তিমির বিদার (Timir Bidar) : 13
খটখটে দুপুরে বেরিয়েছিলাম। রোদ যেন আগুনের তাত। ড্রাই হিট। নিশ্চয় বিয়াল্লিশ কি তেতাল্লিশ হবে। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার পুরনো বইয়ের দোকানে বি এসসি পাস কোর্সের একটা ফিজিক্সের বই কিনব। আজকাল দীপুর কাছে আমি ফিজিক্সটা শিখছি। নিজের ছাত্র-জীবনে যতটা শক্ত লাগত, এখন আর ততটা লাগে না। পড়াতে কাজে লাগে। হায়ার সেকেন্ডারির সিলেবাসও মাঝে মাঝে হ্যান্ডল করতে হচ্ছে। একটু বেশি না জানলে ওভাবে সীমাবদ্ধ পড়ানো যায় না। হঠাৎ খেয়াল হল রোদটা আর নেই, তাপ কমে গেছে, মুখ তুলে দেখি, পুরো আকাশটা নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায় হয়ে গেছে। অলৌকিক আলো পড়েছে কলেজ স্ট্রিটের গলিতে। নতুন রং করা প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা ইউনিভার্সিটির আশুতোষ বিল্ডিং যেন ডানা মেলে ওড়বার জন্য প্রস্তুত অতিকায় পৌরাণিক পাখি। দেখতে দেখতে প্রচণ্ড ঝড়ের হুটোপাটি শুরু হয়ে গেল। বইপত্রের ওপর পলিথিন চাপা দিয়ে স্টলওলারা কোথায় সরে পড়েছে। প্রবল হাওয়া আমাকে কখনও পেছনে কখনও সামনে টানছে, আর তেমনি ধুলো। চোখেমুখে এক-একটা ঝাপটা লাগছে আর মনে হচ্ছে গেল বুঝি চোখ দুটো। ট্রামলাইন পেরিয়ে দুড়দাড় করে ছুটি। বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রিট কফি হাউসের তলাটা ভিড়ে ভিড়। ওপরে যাবার ইচ্ছে আমার ছিল না। ওপরেও কি কোনও চেয়ার খালি পাব? ওপরে গিয়ে কিন্তু দেখলাম যথেষ্ট ভিড় হলেও উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা খালি টেবিল। আমার দিকে পেছন করে বসে একটি ছেলে কিছু পড়ছে। বোধহয় ওর অর্ডার এখনও আসেনি। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বলি—এক্সকিউজ মি, বসতে পারি?
ও মুখ তুলে তাকাল। দেখি—দেবল, দেবল গুহ। আমাকে দেখে কেমন চমকে গিয়ে একটা ফ্যাকাশে অপ্রস্তুত হাসি হাসল।
—কফি বলেছ?
—হ্যাঁ। তুমি কী নেবে?
—কফিই বলছি, ব্যস্ত হয়ো না। —আমি অবশ্য এক প্লেট পকোড়ারও অর্ডার দিলাম।
একটু এদিক ওদিক কথাবার্তার পর বলি—তোমাদের বাড়িটা অমন দুম করে বন্ধ হয়ে গেল, কিছু করছ না?
ম্লান মুখে দেবল বলল—কী করব বলো, স্বয়ং পার্টির লোক যদি নিজের আখের গুছোবার জন্যে তোমার পেছনে লাগে, তুমি কী করতে পারো? রক্ষকই ভক্ষক। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি—চাকলাদারই যে জগাদার কানে মন্তরটি দিয়েছে সে কথা ও জানে কি না। চেপে গেলাম। দেখিই না নিজে থেকে কী বলে! আমি শুধু বলি—দেখো সব রোগেরই তো ওষুধ আছে। জগাদাকে একটু ধরে পড়ো না, কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়ে বাড়িটা যাতে তোমাদের করতে দেয়, মানে কেসটা তুলে নেয়।
দেবল বলল—জগাদা নেক্সট ইলেকশানে কর্পোরেশানের টিকিট পাচ্ছে। এখন কখনও নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করে?
—তবে এক কাজ করো না, সাততলাটা পুরো ভেঙে ছ’তলা অব্দি করো, শেষ করে দাও।
—চারটে ফ্ল্যাটওনার ফিফটি পার্সেন্ট টাকা দিয়ে দিয়েছে। কী ভাবে তাদের সামলাব বলো!
—ওদের টাকা ফেরত দিয়ে দাও। কর্পোরেশনের নিয়মে আটকাচ্ছে, করতে পাচ্ছ না, এর ওপর তো আর কথা নেই। দুটো শাপমন্যি করবে—এই তো?
—সেটাই তো! চাকলাদার বলছে ওর সিক্সটি আর আমাদের ফর্টি পার্সেন্ট শেয়ার। এখন, লাভের শেয়ার যখন এই, লোকসানের শেয়ারও তখন একই থাকবে। সাততলার চারটে ফ্ল্যাটের পাওয়া-টাকা থেকে ফর্টি পার্সেন্ট ও আমাদের দিয়ে দিতে বলছে।
—কিন্তু… তোমরা কি ফ্ল্যাটটা থেকে এখনও কোনও টাকা পেয়েছ? এটা তো পুরোটাই প্রোমোটারের করার কথা। সে-ই নেবে, সে-ই বিল্ড করবে, তারপর ভাগাভাগি হবে। আমি তো এরকমই জানতাম!
—আরে চাকলাদার তো ঠিক সে-অর্থে প্রোমোটার নয়। ঠিকেদার একটা। দু’জন প্রোমোটারের সঙ্গে গণ্ডগোল হবার পর ও নিজেই সাজেস্ট করল ও-ই করে দেবে পুরোটা। প্ল্যান-ট্ল্যান তখন তো সব রেডি! আমরা আর আপত্তি করিনি। টাকা যেমন যেমন পাচ্ছে ও আমাদের দিচ্ছেও কিছু কিছু।
—আচ্ছা! তা কর্পোরেশনের স্যাংশন কি ঠিকঠাক ছিল?
—ওই তো গ্যাঁড়াকল! আগের প্রোমোটার বলল সাততলার ভিত করছি। দমকলের একটা পার্মিশন পেলেই সাততলাটা তুলে দেওয়া যাবে। এখন বেশি পেলে কে আর না চায় বলো!
—তো তাই যদি হয়, এখন পার্মিশনটা বার করার চেষ্টা করো না!
—আরে ভাই বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। শোনোনি! একবার যখন পার্টিতে ছুঁয়েছে…
—তা হলে লোকসানটা পুরিয়েই দাও। পুরো বাড়িটা তৈরি হয়ে গেলে তো অন্তত পক্ষে ফ্ল্যাটগুলোও পাবে!
—অত সোজা নয় ভাই, আমাদের আরও শরিক আছে না? সেজদাদু আর ছোড়দাদুকে তো চেনো না? একজন বিপত্নীক আরেকজন ব্যাচেলর মানুষ অত টাকা টাকা কেন করে বুঝি না। ফ্যামিলি নেই, কিছু নেই। ওরা রাজি নয়।
—তোমরা এখন থাকছ কোথায়? প্রোমোটারদের তো নিজেদের খরচে তোমাদের রাখবার কথা, যদ্দূর শুনি। এতে চাকলাদারের আরও লোকসান হচ্ছে জট ছাড়াতে চেষ্টাটা সে-ই বা করছে না কেন?
—বললাম না চাকলাদার সে-ভাবে প্রোমোটার নয়! ওরকম ব্যবস্থাও আমাদের গোড়া থেকেই হয়নি। এক দাদু থাকেন সিঙ্গাপুর। এক দিদা থাকেন দেরাদুন। আমরা থাকি মামার বাড়ি। আর দুই দাদুরও বাড়ি আছে। কাজেই ওটার ওপর জোর দিইনি।
খুব ম্লান মুখে দেবল বসে রইল। আমি ঝড় থামলে, যে সামান্য এক পশলা বৃষ্টি হয়ে রাস্তা আধভিজে হয়ে উঠেছে তার সোঁদা গন্ধ নিতে নিতে নিজস্ব বাসে উঠে পড়লাম।
যবে থেকে বাড়ি-ওঠা বন্ধ হয়েছে রমেন গুহ বা দেবল কেউ এ মুখো হয়নি। এত বড় একটা বাড়ি, এত সম্পত্তি, টাকা এভাবে আটকে আছে, লোকে কী করে সহ্য করে কে জানে! আমি হলে তো পাগল হয়ে যেতাম। আসলে সেই কবি বলেছেন না— ‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়!’ আমার দেড়তলার ঘরটা থেকে দাদা যদি আমাকে বার করে দেয় আমি কী করব জানি না। এমন মুখ-খিস্তি করব যে দাদার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে, কিংবা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শামুর কাছ থেকে একটা বোমা এনে টপকে দেব, যা শ্শালা হোল বাড়ি উড়ে যা! কিংবা রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পাতাল রেলে ঝাঁপ? তা-ও হয়তো দিতাম। কিচ্ছু বলা যায় না। অথচ এদের একটু মুখ শুকনো হওয়া ছাড়া হেলদোল নেই!
ফিজিক্সের টেক্সট বুকখানা দীপুর কোলে ফেলে দিলাম, —দ্যাখ এতে হবে? উল্টে পাল্টে দেখে বলল—ঠিক আছে। তোকে যেটা বলেছিলাম সেটা আরও ভাল, কিন্তু বেসিক্স্-এর পক্ষে এটা খারাপ নয়। এটা শেষ করে একটু লাইব্রেরি থেকে আনা। তোর তো আজকাল কলেজের ছাত্তরও হচ্ছে! পড়ে নিবি। আটকালে আমি আছি।
এত ভাল বোঝায় দীপু, যখন ব্যাখ্যাতার ভূমিকায় থাকে তখন ওর চোখ থেকে সেই এলোমেলো পাগল-ছাগল চাউনিটা উবে যায়। কেন যে ছাত্র পড়িয়েও অন্তত কিছু রোজগার করে না! এইসা রাগ হয়ে যায় না একেক সময়ে। কিন্তু কাউকে বলে কিছু করানো যায় না। দীপুর কাছে যদি ওর কেসটা নিয়ে কথা বলতে যাই কীভাবে এড়াবে জানেন! ধরুন বললাম—আচ্ছা দীপু ট্যুইশনি করে তো তুই যথেষ্ট রোজগার করতে পারিস!
—সবাইকে দিয়ে কি আর সব কিছু হয়! —উত্তর হবে।
—আমি জানি না, তোর হয়তো ভাল লাগে না, কিন্তু সংসারের কথা ভেবেও তো একটু চেষ্টা করতে হয়!
—সংসারের কথা আমি ভাবছি না তোকে কে বললে? বিশু রাসকেল?
অর্থাৎ দীপু তাতছে।
—ভাববার কোনও লক্ষণ তো দেখি না!
—দুটো ব্যাপার আছে রুণু, সাবজেকটিভ আর অবজেকটিভ। অবজেকটিভ দিকটা দেখতে পাচ্ছিস না বলে যদি জিনিসটাকেই অস্বীকার করিস তা হলে ভগবানকেও অস্বীকার কর। সাইবেরিয়াটাও অস্বীকার করা যায়।
—সে আবার কী! ভগবান ছাড়, কিন্তু সাইবেরিয়া আছে সবাই বলছে, জোগ্রাফি বলছে, কাগজ বলছে।
—আমিও তো বলছি—আমার ভাবনা আছে—এটাও তোর কাছে হিয়ারসে, কাগজের কথাটাও তোর কাছে হিয়ারসে। আগে যা দেখে আয় সাইবেরিয়া আছে। তারপর বলিস।
—মাসিমা রোজগার করছেন তবে খাচ্ছিস, ছোট ভাই-বোনদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।
—মা-ই তো শাবককে খাওয়ায়। ওটা তো মায়েরই কাজ। তা ছাড়া মায়ের যা লাইফ তাতে মা যদি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কোনও কাজ না করতে পারে, ডিপ্রেস্ড্ হয়ে যাবে। মা-ও ছারপোকার…
—চুপ কর দীপু। বাজে বকিস না।
—তুইও বাজে বকিস না। নিজের চরকায় তেল দে। আমি কী করব না করব আমার প্রাইভেট ব্যাপার। তুই নাক গলাবার কে রে?
কেউ যদি এভাবে তোমাকে অপমান করে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, তা হলে আর কিছু করার থাকে না।
একদিন বললাম—তুই সন্ন্যাসী হয়ে চলে যা না!
—কেন? তাতে তোর কী সুবিধে?
—আমার? তোর নিষ্কর্মা বৃত্তি দেখলে আমার কেমন গা কিসকিস করে। আগেকার দিনে প্রায়ই গৃহস্থ ঘরের ধর চার ছেলে-মেয়ের বাবা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-মা-বাবা সব ফেলে সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়, মিনি-হিমালয়ে গিয়ে গাঁজায় দম দিত, কেন জানিস?
—কেন আবার? ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’ সেই কেস। ঈশ্বরের ডাক শুনত!
—তোর মাথা! অত সোজা! চারটে-পাঁচটা বাচ্চা-কাচ্চা তৈরি করেছে, দু’ বেলা বউয়ের হাতের পাখার বাতাস খেতে খেতে চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় সাঁটাচ্ছে, ধর বাবা মারা গেলেন, অমনি বিবাগি হয়ে গেল! যে-বাবার সঙ্গে জ্যান্তে দিনে চারটে কথা হত কি না সন্দেহ!
—স্পিরিচুয়াল নয়? তা হলে কী?
—তা হলে আর কী! দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লে সে-সব ফেলে ভোঁ দৌড়। নইলে যে পরিমাণ লোক আমাদের দেশে সন্ন্যাসী হয়েছে তাতে তো আধ্যাত্মিকতার বান ডেকে যেত রে দেশে। ওই সন্ন্যাসীগুলো কী করে বল তো! স্রেফ গুলতানি করে,ভ্যাগাবণ্ডগিরি করে আর চালাকি করে ভিক্ষে করে। গাঁজায় দম মারলেই ইহকাল পরকাল শীত-গ্রীষ্ম সব বিস্মরণ হয়ে যায়। ব্যাস, আর কী! উপরি-লাভ ভক্তিপূর্ণ প্রণাম, ভয়।
—কী যে বলিস রুণু। তোর মাথাটা একবারে খেয়েছে এস এফ আই। রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ সব ভড়ং?
—তারা কেন হবে? এই এলেবেলে সন্ন্যাসীগুলো যারা কুম্ভমেলা সাগরমেলায় ঘোরে, গ্রাম-ট্রামের ধারে বটগাছ—তাদের তলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে চিমটে হাতে রাগ দেখায়, আবার জ্ঞান দেয়। এখন খবরের কাগজে যাদের ছবি দেখছিস রে নিত্য, তুই বিশ্বাস করিস এদের কিছুমাত্র বৈরাগ্য, অনাসক্তি, মহত্ত্ব বা আর কিছু গুণ আছে?
—তুই আমাকে এইগুলোর মতো হয়ে যেতে বলছিস? দীপু আহত অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
—হয়ে যেতে বলব কেন? তুই তো অমনিই। যখন-তখন রাগে চিমটে ছুড়িস, আবার কীসব দৈববাণী শোনার ভড়ং করিস, ত্রৈলঙ্গস্বামীর মতো বোমভোলা ভাব! সবটাই আছে শুধু ভেকটা নেই। গেরুয়া, রুদ্রাক্ষের মালা, জটা, ত্রিশূল, গাঁজার কলকে। তা নিয়ে ফ্যাল!
—তুই আমার ভয়েসকে ভড়ং বললি রুণু? অথচ তোকেই আমি একমাত্র বিশ্বাস করে বলেছিলাম কথাটা।
দীপু গুম মেরে ইটের পাঁজার ওপর সেই আবোল-তাবোলের রাজাটার মতো বসে রইল।
এইভাবেই বোধহয় তাকে আবিষ্কার করে চাকলাদার।
কেন না শুনতে পেলাম, চাকলাদারের গাঁজাখোরের মতো বিরাট গলা—কী ব্যাপার দীপু মাস্টার। তুমি এখানে বসে? তোমার সুবল সখাটি কোথায় গেল?
দীপু বোধহয় কোনও উত্তর দেয়নি। কেন না চাকলাদার পড়ো অফিস ঘরটায় এসে গেল। বলল—ও সাহেবও তা হলে আছে? শোনো ভাই, আরও একটা ডিসিশন নিতে হচ্ছে। দু’জনকে রাখতে পারছি না। একজনকে রাখব। ওই এক হাজার। তোমরাই ঠিক করো কে থাকবে। আমার খুব বাজে লাগছে ব্যাপারটা। কিন্তু যদ্দিন না কাজ আরম্ভ করতে পারছি… আমার দিকটাও তোমরা বোঝো। কাজ শুরু হয়ে গেলেই শিওর ডেকে নেব। তখন আবার সেই আগেরকার মাইনে। শেষ হলে অন্যত্রও।
বেশ একখানা লেকচার। লম্বা। আমার পারা চড়ছে, চড়ছে।
—চাকলাদারবাবু আপনার এই সো-কল্ড, চাকরিটা কি আমি সেধে সেধে নিয়েছিলাম?
—না, ইয়ে, তেমন তো কোনও…
—আপনিই বরং সেধে সেধে টাকার লোভ দেখিয়ে এই থ্যাংকলেস জবটায় আমাদের ভিড়িয়েছেন। সত্যি কি না?
—থ্যাংকলেস তো আমারও। আমার আরও।
—না আপনার নয়। আপনি সেদিন আঙুলে টুসকি মেরে বলেননি, সবই টাকার খেলা, তা সেই টাকার খেলাটা খেলতে দেরি করছেন কেন? সাততলা বাদ দিয়ে বাকি ফ্লোরগুলো তুলে ফেলা যায় না, এ কথা আমি এত ইডিয়ট নই যে আমাকে বোঝাবেন। জগা মিত্তিরের সঙ্গে টাকার রফাটা করে নিলেই সে কেস তুলে নেবে। সেইটা করছেন না মানেই আপনার অন্য কোনও অভিসন্ধি আছে। এটা বুঝি না এত ক্যাবলা আমি নই।
কিছুক্ষণ ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল চাকলাদার। তারপরে বলল—
—অভিসন্ধি? কী অভিসন্ধি আমার এর মধ্যে তুমি খুঁজে পেলে? তুমি তো আচ্ছা ছেলে! কী অভিসন্ধি হতে পারে!
—সেটা আমি কেন বলব? আপনার অভিসন্ধি আপনারই থাক। এর মধ্যে আমাকে আর জড়াবেন না। আমি চললাম।
লোকটাকে আর একটাও কথার সুযোগ না দিয়ে আমি গনগন করতে করতে চলে আসি।
ইটের পাঁজার ওপর থেকে দীপু চিৎকার করে বলল—চললি?
—হ্যাঁ চললাম।
কিন্তু বিকেলে যখন দীপু আমার বাড়ি এসে বলে গেল—ও কাজ ছাড়ছে না, আমি যখন নিজের ইচ্ছেয় ছেড়ে দিয়েছি তখন ও করছে, করবে, তখন সত্যি কথা বলব কী ক্ষোভে ঘেন্নায় আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল। এই সেই বন্ধু রোজগার দেবার তাগিদে আমি আমার চাকরি যার সঙ্গে স্বেচ্ছায় স্বপরিকল্পনায় ভাগ করে নিয়েছি!
দীপু ভীষণ চালাক-চালাক চোখে বলল—বুঝলি না রুণু, লোকটার একটা সুপারভাইজার ভীষণ দরকার। নয়তো ভেতরটা জবরদখল হয়ে যাবে, তখন হাজার ঝামেলা। একটা কুকুর হোক বাঁদর হোক ওর চাই-ই। এদিকে টাকাটা কমাতে চাইছে। মওকা বুঝে আমিও দাঁও মেরেছি। ওই ভূতের বাড়িতে কে পাহারা দিতে আসবে বল? আসলেও চুরি চামারির মতলবে আসবে। সততা, সিনসিয়ারিটি এগুলো এসব কাজে বড্ড লাগে রে! অথচ মিচকে পটাশ ছিঁচকে চোর থেকে যত্ত থার্ড ক্লাসের ভিড় তো এই বিজনেসে! আমিও বলেছি—ঠিক আছে। এত করে বলছেন যখন করব কিন্তু দেড় হাজারের কমে নয়। কস্তাকস্তি করে সাড়ে বারোশো’য় রফা হয়েছে। ভাল নয়?
কী বলব একে! এই আড়-পাগলার মতো ঘুরছে। এই মাতা-কর্তৃক শাবকের ক্ষুন্নিবৃত্তির ফিলসফি আওড়াচ্ছে, এই ভয়েস শুনছে, আবার এই মওকা বুঝে দাঁও মারছে!
সংক্ষেপে বলি—তোর হবে!
—বলছিস! আগে যে বলতিস হবে না!
—বলে থাকলে ভুল বলতাম। আই বেগ ইয়োর পাৰ্ডন।
—তোর ফিজিক্সের কোনও অসুবিধে হবে না। যখনই দরকার হবে চলে আসবি। অফিস ঘরটা তো এখন একা এনজয় করব। আ-হ কী আরাম।
—তুই এবার যা—বলবার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু ওই যে সীমা! সীমাটা একেবারে কালো পাথরের দেয়ালের মতো। ইচ্ছে ওইখানে এসে ঠেকে যায়। মনে পড়ে যায় উচ্ছিন্ন হকার বাবার আত্মহত্যা, মাসিমার রাঁধুনিগিরি, মুক্তাটার চুল ঝাঁটানো, দীপুটার ভ্যাগাবন্ড-গিরি, এক মিনিটের একটা সামান্য ভগ্নাংশের মধ্যে সমস্ত এক সঙ্গে মনে পড়ে যায়। বলি না। তবে দীপু চলেই যায়। ও চট করে কারও বাড়ি আসে না। সামাজিকতা, বন্ধুর বাড়ি এসে চা খেতে খেতে আড্ডা এ জিনিস ওর নেই। ওর পার্মানেন্ট ঠিকানা—রাস্তা। দীপন চক্কোত্তি কেয়ার অফ রাস্তা। সে রসিক ঘোষের লেনও হতে পারে, শনিতলার মোড়ও হতে পারে, গড়িয়ার কাছে বাই-পাস কানেক্টরও হতে পারে। এনি রাস্তা। তেষ্টা পেলে রাস্তার কলে জল খেয়ে নেবে। সারাদিনে হয়তো দু’ভাঁড় চা আর তেলেভাজা, ঝালমুড়ি…
—এ সব খেয়ে শরীরটা নষ্ট করিসনি দীপু—যদি বলি, ও বলবে—না রে, দানাদারও খাই। দানাদার, ক্ষীর কদম্ব।
একে আপনি কী বলবেন?