Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 9

তিমির বিদার || Bani Basu

পরদিন সাইটে গিয়ে দেখি দীপু আবার সেই থ্যাপাস থ্যাপাস হাওয়াই চটি, আর ন্যাতা মতো প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরে এসেছে। আমার চোখে বোধহয় রাগ, হতাশা, এগুলো পড়তে পেরে গেছিল। আমি কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই বলল—চটিসনি রুণু, এক হাজার টাকা মাইনেয় কাবলি-স্যামসন হয় না, পাটভাঙা প্যান্ট শার্ট পরতেও সাবান লাগে, আয়রন লাগে। এতদিন মুক্তাটা করে দিচ্ছিল। এখনও ওকে বেগার খাটাতে আমার বাজে লাগে।

—তোর তা হলে বাজে-লাগা না-লাগা ব্যাপারগুলো আছে?

ও বলল, আলবাত আছে। মরমে মরে থাকি রে রুণু। তুই যবে থেকে সেই পাগলের ডাক্তার সিনহা না কী ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছিস তবে থেকে আমার বেশ বিবেক গজিয়েছে।

—ইয়ার্কি মারিস না দীপু। এখানে এভাবে কাজ করলে কে তোকে মানবে?

—দূর। তুইও যেমন, কে কাকে মানছে এখানে?

—মানছে। আলবাত মানছে। এবার হঠাৎ সাইটে এসে কেউ যদি তোকে আমার বেয়ারা ভাবে?

—বেয়াড়া কিছু হবে না তাতে। তা ছাড়া আমি তো তোর বেয়ারাই।

—চমৎকার!

—কী আশ্চর্য! কবে থেকে দ্যাখ তুই যা যা হুকুম করছিস তামিল করে যাচ্ছি। চাকরি নে, চাকরি নিলুম। জামা-কাপড়-জুতো কেন, জামা-কাপড়-জুতো কিনলুম। পাগলের ডাক্তার দেখা। পাগলের ডাক্তার দেখালুম— এতেও যদি বেয়ারা না হয়…

আমি হাল ছেড়ে দিই। কলোরস বলেছিল বটে—সেয়ানা পাগল! এক একটা মানুষ আছে যেন জুতোর সুকতলা, যেমন বেঁটেদা, নুয়েই আছে। এক এক জন আছে মানিয়ে চলে, কত ধানে কত চাল বোঝে, কম্প্রোমাইজ করে, কিন্তু একটা সীমা পর্যন্ত যেমন আমি, আর এক একটা মানুষ আছে যাদের তুমি কিছুতেই কাণ্ডজ্ঞান, ধানচালের হিসেব শেখাতে পারবে না, একরোখা একবগ্গা, কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, অথচ গুণ আছে, যোগ্যতা আছে— দীপে শালা এই জাতের। একেক সময়ে মনে হয় পায়ের চটি খুলে বেধড়ক পিটি। কিন্তু ওই! সীমা! একটা সীমা পর্যন্ত আমি নামতে বা উঠতে, রাগতে বা না-রাগতে পারি, তার এ দিক ও দিক আমার কাছে ব্ল্যাঙ্ক, একটা কালো পাথরের দেয়াল। আমাকে আটকে দেয়।

বিকেল সাড়ে চারটেয় আমি চলে আসি। দীপে তার পরেও কিছুক্ষণ থাকে। সারাদিন আমাদের কাছে হবু ফ্ল্যাট-ওনারদের যাওয়া-আসা। কবে কাজ শুরু হবে, তারা অ্যাট অল ফ্ল্যাট পাবে কি না। সময় পেরিয়ে যাবে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, প্রোমোটার যদি এসক্যালেশন চায়? আপনিই ভেবে দেখুন ভাই, সেটা কি উচিত হবে? কী বলছেন দাদা। আচ্ছা বুদ্ধি তো আপনার? বলেছে ডিসেম্বরে পজেশন দেবে। বড় জোর এক মাস কি দু’ মাস পেছোতে পারি, নইলে টাকা ফেরত চাইব। ভেবেছে কী চাকলাদার? আপনারা মশাই পাঁচ রকম কথা বলবেন না, ইউনাইটেড থাকুন, ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল। যেমন যেমন বাড়ি এগোচ্ছে টাকা দিয়েছি, টোয়েন্টি পার্সেন্ট, থার্টি পার্সেন্ট, ফিফটি পার্সেন্ট। যেই ঢালাই হয়ে গেল, এখন বলবে বাড়ি দেবে না? চাকলাদারের ছাল তুলে নেব। এইসব কথা সারাদিন আমাদের আশে-পাশে টরে-টক্কা, টরে-টক্কা করে, দীপে বসে বসে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান চুলকোয়। আমি বলি— আমাকে কেন বলছেন?

—বলব না মানে? আপনি চাকলাদারের রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়?

—না। আমি জাস্ট সাইটে উপস্থিত থাকি, এই সব খোলামেলা তো!

—ওই হল। ঠিক আছে সাততলা নিয়ে ডিসপিউট আছে, অন্যগুলো হোক।

এক ভদ্রলোক ককিয়ে উঠে বললেন— বলেন কী! আমার যে সাততলাতেই। হরি, হরি আপনারা শেষ পর্যন্ত পড়শি হয়ে পড়শির সব্বোনাশ করছেন?

শেষ পর্যন্ত আমাকে বলতেই হয় একটা না একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। একটু হয়তো দেরি হবে। এই যা! হবে না মানে? এটা তো মগের মুলুক নয়!

বলেই আমি জিভ কামড়ে ফেলি! মায়ের সঙ্গে আমার তর্কাতর্কি বা বলা ভাল মায়ের প্রতি আমার দীর্ঘ লেকচারটা মনে পড়ে যায়। সেখানে প্রতিপাদ্য ওইটাই ছিল— দেশটা পুরোদস্তুর মগের মুলুক। পুরো কেঅস। মাৎস্যন্যায় চলছে। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাচ্ছে। বেশি পাওয়ারফুল কম পাওয়ারফুলকে, ধনীতর দরিদ্রতরকে, পেশিবাজ অপেশিবাজকে… এই ভাবেই…।

থার্ড মাসের মাইনেটা হাতে এসেছে, আমরা এখন পালা করে করে আবার নিতাইকাকা বিশুদা করছি, দীপু আমাকে ঝুপসি গাছটার তলায় ডাকল। আমি প্রমাদ গনি—

—কী রে, ভয়েস?

—না, ইনফর্মেশন।

—কে দিলে? বিশুদা?

—না, আমার দুটো চোখ, দুটো কান, নাকের ফুটো।

—কী ইনফর্মেশন?

—রাত্তিরে সাইটে সিকিওরিটি কে থাকে জানিস?

—কে?

—জনাব সমশের আনোয়ার।

—সত্যি? যাঃ। চাকলাদার যে বলেছিল সংস্থা থেকে লোক নেবে!

—নিয়েছে তো! পাড়া-মস্তানের চেয়ে ভাল সিকিওরিটি হয়? শামু একটা সংস্থা নয়?

—তুই কী করে জানলি?

—আমি ছ’টা বাজলেই ফিরে যাই। কোনওদিনই সিকিওরিটি তখন আসে না। বালি ছাড়া অন্য মালগুলো তো আমরা নীচের হলে ঢুকিয়ে দিয়েছিই। বারো লিভারের দুটো তালা মেরে বেরিয়ে আসি। যে ওই দুই তালা তোড়তে পারবে সে আমাকেও পটকে দেবে শালা। কাল একটু দেরি হয়েছে। দেখি শামু আসছে জিনস পরা, গায়ে কালো হাতাঅলা গেঞ্জি না টপ, মুখে সিগারেট, চুল পরিষ্কার আঁচড়ানো। কোমরের কাছটা যেন কেমন ঠেকল। নির্ঘাত রিভলভার। আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে মিনিট পনেরো স্রেফ বাওয়ালি করে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলুম— কোথায় যাচ্ছিস?

বললে— ফুফার বাড়ি, স্ট্রোক হয়েছে, দেখতে যাচ্ছি। তা তুই বাড়ি যাবি না? হাজার টাকা মাইনে দিয়ে চাকলাদার তোদের কি কিনে রেখেছে?

—না, এবার যাব বলে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছি। শামুও অনেকটা চলে গেছে। কিছুদূর গিয়ে বাঁকের মুখে হঠাৎ কী মনে হল— চোখ ফিরিয়েছি, দেখি কী শামু ডাবল-ব্যাক করে আসছে, তারপরে সাজানো ইট আর বালির ঢিবির পেছন দিয়ে নিঃসাড়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

—তা তুই কী করে বুঝলি ও-ই সিকিওরিটি? অন্য কোনও মতলবে ঢুকেছিল এ-ও তো হতে পারে!

—দ্যাখ রুণু ওস্তাদ সমশের আনোয়ার ছিঁচকে চুরি করতে পড়ো বহুতলে ঢুকবে না এটুকু বোঝার শক্তি যদি আমার মতো হাফ-পাগলের থাকে তো তোর মতো কোয়ার্টার-পাগলেরই বা থাকবে না কেন?

আমাকে ভাবায় কথাটা। কিন্তু ছিঁচকে চুরির কথা হচ্ছে না। অন্য কোনও। অন্য কিছু…

—আচ্ছা দীপু এটা তো গদার এরিয়া, গদার এরিয়ায় শামুকে সিকিওরিটি…

—হতে পারে গদার এরিয়া। কিন্তু শামু হল পাতি-গুণ্ডা, হোয়্যার অ্যাজ গদা হল হাই-ফাই। মাফিয়া-টাফিয়া বলা যায়। শামু এই সাইটে একটা নাইটওয়াচের চাকরি পেলে তাকে হাম্পু দেবে এত ছোট দিল গদার নয়। ওরাও কতকগুলো এটিকেট মানে। বুঝলি? তা ছাড়া যে মুহূর্তে শামু বাড়িটার ভেতরে গুপ্তি হয়ে গেল, আমি…

—ভয়েস শুনলি?

—এগ্‌জ্যাক্টলি।

আমি জানি, গদার প্রতি দীপুর একটু, মানে তিল পরিমাণ হলেও পক্ষপাতিত্ব আছে। কেন না, দীপুর মা গদার বাড়িতে রান্না করতেন, গদারা ওঁকে ভালই মাইনেকড়ি দিত। সম্ভবত ব্যবহারও ভালই করত; এমনকী বেশি মাইনের জন্যে যখন মাসিমা মহাজনদের বাড়ি চাকরি নিলেন, গদারা রাগ করেনি। ওদের মধ্যে আসা-যাওয়া আছে। কে জানে মাসিমাকে দরকারে হয়তো ওরা ধারকর্জও দিয়েছে কিংবা দান-খয়রাত! হয়তো সেই পক্ষপাতিত্বের জন্যেই দীপু ও সব এটিকেট-ফেটিকেটের ভাঁওতা দিল। আমার যদ্দূর ধারণা গদার অভিজাত মাফিয়াগিরির আভিজাত্য ওই ছুরির ধার পাতলুন আর রসগোল্লা-লোফা মুখটুকুনিতে। সিকিওরিটিম্যানের চাকরিটা কি আর গদা নিজে করবে? ওর সেই কার্ডবোর্ড বাক্সের কারখানার ওয়ার্কাররা তা হলে আছে কী করতে? যাদের আমি আমার গারাজের ইম্যাজিনারি ‘সুধা-স্টোর্স’-এ তোলা নিতে আসার দিবা-দুঃস্বপ্ন নিশা-দুঃস্বপ্ন দেখি! এলাকার পজেশন, মোড়লি, খবর্দারির অধিকার কি কেউ রাইভ্যালকে ছাড়ে?

যাই হোক শামু সিকিওরিটিতে রইল, কি গদার গদারু সিকিওরিটিতে রইল তাতে আমার কীই-বা আসে যায়?

চাকলাদার লোকটা সম্পর্কে আমার কোনওদিনই কোনও মোহ ছিল না। জগাদা-বলাদাকে দাঁড় করিয়ে যেভাবে ও পাবলিকের ঝাড়টা এড়িয়েছিল তাইতেই বোঝা গেছিল লোকটি এলেমদার। জগাদাও যেভাবে ঘটনাটাকে ইউজ করে নিজের আখের গুছিয়ে নিল, তাতেও পরিষ্কার দু’জনের মধ্যে একটা আঁতাত থাকা সম্ভব। তবু ব্যাপারটা হজম করতে পারছি না। নিজের তৈরি ফ্ল্যাট নিজেই লিগ্যাল পয়েন্ট অন্যকে দিয়ে তুলিয়ে বন্ধ করা, ভাঙানো… হাম্পুটা ঠিক কার কার পেছনে? পয়লা নম্বর লুজার গুহমজুমদাররা। তারা আশা করে আছে তাদের পৈতৃক বাড়িটি ডেভেলপ করিয়ে তারা এখানে আলাদা-আলাদা ফ্ল্যাটও পাবে আবার হাতে কিছু টাকাও পাবে। সে গুড়ে বেশ বালি পড়েছে। দোসরা লুজার এই ফ্ল্যাটের হবু ওনাররা যাঁরা হয়তো সারা জীবনের সঞ্চয় ঢেলে এখানে একটা আশ্ৰয় তৈরি করার আশায় আছেন। এটা অবশ্য পুরোপুরি এম আই জি ফ্ল্যাট নয়, প্রতি ফ্লোরেই একটা করে দেড় হাজার স্কোয়্যার ফুটের আছে। সেগুলো শুনেছিলাম ঘ্যাম হবে, তাদের কেউ কেউ হয়তো অনেক সম্পত্তির মধ্যে এটা একটা জাস্ট করে রাখছে। কিন্তু সেটাও তো লোকসান। এটাও আমার আশ্চর্য লাগছে শামুকে রাতের সিকিওরিটিতে রেখেছে, ঠিক আছে। তো সেটা নিয়ে এত লুকোছাপার কী আছে? শামু মস্তান তাকে সবাই ভয় পায়, ঠিক আছে, কিন্তু সে আমাদের দোস্ত-ও তো বটে! সে একটা কাজ পেলে আমাদের আপত্তি থাকবার কথা না। তবে? সেই ফিরে-ফিরে গদার প্রসঙ্গই আসছে। আমাদের নয়, গদাকে লুকোতে চাইছে চাকলাদার, কেন না গদা এই এরিয়ার লর্ড। আচ্ছা, গদার লোক রাখতেই বা চাকলাদারের কী অসুবিধে ছিল?

জট পাকানো মাথা নিয়ে অন্যমনস্কভাবে পৌঁছে গেছি বিশুদার ওয়েটিংরুমে। এত অন্যমনস্ক ছিলাম যে এতটা পথ কখন পার হয়েছি, কখন ওয়েটিংরুমে ঢুকেছি, একটা কাগজ হাতে তুলে নিয়েছি, বুঝতেই পারিনি। যেন একটা মেশিন। একটা অভ্যাসে ফিট হয়ে গেছি। হুঁশ হল যখন কাগজে দেখলাম শনিতলার মোড়ে খুব ঝামেলা হয়েছে। লোক্যাল লোক নাকি খেপে গিয়ে কয়েকটা সাধারণ মজুরকে পিটুনি দিয়েছে। ব্যাপার হল ওখানকার বিখ্যাত সাত বিঘের তালাও—তিন বিঘে কবেই বুজে মজে গেছে কেউ খেয়ালও করেনি, বাকি পাঁচ-বিঘের বিশাল ঘোড়ার খুরের মতো দিঘিটাতে লোক্যাল সবাই কাপড় কাচা, বাসন মাজা, শৌচকার্য, চান করা সবই চালাত। একদিন সকলের খেয়াল হয় দিঘিটা আরও ছোট হয়ে গেছে, অর্থাৎ দিঘিটা ভরা হচ্ছে। রাত জেগে পাহারা দিয়ে ওরা ধরে ফেলে নিশুতি রাতে ট্রাকের পর ট্রাক রাবিশ মাটি সব ফেলা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে। ওরা দেখতে পেয়েছে টের পেয়ে ট্রাকগুলো উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করে। কয়েকটা মজুর ঝুড়ি হাতে ধরা পড়েছে। পাবলিকের হাতে তারা প্রায় আধমরা।

শনিতলার মোড় আমাদের এখান থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। তালাওটাও আমরা যথেষ্ট চিনি। জায়গাটায় প্রচুর ঝুগগি-ঝুপড়ি আছে। দু’-চারখানা পাকা বাড়ি আর একটা মিশ্র বস্তি। ওইখান থেকে আমাদের কলের মিস্ত্রি, কাজের লোক, ধোপা, ছোটখাটো কাঠের ছুতোর স-ব আসে। বেশি কথা কি বেঁটেদা ওইখানেই থাকে। নিমকি নামে সেই ধিঙ্গি মেয়েটাও থাকে ওই বস্তিরই বেঁটেদার উল্টোদিকের প্রান্তে। আমি সশব্দে বলে উঠেছি—আচ্ছা মজুরগুলোর কী দোষ?

পাশ থেকে পতিতকাকা বলে উঠলেন: কে মজুর? কেন মজুর? কী দোষ?

আমি বলি, কাকা শনিতলার তালাওটার খবরটা পড়েননি?

—শনিতলা? আমার কপালে যে শনি গেঁড়ে বসে আছে তার পরে আবার শনি? কাকা একটা ‘যেতে দাও’ ‘যেতে দাও’ ভঙ্গি করলেন হাত দিয়ে।

আমার কিন্তু খবরটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগল। এরকম খবর আজকাল প্রায়ই দেখা যায়। আবার এ-ও দেখা যায় কোনও না কোনও রাজনৈতিক পার্টির অর্থাৎ যারা জনগণের কাছে ফ্রম টাইম টু টাইম ভোট চায় তাদের একাধিক কেডার এমনকী ছোটখাটো আঞ্চলিক নেতাও এর ভেতরে আছে। রুই কাতলা রাঘব বোয়ালও পেছনে থাকে— টের পাওয়া যায় বেশ। কীভাবে কেউ এ সবের মধ্যে থাকতে পারে, মানে কেমন করে ক্ষমতাটা হয়, কী ভাবে সেটা প্রয়োগ করে, কীভাবে সাকসেসফুল হয়, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আসলে আমি তো আদার ব্যাপারি, বড় বড় জাহাজের কাণ্ডকারখানা কী বুঝব! আমার আংশিক সুপারভিশনে তৈরি বাড়িটা কর্পোরেশন ভাঙছে, হবু মালিকরা কপাল চাপড়ে হাহাকার করছে তাতেই আমি যেন চোর দায়ে ধরা পড়েছি, ভীষণ একটা অপরাধবোধ জাগছে মনের মধ্যে এত দুর্বল আমি। কাওয়ার্ড বললেই হয়। সেখানে কোনও জনগণের কাছে ভোট চাওয়া পার্টির লোক কতটা সাহস থাকলে জনগণের পুকুর বোজাতে নামতে পারে? ধরুন, পুকুরটা কার? কারওর না কারওর তো বটে! যদি কারও ক্লেম না থাকে তা হলে সরকারের খাস? তা-ও যদি না হয় তা হলে পুকুরকে জিজ্ঞেস করতে হয়— পুকুর তুমি কার? চারপাশে উবু হয়ে বাসন ধুচ্ছে ঝোপড়ির মেয়ে-বউরা, চান করছে মরদ, সাঁতার কাটছে বালক-বালিকা, এখন এরা তো বলবে— এ পুকুর আমার! পাবলিক প্লেস যাকে বলে! কার থেকে কিনল তা হলে এরা পুকুরটা! জনগণ বিক্রি করেনি। সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে কোনও জলা দিঘি পুকুর ফটাফট বোজানো চলবে না। তা হলে সরকারও বিক্রি করেনি। এখন ব্যক্তিগত বা শরিকি মালিকানা কার? কাদের? তাদেরই খুঁজে পেতে পুকুরটা এরা কিনেছে না কি? রাবিশগুলো কোথা থেকে আনে? ট্রাক ভাড়া কত? মজুরগুলো কোন পাড়ার? সব আমার জানতে ইচ্ছে করে। নিজে তো পারিনি। পারি না। তাই অসীম কৌতূহল আমার এই সব পারগতা সম্পর্কে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ছুটে চলে যাই, সব জেনে নিই। মৃতপ্রায় মজুরগুলো? মরে তো আর যায়নি। মৃতপ্রায়! ও ঠিক বেঁচে উঠবে। ওদের কাছ থেকে তখন কিছু কিছু খবর পাওয়া যেতে পারে, এখন ধরুন আশপাশের অনেক লোকই আমার চেনাশোনার মধ্যে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যদি জানতে পারা যায়! মানে এই পুকুর-চুরি জাতীয়। কীভাবে কী করা যায়! নট দ্যাট আমিও পুকুর-চুরিতে নামতে যাচ্ছি। কিন্তু এই যারা চিট ফান্ড খুলে রাশি রাশি লোকের বিশ্বাস ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা করে, এইভাবে পুকুরকে পুকুরই লোপাট করে দিতে পারে তাদের আই কিউ তাদের গাটস আমাকে অবাক করে। আমার মনে হয় তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করি— আচ্ছা দাদা। একটা সত্যি সত্যি ভাল বিশ্বাসযোগ্য ব্যাঙ্ক, কী একটা ভাল দেখে পুকুর পরিষ্কার করা, নদী ড্রেজ করা এগুলোতে কী আরও বেশি আই কিউ, বেশি গাট্‌স লাগে? যদি তা না-ই লাগে তা হলে সেটা না করে এইটা করলেন কেন দাদা! মানে চয়েসটার কারণ কী? রিস্‌ক ফ্যাক্টরটা তো এটাতে বেশিই থেকে যায়, তাই না? তা হলে? কারণটা কী? ফাঁকা থেকে টাকা? আরে দাদা গরিব-গুরবো লোকের বিশ্বাস অর্জন করতেও তো খ্যামতা লাগে, সে খ্যামতা ধরেন, সেটা ভাঙিয়ে লোকগুলোর টাকা আত্মসাৎ করবার পর নিজের ছেলে-মেয়ে মা-বাবার মুখের দিকে তাকাতে অসুবিধে হয় না? ধরুন আমি এমনই একটা কিছু করলাম, আমার সে আই কিউ নেই তবু ধরুন করলাম। করে টরে সচিনের পোস্টার হাতে বাড়ি ঢুকছি। এমন সময়ে আকাশ থেকে একটা বিরাট সোনালি বেলুন নামছে। নামছে নামছে হেলতে-দুলতে। সবাই তাকিয়ে আছে, উঁচুর দিকে মুখ, নামল বেলুনটা, রিন্টি সচিনের পোস্টার আঁকড়ে পিন ফুটিয়ে দিল বেলুনটার গায়ে, ফটাস করে ফেটে গেল বেলুন আর তার জায়গায় পড়ে রইল স্তূপীকৃত টাকা টাকা টাকা, সোনা সোনা সোনা। কার বেলুন? বাবার অদৃশ্য মুখ বলে উঠল, …আ…আ…আমার। মা বলল— কোথা থেকে পেলি রুণু? দাদা বলল অসম্ভব গম্ভীর গলায়—কী ব্যবসা তোমার? বউদি ঢুকে যাচ্ছে নিজের ঘরে। নির্বাক, ভীত। রিন্টির হাত থেকে সচিনের পোস্টারটা পড়ে গেল। অত কম আঘাতেও ফুটো হয়ে গেছে উঠোনের মাঝখানটা। ধোঁয়া উঠছে, ধোঁয়া। তার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে নিজের খয়রা মাছ আমার পাতে-তুলে-দেওয়া মা, পূর্ব রেলের পেটি ক্লার্ক দাদা যে নাকি প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ধার করে আমাকে টাকা দিতে চাইছে ব্যবসা করবার জন্য, মাথায় গামছা-বাঁধা ছোট্ট ইয়ার্কি মেরে মন ভাল করে দেওয়া বউদি আর…আর…কাকু—আমাকে একটা সচিনের পোস্টার কিনে দাও না কচি গলার এই আবদার। গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি আমি, আমার বেলুনের মৃতদেহ আমার টাকা টাকা টাকা সোনা সোনা সোনা স-ব স-ব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress