তিমির বিদার (Timir Bidar) : 18
উৎকট আলো ঘরে। সামনে ডাক্তারবাবু। হাতে থার্মোমিটার। আমি বিছানায়। পাশে মা। সত্য। একটু দূরে রিন্টি। হাতে ছেঁড়া মারাদোনা। চুপটি করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশনটা মায়ের হাতে দিলেন। মা দিল সত্যর হাতে— দাঁড়াও একটু।
সত্য বলল—আগে কিনে আনি না, পরে দিয়ে দেবেন।
ডাক্তারবাবু বললেন—এইটা আপনারা ভুল করেন বউদি, এই হোমিওপ্যাথি, তা-ও আবার নিজে নিজে। ভোগান্তি বেড়ে যায় এতে।
আমি কথা বলতে চেষ্টা করি। পারি না। গলা দিয়ে কেমন একটা আওয়াজ হয়। ডাক্তারবাবু বলেন—জল দিন। বউদি, ওকে একটু জল খাইয়ে দিন।
জল খেয়ে অনেক কষ্টে ক্ষীণ গলায় বলি—কী হয়েছে?
—কী আবার হবে? —ডাক্তারবাবু বললেন—ভাইর্যাল ফিভার মনে হচ্ছে, ওই সব ক্যালকাটা ফিভার ক্যালকাটা ফিভার বলছে না? তা সত্ত্বেও ব্লাডটা টেস্ট করতে হবে। নাও ইয়াং ম্যান, টেক অ্যাবসলিউট রেস্ট। এক উইক তো বটেই। জ্বরটা গেলেও প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়বে।
আমার আর শক্তি নেই কথা-বলার, নড়া-চড়ার, কখন সত্য ওষুধ এনে দিয়েছে, মা খাইয়ে দিয়েছে, ডাক্তারবাবু কিছুক্ষণ বকবক করে চলে গেছেন কিছুই জানি না। ঘুম, একটা অসুস্থ ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মা গলায় জল ঢেলে দিচ্ছে, মিছরি-টিছরি জাতীয় কিছুর শরবত, দুধ, এক ঢোঁক দু’ ঢোঁক খেয়েই আমি আবার তলিয়ে যাচ্ছি। দাদা আর মায়ের কাঁধ ধরে একবার বাথরুম গেলাম। বিনবিন করে ঘাম দিচ্ছে পরিশ্রমে। কোল্যাপ্স্ করছি। দাদার গলা শুনতে পাচ্ছি—‘এ ভাবে হয় না মা, তুমি একটা বোতল কি বালতিটালতির ব্যবস্থা করো।’ সুতরাং বালতির ব্যবস্থা হয়। অনেক রাতে অল্প ঘুমের তলা থেকে ভেসে উঠে দেখি—মেঝেতে বিছানা করা, মা চোখের ওপর আড়াআড়ি হাত রেখে শুয়ে আছে। রাস্তার থেকে যথেষ্ট আলো আসে ঘরটাতে। সবই দেখা যায়, কেমন একটা স্বর্গীয় আবছায়ার মধ্যে। আমি পাশ ফিরে আবার ঘুম যাই। টাপুরটুপুর বৃষ্টি পড়ে নদী এল বান। শনিঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান। এক কন্যে পড়া করেন, আর কন্যের মান, আরেক কন্যে গোঁসা করে যমের বাড়ি যান।…
আপনি তো আচ্ছা জ্বর মশাই? আমি সার্জেন্ট বলছি চলে যান, তবু জ্বরে স্টিক করে আছেন? কত কাজ জানেন? জ্বরে থাকলে চলে? তুমুল ঝড় আসছে, বৃষ্টি আসছে, সত্যি-সত্যি হড়্পাবান। কূল ভাসানো, দিক ভোলানো প্রলয়ঙ্করী…।
—মা—গলা দিয়ে স্বর ফোটে না।
মা—আ—
আস্তে আস্তে উঠে বসে মা—জল খাবি রুণু?
—দাও। কত রাত হল?
—দেড়টা বেজে গেছে।
—তুমি ঘুমোওনি?
—ঘুমিয়েছি।
—বউদি?
—ঘুমিয়েছে।
—এসেছে? কখন এল?
—অনেকক্ষণ।
—এ ঘরে একবারও এল না!
—এসেছে, অনেকবার, তুই ঘুমিয়েছিলি।
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। জানি না মাকে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা। তা ছাড়া আমার শরীর মনও খুব-খুব নিস্তেজ হয়ে রয়েছে। ভাবনা-চিন্তা করবার ক্ষমতা নেই। বৃষ্টি পড়ে বান আসে, আমি শুধু অসহায় সেই বানে ভেসে যেতে পারি—ঝমঝমাঝম বিষ্টি পড়ে সাগর এল বান/শনিঠাকুরের শাদি হবে তিন কন্যে দান। এক কন্যে পড়েন শোনেন/আর কন্যের মান/আর, এক কন্যে গোঁসা করে যমের বাড়ি…যমের বাড়ি…যমের বাড়ি যান।
…যা ব্বাবা, তুই তো বরাবরই হিরো! মেয়েগুলো তো সব তোর নামে মুচ্ছো যায়। আমার বোন দুটো, শামুর বোনটা, গদার ভাগ্নী…। শুধু মেয়ে কেন? তুই তো ছেলেদেরও হিরো। সঞ্জু, বাদাম, মুস্তাফা, খলিল, রাজু, তারপর ধর আমাদের ব্যাচমেটদের মধ্যে শামু, সত্য, পানু, গদা, আমি…।
কে বলেছে রে দীপু? তোর ভয়েস? না কি মাজাকি করছিস আমার সঙ্গে? আমি হিরো ছেড়ে একটা জিরোও নই রে! আমার এক কড়ার মুরোদ নেই। যদি হিরো হতাম তা হলে আমাদের পাড়া থেকে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ গায়েব হয়ে যেত? আজ দু’মাসের ওপর হতে চলল তার কোনও খোঁজ নেই? তোকে তো আমিই চাকলাদারের মুখে ঠেলে দিলাম। না বুঝে। কিন্তু যদি না-বুঝব তো হিরো হব কী করে? আর কড়ে আঙুলটাও তুললাম না বলে শামুর বোনটা জহর ব্রত করে নিল। কড়ে আঙুলটাও তুলিনি। উপরন্তু ক্রিটিক্যাল টাইমে এমন সুবিধেবাদী জ্বর বাধিয়ে বসে রইলাম যে একটা মেয়ে, ছোটখাটো কালোমানিক-কালোমানিক বউদি-শ্রেণীর মেয়ে আমাকে নিরাপদে রেখে পক্ষ বিস্তার করে বিপদের মুখে উড়ে চলে গেল। হায় ঈশ্বর, তুমি আমার এ কী করলে…।
সকালবেলা। চড়চড়ে রোদ্দুর। আমার পুবের জানলা দিয়ে অগ্নিস্রোত ঘরে ঢুকে যায়। জেগে উঠি। অবধারিত মাতৃদেবী। মা, মা গো, আমি তোমাকে ভীষণ ভালবাসি। তুমি ছাড়া জীবন আমি কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একটি রণরঙ্গিণী ছোট্ট কৃষ্ণকামিনীকে দেখতে চাই। তার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
—হরলিক্সটা খেয়ে নে।
—দাও।
—আগে মুখটা ধো। দাঁড়া পেস্ট ব্রাশ আনি।
বালতি করে জল কেউ আমার ঘরের কোণে রেখে গেছে। আরেক বালতিতে আমি মুখ ধুয়ে কুলকুচি করি। চোখে মাথায় জল দিই।
—মা, জামাটা ছাড়ব, ওই ছাই রঙের পাঞ্জাবিটা দাও প্লিজ।
—দিচ্ছি, আগে হরলিক্সটুকু খেয়ে নে।
হরলিক্স খাই। জামা বদলাই, মা পেছন ফিরে দাঁড়ায়, পাজামাটাও বদলাই, গামছা জলে ভিজিয়ে একটু স্পঞ্জ মতো করে নিই।
—এখন একটু ভাল লাগছে?
—অনে-ক। বউদি কোথায় মা?
—সে কী রে? আজ শুক্রবার, টুকু স্কুলে চলে গেছে।
—রিন্টিকে কে পৌঁছে দিল?
—তপু।
—কে আনবে?
—টুকু নিয়ে ফিরবে।
—অনেক দেরি হয়ে যাবে না?
—তা কি তুই যেতে চাস? না আমাকে যেতে বলিস?
রাগ করো না জননী, আমার কিছু কথা আছে যে! তোমাকে বলতে, জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছি।
মৌসুম্বির রস করে এনেছে মা।
—কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
—বাঃ রান্না করব না?
—সারা রাত জেগেছ, আবার এখন রান্না?
—তা, কে করবে? তোর দাদা? না রিন্টি!
রাগ করো না জননী, একা থাকতে ভাল লাগছে না। তোমার মাতৃমুখ যে এত মধুর, এত তাপহারী—আগে জানিনি।
—দুধ-পাঁউরুটি এনেছি।
—খেতে ইচ্ছে করছে না।
—জোর করে খেতে হবে। ডাক্তারবাবু বলে গেছেন। ডালের স্যুপ, চিকেন স্যুপ। দুধ,—এসব সমানে খেয়ে যেতে হবে, না হলে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়বি।
–দাও।
দু’ ঘণ্টা পরেই আবার ডাকি—মা, মা।
—কী?
—দেবে না? চিকেন স্যুপ, পাঁউ-পাঁউ?
—খিদে পেয়েছে? বাঃ—মায়ের মুখ হাসিতে ভরে যায়।
মা তাড়াতাড়ি মুসুর ডালের পাতলা স্যুপ, আর ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট নিয়ে আসে। আমার একটুও খিদে পায়নি। তার চেয়েও বড় কথা খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু ‘দুর্বল হয়ে যাব’ ওই কথাটা আমাকে স্পৃহা দিচ্ছে। খাদ্য স্পৃহা। স্যুপ-স্পৃহা, হরলিক্স-স্পৃহা। দুর্বল হয়ে গেলে আমার চলবে না। আমাকে জ্বরটা ছাড়লেই উঠে দাঁড়াতে হবে। অ্যান্টিবায়টিকে সাঙ্ঘাতিক দুর্বলতা আর অরুচি হয়। এটুকু যদি জয় করতে না পারি, তবে আমার এই তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্বের আর কোনও মানে থাকবে না।
তৃতীয়বার ফলের রস খেয়ে আর পারি না। আবার সেই মোহনিদ্রা আমাকে অধিকার করে। কখন কোথা দিয়ে দুপুর, বিকেল কেটে যায়, আমি বুঝতে পারি না।
—মা।
—একটু চা খাবি কি!
—লিকার, একটু দাও, আধকাপ। বউদি কোথায় মা?
—বাজারে গেছে।
—কেন? দাদা?
—দাদার আজকে ফিরতে দেরি হবে, তোর ব্লাড রিপোর্ট নিয়ে ফিরবে।
রাত তখন আট সওয়া আট হবে—মা চিকেন স্যুপ আর টোস্ট নিয়ে ঘরে ঢুকল। তখন আর পারি না আমি, ফেটে পড়ি—সবই কি তোমাকেই করতে হবে? বউদি একটু খাবারটাও আনতে পারে না?
—কী যে বলিস? আমি তো তবু যা করছি বাড়ির ভেতরে। যত দৌড়ঝাঁপ তো ওরই। এখন ছেলেকে পড়াচ্ছে, পরীক্ষা এসে গেছে।
—হুঁ, ওইটুকু পুঁটকের আবার পরীক্ষা।
রাত্রের দুধ নিয়ে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। আধা অন্ধকারে মুখ দেখতে পাচ্ছি না। আমার ঘুম পাচ্ছে।
—শুনলুম বউদি কাজ-কর্মে সেবা-যত্নে শাশুড়িকে সাহায্য করছে না বলে মাতৃভক্ত দেবর খুব চটে গেছে?—আমি তড়াং করে উঠে বসি। মাথা ঘুরে যায়। আবার শুয়ে পড়তে পড়তে বলি—
—আশেপাশে মা বা দাদা আছে?
—না।
—কী খবর? শেষ?
—শেষ কোথায় কেউ কি জানে রুণু? সে পালিয়ে গেছে।
দীর্ঘ দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আমি মাথাটা বালিশের ওপরে ভারহীন পড়ে যেতে দিই।
—নাও দুধটা খাও।
—কী ব্যাপার কী হল একটু খুলে বলবে?
—আমি প্রথমে দীপুদের বাড়ি যাই। তারপর মণি আর মাসিমাকে নিয়ে শামুদের বাড়ি। দেখি সব মুখ গম্ভীর করে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে উঠোনটার ওপরে। শামুর মা ঘরের ভেতরে শুয়েছিলেন। আমাকে দেখে অবাক হয়ে শামু উঠে এল। তখন একপাশে ওকে ডেকে চিঠিটা ওর হাতে দিই। আমার তখন হাত কাঁপছে রুণু, ভাবছি হাসিকে বোধহয় হাসপাতালে নিয়ে গেছে। কে নিয়ে গেছে, সেটাই শুধু বুঝতে পারছিলুম না। ওদের সবাইকে তো চিনিও না। শামু বলল—ভাবি, হাসি কাল কলেজে গিয়ে আর ফেরেনি, মাকে বলে যায়, বন্ধুর বাড়ি শাদির দাওয়াত আছে, একটা ব্যাগে ভাল শাড়ি নিয়ে যাব, বললে—সামসুল কি আমাকে যেন মা পাঠায় রাত আটটা নাগাদ। সঙ্গে চলে আসবে। সামসুল ভবানীপুরে সেই বিয়েবাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয়। দাওয়াত ছিল ঠিকই। খুব জাঁক। বন্ধুর দাদার শাদি। কিন্তু ওর সেই বন্ধু মালিনী বলে, সব্বাই এসে গেল, এখনও হাসিনা এল না। সাড়ে ন’টা অবধি সেখানে অপেক্ষা করে সামসুল ফিরে আসে। সেই থেকে ওর কোনও পাত্তা নেই।
—কারও কাছে কিছু লিখে রেখে যায়নি?
—না। রমজানের সঙ্গে নিকাহ-র দিন নাকি স্থির হয়ে গিয়েছিল। ও বেঁকে বসাতে মায়ের কাছে মার খেয়েছিল। সেই থেকে গুম হয়ে ছিল।
—ওরা হাসপাতালটালে খবর নিয়েছে? —বলতে আমার গলা কেঁপে গেল।
—হ্যাঁ, মর্গ-টর্গ সব, এ ক’দিন গঙ্গায় কোনও তেমন দুর্ঘটনার খবরও তো নেই। খবরটা ওরা এখনও প্রকাশ করেনি। রমজানকেও বলেনি। আমাদেরও চুপচাপ থাকতে বলেছে। যা হয় ভেবে-চিন্তে করবে।
—মণিও কিছু জানে না?
—কিচ্ছু না। আকাশ থেকে পড়ল। খুব শক্ড্। কথা বলতে পারছিল না।