তিমির বিদার (Timir Bidar) : 20
বেঁটেদাকে দেখে আমার চোখ ফেটে জল এল।
বাঁ হাতটা ব্যান্ডেজ করা। কতটা কাটা গেছে বুঝতে পারছি না। বেঁটেদা এখন অ্যানেস্থেশিয়ার ঘোর থেকে জেগে উঠেছে। কিন্তু বিহ্বলতা কাটেনি। আমাকে দেখে কিন্তু হাসল। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল— এখন থেকে ডান হাতেই খাওয়া, ডান হাতেই ছোঁচানো, বুঝলি রুণু! লোকে আমার হাত থেকে জিনিস কিনবে তো রে?
আমি ওর ডান হাতটা ধরে চুপ করে বসে রইলাম। বেঁটেদার কেউ নেই যে দেখতে আসবে। জনরব শুনেছি বেঁটে হওয়ার অপরাধে বছর দশেকের ছেলে বাবা-মা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল। হিজড়েরা যেমন হয়। তারপর নানা ঘাটের জল খেতে খেতে আমাদের এই এলাকায়। খুব সম্পন্ন না হলেও বেঁটেদার জন্ম নাকি মোটের ওপর ভদ্র পরিবারে। কোনও শহরের উপকণ্ঠে। কোথায়, কী বৃত্তান্ত বলতে চায় না। অভিমান ভেতরে আছে কি না জানি না, মুখে বলে— ‘বেঁটে ছেলে, পা ছোট, ধড় বড়, এমন ছেলে আবার কেউ সংসারে রাখে? সংসারের অকল্যেণ হবে না?’ আমি যবে থেকে দেখছি বেঁটেদা সদানন্দ পুরুষ, লাল দোপাট্টা মলমল, ডম ডম ডিগা ডিগা… ববিতা-আ, ও মাই ডার্লিং এইসব ফিলমি গান হেঁড়ে কর্কশ গলায় গাইতে গাইতে নিস্তব্ধ শুনশান শীতের রাতে বাড়ি ফিরত। পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে গামছা। বেঁটেদা খুব সম্ভব শনিতলায় আর পাঁচজনের পাশাপাশি একটা ঝোপড়ি তুলে নিয়েছে। সবাই যা করছে তাই করেছে। একেক সময়ে আমার মনে হয় বেঁটেদা বাঙালিও নয়, বিহারি। কোনওদিন তো এসব খোঁজ করিনি, বাজারে অদ্ভুত কম্বিনেশনের সওদা নিয়ে বসেছিল তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, গান-টান গেয়ে গেয়ে অদ্ভুত ক্লাউন চেহারার লোকটা ঘুরত, মজা মারতাম, আজ বাঁ হাতটা কার বোমার ঘায়ে শেষ তাই খেয়াল হয়েছে বেঁটেদাও মানুষ, তার একটা শরীর আছে, ডান হাত বাঁ হাত আছে। বাঁ হাতটা যেতে বেঁটেদার প্রধান সমস্যা তাকে খাওয়ার হাতেই ছোঁচাতে হবে, সেই হাতেই আবার তার সওদা বেচতে হবে, এখন ডান বাঁ এক হয়ে গেলে, হকার হিসেবেও সে অচ্ছুত হয়ে যাবে কি না।
—কত বড় বড় লোক যে আমাকে দেখতে আসছে। আমি তো কোথায় বসাব কীভাবে কী করব… একেবারে বোকা মেরে গেছি রে! প্রেথম এল বিশুদা এমেলে, তারপর জগন্নাথবাবু, বলরামবাবু, দুই ভাই, তারপর অরবিন্দদা, তুই আসার ঠিক আগেটায় কে এল জানিস?
—কে?
—এম পি সায়েব, নিতাইলাল ভটচায। বলতে বলতে বেঁটেদা কেঁদে ফেলল, —কী এমন হয়েছে বল যে এত বড় বড় মাথা আমার জন্যে ভাববে! তোরা ছোটভাই, আসবি বইকী! কিন্তু..
—তা এঁরা কি শুধু দেখেই গেলেন, না কিছু বললেন টললেনও— আমি আমার গলার শ্লেষ গোপন করতে পারি না। কিন্তু বেঁটেদা সে-সব ধরতে পারে না। বলে সব্বাই প্রমিস করে গেল কমপেনসেট আদায় করে দেবে! এখন, সব্বাই যদি কিছু কিছু করে দেয়, তো সে তো অনেক টাকা রে রুণু, ব্যাংক-ট্যাংক আমার বড্ড ভয় করে, তুই যা করার করে দিস।
আমি চুপ করে ছিলাম, বেঁটেদা বলল— দিবি তো? তোকেও কিছু দোব। নিয্যস। তার মানে বেঁটেদাও ভালই বুঝে গেছে, বিনা স্বার্থে, বিনা পারিশ্রমিকে কেউ কারও জন্যে কিছু করে না। ছোট স্কেলে বুঝতে পারছে। কিন্তু বড় স্কেলে অর্থাৎ জগা, বিশু, অরবিন্দ, নিতাইয়ের স্কেলে বুঝতে পারছে না।
বেঁটেদার পাশের বেডেই আলম। তারও দেখলাম পায়ে প্লাস্টার, মাথায় ব্যান্ডেজ, ডান পাটা ট্র্যাকশনে রাখা। আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
কেউ দর্শনীয়ভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও গিয়ে খোঁজখবর করব এতটা বুকের পাটা আমার নেই। তবু বুকের মধ্যে অনেকটা হাওয়া টেনে গেলাম।
—আলম!
—বলেন!
—কেমন আছ?
—যেমন রাখছেন! ডান পাটা বোধয় গেল গিয়া। আল্লার কিরা আমি এর শোধ নিয়া ছাড়ুম। এ আপনেরে কইয়া দিলাম।
আলম হল ইনফিলট্রেশন। বাংলাদেশি মুসলমান, বনগাঁ বর্ডার দিয়ে এসেছে পশ্চিম বাংলায় যে বাংলা থেকে আলমের নানা-দাদারা স্বেচ্ছায় ভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তবু আলম এই বাংলাকেই বেশি বাসযোগ্য মনে করেছে। অনেক বাংলাদেশি মুসলিমও চলে এসেছে কাজ-কামের খোঁজে। র্যাশনকার্ড পেয়েছে, ভোটার লিস্টে নাম তুলিয়েছে। রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলই বোধহয় ওর পা-টা বাঁচাতে পারবে না। কেন না পা তো ভোট দেয় না! আমি ওর এই প্রতিহিংসা-বৃত্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কী বলব! ওর জায়গায় থাকলে আমি কী বলতাম! আমি পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি, যেমন করে পারি আমি আমার অন্ন জোগাড় করে নেব, কারণ পেট মানবে না, ক্ষুধা, ক্ষুধা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আমি এক চারণভূমি থেকে ভিন্ন চারণে প্রস্থান করেছি। নির্মায়ায়। পেরিয়ে গেছি মরু, নদী, পাহাড়, সাগর, শুধু এই জঠরের তাগিদে, শস্য বুনেছি, হাত দিয়ে তৈরি করেছি কারুমায়া, সব স-ব মূলত এই পেটের জন্যে। হে এম এল এ হে এম পি হে ক্ষমতাবান, হে বিত্তবান, তোমারও যেমন খিদে পায়, আমারও তেমনি খিদে পায়। খিদে মেটাতে আমি উঞ্ছবৃত্তিও করতে পারি, আবার দস্যুবৃত্তিও করতে পারি। খিদের কোনও দেশ কাল নেই। পাত্রাপাত্রভেদ নেই। সদুপায় কদুপায় নেই।
কিছু ভাবিনি কী বলব, ভাবছিলাম চুপচাপ পেরিয়ে যাব, ও তো আমাকেই ওর দুরবস্থার জন্যে দায়ী করছে। সম্পূর্ণ না জেনে, যে ও আরও গভীর চক্রান্তের শিকার! যদি দীপুর ভয়েস সত্যি হয় অবশ্য। কিন্তু পেরোতে গিয়েও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম, শুনলাম বলছি— তোমার বাঁ দিকে দেখো, বেঁটেদার বাঁ হাতটা গেছে, ডানদিকে তোমার পা জখম, কে কার বিরুদ্ধে লড়বে আলম?
নিমকি এখনও অজ্ঞান, ওর মাথায় লেগেছে। খুব সম্ভব আরও বড় হাসপাতালে পাঠানো উচিত। অপারেশনের জন্য। কর্তারা না কি আশা দিয়েছেন পি জিতে পাঠাচ্ছেন। শিমকির চোট সে তুলনায় কম, বোমার শব্দে আর কাঁপুনিতে ওদের টালির ছাদ ধসে পড়েছিল। ওর চোট তার থেকেই। সারা শরীরে কাটাছেঁড়া, ব্যান্ডেজ, স্টিকিং প্লাস্টার।
—শিমকি এখন একটু ভাল আছ!
—জ্বলছে—শিমকি বলল।
—যাই হোক, ওষুধ পড়েছে, ব্যান্ডেজ-টেজ হয়েছে, আগের চেয়ে তো অনেক…
—শরীর নয়কো, মন…মন জ্বলছে…আপনি অন্য মেয়ের সঙ্গে পুড়কিবাজি করবেন, আর আমাদের ওপর বোম পড়বে! ভাল রে ভাল! কী ভদ্দরলোক! মা বলত না—অমন ভদ্দরের মুখে ঝাড়ু মারি। ঠিক বলত… বলতে বলতে, শিমকির দু’চোখ দিয়ে জলের ধারা নামল।— যে মা ও কথা বলতেন, তিনি আর নেই।
আমি পাথরের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। কী বলব! কাকে বলব! কেনই-বা বলব!
—যান, যান, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন! কোথায় সেই পীরিতকে লুকিয়ে রেখে এসেছেন, যান তার সঙ্গে কেলি করতে যান।
আমি আর চুপ করে থাকতে পারি না, বলি— তোমরা…তোমরা আমাকে ছোটবেলা থেকে জানো চেনো, ওই শনিতলাওয়ে কত সাঁতার কেটেছি সে সময়ে, তোমরাই যদি মিথ্যে রটনা বিশ্বাস করো তা হলে তো অন্যে করবেই। বোমটা এরপর সোজা আমার মাথার ওপর পড়বে। বিনা কারণে। খুশি হয়ো তখন।
বেশ একদল নানা বয়সের বাচ্চাও ওয়ার্ডের এক ধারে রয়েছে। এদের অল্পস্বল্প চোট। সে সবের চিকিৎসা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু এরা স-ব এই বোমবাজিতে অনাথ হয়ে গেছে। কারও কারও বাবা বা মা মৃত্যুমুখী, অজ্ঞান, যুঝছে। হেরে যাবে, সবাই বুঝছে।
কয়েকটা ছোট কট-এ দুগ্ধপোষ্য শিশুদের স্থান হয়েছে। একজন সিস্টার দেখি একটা বড় বোতলে দুধ নিয়ে একটি শিশুর মুখে ধরলেন। পরম আগ্রহে সে যেই টানতে শুরু করেছে, এক মিনিট, তারপরেই বোতলটা টান মেরে খুলে নিয়ে আরেকটা বাচ্চার মুখে ধরলেন মহিলা, এইরকমই চলল কিছুক্ষণ। আমি বেকার, আমার অনন্ত সময়। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি।
—কী করছেন এটা?—আর থাকতে পারি না, বলি।
—কী?
—এইভাবে একটু খাইয়ে টেনে নেওয়া, একই বোতল দশটা বাচ্চার মুখে…
—এইরকমই ইনিস্ট্রাকশন আছে।
—কে দিলেন?
—কে দেয়?
—ডাক্তার বা মেট্রনের বোধহয় দেবার কথা, কিন্তু আপনার ইনস্ট্রাকশন মনে হচ্ছে আরও ওপর থেকে এসেছে!
—ওপর-টোপরের ভয় আমাকে দেখাবেন না। অত সহজে ভয় খাওয়ার মেয়ে আমি নই! তা ছাড়া, আপনি কে? এই বাচ্চাগুলোর বাবা?
আমি বললাম—আপনিও যেমন ওদের মা নন, আমিও তেমনই ওদের বাবা নই। আপনি ইনিস্ট্রাকশন পালন করুন, আমি আপনাকে নমস্কার করে— আসি।
ভেতরটা কীরকম একটা অক্ষম রাগে ফুঁসছে। যদি পাই, একবার হাতের কাছে ওই বেজম্মাগুলোকে, একবার কেউ বলে দিক, অকাট্য প্রমাণ দিক তারপরে দেখাচ্ছি কত ধানে কত চাল, ধম্মের কল কোন বাতাসে নড়ে। দেখছি আমি হিরো কি জিরো, ব্যায়াম করি কি করি না, টুঁটি টিপে ধরে বঁটিতে গলা কাটব। একবার, একবার শুধু কেউ বলে দিক। আমি একটা একদা উদ্বাস্তু-পরিবারের বেকার ছেলে, যেমন মস্ত কিছু ভাল নই, তেমনি মস্ত কিছু খারাপও নই। কারুর বিরুদ্ধে আমার নালিশ ছিল না, লোকের সাধ্যমতো উপকার করবার চেষ্টা করেছি। অপকার কারও করিনি কখনও। সেই আমাকে উপলক্ষ করে দাঙ্গা লাগবে? ধান্দাবাজরা তার সুযোগ নেবে? এতগুলো মানুষ ঘরছাড়া, অঙ্গহীন, অনাথ হবে, মরে যাবে? সত্যি কথা বলতে কি হাসির ওপর পর্যন্ত এবার আমার হেভি রাগ হতে লাগল। প্রেমে পড়েছে? প্রেম মাই ফুট। পালাত, আমাকে চিঠি লিখে পালাবার দরকারটা কী ছিল? বুড়ো ভামটা, আলুর বস্তাটা নিকাহ নিকাহ করে এগিয়ে আসছিল তো তার মুখে থুতু দিতে পারেনি! কাটারি নিয়ে তেড়ে যেতে পারেনি! একজন একজনকে বিয়ে করবে না বলে দাঙ্গা? নিরীহ মানুষের সম্পত্তিনাশ, প্রাণনাশ?
ফুটতে ফুটতে রসিক ঘোষের মোড়ে পৌঁছেছি হঠাৎ দেখি একজন লম্বা রোগা দাঁড়িগোঁফঅলা লোক, একটা হাত স্লিং-এ ঝোলানো, মাথায় ব্যান্ডেজ, বিশ্রীভাবে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে। আমাকে খুব দুর্বলভাবে হাত তুলে থামতে ইশারা করছে। আমি দাঁড়িয়ে যাই। আর একজন দাঙ্গার ভিকটিম না কি? কী বলতে চায়? আরও নিকটবর্তী হল লোকটা। তারপর ভাঙামতো গলায় জিজ্ঞেস করল— সৈয়দ সৈফুল আলি রোডটা কোথায় বলতে পারেন? এখান থেকে কতদূর?
—এই তো আর একটু, আপনি আসলে উল্টো দিক দিয়ে ঢুকেছেন। বড় রাস্তা থেকে স্ট্রেট এস এস আলিতে ঢুকতে পারতেন, ‘মহাজন হাউস’ বলে একটা বিরাট বাড়ি আছে ঢুকতেই…
কীরকম অস্বাভাবিক উত্তেজিত হয়ে লোকটি বলল—আছে? আছে, এখনও আছে? ‘মহাজন হাউস’। ও থরথর করে কাঁপছে। তখন ভাল করে দেখি এ তো মহেন্দ্র? অদ্ভুত একটা গা ছমছমে চেনা চেনা মতো লাগছিল। কিন্তু এত দাড়িগোঁফ, রোগা কালো, ঝাঁকড়া মতো চুল!
আমারও উত্তেজনা চরমে ওঠে— মহেন্দ্রদা আমি রুণু, রণধীর সরকার। চিনতে পারছেন না! তপোধীরের ভাই, আপনাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িটা দেখা যায়।
কোনওরকমে আমার হাতটা ধরে ফেলে মহেন্দ্র— চুপ, একদম চুপ, কথা বললে দে উইল কিল মি। প্লিজ গাইড মি আ বিট। আমি কিচ্ছু চিনতে পারছি না। আই অ্যাম লাইক আ ব্লাইন্ড ম্যান ইন আ ব্লাইন্ড লেন… প্লিজ রুণু অর হোয়াটেভার…
আমি একটা রিকশা ডাকি। গায়ের মধ্যে কী রকম শিরশির করছে। কোনওক্রমে মহেন্দ্রকে তুলি, পর্দা ফেলে দিতে বলি। তারপর ‘মহাজন হাউজ’-এ গিয়ে বেল দিই।
ভেতরে সেই অ্যালসেশিয়ানটা ডাকছে গাঁউ গাঁউ করে। আস্তে আস্তে দরজাটা ফাঁক হল, কোনও কাজের লোক, চেনের ওপারে আলোর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বলি এ এস কিংবা জে মহাজন আছেন?
—কী দরকার?
—বলুন একটি চেনা ছেলে দেখা করতে এসেছে। একটা হারানো জিনিসের ব্যাপারে।
একটু পরেই ভেতরে আলো জ্বলে উঠল। আরও একটা আলো, আরও একটা জোর আলো। প্রথমে জগদিন্দ্র, তারপরে একটি ইয়াং ম্যান আমি চিনি না, তারপরে এ এস, তারপরে বাড়ির মেয়েরা, বাচ্চারা। আমি সাবধানে রিকশার পর্দা তুলে মহেন্দ্রকে নামাই। দরজার ফাঁকে মুখ রেখে বলি— দেখুন, দরজা খুলে দিন, মহেন্দ্ৰদা। মহেন্দ্রদা এসেছেন।
দরজা খুলে গেল, তীব্র একটা আর্ত মেয়েলি চিৎকার, সোনা রঙের একটি একহারা বউ আলুথালু অবস্থায় ছুটে এসে মহেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরল। পাগলের মতো কাঁদছে, বুকে মাথা ঘষছে, কোনও অদৃষ্টকে অভিশাপ দিচ্ছে আবার আশীর্বাদ করছে…।
আমার পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। চোখভর্তি জল এ এস বললেন, মাই বয়, কোথায়, ওকে কোথায়, কীভাবে? তুমি কি সামহাউ কিডন্যাপার্সদের সঙ্গে জড়িত? বলো, আমি কিছু বলব না। আর কারও কাছে আমার নালিশ নেই। দে হ্যাভ কেপ্ট দেয়ার ওয়ার্ড। দে হ্যাভ রিটার্নড্ হিম। অ্যাট লঙ লাস্ট।
আমি প্রমাদ গনি। দাঙ্গার সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। এবার কি কিডন্যাপার্সদের সঙ্গেও জড়াব? খুলে বলি কীভাবে ওঁকে পাই।
সবাই গোল হয়ে আমায় ঘিরে। একটা বিশাল ডিভানে মহেন্দ্রকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। কী রকম বেভ্ভুল ভাবে অসংলগ্নভাবে বলে যাচ্ছেন ওঁর অভিজ্ঞতা। আমাকে অন্ধকার ঘরে চোখ বেঁধে রাখত, পা, ওরা আমাকে শট দিত বার বার, আমি কত করে বলতাম আমি এমনিই ঘুমব। শট দেবার দরকার নেই। শুনত না। ওরা কিছুতেই শুনত না, শাসাত। পা, আমি আমার নাম ভুলে গেছিলাম। আমি কে, কোথায় আমার ঠিকানা, বেঁচে আছি না মরে গেছি। ভাবতাম আমি মরে গিয়ে নরকে এসেছি। ধস্তাধস্তিতে গাড়িতে গুলি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই, তো যখন জ্ঞান হল দেখলাম একটা অন্ধকার ঘরে মোম জ্বলছে। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা কিছু লোক, তখনই বুঝি আমি মরে গেছি, নরকে এসেছি। এ এস বললেন— রেস্ট করো, রেস্ট করো সোনা, একসঙ্গে অত কথা বোলো না। তোমরা ওকে কিছু খেতে দাও। স্যুপ, দুধ, হালকা কিছু, সারদা তুমি আনো খাবার, শর্মিলা তুমি ওর কাছে থাকো, বান্টি, বুলা তোমরা বাবাকে ছেড়ে নড়বে না।
আমি বললাম— একজন ডাক্তার তো এখখুনি ডাকা দরকার। যাব?
—ফোনে ডাকছি, ব্যস্ত হয়ো না ভাই, —জগদিন্দ্র অন্য ছেলেটিকে ইশারা করলেন, সে বোধ হয় ফোন করতে চলে গেল। তারপর জগদিন্দ্র ক্রুদ্ধ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন— পাঁচ কোটি টাকা নিয়ে সোনাকে এই কন্ডিশনে ফিরিয়ে দিয়েছে। হি ইজ অলমোস্ট আউট অফ হিজ মাইন্ড। গুলি করেছে, হাতুড়ে দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে। লুক অ্যাট হিজ ফিজিক্যাল কন্ডিশান। পা, আই’ল কিল দেম, কিল দেম অল। আই’ল নট স্পেয়ার আ সিঙ্গল ওয়ান।
এ এস বললেন— দিস ইজ আনথিংকেবল, আমার দিকে চেয়ে বললেন, ইয়াং ম্যান, আমরা বহু অ্যাসেটস বিক্রি করে কোনও মতে টাকাটা জোগাড় করেছিলাম। আন্ড দে ট্রিটেড হিম লাইক দিস। আমি ওদের ছেড়ে দেব না। তুমি কী বলো?
আমি যেন হঠাৎ ওঁদের পরামর্শের যোগ্য হয়ে উঠেছি। ওঁদের সমান সমান। বয়সে, অভিজ্ঞতায়, সামাজিক অবস্থানে।
আমি বললাম— নেভার। দে শুড বি ব্রট টু বুক। এক্ষুনি পুলিশে এবং কাগজে খবর দেওয়া উচিত। তবে আপনারা কিন্তু আপনাদের সিকিওরিটি একটুও শিথিল করবেন না। একটু পরে বললাম, এবার আমি যাই?
এ এস হঠাৎ আমার হাত দুটো ধরে বললেন— আরও একটু থাকো, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, উই আর ওল্ড পিপল, খুব হেল্পলেস লাগে, বাবা! আইসোলেটেড, যেন আমাদের কেউ নেই। আমার মনে আছে, তুমি নিজে এগিয়ে এসে আমার স্ত্রীর শেষ যাত্রায়… চোখ মুছতে লাগলেন এ এস।
—আমি বসছি। কী ভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি, আমাকে বলবেন। আমি তো এই কাছেই থাকি।
চুপচাপ বসে বসে পারিবারিক মিলন দৃশ্য দেখতে থাকি।
—পা। তুমি আমার কাছে এসো। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? মা কই? মা! শর্মিলা প্লিজ কিস মি, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না আমি বাড়ি এসেছি। রুণুর সঙ্গে দেখা না হলে আমি খালি এই রাস্তাগুলোয় ঘুরতাম, ঘুরতাম, কিচ্ছু চিনতে পারতাম না, তারপর এক সময়ে পড়ে মরে যেতাম।
জগদিন্দ্রর স্ত্রী দুধ নিয়ে ঢুকলেন।
—সোনা পিয়ে নাও।
—ওহ তুমি? ভাবি তুমি? আমি ভাবিনি আবার তোমাদের দেখতে পাব।
জগদিন্দ্র বললেন— সারদা, দুধে একটু ব্র্যান্ডি মিক্স করে দাও।
দুধটা খেল মহেন্দ্র। তার পর একেবারে নেতিয়ে পড়ল, মহেন্দ্রর স্ত্রী ও বাচ্চাগুলো ককিয়ে কেঁদে উঠল। জগদিন্দ্র বললেন, শর্মিলা— স্টে স্ট্রং, এরকম করলে চলবে না, ডক্টর সেন এক্ষুনি আসছেন।
ডাক্তার এসে যাবার পর আমি চলে এলাম।
পরের দিন জোর খবর। এরা বোধহয় বাতাসের মুখে খবর পায়। এত ডিটেল তো আমিও শুনিনি। মহেন্দ্রর ডান হাতে গুলি লেগেছে, অপটুভাবে অপারেশন করা হয়েছে, মাথার অবস্থা ভাল নয়। মাথায় ভারী কিছু দিয়ে মারা হয়েছে। ভদ্রলোক এমন একটা শক খাওয়া অবস্থায় আছেন যে মাঝে মাঝে হিস্টিরিক হয়ে যাচ্ছেন। দুর্ঘটনার দিন গাড়িতে বসে ওঁর কেমন ঢুল এসেছিল। তারপরেই ড্রাইভার মদনলালের কানের পাশে পিস্তলটা দেখতে পান এবং দুই বাক্সের টিফিন কেরিয়ারটা ছুড়ে মারেন। তারপরেই গাড়ির দরজা খুলে দুষ্কৃতীরা ওঁকে ধরে। উনি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন, তখন ওরা গুলি করে এবং মাথায় আঘাত করে। তিন মাস হয়ে গেছে একটা অন্ধকার ঘর একটা বাতি জ্বলছে এ ছাড়া আর ওঁর কিছু চোখে পড়েনি। ঘরটা মাঝে মাঝে বদলে যেত। কিন্তু একই রকমের অন্ধকার। শেষটায় একটা অসহ্য গরম ঘরে ছিলেন। কালো মুখোশ পরা কয়েকজন লোক যাওয়া-আসা করত, খাবার দিত। ওই রকমই একজন তাঁর হাত থেকে গুলি বার করে। ইদানীং অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে সেখানে। দু’মাসের পরে এ এস একটা ফোন পান। পাঁচ কোটি টাকার দাবি করে কেউ। ওঁরা অনেক দরদস্তুর করেও টাকার অঙ্কটা কমাতে পারেননি। দুর্বৃত্তরা হয় জানত না নয়তো বিশ্বাস করেনি পাঁচ কোটি টাকা মুক্তিপণ দেবার ক্ষমতাসম্পন্ন ওঁরা নন। ওঁরা ভয়ে পুলিশকে কিছুই বলেননি। কিন্তু পুলিশ তলে-তলে তদন্ত করে চলেছে। অনেক কিছু জানতেও পেরেছে। আপাতত তদন্তের স্বার্থে কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছে না। অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ির কাছাকাছি রাস্তায় মহেন্দ্রকে ফেলে ওরা চলে যায়। উনি আকাশ দেখেন। কিন্তু বাড়ি চিনে ফিরতে পারেন না। একটি স্থানীয় ছেলের সাহায্যে বাড়ি পৌঁছন। সময় কতটা কেটেছে, তিন মাস না তিন বছর সে সম্পর্কে ওঁর কোনও ধারণা নেই।