Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 4

তিমির বিদার || Bani Basu

—কাকু, সচিন?— রিন্টি এমন করে বলল যেন সচিনকে ও নেমন্তন্ন করেছিল, আমার তাকে নিয়ে আসার কথা। মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল সচিন এল না, একটু ছুটি পেয়েছে, ফ্যামিলি নিয়ে অ্যান্টার্কটিকায় বেড়াতে গেছে।

বললাম— খুঁজছি তো, না পেলে কী করব বল।

—তুমি ভাল করে খুঁজছ না।

রিন্টির মা এসে তাকে এক ধমক দিল—কাকু চাকরি খুঁজবে না তোমার সচিন খুঁজবে?— খাইসে, বউদি মর্নিং স্কুলে পড়ায়। এসে গেছে।

বললাম—বউদি একটা কথা আছে।

—কী কথা? ব্যাঙের মাথা?

মা বলল—যা দিকিনি চান করতে যা, চান করে বেরোলেও তো পারিস। আমি আর তোর ভাত আগলে বসে থাকতে পারছি না।

—কে তোমাকে ভাত আগলে বসে থাকতে বলেছে?

মা কোনও জবাব দিল না। রান্নাশালের দিকে চলে গেল।

বউদি বলল—কী ব্যাং? সোনা ব্যাং না কোলা ব্যাং?

—একটা টেম্পোরারি কাজ পাচ্ছি। সোনা ব্যাং-ই বলতে পারো।

—সত্যি? বউদির চোখ চকচকে হয়ে উঠল অমনি।

—ছ’হাজার টাকা মাইনে।

—স্টার্টিং? সত্যি?—বউদির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

—আজ্ঞে। দেখো, আবার জ্বলতে আরম্ভ কোরো না।

—সত্যি? বলো না বাবা!

—আঃ, বললাম না টেম্পোরারি! কনসলিডেটেড।

—বলিস কী রে রুণু! বউদি এক পাক নেচে নিল। ফার্স্ট মাসের মাইনে পেয়ে আমাকে একটা সিল্ক বমকাই কিনে দিস।

—কত দাম?

—হয়ে যাবে, ধর হাজার চারেক।

আমি গম্ভীর হয়ে বলি, মাত্র? আর কিছু না?

—আর কিছু কী করে হবে বল। দু’হাজারে কি কানের কিছু ভাল হবে? আর একটু অ্যাড করতে হবে। তোর টিউশনির টাকা থেকে…

আমি মাথায় নারকোল তেল ঘষতে ঘষতে বলি—অত টক খেয়ো না। ছ’হাজার টাকার চাকরিও করব, আবার বাড়ি-বাড়ি ছাত্র পড়াতেও ছুটব। ও গুড়ে বালি।

—বা, বা, বা—এতদিন যে খাওয়াচ্ছি। পরাচ্ছি।

—পরাচ্ছ না। শুধু খাওয়াচ্ছ, ভাত, আলুসেদ্ধ, খেঁসারির ডাল, আর কলার বড়া।

—মারব এক থাবড়া রুণু। খেঁসারির ডাল কেউ খায়?

—কেউ না খেতে পারে, তোমরা খাও। তোমরা যদি না খাও—বেকার দেওরকে খাওয়াও। বউদি এবার এক হাত তুলে তেড়ে আসে।

মা না এসে পড়লে ঠিক একটি থাবড়া জুটত।

মা বললে—কী হচ্ছে রুণু?

—অমনি ‘কী হচ্ছে রুণু?’ কেন ‘কী হচ্ছে টুকু’ও তো বলতে পারতে! একচোখোমির কমপিটিশন হলে ফার্স্ট প্রাইজ পাবে।

—যা চান করে আয়।

চান করতে যাচ্ছি বউদি বলল—সত্যি? ভড়কি দিচ্ছিস না তো!

—আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?

চান করতে করতে অবশ্য আমার মনে হল টিউশনিগুলো না-ছাড়াই ভাল। চাকলাদারের বাড়ি কিছু অনন্তকাল ধরে হবে না। যে রেটে এগোচ্ছে তাতে হয়তো মাস ছয়েকের মধ্যেই কমপ্লিট হয়ে যাবে। হয়তো সেইজন্যেই ছ’ হাজার ছড়াচ্ছে। তদ্দিনে আমার খানিকটা এক্সপিরিয়েন্স হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু ছ’ মাস ফুরোবার মাথায় মাথায় ঠিক এই চত্বরেই আরেকটা মাল্টিস্টোরিড হবে কী? ‘নির্মীয়মাণ বহুতলের জন্য অভিজ্ঞ সুপারভাইজার চাই’—এরকম কোনও বিজ্ঞাপনও তো… নাঃ চারটে মাত্র টিউশনি, গড়ে দেড়শো করে ছ’শো টাকা। এটা স্টপ করা ঠিক হবে না। সবগুলোই সন্ধেয়। কাজেকাজেই আমি দিনের বেলায় সংসারের খেপ খাটি। তা সেইটে হবে না।

মা কিন্তু শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। রান্নাঘরের সামনে একটা ক্যারমবোর্ডের মতো চৌকো জায়গা আছে। সেইখানে কেরোসিন কাঠের এক চারপেয়ে টেবিল আর চারটে লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। মা মুখে গরস তুলতে গিয়ে থেমে গেল আমার ভাল খবর শুনে। তারপর গরসটা খেয়েই নিল। বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে। কয়েক গরস খেয়ে বলল— ভাল করে ভেবে দেখেছ!

—কেন বলো তো! এর মধ্যে ভাবাভাবির কী আছে?

—সেই ভিখিরি চাপা পড়ার ঘটনাটা ভুলে গেছ বোধহয়।

—হ্যাঁ, তো তার সঙ্গে কী!

—তুমি যে ঘরটায় বসে কাজ করবে সেটাও ভেঙে পড়তে পারে। ভেঙে পড়ার চান্স আছে বলেই হয়তো লোকটা অত দিচ্ছে।

—সে ক্ষেত্রে তোমরা একটা বিরাট টাকা কমপেনসেশন পাবে। জগাদা-বলাদা-বিশুদা-অরবিন্দদা সব্বাই তো রয়েছে। কমপিটিশন করে টাকা বার করে দেবে।

মা’র মুখটা মুহূর্তে ভিমরুলের চাকের মতো গোমড়া হয়ে যায়।

আমি বলি—আচ্ছা মা, সেটা ছিল একটা পাতলা কাঁচা দেয়াল। জাস্ট জমিটা ডিমার্কেট করে রাখার জন্যে তোলা। হাফ পাঁচিল। এখন পুরো স্ট্রাকচারটা মানে ঢালাই টালাই সব শেষ। এখন জিনিসটা ভেঙে পড়বে?

—প্রদীপ কুণ্ডলিয়ার কেসটা বোধহয় তোমার মনে নেই। বেশ ছোট তখন তুমি। কিন্তু ল্যান্সডাউন রোডে যে একটা বহুতল ধসে ফ্যামিলিকে ফ্যামিলি সাবাড় হয়ে গেল, সে তো তোমার দেখার মধ্যে। সে-ও একদিনে হয়নি। কয়েক বছর বাস করবার পর হয়েছে।

—তুমি তো দেখছি সেই শরৎচন্দ্রের বিন্দুর মতো হলে। ছেলেকে পাঠশালে পাঠাবে না, ছোটটি পেয়ে যদি কেউ চোখে কলমের খোঁচা দিয়ে দেয়! সত্যি মা! দেখালে বটে!

—কী জানি বাবা, যা ভাল বোঝো করো। জীবনে তো কোনওদিন সুখ বলে জিনিস জানিনি, এখন তোমাকে নিয়ে আমার শান্তিটুকুও গেল। তপু কী ভাগ্যি পাশ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি পেয়ে গেল, চাকুরে বউও ঘরে আনল। তাই, নইলে…

এইবার আমার রাগ হয়ে যায়। বলি—বেশ আমার না হয় সে ভাগ্য হয়নি, চাকুরে বউ একটা জোটাতে পারি অবশ্য। তাতে হবে?

মা সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কিত চোখ তুলে বলল—কেউ আছে?

—উঃ তুমি না! নেই। কিন্তু বিয়ের লোভে চাকুরে মেয়েরা আজকাল বেকারকেও বিয়ে করছে। এটাও একটা হিল্লে। তবে বউটি তোমার শান্ত, সুকুমারী, ছেলেমানুষটি নাও হতে পারে। হয়তো জাঁদরেল পোস্টাপিসের কেরানি। আমার থেকে বছর পাঁচ সাতের বড়। আমাকে একবার ‘রুণু—উ-উ’ বলে হাঁক ছাড়লে আমি পটোল তুলব। তোমাকেও…

—থাক থাক হয়েছে—মায়ের মুখে একটা ক্ষীণ হাসির আভা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। মা বললে—দ্যাখ পোস্টাপিসের কেরানি-টেরানি বলে অমন করে মেয়েদের সম্পর্কে বলবি না। এইসব মেয়েরা সংসারের অ্যাসেট তা জানিস? দশ হাতে দশ দিক সামলায়। তোর মতো চ্যাংড়াকে বিয়ে করতে তাদের বয়েই গেছে।

—সঙ্গগুণে তোমার অনেক চেঞ্জ হয়েছে মা। লাস্ট সেনটেন্সটা তো একবারে বউদির স্টাইলে বললে!

মা বলল—কে কাকে চেঞ্জ করে! এসব ভ্যালুজ আমার নিজের জীবন দিয়ে শেখা। তপু যখন টুকুকে নিয়ে এসে দাঁড়াল, টুকু ছিল কড়ে আঙুলের মতো রোগা, মুখ চুপসোনো এতটুকু, এতটুকুনি সে মুখ কালো না ফর্সা কিছুই বোঝা যায় না। তপুর পাশে একেবারে বেমানান। আদর করে ঘরে তুলিনি? কোনওদিন কারও সঙ্গে বউয়ের রূপগুণ নিয়ে গুলতানি করেছি? আজ যে তোর বউদি এমন গোলগাল, শ্রীছাঁদ অলা দাঁড়িয়েছে সে কার যত্নে? কেন যত্ন? ভ্যালুজ ছিল বলেই না? নিজেরও ছিল, তোর বাবারও ছিল, মেয়েদের মা জ্ঞান করা, শক্তি, ভাগ্য বলে গণ্য করা।

—দোহাই মা আর শক্তিটক্তি হয়ে কাজ নেই। ঠিক আছে আমি তক্কেতক্কে থাকব। তেমন তেমন কালোকোলো রোগাসোগা চাকুরে মেয়ে পেলে তোমার ভ্যালুজ প্রমাণ করবার জন্যে এনে ফেলব। কিন্তু উইদাউট নোটিস।

মা এমন করে আমার দিকে চেয়ে রইল যেন হিপনোটাইজ করে পেটের কথা জেনে নেবার চেষ্টা করছে।

আমি আর দাঁড়াই না। হাসি চেপে বাইরের ঘর। মা যতই বলুক কে কার থেকে শেখে ‘তোর মতো চ্যাংড়াকে’ ‘গুলতানি’এসব বউদি ব্র্যান্ড। মা বউমার দ্বারা বিলক্ষণ প্রভাবিত হয়ে পড়ছে।

আর হবে না-ই বা কেন? বউদি আমাদের ঘরে ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোচ্ছে। এল যখন কী সলজ্জ, কী ডিফিডেন্ট, যেন কালো মেয়ে হয়ে ফর্সা ছেলেকে পাকড়ে মরমে মরে আছে। সব্বাই একধার থেকে বলতে লাগল কী চমৎকার বউ! যেমন ব্যবহার তেমন কাজকর্ম। ভোরবেলা স্কুল যাচ্ছে, স্কুল থেকে ফিরে মাস্টারির খোলস খুলে রেখে ঘরের লজ্জাবতী লতা, দাসানুদাসী। খালি আমার দিকে তাকিয়ে যখন ঘোমটার ফাঁকে ফিক ফিক হাসত, তখন আমার একটা ধন্দ জাগত মনে। শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে যেত। তারপর একদিন বাবাই ডেকে বললেন— বউমা, তুমি কি আমাদের বাঘ-ভালুক কি বেগার খাটানো মধ্যযুগীয় জমিদার মনে করো?

—না তো। কেন বাবা! যেন ভীষণ ইনোসেন্ট কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।

—না তাই বলছি। হ্যাঁগো তপু-রুণুর মা, বউমা যদি ওর ঘোমটাটুকু খুলে ফেলে তোমার কোনও আপত্তি হবে?

মা বলে— আমার? আমি নিজেই কত ঘোমটা দিই! শাশুড়ি বেঁচে থাকতেই দিইনি! এখন বাইরে বেরোলে বড়িখোঁপা নিয়ে লজ্জা করে তাই একটু কাপড় ছুঁইয়ে রাখি মাথায়।

অমনি বউদি বললে—বড়ি কোথায় মা, আপনার কী সুন্দর মাথা সাজানো ঢেউ খেলানো চুল। আজকাল তো ছোট চুলই ফ্যাশন। লম্বা চুল কেউ রাখছে না আর। তার ওপর অত সুন্দর ব্রাউন রুপোলি কালার। এরকম তো আজকাল ডাই করে করাচ্ছে মেয়েরা।

ব্যাস বউদির পয়েন্ট পাওয়া শুরু হয়ে গেল। আমার মাতৃদেবী তো কোন ছার, আশি বছরের বৃদ্ধাকেও রূপের প্রশংসা করলে নিদন্ত মুখে এক মুখ হাসি ফুটে ওঠে। ও আমার দেখা আছে।

আমার সঙ্গে বউদির কনফ্রন্টেশনও শুরু ওখান থেকেই। একা পেয়ে বললাম—খোশামোদ করে হাত করে নিলে শাশুড়িকে, অ্যাঁ?।

—ও মা! খোশামোদ! খোশামোদ কোথায়! কী জানো রুণু, মায়ের রূপ, তাঁর চোখ চুল, নাক মুখ ছেলেদের আলাদা করে চোখে পড়ে না। মা মানে মা, যিনি হলেন…

আমি বলি—অরূপরতন।

—এইবারে একটা কথার মতো কথা বলেছ।

—আমাকেও হাতাবার চেষ্টা করছ।

—তোমাকে! দ্যাখো রুণু অন্যায্য কথা একদম বলবে না, আমি একজন সৎ শিক্ষয়িত্রী। ওসব আমি সইতে পারি না। কথাটা ভাল বললে তাই বললাম।

—যদি তোমাকে কালোমানিক বলি! সত্যি কথা তো! সইতে পারবে?

বউদি একটু করুণ মতো হেসে (সব চাল) বলল—মানিক কেন? কালোই বলো না, শুধু কালো, ধরো কেলেকুষ্টি কি রক্ষাকালী! আমি কিচ্ছু মনে করব না, সত্যেরে লও সহজে—কবি তো বলেই গিয়েছেন।

আমিও অত সহজে হারি না, বলি—মানিক লেগেছে তাই মানিক বলেছি। সত্যি কথাই বলেছি। আমিও সহজে মিথ্যে বলি না। তবে অপ্রিয় সত্যও আমি সাধারণত অ্যাভয়েড করি।

ঠিক আছে বাবা, মায়ের এত ভয়, চাকলাদারকে একবার বাজিয়েই নিই। যেন না ভাবে বেকার হাতে চাঁদ পেয়েছে।

পরদিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ সাইটে হাজির হয়ে গেছি। চাকলাদার একেবারে বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা। মুখের তলায় বাটি ধরলেই হয়।

—আরে এসো, এসো সাহেব।

আমি মাথা চুলকে বলি—একটা অসুবিধে হচ্ছে যে!

—কী অসুবিধে? চাকলাদার একই সঙ্গে ত্রস্ত এবং বিস্মিত। ছ’ হাজার টাকা নিলাম হেঁকেও জিনিস ঘরে উঠল না, এমন একটা হতাশ ভাব।

যাক, একজন চাকুরিদাতাকে অন্তত মাথা নত করে দাও হে করতে পেরেছি। লোকটা বেশ বিপদে পড়ে গেছে। যে-কোনও কারণেই হোক।

—মানে… আপনার এই সাইটেই তো দু’জন কনস্ট্রাকশন চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। তাই…বাড়িতে…

—সব্বোনাশ! সে কী কথা! পাঁচিল ছিল ল্যান্ড-ওনারের। আমার করা নয়। ঝুরঝুরে ঘুণধরা হয়ে গিয়েছিল। ল্যান্ড-ওনারের পাঁচিল, শাস্তি খেলাম আমি। এতদিন কোর্ট কাছারি! এখন এটা হচ্ছে সেন্ট পার্সেন্ট পারফেক্ট ইয়াং ম্যান, তোমার মাকে বোলো তোমার সেফটির ভার আমার ওপর। বলেন তো যে ক’দিন এখানে কাজ করবে—একটা মোটা টাকার লাইফ ইনসিওরেন্স করে দিই। কী, দিতে হবে নাকি?

বলে কী লোকটা! তবে আমিও শেয়ানা আছি। আমি গম্ভীরভাবে বলি—আমার মা লাইফ ইনশিওর চান না, লাইফ শিওর চান।

—হাঃ হাঃ হাঃ হা। তুমি তো বেশ কথা বলতে পারো!

মাস্টারমশাই যেমন ভাল ছেলের পিঠ চাপড়ে দেন, তেমনি অবিকল।

কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটার ভাঙা নাকটা আচ্ছাসে মলে দিই। কেন যে এই ইচ্ছে! ফ্রাসট্রেশন থেকে বোধহয়।

বললাম, আমি তো অর্ডিনারি কমার্স গ্র্যাজুয়েট। একজন ম্যাথস অনার্স নিয়ে এম এসসি পড়া ভাল ছেলে আমার চেনা আছে। ট্রাই করে দেখবেন নাকি?

চাকলাদার হাঁ হয়ে বলল—তুমি তো আচ্ছা পরোপকারী ছেলে সাহেব? এমনটা আজকালকার দিনে দেখা যায় না—যা-ই বলো। তা ছেলেটি কে?

—দীপন চক্রবর্তী—ও-ই দিকে থাকে। খুব ভাল…

—দীপন-দীপন… মানে ওই ঝাঁকড়া চুল চশমাপড়া ছোকরা হাওয়াই চটি ফটাস ফটাস করে ঘোরে।

ঠিকই ধরেছেন ভদ্রলোক।

আমি বলি—হাওয়াই চটি কিন্তু ফটাস ফটাস করা যায় না, ধপাস ধপাস কি থপাস থপাস মতো আওয়াজ বেরোয়।

—রাইট য়ু আর। তোমার অবজার্ভেশন আছে। ছেলেটা চটিটা আগে ছুড়ে দেয়। তারপর আসে পা-টা।

—আপনার অবজার্ভেশনও খারাপ নয়, আমি বলি। —ও-ই।

—ও ম্যাথসের এম এসসি নাকি?

—এম এসসিটা পড়েছিল, শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।

—ফেল!

—উঁহু, বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যায়।

—তোমারই বন্ধু, বলছ, ভাল ছেলে, এখনও চাকরি পায়নি?

—নাঃ!

—কিন্তু ও তো পাগলা!

অর্থাৎ দীপুর ‘পাগলা’ বিশেষণ অলরেডি জুটতে শুরু করেছে?

আমি বলি—অঙ্কের লোকেরা অমন একটু উদাস-উদাস, ভুলো স্বভাবের হয়ে থাকে। কাজের বেলায় পারফেক্ট।

—ভুলো মন নিয়ে আমার কাজ করবে কী করে?

—আমি বলছি—পারবে। এখন আপনি রাখবেন কি না রাখবেন সেটা আপনার চিন্তা।

—বাপস্ তুমি তো খুব…

—উদ্ধত!

এতটা জিভ কেটে চাকলাদার বলল—তাই কি আমি বলতে পারি! বলছি খুব প্র্যাকটিকাল। কথা বলতেও পারো। তো দ্যাখো তোমার বন্ধুটিকে আমি ঠিক মানে একলা রাখতে সাহস পাচ্ছি না। এক কাজ করো না, দু’জনে মিলে কাজটা করো, সুবিধেও হবে। ও অঙ্ক তুমি অ্যাকাউন্টস! বোরও লাগবে না… হ্যাঁ তবে স্যালারিটা কিন্তু শেয়ার করতে হবে।

—ন্যাচারালি!

—তা হলে ওই কথাই রইল। কাল থেকেই কিন্তু জয়েন করো। আমি ক’দিন পর একটু বাইরে যাব। তার আগে সব বুঝিয়ে দিতে চাই।

দীপুর কথাটা আমি ভেবে বলিনি, বিশ্বাস করুন। দীপুকে দেখে-দেখে আমার ফ্রাসট্রেশন বেড়ে যায়, একশো বার ঠিক। কিন্তু তাই বলে আমাকে অফার করা সাধা চাকরি আমি দীপুকে দিয়ে দেব, এতটা উদারচেতা পরহিতৈষী টাইপ আমি মোটেই নই। কীরকম একটা ইনস্টিংক্ট আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল যেন। কেন, কী বৃত্তান্ত অত ভেবে ভেবে কূল পাইনি। ছ’ হাজারটা নিমেষের মধ্যে তিন হাজার হয়ে গেল। ভেতরটা করকর করছে ঠিকই, কিন্তু কেমন একটা স্বস্তি। সুখের চেয়ে সোয়াস্তি ভাল একটা কথা আছে না। টাকাটা সুখ, আর এই ফিলিংসটা সোয়াস্তি।

দীপুর খোঁজে যাওয়া দরকার এখন। কোথায় থাকতে পারে? বিশুদার লাইনে আছে? না সেই ঝুপসি গাছটার তলায়…

দুটোই খুঁজে এলাম, পাত্তা নেই। বাড়িতে গেলাম। তালা দিয়ে বেরোচ্ছে মুক্তা।

—কী মনে করে? মুক্তার কথাবার্তা সবসময়ে কাটা-কাটা, কাঠ-কাঠ।

—দীপু কোথায়?

—জানি না।

—ভেতরে নেই?

—তালা দিয়ে রাখবার অবস্থা এখনও হয়নি।

বাব্বাঃ! বলে কী?

—আর কিছু? আমার তাড়া আছে রুণুদা।

আমি পেছন ফিরি। মুক্তা যেমন আমার সঙ্গে ঠাণ্ডা অভদ্র অনেক সময়ে রুক্ষ ব্যবহার করে, আমারও তাই করা উচিত। দীপুর সম্পর্কে ওর ওইরকম ঠাণ্ডা, অনুভূতিহীন উক্তিটাও আমার যাচ্ছেতাই লেগেছে। কী ভেবেছে মেয়েটা? নিজে একমনে বিউটিশিয়ানের কেরিয়ার করে যাবে, অন্য সবাই চুলোয় যাক?

দুপুরবেলা সম্ভাব্য সব জায়গাগুলোতে খোঁজটোঁজ করে ফিরে যাচ্ছি, দেখি দীপু ফতাস ফতাস করে আসছে।

—কী রে? কোথায় ছিলি? সারা সকাল তোকে খুঁজেছি। বিশুদার লাইনে নেই… দীপু বলল—লাইনেই ছিলাম বাবা।

—ধ্যাৎ—

—আরে আজকে নিতাইদার লাইনে ঢুকেছিলাম। দ্যাখ রুণু আফট্রল এম পি লোক, রোজ রোজ বিশুদার কাছে গেলে যদি ভাবে ওকে আমরা ইগনোর করছি। কিংবা ওর পার্টিকে সাপোর্ট করি না, তা হলে? দ্যাখ তোর আমার একটা ভোট পেরিয়ে গেছে, আমরা তো দাগী আসামি হয়ে যাব রে?

—তুই কি বিশুদার পার্টিকেই সাপোর্ট করিস?

—তা অবিশ্যি করি না, কিন্তু জানতেও তো দিচ্ছি না, বিট্রে করে যাচ্ছি।

—বিট্রে নয়। আমাদের ভোট হল সিক্রেট ব্যালট সিস্টেমে দেওয়া। কারও জানতে পারার কথা নয়।

—তবু জেনে যায়।

—অদ্ভুত কোনও কৌশলে। সে যাক। তা তুই কাদের সাপোর্ট করিস?

দীপু চোখ সরু করে আমার দিকে তাকাল—কোন পার্টির পে-রোলে আছিস শালা? আমার হাঁড়ির খবরে তোর কী কাজ!

আমি হেসে ফেলি—হাঁড়ির খবর সত্যিই একটা আছে রে দীপু। আমার আর তোর একসঙ্গে চাকরি। তিন হাজার ইচ্‌। টেম্পোরারি। স্কুলেরটা লেগে গেলে তুই ছেড়ে দিতে পারবি…এক নিশ্বাসে আমি বলে যাই। চাকরিটার কথাও বলি। তবে চাকলাদার যে আমাকেই ধরেছিল সে-সব ডিটেলে আমি যাই না।

—চাকলাদার?—দীপু খুঁতখুঁত করে। শালা ভিখিরি চাপা দিয়েছিল…

—ও বলছে সে ওর পাঁচিল নয়। আগেকার পুরনো বাড়ির ঘুণ ধরা পাঁচিল। তাও ও এত দিন ধরে শাস্তি পেল।

—বলছে? কিন্তু এই প্রোমোটার চাকলাদার কম্বিনেশনটা…বুঝলি…

—কিচ্ছু বুঝলাম না। আমরা ওর বাড়ির খুঁটিনাটি সুপারভাইজ করব। হিসেব পত্র দেখব। ভাল না লাগলে বা লোকসান বুঝলে ছেড়ে দেব।

—ডান—খুব চকচকে চোখে আমার দিকে চাইল দীপু।

আ-হ। ভীষণ একটা স্বস্তি। একটা আরাম বোধ হল আমার। কেন আমি বলতে পারব না। তবে কি আমি মহামানব-ফানব হয়ে যাচ্ছি! দীপু বাড়িতে তিন হাজার কনট্রিবিউট করতে পারবে, তার ব্যবস্থা করেই কি আমার এই উল্লাস!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress