তিমির বিদার (Timir Bidar) : 02
আমাদের এই পুরো পাড়াটার নাম নাকি একসময়ে ছিল জবরদখল নগর। সরকারি খাতায় উদ্বাস্তু শিবির কিন্তু স্থানীয় লোকেদের মুখে জবরদখল নগর। বাবা তখন বছর পাঁচেকের ছেলে, ঠাকুর্দা-ঠাকুমার হাত ধরে এখানে এসে পড়েছিল। পঞ্চাশের দশক, একান্ন কি বাহান্ন। ঠাকুমা বলতেন সে যে কী হেনস্থা, কী হেনস্থা কহতব্য নয়! যাদের জমি এখানে দখল করে দলে দলে প্রাণ-মানের ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য পূর্ববঙ্গীয়রা বসে গিয়েছিল, তারা মাঝে মধ্যেই চড়াও হয়ে গালাগাল দিত। কেউ-কেউ অনুনয়-বিনয়ও করত। ঠাকুর্দা ছিলেন সেকালের আদর্শ ইস্কুল মাস্টার, ফরিদপুরে অনেক জমিজমা ছিল। তবু কোনওক্রমে দুটো খাওয়া আর পরনের কাপড় জুটলেই মনে করতেন সব ঠিক আছে। ঠাকুমা কিন্তু ছিলেন রীতিমতো জাঁদরেল। একবার এইরকম একদল এসে শাসাচ্ছে, এক ভদ্রলোক বলছেন— মাস্টারমশাই আপনারা বলছেন আপনারা বাস্তুহারা, স্বাধীন দেশের সরকার আপনাদের জন্য কিছু করেনি, কিন্তু আপনারা! আপনারাই বা কী? আপনারা তো আমাদেরই উদ্বাস্তু করে দিচ্ছেন, বিশ্বাস করুন গলির গলি তস্য গলি বউবাজারের একতলায় ছেলেপিলে নিয়ে ভাড়া থাকি। এই জমিটুকু কিনেছিলুম একটু আলো-হাওয়ায় বাস করব বলে, বাড়ি তৈরির ব্যবস্থা এখনও এই চুয়ান্ন বছর বয়সেও করে উঠতে পারিনি। সে আশাটুকুও গেল।
ঠাকুর্দা মাথা চুলকে, দাড়ি চুলকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠাকুমা নাকি ফ্রন্টে এসে যান। বলেন— আমি ধরেন আপনের বউমা, আপনি আমার শ্বশুরের মতন, একটা কথা জিগাই জবাব দ্যান তো! আপনের কয়টা পোলাপান?
—আজ্ঞে পাঁচটি, কেন?
—মেয়ে কয়টি?
—দুটি।
ঠাকুমা বলেন—আমাগ তিনটা ছিল। একটিরে ও পারেই হারাইসি। চক্ষুর সম্মুখ দিয়া নিয়া গেল কিসুই কইরতে পারি নাই। আর দুটিরে লইয়া পলাইয়া আইতে ছিলাম, কখন, কোন নিশিরাত্রিতে কোন যমে যে আর একটিরে কাছছাড়া কইরলো, এই এতগুলান দিনেও খুঁজিয়া পাই নাই। এখন এই চার খানি প্রাণ। বক্ষে পাষাণ, নিজেরা মাথায় বাড়ি মাইরা মাইরা মইরা যাইতে পারতাম। কিন্তু এই শিশু, পাঁচ বছুরা, এগারো বছুরা, ইয়াদের কী করি, কইয়া দ্যান, একটি আবার সে-ই মাইয়া।
পুরো দলটা থমকে গিয়েছিল। হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারেনি। এখন যেমন প্রতি দলে কিছু গুণ্ডা থাকে, তখন তো অতটা থাকত না। এঁরা সত্যিই জমিগুলোর মালিক ছিলেন। সস্তার জলা জমি। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত মানুষের অনেক কষ্টের কেনা।
ঠাকুমা তখন বলেন—আমাগ সকল গিয়াসে। মান সম্ভ্রম-বিষয়-সম্পদ-পোলা-মাইয়া-সোয়ামি-স্ত্রী-ভাই-বুন। স্বাধীনতা সব খাইয়াসে। স্যাক্রিফাইস। আপনাদের কষ্ট, আশাভঙ্গ সকলই বুঝি। এইটুকু ধরেন আপনাগ স্যাক্রিফাইস। গরমেন্টরে বলেন অ-মশায়গণ আপনেরা তো সব গদি পাইলেন, আমরা কী পাইলাম? কিস্যু না, যা ছিল সকল হারাইসি। দুর্বৃত্তে নিজের মাইয়া টাইনা লইয়া গেল, কী অত্যাচার করল, কী কাটবা, কী রাখবা, কোথায় কোন আন্ধারে উয়াদের স্থান হইবে গিয়া, ভাবেন, একটু ভাবেন, এই নরক যন্ত্রণা তো অন্তত পক্ষে আপনাগর নাই।
ঠাকুমার কাছেই এ সব গল্প আমার শোনা। বাবা মুখচোরা মানুষ, কারও সাতে পাঁচে থাকতেন না। ঠাকুর্দার স্বভাব পেয়েছিলেন। বাবার কাছ থেকে কথা বার করা মুশকিল ছিল। আর এই অতীত খুঁড়তে কারই বা ভাল লাগে। তবে কিনা আমার কৌতূহল বরাবরই একটু বেশি। যেখানে যেটুকু পাই, জানতে ইচ্ছে করে, কী, কেন, কীভাবে কী হয়! তা সেই পুনর্বাসন, সেই জবরদখলত্ব আর রেফিউজিত্ব তো সোনার পশ্চিমবঙ্গে এখনও টিকে রয়েছে দেখি। ফুটপাত জবরদখল, খালপাড় জবরদখল, উড়ালপুলের তলা জবরদখল, বাজার বাড়তে বাড়তে বাজারের আওতা ছাড়িয়ে বসতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অফিসযাত্রী রবিনবাবু একদিন দলামোচড়ানো পুঁইশাকের পাতায় হড়কে কোমরের হাড় ভাঙলেন। তনিমা দিদিমণি আঁশবঁটি আর মোটরের তলা কোনটা বেছে নেবেন ভাবতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় পাননি। মহিলার পায়ের পাতার ওপর দিয়ে মোটরটা চলে যায়। এখন সেরে উঠেছেন, একটু খুঁড়িয়ে চলেন। কিন্তু রবিনবাবু তনিমা দিদিমণি দু’জনেই এখনও এই রাস্তা বাজারেই বাজার সারেন। রবিনবাবু কাকে যেন বলছিলেন— সময় কোথা? যে জম্পেশ বাজার করব? এই ফিরতি পথে লাউটা, কুমড়োটা, এই-ই আমাদের সুবিধে বুঝলেন না? তনিমা দিদিমণিরা বলাবলি করেন— এখানে চাষিরা, চাষিবউরা বসে, ওদের জিনিসগুলো অনেক ফ্রেশ, দামেও সস্তা, শাকে-পটোলে কেমিকেল রং দেয় না।
সেদিন দেখি শনিতলার বেঁটেদা তিনটে গামছা আর ক’ বাণ্ডিল বিড়ি নিয়ে ওখানেই বসে পড়েছে। পাশে আবার ক’খানা মেয়েদের ব্রেশিয়ার, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাখা। বেঁটেদার হাইট সাড়ে তিন ফিট। কোমরের ওপর থেকে সবই ঠিকঠাক। গোঁফ দাড়ি, যন্তর সবই যে যার জায়গা মতো। কিন্তু হাঁটুর তলা থেকে পায়ের সাইজ বাড়েনি।
—কী বেঁটেদা, এসব কী?
—বেওসাটা শুরুই করে ফেললুম, বুঝলি না? কত লম্বা-চওড়ারাই বলে চাকরি পাচ্ছে না। ত আমার মতো বেঁটে!
—তা গামছা বুঝলাম। বিড়িও বুঝলাম। ওগুলো কেন?
ব্রেশিয়ারের ফোলা জায়গায় হাত বুলিয়ে ভেতরে মুঠো ঢুকিয়ে আরও নিটোল করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেঁটেদা চোখ মটকে বলল— অ্যাডভাইস।
—অ্যাডভাইস? মানে?
—অ্যাডভাইস দেখায় দেখিস না? ছেলেদের গেঞ্জি তাতেও মেয়েছেলে হাত বুলোচ্ছে, ছেলেদের জাঙ্গিয়া সেখানেও ছোট ছোট জামা পরা মেয়েছেলে। এমন কী দাদের মলমেও দেখবি মেয়ে নাচছে। আসলে সেক্স না থাকলে কোনও কিছুই বিকোয় না শালা। তোদের বেঁটেদা সব খ্যাল রেখেছে। বেঁটে হলে কী হয় মাথার ঘি কিলোয় তোদের কারও থেকেই কম হবে না। বুঝলি? ফুলো ফুলো, সাদা-সাদা আহা, এই দেখে খদ্দের দাঁড়িয়ে পড়বে তারপর দেখবে আসল দরকারের মাল। বিড়ি আর চেড়ি— এই দুটি হল গিয়ে হত্যাবশ্যি জিনিস। পরনে গামছা আর মুখে বিড়ি থাকলে কোন শালা কার তোয়াক্কাটা করে, তুই-ই বল!
—বিড়ি তো বুঝলাম। কিন্তু ছিঃ বেঁটেদা তুমি চেড়িও সাপ্লাই দিচ্ছ না কি?
—আরে বুরবক কাঁহিকা, চেড়ি হল ওই গামছাগুলো। চেক-চেক দেখছিস না? চেক-চেকের বাংলা হল চেড়ি। এই সামান্য কথাটা বুঝলি না? ইংলিশ ইংলিশ করে দেশটা এমন খেপে গেল যে সামান্য বাংলা কথা ধরতে পারে না। তা বিড়ি আর চেড়ি এই হল গিয়ে হত্যাবশ্যি। আর বাকি যা দেখছিস তা স্বপন, নিশার স্বপন। যে ছিল আমার স্বপনচারিণী— হেঁড়ে গলায় গান ধরে বেঁটেদা। কে বলে রবীন্দ্রসঙ্গীত জনগণের কাছে পৌঁছয়নি?
এই সময়ে নিমকি এসে দাঁড়াল।
—ব্রাগুলো কত করে?—আমি সরে যাচ্ছিলাম, বেঁটেদার চোখে দেখি কাতর অনুনয়। সে কোনও মতে বলল— সাইজ কত?
—বুঝতে পারছ না গো বেঁটেদা? ছত্তিরিশ গো ছত্তিরিশ!
আমার দিকে আড়চোখে একবার চাইল নিমকি। কটাক্ষপাত আর কী!
বেঁটেদা দেখলাম একটু ব্রীড়াবনত, থতোমতো খেয়ে গেছে।
—ব্র্যান্ডো জিগ্যেস করলে কিন্তু বলতে পারব না। এসব লোকেল মাল।
—আরে আমরাও তো লোকেলই গো—বলতে বলতে নগদ কুড়ি টাকার একটা কমলালেবু নোট ফেলে দিয়ে খবরের কাগজে মোড়া একটা ব্রেশিয়ার তুলে নিলো নিমকি। তারপর পেছন নাচাতে নাচাতে চলে গেল।
আমি বলি— এতক্ষণ তো খুব লেকচার ঝাড়ছিলে হেনচারিণী, তেনচারিণী, যেই খদ্দের এসে উপস্থিত হল, অমনি ওরকম কেঁচো মেরে গেলে কেন?
বেঁটেদা মাথা চুলকে বলল— আরে মেয়েছেলে দূর থেকে একরকম। ছায়া-ছায়া নরম নরম। কিন্তু এমন কাছ থেকে? বাপরে! আমার পেটের ছেলে পড়ে যাবে।
—তা তোমার বউনি তো হয়ে গেল! ভাল ভাল!
আমি বাজারের সরু পথ সাইকেল ধরে পার হই। ভেতরে একটা রাগ ঘুঁষি পাকিয়ে আছে। নিমকি বিহারের মাল। ওদের ওইরকম নাম হয়— রাবড়ি, জিলাবি, নিমকি, খাজা, খাস্তাগজা। তা হোক গে! আমি জন্মে থেকে নিমকিকে দেখে আসছি। নাকে শিকনি, ছেঁড়া ইজের খালি গা। যেখানে-সেখানে রোঁয়া ফুলিয়ে বেড়ালের মতো ঝগড়া করত। নিমকির মা এ দিকের হিন্দি ইস্কুলের ক্লাস ফোর, মানে ঝি। বাপের খোঁজ নেই। নিমকি হিন্দি ইস্কুলে ছ’-সাত ক্লাস পড়ে আর সুবিধে বোঝেনি। এইরকম ঢলে ঢলে বেড়ায়। জুতোর পালিশের মতো চকচকে কালো রং। ডেঁও পিঁপড়ের মতো পেছন উঁচু, বুক দুটো কেমন খোঁচা মেরে থাকে, যেন ভেতরে মাংস নেই, দা-কাটারি জাতীয় কিছু পোরা আছে। দু’-তিন বছর আগেও নিমকির চেহারায় একটা মার্কামারা বিহারি লাবণ্য ছিল, এখন দেখলেই বোঝা যায়— নিমকি গন কেস! তা সেই কেস যে কেন এত এলিজিব্ল্ তরুণ থাকতে আমারই পেছনে সেঁটে থাকে আমার বোধগম্য হয় না। বেঁটেদার কাছ থেকে সওদা করা ওর একটা বাহানা। আমি আছি দেখে স্রেফ ভিড়ে গেল!
রাগে ব্ৰহ্মরন্ধ্র অব্দি জ্বলতে থাকে। কোন হিসেবে এই নোংরা নিমকি নিজেকে আমার যোগ্য মনে করে! ও কি ভেবেছে বেকার বলে আমি একটা যা-তা! ও ফিলমের হিরোইনের মতো বুক আর পেছন নাচালেই আমি ভিজে যাব। ছোঃ! সশব্দে থুতু ফেলি। এইয্ যাঃ! পাশ দিয়ে মহাজনদের একটা গাড়ি যাচ্ছে, লাগল না কি? দেখি তামাটে কাচ নেমে যাচ্ছে, দাড়ি-গোঁফ কামানো মেয়েলি চেহারার ছোট মহাজন নাম বোধহয় মহেন্দ্র, আমার দিকে তাকিয়ে বলল— রাস্তার মাঝখানে থুতু ফেলাটা কি ঠিক হল ভাই? গাড়ির কাচ উঠে যায়। শব্দহীন গাড়ি ভেসে চলে যায়। লান্সার গাড়ি। বেঁটেদা বলে লাঞ্চার।
বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর বাপের থুতুদানিটা তো পথশোভার স্বার্থে দান করলেও পারে। তা বলব কী গাড়ি তার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। অবশ্য কথাগুলো আমি বলতে পারতামও না। বড়জোর বলতাম— স্যরি। রাস্তাটা যেমন আপনাদের, তেমনি আমাদেরও, আপনাদের থুতু ফেলার জায়গা আছে, আমাদের নেই। বলতে কী আপনাদের তেমন স্যালিভেশন হয়ও না। আমাদের অ্যাসিড-ফ্যাসিড আছে, থেকে থেকেই পথে-ঘাটে থুতু পায়। তা বেঁটেদার মতো লোকেদের গ্যাঁট-গচ্চার মালের ওপর ফেলব? না আপনাদের লাঞ্চারের ওপর, বলুন! আর তো কোনও অলটারনেটিভ নেই! আর নিজের থুতু নিজে গিলব এমন আহাম্মক ডরপোকও আমাকে পাননি। এ সব কথাও অবশ্য আমি বলতে পারতাম না। কথাগুলো অবিকল শামুর স্টাইলে বলা। খুব ডিপলি একটা মানুষের সঙ্গে মিশলে এগুলো আপনা থেকে হয়ে যায়। এই সিচুয়েশনে শামু কী বলত, শামু কী করত! সঙ্গগুণ। যেমন আমার সংস্কৃত পণ্ডিত বাবার আমলে আমরা কখনও পেচ্ছাব পায়খানা যাইনি। তখন আমরা বড়জোর প্রস্রাব করতাম, বাহ্যে যেতাম, তখন মেয়েরা মেয়েছেলে ছিল না, মা জননী ছিল, তখন আমরা নিয়মিত গৃহদেবতার আরতির সময়ে অংশ নিতাম। বড় বড় মানুষদের, যেমন বিদ্যাসাগর, সুভাষচন্দ্র, গাঁধীজি এঁদের ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম।
এখন আমাদের ভক্তি চটকে গেছে। এনাদের নাম উঠলেও আমরা এনাদের কাঠগড়ায় তুলি। পৃথিবীটা জীবনটা ফলাফলের। কর্মের মোটেই নয়। কার কোন কাজের ফলে টাকাপয়সা আসছে, সেটা দেখবার দরকার নেই, টাকাপয়সাটাই দেখবার। পানু তো বলে— বিদ্যেসাগর! বিদ্যেসাগর আমাদের কী করেছে রে! যা কিছু সব মেয়েদের জন্যে। বিধবা বিবাহ! আরে বাবা সব বিধবা বিয়ে বসলে হাজারে হাজারে যে সব কুমারী জন্মাচ্ছে তাদের বিয়ে হবে কী করে— তা সে ভেবেছিল?— আমাদের হাততালি আর হাসিতে বিরক্ত হয়ে পানু মহা উত্তেজিত হয়ে যায়।— আরে সেই থেকেই তো মেয়েগুলো তড়পে তড়পে এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। আপিসে যা— মেয়েছেলে, ইস্কুল-কলেজে যা— মেয়েছেলে! বাসে-ট্রামে ওঠাও চাই গায়ে গা লাগিয়ে, আবার ছুঁচিবাইও ষোলো আনা। থানায় সুদ্ধু মেয়েছেলে। আর বছর ম্যালেরিয়া হয়েছিল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি, ও মা দেখি এক লেডি-ডাক্তার স্টেথো বার করছে। ‘আমি লেডি নই, আমি লেডি নই’ বলে খুব চিৎকার দিয়েছিলুম, শুনলে না, গম্ভীর মুখে ইনজেকশন দিয়ে নার্সকে কী সব ছাই-ভসসো বলে গটগট করে চলে গেল। তার ওপর নার্সটা আবার বলে কী জানিস? মুচকি হেসে বলে— লেডি নন, কিন্তু আপনি নির্ঘাত লেডি-কিলার।
সাম্য বলল—যা বলেছিস। বহু বিবাহই বা বন্ধ কেন? বড় বড় লোক, ফিলিম স্টার— এরা তো দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে, আইনকে কলা দেখিয়ে। আমাদের হিন্দু জনগণের বেলায় আলাদা নিয়ম কেন?
শামু বলল— খবরদার! আমাকে একলা পেয়ে খুব ডিং নিচ্ছিস, না? দলবল থাকলে দেখিয়ে দিতুম মজা।
আমার খুব খারাপ লাগল। শামু আমাদের ছোটবেলাকার খেলার সাথি। এখন ও গদার সঙ্গে নেই, তার চালচলন বড়লোকি হয়ে গেছে। কিন্তু শামু আমাকে অনেক খবরাখবর দেয়। আমার বাবা মারা গেলে শামু এসেছিল। শামুর বড় বোনের শাদিতে আমি বিরিয়ানি খেয়ে এসেছি। শামু আমাকে দল দেখাচ্ছে? কোথায় ছিল খেলার মাঠে শামুর দল, যখন একটা নামকরা নাক-উঁচু ক্লাবের প্লেয়ার আমাদের মাঠে খেলতে এসে ইচ্ছে করে লেঙ্গি মেরে শামুর ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছিল। আমার মনে পড়ছে সেই প্লেয়ারটার নাম ছিল মুস্তাক। এ কথা বলছি না যে কোনও কানাই-বলাই কাজটা করত না। কিন্তু কাকতালীয় হলেও খুব অদ্ভুত ছিল ঘটনাটা। ভাঙা পা নিয়েই মুস্তাককে এক বিরাশি সিক্কার চড় মেরেছিল শামু। হাসপাতাল-ওষুধপত্র-অপারেশন সব কিছুর ব্যবস্থা তো আমরাই করি। সেই থেকে শামুর ফুটবল শেষ। বড্ড ভালবাসত খেলাটা। কিন্তু পার্ক সার্কাসের ওই পয়সার ফুটানিঅলা মুস্তাক মির্জা ওর কেরিয়ার তো শেষ করে দিলই, কোনও মাফ চাওয়া না, কিচ্ছু না। ড্যামেজ দাবি করে ওদের বাড়ি আমরা ধাওয়া করেছিলাম। বাপস সে কী বাড়ি, বড়লোক বটে। ওরা সব নামকরা ইংরেজি স্কুলের ছাত্র, ওর বাবা ইংরেজিতে আমাদের হাঁকিয়ে দিল। সেই শামু আজ আমাকে দলবল দেখাচ্ছে।
আমি স্থির আহত চোখে ওর দিকে চেয়ে বলি—ওই কর, যেখানে তোদের ধর্মের লোকজন বেশি সেখানে তোরা আমাদের ঠ্যাঙা, আর যেখানে আমাদের ধর্মের লোকজন বেশি সেখানে আমরা তোদের ঠ্যাঙাই। ইতিমধ্যে পৃথিবী জ্ঞানে-বিজ্ঞানে মিলিয়ন পা এগিয়ে যাক। ইতিমধ্যে তোদের আর আমাদের ধর্মবাজগুলো বেশ কিছু গুছিয়ে নিক। সাতপুরুষের মতো। তুই আর আমি একই মাঠে মরে পড়ে থাকি। আমি ধর পাথরচাপা আর তুই ধর বেগুনপোড়া। একই খেলার মাঠে। একই ভাষায় মা মা চিৎকার করতে করতে।
কথাবার্তা গোলমেলে জায়গায় চলে যাচ্ছে এবং শামুর মুখ কালো হয়ে গেছে দেখে সত্য আমাকে থামাল। আমিও থেমে গেলাম। কিন্তু পানু আর থামে না। বলল— ব্যাপারটা একলা পাওয়ারও না, ডিং নেওয়ারও না, লজিক্যাল কথা বলছি। বুঝতে যাতে না পারিস তার জন্যে চতুর্দিকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, জাল বিছোনো হচ্ছে। তোদের মেয়েরা লেখাপড়া করে না কেন রে? খালি আরবিটুকু শেখে, কেন? সত্যি কথা, আমাদের জন্যও জাল বিছানো চলছে। কিন্তু ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার লোকও আমাদের আছে শামু। কথাগুলো সাম্য খারাপ বলেনি।
তবে এ ধরনের তর্কাতর্কি সবই এখন অতীতের ব্যাপার। সাম্প্রতিক অতীত। কিন্তু অতীতই। শামু খুব তাড়াতাড়ি কেউকেটা হয়ে যাচ্ছে। শামুকের খোলের মধ্যে ঢুকে থাকে। মাঝে মাঝে তার থেকে বেরিয়ে হঠাৎ-হঠাৎ এক একটা খবর দিয়ে যায়। নইলে রাস্তাঘাটে দেখা হলে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি দিয়ে বলে—কী রে রুণু এখনও চাকরি খুঁজে যাচ্ছিস? না, সেলফ-এমপ্লয়মেন্টের স্বপন দেখছিস? আজকাল খুব ফিনান্স কম্পানি টম্পানি হয়েছে, এজেন্ট হয়ে ভালই কামানো যায়। দেখছিস নাকি? আমি বলি—এ-ই!
খবর থাকলে অবশ্য খবরটুকু শুনে নিই কান পেতে। তামাশা-মশকরা হজম করি নির্বিবাদে কেন না শামু আর আমাদের সেই শামু নেই। সে এখন ওস্তাদ সমশের। পেছনে রাজনৈতিক দাদারা আছেন। আমি যদি রেললাইনের ওপারে সিগ্রেট-লজেন্স-কোকোকোলার দোকান দিই তো শামুকে প্রতি মাসে চাদা দিতে হবে। শামু চাইবে না। আমাকেই অন্য দোকানদারদের থেকে খবরাখবর নিয়ে নিজে শামুকে পৌঁছে দিতে হবে।
—শামু, শামু-উ বাড়ি আছিস?
—কে রে? আরে রুণু না?
আমি একগাল হেসে বলব—দোকানই দিলাম শেষে, কেউ হুজ্জোতি করলে সামলে দিস ভাই। খরচখরচাও তো আছে তাতে। টাকাটা রাখ।
লুঙ্গির গেঁজেতে টাকাটা রাখতে রাখতে শামু বলবে—ধুস, তুইও যেমন, তোর আমার দোস্তি আজকের? তোর দোকানে হুজ্জোতি করবে শামু থাকতে? তোর জন্যে জানটাই দিয়ে দিতে পারি তা জানিস?
—সে আমি জানি—আমি বলব—তবু আমার দিক থেকে বললাম। তোর দিকটাও তো আমার দেখা দরকার।
—তা যদি বলিস তা হলে আলাদা কথা।
আর, দোকানটা যদি রেললাইনের এপারে করি? গদাইয়ের কাজ কারবার আরও জটিল, রাশভারি। সে নিজেই হয়তো তার গ্রে রঙের ফোর্ড আইকনখানা থামিয়ে মুখ বাড়াবে। পরম বিস্ময়ের গলায় বলবে—আরে, রুণু যে! যেন আমি বহুদিন প্রবাসী, দিল্লি কিংবা মুম্বই। আমি হাসব। গদাই বলবে—‘সুধা স্টোর্স’ দোকানটা তোমার? আমি বলব—হ্যাঁ। তো কী? গদাই বলবে—কী আবার। ভীষণ আনন্দের কথা যে শেষ পর্যন্ত ডিসিশনটা নিলে। নাইস থিং। আমরা পাড়ার লোকেরা ন্যাচারালি পেট্রোনাইজ করব। গারাজটাও তোমাদের পড়ে ছিল।
এই বলল তো গদাই? দু’-চার মাস পরে, জমিয়ে বসে যাবার পর একদিন একটা অচেনা ভীষণ দর্শন লোক, তার পেশি হাফপাঞ্জাবির মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান করে এসে ঘটা করে কোক চাইবে—দেব। সিগ্রেট চাইবে—দেব। ধরিয়ে নিয়ে ধীরেসুস্থে বলবে—ক্যাশে কত জমল?
তখনই আমার হাড় হিম হয়ে যাবে। এই সেই। গদার লোক।
—আমরা সিকিওরিটি বাবদ সামান্য কিছু নিয়ে থাকি।—আমার ভয় দেখে লোকটা মোলায়েম করে বলবে।
—কত?
—প্রফিটের ফাইভ পার্সেন্ট।
—তা এই চার মাসে তো প্রফিট হয়েছে সাকুল্যে এগারো হাজার টাকা ক’ পয়সা।
—রাউন্ড করে দিলেই হবে। তো এগারো হাজারের দশ পার্সেন্ট কত হচ্ছে?
—এগারশো।
—তো ফাইভ পার্সেন্ট?
—সাড়ে পাঁচশো।
—টেন নেওয়া হয়। আপনি নতুন আছেন আপনার সাড়ে পাঁচেই হোবে। লোকটা টাকা নিয়ে চলে যাবে।
পুরো কথোপকথনগুলো আমি বানিয়ে বললাম ঠিকই। কিন্তু বানানো হলেও এটাই সত্যি। আর সেই হেতু মা, দাদা, বউদি, সব্বাই আমাকে গারাজে দোকান দিতে জোর করলেও আমি একেবারেই কান দিচ্ছি না। খাল কেটে কেউ কুমির আনে?