখে, বাসা বাঁধবে জোড়া শাখার সঙ্গমে। বাসা আর বাঁধা হয় না। স্বপ্নই থেকে যায়। তবু, যত বার আসে, স্বপ্ন দেখতেই থাকে।
কিন্তু, এ দুয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে সুমিতা নিজে কোনও স্বপ্নই দেখে না। কোনও স্বপ্নই দেখা দেয় না এসে। শুধু হাসে, খেলার হাসি।
পাতাবাহারের এই বর্ণালী সমারোহ নিয়ে কবে যে সুমিতা এ খেলায় মেতে গেছে, নিজেরই খেয়াল নেই। শুধু জানত না, আসলে এটা ওর যৌবনের প্রাক্মধ্যাহ্নের বাঁকা। ছায়ার লুকোচুরি খেলা। এখন সবটাই বাঁকা। কারুর চোখে চোখ পড়লে, চাহনি বেঁকে যায় বেঁকে যায় হাসি। এমনকী, চলনটুকুও বাঁকা হয়ে যায়।
ওর বয়সি সব মেয়েরই এমন হয় কি না, তা ও দেখেনি, জানেও না। নিজেরই বাঁকা ভঙ্গিটুকু নিজে জানে না। এ যে ওর সেই রাশ না মানা হৃদয়ের কারসাজি। একে রুখতে জানে না, এর স্বরূপও চেনে না। কিন্তু ভালবাসার স্বরূপটি সুমিতা আবিষ্কার করতে চায় নিজে।
পরীক্ষার ফলাফল বেরুবার আগেই বিনয় এসে পড়ল একদিন। কী বিপদ সেই বেচারির। যাকে সবচেয়ে বেশি ভয়, সেই সুগতার সামনেই পড়ে গেল প্রথম দিন। সুগতা তো অবাক। ওদের ছাত্রসংঘে কমবেশি যাতায়াত বিনয়ের। তা ছাড়া, ছাত্রসভায় কয়েক বার গানও শুনেছে। তাই পরিচয় কিছুটা ছিল। তবে, এই ধুতি-পাঞ্জাবির বহর দেখে, একটুখানি বোধ হয় বিরক্তিই বোধ করত সুগতা। বললে, বিনয় যে? কী মনে করে?
যেন বাঘিনীর মুখে পড়েছে। তার উপরে মুখ হয়ে উঠেছে লাল। কোনওরকমে বলল, এই এলুম একটু
সুমিতা তখন শোবার ঘরে, ওর খাতার পাতা বিচিত্র সব লিখনে ভরে তুলেছে। ওইটি নিরালায় সবচেয়ে সঙ্গী। অথচ তার মধ্যে কোনও ধারা নেই, ছন্দ নেই, কাহিনী গল্প কিছু নয়, কিছু আঁকাবুকি মাত্র। কোথাও হঠাৎ লেখা হয়েছে, আমার পিতা শ্রীযুক্ত মহীতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরেই রবিদার নামটিই হয়তো লেখা হয়ে গেছে চার বার। পরমুহূর্তেই বড়দি ও গিরীনদা। তারপর উলটোদিকে হয়তো মেজদির নাম, আবার বড়দি তারপরেই পর পর রাজেনদা, মৃণালদা। ঝোঁকটা সেখানেই থেমে থাকেনি। বিনয় হিরন্ময় আশীষ নবেন্দু তাপসীতে গিয়ে ঠেকেছে। এক কোণে ছোট্ট করে শিবানীর নামটিও লেখা হয়ে গেছে। এমনি আঁকাবুকির মাঝখানে, বাগানের দিকে জানালায় দৃষ্টি পড়ে গেছে সুমিতার। বাগানের ছোট লোহার দরজা, তারপরে সরু একটি গলি পশ্চিম দিকে, উত্তর দক্ষিণে লম্বা। যেখানে জানালার মুখোমুখি একটা ঝাড়ালো কতবেল গাছের ছোট ঘোট পাতার ঝালরে হেলে-পড়া সূর্যকিরণ! অপরাহ্নের সোনালি রোদ সেখানে হাসছিল যেন চোখের জল চেপে। অমনি ওর বাবার কথা মনে পড়ে গেছে। এইবার বাবা আসবেন ঘরের বাইরে। বসবেন হয়তো বাগানে কিংবা বারান্দায়, আর বারবার চোখ তুলে তাকাবেন গেটের দিকে। সুমিতা আপনমনে কলম চালিয়ে লিখে গেছে, বড়দি! তুমি যেন কী! আবার বড়দিটা যেন কী!
ও যখন এমনি করে নিজের মনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে খাতার পাতায়, সেই সময় বাইরের ঘরে বিনয় দরদর করে ঘামছে সুগতার সামনে। কে জানত, এমনি হঠাৎ বিনয় এসে পড়বে। পরে বুঝেছিল সুমিতা, মেজদি ওকে এমনি এমনি আটকে রাখেনি। আশা করছিল, বিনয়কে দিয়ে হয়তো রাজেনদা কোনও সংবাদ পাঠিয়েছে। কিংবা মৃণালের কোনও খবর নিয়ে এসেছে বিনয়। হিরন্ময়কে দেখলে সে বিস্মিত হত না, কিন্তু এ কথাই ভাবত। আশীষকেও তাই। কিন্তু বিনয়কে কোনওদিনই আসতে দেখেনি।
সুগতা উদগ্রীব হয়ে উঠল ভিতরে ভিতরে। সলজ্জ বিনয়কে দেখে সে কিছুই বুঝতে পারল না। বলল, বসো।
বিনয় খুব সন্তর্পণে বসল একটি চেয়ারে। প্রায় এক মিনিট নীরবতার পরেও যখন মুখ খুলল না তখন পাখা খুলে দিয়ে মেজদি জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে বিনয়?
সহসা যেন চমকে উঠে বিনয় বলল, হ্যাঁ, সুমিতার সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছিলুম।
চকিতে একটু বিস্ময়ের ছায়া খেলে গেল মেজদির মুখে। বলল, ও! বসো তুমি, আমি ডেকে দিচ্ছি।
খবর পেয়ে সুমিতাও একটু অবাক হল। খবর দিয়ে মেজদিও যে ওর দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, সেটুকু বুঝে লজ্জা গেল বেড়ে। খাতাখানি ডেস্কের মধ্যে বন্ধ করে চলে যাচ্ছিল। মেজদি বলল, ও কী হচ্ছে? কাপড়চোপড় একটু ঠিক ঠাক করে যা।
তাও তো বটে। অথচ সুমিতা যে খুবই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, তা নয়। এখানে ওর ভয় নেই, ভাবনা নেই। গভীর গুরুতর কিছু ভাবতেও পারেনি। তাই নিজের দিক থেকে সাবধান হওয়ার কোনও কথাও মনে হয়নি। কিছু স্পষ্ট না হলেও, মেজদির ভাবখানা যেন সেই ডাচ-লেডি ফ্রকটি ছেড়ে ফেলা দিনের মতো নতুন কিছু। ওইটুকু ওকে বেকুব করে তুলল। কে অত সাবধানী মন নিয়ে ঢোকে খেলার আসরে।
বাইরের ঘরের পরদা সরিয়ে দেখল, মাথা নিচু করে বসে আছে বিনয়। সুমিতার মুখ দিয়ে আপনি বেরিয়ে এল, কতক্ষণ এসেছ?
বলে ফেলেও কী লজ্জা! বিনয়কে তো তুমি বলেনি কোনওদিন। কেমন করে ওর মুখ দিয়ে এসেছ বেরিয়ে এল। এক মুহূর্তের জন্যে বিনয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না। কিন্তু কী দোষ ওর। বিনয়কে দেখে ওর আপনি কিছুতেই আসল না যে মুখ দিয়ে। আর ঠিক, এই মুহূর্তে তো এক বারও আপনি শব্দটি মাথায় উদয় হয়নি।
বিনয় উঠে দাঁড়িয়েছে সুমিতাকে দেখে। কেমন একটু অপরাধের সুরেই বলল, এই আসছি। হঠাৎ কি মনে হল
সুমিতা বলল, তাতে কী। বসুন।
বিনয়ের লজ্জা-দীপ্ত মুখখানিতে হঠাৎ ছায়া ঘনিয়ে এল। কেমন একটি বিষণ্ণ অথচ থরোথরো ভাব। বলল, তুমি বললে ক্ষতি কী?
ভীষণ হাসি পেতে লাগল বিনয়ের ভাবভঙ্গি দেখে। ও যদি ধুতি পাঞ্জাবি না পরে, হাফ প্যান্ট আর শার্ট গায় দিয়ে আসত, তা হলে ঠিক মানাত বোধ হয়। তবু নিজের লজ্জা ও অপ্রতিভ কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না সুমিতা। বলল, ক্ষতি আবার কী। কোনওদিন বলিনি, তাই
বিনয় তেমনি মাথা নিচু অবস্থায় চকিত চোখে তাকিয়ে বলল, আজ এক বার তো বলা হয়ে গেছে।
সুমিতা নিঃশব্দে হাসল। তারপর বসল দুজনেই। কিন্তু কারুরই কোনও কথা নেই মুখে।
এই নৈঃশব্দের মধ্যে শুধু যে কুণ্ঠা ও সংকোচ রয়েছে, তা নয়। এও যেন একটি খেলা। ভালবাসার খেলা কি না, সুমিতা জানে না। ভাল লাগার খেলা। দুজনেই আড়ষ্ট। সুমিতা একটু কম। উত্তেজনা ও আবেগের কেন্দ্রবিন্দুটি আসলে বিনয়।
আবার চোখাচোখি হল দুজনের। দুজনেই হাসল। হেসে বিনয় উৎসুক কুণ্ঠিত চোখে দেখতে লাগল ঘরের চারপাশে। বইয়ের আলমারি, রেডিয়ো, পরদা ঢাকা অর্গান। অর্গানটির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বিনয় জিজ্ঞেস করল, কে গান করেন?
সুমিতা অবাক হয়ে বলল, কোথায়?
: এ বাড়িতে?
: কেউ নয় তো।
অর্গানের দিকে তাকিয়ে বলল বিনয়, তবে ওইটি কী জন্যে?
সুমিতাও আজ অর্গানটির দিকে তাকিয়ে অবাক হল। সত্যি, ওটা যে কার, কেন, সুমিতা নিজেও তা পরিষ্কার জানে না। শুনেছে, বড়দি একসময়ে বাজাত। কিন্তু কোনওদিন গান গাইতে শোনেনি। ওইটি চিরদিন ধরেই সাজানো আছে বাইরের ঘরে। এক সময় গিরীনদা অপটু হাতে বিচিত্র রাগিণী তুলেছেন। সেটুকু নেহাত-ই হাসাবার জন্যে। কেউ বেড়াতে এলে হয়তো গান করেছেন। উপরোধে পড়ে বড়দিকে দু-একবার বসতে দেখেছে। তা ছাড়া, লখনৌয়ের বুটি-পরদা ব্যতীত, ওখানে আর কোনওদিন উল্লেখযোগ্য কিছু চোখে পড়েনি।
খানিকটা বিব্রত, লজ্জিত হয়ে হেসে বলল সুমিতা, কারুর জন্যেই নয়, এমনি আছে। তুমি বাজাবে?
মুহূর্তে পাংশু হয়ে উঠল বিনয়। সন্ত্রস্ত গলায় বলে উঠল, না না, আমি ও সব বাজাতে শিখিনি এখনও। তা ছাড়া আমার ও সব বাজাতে একদম ভাল লাগে না।
কেন?
বিনয় গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের দেশের গানের সঙ্গে, এই যন্ত্র ঠিক খাপ খায় না।
বিনয়ের গাম্ভীর্য দেখে সুমিতার হাসি সহসা যেন বাঁধভাঙা হয়ে উঠতে চাইল। মনে হচ্ছে, ও যেন গম্ভীরভাবে বইয়ের পড়া বলছে। তবু একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল সুমিতা, আমাদের দেশের গান মানে?
বিনয় তেমনি গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের দেশ, মানে, এই দেশ, এই বাংলা। অর্থাৎ ভারতবর্ষ।
বিনয়ের সমস্ত কথার মধ্যেই কেমন একটু বালকের আড়ষ্টতা। কথা বলে চারদিকে তাকিয়ে, আবার বলল, চলো বাইরে যাবে?
সবটাই কেমন ছেলেমানুষিতে ভরা। কিন্তু, ভাল লাগছে বিনয়কে। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, বড় অস্বস্তি বোধ করছে ও। সুমিতার কথা বলবার আগেই এমনভাবে বাইরে যাওয়ার কথা বলল যে, না গেলে ও কিছুতেই মুখ খুলতে পারছে না। সুমিতার চোখের উপর দিয়ে চকিতে ভেসে গেল বাবা আর মেজদির মুখ। লজ্জার সঙ্গে একটু ভয়ও যে না ছিল, তা নয়। তবু দাঁড়িয়ে উঠে বলল, বসো, আমি জামাকাপড় পরে আসি।
ভিতরে এসে দেখল, মেজদি বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে বসে চা খাচ্ছে বাবার সঙ্গে। ওদিকে এক ঝলক দেখে, ফিরতে গিয়ে হঠাৎ সুমিতার মনটা যেন ফিক ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। বাবাকে ছেড়ে ও যাবে কেমন করে? বড়দি বেরিয়ে গেছে সেই বেলা তিনটের সময়। মেজদিও বেরুবে। বাবা বসে থাকবেন একলাটি।
সুমিতা তো জানে, বড়দি মেজদির কাছে থাকার জন্যে বাবা কেমন লালায়িত হয়ে থাকেন। যখন দুজনেই চলে যায়, তখন নজর পড়ে রুমনির দিকে। ওকে কাছে ডেকে নিয়ে, দু-এক কথার পরেই ঘুরে ফিরে আসে সেই বড়দি মেজদির কথা। মেজদির চেয়েও বড়দির-ই বেশি। তার মাঝে যদি এসে পড়েন রবিদা, বাবা যেন স্বর্গ পান হাতে। অথচ দুজনের কেউ-ই যে খুব বেশি কথা বলেন, তা নয়। যা-ও বা বলেন, সেগুলি রবিদার রাজনীতির কথাই অধিকাংশ। বাবা সে সব কথা শোনেন এক শিশুর বিস্ময় নিয়ে। নিজেই বলেন, আশ্চর্য রবি, আমার জন্ম বটে কলকাতায়, কিন্তু এ দেশের আমি কিছুই প্রায় জানিনে।
আর কখনও কখনও আসেন তাপসীর বাবা, রিটায়ার্ড ডেপুটি।
হয়তো সবশেষে বাবার মনে পড়বে সুমিতাকে। কিন্তু এই সবশেষের জন্যে ও নিজেও থাকে উন্মুখ হয়ে। কেমন করে যাবে বাড়ি ছেড়ে।
কিন্তু বিনয়কে বসিয়ে রেখে এসেছে বাইরের ঘরে। এখন যদি গিয়ে বলে, যাব না, তবে কী ভাববে ও। ভাববে, আমাকে বুঝি বাড়ি থেকে বেরুতে দিতে চায়নি। ছি ছি, সে যে বড় বিশ্রী।
এই দোটানার মাঝে, সুমিতা জামাকাপড় বদলে নিল। দু পাশের এলায়িত বিনুনি দুটি খুলে খোঁপা বাঁধতে গিয়েও থেমে গেল। আর সেই মুহূর্তে আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে হল, বিনয়ের চেয়ে ও অনেক, অনেক বড়।
জামাকাপড় পরে বেরিয়ে আসতেই শোবার ঘরে মুখোমুখি হল মেজদির সঙ্গে। একটু অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছিস?
ঈষৎ রক্তাভা দেখা দিল সুমিতার মুখে। বলল, একটু বেরুব।
মেজদি বিস্মিত নিরাশার সুরে বলল, ও!
সুমিতার সবচেয়ে বড় লজ্জা, মেজদি না জানি কী ভাবছে। বলল, কিছু বলছ মেজদি?
মেজদি চিন্তিতভাবে বলল, মৃণালের আসার কথা ছিল একবার।
সুমিতা সহজভাবে বলল, কিছু বলতে হবে?
মেজদি ঠিক বিরক্ত নয়, একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলল, না, তুই যা আমি মৃণালের বাড়ি হয়েই যাব একেবারে।
বলে বেরিয়ে গেল। সবদিক থেকেই সুমিতার চারপাশের সর্পিল ও কঠিন সংসারের মাঝে খেলার মাধুর্যটুকু ম্লান হয়ে এল। এক মুহূর্তের জন্যে বিনয়ের কথাও গেল ভুলে।
নিজের মনের সবটুকু সুমিতা আজও বুদ্ধি দিয়ে অনুভব করতে পারছে না। জানে না, নিজের জীবনকে কোন প্রান্তরে, কোন বেড়ায় দিয়েছে লতিয়ে। জীবনের আঁকাবাঁকা সর্পিল শিকড়খানি বিস্তৃত হয়েছে কোন গভীরতর প্রদেশে। সেখানে আর যাই হোক, বিনয়কে দেখতে পাচ্ছে না ও। কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওর চারপাশে ভিড় করে এল অন্য জগৎ। কিন্তু সুমিতার এ বয়সের একটি দাবি আছে। সে দাবি ওর প্রাক মধ্যাহ্নের সকালবেলার চঞ্চলতা।
নিজেকে ঠেলে নিয়ে এসে দাঁড় করালে বাবার কাছে। বাবা বললেন, কোথায় যাচ্ছ রুমনো সাহেবা?
সুমিতা বলল, আমি একটু বিনয়ের সঙ্গে বেরুচ্ছি।
বিনয়? অবাক হয়ে বললেন মহীতোষ, সে আবার কে?
: আমাদের সঙ্গে পড়ে। যাব বাবা?
মহীতোষ যেন চিন্তিত অনুসন্ধিৎসু চোখে কয়েক নিমেষ দেখলেন সুমিতার মুখের দিকে। পরমুহূর্তেই প্রসন্ন হেসে বললেন, যাও, ঘুরে এসো।
সুমিতা করুণ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বড় একলা একলা কাটবে বাবা। মহীতোষের বুকের মধ্যে কতখানি টনটন করে উঠল, সে কথা জানে না সুমিতা। খালি দেখল, বাবার সেই ব্যথাচাপা হাসিটুকু। বললেন, বেশ তো তুমি কাছে পিঠেই বেড়িয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো, কেমন?
ঘাড় কাত করে চলে গেল সুমিতা। বিনয় ততক্ষণে আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে প্রায়। সুমিতাকে দেখেই, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাবে?
সুমিতা বলল, তবে?
মাথা নিচু করে বিনয় বেরিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। রাস্তায় পড়তেই খই ফুটতে লাগল বিনয়ের মুখ দিয়ে। বলল, পরশু দিনই তো পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হবে। ফেল করব নিশ্চয়ই। মাকে বলে রেখেছি, পড়াশুনো আমার হবে না। আমি গান নিয়েই থাকব।
যেন একটি শিশু বলছে, আমি শুধু খেলা নিয়ে থাকব। কত যে বক বক করতে লাগল বিনয়, সব কথার খেই ধরাও সম্ভব হল না সুমিতার পক্ষে। খানিকটা এসেই একটা পার্কের এক কোণে বসে পড়ল দুজনে। তখনও কথা বলেই চলেছে বিনয়, জান, আমি বীরভূমে ঘুরে এলুম সাতদিন।
: কেন?
: গান সংগ্রহ করতে গেছলুম। বাউল গান। রাজেনদা আমাকে বলেছেন
রাজেনদা? চমকে উঠল যেন সুমিতা। কোন রাজেনদা?
বিনয় অবাক হয়ে বলল, আমাদের রাজেনদা, মানে, সুগতাদি, রাজেনদা, মৃণালদা
বুঝেছে, বুঝেছে সুমিতা; সেই মুহূর্তেই ওর মনে একটু সন্দেহ হল, মেজদি আর রাজেনদা আর মৃণালদাকে নিয়ে বোধ হয় আজকাল আলোচনা হচ্ছে ছাত্রমহলে। হয়তো অনেক দিন থেকেই হচ্ছে। হিরন্ময়ের সঙ্গে কথার ফাঁকে এ সন্দেহ পূর্বেও হয়েছে সুমিতার।
রাজেনদার কথা ওকে বেশি উৎসুক করে তুলল। বলল, কী বলেছেন রাজেনদা?
বিনয় যেন ভক্তিতে কেমন গদগদ হয়ে উঠল। বলল, আমি রাজেনদাকে সব বলেছি, কী আমি চাই, কী আমি করব। রাজেনদা আমাকে বললেন, দেখ বিনয়, আমি নিজে গান গাইনে, শুনতে ভালবাসি। এক সময়ে এ সব বিষয় নিয়ে কিছু পড়াশুনো করেছি। তাতে বুঝেছি, ওটি একটি সাধনার বিষয়বস্তু। তুমি সম্পন্ন ঘরের ছেলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, গানের নামে এরা শেষ পর্যন্ত বদখেয়ালি হয়ে যায়। শিখতে চাও শেখো। আমায় যখন বলছ, তখন আমি সবসময়েই বলব, যদি ভালবাস, পবিত্রভাবে নিতে পার, তবে এ বৃত্তি নাও। আর ভালবাসা পবিত্রতা,এ সব কোনওকিছু দিয়েই লোকের কাছে প্রমাণ করা যায় না। ওটা তোমার নিজের মনের অনুভূতির বিষয়।
ঠিক যেন মুখস্থ বলছে বিনয়। রাজেনদাকে সুমিতা চেনে, কিন্তু জানে না। বিস্মিত কৌতূহলে কথাগুলি শুনছিল। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, ওদের দুজনের কেউ-ই রাজেনের কথার মর্ম উপলব্ধি করতে পারছে না। বিনয় আবার বলল, আমি বললুম, রাজেনদা, আমি খুব সিরিয়াসলি এ পথে আসতে চাই। রাজেনদা বললেন, বেশ তো, তবে দেখো ভাই, এদেশে অনেক গান-পাগলা ছেলের ভিড়। ওই পাগলামির বিড়ম্বনাটা আর বাড়াতে যেয়ো না। আর গানের পথে যাওয়াটা কিন্তু ঘরে বসে পড়া মুখস্থ করা নয়। হ্যাঁ হ্যাঁ করে গলা সাধলেই গান হয় বলে আমার মনে হয় না। বললেন, কিছু বুঝতে হয়। অতুলচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, এঁদের যোগাযোগ ছিল এদেশের মাটির সঙ্গে। ভালবাসতেন এদেশের ধূলিকণাটিকেও। দেশের মর্মোপলব্ধি যার হয় না, চারটে রেকর্ডের পুরনো ভাঙা শব্দতেই সে দুদিনে শেষ হয়ে যায়। সে বড় বিশ্রী! যার মূল নেই, তার আগাও নেই। এই যে কীর্তন বাউল, এগুলো শুধু সম্প্রদায়ের গান নয়। এর মধ্যে যে তত্ত্ব আর আবেগের মিলন হয়েছে, সেটুকু এদেশের মানুষের অন্তর্নিহিত মনের রস দিয়ে তৈরি হয়েছে। ও সব আর ভক্তির ডোরে বাঁধা নেই। এগুলো আমাদের স্বদেশের। ক্লাসিকও তাই। অনেকে বলে, ক্লাসিকে যেমন বুদ্ধির গতি আছে, বাউল কীর্তনে তা নেই। আমার মনে হয়, এ কথা ভুল। বুদ্ধি এতে খুব আছে, না হলে তত্ত্বের বুলিকে কেউ অমন আবেগের সুরে ঢেলে দিতে পারে। অবশ্য এইটুকুই সব নয়। এইটুকু বললুম, তোমার আপন সত্তাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে। যদি এ পথে আসতে ইচ্ছে হয়, এ সব বোধ হয় তোমাকে ভাবতে হবে। বাঙালির পুরনো জাত্যভিমান যেমন ভাল নয়, শুধু ইঙ্গ বঙ্গগিরি তার চেয়ে বেশি অসহ্য। দেশের এই অন্তর্নিহিত মনসন্ধানের দায়টা তোমার বিবেকের। সেই বিবেকটার কথাই বললুম, তাকে কোনদিকে চালাবে সেটা এখন তুমিই জান। কিন্তু খবরদার, তোমার গানের বিষয় নিয়ে আমি এ সব বলেছি, তা যেন আর কাউকে বোলো না। জিজ্ঞেস করলে তাই বললুম।
বিনয় থামল। কিন্তু সুমিতার বিস্মিত শ্রদ্ধাভরা বুকে এক বিচিত্র আলো ছায়ার খেলা। কী যেন বুঝতে চাইছে এ কথাগুলি থেকে, বুঝতে পারছে না।
পরমুহূর্তেই ওর বুকের মধ্যে এক ছোট মেয়ে নেচে উঠল করতালি দিয়ে। ভাবল, রাজেনদা তো আমাদেরই ঘরের মানুষ হবে। মেজদি নিশ্চয়ই রাজেনদাকে বিয়ে করবে। নিশ্চয় নিশ্চয়! মেজদি যেমন মেয়ে, তার সঙ্গে রাজেনদাই উপযুক্ত। এক বার ভেবেও দেখল না, শুধুমাত্র একজনের মুখের দুটি কথা শুনে, তাকে ও মেজদির স্বামীরূপে চিন্তা করতে আরম্ভ করেছে।
আবার হিংসে হতে লাগল বিনয়কে। যে মানুষ ওর আপনজনের এত ঘনিষ্ঠ, তাকে সুমিতার চেয়ে বেশি চিনে নিয়েছে বিনয়। কিন্তু সেদিন কি খুব বেশি দুরে, যেদিন ও অনেক বেশি জেনে নিয়ে শোধ তুলবে বিনয়ের উপর? এ সংসারে পুরুষদের মধ্যে বাবাকে ছাড়া, রবিদা ওর মনের কথার মানুষ। সেই রবিদার পাশে রাজেনদাকে দাঁড় করিয়ে দিলে।
তারপরে হঠাৎ সুমিতা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, কিন্তু রাজেনদা বলতে বারণ করেছেন, তুমি বলে ফেললে যে?
বিনয় এতক্ষণ ছাত্রের মতো কথা বলেছে। এবার লজ্জিত কিশোরের মতো বলল, তোমাকে ছাড়া তো কাউকে বলিনি। বলার জন্যেই তো এসেছিলাম। কিন্তু বীরভূমে গিয়ে আমার কিছু হল না। প্রথমে গিয়ে শিউড়িতে
সে কথা শুনল না সুমিতা। জিজ্ঞেস করল, তুমি রাজেনদার কথা সব বুঝেছ?
ওর বিস্মিত কৌতূহল দেখে লজ্জা পেল বিনয়। বলল, না।
: তবে এত কথা মনে রাখলে কী করে।
ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গেল বিনয়। ভাবেনি, এমন প্রশ্ন আবার কেউ করতে পারে।
অসহায় বিস্ময়ে বলল, কী জানি।
সুমিতা এক নিমেষ বিনয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তবে তুমি যে বলছ পরীক্ষায় নিশ্চয়ই ফেল করবে?
: কেন?
: যার এত মুখস্থ হয়, সে বুঝি ফেল করে?
:না, সেজন্যে নয়।
: তবে?
বিনয় মাথা নিচু করে বলল, তোমাকে বলব বলে মুখস্থ করে ফেলেছিলুম।
উদগত হাসিটা কিছুতেই চাপতে পারল না সুমিতা। বিনয়ও হাসল। পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল ওদের, সব সংকোচ কাটিয়ে রাজেনদার কথাগুলিই যেন কাছাকাছি করে দিলে দুজনকে।
ইতিমধ্যে আলো জ্বলে উঠেছে রাস্তায়। পথে ভিড় বেড়েছে, পার্কে জমছে গুচ্ছ গুচ্ছ নরনারীর জটলা। সারাদিনের দাবদাহের পর সবাইকে ঘর খালি করে বার করে নিয়ে এসেছে দক্ষিণা বাতাস। কুলপি বরফ আর বাদাম ভাজাওয়ালারাও ছুটে এসেছে, সন্ধ্যার সঙ্গী হয়ে।
ওদের দুজনের গায়ে পড়েছে রাস্তার আলোর একটু রেশ। সুমিতা লক্ষ করছিল, এই অস্পষ্ট আলোয় কেউ কেউ বিস্মিত-মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে যাচ্ছে ওকে। কিছু অনুসন্ধিৎসাও আছে সেই চোখগুলিতে। সুমিতার ঠোঁটের কোণদুটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর সেই প্রাকমধ্যাহ্নের বাঁকা ছায়ার খেলা এইটি। এই চাউনি দেখলে, বাইরে বিব্রতবোধ করে। ভিতরে একটি দুর্বোধ্য খুশির হাসি কিছুতেই চেপে রাখতে পারে না।
মুখ ফেরাতেই চোখাচোখি হল বিনয়ের সঙ্গে। বিনয় ওই পার্কচারীদের মতোই বিস্মিত-মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল। সেখানে কোনও কৌশল নেই, প্রচেষ্টা নেই চেপে রাখবার। সুমিতার চোখের সামনে এখন সারা বিশ্বটাই এমনি বিস্মিত-মুগ্ধ। আর ও সেই বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সলজ্জ হাসি নিয়ে।
বলল, চলো, যাওয়া যাক।
চমক ভাঙল বিনয়ের। বলল, হ্যাঁ, চলো।
উঠল দুজনেই, তবু সুমিতার মনে হল, কী যেন বলা হল না বিনয়ের। রাস্তার মোড়ের কাছে এসে থামল দুজনেই। সুমিতা বলল, আবার এসো একদিন।
সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল বিনয়, কবে?
সুমিতা বলল, যেদিন তোমার খুশি। তা ছাড়া এবার তো কলেজে দেখা হবে।
আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে, ঘাড় নেড়ে চলে গেল বিনয়।
গেটের কাছে এসে অবাক হয়ে দেখল সুমিতা, সারা বাড়িটা অন্ধকার। বারান্দায় আলো নেই। ঘরের জানালাও অন্ধকার। কেউ বাড়ি নেই নাকি?
গেট পার হয়ে বারান্দায় উঠে ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবে, ডাক শুনতে পেল, রুমনো এলি?
চমকে ফিরে দেখল, বারান্দার এক কোণে বাবা একলা বসে আছেন ইজিচেয়ারে। সামনে টি-পয়ের উপরে শূন্য কাপ। সুমিতা কাছে গিয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা।
বাবা ওকে টেনে নিলেন কাছে। ইজিচেয়ারের হাতলের উপরে বাবার গা ঘেঁষে বসল সুমিতা। কী যে ছিল বাবার এই কাছে টেনে নেওয়ার মধ্যে। সুমিতার বুক ঠেলে কান্না উঠতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, বাবা, কেউ আসেনি বাড়িতে?
বাবা বললেন সস্নেহে হেসে, এই যে তুমি এসেছ রুমনো সাহেবা। তোমার বন্ধু চলে গেছে?
: হ্যাঁ।
: কদ্দুর গেছলে?
: এই সামনের পার্কে বসেছিলুম।
কিন্তু, এ সব কথাতেও সুমিতার মন প্রবোধ মানল না। ওর বুকের মধ্যে আবর্তিত হয়ে কী একটি কথা উঠে আসতে চাইছে বারবার। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না। সেই অদৃশ্য ছোট লতাটির ভয় লেগে রয়েছে মনে। তবু ওর রক্তের মধ্যে তোলপাড় করে উঠল। নিজেরই অজান্তে ডাক দিয়ে বসল, বাবা।
: বলো রুমনো।
এ যেন খাদের কিনারায় এসে টলোমলো ভাব। পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারল নিজেকে সুমিতা। বলল, বাবা, বড়দির জন্যে তোমার বড় কষ্ট।
মহীতোষ সুমিতার পিঠে হাত রেখে বললেন, তোমাদের সকলের জন্যেই আমার কষ্ট হয়।
: তুমি বড়দিকে কিছু বলল না কেন?
: কী বলব বলো। সে কত বড় আঘাত পেয়েছে তার জীবনে। তুই এখন হয়তো সব বুঝবিনে। উমনো যে কিছুই স্থির করতে পারছে না, কী করবে ও? সেই তো আমার ভয়, ও কী করবে? ও যে আমাকে কিছুই বলে না।
বলে অনেকক্ষণ চুপচাপ রইল দুজনেই। তারপর আবার বললেন মহীতোষ, তোমরা সবাই বড় হয়ে যাচ্ছ। এখন ভাবি রুমনো সাহেবা, তোমাদের প্রতি আমার যা কর্তব্য ছিল, ঠিক করেছি কি না। খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখা শুধু নয়, তোমরা জীবনটাকে ঠিক গড়তে পেরেছ কি না।
বলে এক মুহূর্ত নীরব থেকে আবার বললেন, এখন আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব, তোমরা সবাই কে কোন ধারায় চলেছ। তুমি, তোমার মেজদি, বড়দি। তোমাদের দুঃখ দেখলে আমার লাগবে। কিন্তু বড় হয়ে যখন তোমাদের নিজেদের মতামত তৈরি হবে, তার উপরে তো আমি সবসময়ে কথা বলতে পারব না। কেবল তোমাদের বুঝতেই চেষ্টা করব।
সুমিতার চোখের জল বাধা মানল না। আবার লজ্জা করতে লাগল, যদি এ কান্না বাবা টের পেয়ে যান। ভাবল, কেউ-ই জানে না, কে কোথায় চলেছে। ওদের তিন বোন, তিন দিকে চলেছে। নিজের কথাও যেমন সুমিতা জানে না, কোনদিকে ওর গতি, তেমনি জানে না দিদিদের প্রবাহপথ।
.
০৯.
তারপর আবার অপেক্ষা।
ছোট্ট পরিবার, চার জন মানুষ। সকল কাজের মাঝেও সারাদিনে দু বার খাবার টেবিলে চারজনের দেখা হওয়াটা এ পরিবারের নিয়ম। সে নিয়মে ফাটল ধরেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। দিনের বেলা যদিও বা দেখা হয়, রাত্রি বেলার ভাঙা আসর তার শোধ তুলে নেয়। নিয়মটি আসলে নিয়ম নয়। খাবার টেবিলের সভা ছিল এ বাড়ির সব আনন্দ ছাপিয়ে ওঠা নিত্য উৎসবের হিল্লোল। না ছিল তার সময়ের হিসেব, না বিষয়বস্তুর অভাব। এখন বড়দি-ই এ আসরে অনুপস্থিত থাকে অধিকাংশ দিন। মাঝে মাঝে মেজদিও। কিন্তু চারজনের উপস্থিতি সত্ত্বেও উৎসবের সুরটি আর বাজে না তেমন করে। কথা হয়। এ কথা-সেকথা। তাও শোনা যায়। কিন্তু সুমিতা জানে ওগুলি আসলে ছলনা।
এ বাড়ির কাছ থেকে একটু দূরে করপোরেশনের গ্যাসপোস্ট। সে আলো এসে পড়েনি কাছেপিঠে। পথচারীরা যেন কোন অদৃশ্যলোকের অধিবাসী। ছায়ার মতো অস্পষ্ট মূর্তি চলাফেরা করছে। কোন বাড়িতে রেডিয়ো বাজছে গাঁক গাঁক করে। যেন বাড়ি নয়, দোকানঘর। তবু এরই ফাঁকে শোনা যাচ্ছে ঝিল্লিরব। বাতাসে ছড়াচ্ছে স্বর্ণচাঁপার তীব্র গন্ধ। চাঁপার এ তীব্র গন্ধের মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে একটু চাপা ব্যথা। কেন যে এমন হয়, তা জানে না সুমিতা। মনে হয়, সব ফুলের গন্ধেই বুকের মধ্যে। কেমন একটু আশ্চর্য বেদনার আভাস থাকে মিশে।
হঠাৎ একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল গেটের সামনে। গাড়ির দরজা খোলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-গলা শোনা গেল, না ভাই, আজ আর নয়। এমনিতেই রাত্রিবেলা ড্রাইভ করতে বড় ভয় লাগে। আর তুই তো এখন…অস্পষ্ট হয়ে গেল গলার স্বর। তারপর একটু চাপা হাসির ওপচানো ঝংকার। আবার, টা-টা–
সুমিতা বলে উঠল চাপা গলায়, বাবা, অমলাদির গলা শোনা গেল। বড়দি এসেছে।
সুমিতার গলায় কৌতূহল ও ব্যাকুলতা। বাবাও যেন চমকে উঠে মুহূর্তের মধ্যে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন, সেটুকু টের পেল না ও। মহীতোষ শান্তভাবে বললেন, হ্যাঁ। তুমি উঠে বারান্দার আলোটা জ্বেলে দাও।
আলো জ্বেলে দিতেই বড়দি চমকে তাকাল সুমিতার দিকে। কী এক ভাবনার ঘোরে যেন ও ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে আসছিল। এক মুহূর্তের জন্যে অপ্রস্তুত ও বিব্রত হয়ে পড়ল বড়দি। বলল, কী করছিলি ওখানে?
বলতে বলতেই দৃষ্টি পড়ল বাবার দিকে। আর একবার চকিত লজ্জায় ও অস্বস্তিতে একটু ছায়া ঘনিয়ে এল সুজাতার মুখে।
সুমিতার জবাবের আগেই বাবা বলে উঠলেন, বসেছিলুম আমরা। আয়, আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছিস।
বাবা সহজ হওয়ার চেষ্টা করেন, বড়দি পারে না কিছুতেই। অন্ধকারে লক্ষ পড়েনি আগে। বাবার ইজিচেয়ারের পাশে ছিল হাতির পায়ের আসনটি। বড়দি গিয়ে বসল সেখানে।
সেই যে বড়দি কোর্টে যাওয়ার দিন সাদা শাড়ি-ব্লাউজ পরেছিল, তারপর থেকে রঙিন কিছু গায়ে ওঠেনি আজ পর্যন্ত। এটা চোখে ঠেকেছিল সকলেরই। কিন্তু বলেনি কিছু কেউ। যে জিজ্ঞেস করতে পারত সোজাসুজি সেই মেজদিও কিছু বলেনি।
অথচ জোড়-মেলানো জামা-শাড়ির অভাব নেই। নিরঙ্কুশ শুভ্রতায় বড়দি কোনও দিন খুশিও ছিল না। প্রচুর সাপ্তাহিক আর মাসিকে এখনও জবরজং হয়ে আছে ওর বেঁটে পুরনো আলমারিটা। সে সবই দেশি-বিদেশি জামাকাপড়ের হালফ্যাশান, নতুন ডিজাইন, কলার কম্বিনেশন আর আধুনিক স্টাইলের ছবিতে ভরা। তার কাট-ছাঁট, তার আসল সৌন্দর্যের সিক্রেসি, (কীসের যে আবার সিক্রেসি আহা! একেবারেই জানে না বুঝি সুমিতা?) নিপুণভাবে আঁকাজোকা লেখা আছে ম্যাগাজিনগুলিতে।
কিন্তু সে সব রঙিন জামাকাপড় হঠাৎ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে বড়দি। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক দিন টের পেয়েছে সুমিতা, উনি দুঃখ পান। আর রবিদার বড়দি, যিনি বিধবা হয়েছেন, তাঁর মূর্তিটা বারবার ভেসে ওঠে কেন যেন সুমিতার চোখে। যদিও তিনি ঘুরিয়ে পরেন সাদা সিল্কের কিংবা সুতির থান। বড়দি পরে পাড়জোড়া সাদা শাড়ি। তবু সেই চিরদিনের চেনা বড়দি বলেই কীসের একটি উদ্দেশ্যমূলক অসামঞ্জস্য বুকের মধ্যে ব্যথার চমক দেয়।
বাবা বললেন, অমলা এসেছিল বুঝি?
বড়দি হাতের ভ্যানিটি ব্যাগে নখ ঘষতে ঘষতে জবাব দিল, হ্যাঁ।
বাবাঃ ওকে ডেকে আনলিনে কেন? অনেক দিন আসেনি আমাদের বাড়িতে।
বড়দির মুখ ক্রমেই লাল হচ্ছে। সুমিতা জানে, বড়দি আর অমলাদির সম্পর্ক নিয়ে একটি ভীত-বিস্মিত প্রশ্ন প্রতিনিয়ত দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। শুধু বাবা নয়, ব্যাপারটি মেজদি নিয়েছে আরও তীব্র সংশয়ান্বিতভাবে। ওর কথা থেকেই টের পাওয়া গেছে, বিষয়টি এখন আর শুধু ঘরের নয়। বাইরের সকলেই, চেনা অচেনারাও নাকি কথা বলছে এই নিয়ে। আশ্চর্য বাইরের লোক! তারা কেন বলছে, কী বলছে, কিছু জানে না সুমিতা শুধু শুনতে পাচ্ছে, স্ক্যান্ডাল! স্ক্যান্ডাল! কীসের স্ক্যান্ডাল, কে জানে।
সংসারে এত ভয়, এত সংশয়! বড় অল্পদিনের মধ্যে এই জগৎ তার বিচিত্রের দরজাগুলি একটি একটি করে খুলে দিচ্ছে সুমিতার চোখের সামনে। বোধ হয় এমনি হয়। যখন খোলে তখন পর পর খোলে অনেকগুলি। সেগুলি পার হয়ে মানুষ আবার দাঁড়ায় এসে নতুন দরজার সামনে।
বড়দি জবাব দিল বাবাকে, ওর একেবারে সময় নেই হাতে, তাই চলে গেল। সুমিতা বুঝতে পারছে, বাবা ছটফট করছেন অনেক কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে। কিন্তু বড়দি কেমন যেন নিরুৎসুক, নিরাসক্ত। বাবার ভয় করছে। সহজভাবে জিজ্ঞেস করে, কোথায় আবার বড়দির মনকে দেবেন আরও কঠিন করে, সেই ভয়। তবু বললেন, অমলার স্বামী আছেন?
বড়দি: হ্যাঁ।
সুমিতা দেখতে পাচ্ছে ওর দুরুদুরু বুক নিয়ে, বাবার হাত বারবার মুঠি পাকাচ্ছে আর খুলছে। বড় অসহায় মনে হচ্ছে বাবাকে। অথচ বড়দির কী সংক্ষিপ্ত নিরাসক্ত জবাব। তবু বাবা জিজ্ঞেস করলেন, শুনেছিলুম ওর স্বামীর ব্যবহার খুব ভাল নয়। এখন কেমন যাচ্ছে জানিস?
বড়দি যেন খুব স্বাভাবিকভাবে হেসে বলল, কই, অমলাকে দেখে তো কিছুই বুঝতে পারিনে।
এমন সময় মেজদি ওর মস্ত বড় ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে ঢুকল বাড়িতে। অমনি হাসি ও শঙ্কার একটি যুগপৎ আলোছায়া খেলে গেল বাবার মুখে। হাসিটুকু মেজদির আগমনে। শঙ্কাটুকু অমলাদির প্রসঙ্গ। বাবা যেন মেজদির সামনে সেটুকু চেপে রাখতে চান। এ প্রসঙ্গ উঠলে এখুনি কোন কথায় কোন কথা দাঁড়িয়ে যাবে। ভয় মেজদির জন্য নয়। বড়দি যদি ব্যথা পায়। বাবা বলে উঠলেন, আজ দেখছি। সন্ধ্যাবেলাতেই ফুলহাউজ। বড়দির দিকে ফিরে বললেন, যা দুজনে জামাকাপড় ছেড়ে নিয়ে যা।
মেজদি বড়দির দিকে তাকিয়ে বলল, বড়দিও এসে পড়েছ?
দুজনে হাসল চোখাচোখি করে। দুজনে একসঙ্গে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বড়দি বলল, তুই বোধ হয় এবারো ফেল করবি ঝুমনো?
মেজদি বলল, মাথা খারাপ তোমার!
বড়দির তরল গলা শোনা গেল, যা চরকিবাজি চলছে তোর এখনও।
এমনি দু-চারটে কথাবার্তা হয় প্রায় নিত্যই। আর এখন পর্যন্ত সত্যি সন্ধ্যাবেলাও নয়। রাত্রি প্রায় আটটা বাজে। তবু এত শীঘ্র এমন করে ভরে উঠল বাড়িটি যে, লহমার মধ্যে একটি খুশির আবহাওয়া পড়ল ছড়িয়ে। বাবার মুখের হাসিটুকু হয়ে উঠেছে অনাবিল।
বাবা বলে উঠলেন, যাও রুমনো সাহেবা, তুমিও বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে নাওগে। বিলাসকে বলো খাবার দিতে।
খাবার টেবিলে বসে পুরনো কথা উঠতে লাগল। প্রবাসের বন্ধুবান্ধবী, তাদের নানান গল্প। সুমিতা নিজেই এক ফাঁকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল রেডিয়োর বোতামটা। তারপর একে একে যে যার ঘরে চলে গেল শুতে।
সুমিতা ঘুমোতে পারছে না কিছুতেই। ও আজ কথা বলতে চায়। এখুনি বলতে চায়। মেজদির কাছেই বলতে চায়। ভয় ঠিক লাগছে না মেজদিকে। অভ্যাসের সংকোচটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ভিতরের লজ্জারুণ হাসিটুকু কাঁপছে ঠোঁটের কোণে। উশখুশ করছে শুয়ে বসে। কখনও আঁচল কষছে কোমরে। গলায় ফাঁস কষছে বিনুনি টেনে।
মেজদি বইয়ে মুখ দিয়ে পড়ছে। ওরই টেবিল-লাইটের ঢাকনা খুঁড়ে প্রদোষের অস্পষ্টতা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। কিন্তু মেজদির মুখখানি দেখতে পাচ্ছে সুমিতা পরিষ্কার। মেজদি কি পড়ছে? যেন মনে হচ্ছে, কিছু ভাবছে বইয়ের উপর ঝুঁকে। ভেবেছে হয়তো রুমনি ঘুমোচ্ছে কিংবা চোখ বুজে চেষ্টা করছে ঘুমোবার। এত উশখুশ একটুও টের পাচ্ছে না।
একটু টের পেয়েছে সুগতা, কিন্তু বিশেষ কিছু ভাবেনি। তারপর এক সময়ে জিজ্ঞেসও করল, কীরে রুমনি, ঘুমোচ্ছিস না?
বুকের ভিতরে দুরুদুরু করে উঠল সুমিতার। বলল, না, ঘুম আসছে না। মেজদি বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বলল, দিনের বেলা ঘুম দিয়েছিস বুঝি কষে!
সুমিতা ভ্র তুলে জবাব দিল, বা-রে! তুমি তো এলে বেলা তিনটেয়। তখন কি আমি ঘুমোচ্ছিলুম?
তবে?
তবে? এইটুকুনি তত শুনতে চেয়েছিল সুমিতা। তবে? তারপর?…তারপর তো সুমিতার পালা। কিন্তু বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এক চরম প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সুমিতা। ও কিছু জানতে চায় মেজদির কাছে থেকে। সেটা আসলে ওর অনধিকার এবং দুঃসাহসের বিষয়। সোজাসুজি নয়। মেজদির কাছে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করতে চায় খালি। তার মাঝখান দিয়ে জেনে নিতে চায় মেজদির মন। আর মনের এই চাতুর্যটুকু বোধ হয় নিজেও জানে না। তা হলে ভাবত, ছি! আমার সকলি গরল ভেল।
উপুড় হয়ে দ্রুত-স্পন্দিত বুক বালিশে চেপে বলল, জান মেজদি, বিনয়টা এমন অদ্ভুত কথা বলে।
মেজদির চোখে একটি চকিত তীক্ষ্ণতা ঝিলিক দিয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কী বলে?
সুমিতা যে মেজদিকে একটুও বোঝেনি তা জানে না। মেজদি যে ওর কথা ভেবেই অবাক হয়েছে। তা বোঝেনি।
সুমিতা বলল, বিনয় বলছিল, ও গান শিখবে।
কিন্তু এর মধ্যে অদ্ভুত কী আছে, বুঝতে পারল না সুগতা। ওর ভ্র দুটি কুঁচকে উঠল। সুমিতা আড়ষ্ট বোধ করছে। আসলে বিনয়ের কথা তো বলতে চায়নি। অদ্ভুত কথাগুলি রাজেনদার। মেজদি বলল, তাই নাকি?
সুমিতা: হ্যাঁ। আর জান, রাজেনদার কথা বলছিল।
বলে মেজদির দিকে তাকাল। সুগতাও অবাক অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বলল, রাজেনের কথা? কী বলল?
সুমিতা হঠাৎ উঠে বসে রাজেনদার কথাগুলো এলোমেলোভাবে বলতে লাগল। বিনয়ের মতো সুমিতার মুখস্থ হয়নি। অর্থ বুঝলে নিজের মতো করে বলা যায়। অর্থও বোঝেনি। কথার সঙ্গে কথার কোনও মিল নেই, মানেও বোধ হয় হয় না।
তারপরে বলল, আমি রাজেনদার কথা ঠিক বুঝতে পারিনি মেজদি। কিন্তু বিনয়ের মুখ থেকে শুনে আমার এমন অদ্ভুত লাগল।
সহসা মেজদিকে কেমন একটু বিব্রত বোধ হল। রাত্রে অস্পষ্টতা না থাকলে সুমিতা দেখতে পেত মেজদির মুখের রক্তাভা। রাজেনদার কথা যে ও কেন সহসা এমন করে মেজদির কাছেই পেড়ে বসেছে, সেইটি বুঝেই সুগতার এত লজ্জা। সুমিতা চোখ ফেরাল না মেজদির মুখ থেকে। ওই বিব্রত ভাবটাই যেন অনেকখানি নির্ভয় করে দিল সুমিতাকে। আবার বলল, আচ্ছা মেজদি রাজেনদাকে দেখে কেমন রাগি লোক মনে হয়। বিনয়কে এত কথা কেমন করে বললেন?
সুগতা বিস্মিত হেসে বলল, রাজেন রাগি লোক তোকে কে বললে?
সুমিতা বলল সলজ্জ হেসে, কেউ বলেনি। আমি ভেবেছিলুম তাই।
আশঙ্কা ছিল সুমিতার, হয়তো এক কথায় ওকে নীরব করে দেবে মেজদি। কিন্তু রাশভারী মেজদির অন্তস্রোতের যে নিঝরিণীটার সন্ধান পেয়েছিল, তাকে এখন নানান ভঙ্গিতে বয়ে যেতে দেখল মেজদির চোখে-মুখে, হাসিতে, কথায়। মেজদির সঙ্গে দূরত্বটুকু দূর হয়ে গেছে। অনেক কাছাকাছি এখন দুজনে।
বাতির ঢাকনার অস্পষ্ট আলোয় সুমিতার মতো মেজদির চোখ দুটিও চক চক করছে। দুজনেই এখন সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দুজনকে। বাইরে নিঝুম হয়ে এসেছে শহর। ঝিল্লিস্বর তীব্র হয়েছে। যেন ওটা এই কলকোলাহলমুখর শহরের বিদেহী আত্মা। সুবিশাল এই নগরীর ভারে ও পেষণে তার তাহর্নিশ ক্রন্দন দিনের কোলাহলে থাকে ঢাকা পড়ে। যত রাত্রি বাড়ে, ততই তার কান্না ওঠে সপ্তমে। দূর রাস্তায় মাঝে মাঝে ছুটন্ত গাড়ির শব্দ আসছে ভেসে। সুগতার চোখে-মুখে চমকাচ্ছে সকৌতুক হাসি। আবার বলল, কেন ও রকম ভাবলি?
এবার লজ্জার পালা সুমিতারই। বলল, কী জানি! এমন গম্ভীর আর এমন একদৃষ্টে তাকান। কথাগুলো যেন কেমন করে বলেন।
সুগতা নিঃশব্দে হেসে উঠল ভারী মিষ্টি ভঙ্গিতে। বলল, সে বোধ হয় তুই ওকে কাজকর্মের সময় দেখেছিস। একদৃষ্টে ও কারুর দিকেই তাকায় না, চিন্তিত হলে রাজেনকে ওরকম মনে হয়। ও তো খুব হাসে।
বলতে বলতে এক মুহূর্তের জন্যে সুগতা যেন মনের কোন অতলে ডুবে গেল। তারপরেই যেন হঠাৎ বড় লজ্জা করে উঠল। বলল, নে রুমনি, হয়েছে, এবার শুয়ে পড়।
অমনি শুয়ে পড়ল সুমিতা। বালিশে-চাপা মুখের একপাশ থেকে ওর একটি চোখ তবু মেজদিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
বাইরে ঝিঁঝির ডাক। ভিতরে কড়িতে ঝোলানো পাখা ঘোরার ফরফর শব্দ। সুমিতা দেখল মেজদির রুক্ষ চুল উড়ছে। গায়ের আঁচলটি অনেকখানি টেনে নামিয়েছে বাতাস। এখনও যেন টানছে একটু একটু করে। রাত্রের ঢিলে জামা বেশ খানিকটা ঝুলে পড়ে বুকের অন্তর্বাসের বাতাস কাঁপুনিটুকুও দেখা যাচ্ছে। দেখছে, আস্তে আস্তে ছায়াঘন হয়ে উঠছে মেজদির মুখ। কিংবা ওর নিজেরই চোখে ঘনিয়ে আসছে ঘুমের ছায়া। কেন যেন মনে হতে লাগল সুমিতার, প্রকৃত ভালবাসা প্রত্যক্ষ করছে ও।
হঠাৎ মেজদি আবার ডাকল, রুমনি।
বলো।
–মৃণাল এসেছিল কি না সন্ধ্যায় শুনেছিস?
না তো। বাবা তো কিছু বলেননি। সুমিতার চোখ দুটি তখন সত্যি জুড়ে আসছে। কিন্তু মেজদির গলার স্বরে কেমন একটি দ্বৈত সুরের রেশ ওর কানে বাজতে লাগল। কেমন একটু আনমনা, অস্বস্তি, সংশয়ের সুর কথার মধ্যে।
কতক্ষণ কেটে গেছে জানে না সুমিতা। হঠাৎ পাশ ফিরতে গিয়ে চোখে লাগল আলোর রেশ। তাকিয়ে দেখল, বাতি জ্বলছে তেমনি। কিন্তু মেজদি নেই চেয়ারে। ঘাড় কাত করে দেখল, বাগানের দিকে জানালা খোলা। মেজদি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
বাইরে দেখা যাচ্ছে সেই কতবেল গাছটি। বাইরে কি চাঁদের আলো উঠেছে! না কি রাত্রি গভীরে গ্যাসপোস্টের আলো আপনাকে ধীরে ধীরে বিস্তৃত করে দেয় রহস্যময়ীর মতো। স্বর্ণচাঁপার গন্ধ তীব্রতর হয়ে উঠেছে। তীব্র সুখ ও তীব্র বেদনার গন্ধ।
মেজদি দাঁড়িয়ে আছে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে। অবাক হল সুমিতা। কী করছে মেজদি ওখানে। ডাকতে গিয়েও চুপ করে গেল সুমিতা। একেবারে অকস্মাৎ ওর বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল। মনে হল, মেজদি যেন এক অশেষ বেদনার ছায়ামূর্তি। ওর রুদ্ধদ্বার হৃদয়ের ঝরনা কোথায় এক জায়গায় এসে ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হয়ে উঠছে।
সুমিতার মনে হল, পাশের ঘরে বড়দিও ঠিক এমনি করেই দাঁড়িয়ে আছে জানালার গরাদ ধরে। মনে হয়, কে আসে রাত্রি করে। মানুষ নয়, অদৃশ্য এক বিচিত্র আত্মা। নিশীথের সুপ্তিমগ্নতাকে ছিঁড়ে ফেলে মানুষকে জাগিয়ে ফেরাই তার কাজ। সে এ ঘরে, পাশের ঘরে, হয়তো বাবার ঘরেও ঘুরে ফিরছে। হয়তো বাবাও এমনি করেই দাঁড়িয়ে আছেন জানালায়। জীবনের বহু দূরান্তের পথ পার হয়ে এসে পথ ঠেকে গেছে এই সায়াহ্নে।
হঠাৎ সুমিতার মনে হল হয়তো তাপসীও জেগে আছে পাশের বাড়িতে। বাগবাজারে জেগে আছে হয়তো শিবানী। আশ্চর্য। বড় বিচিত্রভাবে গোটা কলকাতার নানা দৃশ্য ওর চোখে ভাসতে লাগল। পথের ভিক্ষুক থেকে প্রাসাদপুরীর সুখী মানুষের ছবি। মনে হল একটি কলকাতা ঘুমোয় আর অনেকগুলি কলকাতা জেগে থাকে।
জীবন যেন ক্রমেই বহুব্যাপ্ত, সুদূরবিস্তৃত হয়ে পড়ছে সুমিতার কাছে। তার শেষ নেই, সীমা নেই। শেষ পর্যন্ত সে দৃষ্টিও স্পর্শের অগোচরে কোন মহাদিগন্তে কুয়াশা ঢাকা রয়েছে অশেষ রূপ নিয়ে।
সুমিতার বিশ্বাস, মানুষ এই মহাজীবনের আদিগন্ত রাস্তাটি ধীরে ধীরে পার হয়ে যায়। ও নিজেও যাবে। মেজদি যাচ্ছে, বাবা, আর বড়দিও।
চোখে ওর অবোধ অশ্রুর ইশারা, অথচ ঘুম ঘুম অচেতন আমেজ। মেজদি যেন টের না পায়, এমনি নিঃসাড়ে নিজের বেণী দুটি ঢাকা দিয়ে দিল চোখের উপর।
.
১০.
তিন দিন গেল না। নতুন ঘটনা ঘটে গেল।
বাইরের ঘরে বসে আনমনে খবরের কাগজ ওলটাচ্ছিল সুমিতা। বেলা প্রায় দশটা। বাবা ওঁর নিজের ঘরে বসে একটি অফিশিয়াল পত্রের জবাব দিচ্ছিলেন। এত দিন বাদে আবার হঠাৎ কী প্রয়োজন পড়েছে, কতগুলি বিষয়ের অনুসন্ধান করছে গভর্নমেন্ট। বাবার কাছে ফিরিস্তি চেয়ে পাঠিয়েছে। মেজদি বড়দি দুজনেই বাড়িতে।
বাইরের ঘরে দরজায় খট খট শব্দে সুমিতা ফিরে তাকাল। দেখল পরদার আড়ালে মুখ বাড়িয়েছে ডাকঘরের পিওন। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, একটা রেজিস্টারি চিঠি আছে।
কার নামে?
পিওন ভিতরে এসে চিঠিখানি বাড়িয়ে দিল সুমিতার হাতে। নাম দেখে একটু অবাক হল। বড়দির চিঠি, শ্রীমতী সুজাতা দেবী। কেয়ার অব মহীতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। রেজিষ্ট্রি স্লিপটা ওলটাইতেই ধক করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। গিরীনদার এটর্নি পাঠাচ্ছেন চিঠিখানি। পিওনকে বলল, একটু দাঁড়াও, সই করিয়ে নিয়ে আসছি।
পিওন গম্ভীর কোমল গলায় বলল, মাজিকে সই করে দিয়ে যেতে বলুন এখানে। চোখে তার সসংকোচ অসম্মতি রয়েছে চিঠি নিয়ে যাওয়ার।
চিঠি রেখে সুমিতা বড়দিকে ডেকে দিলে। তারপরে বাবার ঘরে গিয়ে চিঠির কথাটা না বলে পারল না।
বাবা এক মুহূর্ত চশমার ফাঁকে চেয়ে রইলেন চিন্তিতভাবে। তারপর হঠাৎ তাড়াতাড়ি উঠে বললেন, ও! এসেছে চিঠি? আচ্ছা–
বলে তাড়াতাড়ি পায়জামাটা একটু টেনে তুলে বাইরের ঘরে এলেন। সুমিতাও এসে দাঁড়াল দরজায়। বড়দি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে খামের উপরের লেখাগুলি। সহসা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিয়েছে ওর মুখে। টানা চোখের তরল স্রোতে অদ্ভুত দীপ্তি ঝকঝক করছে। চিঠি থেকে দৃষ্টি গিয়ে আটকে পড়েছে মেঝের উপর। মুখে দেখা দিয়েছে রক্তাভা। ঠোঁটের দু পাশ হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠেছে। চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হল বাবার সঙ্গে।
নিমেষমাত্র বড়দিকে লজ্জিত মনে হল।
চিঠিখানি বাড়িয়ে দিল বাবার হাতে। বাবা দেখলেন। মনে হল, দেখা হয়ে গেছে, তবু দেখছেন। সকলেই চুপচাপ, কতগুলি অস্বস্তিকর মুহূর্ত।
বাবা বললেন, সই করে দাও উমনো।
আবার চোখাচোখি হল দুজনের। লখনৌ সাদার ওপরে সাদা বুটি শাড়িটি বড়দির একেবারে বাঁয়ে সরে গেছে। তাতে যেন ওকে কেমন সুস্পষ্ট উদ্ধত মনে হচ্ছে। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল, তার কী দরকার আছে বাবা!
বাবাকে কেমন অপ্রতিভ করুণ মনে হচ্ছে। বললেন, দরকার আছে উমনো। আমাদের জানা দরকার, কীসের চিঠি এসেছে।
আর এক বার চোখাচোখি হল পরস্পরের। বড়দির চোখে বিস্ময় ও বিতৃষ্ণা। বাবার চোখে অনুনয়। যেন জানে দুজনেই, কী আছে চিঠিতে। বড়দি বলল, যা-ই থাকুক, আমার তাতে কোনও প্রয়োজন নেই। আমার বিশ্বাস, সমস্ত কিছুরই শেষ হয়ে গেছে, আর কোনও লেখালেখির দরকার নেই। জের টানলেই টানাটানি হবে। তাতে আমি আর কিছুতেই রাজি নই বাবা।
বড়দিকে কেমন শক্ত নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। বাঁ হাতের উপর দিয়ে এলিয়ে পড়েছে আঁচল। মুখ ওর ক্রমেই যেন দপদপিয়ে উঠছে। কিন্তু বাবাকে ভীরু আর আহত দেখাচ্ছে। মুখের রেখাগুলি উঠছে কেঁপে কেঁপে। বললেন, জের না টানলেও এ চিঠি তোমার দেখা কর্তব্য উমনো।
কর্তব্য?
–হ্যাঁ।
সুমিতার ভয় করছে। মেজদি এসে দাঁড়িয়েছে তখন দরজায়, সুমিতার পাশে। বড়দি আঁচলটি ঘাড়ের উপর তুলে দিয়ে ডেস্ক থেকে পেনসিল নিয়ে সই করে দিল। পিওনটি যেন বাঁচল। পালাল রিসিট নিয়ে, সেলাম দিয়ে।
বড়দি উত্তেজিত হাতে চিঠি খুলতে খুলতে দ্রুত তীব্র অথচ চাপা গলায় বলতে লাগল, জানিনে তুমি কোন কর্তব্যের কথা বলছ। যেখানে আমার কোনও কর্তব্যের লেশমাত্র নেই, সেখানে কেন তুমি কর্তব্যের কথা বলছ বুঝিনে। আমি জানি, কী এসেছে এই চিঠিতে
বলতে বলতে খাম খুলেই বার করে একটি টাইপ করা চিঠি। তার সঙ্গে পিন দিয়ে গাঁথা একটি বেয়ারার চেক। হাতের উপর চলকে-পড়া বিছের মতো সেগুলি ফেলে দিল বড়দি টেবিলের উপর। অপমানাহত ক্রোধরক্তিম মুখে, অসহ্য উত্তেজনায় পাশ ফিরে গিয়ে বসল সোফায়। বলল, আমি জানতুম, ও ছাড়া আর কিছু আসতে পারে না।
সুমিতা ভাবল, এ সময়ে ওর এ ঘরের মধ্যে ঢোকা উচিত নয়। কিন্তু মেজদির সঙ্গে পায়ে পায়ে চলে এল ও টেবিলের কাছে। বাবা দেখছেন ঝুঁকে। মেজদিও দেখছে। সুমিতাও দেখল, নশো টাকার একখানি চেক, রেভেনিউ স্ট্যাম্প লাগানো একটি রিসিভ লেটার। আর এটর্নির চিঠিটার বাংলা মানে হল, সুজাতা দেবীর স্বামীর নিকট থেকে খোরপোশের টাকা তিন মাসের একসঙ্গে পাঠানো হচ্ছে।
সুমিতা দেখল, বাবা যেন অসহায়ভাবে গলায় শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছেন। বললেন, উমনো এতে তো অনুচিত কিছু হয়নি। এ তোর অনধিকারের বিষয়ও নয়। কোর্টের জাজমেন্ট তো উভয় পক্ষই মেনে চলতে বাধ্য।
বড়দি তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল, আমি বাধ্য নই বাবা। কোর্টের জাজমেন্ট আমার যতক্ষণ মেনে চলার চলেছি। এটা মানা না মানায় কোর্টের কোনও হাত নেই।
বাবার গলা ক্রমেই ভারী ও ভীরু হয়ে আসছে। বললেন, তা ঠিক। উমনো, নেহাত রাগে আর আবেগে কিছু করে বসতে নেই বাবা! সসম্মানে বাঁচবার জন্যে ওটা তোর প্রয়োজন।
রুদ্ধ-অস্থির গলায় বলে উঠল বড়দি, নানা-না, বাবা। আইন আমাকে যা দিয়েছে, তা অনেক কম। আমাকে ত্রিশঙ্কু করে রেখেছে। আজকে যা এসেছে, সেটুকু আইনের ফাঁকে খানিকটা বাড়তি অপমান।
বলতে বলতে দুহাতে মুখ ঢাকল বড়দি। বাবা গিয়ে বসলেন ওর পাশে। মেজদি এক বার তাকাল সুমিতার দিকে। সুমিতার বেদনাবিহ্বল মন চমকে উঠল। ভাবল, বুঝি ওর উপস্থিতিটা ভ্র দিয়ে বিধছে মেজদি। কিন্তু মেজদি সেই চিঠিটা তুলে নিল হাতে।
বাবা বড়দির পিঠে হাত বুলিয়ে সস্নেহ ভারী গলায় ডাকলেন, উমনো।
বড়দি কান্না-জড়ানো গলায় বলল, এ আমি নিতে পারব না বাবা। যার সঙ্গে আমার কোনওই সম্পর্ক নেই, শুধুমাত্র আইনের সুযোগে তার এ অবহেলার দান আমি নিতে পারব না।
দুশ্চিন্তায়, ভয়ে ও ব্যথায় বাবা যেন কেমন হয়ে গেলেন এর মধ্যেই। আর এক বার বললেন অনেক চেষ্টা করে, অবহেলা না হয়ে তার কর্তব্যবোধও হতে পারে উমনো।
তার এ কর্তব্যবোধে আমার কী যায়-আসে। তুমি কি একটুও বোঝ না বাবা, এ আমার বড় অপমান। রফা আমি চাইনি কারুর কাছে।
সুমিতার উত্তেজিত মন বার বার বড়দির কথাতেই সায় দিচ্ছিল। আর গিরীনদার সেই মুখখানি মনে করে তীব্র অভিমানে কান্না আসছিল ওর।
হঠাৎ মেজদি ডাকল, বাবা।
বল।
–থাক। এটা বড়দির উপরেই তুমি ছেড়ে দাও।
বাবা চশমাটি খুলে হাতে রেখেছিলেন। আবার চোখে পরে এক বার মেজদির দিকে তাকালেন। কীসের এক গাঢ় ছায়ায় ঢেকে গেছে বাবার মুখ। লেন্সের আড়ালে বড় বড় চোখ দুটির দৃষ্টি ঠিক মেজদির উপরে নয়। কোথায় কোন সুদূর অন্ধকারে যেন কী খুঁজছেন। বললেন, আচ্ছা। তোমরা যা ভাল বুঝবে, তাই করবে। আমার কথায় যেন রাগ কোরো না। উঠে বললেন, আমি যাই, চিঠিগুলি সেরে ফেলি।
বাবা চলে গেলেন। তিন বোন রইল। কেউ কারুর দিকে তাকাতে পারছে না। বাতাসে উড়ছে দরজার পদাটা।
সুমিতার মনে হল, একটি ভুতুড়ে স্তব্ধতা নেমে এসেছে ঘরে। অস্পষ্ট, অর্থহীন তীক্ষ্ণ ব্যাকুল জিজ্ঞাসায় সেই স্তব্ধতা পাক খাচ্ছে। ওর সেই সুবৃহৎ জগৎ প্রতি পদক্ষেপে এত সর্পিল, চোরাবালি, ঘূর্ণাবর্তের আবর্তনে কম্পিত।
তিন বোন, তিনজনের সবটুকু জানে না। কিন্তু একই রক্তের বেদনা এ-সংসারে ওদের এখন একশা করে দিয়েছে।
বাতাস আসছে ঘরে। আর আসছে তার সঙ্গে উত্তাপ। হালকা গন্ধ ফুলের আর শহরের কংক্রিটে ঘা-খাওয়া-পাখা ভ্রমরের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে বাতাসে।
হঠাৎ মেজদি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে, গম্ভীর গলায় বললে, আমাদের কথাই সব নয়। তুমি এক বার–এক বার তোমার বিশেষ বন্ধু অমলাদির সঙ্গে আলাপ করে নিয়ো।
বলে মেজদি বেরিয়ে গেল। সুমিতা দেখল, বড়দির মুখখানি আচমকা ভয়ে ও ব্যথায় পাংশু হয়ে উঠল।