নিয়ন্ত্রণকক্ষে সবাই গম্ভীর
নিয়ন্ত্রণকক্ষে সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে।
অতি অল্প সময়ে বেশ কিছু বড় বড় ঘটনা ঘটে গেল। জানা গেল, প্রাণীগুলি নিওলিথি সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত। প্রাণীগুলি অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং তারা মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। ক্যাপ্টেন আবেগশূন্য স্বরে বললেন, প্রথম শ্রেণীর জরুরি অবস্তু তুলে নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর সতর্কতামূলক অবস্থা ঘোষণা করা হল।
তৃতীয় স্তর খুলে দেয়া হল। এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হল প্রাণীগুলির সঙ্গে সরাসরি কথা বলা হবে। কথাবার্তা হবে নিয়ন্ত্রণকক্ষে। পরিচালকমণ্ডলীর সব কজন সদস্য ছাড়াও এতে থাকবে মনস্তত্ত্ব ও সমাজবিদ্যা বিভাগের সদস্যরা। কম্পিউটার সিডিসিকেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে স্রুরাকে। স্রুরাকে নেয়া হয়েছে তার ব্যক্তিগত আগ্রহের জন্যে। স্রুরা হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে অযু নামধারী প্রাণীটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যোগাযোগ করেছে। এই একটি মাত্র কারণে স্রুরার আগ্রহের মূল্য দেয়া হয়েছে।
আলোচনা শুরু হল গ্যালাক্সি-ওয়ানের সময়সূচি অনুযায়ী ১২ টা ৩৬ মিনিটে। তিনটি প্রাণীর মধ্যে এসেছে মাত্র দুটি। তারা গোলাকৃতি ডায়াসের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তাদের মাথার উপর গাছের শিকড়ের মতো বিচিত্র জিনিসগুলি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কাঁপছে। প্রথম কথা বললেন ক্যাপ্টেন।
আমি আপনাদের তিন জনকেই আসতে বলেছিলাম। এক জন দেখছি আসেন নি।
সে অসুস্থ, কাজেই সে সমস্যা নিয়ে ভাবছে।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
সে অসুস্থ, কাজেই সে ব্যথা ভুলে থাকবার জন্যে সমস্যা নিয়ে ভাবছে।
কিছু মনে করবেন না। আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না।
শারীরিক ব্যথাবোধ ভুলে থাকবার জন্যে আমরা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি।
কী ধরনের সমস্যা নিয়ে সে চিন্তা করছে?
যাকে আপনারা হাইপারডাইভ বলছেন, তাই নিয়ে।
নিয়ন্ত্রণকক্ষে একটি মৃদু গুঞ্জন উঠল।
ক্যাপ্টেন বললেন, আপনারা নিঃসন্দেহে প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিমান প্রাণী। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা সবাই বিশেষ গর্বিত ও আনন্দিত।
প্রাণীটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মনে হচ্ছে আপনি ঠিক বলছেন না। আপনি মোটেই আনন্দিত নন। ঠিক এই মুহুর্তে আপনি আমাকে ঘৃণা করছেন এবং ভাবছেন, কী করে আমাদের তিন জনকে সবচেয়ে কম পরিশ্রমে মেরে ফেলা যায়।
নিয়ন্ত্রণকক্ষে বড় রকমের একটি গুঞ্জ উঠল। সেই গুঞ্জনের মধ্যেই প্রাণীটি থেমে থেমে বলল, আমাদের একটি ক্ষমতা হচ্ছে, আমরা আপনাদের মনের কথা বুঝতে পারি।
ক্যাপ্টেন অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। দীর্ঘ নীরবতার পর প্রথম কথা বলল স্রুরা, আমি তোমাদের ঘৃণা করি না। তোমাদের অসাধারণ বুদ্ধি দেখে আমি সত্যি সত্যি মুগ্ধ।
আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আপনার মতো আরো আট জন মানুষ এখানে আছেন, যাদের মনে আমাদের সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণা নেই।
এবার কথা বললেন মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান হেরম্যান, আমাদের সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি?
প্রযুক্তিবিদ্যায় আপনাদের দক্ষতা সীমাহীন।
এ ছাড়া আর কী বলার আছে আপনার?
আপনারা অত্যন্ত সন্দেহপ্রবণ।
হেরম্যান বললেন, কেন আমরা সন্দেহপ্রবণ বলতে পারেন? অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, কী কারণে আমাদের এই সন্দেহপ্রবনতা?
আত্মবিশ্বাসের অভাব এর একমাত্র কারণ। আপনাদের সভ্যতা যন্ত্রনির্ভর। যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার জন্যেই আপনাদের নিজের উপর বিশ্বাস কম।
যন্ত্র কিন্তু আমাদেরই তৈরি?
আপনাদের তৈরি হলেও যন্ত্রের সঙ্গে আপনাদের যোগ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আপনাদের তৈরি কম্পিউটারকে আপনারা সন্দেহের চোখে দেখেন।
কম্পিউটার সিডিসি বলল, আমি এ ক্ষেত্রে আপনাদের যুক্তি সমর্থন করছি।
হেরম্যান বললেন, আপনাদের সভ্যতা কি যন্ত্রনির্ভর নয়?
আমরা আমাদের সভ্যতা সম্পর্কে কিছু জানি না।
বলতে চান আপনাদের কোনো সভ্যতা নেই।
জ্ঞানের বিকাশকে যদি সভ্যতা বলেন, তাহলে আমাদের সভ্যতা আপনাদের ভাষায় প্রথম শ্রেণীর। আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারি।
যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারেন?
হ্যাঁ, পারি।
আপনি একাই শুধু আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন, আপনার সঙ্গী চুপ করে আছেন কেন?
আমরা তিন জন একসঙ্গে কথা বলছি। আমার অসুস্থ সঙ্গী, যে আসে নি, সেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করছে।
আপনি কিন্তু বলেছেন, আপনার অসুস্থ সঙ্গী সমস্যা নিয়ে ভাবছেন।
সমস্যা নিয়ে ভাবার সময়ও আমরা ইচ্ছা করলে কিছু বাহ্যিক যোগাযোগ রাখতে পারি।
জীববিজ্ঞান পরিষদ থেকে পরবর্তী প্রশ্নগুলি হল :
মোট কত ধরনের প্রাণের বিকাশ এখানে হয়েছে?
এখানে কোনো প্রাণের বিকাশ হয় নি। আমরা তিন জন ছাড়া এখানে অন্য কোনো প্রাণী নেই।
আপনি কি এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত?
আমরা নিশ্চিত। আমরা দীর্ঘদিন এই গ্রহে আছি।
কত দিন ধরে আছেন?
আপনাদের হিসেবে তিন শত বছর।
জীবন ধারণের জন্যে আপনাদের খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয় না।
না।
আপনাদের শারীরবৃত্তির কার্যাবলি পরীক্ষার জন্য আমরা কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাই। এ ব্যাপারে আপনাদের আপত্তি আছে?
না, আপত্তি নেই।
আপনারা এই গ্রহের বাসিন্দা?
আমরা সঠিক বলতে পারছি না।
আপনারা সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন বলে বলেছেন। এ সমস্যাটির সমাধান করতে পারেন নি?
না, পারি নি। তবে চেষ্টা চলছে। কিছু সমস্যা আছে, যার সমাধান নেই। এটিও এ ধরনের সমস্যা কিনা বলতে পারছি না।
সমাধান নেই, এ ধরনের একটা সমস্যার কথা আমাদের বলুন।
যেমন ধরুন আকাশের বাইরে কী আছে?
আকাশ বলতে আপনি কি মহাশূন্য বোঝাচ্ছেন?
আমি বোঝাচ্ছি আমার চারপাশে যা আছে, তা।
আপনাদের ধারণা, আকাশের বাইরে কী আছে—সে সমস্যার সমাধান নেই?
হ্যাঁ, আমাদের ধারণা সেরকম। আমরা মনে করি আকাশের বাইরে আছে আরেকটি আকাশ, তার বাইরে আরেকটি আকাশ। তার বাইরে–
আপনাদের যুক্তি বুঝতে পারছি। হ্যাঁ, অসীম সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয়।
সমাধান নেই, এই জাতীয় অনেক সমস্যা কি আপনাদের কাছে আছে?
হ্যাঁ আছে।
আমরা সেই সব সমস্যা জানতে আগ্রহী।
জাহাজের ক্যাপ্টেন বল, আজকের মতো আলোচনা মুলতবি থাকবে। আমরা কাল নিওলিথি সভ্যতা প্রসঙ্গে কথা বলব।
লী নীমকে মৃদুস্বরে বলল, এরা কিন্তু একবারও বলল না, ঠিক কী কারণে এরা আমাদের মেরে ফেলতে চেষ্টা করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে কি না।