মাটির রাস্তা
হোতর থেকে ডান দিকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে জোড়াশোলে। এটা মাটির রাস্তা। গোরুর গাড়ি আর ভ্যানরিকশার চাকা রাস্তার দুই ধারে নালার মতো গর্ত করে রেখেছে। প্রায়ই রাস্তার দুই পাশ ধসে পড়া। পঞ্চায়েত থেকে রাস্তা মেরামতের চেষ্টায় কয়েক বছর আগে যেসব ভাঙা ইট ফেলা হয়েছিল, সেগুলোর উঁচিয়ে থাকা ছুঁচোলো মাথা যুদ্ধক্ষেত্রে পুঁতে রাখা মাইনের মতো আচরণ না করলেও, পদাতিক গ্রামবাসীর কাছে দুঃস্বপ্ন।
হোতর-জোড়াশোল রাস্তার মোড়ে এখন বহু লোক জমা হয়েছে। তার মধ্যেই সাইকেল নিয়ে রয়েছেন বলরামও। মেয়ে প্রতিযোগীদের চোদ্দোজনই জোড়াশোলের দিকে চলে গেছে। সেখানে ঘণ্টার মোড় ঘুরে তারা প্রত্যাবর্তন করবে। সবাই প্রতীক্ষা করছে সেইজন্যই।
এখানকার বহু মানুষই সাইকেল চড়া রমেন স্যারের মেয়েকে চেনে। তারা আশা করে আছে, তাদের পাশের গ্রাম কুলডাঙার মেয়েটিই প্রথম আসবে। বস্তা মাথায় এক চাষি বলরামকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ বাবু, এখানে হতিসে কী?
দৌড় হচ্ছে, দৌড়। মেয়েরা দৌড়চ্ছে।
কতডা দৌড়িবে?
দশ কিলোমিটার।
সেডা কতটা?
তিন কোশ।
অ বলে চাষি চলে যেতে গিয়েও ফিরে এল। দেখি যাই ক্যামন দৌড়ায়। বলরামের পাশে সে দাঁড়িয়ে গেল।
কে একজন কাঁসর এনেছে। সেটা বাজাতে শুরু করতেই ভিড় থেকে রব উঠল, আসছে, আসছে।
প্রথম আসছে ঠাকুরপাড়া যুব সম্মিলনীর দুটি মেয়ে। তাদের পাশে পাশে পতাকা লাগানো সাইকেল নিয়ে এক পথপ্রদর্শক। ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। রমেন স্যারের মেয়ে কই?…সে অনেক পেছনে পড়ে।
তুলসী তিনজনের পর এবং প্রথমজনের থেকে প্রায় তিনশো মিটার পেছনে। বলরাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করলেন প্রথম দুটি মেয়ের মুখ। ছ কিলোমিটার দৌড় হয়েছে। ওদের মুখে শ্রান্তির ছাপ, পদক্ষেপে অবসাদ। বলরামের মনে হল, নিজেদের টানতে টানতে যেন ওরা এগোচ্ছে, একে দৌড় বলে না। অসমান, ভাঙাচোরা রাস্তায় দৌড়ের অভ্যাস না থাকায় এবং বারবার গর্ত আর উঠে-থাকা ইট এড়াবার জন্য সোজা পথে দৌড়ের সুযোগ না পাওয়ায়, ওদের বাড়তি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। ছোটার ছন্দও নষ্ট হয়ে গেছে। ওদের চোখে বিরক্তি। যুব সম্মিলনীর আর-একটি মেয়ে ছিল, সে গেল কোথায়? বলরাম তাকে দেখতে পেলেন না।
তৃতীয় মেয়েটি ছুটছে মাথাটি একদিকে হেলিয়ে, আপনমনে কী যেন ভাবতে ভাবতে। চোখ দুটি লাল। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে দূরপাল্লার দৌড়ে অনভ্যস্ত। বলরামের মনে হল, বেশিক্ষণ টিকবে না।
কিন্তু তুলসীর এ কী হল! খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে কেন! সঙ্গের সাইকেলের লোকটি জলের বোতল দিল ওর হাতে। তুলসী থেমে গিয়ে বোতলের জল তার দুপায়ের কেডসের ওপর ঢেলে বোতল ফিরিয়ে দিয়ে আবার ছোটা শুরু করল। লোকটি অপেক্ষা করতে লাগল একসঙ্গে আসা পঞ্চম ও ষষ্ঠ মেয়ে দুটির জন্য।
বলরাম লাফিয়ে সাইকেলে উঠলেন। তুলসী হোতরের মোড় থেকে বাঁ দিকে বেঁকে মাজাভাঙার রাস্তা ধরেছে। এই রাস্তাটায় কোনও এক সময় পিচ ও পাথরকুচি ঢালা হয়েছিল তার কিছু কিছু চিহ্ন এখনও ছড়ানো আছে। এই রাস্তাটা তুলসী ও বলরাম দুজনেই ভালমতো চেনে।
কী হল পায়ে? সাইকেলটা তুলসীর পাশে এনে চালাতে চালাতে উদ্বিগ্ন স্বরে বলরাম জিজ্ঞেস করলেন।
কেডসটা বাবুর। ছুটতে ছুটতে এককথায় তুলসী জানিয়ে দিল তার সমস্যাটা।
খুলে ফেলল। এখন তো রাস্তা একটু ভাল।
ঠোক্কর লেগে বুড়ো আঙুলে যন্ত্রণা…বোধ হয় নখটা উঠে গেছে…ভীষণ লাগছে। তুলসীর মুখ কুঁকড়ে গেল কথা বলার সঙ্গে।
দাঁড়াও। ধমকে উঠলেন বলরাম। খোলো জুতো।
তুলসী থেমে গেল। নিচু হয়ে জুতো দুটো খুলতেই বলরাম তা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ছোটো। তিনি তুলসীর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটায় লাল ছোপ দেখতে পেয়েছেন।
পেছনের মেয়েরা একই দূরত্বে পেছনে রয়েছে। ওদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। ব্যবধানটা ঘোচানো। তুলসীর সামনের মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল কোমরে হাত রেখে। পেছনের জিপ এসে ওকে তুলে নিয়ে যাবে। মেয়েটি ম্লান হাসল, যখন তুলসী তার সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। প্রথমের দুটি মেয়ে জোড়-বেঁধে এতক্ষণ দৌড়ে এসেছে এবার তাদের একজনকে বলরাম দেখলেন সাত-আট মিটার পিছিয়ে পড়েছে।
মাজাভাঙার তেঁতুলতলায় পৌঁছে বলরামের মনে হল, তুলসীকে যদি এই দৌড় জিততে হয়, তা হলে এখনই ওকে গতি বাড়াতে হবে, নইলে ব্যবধান ঘোচাবার জন্য সময় আর পাবে না।
তুলসী?
বলরাম ডাকলেন। তুলসী একবার তাকাল তাঁর দিকে।
সামনের দুজনকে দেখা যাচ্ছে না, অনেক এগিয়ে গেছে। স্পিড বাড়াও।
আঙুলে লাগছে মেসোমশাই।
তুলসীর দৌড়ের গতি বাড়ল না। রাস্তার দুধারে দর্শকদের সংখ্যা এবার ক্রমশ বাড়ছে। যতই বিদ্যানগরের দিকে এগোবে, সংখ্যাটা ততই বাড়বে। দর্শকদের অনেকেই তুলসীকে সাইকেলে এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছে। এখন তাকে দৌড়তে দেখে তারা অবাক হয়ে যাচ্ছে।
লাগুক আঙুলে, তুমি শুধু আমাকে তাড়া করো।
এই বলে বলরাম সাইকেলটা তুলসীর সামনে এনে চালাতে শুরু করলেন। তুলসী দৌড়ের জোর একটু বাড়াল। বলরাম পিছু ফিরে দেখলেন একবার, তারপর আর একটু জোরে সাইকেলে প্যাডেল করলেন। তুলসীও আর একটু গতি বৃদ্ধি করল।
এই, এই মশাই, এটা কী হচ্ছে? পতাকা লাগানো সাইকেল নিয়ে হলুদ গেঞ্জি। পরা একজন বলরামের পাশে চলে এল। আপনি ওকে হেল্প করছেন, পেস। সেটারের কাজ করছেন, এটা বে-আইনি জানেন?
আরে মশাই, বয়ে গেছে, আমার পেস সেন্টারের কাজ করতে। সাইকেলের গতি একটুও না কমিয়ে রাগত স্বরে বলরাম বললেন। আমি এখন স্টেশনে যাচ্ছি। ট্রেন ধরতে। দেখলুম মেয়েটা খোঁড়াচ্ছে, আঙুল দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তাই বললুম, খুকি একটু ফাস্ট এড দিয়ে নাও, নইলে সেপটিক হয়ে যাবে। মেয়েটিকে আপনারা একটু দেখুন। ধনুষ্টঙ্কার হয়ে মরে গেলে আপনাদেরই তো দুর্নাম হবে।
ফাস্ট এড বক্সটা জিপে আছে। আচ্ছা, আমি দেখছি।
পতাকাধারী সাইকেলটা পেছন দিকে ঘুরে জিপের খোঁজে চলে গেল। লোকটি যেন ঘাবড়ে গেল ধনুষ্টঙ্কারে মরে যাওয়ার কথা শুনে। বলরাম হাসলেন এবং হাত নেড়ে তুলসীকে গতি আরও বাড়াতে ইশারা করলেন।
সামনের দুটি মেয়ের একজন, যে পিছিয়ে পড়ছিল তুলসী তাকে পার হয়ে গেল বিদ্যানগরে ঢোকার মুখেই। তাকে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে মেয়েটি উৎকণ্ঠিত মুখে গতি বাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু তুলসী এখন উধ্বশ্বাসে তাড়া করে যাচ্ছে বলরামের সাইকেলকে। মেয়েটি হাল ছেড়ে দিল। এবার সে প্রথমজনকে দেখতে পাচ্ছে। রাস্তা এখন আঁকাবাঁকা, প্রথম মেয়েটিকে কখনও দেখা যাচ্ছে, আবার কখনও বাঁকের মুখে আড়ালে চলে যাচ্ছে। দুধারের ভিড় নেমে এসে রাস্তাটাকে সরু করে দিয়েছে।
বলরাম নির্বিকার মুখে সাইকেলের গতি একটু একটু করে বাড়িয়ে যাচ্ছেন। রামপ্রসাদ হস্টেলের বারান্দায় সার সার মুখ। দেখে বলরামের মনে ফুর্তি জাগল। তিনি গুনগুন গাইলেন, মাথার উর্ধ্বে আছে মাদল, নিম্নে উতলা পদযুগল..পদযুগল…পদযুগল। দু পায়ের চাপে বনবন প্যাডেল ঘুরছে।
প্রথম মেয়েটি বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। তার চোখে স্পষ্ট ভীতি। খালি পায়ের, কালো শর্টস পরা মেয়েটা তার কুড়ি মিটারের মধ্যে এসে পড়েছে। নাছোড়বান্দা ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছে তার সঙ্গে।
সরে যান, সরে যান, রাস্তা পরিষ্কার রাখুন…মেয়েদের দশ কিলোমিটার দৌড়ের প্রতিযোগীরা সমাপ্তি-সীমানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আপনারা পিছিয়ে যান। দুই সাইকেল আরোহী চিৎকার করে হাত নাড়তে নাড়তে পেছন থেকে এসে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তায় নেমে আসা ভিড় তাতে একটুও সরল না।
জায়গা করে দিন, দৌড়োবার জায়গা রেখে আপনারা পিছিয়ে যান। বলরামও হঠাৎ আগের দুই সাইকেল আরোহীর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে চেঁচাতে শুরু করলেন। তাঁর একটু আগেই যাচ্ছে প্রথম মেয়েটি এবং পিছনে তুলসী। দুধার থেকে জনতার উৎসাহধ্বনি আর হাততালিতে বলরামের চিৎকার ডুবে গেল।
পথ থেকে সরে যান, সরে যান। বলতে বলতে বলরাম প্রথম মেয়েটির পাশে চলে এলেন। পেছনে তাকিয়ে দেখলেন তুলসী দাঁতে দাঁত চেপে তাঁর সাইকেলের পেছনের চাকার দিকে তাকিয়ে দৌড়চ্ছে। একবার সে মুখ তুলল। তখন বলরাম তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠলেন, এবার এগোও। বলেই তিনি রাস্তার ধারে সরে গিয়ে সাইকেল থেকে নেমে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেলেন।
স্টেশনের পুবদিকের লেভেলক্রসিং দেখা যাচ্ছে। প্রথম মেয়েটি বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে তুলসীকে। দুজনের ব্যবধান বড়জোর তিন মিটারের। এখন দুজনের লড়াই চলছে দম আর সহন-ক্ষমতার মধ্যে। তুলসী জানে দুটো ব্যাপারে সে কারও চেয়ে কম নয়, সুতরাং এবার সে একটা শেষ চেষ্টা করবে। আঙুলের নখটা প্রায়। উঠে গেছে। যন্ত্রণা নিয়ে, খোয়া, পাথর, গর্ত আর ঢিবিতে ভরা রাস্তায় খালি পায়ে সে এতটা দৌড়েছে একটা আশার পেছনে। সেই আশা এখন সম্ভাবনা হয়ে দেখা। দিয়েছে। এবার নিজেকে নিংড়ে দিয়ে তার এই দৌড়ে নামাকে সার্থক করে তুলতে হবে। নয়তো নিজের কাছে নিজে লজ্জায় মরে যাবে।
পুবের লেভেলক্রসিং পার হয়ে রেলের চার নম্বর ডাউন ট্র্যাকের মধ্যিখানে এক পা ফেলে মেয়েটি হার্ডলারের মতো লাফিয়ে পার হল। তার ঠিক চার হাত পেছনেই তুলসী। তিন নম্বর আপ ট্রাকের মাঝে ডান পা ফেলে মেয়েটি বাঁ পা তুলেছে। পা-টি এবার সে রেললাইনের বাইরে ফেলবে। এই সময়ই তুলসীর চোখ পড়ল জায়গাটায়। মেয়েটি তার বাঁ পা যেখানে ফেলতে যাচ্ছে সেখানেই সেই গর্তটা। ঘাসে আর পাতায় ঢাকা। এই গর্তে পড়েই তার সাইকেলের টিউব পাংচার হয়েছিল। মেয়েটির পেছন থেকে তুলসী চকিতে বাঁ দিকে সরে গেল।
আহহ্…মা গো।
হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মেয়েটি। এই আমার শেষ সুযোগ, তুলসীর মনের মধ্যে দপ করে উঠল আশার একটা ঝলকানি। মেয়েটির পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে দেখল জমিতে দু হাত রেখে সে ওঠার চেষ্টা করছে।
ডাউন দু নম্বর, তারপর আপ এক নম্বর রেল ট্র্যাক, তারপর পশ্চিমের লেভেলক্রসিং পার হয়ে তুলসী এমনভাবে ছুটতে শুরু করল, যেন কোনও উন্মাদ আত্মা তাকে ভর করেছে।
এবার প্রথম, প্রথম, প্রথম…মন্ত্রের মতো শব্দটা সে মনের মধ্যে আওড়ে যেতে যেতে সূর্য সঙ্ঘ ক্লাবঘরের সামনে পৌঁছল।
পনেরো ফুট ব্যবধানে দুটো বাঁশের খুঁটি ধরে দুজন ছেলে। তাতে বাঁধা লাল পশমের সুতো। তুলসী হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুতোর ওপর। সে দেখল একটি লোক তাকে দুহাতে ধরে নিল। দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে আসার আগে সে শুনতে পেল কেউ চিৎকার করে বলছে, জল, জল, অজ্ঞান হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় হওয়া মেয়েটি সমাপ্তি রেখায় পৌঁছল তুলসীর দশ সেকেন্ড পরে। তৃতীয় মেয়েটি এল দু মিনিট পরে, মোট আটটি মেয়ে দৌড় শেষ করেছে। ছেলেদের কুড়ি কিলোমিটার দৌড়ে প্রথমজন সহজেই জিতল, প্রতিযোগিতা হয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয়ের মধ্যে। দৌড় শেষ করেছে তিনজন ছাড়া সবাই।
তুলসীকে শুইয়ে রাখা হয়েছে ক্লাবঘরের মধ্যে একটা বেঞ্চে। তাকে একটা ইঞ্জেকশন আর ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। পায়ের বুড়ো আঙুলে ব্যান্ডেজ। নখটা। আধখানা উঠে গেছে। ঘরভর্তি লোক। চারদিকে কর্মব্যস্ততা আর কোলাহল। পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠানের জন্য তোড়জোড় চলছে। মেয়ে প্রতিযোগীরা এরই মধ্যে পাশের বাড়ির একটি ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে এসেছে।
তুলসী উঠে বসল। এধার ওধার তাকিয়ে সে বলরামকে খুঁজল। দেখতে পেল তার সাইকেলটা একধারে রাখা। হান্ডেলে ঝুলছে কাপড়ের থলি, তার মধ্যে আছে। তার শালোয়ার কামিজ। কেডস জুতো পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল, সেটা তো পথেই তুলে নিয়েছেন মেসোমশাই। দ্বিতীয় হওয়া মেয়েটি খয়েরি ট্র্যাকসুট পরে দুটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। তুলসীর সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় সে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, তোমার যা বরাত, আজ একটা লটারির টিকিট কিনে নিয়ো।
তুলসী ম্লান হেসে মেয়েটির হাতটা ধরেই ছেড়ে দিল। সত্যিই বরাত-জোরে সে জিতেছে। গর্তটাই তাকে জিতিয়ে দিল, নাকি মেসোমশাই মাঝপথ থেকে সাইকেলে তাকে প্রায় টেনেই নিয়ে এলেন, সেটা এখনও সে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মনের মধ্যে একটা খচখচানি শুরু হয়ে গেল। এই জয়টাকে পুরো উপভোগ করতে কোথায় যেন তার বাধছে।
এখন শরীর কেমন লাগছে? কর্মকর্তাদের একজন গ্লুকোজের জলভরা গ্লাসটা তুলসীর হাতে দিয়ে হেসে বললেন, খেয়ে নাও। জামাকাপড় বদলে, চুলটুল আঁচড়ে নাও। এখুনি তো প্রাইজ দেওয়া হবে। এই সাইকেলটা তো তোমার?
হ্যাঁ।
বাড়ি কদ্দুরে?
কুলডাঙায়।
সে তো অনেকটা পথ। এখনই ফিরে যেতে অসুবিধে হলে কিছুক্ষণ কারও বাড়িতে বিশ্রাম নিতে পারো।
তুলসীর একবার মনে হল, বলে এখানে তার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় থাকেন, তেমন বুঝলে তাঁর বাড়িতেই যাব। তারপরই ভাবল, জগন্নাথকাকা যদি বিব্রত হন! ছুটির দিন ওঁর বাড়িতে অনেক লোকজন আসে।
মাঠের ওপর কাঠের পাটাতনে তৈরি ছোট মঞ্চ। পুরুষ ও মেয়েদের প্রাইজগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলে। ছোট-বড়, চৌকো, লম্বা নানারকম বাক্স আর প্যাকেটের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রাখা একটা নতুন সাইকেলও দেখা যাচ্ছে। টেবিলের পেছনে কয়েকটি চেয়ার, তাতে বসে আছেন সভাপতি, প্রধান অতিথি ও ক্লাবকর্তারা। তাঁদের পেছনে একটি সোনালি কাপড়ের ফেস্টুনে লেখা সূর্য সঙ্ঘ। স্থাপিত ১৯৭০। চতুর্দশ বর্ষ দশ ও কুড়ি কি.মি. রোড রেস।
সাইকেলটা দেখেই তুলসীর দেহ থেকে সব ক্লান্তি এবং আঙুলের যন্ত্রণা নিমেষে উবে গেল। অবশ্যই ওটা প্রথম পুরস্কার। দারুণ দরকারি জিনিস। এই পুরনো সাইকেলটা তার এখন চাপতে ভয় করে, কখন যে বসিয়ে দেবে পথের মাঝে, কে জানে। তুলসী ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এসে দাঁড়াল আর ভাবল এই সাইকেলটায় চড়ে যদি বাড়ি ফেরে তা হলে বাবা, মা, বাবু কী অবাকটাই না হবে! কিন্তু সে তো পরের কথা। এখন সে এই পুরনোটাকে নিয়ে কী করবে? শেষে কি দুহাতে দুটোকে ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরতে হবে না কি? মেসোমশাই কোথায় যে ডুব মারলেন, উনি থাকলে না হয় পুরনোেটা ওঁর হাতে দিয়ে বলতে পারত, এখন আপনার বাড়িতে রেখে দিন, কাল-পরশু নিয়ে যাব। কিংবা জগন্নাথকাকার বাড়িতেও রেখে আসা যায়। পেছনের উঠোনে একটা রাত থাকলে ওঁদের নিশ্চয় অসুবিধে হবে না।
এবার আমাদের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আরম্ভ হচ্ছে। ক্লাবের সচিব মাইকের সামনে। রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নাটুকে ভঙ্গিতে বললেন, বেলা বাড়ছে, রোদের তেজ তীব্র হচ্ছে, ছুটির দিনে মানুষের নানারকম কাজকর্ম থাকে, তাই অনুষ্ঠানকে আমরা দীর্ঘ করব না। আমরা কথার থেকে কাজে বিশ্বাসী, তাই কোনও বক্তৃতা বা ভাষণ কেউ দিচ্ছেন না। আমাদের এই বাৎসরিক দৌড় উপলক্ষে আগামী মাসে রবীন্দ্র ভবনে যে সাংস্কৃতিক-সন্ধ্যা হবে, সেখানে এনারা বক্তৃতা দেবেন, এখানে নয়।
সচিবকে থামতে হল জনতার সমর্থনসূচক হাততালিতে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হতাশায় চেয়ারের পিঠে এলিয়ে পড়লেন। ক্লান্ত প্রতিযোগীদের মুখে ফুটে উঠল স্বস্তি।
প্রথমে পুরুষদের কুড়ি কিলোমিটার দৌড়ের বিজয়ী, বারাসাতের নেতাজি বাহিনী ক্লাবের সদস্য মহম্মদ জয়নুল ইসলামের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন। আমাদের পুরসভার প্রধান শ্রীবিজয়কুমার পাল।
চেয়ারম্যান চেয়ার থেকে উঠে মঞ্চের একপাশে রাখা সাইকেলটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কৃশকায়, ট্রাউজার্স ও বুশশার্ট পরা এক তরুণ মঞ্চের পিছনে লাগানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল হাসিভরা মুখে। তুমুল হাততালি উঠল।
তুলসী দুহাতে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে ফেলল। তার মনে হচ্ছে, সে বোধ হয় আর-একবার জ্ঞান হারাবে। একটা স্বপ্নের বেলুন সে ফুলিয়ে যাচ্ছিল, এখন তাতে পিনের খোঁচা পড়ল। বেলুন ফাটার শব্দটা বুকের মধ্যে শুনতে পেল।
এই সাইকেলটি দান করেছেন স্থানীয় সাইকেল ব্যবসায়ী দ্য বেঙ্গল সাইকেল স্টোর্স-এর মালিক শ্রীকালিপদ দাস মহাশয়ু…।
তুলসী ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল। তার আর দেখার বা শোনার কোনও আগ্রহ নেই। ছেলেদের পর মেয়েদের পুরস্কার দেওয়া হবে। নিজেরটা নিয়েই সে সাইকেলে উঠে বাড়িমুখো হবে। তাকে যাই দেওয়া হোক, সাইকেল তো দেওয়া হবে না! এখানে বসে বসে অন্যদের প্রাইজ নেওয়া দেখার কোনও দরকার তার আর নেই। খাবারের বাক্স দেওয়া হয়েছে সব প্রতিযোগীকে। অনেকেই পাওয়ামাত্র খিদের তাড়নায় খেতে শুরু করে দেয়। তুলসী খায়নি। এখন সে বাক্সটা খুলে দেখল, তাতে রয়েছে লুচি, আলুর দম, সন্দেশ, সিদ্ধ ডিম আর কলা। সে কলাটা বের করে বাক্সটা আবার তার ঝুলির মধ্যে রেখে দিল।
ছেলেদের পুরস্কারগুলো দেওয়া হয়ে গেছে। স্থানীয় একজনও কেউ পুরস্কার পায়নি। বারাসাতের দুজন, ইছাপুর, চাকদা আর আগরপাড়ার ছেলেরা প্রথম পাঁচটি স্থান জিতেছে।
এবার মেয়েদের পুরস্কারগুলো দেওয়া হবে। দশ কিলোমিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছে কুলডাঙার তুলসী রায়। হাততালি পড়ল, কিন্তু তুমুলভাবে নয়।
তুলসী যখন মঞ্চে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে তখন তার কানে এল একটা কথা, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে প্রথম। ঠাকুরপাড়ার মেয়েটা হোঁচট খেয়ে না পড়লে…
তুলসীর দুটো কান গরম হয়ে গেল। কথাটা কে বলল দেখার জন্য মুখ ফিরিয়ে দেখল না। মাথা নামিয়ে সে মঞ্চে উঠল। তার জয়টা পরিচ্ছন্নভাবে নয়, এতে কলঙ্ক লেগে আছে। কিন্তু সে তো ইচ্ছে করে গর্তটা তৈরি করে রাখেনি। কিন্তু লোকে সে যুক্তি মানবে না। তার মনে হল, প্রথম না হলেই যেন ভাল হত! এখন সে অবসাদ বোধ করছে।
বিজয়িনীর হাতে পুরস্কার তুলে দিতে অসুস্থ শরীর নিয়েও এসেছেন স্থানীয় বিধায়ক শ্ৰীযুধিষ্ঠির সাহা। তিনি আমাদের বলেছেন, আপনাদের জানিয়ে দেওয়ার জন্য—খেলাধুলোয় উৎসাহ দেওয়ার জন্য রোগশয্যা কেন, শ্মশানের চিতা থেকেও তিনি উঠে আসবেন। কিছু করতালিধ্বনি উঠল।
যুধিষ্ঠির সাহা চেয়ার থেকে নিজের ভুঁড়িটি কষ্টেসৃষ্টে তুলে উঠে দাঁড়ালেন। মাইকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সচিব বাধা দিয়ে বললেন, না, না, ভাষণ নয়, টেবিলের দিকে যান।
লাজুক স্বরে বিধায়ক বললেন, অভ্যাস তো!
একটা বাক্স থেকে টেপরেকর্ডার বের করে সচিব তুলে ধরে দর্শকদের দেখালেন। স্থানীয় বিখ্যাত ইলেকট্রনিক দ্রব্য ব্যবসায়ী ও টিভি-র দোকান রূপ ও বাণীর মালিক শ্রীঅরুণাভ পাল মহাশয় এই টেপরেকর্ডারটি দান করেছেন। দৌড়বার এই জুতোজোড়া দান করেছেন স্থানীয় পদসেবার মালিক শ্রীজয়দেব গোস্বামী। আর এই ট্র্যাকস্যুটটি দিয়েছেন পিকু হোসিয়ারির স্বত্বাধিকারী গোবর্ধন শীল। সচিব একজোড়া জুতো তুলে ধরে সবাইকে দেখালেন।
পুরস্কারগুলির সঙ্গে তুলসী পেল, পুরুষ বিজয়ীর মতোই একটি কাপ ও সার্টিফিকেট। মঞ্চ থেকে নেমে সে ক্লাবঘরের দিকে যাচ্ছিল তার সাইকেলটা আনতে। তখন দেখল সদ্য পাওয়া নতুন সাইকেলটি হাতে ধরে জয়নুল ইসলাম কয়েকটি ছেলের সঙ্গে গল্প করছে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে তুলসী ওদের দিকে এগিয়ে গেল।
আপনাকে তো অভিনন্দনই জানানো হয়নি। তুলসী হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। জয়নুল থতমত হয়ে তাড়াতাড়ি তুলসীর হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, আমারও তো আপনাকে অভিনন্দন জানানো হয়নি।
আর অভিনন্দন! বিষণ্ণ মুখে তুলসী বলল, লোকে যা বলাবলি করছে! মেয়েটা নিজে পড়ে গেল, সেটা কি আমার দোষ? অথচ দেখুন, লোকে বলছে আমার প্রথম হওয়াটা নাকি..ইচ্ছে করছে এই প্রাইজ ফাইজ ছুড়ে ফেলে দিই। তুলসী টেপরেকর্ডার, জুতো, কাপ হাত থেকে ছুড়ে ফেলার ভঙ্গি করল।
আরে ফেলবেন কেন, লোকের কথার কান দিতে নেই। দশ কিলোমিটার দৌড়েছেন, সেটা তো মিথ্যে নয়। জয়নুলের পাশে দাঁড়ানো তরুণটি সহানুভূতি জানিয়ে বলল।
না, আমার ভাল লাগছে না এইসব জিনিস। আপনি এই রেকর্ডার আর জুতোজোড়া নেবেন?
আমি! আপনার জিনিস? জয়নুল আকাশ থেকে পড়ল।
হ্যাঁ। নিন না। বদলে আমি বরং সাইকেলটা নেব। হরেদরে দাম একই হবে। তা ছাড়া এখান থেকে সাইকেল নিয়ে বারাসাত যাওয়াটাও তো এক ঝামেলার ব্যাপার। তুলসী বহু আশা নিয়ে অবশেষে ঝুলি থেকে তার বেড়ালটি বের করল।
কিন্তু দিদি, সাইকেলটা অলরেডি তো বুক হয়ে গেছে। ওটা আমিই নিচ্ছি। সহানুভূতি জানানো তরুণটি একগাল হাসল। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি কিনতে জয়নুল দু হাজার টাকা ধার নিয়েছিল, শোধ হতে এখনও আটশো টাকা বাকি। দোকানে জিজ্ঞেস করে দেখি সাইকেলটার দাম কত হবে। মনে তো হয় টাকা শোধ হয়ে যাবে।
তুলসী মিইয়ে গেল শুনতে শুনতে। মুখে হাসি টেনে বলল, দেনার টাকা শোধ তো সবার আগে করতে হয়। আচ্ছা, আমি চলি।
তিক্ত, ক্লান্ত তুলসী সাইকেলে ফিরছিল। রামপ্রসাদ হস্টেল পার হয়েই দেখল বলরাম। হাত তুলে দাঁড়িয়ে।
কী ব্যাপার মেসোমশাই! আপনি সেই যে হাওয়া হয়ে গেলেন, তারপর তো আর দেখতেই পেলাম না!
পথে সন্দেহ করে আমাকে একজন ধরেছিল পেস সেন্টারের কাজ করছি বলে। তোমাকে ডিসকোয়ালিফাই করে দিতে পারে, এই ভেবে পরে আর মুখ দেখাতে সাহস পাইনি। প্রায় শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছলুম তো। বলরাম তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
আর জ্বলে উঠল তুলসীর মাথা। আর একজন গর্ত পড়ে গেল বলে প্রথম হতে পারল না…সাইকেলে আগে আগে গিয়ে তার দৌড়ের স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ইনি…কোনও কৃতিত্বই নেই আমার, কিছুই নেই, সবই অন্যের দয়ায় পাওয়া।
আজ আমার বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন। চলো, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।
দরকার নেই আপনার নেমন্তন্নের।
বোকার মতো চেয়ে-থাকা বলরামকে দাঁড় করিয়ে রেখে তুলসী জোরে জোরে প্যাডেল শুরু করল।
তুলসীর ওইরকম রুক্ষ প্রত্যাখ্যানে বলরাম মনে খুবই আঘাত পান। সেদিন বাড়ি ফিরে আসতেই বিমলা বলেন, কই, মেয়েটি এল না? রান্নাবান্না সব তো হয়ে গেছে, চাটনিটা শুধু বাকি।
দেখতে তো পেলাম না। একটা মেয়ে ফিরছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলুম, বলল প্রাইজ তো অনেকক্ষণ দেওয়া হয়ে গেছে। তবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আমার মনে হয়, স্টেশনের ওপারে তুলসীর এক কাকা থাকেন, বোধ হয় তাঁর বাড়িতেই ও গেছে।
মিছিমিছি তাড়াহুড়ো করে এত রাঁধলুম। তোমার উচিত ছিল ওকে আগেই বলে রাখা। ঘটে এতটুকু যদি বুদ্ধি থাকে!
বলরাম সেদিন এইভাবে স্ত্রীর কাছে নিজের মুখরক্ষা করেছিলেন। কিন্তু মনের গভীরে সূক্ষ্ম একটা অপমানের জ্বালা ধরে গেল। নেমন্তন্নটা তো উপলক্ষ, আসলে ওর এই জয়কে মর্যাদা দেওয়ার জন্যই তো তিনি তাড়াতাড়ি মাংস কিনে সঙ্গে দই-রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। রাস্তায় অপেক্ষা করতে করতে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, আচমকা নেমন্তন্নের কথা শুনে তুলসীর মুখ-চোখের অবস্থাটা কেমন। হবে!
রানিসায়রে সকালে সাঁতার কাটতে যাওয়া তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি চান না তুলসীর সঙ্গে আর দেখা হোক। রাস্তার আলাপ রাস্তাতেই শেষ হোক, এমন এক মনোভাব তাঁর। সাইকেল নিয়ে আর তিনি বেরোন না। অফিস আর বাড়ি ছাড়া আর তাঁর করার কিছু নেই। এমনই এক সময় কাগজে তিনি দেখলেন ছোট্ট একটা খবর, গঙ্গাবক্ষে চার মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতা। সামন্তপুর স্পোর্টিং ক্লাবের উদ্যোগে বৈদ্যপাড়া বাঁধাঘাট থেকে সামন্তপুর কালীতলা ঘাট পর্যন্ত। সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ার শেষ তারিখ ২০ নভেম্বর। অফিসের মনোজ সামন্তর বাড়ি তো সামন্তপুরেই। বলরাম খবরের কাগজ হাতে ভাবতে শুরু করলেন।
পরদিন অফিসে ছুটির কিছু আগে বলরাম মনোজকে প্রশ্ন করলেন নিচুস্বরে, আচ্ছা সামন্ত, তোমাদের ওখানে সামন্তপুর স্পোর্টিং ক্লাব বলে একটা ক্লাব আছে না?
মনোজ সামন্ত ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ পিটপিট করে বললেন, আপনি জানলেন কী করে?
কাগজে দেখলুম গঙ্গায় একটা সাঁতার প্রতিযোগিতা করছে।
আমার ঠাকুর্দার বাবা পতিতপাবন সামন্ত ক্লাবটা এস্টাব্লিশ করেন সেই বছরেই যে বছরে মোহনবাগান ক্লাব হয়, তার মানে এইটিন এইট্টি নাইনে। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের উদ্বোধন করার কথা ছিল, আসতে পারেননি। দুমাস পরে অবশ্য এসেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রও এসেছেন। মনোজ সামন্ত খুবই সাধারণ একটা খবর জানানোর ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে হাই তুললেন। বিগ নেম কত আর করব, লাস্ট এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়, আমাদের ঠাকুরদালান দেখতে।
ক্লাবটা তোমাদের বাড়িতেই কি?
ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকারের যুগ আসতেই ক্লাবঘরটা বাড়ি থেকে তুলে দিলাম। এখন গঙ্গার ধারে আমাদের দেওয়া জমিতেই নতুন ঘরে ক্লাব।
ভাই, আমার একটা উপকার করবে! গঙ্গায় যে চার মাইল সাঁতার হবে, তাতে আমার নামটা তুমি এন্ট্রি করে দেবে? বলরাম লাজুক ফিসফিসে গলায় বললেন। তা হলে আমায় আর যেতে হয় না নাম দিতে।
মনোজ সামন্ত প্রথমে বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে বলরামের দিকে তাকিয়ে থেকে, গম্ভীরভাবে বললেন, ঠাট্টা করছেন?
একদমই নয়। খুব সিরিয়াস হয়েই বলছি।
কেন?
তার মানে?
কেন এই বয়সে শরীরটাকে মিছিমিছি বেগার খাটাচ্ছেন? সেদিন অফিসে ঘুমোচ্ছিলেন, মনে আছে? আপনি সাঁতার কাটলে কারও কি কোনও উপকার হবে? আপনার কি সেজন্য মাইনে বাড়বে? তা যদি না হয়, তা হলে সাঁতার কেটে লাভ?
খাঁটি কথা বলেছ ভাই। এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সাঁতার ফাঁতার কেটে কোনও লাভ হয় না। তবে কী জানো সামন্ত, মানুষ তো একরকমের হয় না। কেউ কেউ মনে করে, জীবন বলতে যদি বেঁচে থাকা বোঝায়, তা হলে বাঁচার একটা মানে থাকা দরকার। জীবন নানা সময়ে নানা রূপ ধরে। আমি এখন জীবনের যেখানে এসে পৌঁছেছি, সেখানে দেখছি, জীবনটা চেন দিয়ে বাঁধা কুকুরের রূপ ধরেছে। আমি। তাই চেনটা ছিঁড়ে ফেলতে চাই।
মনোজ সামন্ত মন দিয়ে শুনছিলেন। অনেকক্ষণ পর বললেন, আপনার নাম আমি দিয়ে দেব। তারপর হেসে উঠে জুড়ে দিলেন, ডুবেটুবে গেলে কিন্তু লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।
.
বলরাম স্ত্রীকে জানাননি সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছেন। শুধু বলেছিলেন, মনোজ সামন্ত রবিবার অফিসের কয়েকজনকে বাড়িতে খেতে বলেছে, তিনিও তাদের মধ্যে আছেন।
সাঁতার শুরু হবে বেলা তিনটেয়, বৈদ্যপাড়া থেকে। বলরাম প্রথমে এলেন শেয়ালদা স্টেশনে। সেখান থেকে বাসে হাওড়া স্টেশনে এসে পেয়ে গেলেন ব্যান্ডেল। লোকাল। বৈদ্যপাড়া স্টেশনে নামলেন বেলা দুটোয়। সাইকেল রিকশায় গঙ্গার ধারে পৌঁছে দেখলেন, অস্থায়ী একটা শামিয়ানা আর পোশাক বদলাবার জন্য ঘেরা জায়গা। একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার। জনা-তিরিশ ছেলেমেয়ে আর কিছু ক্লাবকর্তা। এদের সঙ্গে মনোজ তার জন্য অপেক্ষা করছে। ওকে দেখে বলরামের একটা চিন্তা থেকে রেহাই ঘটল। প্রতিযোগী বলে শনাক্ত করার জন্য একটা লোক পাওয়া গেল।
বলরাম একজন প্রতিযোগী শুনে দু-চারজন চোখ কুঁচকে তাকালেন। বলরাম। অনুমান করেই ছিলেন, এইরকম দৃষ্টির সামনে তাঁকে পড়তে হবে। তিনি কিছু মনে করলেন না। একজন শুধু তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, গঙ্গায় কখনও সাঁতার কেটেছেন?
কেটেছি। সাত মাইল কম্পিটিশনের একটা কাপও আছে। বিনীত ভাবে বলরাম জানিয়ে দিলেন।
মনোজ সামন্ত ক্লাবের লোকেদের সঙ্গে বলরামের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এনার্জি আছে বটে গড়গড়িদার! এই সব ইয়ং ছেলেমেয়ের সঙ্গে কম্পিট করতে এই বয়সে জলে নামা, চাট্টিখানি কথা! ওঁকে তো একটা স্পেশাল প্রাইজ দেওয়া উচিত।
তা যদি দাও, তা হলে ওকেও দেওয়া উচিত। এই বলে বলরাম পোশাক বদলাবার জায়গা থেকে এইমাত্র বেরিয়ে আসা ছোট্ট বিনুনি ঝোলানো কস্টিউম পরা একটা সাত-আট বছরের মেয়ের দিকে আঙুল তুললেন। ওর সঙ্গে আমার বয়সের ডিফারেন্স অন্তত অর্ধ শতাব্দীর। গঙ্গায় আজ একটা ব্রিজ হবে, পঞ্চাশটা বছর জোড়া লাগবে।
বলরাম হা হা শব্দে হেসে উঠলেন। তাঁর মনে হচ্ছে এমনভাবে তিনি কলেজে পড়ার দিনগুলোর পর আজই প্রথম হাসলেন। হাসির সঙ্গে যেন শুকনো হয়ে যাওয়া বছরগুলো ঝরে ঝরে যাচ্ছে শরীর থেকে।
মেয়েটি কি একা জলে নামবে? বলরাম তারপর কথাটা শুধরে নিয়ে বললেন, ওর সঙ্গে সঙ্গে কারও থাকা দরকার।
ওর বাবা, দাদা, ওই তো দাঁড়িয়ে…ওরাও নামছে। মনোজ আঙুল তুলে দেখাল। বছর চল্লিশের একটি লোকের সঙ্গে দশ বারো বছরের একটি ছেলে। দুজনে গায়ে সর্ষের তেল ঘষছে। ব্যবসা করে, মুদির দোকান আছে। ওর স্ত্রী…মেয়েটার মা, সেও তো এই চার মাইল সাঁতারে নামত বিয়ের আগে পর্যন্ত।
আগে কেন, পরেও দুবার নেমেছে। মনোজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরু চশমা-চোখে লোকটি ভুল শুধরে দিল।
বুঝলেন গড়গড়িদা, কম্পিটিশনের থেকেও বেশি, এটা একটা উৎসব। ভাটা এই আধঘণ্টা আগে শুরু হয়েছে, টানেই চার মাইল চলে যাবে। এবার আপনি জামা-প্যান্ট ছেড়ে ঝোলাটা আমায় দিন।
তুমি নৌকোয় থাকছ তো?
আমি বাস কি অটোয় সামন্তপুর চলে যাব..আপনাদের আগেই।
চৌত্রিশজন সাঁতারু আর চারটে নৌকোয় লাইফ সেভার ও ক্লাবকর্তারা। সাঁতারুদের মাথায় লাল কাপড়ের টুপি। এদের মধ্যে অনেকেই রাজ্য চ্যাম্পিয়ান। বাঁধাঘাটে জলের পারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে। প্রতিযোগীরা, কে সামনে থাকবে তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে। নৌকো থেকে হুইল্ল বাজল। একজন সাদা পতাকা তুলে দাঁড়িয়ে। আবার হুইল্ল এবং পতাকা ধরা হাতটি নামল। হইহই করে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সাঁতারুরা। সকলের শেষে নামলেন বলরাম।
সামন্তপুর কালীতলা ঘাটে সকলের শেষে জল থেকে উঠলেন বলরাম। এবং উঠলেন দুহাত তুলে বিজয়ীর মতো।
কই, মনোজ কোথায়?
মনোজ সামন্ত উত্তেজিতভাবে এগিয়ে এলেন। গড়গড়িদা, আপনি যে ফিনিশ করবেন, সত্যি বলছি, ভাবিনি।
ভেবেছিলে ডুবে যাব, হাফ ছুটি পাবে? মাথা কাটা যায়নি তো?
আজ রাতে গরিবের বাড়ি চাট্টি ডালভাত খেয়ে তবে বাড়ি ফিরবেন। স্কন্ধকাটা হইনি, কম আনন্দ হচ্ছে আমার!
বলরাম হাসতে গিয়ে একটা কাঁটা ফোটার বেদনা অনুভব করলেন। আর-একদিন তিনি একজনকে অনেকটা এইভাবেই খাওয়ার কথা বলেছিলেন। সে রূঢ়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছিল।
নিশ্চয়ই খাব। পেটপুরে খাব। কাল অফিস যদি না যাই—
যেতে হবে না, যেতে হবে না, আমি ম্যানেজ করে দেব। এবার থলেটা নিন। জামাপ্যান্ট পরে তারপর প্রাইজ নেওয়া।
আমার আবার প্রাইজ কী? বলরাম অবাক হলেন। লাস্টের আবার প্রাইজ হয় নাকি?
হয়, হয়, চলুন তো! মনোজ সামন্ত টান দিলেন বিস্মিত বলরামের হাত ধরে।
ক্লাবঘরের সামনে খোলা জায়গায়, দুটো তক্তপোশ দিয়ে মঞ্চ হয়েছে। মাইক্রোফোন আর টেবিল। নিরাভরণ এই অনুষ্ঠানে পুরস্কার দিলেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। এখানকারই একজন ডাক্তার। কাপ, মেডেল এবং তোয়ালে যারা পেল, তারা সকলেই নিয়মিত সাঁতার কাটে এবং কুড়ির কম বয়সি।
এবার পুরস্কার দেওয়া হবে প্রতিযোগিতার কনিষ্ঠতম সাঁতারু উমা পালকে। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন প্রতিযোগিতার সব থেকে বয়স্ক সাঁতারু শ্রীযুক্ত বলরাম গড়গড়ি। প্রসঙ্গত জানাই দুজনের বয়সের পার্থক্য পঞ্চাশ বছরের, এবং দুজনেই সফলভাবে প্রতিযোগিতা শেষ করেছেন। ক্লাব-সচিবের ঘোষণা হওয়ামাত্র তুমুল হাততালি আর চিৎকার উঠল। দুজনকে কাছ থেকে দেখার জন্য মঞ্চের দিকে এগিয়ে এল জনতা। ঠেলাঠেলি শুরু হল।
বলরাম হকচকিয়ে গেলেন এত লোকের আগ্রহ, ঔৎসুক্য দেখে। তাঁকে দেখার জন্য নয়, আসলে ওই পঞ্চাশ বছরের পার্থক্যটাই যে এদের কৌতূহলী করে তুলেছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। তিনি নিজেও কিঞ্চিৎ উত্তেজনা বোধ করলেন। মনোজ সামন্ত প্রায় ঠেলতে ঠেলতে বলরামকে মঞ্চের দিকে নিয়ে গেলেন। টাক মাথা, বেঁটে লোকটিকে দেখে বাচ্চা দর্শকরা আবার হাততালি দিল। বলরামের চেয়ে উমা পাল উচ্চতায় মাত্র আধফুট ছোট।
প্রতিযোগিতায় ছেলেদের ও মেয়েদের মধ্যে পঞ্চম পর্যন্ত যারা স্থান পেয়েছে তাদের একটি করে তোয়ালে দেওয়া হয়েছে। বাড়তি রয়েছে দুটি তোয়ালে। তারই একটি উমার হাতে দিয়ে বলরাম তাকে কোলে তুলে নিলেন। বাচ্চা মেয়েটি লজ্জায় তোয়ালেটা দিয়ে মুখ ঢাকল।
আবার ঘোষণা হল, এবার উমা পাল পুরস্কার তুলে দেবে বলরাম গড়গড়ির হাতে।
দুহাত বাড়িয়ে উমার হাত থেকে একটা তিন হাত লম্বা হ্যান্ডলুম তোয়ালে নিলেন বলরাম। ইতিমধ্যে কেউ বলে দিয়েছিল উমাকে, তোয়ালেটা হাতে দিয়েই সে প্রণাম করল বলরামকে। প্রবল হর্ষধ্বনি আর করতালি বলরামের চোখে বাষ্প ঘনিয়ে। তুলল।
সভাপতি ডাক্তারবাবু মাইকের সামনে এসে বললেন, এবার বলরামবাবু আপনাদের দু-চার কথা বলবেন।
বলরামের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বক্তৃতা! ভাষণ! দু-চার কথা মানে? কিন্তু আমি কেন? তিনি অসহায়ভাবে সভাপতির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাসতে হাসতে ডাক্তারবাবু বললেন, আজ আপনিই তো বলবেন। আমাদের এই চার মাইল সাঁতারে আজ পর্যন্ত আপনার বয়সি কেউ কম্পিট করেনি। আপনি বলবেন না তো কি, যে জীবনে সাঁতার কাটেনি, সেই আমি এখানে বাণী দেব? আমার কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! আপনার যা মনে আসে তাই বলুন।
সামনে থেকে মনোেজ সামন্ত চেঁচিয়ে বলল, গড়গড়িদা, ঘাবড়াবেন না। যা বলবেন আমরা শুনব।
বলরাম মাইক্রোফোনের সামনে এলেন।
একটা সময় ছিল যখন আমার বয়স তোমাদের মতোই ছিল। বলরামের মুখ থেকে হঠাৎই বাক্যটি বেরিয়ে এল। যেটুকু কথাবার্তা দর্শকদের মধ্যে হচ্ছিল, বন্ধ হয়ে গেল।
বাড়ির কাছেই ছিল গঙ্গা, সাঁতার কাটতাম। স্বপ্ন দেখতাম, ইংলিশ চ্যানেল পার হচ্ছি। স্বপ্ন দেখতাম, ওলিম্পিকে গোল্ড মেডেল গলায় পরছি। আমার দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুর বাজছে। তারপর যা হয়! বলরাম থামলেন। একটু হাসলেন, আমি সরকারি অফিসের একটা আপার ডিভিশন ক্লার্ক হলাম।
আমার বয়স বাড়তে লাগল। বুড়ো বলতে যা বোঝায় কালক্রমে আমি সেই বয়সে প্রবেশ করলাম। কিন্তু বুড়ো তো দুভাবে হয়, শরীরে আর মনে। আমার শরীরের ক্ষয় অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু যেভাবেই হোক মনের ক্ষয় আটকাবার কথা। আমি ভাবলাম। আমি যেখানে থাকি, সেই বিদ্যানগরে একটি মেয়েকে দেখেছি, সে কী প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে! তাকে দেখেছি, শুধুই মনের জোরে দশ কিলোমিটার রোড রেসে প্রথম হতে।
আমার মন বলল, বলরাম, তুমিই বা পারবে না কেন? বয়স হলেই কি ছোটদের কাছে হটে যেতে হবে? জবুথবু হয়ে সংসারের, সমাজের এককোণে পড়ে থাকবে? যৌবন চলে গেলেই কি জীবন শেষ হয়ে যাবে?
বলরাম জানেন না, তাঁর গলা চড়ে গেছে, তাঁর চোখের মণি বড় হয়ে উঠেছে। জীবনে এই প্রথম তাঁর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে তাঁর কানে ফিরে আসছে। এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও তাঁর হয়নি।
কবে গঙ্গায় সাঁতার কেটে একটা কাপ জিতেছি, তাই ভাঙিয়ে আজীবন চলে না। বয়সকে কমানো যায় না, ধরেও রাখা যায় না, কিন্তু তাকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেওয়া যায়।
আমি অতি সাধারণ মানুষ। বৈজ্ঞানিক নই, শিল্পী নই, শিল্পপতিও নই, কিছুই নই। আমি তা হলে বয়স নিয়ে কী করতে পারি? পারি শুধু একটা কাজই—মন থেকে বয়সকে তুলে নিতে। সেই কাজটাই আজ করলাম। এই কাজ আবার করব, যতদিন পারব করে যাব।
সেদিন রাতে শেয়ালদায়, রাস্তা থেকে ছ টাকা দিয়ে বড় একটা ফুলকপি কিনে বলরাম ট্রেনে উঠলেন। বিমলাকে দুটো মিথ্যা কথা বললেন বাড়ি পৌঁছে।
পনেরো টাকায় বিক্রি হচ্ছে দেখে তোয়ালেটা শেয়ালদায় কিনে ফেললাম। সস্তা হয়নি?… আর এই কপিটা ধরো, মনোজের ক্ষেতের। তোমার জন্য দিল।
.
আমায় ডেকেছেন, জগন্নাথকাকা?
বসার ঘরে খবরের কাগজ পড়ছিলেন জগন্নাথবাবু। কাগজটা নামিয়ে বললেন, আয়, বোস।
তুলসী মুখোমুখি সোফায় বসল।
চাকরিবাকরির খোঁজ পেলি?
না। একজন বলল কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হতে, এটা জানলে আজকাল চাকরি পেতে নাকি সুবিধা হয়। গেছিলাম একটা কম্পিউটার শেখানোর টিউটোরিয়ালে। এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হতে লাগবে পৌনে পাঁচশো টাকা আর মাসে মাসে আড়াইশো। তুলসী মাথা নামিয়ে চুপ করে গিয়ে বুঝিয়ে দিল টাকাটা তার সাধ্যের বাইরে।
জগন্নাথবাবু কয়েক সেকেন্ড ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এখানে সূর্য সঙ্ঘের দশ কিলোমিটার দৌড় কম্পিটিশনে তুই নাকি প্রথম হয়েছিস?
হ্যাঁ।
কই, সে কথা আমায় বলিসনি তো? ক্লাবের সেক্রেটারি পূর্ণেন্দু কথায় কথায় কাল আমায় বলল।
এ আর বলার মতো কিছু নাকি? তুলসীর স্বর লাজুক। মনে মনে বলল, বলে কোনও লাভ হবে না বলেই বলিনি।
বলার মতো নয়! বলিস কী? দশ কিলোমিটার মানে ছ মাইল। একটা গেরস্তবাড়ির মেয়ে এই ভাঙাচোরা রাস্তায়…পূর্ণেন্দু বলল নখ উঠে যাওয়ায় খালি পায়ে যন্ত্রণা নিয়ে দৌড়ে প্রথম হয়েছে। তার মানে ভীষণ কষ্ট সইবার ক্ষমতা আর জেতার ইচ্ছেটা তোর আছে। এটা তো খুব বড় ব্যাপার। এটাই কি তোর প্রথম এই দৌড়ে নামা?
হ্যাঁ, বলেই তুলসী লজ্জায় কুঁকড়ে রইল। সেদিনের মিথ্যে কথাটা জগন্নাথকাকা এখনও মনে করে রেখে থাকলে তার সম্পর্কে কী ধারণা করছেন।
আমাদের অফিসের স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ডের নির্দেশ আছে, চাকরি দিতে হবে সেই স্পোর্টসে, যেটা ওলিম্পিকে আছে। সামনের ওলিম্পিকে একটা নতুন স্পোর্টস ইনফ্লুডেড হয়েছে। এদেশে সেটা নেই বললেই চলে। জগন্নাথবাবু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন।
নাম কী স্পোর্টস-টার? কৌতূহলভরে তুলসী জিজ্ঞেস করল। ডাকিয়ে এনে জগন্নাথকাকা নতুন একটা স্পোর্টসের খবর দিচ্ছেন কেন?
ট্রায়াথলন।
জগন্নাথবাবু পিঠের থেকে বালিশটা কোলের ওপর এনে ঝুঁকে বসলেন। পেন্টাথলন, হেন্টাথলন, ডেকাথলন শুনেছিস তো, সেইরকমই এটা হল ট্রায়াথলন। তিনটে বিষয়ে স্পোর্টস পর পর করতে হবে। প্রথমে সাঁতার, তারপর সাইক্লিং, তারপর দৌড়।
জগন্নাথবাবু পিটপিট করে তাকিয়ে রইলেন তুলসীর মুখের দিকে। মুখে পাতলা রহস্যময় হাসি। হাসিটার অর্থ একটু একটু করে তুলসীর কাছে পরিষ্কার হল যখন, তার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল, শিরদাঁড়া বেয়ে গরম একটা ধারা নেমে এল।
কাকাবাবু, আমি পারব। আমি ওই তিনটেই পারি।
আরে সেইজন্যই তো ডেকে পাঠিয়েছি। পূর্ণেন্দুর কাছে তোর কথা শুনেই আমার স্ট্রাইক করল। আমাদের কোটার চারটে মেয়ে তো নেওয়া হয়ে গেছে। আর্চারিতে, একজন এখনও বাকি, তা হলে ট্রায়াথলনে নিলে কেমন হয়? একটা নতুন ব্যাপার হবে! আর আমার মনে পড়ল, সেদিন তুই বলেছিলি, সাঁতার জানি, সাইক্লিং জানি। মনে আছে?
তুলসী ঘাড় নাড়ল। পাঁচ মাইল দৌড়ে তার ফাস্ট হওয়ার কথাটাও কি কাকাবাবুর মনে পড়েছিল? কিন্তু সে-সম্পর্কে কিছু তো বলছেন না!
নতুন স্পোর্টস বোর্ডের কাছে চিঠি লিখে অ্যাপ্রুভাল আনাতে হবে। যাকে নেব, তাকে তো আগে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। ট্রায়াথলনের কোনও কম্পিটিশন বাংলায় হয় কি না আগে সেটার খোঁজ করি। যদি হয়, তা হলে তাতে নেমে তোকে ফাস্ট প্লেস পেতে হবে। তারপর তোর নাম বোর্ডের কাছে পাঠাব। ব্যাপারটা বুঝলি?
তুলসী ঘাড় নাড়ল। সে বুঝেছে বন্ধ দরজাটা একটু ফাঁক হয়েছে। সেই ফাঁকের মধ্য দিয়ে অস্পষ্টভাবে একটা চাকরি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওটা তো অনেক দূরের ব্যাপার, তার আগে কাছের ব্যাপারটা তাকে জেনে নিতে হবে।
কাকাবাবু, তিনটে বিষয় পর পর কম্পিট করতে হবে, বললেন। কিন্তু কোন বিষয় কতটা করে করতে হবে?
জগন্নাথবাবুকে এবার সামান্য বিব্রত দেখাল। ব্যাপারটা আমার কাছেও নতুন, ডিটেইলে কিছুই জানি না। শুনেছিলাম মাদ্রাজে নাকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ানশিপ হয়েছে। আমি কালই খোঁজ নেব, তুই তিন-চারদিন পরে এসে জেনে যাস। তবে এটা জানি, সাঁতার, সাইক্লিং আর দৌড় পর পর তিনটে করতে হবে। তোর তো সাইকেল আছে।
আছে, তবে বড় পুরনো, বাবা কিনেছিলেন। ওটার অনেক কিছুই পালটাতে হবে।
তা হলে পালটে নে। প্র্যাকটিস তো করতে হবে, আর যত শিগগির শুরু করা যায়, ততই ভাল।
জগন্নাথবাবুর বাড়ি থেকে তুলসী যখন বেরোল, তখন বলরামবাবু ধাক্কাধাক্কি করতে করতে বিদ্যানগর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন। তাঁর হাতে স্পোর্টস্টাইম নামে একটি ইংরেজি খেলার পত্রিকা। খবরের কাগজের খেলার পাতাটি খুঁটিয়ে পড়েন কিন্তু খেলার পত্রিকা তিনি কেনেন না, এটিও কেনেননি। পেয়ে গেছেন।
বাড়ি ফেরার জন্য বিধাননগর স্টেশনে বলরাম চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর একটি ট্রেন এল। এত ভিড় যে, কামরার দরজা দিয়ে মানুষ উপচে বেরিয়ে রয়েছে। প্ল্যাটফর্মে যারা অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল দরজায়। সেই ঝাঁপানোদের মধ্যে বলরাম নিজেকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এবং মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পেরে পিছিয়ে আসেন।
ট্রেনটি যখন ছাড়ল, তখনও কেউ কেউ ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে ট্রেনের সঙ্গে ছুটল। বলরাম চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ট্রেনটির দিকে যখন হতাশ চোখে তাকিয়ে, তখন একটি লোক যেতে যেতে থেমে গিয়ে, তাঁর পায়ের কাছ থেকে একটি রঙিন মলাটের পত্রিকা কুড়িয়ে তুলে নিয়ে বলল, আপনার ম্যাগাজিনটা পড়ে গেছে।
বলরাম তার হাত থেকে পত্রিকাটা নেওয়ামাত্র লোকটি ব্যস্তভাবে চলে গেল। বলরাম তখন বলতে চেয়েছিলেন, এটা আমার নয়, ট্রেনে ওঠার সময় কারও হাত। থেকে পড়ে গেছে। কিন্তু বলার সুযোগই পেলেন না। মলাটে স্টেফি গ্রাফ আর মোনিকা সেলেস-এর ছবি, প্রকাশের তারিখ, চার মাস আগের। পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা গোছের একটা মনোভাব হল বলরামের। আমি না পেলে আমার বদলে অন্য কেউ পেত, ব্যাপারটা তো একই হত। রাত্রে এটা পড়ব স্থির করে পত্রিকাটা ঝুলিতে রেখে তিনি পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
বিদ্যানগর স্টেশন থেকে বেরিয়ে স্টেশন রোডে কলাওয়ালার কাছাকাছি হয়েছেন, তখন বলরাম শুনলেন তুলসীর গলা। মেসোমশাই, রানিসায়রে আর সাঁতার কাটতে যান না যে?
অস্বস্তি বোধ করলেন। না যাওয়ার কারণটা এতদিন পর না বলাই ভাল। তুলসীর চোখের এবং কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতা থেকে তিনি বুঝলেন, মেয়েটি মনে করে রাখেনি রূঢ়ভাবে তাঁর নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের কথা।
ঠাণ্ডা লেগে সর্দি হয়েছিল।
তা হলে কলা খাবেন না।
না, না, এখন একদম সেরে গেছে। ভাবছি কাল থেকে আবার যাব। সবুজ সিঙ্গাপুরি কলার একটা ছড়া তুলে বলরাম তাঁর ঝুলিতে ভরতে যাচ্ছেন, তখন তুলসী হাত বাড়িয়ে বলল, আমার একটা।
একটা নয়, দুটো। বলরাম দুটো কলা ছিড়লেন ছড়া থেকে। সাইকেলে কোথায় গেছিলে?
ওপারে জগন্নাথকাকার কাছে। আমিও ভাবছি কাল থেকে জলে নামব। সাইকেলটাও সারাতে হবে। মনে হচ্ছে ভালই খরচ পড়বে।
তুলসী একহাতে কলা খাচ্ছে অন্য হাতে ধরা সাইকেল—এইভাবে সে বলরামের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। রাস্তার ভিড়ের অংশটুকু পেরিয়ে আসার পর বলল, আপনার চেনাজানা কেউ আছে যে, টেপরেকর্ডার কিনবে?
কেন! তুমি কি বিক্রি করবে?
হ্যাঁ। দশ কিলোমিটারে প্রাইজ পেয়েছিলাম। আমি ওটা দিয়ে কী করব বলুন? গান শুনতে হলে তো ক্যাসেট কিনতে হবে, তার মানে খরচ! আপনার জানাশোনাদের মধ্যে যদি কেউ থাকে তো বলবেন, কেমন? একদমই নতুন, পাশের বাড়ি থেকে ক্যাসেট এনে শুধু দু-তিনবার চালিয়েছি। নতুনের থেকে কমেই দেব।
তোমার কি খুব টাকার দরকার?
হ্যাঁ, সাইকেলটা সারাব। আমাকে ট্রায়াথলনে নামতে হবে।
কী থলনে? বলরাম ঝুঁকে কানটা তুলসীর দিকে এগিয়ে দিলেন।
নতুন একটা স্পোর্টস। ট্রায়া-থ-লন। প্রথমে সাঁতার, তারপর সাইকেল, তারপর দৌড়। পর পর, মাঝে থামাথামি নেই।
সে কী! এ তো খুব কষ্টকর ব্যাপার।
তুলসীর মুখে আত্মপ্রসাদ ফুটে উঠল, তা তো বটেই। কষ্ট না করলে আর স্পোর্টস কীসের?
তোমার পায়ের নখের অবস্থা এখন কেমন?
নতুন নখ উঠছে, ব্যথাট্যাথা নেই।
তা এই ট্রায়াথলনে কোথায় নামবে? কবে হবে?
কিছুই জানি না। কতটা দৌড়তে হবে, কতটা সাঁতার কাটতে হবে, তাও জানি না। আজই তো জগন্নাথকাকার কাছে প্রথম শুনলাম। উনি খোঁজখবর নিয়ে আমায় জানাবেন বললেন। তুলসী দাঁড়িয়ে পড়ল, মেসোমশাই, এবার আমি যাব। টেপরেকর্ডারের কথাটা মনে রাখবেন।
হ্যাঁ, মনে থাকবে।
প্যাডেলে পা রেখে উঠতে গিয়েও তুলসী উঠল না একটা কথা বলার জন্য। জগন্নাথকাকা বললেন, একটা চাকরি হতে পারে যদি ট্রায়াথলনে ফার্স্ট হতে পারি।
তুলসী সাইকেলে উঠে প্যাডেল শুরু করল।