তিমির বিদার (Timir Bidar) : 22
বাড়িতে বোধহয় গুম মেরে থাকি। আমি অতটা বুঝতে পারি না। কিন্তু সবাই যেন আমাকে একটু সমঝে চলছে। রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরলেও গরম ভাত পাচ্ছি। মা বসে থাকছে। রিন্টিটা কাছে ঘেঁষছে না, সচিনের পোস্টারের আবদার ধরছে না, দাদা বাড়ি ফিরে জিজ্ঞেস করছে— রুণু ফিরেছে? খেয়েছে? অফিস বেরোবার সময়ে একটু উঁকি দিয়ে যায় —রুণু। বেরোচ্ছি, বুঝলি? কিংবা, কী রে উঠেছিস? —একেবারেই এলেবেলে কথাবার্তা। কোনও মানে নেই। আছে, কথায় নেই, কথা বলার চেষ্টায় আছে। মনোযোগ, একটু অতিরিক্ত। যেন কেজো সম্পর্কটার ওপরে যাওয়ার চেষ্টা। দাদা চিরকাল আমার অবস্থাটা বুঝেছে। আমি যে বসে নেই, প্রাণপণে চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিছুতেই পাচ্ছি না, কিন্তু ফাঁকটা অজস্র ট্যুইশনি দিয়ে ভরাচ্ছি, দাদার ঘাড়ে চেপে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াবার কোনও ইচ্ছেই যে আমার নেই এটুকু আমি দাদাকে বোঝাতে পেরেছি। বেকার ভাই নিয়ে মানুষের যে একটা সামাজিক লজ্জা থাকে সেটাও সম্ভবত দাদার নেই। কেন না, আমরা সামাজিক ভাবে যাদের স্টেটাস থাকে, সে গোত্রের তো নই! আমার কোনও চাহিদা নেই, নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিই, সংসারের যাবতীয় গাধার খাটনিগুলো খাটি। আর বউদি? সত্যিই মনে হয়, অনেক ভাগ্য করলে কারও সংসারে এ রকম বউ আসে। আমাদের তো আর কোনও ভাগ্যই নেই। এই বউদি-বউমা ভাগ্যটা আছে। বউদি সারাক্ষণ ছুতো করে করে আমাকে কথায় টানবার চেষ্টা করে। আমি কেন গম্ভীর, কী ভাবছি!
—রুণু। রিন্টির অঙ্কের খাতাটা একটু দেখো না, কী যে ভজঘট ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে আমি বুঝতে পারছি না।
—আমি পারব না।
—বাঃ তুমি তো রেগুলার পড়াচ্ছ।
—অত ছোট ছেলে আমি পড়াই না, তা ছাড়া ওসব সাহেবি-স্কুলের কায়দা বোঝার মতো মগজ আমার নেই।
—সব সময়ে স্কুল নিয়ে অত খোঁটা দাও কেন বলো তো?
—খোঁটা দিইনি। সত্যি কথাটা বলেছি— দেয়ালে লম্বিত আয়নায় আমি প্রাণপণে চুল আঁচড়াতে থাকি। ভীষণ কাজ যেন আমার। একটা ইমপর্ট্যান্ট মিটিং অ্যাটেন্ড করতে হবে যেন।
সত্য, পানু, অমল, কমল কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলি না। —ওই ‘কেমন আছ?’ ‘এই চলে যাচ্ছে ভাই,’ জাতীয়। বাস। কিন্তু দীপুর বাড়িতে আমি এখন নিয়মিত যাই। মাসিমার চাকরি গেছে, মাথার ওপর ঘুমপাড়ানি প্রয়োগের অ্যালিগেশন ঝুলছে। রোজগার, সম্মান, বিশ্বাসযোগ্যতা সব এক ধাক্কায় নেমে গেছে। মণি সাধ্যের অতিরিক্ত ট্যুইশন করছে, মুক্তার অবশ্য মাইনে বেড়েছে। কিন্তু ছেলে তিনটে? সেই আছে না? একটা পাগল একটা গোঁয়ার! আর বড়জন তো হারাধনের প্রথম ছেলে। কবেই ‘একটি কোথা হারিয়ে গেল’ হয়ে গেছে।
একটাই তো ঘর। সন্ধেবেলার ট্যুইশন যাবার আগে বসে থাকি গিয়ে। মাসিমার ভাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন কষ্ট হয়।
—ব্যাপারটা কী বলো তো? —উনি বিহ্বল হয়ে বলেন।
—আপনি তো গদার বাড়ি বেশ ছিলেন। মহাজনদের বাড়ি যেতে গেলেন কেন?
—গদাই তো আমায় বিজ্ঞাপনটা দেখায়, ডবল মাইনে। মাসিমা আপনি যান। আমরা চাই আপনি ভাল থাকুন। তা দেখ কী থেকে কী হয়ে গেল।
—কেউ আপনাকে ফ্রেম করেছে। কিন্তু কেন? কীভাবে? ফ্লাস্কটা আপনি কার হাতে দিতেন?
—একটা পিকনিক বাক্স মতো আছে ওদের। একটা খোপে ছোট ফ্লাস্ক। একটাতে টিফিন বক্স, একটাতে কাঁটাচামচ এইরকম ভাগ ভাগ করা। তাইতে ভরে দিতাম। মদনলাল, কিংবা বাড়ির কাজের লোকেরা কেউ— তারক, নওরতন, কি ফুলি তুলে দিয়ে আসত।
—তখন মহেন্দ্রদা কোথায়?
—গাড়িতে বসে থাকতেন। উনি বসলে তবে খাবার, ব্রিফকেস সব যেত।
—সেই বিশেষ দিনে, কে নিয়ে গিয়েছিল বাক্সটা মনে করতে পারেন?
—ভাবতে হবে।
—ভেবে রাখুন। কোর্টে কেস উঠলে কাজে লাগবে।
মাসিমা কেঁপে উঠলেন।
অসম সাহসী মহিলা, স্বামী মারা যাওয়ার পর, বড় ছেলে দায় এড়িয়ে পালিয়ে যাবার পর সংসারের সমস্ত ভার, চার ছেলেমেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে এবং সে-জন্য রাঁধুনিগিরি করতে পর্যন্ত পিছপা হননি। তিনি সাহস আশা হারিয়ে ফেলছেন, অথচ তাঁর কাছে ছেলেরা কেউ একটু ভরসা দেবার জন্যও মজুত নেই। মেয়ে দুটোই শুধু অক্লান্ত খেটে যায়।
আমার এক এক সময়ে মনে হয় দীপে শালাকে আচ্ছা করে ধোলাই দিই।
বাড়ির লোকেদের ওপর, পাড়ার লোকেদের ওপর যে আমার খুব একটা রাগ হয়েছে তা কিন্তু মোটেই নয়। আসলে মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ একটা ঘুরঘুরে পোকা ঘুরঘুর করে ঘুরতে থাকে। পোকাটা মগজের মধ্যে কিছু একটা কেটে চলেছে— ধৈর্য, সহনশীলতা, রসবোধ, একটা ‘ঠিক আছে, হয়ে যাবে’ গোছের ভাব। ‘হয়েছে, হয়ে গেছে,— ঝেড়ে ফেলে দাও— সামনের দিকে তাকাও, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবো’ গোছের নিজেকে নিজে দেওয়া উপদেশ যাকে বলা যায় অটো-সাজেশন, যার বলে আমরা নৈরাশ্য, শোক, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কাটিয়ে উঠি। ফলে, আমি আর ঠিক আমাতে নেই। আর সবাই আমাকে ঠিক চিনতে পারছে না বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আলকাতরায় স্টোন চিপস-এর মতো, আমি আটকে আছি দাঙ্গাটায়, মহেন্দ্র মহাজনে, মাসিমার গ্রেপ্তারে। কিছুতেই ভুলতে পারছি না আমার দেড়তলার ঘর থেকে দেখা শোনা সেই জনতার ক্রুদ্ধ গর্জন, সেই অপমান— ‘এই কে আছিস, মেয়েছেলেটাকে সামনে থেকে সরিয়ে দে তো!’ অপমান মানুষকে কেমন ছোট করে দেয়। যে বউদিকে বন্ধু বলে দিদি বলে, একজন অত্যন্ত সহৃদয় বুদ্ধিমতী নারী বলে আমাদের পুরো সংসারটা প্রায় একটা উচ্চ বেদিতে বসিয়েছে, মা তার দোষ দেখতে পান না, দাদা তাকে পরম নিশ্চিন্তি এবং ভরসা জ্ঞান করে, আমি তাকে একটা ‘ওয়ান্ডার’ বলে মনে করি, যদিও কক্ষনও ঘুণাক্ষরেও সেটা জানতে দিই না, সেই বউদিকে এককোপে যেন লোকটা তার সিংহাসন থেকে নামিয়ে দিয়ে গেল। বউদিকে যখনই দেখি— ‘মেয়েছেলেটা’ এই কথাটা আমার মাথার মধ্যে বোলতার মতো বোঁ-ও-ও করে ঘোরে। এই মেয়েটির, এই মানুষটির একটা অত্যন্ত তুচ্ছ জ্ঞান করার মতো ‘মেয়েছেলেটা’ দিকও আছে! বউদির ওপরও কেমন একটা বিরাগ-বিতৃষ্ণা হয়। এর কী সাইকলজি আমি জানি না। মনে হয়, ওহ্ যেটাকে তোমার বুদ্ধি, তোমার সপ্রতিভতা, মাধুর্য, ব্যক্তিত্ব বলে জেনেছিলাম, সেটা তা হলে খুব ঠুনকো জিনিস। আমাদের ভুলিয়ে রেখেছিলে। কিন্তু ওই দুর্বৃত্তটাকে ভোলাতে পারোনি। ও ঠিক দেখতে পেয়েছিল, চিনতে পেরেছিল! ‘মেয়েছেলে’ ‘মেয়েছেলে’ আমার মগজটা চিৎকার করে, মাথায় খুন চেপে যায়, মনে হয় আর কাউকে না পারি নিজেকেই নিজে গলা টিপে শেষ করে দিই। বউদির মুখের দিকেও আমি তাকাতে পারি না। যেন কেউ তার কাপড় খুলে নিয়ে গেছে। আমি বউদির সমস্ত আসা-যাওয়া কাজ-কর্মের মধ্যে একটা অনুক্ত ধিক্কার শুনতে পাই। —ছিঃ রুণু, লোকটাকে সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে দিতে পারলে না? পারলে না, না দিলে না? কারণ তোমার মনের ভেতরেও ওই ‘মেয়েছেলে’— ঘৃণাটা তুচ্ছ জ্ঞান করাটা আছে? কী জানি, বউদি হয়তো এসব কখনওই ভাবে না। কিন্তু আমি ভাবি, এবং ভাবি বউদি ভাবছে। আর অক্ষম ক্রোধে আমার সামনের কালো পাথরের দেয়ালটার ওপর ঘুষি মারি, ঘুষি মারি— ভাঙ শালা, ভাঙ শালা, ভাঙ, ভাঙ, ভাঙ।
কাগজে বেরিয়েছে— পুলিশ না কি আরও অনেক ক্লু পেয়েছে। জাল এবার গুটোবে ধীরে ধীরে। মহাজনদের পাঁচ কোটি টাকা হাওয়ালা মারফত দুবাই, আবুধাবি চলে গেছে।
রবিবার, জাস্ট এলোমেলো ঘুরতে বেরিয়েছি। উল্টো দিক থেকে দেখি অরুণ হনহন করে আসছে— মুখের মধ্যে একটা ভয় খাওয়া ভাব, কে যেন ওকে তাড়া করেছে, কোনও ভয়াল ভীষণ। অরুণ পতিতকাকার ছেলে, বাঙ্গালোরে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ও যে এসেছে তা-ই আমি জানতাম না। বলতে যাচ্ছিলাম কী রে অরু, কবে… অরুণ যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। —‘রুণুদা, একটা ডাক্তার, ডাক্তার বলতে পারো, রোববার… কাউকে পাচ্ছি না, সকাল থেকে বাবার শরীরটা বড্ড খারাপ। বোধহয়…’ বলতে বলতে অরুণের স্বর কেঁপে যাচ্ছে, গলা ধরে যাচ্ছে। সর্বনাশ, কাকে ডাকি? ছুটে যাই গণাদার দোকানে, ওখানে কে যেন বসেন। গণাদা বলল— দূর, আজ রোববার কখনও ডাক্তার পাস? ওষুধের দোকানই খোলা পাবি না, আমিই একা খোলা রাখি।
ও রোববার বুঝি মানুষের অসুখের ছুটি? আমি কড়া গলায় বলি।
গণাদা বলে, আরে ডাক্তারেরও তো শরীর-স্বাস্থ্য আছে, না কি?…
—সব্বাইকে একই দিনে শরীর-স্বাস্থ্য চর্চা করতে হবে? সব ডাক্তারকে? সব ওষুধের দোকানদের?
—আমাকে ঝাড়ছিস কেন ভাই, আমি তো খোলা রেখেছি। খোলা রাখি। তা কী হয়েছে পতিতকা’র? সিমটমটা কী?
—নিশ্বাসের কষ্ট। বাবার তো হাঁপানি আছেই!
আমি গণাদার দিকে তাকাই। বলি— অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে?
—আছে।
—তবে দাও, মানে নিয়ে এসো। আমি তো ফিট করতে জানি না। কুইক গণাদা।
দোকানটা, দোকানটায় সবে ধূপ দিয়েছি। এখনও খোকা আসেনি।
—চুলোয় যাক তোমার দোকান, তুমি আসবে কি না বলো!
আমার মুখের চেহারা দেখে গণাদা অক্সিজেন সিলিন্ডারটা বার করে আমাদের দিল। বলল এগিয়ে যা, আমি শাটার ফেলে আসছি।
পতিতকাকা পেনশন ভোগ করলেন তার মানে কাঁটায় কাঁটায় একমাস। চার হাজার তিনশো সাত টাকা। হার্টের ট্রাবল হয়েছিল, কাকিমাকে পর্যন্ত বলেননি, প্রাণপণে টুইশানি করে ছেলের পড়ার খরচ আর নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনটুকু জোগাড় করছিলেন। কাছা গলায় ঘুরছে অরুণ। আমাকে বলল— বাবার এরিয়ার দিয়ে আমার পড়া শেষ হবে রুণুদা, আমি ভাল চাকরি পাব, …তখন বাবা…বাবাটা… রুণুদা আমি বাঙ্গালোর যেতে চাইনি। বলেছিলাম আমি সাধারণ ছেলে বাবা, জয়েন্ট পাইনি, সেটাই মেনে নাও। আমাদের মতো…আমরা কে কবে লাখপতি এনজিনিয়ার হয়েছি বাবা, ছাড়ো। বাবা কিছুতেই শুনলে না। বললে আমার তিনটে সন্তান চলে গিয়ে তুই রয়েছিস। আমার জীবন যেমন হয়েছে হয়েছে, তোকে— তোকে আমি যতদূর পারি ওপরে তুলে দেব। যদি… যদি রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটগুলো ঠিক সময়ে পেত… উদয়াস্ত খাটুনি। বাবা নিজের ট্রিটমেন্ট করাল না, এখন দেখছি, ডাক্তার সেনের প্রেসক্রিপশন রয়েছে ইসিজি করাতে লিখেছেন, আরও কী কী সব, হল্টার কার্ডিওগ্রাম, ট্রেডমিল টেস্ট, বাবা কিচ্ছু করায়নি।
আমি বললাম— তোর শ্রাদ্ধের চিঠি আমাকে দুটো এক্সট্রা দে তো!
—নাও না, কাকে বলতে হবে, বলো। বাবার কাজ আমি ঘটা করে করব।
—কেন? ভূতভোজন করাবি কেন? আমার ভুরু কুঁচকে যায়।
আমার দিকে অবাক চোখে তাকায় অরু—ভূত?
—হ্যাঁ নানা কিসিমের ভূত। ধর মামদো ভূত, গো ভূত, প্রেত ভূত… খবর্দার ভোজন-টোজন করিয়ে কাকার কষ্টের টাকাগুলো নয়ছয় করবি না। ওগুলো তোর পড়াশুনো, কাকিমার চিকিৎসা, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া এসবের জন্যে। ভক্তি করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান কর, মিষ্টি ফিষ্টি খাইয়ে দিবি, একটা রসগোল্লা এক গ্লাস মিনারেল ওয়াটার। ব্যাস। একদম ফুলস্টপ। আর অরু, সারা জীবন মনে রাখবি কাকা তোর জন্যে কী করেছেন। কাকার আত্মা তাতেই তৃপ্ত হবে। ভূতভোজনের চেয়ে এটাই ইমপর্ট্যান্ট।
—লোকে কী বলবে রুণুদা?
—ও, আমাদের জেনারেশনের ছেলে তুই, এখনও লোকে কী বলবে ভেবে কাজ করিস! কোন হারামজাদা কবে এসে তোর বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিল?
—তুমি তো দাঁড়িয়েছিলে, বিশুদা, শামুদা…
—তা হলে সাহস থাকে তো, শুধু এই তিনজনকে চিঠি দে!
—কী যে বলো রুণুদা!
—শোন অরু, তুই যদি সেই বেম্মো ভোজন, নিয়মভঙ্গের এলাহি ঘটাপটার বন্দোবস্ত করে থাকিস, তা হলে আমার চিঠিটা তুই রেখে দে। আমি যাব না। অ্যান্ড আই’ল কার্স ইউ অ্যাজ এ কাওয়ার্ড, একটা কাওয়ার্ড যে বাবার কষ্টের টাকাগুলো স্রেফ ‘সুপুত্তুর’ সুনামের জন্যে ফুঁকে দিচ্ছে। আমাকে ক্ষমা কর।
অরু ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বলল— তুমি ঠিকই বলেছ। এক্কেবারে ঠিক। আমার নিজের যদি টাকা থাকত, সে আলাদা কথা। কিন্তু এর একটা পয়সা তো আমার নয়! সব বাবার না ভোগ করতে পাওয়া টাকা। শ্রাদ্ধ আমি ভালভাবেই করব। কিন্তু ও সব বাদ। মাকে একটু বোঝাতে হবে। মা এখন শোকার্ত। নানান ইমোশন… সেন্টিমেন্ট…।
—মাকে বল এফ ডিগুলো ভাঙানো যাচ্ছে না। বল আর দেনা করলে ডুবে যাবি। তোরও বাবা মতো অবস্থা হবে। ভাল ডোজ দে কাকিমাকে, নইলে মেয়েদের এইসব ইমপালসিভ, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে সেন্টিমেন্টে চলবার অভ্যেস বন্ধ করতে পারবি না। আর শোন, পারিস যদি দুটো শ্রাদ্ধের চিঠি নিয়ে আমার সঙ্গে চল।
—কাল গেলে হবে?
—ঠিক আছে।
—কোথায়? কাকে রুণুদা?
—সে তুই চিনবি না। চলই না।
কাছা গলায় — অপ্রত্যাশিত শোকের ধাক্কায় ধ্বস্ত ছেলেটাকে টেনে নিয়ে যাই হুগলি ডি-আই অফিসে। প্রথমেই কেষ্টা, সেই কেষ্টা ব্যাটাই চোর।
আমাকে দেখে চমকে বললে—আবার এসেছ? আবার কী? হাটো হাটো।
আমি অরুকে এগিয়ে দিয়ে বলি—এবার আলাদা কেস, ঘোষদা। নেমন্তন্ন। দয়া করে পায়ের ধুলো দিলে মৃতের আত্মার বড্ড শান্তি হবে।
—ঘোষ লিখেছ কেন? কৃষ্ণপদ ব্যানার্জি।
আমি বলি—ওই হল, ঘোষও যা ব্যানার্জিও তা। কৃষ্ণপদ ঘুষ কি লেখা যায়?
—তুমি তুত্তুমি … আস্পদ্দা তো কম না …
—রিল্যাক্স দাদা, রিল্যাক্স, চিঠিটা কার ছেরাদ্দের, পড়বেন না?
রাগি হাতে চিঠিটা খুলল কেষ্টপদ। খানিকটা পড়ে ব্ল্যাংক চোখে আমার দিকে তাকাল।
আমি বললাম—ধরে নিন, আপনার ছেলে, আপনার ছেরাদ্দের চিঠিটা আপনাকে মানে যার কুচুটে চোট্টামির জন্যে আপনি মারা গেলেন তারই হাতে দিতে এসেছে।
শক-খাওয়া লোকটাকে পাশ কাটিয়ে ডি-আইয়ের ঘরে ঢুকে যাই।
—কে? ও তুমি ভাই! বিশ্বনাথদা কেমন আছেন?
—বিশ্বনাথদা ভালই আছেন, পতিতপাবনদা মারা গেছেন।
—পতিতপাবনদা … আমি তো ঠিক …
—আপনার কত কাজ! তুচ্ছ জিনিস কি আর স্মরণে থাকে! এটা ওই পতিতপাবন সেনের শ্রাদ্ধের চিঠি, পাঁচ বছর পর ছ’ বছরের মাঝামাঝি — মস্তান নিয়ে এসে হুমকি দেবার পর যাঁর পাওনা-গণ্ডাগুলো চুকিয়ে ছিলেন! আবার বিধবার পেনশনের জন্যে আসতে হবে তো! চিঠিটা আগাম দিয়ে যাচ্ছি। দাও, অরুণ, দাও।
অরু হকচকিয়ে গিয়েছিল, একটা ব্ল্যাংক খামে ভরা চিঠি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে। আমি নাম লিখি অলকেশ দত্ত। চিঠিটা নিয়ে উনি চমকে ওঠেন। এ কী চন্দ্রবিন্দু দিয়েছ কেন?
আমি চিঠিটা ফেরত নিয়ে জিভ কাটি—ইসস্ দেখুন তো, কে মারা গেলেন আর কাকে চন্দ্রবিন্দু মারছি। ছ্যাঃ। তবে সরকারের কতগুলো টাকা বেঁচে গেল, বলুন তো? কেমন কল করেছেন? চন্দ্রবিন্দুটা কেটে দিয়ে বেরিয়ে আসি।
অরু বলছে শুনছি—দয়া করে একবার পায়ের ধুলো দেবেন কাকা।
কেউ কোনও উত্তর দিল না।
ভাবতে ভাবতে রাস্তা হাঁটি। একেবারে অন্যমনস্ক। অভ্যাসে রিকশা, ঠ্যালা, এক আধটা গাড়ি পাশ কাটাই। কী এত ভাবছি! ভেবে, আমার মতো একটা সাধারণ কমার্স গ্র্যাজুয়েট, একদা রিফিউজির বেকার ছেলে, কী করতে পারে? বুঝতে পারি কাগজে দেখা কতকগুলো ছবি আমার মাথায় মৌমাছির মতো ঘুরছে। কী ছবি? মহেন্দ্র মহাজন, হাতে ব্যান্ডেজ, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখে বিহ্বল শূন্য দৃষ্টি, যেন গাছপালা, মানুষজন, রাস্তাঘাট, যানবাহন কিছু চিনতে পারছে না। পাশে মদনলাল, পায়ের যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত। পাশে মদনলাল হাসপাতালের বেডে শয়ান। পাশে মদনলাল স্বাভাবিক, আহত হওয়ার আগে যেমন ছিল, পাশে মহেন্দ্র কিডন্যাপ হবার আগে যেমন ছিলেন, তারাতলা রোড, সোজা গেলে বজবজ। বাঁয়ে বেঁকে ডায়মন্ডহারবার, ব্রেসব্রিজ। ব্রেসব্রিজ… মাথায় এই ছবিগুলো নিয়েই দীপুর হানাবাড়িতে হানা দিই। দেখি আপন মনে খ্যাপার মতো হাসতে হাসতে হাতে খইনি ডলছে।
—তুই খইনি ধরেছিস?
—ধরাল একজন।
—তুইও ধরে নিলি? খইনিতে টোব্যাকো তো আছেই, ব্রাউন শুগারও নিচ্ছিস নাকি?
—নিতে পারি।
—তুই শ্ শালা— মাকে পুলিশ মুরগি করছে আর তুই …
—বাওয়ালি থামা রুণু, চ’ তোকে একটু আলোকপাত করি।
ইটের পাঁজা থেকে দীপে উঠে দাঁড়ায়। একটু নড়বড়িয়ে ওঠে, কিন্তু জাতে পাগল হলে হবে কী, তালে শালা আছে ঠিক।
—চ।
—কোথায় যাব? তোর সঙ্গে কোত্থাও যাব না। তুই একটা সাজা-পাগল, দায় এড়াবার জন্যে সেজে থাকিস। টো-টো কোম্পানি কাঁহিকা—আমি তোর সঙ্গে কোত্থাও যাব না।
—আরে চলই না, একটা বহুৎ ইনটারেস্টিং জিনিস দেখাব। না দেখলে পরে কিন্তু পস্তাবি। তখন বলবি—আমায় কেন বলিসনি?
ফুটতে ফুটতে দীপুর পেছন পেছন অসমাপ্ত বাড়ির সাইড-রেলিং-হীন ঢালাইয়ের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি। দোতলা পেরিয়ে যায়, তিনতলা পেরিয়ে যায়, চারতলা পেরিয়ে যায়। একেবারে সাততলায় পৌঁছে দীপু থামে। একদিকে, অর্থাৎ দক্ষিণ-পুবে সেই ভাঙা ফ্ল্যাট। ইটকাঠগুলো ভাঙা পড়ে আছে। কেউ একটু পরিষ্কার পর্যন্ত করেনি। কিন্তু ঢালাইয়ের খাঁচাটা এখনও অক্ষত দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্য তিনটে ফ্ল্যাট একেবারে আস্ত নতুন, দরজা লাগানো। খালি বাইরের রংটা হয়নি।
—ভাঙলই যদি, তো সবগুলো ভাঙল না কেন? —আমি আপন মনে বলি।
দীপু খইনিঅলা দাঁতে বিকট হাসতে থাকে।
—এটারও তো ঢালাইয়ের ছাদ, বিম, পিলার সব ঠিক আছে। এগুলোই-বা ভাঙেনি কেন? —আমি আবার বলি।
—অ্যায়। দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন—দীপু আওড়ায়। য়ু আর অন দা রাইট ট্র্যাক। আমি শালা মাল আগলাই, গ্রাউন্ড ফ্লোরের ওপরে এখন আর কাজ নেই। পাগলাটা! ইটের পাঁজায় বসে গাঁজায় দম দিই। ভাঙেনি কেন? … আমি দীপুর দিকে তাকাই, কেন বল তো?
—রি-বিল্ড করতে যাতে মিনিমাম খৰ্চা হয়! এ তো সোজা হিসেব!
আমি চোখে প্রশ্ন নিয়ে দীপুর দিকে তাকিয়ে থাকি।
দীপু বলে—কেস বুঝলি না? ‘হারাধনের দুইটি ছেলে ধরতে গেল ভেক/ একটি মলো সাপের বিষে রইলো বাকি এক।’ তুই বোধহয় জানিস না তোর প্রিয় কমরেড দেবল গুহর ছোট দাদু মারা গেছে।
—বলিস কী রে! জানি না তো! ওই যিনি হার্টে ভুগছিলেন!
—না, তাঁর ছোট। সেই খটখটে, খেঁকুরেটা। বুঝলি রুণু স্বামী-স্ত্রী হরবখত্ দেখবি দু’জনেই ভুগছে। এ বলে আমি আগে, ও বলে আমি আগে। দু’জনের মধ্যে বেটার অবস্থা যার সে-ই কেটে পড়ল। যার যেমন আয়ু। ভগবানের মাপা নিয়ম একেবারে। কেউ কিস্যু করতে পারবে না। অন্য হেটো রুগীটা একা-একা আর কদ্দিন যুঝবে? গেলেই, জগামিত্তির কেস তুলে নেবে, দমকলের স্যাংশন এসে যাবে, কর্পোরেশনের পারমিট বার হয়ে যাবে। ষাট-চল্লিশের হিসেব এক্কেবারে আগের মতো। চল্লিশের সোল প্রোপ্রাইটার রমেন গুহ, ডাইরেক্ট ডিসেন্ট-এ দেবল গুহ। ওনারদের টাকাটাও সুদে বাড়ছে।
—তা ছাড়াও কিছু ছুটকো কাজ কম্মো আছে। বুঝলি? সেগুলো শেষ হোক! —দীপু বলে চলে, ধর না কেন ওই দক্ষিণ-পশ্চিমের ফ্ল্যাটটা!
সে ফ্ল্যাটটার দিকে এগিয়ে যায়। টুকটুক করে টোকা দেয়।
আমি আশ্চর্য হয়ে শুনি ভেতর থেকে কে ফিসফিসে গলায় বলছে, কে? কে?
—আমি দীপুদা।
দরজা খুলে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে সমশের-সামসুলের বোন হাসিনা না? আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আমি, আমি নাকি পাড়ার সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে, আমার একেবারে বাক্য হরে যায়। একটা কথাও বলতে পারি না।
দীপু বলে—ঘাবড়াচ্ছিস কেন হাসি। এ তো রুণু! রুণু রে!
হাসি দু’-হাতে মুখ ঢেকে ফেলে।
ঘরটার চারপাশে চোখ চালিয়ে দেখি, জানলাগুলোর কাচ সব বন্ধ। কাচের মধ্যে দিয়ে আলো আসছে কিন্তু অসহ্য গুমোট। ভেতরে একদিকে এক সেট এঁটো থালাবাটি গেলাস, আর একদিকে একটা মাদুর আর বালিশ। বালিশের পাশে স্তূপীকৃত বইখাতা।
—তুই এভাবে ওকে এখানে লুকিয়ে রেখেছিস! আমার স্বরে আর রাগ নেই। শুধু প্রচণ্ড বিস্ময়!
—আরে আমি একটা পাগলা, বাউন্ডুলে, আমার মাথায় এত আসে? শামু, শামু ভাই, ওকে লুকিয়ে রেখেছে! রমজানকে রেজিস্ট করতে। না কী রে হাসি!
শামুর নাম করবার সঙ্গে সঙ্গে হাসি একটা আঁক মতো শব্দ করে পরক্ষণেই সেটা গিলে নিল।
দীপু বলল— বলে দেব না তো কী! আগে দোষটা রুণুর ঘাড়ে চেপেছিল। এবার চাপবে আমার ঘাড়ে। আর কী করে রিসক্ নিই বল? যা হল? দুরাত্মাদের ছলের অভাব থাকে না, বুঝলি তো! তা রুণু আমাদের সেরকম মিতে নয়। যতই অপমান হোক কাউকে বলবে না। তোর পড়াশুনো কী রকম চলছে?
—ভাল।
—এই অসহ্য গরমে আট কাঠ বন্ধ করে … তুমি থাকো কী করে? অবশেষে আমি বলি। হাসি মুখ নিচু করে বলল—সইতে তো হবেই! এরকম নয় তো ওরকম!
—ওর হাত ফাতগুলো দ্যাখ — ঘামাচি হয়ে হয়ে ফোস্কা মতো পড়ে গেছে।
সত্যি, দেখি মুখটাও হাসিনার অসম্ভব খসখসে, যেন ব্রণয় ভরে গেছে।
—রাত্তিরে শামু খাবার নিয়ে, বরফ নিয়ে আসবে, মাঝ রাত হলে জানলাগুলো খুলে দেবে — তখন হাসিনা বেগম খেয়েদেয়ে গায়ে-মুখে বরফ ঘষে চাঁদের আলোয় নিদ্ যাবে। নয় রে হাসি! —থাক আর না, কে কোত্থেকে টিকটিকি করবে। আয় রুণু। হাসি দরজা বন্ধ কর।
—তোর সঙ্গে ষড় করেই শামু করেছে নিশ্চয় কাজটা? —আমি ফিরতে ফিরতে শুকনো গলায় বলি।
—তুই কি খেপেছিস? শামু হল গিয়ে চাকলাদারের নাইট-ওয়াচম্যান, গেঞ্জির ভেতরে বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট, কোমরে ছ-নলা রিভলভার, হাতে ইয়া গুলি, পাগুলো স্টিলের মতো, শালা একটা লাথি ঝাড়বে তো তুই আমি কেন চাকলাদার বিশুদা সুদ্ধ ও-ই কোণে ছিটকে পড়বে। দু’জনের লাশ কী সাইজের, ওজন কত—ভাব একবার।
—তা হলে? চাকলাদার জানে?
—জানে বই কী! তবে এটা না! এটা শামুর নিজস্ব সিক্রেট। একেক জনের একেক ধান্দা আর কী! চাকলাদার কুমীরটা গভীর জলে ঘাপটি হয়ে আছে এখন। কোস্ট ক্লিয়ার দেখলেই সিনে চলে আসবে। এখন তোর চাকলাদারের আরও কত তালাও-ফালাও বোজাবার আছে!
—তুই বলছিস, শনিতালাও বোজাবার পেছনেও ও?
—আলবৎ।
—তার মানে দাঙ্গাটাও …
—রুণু, তোর আর কবে আই কিউ বাড়বে? এসব কেউ একা করে? বখরাদার থাকে। চোরের পেছনে জোচ্চোর তার পেছনে বাটপাড় তার পেছনে …। তোরা ভাবিস গডই সব। কিন্তু শালা, গডের পেছনেও গডফাদার থাকে। থাকে কি না?
—তুই জানিস, শামু জানে?
—শিওর।
—তুই কী করে জানলি?
—আরে ভয়েসটা খালি কিনকিন কিনকিন করে। শামু যে-ই আসে অমনি। এমন শেয়ালের মতো গুঁড়ি মেরে আসে, যেন শুধু আধভাঙা বাড়ি পাহারা দিতে আসছে না, গুপ্তধন চোরাই ধন-টন কিছু পাহারা দিচ্ছে। ব্যাস ভয়েসের কিনকিন স্ট্যান্ড করতে না পেরে একদিন ভর দুপুরে সোজা সাততলায়। তারপরেই ডিসকভারি চ্যানেল।
—শামু যে তোকে এখনও নিকেশ করে দেয়নি, এ তোর ভাগ্য দীপু। সাবধানে থাকিস।
—কী যে বলিস! বন্ধু কখনও বন্ধুকে নিকেশ করে? তা ছাড়া হাসির ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিকস্ কে দেখিয়ে দেবে এই খোঁচড়ের দেশে, দীপু পাগলা ছাড়া? মেয়েটা শিওর এইচ এস-এও ফার্স্ট ডিভিশন পাবে। দেখে নিস।
আমি সিঁড়ির দিকে যাই। একেবারে অন্যমনস্ক। যাক হাসির পাত্তা করা গেল। যাক শামু, ওর দাদা-ই ওকে সাহায্য করেছে। শামুর মধ্যে যে একটা ভাল দিক আছে আমি বরাবর জানি। তবে শুধু এই পর্যন্ত হলে চমৎকার হত ব্যাপারটা। আমার ওপর হামলাটা আমি ‘লেট বাইগনস্ বি বাইগনস্’ করে দিতে রাজি আছি। শুধু ওই ‘মেয়েছেলেটা!’ ভুলতে পারব না। আর দাঙ্গাটা? … বেঁটেদার বাঁ হাত, আলমের ডান পা, নিমকির ভেজিটেবল হয়ে যাওয়া, ওদের মায়ের মরে যাওয়া। বাচ্চাগুলো … উঃ, এটা আমি কিছুতেই কিছুতেই … কিছুতেই … ভেতর থেকে কী যেন একটা গরম লাভার মতো বেরিয়ে আসতে চায়। পেছন থেকে দীপু আমাকে একটা হ্যাঁচকা টান দিল।
—এই রুণু মস্তান, যাচ্ছিস কোথায়?
—আর ভাল্লাগছে না দীপু, ছাড়।
—ডিসকভারি চ্যানেলে আজ ভাল প্রোগ্রাম। না দেখলে পস্তাবি। তখন আমায় দোষ দিস না!
হঠাৎ আমার ভেতরে একটা শিকরে রাজ নখওলা একটা শিকারি ডবারম্যান উঠে দাঁড়ায়, হঠাৎ আমিও একটা আশ্চর্য কিনকিন কিনকিন মগজের মধ্যে শুনতে পাই। জোরে চেপে ধরি দীপুর হাত।— সত্যি? কোথায়? কোথায় বল।
দীপু চোখ সরু করে বলে—শুনতে পেয়েছিস, না?
—ইয়েস।
দীপু চোখ বড় বড় করে দু’হাতে আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে যেন আমরা এতদিন পরে ঠিকঠাক এক লেভেলের বন্ধু হলাম। উত্তর পুবের ফ্ল্যাটটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ও। একটা চাবি বার করে পকেট থেকে। ঘোরায়। ক্যাঁচ শব্দে হাট হয়ে যায় দরজা, দেখি একটা শূন্য ঘর, সব জানলা বন্ধ, অন্ধকার, অসহ্য গুমোট। একটা অসুখ-অসুখ গন্ধ। ভেতরে একটা ফোল্ডিং খাট, একটা কুঁজো। আমি ঢুকে পা টিপে টিপে যাই, খাটটার ওপর বিছানা, তাতে কী আছে? কুঁজোটা? কুঁজোটায় কী আছে?
দীপু বলে —হল্ট। একটা জিনিসও ছুঁবি না। অল দিস ইজ এভিডেন্স। যা দেখলি দেখলি চলে আয়। এই হচ্ছে সেই চোরাই ধন যা পাহারা দেবার জন্যে শামুর মতো ওস্তাদ লাগে।
—এত কাছে? আর কেউ টের পেল না!
—রাক্ষসরা যে-দিন কাছে বলত সে-দিন দূরে যেত, যে-দিন দূরে বলত সে-দিন কাছে। মনে নেই? নাকের ডগায় কে খুঁজে দেখবে রে? এখানে ওকে শিফ্ট করে বোধহয় শেষ মাসটা রাত্তির একটা নাগাদ, যখন দেখে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। কোনও ভাল ডাক্তার তো পাচ্ছিল না! তো শামুর রেফারেন্সে ডাক্তার আনোয়ার অপারেশনটা করেছিলেন, এখানেই। অ্যাম্পুল ফাম্পুল, ওদিকের রাবল-এর মধ্যে অনে-ক আছে, সব এভিডেন্স, টাচ করিনি। এখানেই ওকে অজ্ঞান অবস্থায় মাঝরাত্তিরে নামিয়ে, গাড়িতে ভরে হোল কলকাত্তা ঘুরিয়ে রসিক ঘোষের মোড় থেকে একটু দূরে রাস্তায় জাস্ট নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। জ্ঞান হলে যেতে পারে যাবে, কেউ সাহায্য করলে করবে, আর যদি না পারে? হি’ল সাকাম টু হিজ উন্ডস্। পাঁচ কোটি টাকার সওদা—ডেড অ্যান্ড গন। কী করা যাবে?
আমার চোখে আগুন জ্বলে। আমি বুঝতে পারি আমার ভেতরে একটা ভূমিকম্প হচ্ছে, লাভা আর ছাই ছিটকে উঠে যাচ্ছে আকাশে। গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে, শহর গ্রাম সব চাপা দিয়ে দেবে।
গুমগুমে স্বরে জিজ্ঞেস করি—এটা যে তুই জানিস, শামু জানে?
—শিওর!
—তোকে খতম করে দেবে দীপু। শিগগির থানায় যা।
—থানা? —দীপু হেসে উঠল। ইউ মীন শনিতলা থানা? সব্বোনাশ! তুই এ-ও জানিস না ও থানাটা শামুর চেয়েও ডেঞ্জারাস! তবে গেছি, তুই ভাবিস না —দীপু আমার পিঠ চাপড়ে দেয়। আসল জায়গায় গেছি — ডি.সি.ডি.ডি, লালবাজার। লোকটা টিপিক্যাল খোঁচড় নয় — ভয়েস বলল। কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। সমস্ত এভিডেন্সসুদ্ধ নাটের গুরুগুলোকে ধরবে। ইনক্লুডিং শামু।
—বলিস কী রে! শামু জানে তুই …
—শামু রাজসাক্ষী। ঘাবড়াস না। শালা আমাকে খতম করবার ভয় দেখিয়েছিল। হাসি সঙ্গে সঙ্গে ছারপোকা মারার বিষটা—সেই যে রে যেটা আমার বাবা খেয়েছিল—খুব হ্যান্ডি। হাসি সবসময়ে সঙ্গে রাখে। আমাতে হাসিতে মিলে অনেক কষ্টে ওকে বুঝিয়েছি।
—অত সোজা নয় দীপু। ও ওর ওপরের গডফাদারটাদারকে সাবধান করে দেবে না তুই কী করে জানলি?
—রিল্যাক্স ম্যান, ও এখন পুরোপুরি ক্যালকাটা আই-বির কবজায়। ইনটারপোলে খবর চলে গেছে। কিছু করতে পারবে না। পুলিশ যা বলছে মুখ বুজে ও তাই করছে। নইলে ল্যাংচা খেয়ে যাবে। গদ্দাম্।
—তা হলে ওর পেছনের লোকগুলোই ওকে খতম করবে।
—সে দ্যাখ রিস্ক্ নিতেই হবে। যা করেছে তার মাশুল তো ওকে কোনও না কোনওভাবে দিতে হবেই। তবে ওর বিপদের সম্ভাবনা মিনিমাম রাখার চেষ্টা হচ্ছে। যা কিছু কমিউনিকেশন এখন ভায়া দীপু পাগলা। এই দ্যাখ—দীপু আলাদিনের আশ্চর্য পিদিমের মতো একটা ছোট্ট মোবাইল বার করল পকেট থেকে। আমি ওর কথা শুনছি এক কান দিয়ে আর এক কান দিয়ে শুনছি মনের ছবিগুলো কী বলছে। শটাশট জুড়ে যাচ্ছে ছবিগুলো। কিনকিন কিনকিন মদললালকে তুমি স্বপ্নে দেখেছ। আসল মদনলাল অত তাগড়া অত বিভীষণ নয়। কিন্তু সে স্বপ্নের মদনলালই। কোথাও দেখেছ, তুমি খেয়াল রাখোনি, তোমার স্বপ্ন খেয়াল রেখেছে। স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন। হঠাৎ বুঝতে পারি আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পাল্টে যাচ্ছে। চেরা জিভে আগুন, চোখে আগুনের হলকা, পাগুলো একটা বিরাট অগ্নিশিখাময় ল্যাজ। আমি ড্রাগন হয়ে যাচ্ছি। ঊর্ধ্বশ্বাসে পুচ্ছ তুলে হলকা ছড়াতে ছড়াতে বুক হড়কে স্লিপ করে করে আমি পিছলে নেমে যেতে থাকি যেন ওখানে কোনও সিঁড়ি নেই, একটা ঢালু উৎরাই শুধু। দীপু পেছন থেকে ছুটে আসে। —কোথায় চললি? কোথায়? এই রুণু?
আমার সামনে কালো পাথরের দেয়ালটা চৌচির হয়ে ফেটে যাচ্ছে, আমি অবলীলায় সেই ফাটল দিয়ে বেরিয়ে যাই, ছুটে যাই একটা ধূমকেতুর মতো। রসিক ঘোষ, রহিম শেখ, অবনী শেঠের গলি উপগলির ধুলো উড়িয়ে একটা ম্যানশনের বেল টিপে ধরি। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একটা চাউনি আমায় আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে বলে—কাকে চান? —চাকর নয়। চাকরানি নয়। দারোয়ান বা বডিগার্ড নয়—স্বয়ং মালিক।
—চিনতে পারছিস না? আমি রুণু রে! প্রাণপণে আগুনের হলকাকে হাসিতে পরিণত করি আমি, একটা পার্সোন্যাল দরকারে তোর কাছে এসেছি ভাই। একটু সময় দিবি?
ডবল তালা-অলা গ্রিলের গেট, কোল্যাপসিব্ল সব খুলে যায়—ও বাইরে এসে দাঁড়ায়। ও স্টপার আর আমি স্ট্রাইকার।
আমি আর এক মুহূর্ত দেরি করি না। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে টুঁটি টিপে একেবারে রাস্তার মাঝখানে টেনে আনি ওকে।
—বল গদা মাসিমাকে কেন মহাজনদের বাড়ি পাঠিয়েছিলি?
—কী হচ্ছেটা কী? রাস্তার মাঝখানে? ছাড়ো, ছাড়ো কলারটা…। মহাজনরা আমাদের ডবল মাইনে হেঁকেছিল, যাবেন না কেন? আমি কেন বাধা দেব?
—সব্বাই তোর মতো গদ্দার গুখোর হয় না শালা? তুই ওয়েলউইশার সেজে পাঠিয়েছিলি ফ্রেম করবি বলে। ওদের ভেতরের নিয়মকানুন সব কথার ছলে জেনে নিতিস মাসিমার থেকে। অ্যালজোলামটা কফিতে মিশিয়েছিল তোর শাগরেদ মদনলাল। তা সত্ত্বেও মহেন্দ্র টিফিনবক্স ছোড়ায় তোদের প্ল্যান একটু কাঁচে, শুয়ার মদনলালটা গুলিতে জখম হয়। ইচ্ছে করে শালা ব্রেসব্রিজের দিকে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। নির্জন বলে। তার মানে পুরো কিডন্যাপটার পেছনে তুই।
চাপা গলায় গদাই বলে—গাড়ল, গাড়ল একটা। পুরো কিডন্যাপ! হুঁঃ! প্রাণপণে ছাড়িয়ে নেয় আমার হাত।
চতুর্দিকে সলিড ভিড় জমে গেছে। সত্য, অমল কমল সাহা। সেলিম বিশ্বাস আর তার তিন ভাই খলিল, মুস্তাফা আর সঞ্জু, অরুণ, পানু, সামসুল … যে যেখানে আছে। অনেক ভিড়। অজস্র মুখ। মুখ চিনি নাম জানি না। অনেক মানুষ যারা অবমানবের জীবন কাটিয়ে এসেছে এতদিন। আমি জানি না আজকের ধাক্কায়ও তারা মানব হবে কি না। না হলে আর কোনও আশা নেই।
নিজের কোমর থেকে এতক্ষণে পিস্তল বার করেছে গদা। —পথ ছেড়ে দাও। নইলে গুলি করতে বাধ্য হব — জনতার দিকে তাকিয়ে সে বলে। কেউ পথ ছাড়ে না। তখন আমার দিকে পিস্তল তাক করে শয়তানটা। ড্রাগন লাফিয়ে উঠে ওর কাঁধে ল্যাজের আছাড় মারে — ছিটকে যায় পিস্তল। পুলিশের গাড়ির তীব্র সাইরেনের শব্দে কেঁপে ওঠে রসিক ঘোষ, রহিম শেখ, অবনী শেঠ আর শনিতলার অলিগলি। চারদিক থেকে ছ’ সাতটা সশস্ত্র গাড়ি এসে ঘিরে ধরে আমাদের।
হাতে হাতকড়া বেঁধে পুলিশের খাঁচায় ওঠে গদা—মাস্টার কিড্ন্যাপার, শামু—ওয়াচম্যান, রমজান আলি, চাকলাদার দাঙ্গাবাজ, রমেন গুহ, জগা মিত্তির ডাক্তার আনোয়ার আরও অনেক ছোট ছোট নাট বল্টু—বিধ্বংসী যন্ত্রের, তাদের চিনি না, জানি না। মহেন্দ্র মহাজন অপহরণ কেসের সমস্ত সন্দেহভাজন লোককে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এটা ফার্স্ট রাউন্ড। এলাকার সমস্ত রাজনৈতিক নেতা, মস্তান, ক্যাডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরা সমশের আর গদাকে কাজে লাগাত, রমজান আলির এরা জিগরি দোস্ত।
কিন্তু আমি তো সত্যিই মৌলিক প্রজাতির পৌরাণিক ড্রাগন নই! নই কারাটের ব্ল্যাকবেল্ট। কিংবা নাগাদের হেড-হান্টার। কোনও দিন বডিবিল্ড করিনি। সামনের কালো পাথরের দেয়ালটা স্রেফ মনের জোরে ভাঙবার জন্যেই আমার আপ্রাণ চেষ্টা। জাস্ট কিছুক্ষণের জন্য আমার একটা মেটামরফোসিস হয়েছিল, কুরূপা চিত্রাঙ্গদার সুরূপায় রূপান্তরের মতো, একটা দীর্ঘ ঐকান্তিক মানসিক প্রয়াসের ফল। তাই ঘটনাগুলো ঘটে যাবার পর আমি শেকড়হীন ফোঁপরা একটা গাছের মতো পড়ে যাই। বুঝতে পারি, মাটিতে আছড়ে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু পড়িনি। কারা আমাকে ধরে নিয়েছে, নিয়ে যাচ্ছে। আমার বডির তলায় আপাদমস্তক একটা মানুষের হাতের স্ট্রেচার। ড্রাগন হবার ক্লান্তিতে, ড্রাগুনে আগুন বয়ে জ্বলে পুড়ে যাওয়ার অসহ্য যাতনায় আমি ছটফট করি। ঘোরের মধ্যে বুঝতে পারি আমার কব্জিতে ছুঁচ, মুখে গ্যাস-মাস্ক। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, ডুবছে, ভাসছে নানা মুখ—মা, রিন্টি, দাদা, দীপু, মণিমালা, মুক্তামালা, হাসি, সামসুল, অমল, কমল, সত্য, পানু, সাম্য, সেলিম, এ.এস, জগদিন্দ্র, অরুণ এবং বউদি। চিৎকার করে বলতে চাই—বেঁটেদা, মহেন্দ্রদা, নিমকি-শিমকি, পতিত কাকা, আলম, হাসি, দাঙ্গায় মৃত এবং অনাথরা শোনো, মাসিমা শুনুন, বউদি শোনো—আমি শালা দীনদুনিয়ার মালিক বস নই, জান-প্রাণ আর ফিরিয়ে দিতে পারব না, কিন্তু তোমাদের ওপর বর্বর মস্তানি, বজ্জাতি, তোমাদের বে-ইজ্জতির বদলা আমি নিয়েছি। এবার, এইবার আমি রিন্টির জন্যে সচিনের পোস্টারটা ঠিক পেয়ে যাব, যে সচিন শুধুই ছক্কার পর ছক্কা, ছক্কার পর ছক্কা, ছক্কার পর ছক্কা, ছক্কার পর ছক্কা …।