Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তিমির বিদার || Bani Basu » Page 21

তিমির বিদার || Bani Basu

পরদিন বেলা বারোটা নাগাদ মাসিমা অর্থাৎ দীপুর মাকে মহাজন হাউজের দরজার সামনে থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল পুলিশ। সত্য খবরটা দিল। মহেন্দ্রর ফ্লাস্কে কফির তলানিতে নাকি অ্যালজোলাম পাওয়া গেছে। মাসিমাই নিজে হাতে দুই ভাইয়ের টিফিন করে দিতেন। ফ্লাস্কে কফি ভরে দিতেন। এগুলো সবই ছিল ওঁর ডিউটি। আমি সোজা দীপুদের বাড়ি চলে গেলাম। মণি কলেজে যায়নি। চুপ করে বসে আছে। বলল— দাদা আর মুক্তা থানায় গেছে। ছোট ভাইকে কোনও খবর দেওয়া হয়নি। কাগজে নামটা দেখে যদি আসে।

মণি আমাকে দেখে বলল— এ সব কী হচ্ছে রুণুদা? কিডন্যাপ, দাঙ্গা…এ সব কী? মা কারও খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিতে পারে তুমি বিশ্বাস করো! —ওর মুখে একটা শক-খাওয়া ভাব, কান্না নেই।

আমি মাথা নাড়ি, তারপর বলি— আমি হাসির সঙ্গে প্রেম করেছি, তাকে লুকিয়ে রেখেছি, এটাই কি তুই বিশ্বাস করিস?

—না—এবার চোখের জল মুছতে মুছতে মণি বলল, আমি সামসুলদা, রমজান চাচা এদের অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম— ওরা বোঝেনি।

—শামু? শামু কিছু বলেনি?

—না, কেমন গুম হয়ে ছিল।

আমি জানি কেন। শামু ভাল করেই জানত হাসির সঙ্গে আমার কিছু নেই। কিন্তু ও বোধহয় ভাবছিল হাসিকে বাঁচাবার জন্যে ও যে আমাকে বারবার রিকোয়েস্ট করছিল, তার ফলে ওকে কোনওভাবে পালাতে এবং লুকিয়ে থাকতে আমি সাহায্য করেছি।

—কী হবে রুণুদা? মাকে…এভাবে…মা একেবারে ভেঙে পড়বে।

—আমি যাচ্ছি, সত্য প্রকাশ পাবেই!

—এখনও… এখনও আশা করো রুণুদা— এখানে সত্যের কোনও স্থান আছে? সত্য প্রকাশ পায়?

—তুই ভাব মণি, তোকে ভাবতে বারণ করছি না। কিন্তু মাথাটা ঠিক রাখ। বিপদে কেউ হাতে পায়ে কাজ করবে, কাউকে শান্ত মাথায় ভাবতে হয়। অন্যদের শান্ত করতে হয়, সেবাও করতে হয়। আমি যাচ্ছি।

—আমাকে একটা খবর দিও।

—কেউ না কেউ আসবেই। হয় আমি, নয় ওরা কেউ।

আমি, মণি, মুক্তা, দীপু, শামু, সত্য, পানু— আমরা সব একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। নিমকি শিমকি বেঁটেদা— এরাও। হয়তো সামাজিক স্তর বিন্যাসের ভিন্ন পরতে। কিন্তু এক সঙ্গে। আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা মূলত ভাই-বোনের। আমি অন্তত কখনও পাড়ার মেয়েদের দিকে অন্য চোখে তাকাইনি। জানি না এটা অস্বাভাবিক কি না। কিন্তু আমরা যারা জীবনসংগ্রামে এইভাবে সর্বক্ষণ লিপ্ত, তাদের যৌবনের ওই অংশটা জাগেনি, জাগলেও আমরা হয়তো জিতেন্দ্রিয়। হয়তো। তেমন তেমন হলে আমাদের হাত আমাদের শান্ত করে, কারও সঙ্গে ইনভলভ্‌ড হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না। আমরা খালি চেষ্টা করে যাচ্ছি— কীভাবে মানুষের মতো খেয়ে, পরে, চিকিৎসিত হয়ে, প্রিয়জনদের খাইয়ে, পরিয়ে, অসুখে চিকিৎসা করিয়ে একটা সুস্থ সচ্ছল সামাজিক পরিচয় নিয়ে বাঁচব, ও সব চিন্তা আরও অনেক অনেক পরে। আমাদের কাছে এই প্রেমে পড়া, হিড়িক দেওয়া, শারীরিক ভাবে লিপ্ত হবার জন্যে আকুলি-বিকুলি এগুলোই অস্বাভাবিক লাগে। সত্য যখন সাহা বাড়ির শিবানীর প্রেমে পড়ল, এবং শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে ইলোপ করল— আমরা যতই বন্ধু হই কেউ তাকে আশ্রয় দিইনি, মদত করিনি। নিজেরা অনর্থক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ব এ চিন্তা যে একেবারে ছিল না তা নয়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল একটা ধিক্কারবোধ, আত্মসম্মান যেটুকু ভদ্র দরিদ্রের সবে-ধন নীলমণি সেটুকু বিকিয়ে যাওয়ার গ্লানি। ইসস্ সত্যটা এই কীর্তি করতে পারল? ওরা সাত ভাই বোন, ও সবার বড়, বাবা গণাদার দোকানে সেলসম্যান। মা কোনও এক নারীসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সেলাই-বোনা করেন, সত্যর পরের ভাই ব্রত প্রচুর কাঠ-খড় পুড়িয়ে স্রেফ মেধার জোরে ‘টেকনিক্যাল স্কুলে’ পড়ছে, বোনগুলোও সেলাই করে, আচার তৈরি করে মায়ের সঙ্গে, কে সেভেন, কে এইট পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিয়েছে। প্রেম করে ইলোপ-টিলোপ যদি তারা করত তবে ব্যাপারটা বোধগম্য হত। কারণ মেয়েগুলোর তো কোনও জীবন ছিল না। ভবিষ্যৎ ছিল না! বিয়ে ছাড়া শেষ পর্যন্ত যেহেতু মেয়েদের গতি নেই, সেহেতু যেন তেন প্রকারেণ একটা বিয়ের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিলে ওদের দোষ দেওয়া যেত না। কিন্তু ওরা নিয়মিত আচার আর সোয়েটার বানিয়ে যেতে থাকল। আর ওদের সবার বড় দামড়া গো-খোরটা বড়লোকের মেয়ে নিয়ে পালাল। এখন সাহারা সত্যকে অ্যাকসেপ্ট করেছে কিন্তু ওর ফ্যামিলিকে করেনি। সাহাদের মদের ব্যবসায় সত্য যুক্ত আছে কিন্তু শিবানী একবারের বেশি কখনও শ্বশুরবাড়ি যায়নি, সত্য কিছু সাহায্য ওঁদের করতে পারে কি না, করে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আমি যে এতদিন ধরে মণিকে পড়াচ্ছি— প্রেম হতে পারত তো! টিউটর আর ছাত্রী। দু’জনেরই অল্প বয়স। একেবারে টিপিক্যাল কেস! কিন্তু কই, হয়নি তো! মণিটা ওর ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে চুবে থাকত। ইংরেজিটা আমাকে দেখাত নিয়মিত। তখন রেগুলার বকুনি খেত— তুই আবার বিগিনিং বানান ভুল করেছিস? বলেছি না ‘বাই’ আর ‘উইথ’-এর ব্যবহারে তফাত আছে! কথাটা ইনডিসক্রিমিনেটলি, ‘ন্যান্টলি’ নয়। বাংলা চিরকালই ও খুব ভাল জানত। ও বরং আমাকে জ্ঞান দিত। —রুণুদা প্লিজ ‘সাথে’টা বোলো না, স্ট্যান্ডার্ড বাংলাতে ‘সঙ্গে’টাই অ্যাকসেপ্টেড। সারা রবীন্দ্রনাথ খুঁজে দেখো কোথাও গদ্যে ‘সাথে’র ব্যবহার নেই। গানে, কবিতায় প্রচুর আছে। কিন্তু কোনও ভাল বাংলা গদ্যে সে তুমি রবীন্দ্রনাথই বলো, আর বুদ্ধদেব বসুই বলো—‘সাথে’ পাবে না। বুদ্ধদেব তো পুরো বাঙাল ছিলেন, ছিলেন না?

আমি যদি বলতাম আর তোদের গেলুম, খেলুম, হালুম হুলুম, নেবু, নঙ্কা, নুচি…?

—শুধু শুধু ভাষা নিয়ে ঝগড়া কোরো না রুণুদা, গেলুম-খেলুম রবীন্দ্রনাথও লিখে গেছেন। উনিই আমাদের ফাইন্যাল রেফারেন্স। কিন্তু তা সত্ত্বেও গেলাম, খেলামটাই এখন স্ট্যান্ডার্ড বলে মানা হয়, আমার বাবা পর্যন্ত নুচি বলতেন, আমার দিদিমাকে ‘আঁব’ বলতে শুনেছি ‘আম’কে। কিন্তু আমরা আর বলি কি? একটা আদান-প্রদানের মধ্য দিয়েই স্ট্যান্ডার্ড বাংলা তৈরি হয়ে উঠেছে।

থানার পথ ধরি। দেখি শামু আসছে। কথা বলতে সত্যি বলতে কী আমার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু শামুই বলল— দীপুর মায়ের খবরটা শুনেছিস তো!

—হ্যাঁ, যাচ্ছি তো!

—আমি ওর জামিনের ব্যবস্থা করেছি। জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেবে।

—তুমি! জামিন?

—কেন, আমি বন্ধুর মায়ের জন্য এটুকু করতে পারি না?

—কী জানি! কী পারো আর কতটুকু পারো। —আমি উদাস ভাবে রাগ লুকিয়ে, যথাসম্ভব রাগটাকে সামান্য অভিমানের চেহারা দিয়ে বলি— তা কেসটা কী? ওঁকে অ্যাট অল ধরেছে কেন?

—ড্রাইভার মদনলাল সাক্ষ্য দিয়েছে, ছোটসাহেব গাড়িতে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, ও কোনওদিন কোনও সাহেবকেই এ ভাবে ঘুমোতে দেখেনি। ফ্লাস্কে কফি তখনও একটু পড়ে ছিল। ওরা কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে ঘুমের ওষুধ পেয়েছে। এতদিন ছোট মহাজন ফেরেননি বলে ওরা ওয়েট করছিল। এক মাস আগে মুক্তিপণের টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। অথচ ছোট মহাজন ফিরছিলেন না। খুব ওয়ারিড ছিল পুলিশ। ফেরা মাত্র অ্যাকশন নিতে শুরু করেছে।

—বলো কী? এক মাস আগে টাকা দেওয়া হয়ে গেছে! মহাজনদের তো নরকযন্ত্রণায় কেটেছে! ফেরত দিলই যদি তো আরও আগে দিল না কেন? পাঁচ কোটি র‍্যানসম কি চালাকি কথা!

—বোধহয় ফিজিক্যাল কন্ডিশান অত খারাপ ছিল বলে দেয়নি। বাঁচবে কি না বাঁচবে!

—না বাঁচলে কি ওরা মুক্তিপণের টাকাটা ফেরত দিত?

—দিত হয়তো, ওদেরও একটা এথিক্‌স্‌ আছে।

—তা ভাল, তুমি ভাল জানবে।

—কেন? এ কথা কেন বললে? শামু অদ্ভুতভাবে মারমুখো হয়ে বলল।

—তোমার চেয়ে ভাল করে একথা কেউ জানে না শামু! নিজে সত্য জেনেও বন্ধুর ওপর হামলা যে রুখতে পারে না, চায় না, এথিকস-টেথিকস তো তারই জানবার কথা!

—আরে ছোড়ো ইয়ার। গুসসা মৎ হোনা। হয়ে গেছে ঝোঁকের মাথায় একটা অন্যায়। আমি কী করতুম বলো? যদি কিছু বলতে যেতুম ওই হারামি কামিনা রমজান আমাকে ছাড়ত না কি! —যাই হোক, হাসিটা যেখানেই থাক, মনে হচ্ছে ভালই আছে। বেশ ভেবেচিন্তে কাজটা করেছে। ও যদি একটা ভাল ছেলেকে শাদি করে নিয়ে থাকে— তাতেও আমার আপত্তি নেই। ভাবতে পারিস রমজান আলির দোসরা বিবি জাহানারা চাচি, চাচার ছেলে বিইয়ে বিইয়ে শয্যা নিয়েছে। এখন ফ্রেশ মেয়ে খুঁজছে, নিজের মেয়ের বয়সি। আর আমরা —উঃ!

—ভাল, তোমরা কী? ক্রীতদাস— হাসিনা লিখেছিল, —কেন?

—আরে তোকে বলতে বাধা কী? অনেক টাকা ওর কাছে আমাদের ধার-দেনা রয়েছে। শুধতে পাচ্ছি না কিছুতেই। মাকে এসে বললে— হাসিকে দিন, নইলে আমার বাল-বাচ্চাগুলো কে মানুষ করবে, হাসিকে আমি নবাবের বেগমের হালে রাখব। মা-ও রাজি হয়ে গেল। টাকার জন্যে রমজান চাচা জাহানারা চাচি দু’জনের কাছ থেকেই তো গাল খেতে হত মাকে! দু’বেলা!

—এ কথা একবারও মনে হল না, এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে একটা মারদাঙ্গা লাগল। এতগুলো মানুষ মারা গেল, বাচ্চাগুলো অনাথ হল! মনে হল না?

—ইয়াকিন কারো ইয়ার বোমাগুলো কে টপকালে, আমি জানি না।

—বোমা তো তোরাই বাঁধিস। তুই আর গদা। তোদের গুদোম ঘরে এত বোমা জমা আছে শামু যে কোনওদিন একটা আগুনের ফুলকি পড়লে গোটা পাড়াটা উড়ে যাবে।

—আরে মহা মুশকিল তো! চল, এক্ষুনি চল আমার বাড়ি। কোথায় বোমার গুদাম, চল নিজের চোখে দেখে আসবি।

—আমার সাধ্য কী সে-সব বার করি। —বলে আমি মুখ ফিরিয়ে নিই।

মাসিমা জামিনে ছাড়া পেলেন কিন্তু মহাজনদের বাড়ির কাজটা ওঁর গেল। লজ্জায় উনি যেতেই চাইছিলেন না। আমরা বোঝালাম না গেলেই ওঁকে ওঁরা অপরাধী ভাববেন। সাহস করে উনি শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু এ এস বলেছেন ওঁকে আর তাঁদের দরকার নেই।

ঠিক আছে— লেট ল’ টেক ইটস কোর্স।

দীপুরা, এবং আমরাও বৃহত্তর পাড়াতে খানিকটা একঘরে হয়ে রয়েছি। বদনাম একবার রটলে, গায়ে আলকাতরা লাগার মতো, চিটে আর উঠতে চায় না। মানুষকে জনা জনা ধরে কত বোঝানো যায়। আর বোঝাবই-বা কেন? বিশুদা সুদ্ধু একদিন ডেকে বললেন— কাজটা তুই ভাল করিসনি রুণু। বিচক্ষণতা দেখাতে পারিসনি।

—যা আমি করিনি, তার জন্যে কৈফিয়ত দিতে আমি আর পারব না বিশুদা।

—তোর আজকাল খুব তেল হয়েছে।

—বিনা দোষে এভাবে অপমান করলেও জবাব দেব না?

—বিনয় শেখ, তা নয়তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

—বিনয় অর নো বিনয়, ভবিষ্যতে বালব জ্বলার চান্স দেখতে পাচ্ছি না।

জগাদা একদিন রাস্তায় ধরল— কী রে রুণু, আজকাল খুব মস্তান হয়েছিস।

আমি খুব শান্তভাবে বলি— তোমার চেয়েও?

—আমি? তোর তো আস্পদ্দা কম নয়। মস্তানি রুখতে আমি প্রাণটা ছাড়া এখনও পর্যন্ত সবই দিয়েছি, তা জানিস?

আমি বললাম— ও ছার প্রাণ গেলেই বা কী! থাকলেই বা কী।

—তুত্তুই এ কথা বললি? বলতে পারলি? জগাদার সরু মুখটা আরও লম্বা হয়ে গেছে। চোখ দুটো বড় বড়।

—ও সব ছাড়ো। আটকালে কেন? পড়াতে যাচ্ছি!

—ওই মেয়ে-ফুসলোনো, দাঙ্গাবাজির পরেও তোর টুইশানগুলো আছে?

—আমি আর মেয়ে-ফুসলোনোর মতো হিরোইক কাজ করতে পারলাম কোথায়? তুমি চেষ্টা করলে পারতে কারণ, বাড়িক্কে একটা গোটা বাড়ি ফুসলোনোর অভিজ্ঞতা তোমার আছে!

—মানে? তুত্তুই বলতে পারছিস এ কথা? কর্পোরেশনের নিয়ম ভাঙলে ইস্টেপ নেব না?

—নিশ্চয় নেবে, এ এলাকার কাউন্সিলর-এর টিকিটটা পেতে হলে তো তোমাকে কাজটুকু দেখাতেই হবে। তবে তোমার আই কিউ যা তাতে করে চাকলাদার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে না দিলে— টিকিটটা বোধহয় আর পাওয়া হয়ে উঠত না।

মুখটা ছাইয়ের মতো হয়ে গেল জগাদার। বললে— চাকলাদার বলেছে তোকে? মিথ্যেবাদী, জোচ্চোর…

—রাজনীতি করতে গেলে তোমাকে এর চেয়ে সংযত হতে হবে জগাদা। আই কিউ না হলেও চলে কিন্তু আর কিউ মানে রি-অ্যাকশন কোশেন্টটা ঠিকঠাকমতো থাকা দরকার। চলি…

প্রায় মাথার চুল খামচানো অবস্থায় জগা মিত্তিরকে পেছনে রেখে আমি এগিয়ে চলি, টুম্পাদের বাড়ির দিকে। টুম্পা-তুলতুলদের ট্যুইশানটা কোনও অজ্ঞাত কারণে বাতিল হয়নি। ছেলেমেয়ে দুটির বাবা আজকাল প্রায়ই পড়ার ঘরে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। মাঝে মাঝে ছেলের দিকে এমন কটমট করে তাকান যে আমারই হৃৎকম্প হয়।

অরবিন্দদা বললে— ব্রেভ ইয়াং ম্যান তোর গাট্‌স্ আছে। ওয়েল-ডান।

—কোনটা!

—ওই বৃদ্ধস্য তরুণী ও তৃতীয়া ভার্যার ব্যাপারটা বন্ধ করা!

আমার এত রাগ হয়ে যায় যে আর কিউটা আমারই গণ্ডগোল হয়ে যায়। ঠাণ্ডা স্বরে বলি— ব্রেভ ওল্ড ম্যান, তোমারও গাট্‌স্‌ আছে। ওয়েল ডান!

—মানে?

—মানে তুমিই ভাল জানো। রাদার তুমি-ও…আচ্ছা চলি।

পেছনে দুটো চোখ থাকলে দেখতে পেতাম কী ধরনের আর কিউ ও মুখে খেলা করছে। তবে এমন মাংস মুখে যে কোনও ভাবের খেলাই চট করে দেখা যায় না।

আর নিতাই ভটচায? এরা যদি চলে ডালে ডালে সে চলে পাতায় পাতায়। তিনটে সেক্রেটারির একটাকে দিয়ে ডেকে পাঠাল। খাস কামরায় তলব হল। উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল নিতাই ভটচায। খাস বিলিতি কায়দায় একেবারে। তারপরে বলল— কংগ্র্যাচুলেশনস।

—কীসের জন্যে?

—কীসের জন্যে? তোর বিনয় দেখলে তোর বাবার কথা মনে পড়ে যায় রুণু। অজিতদাও এমনি ছিলেন।

আমি চুপ করে থাকি।

—নেতারা তো শুধু একটা ছকে কাজ করে যায়। এত মিটিং, সেশন, এত জনসংযোগ করতে হয় যে প্রাণ একেবারে কণ্ঠাগত। একটু সময় বার করতে পারি না আমরা যে সোসাইটির কথা একটু আলাদা করে ভাবব। সে-দিক থেকে দেখতে গেলে সমাজ সংস্কারকরাই আসল। সোসাইটির মধ্যে থেকে, তলা থেকে তাকে বদলায়, চেষ্টা করে অন্তত, সাফল্য হয়তো সেই মুহূর্তেই আসবে না, কিন্তু ইন দা লং রান আসতে বাধ্য। হয়তো সেটা দেখতে আমরা থাকব না। কিন্তু তোর অল্প বয়স। তুই দেখে যাবি।

আমি চুপ করে থাকি। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় দেখি।

—এই যে পতিতদার পেনশনটা করে দিলি, এটা দুর্দান্ত কাজ।

আমি বলি— আমি করিনি, তোমার জ্ঞাতিশত্রু বিশু মল্লিক করেছে কাজটা।

—ধুর ও কী করবে! তুই যে বার বার গেলি, ইয়াং ম্যান দেখলে ঘুষখোরগুলো ভয় পেয়ে যায়। এখন তো সব জায়গাতেই ওদের রাজত্ব! কোটি কোটি টাকা… কোটি কোটি টাকা এক শিক্ষাবিভাগ থেকেই হাপিস করে দিলে রে! পুরো দেশটা লুঠেরাদের হাতে চলে গেল। সে যাক, দাঙ্গা একটা বাধল তোকে উপলক্ষ করে। ডোন্ট মাইন্ড রুণু, শামুর বোনটাকে তুই অজ্ঞাতবাসে সাহায্য করেছিস, করছিস কি না জানি না। আমি অত কানপাতলা নই। যদি না করে থাকিস ভাল, করে থাকলে আরও ভাল। কিন্তু দাঙ্গাটা থামালি, দাঙ্গার ভিকটিমদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিস। বেঁটে তোর কথা খুব বলছিল। আলম বলে ছোকরা সেও দেখলাম তোর গুণ গাইছে। বললে— রুণুবাবুকে যে না-পাক ভাববে সে নিজে না-পাক। …আমি তোর ব্যাপারটা দেখছি। ইউ শুড বি প্লেসড সামহোয়্যার যেখানে তুই প্রপারলি ইউটিলাইজড হবি। ও হ্যাঁ এ এস মহাজন অ্যান্ড ফ্যামিলি তোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ একেবারে। সত্যিকারের হৃদয়বান ছেলে… ওকে দেখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ভরসা হয়।

আমি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলাম। দীর্ঘ জ্বালাময়ী শেষ হলে জিজ্ঞেস করি—‘হৃদয়বান’ ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম’ কথাগুলো কি ওঁরাই ব্যবহার করলেন?

—তা কি আমি করলাম?

—না, ওঁরা এতটা ভাল বাংলা জানেন— বলেন জানতাম না। সব সময়েই ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন দেখি।

—য়ু আর রাইট। আমি নিজের অজান্তেই ওঁদের কথাগুলো ট্রানস্লেট করে নিয়েছি। বুঝলি?

বুঝলাম, এবার উঠি নিতাইকাকা! ট্যুইশন আছে তো!

—এই যে, পড়িয়ে শুনিয়ে ছেলে-মেয়েগুলোকে মানুষ করে তোলার ব্রত নিয়েছিস, এটাই কি কম মহৎ? পশ্চিমবাংলায় তো স্কুল-কলেজ সব উচ্ছন্নে গেছে। পরিকল্পিতভাবে পুরো ইনফ্রাস্ট্রাকচারটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এরা।

—ব্রত ট্ৰত নয় নিতাইকাকা, তুমি ভুল করছ— আমি বলি— না করলে বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না। তাই করতে বাধ্য হচ্ছি। নইলে কে শালার পাথর ঘষে ঘষে গর্ত করবার চেষ্টা করে!

আমি বুঝতে পারছি একটা বিপজ্জনক ব্যাপার ঘটছে। আমার সেই কালো পাথরের দেয়াল! সেই সীমার দেয়াল? তাতে একটা চিড় ধরেছে। ঠিক বিদ্যুতের রেখা আকাশে যেমন আঁকাবাঁকা আলোর আঁকি-বুকি কেটে দেয় তেমনই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress