Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তরাই || Samaresh Basu » Page 3

তরাই || Samaresh Basu

নারায়ণ আর কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ খেতে লাগল। ওর চোখেমুখে চিন্তার ছায়া। কিন্তু চুপ করে থাকতে পারল না। একটু পরেই আবার মুখ খুলল, কিন্তু যাই বলিস উদিত, ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না।

উদিত জিজ্ঞেস করল, কীসের ব্যাপার?

এই মেয়েটির কথা বলছি।

এখন মেয়েটা তোর মাথায় চেপে আছে?

থাকছে কি আর সাধে। ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। যতই ভাবছি, ততই মনে হচ্ছে। একে আমি কোথায় দেখেছি।

উদিত নির্বিকারভাবে বলল, মেয়েটা তো আর পালিয়ে যায়নি, সঙ্গেই রয়েছে। ভাল করে আলাপ করে নে, তা হলেই হবে।

নারায়ণ উদিতের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। তারপর এক বার গাড়ির সামনের দিকে। বলল, সেটাই ঠিক, চেষ্টা করে দেখতে হবে।

উদিত সে কথার কোনও জবাব দিল না। মীনার কথা হঠাৎ মনে পড়ল, আপনাকে খুব ভাল লেগেছে। অর্থাৎ মেয়েটির। ফাজিল মীনা। তবে, হাওড়ায় দেখে যেরকম গর্বিতা মনে হয়েছিল, এখন সে সব কিছু নেই। বরং এবার নামিয়ে দেবার সময়, অনায়াসে, উদিতের কাঁধে হাত তুলে দিয়েছিল। এমন ঝুঁকে পড়েছিল, মেয়েটির বুক আর মুখের দিকে তাকিয়ে, ওর বুকের মধ্যে কেমন ছলাৎ করে উঠেছিল। মেয়েটি তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিল। তা-ই কি একরকম মনে হতে, পিছন থেকে ব্যাগটা এনে দিয়েছিল।

উদিত এবার জিপটা আর লোক কটাকে দেখিয়ে, নারায়ণকে জিজ্ঞেস করল, ওদের চিনিস নাকি?

নারায়ণ জিপের দিকে খানিকক্ষণ দেখে বলল, আলো আঁধারে ঠিক বুঝতে পারছি না। একটাকে চিনি মনে হচ্ছে। শিলিগুড়ির স্মাগলার বিজয় দাশ।

উদিত একটু আগের ঘটনাটা বলল। নারায়ণ ঘটনাটা শুনে বলল, পেছু নেবার মতলব থাকতে পারে। আমার কাছে রিভলবার আছে।

উদিত বলল, টাকা কীরকম আছে তোর কাছে।

বেশি না, তিন-চার হাজার ক্যাশ থাকতে পারে। তবে তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওদের নজর মেয়েটার দিকে।

ওরা দুজনেই তাকিয়ে ওদের দেখল। ভিতর থেকে ডাক শোনা গেল, উদিতবাবু।

উদিত খেতে খেতে সামনের দিকে ফিরে তাকাল। মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে না, তার স্বর ভেসে এসেছে।

নারায়ণ বলে উঠল, তাকিয়ে দেখছিস কী। যা, তোকে ডাকছে।

নারায়ণের ভাব দেখে উদিত ঠোঁট টিপে হেসে বলল, তুই যা না। দ্যাখ না কী বলছে।

নারায়ণ ব্যস্ত হয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই মেয়েটির গলায় যেন অস্থির রুদ্ধ ডাক শোনা গেল, উদিতবাবু।

নারায়ণ এবার উদিতকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিল। উদিত রুদ্ধ হাসি চেপে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। জিভে শব্দ করে বলল, আমাকে একটু জল দেবেন। বড্ড ঝাল লেগেছে।

উদিত খাবারের দিকে লক্ষ করে দেখল, বিশেষ কিছু খেতে পারেনি। বড়লোকের মেয়ের জিভ, এ সব খাবারে পোষায় না। ও বলল, মিষ্টি খান, কমে যাবে। জল দিচ্ছি।

তাড়াতাড়ি নিজের খাবার শেষ করে, কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে একটা মাটির গেলাস দিল মেয়েটিকে। কয়েক বার চেয়ে চেয়ে অনেকটা জল খেল মেয়েটি। খাবারের ঠোঙাটা দেখিয়ে বলল, এটা কোথায় ফেলব?

উদিত মনে মনে বলল, গাড়ি থেকে নেমে এসে রাস্তার ধারের নর্দমায় ফেলতে হবে। সে সব কিছু না বলে, হাত বাড়িয়ে বলল, আমার হাতে দিন।

না না, এঁটোটা আপনার হাতে দেব না। দরজাটা খুলে দিন, আমি নামছি।

উদিত মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। বলল, নামবার আর কোনও দরকার আছে?

না, ঠোঙা ফেলব।

তার জন্য আপনাকে নামতে হবে না। আমার হাতে দিন, কিছু ক্ষতি হবে না।

মনে মনে ভাবল, মেমসাহেবি থেকে এ বাঙালিয়ানা তবু ভাল। উদিত মেয়েটির কাছ থেকে এটা আশা করেনি। মেয়েটি সংকোচের সঙ্গে ঠোঙাটা বাড়িয়ে ধরল। বলল, আপনাকে খুব বিরক্ত করছি।

উদিত বলল, ইচ্ছে করে যখন করছেন না, তখন আর বিরক্ত হব কেন?

মেয়েটি তোয়ালে টেনে নিচ্ছিল। উদিত ফিরতে উদ্যত। ওর কথা শুনে, মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, ইচ্ছে করে কেউ আবার বিরক্ত করে নাকি?

উদিত ফিরে তাকিয়ে হাসল। মেয়েটি শুধু অবাক হয়নি, একটু আহত হয়েছে যেন। উদিত বলল, কেউ কেউ করে। কিন্তু আপনি তো করেননি।

মেয়েটি একটু হাসবার চেষ্টা করল, বলল, আমার খুব লজ্জা করছে। মনে হচ্ছে, আপনি বিরক্ত হয়েছেন।

উদিত তেমনি হেসে বলল, আমার মুখ দেখে কি তা মনে হচ্ছে?

দুজনেই এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। নারায়ণের গলা খাকারি ইতিমধ্যে কয়েক বার শোনা গিয়েছে। উদিত ঠিকই শুনতে পেয়েছে। মেয়েটি লজ্জিত হেসে বলল, বুঝতে পারছি না।

উদিত এবার শব্দ করে হেসে উঠল।

মেয়েটি ঠোঁটের ওপর তোয়ালে বুলিয়ে বলল, আপনাকে বিরক্ত করলে, নিজেই বিপদে পড়ব।

সেটাও ভেবে রেখেছেন দেখছি।

ভেবে রাখব কেন, এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। বরং আপনার কাছে আমি গ্রেটফুল। আপনি হলেন রক্ষাকর্তা।

উদিত সন্দিগ্ধ বিস্ময়ে ভুরু তুলে তাকাল। বলল, একেবারে রক্ষাকর্তা বলে ফেললেন?

পিছন থেকেই নারায়ণের গলা শোনা গেল, ঠিকই বলেছেন উনি। তুই না থাকলে আজ আমারই বা কী গতি হত, ওঁরই বা কী গতি হত।

উদিত অবাক হয়ে পিছন ফিরে দেখল। নারায়ণ কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ও টের পায়নি। বলল, ও তুমিও এসে গেছ?

নারায়ণের গোল মাংসলো মুখে হাসি আর লজ্জায় অদ্ভুত দেখাল। মেয়েটিকে লক্ষ্য করে কিছু বলতে গিয়ে, উদিতের দিকে চোখ ফেরাল। বলল, কথাটা কানে এল কিনা, তাই না বলে পারলাম না।

উদিত মেয়েটির দিকে দেখল। মেয়েটির চোখেমুখে রুদ্ধ হাসির ছটা। উদিতের দিকে তাকিয়ে, যেন হাসি চাপবার চেষ্টা করছে। আবার এক বার ঠোঁটে তোয়ালে ছোঁয়াল। গলায় একটু কাশির আওয়াজ করল। বলল, দেখছেন তো, আপনার বন্ধুও বলছেন।

উদিত ঘাড় নেড়ে শব্দ করল, হু।

নারায়ণ মেয়েটির সঙ্গে আলাপের জন্য ব্যস্ত হয়েছে, উদিত বুঝতে পারল। বলল, ঠিক আছে, আমি রক্ষাকর্তা। শিলিগুড়ি অবধি যদি না পৌঁছুতে পারি, তখন যেন দোষ দিয়ো না।

একটু হেসে আবার বলল, তুই ওঁর সঙ্গে কথা বল। আমি ঠোঙাটা ফেলে দিয়ে আসি।

নারায়ণ যেন হঠাৎ লজ্জিত আর বিব্রত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমি জল খাব বলে কুঁজোটা তোর কাছে চাইছি।

উদিত চকিতে এক বার মেয়েটির মুখের দিকে দেখে নিল। ঠোঁটের ওপর তোয়ালে চাপা। শরীরটা কি কাঁপছে? মেয়েটা হাসছে নাকি? ও কুঁজোটা নারায়ণের হাতে তুলে দিয়ে সরে গেল। মনে মনে ভাবল, রঙ্গিনী মেয়ে। নারায়ণকে দেখে আর কথা শুনে হাসি চাপতে পারছে না। গাড়ির পিছন দিয়ে ঘুরে, নর্দমায় ঠোঙা ফেলে দিল। ফিরে এসে দেখল, নারায়ণ কুঁজো করে, মুখ হাঁ উঁচু করে জল ঢালছে। গাল গলার চাপ চাপ মাংস কাঁপছে। ঢক ঢক শব্দ, আর চিবুক এবং গলা বেয়ে বুকে জল গড়িয়ে জামা ভিজছে। উদিত মেয়েটির দিকে তাকাল। তখনও ঠোঁটের ওপর তোয়ালে চাপা। চোখাচোখি হওয়া মাত্র, মেয়েটির গলায় একটা শব্দ শোনা গেল এবং তৎক্ষণাৎ মুখটা ফিরিয়ে নিল।

ঠিক এই মুহূর্তেই নারায়ণ কুঁজোটা নামাল। গলায় একটা আরামের শব্দ করল। উদিতেরও হাসি পাচ্ছিল, নারায়ণের জল খাওয়া দেখে। ও নিচু হয়ে, হাত বাড়িয়ে বলল, আমার হাতে একটু জল দে নারাণ।

নারায়ণ উদিতের হাতে জল ঢেলে দিল। তারপরে কুঁজোটা নিয়ে, উদিতও নারায়ণের মতো করেই জল খেলা খেয়ে কুঁজোটা গাড়িতে তুলে দিল। বলল, সিগারেট দে নারাণ।

দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে, একটু সরে দাঁড়াল। উদিতের চোখ পড়ল আবার জিপের সামনে তোক কটার ওপর। লোকগুলো এদিকেই তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে আস্তে আস্তে কথা বলছে। এক জন জিপের ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে, বোতল বের করল। ছিপি খুলে গেলাসে ঢালল। যা অনুমান করা গিয়েছিল, তা-ই। মদ খাচ্ছে।

উদিত বলল, লোকগুলোর সত্যি কী মতলব থাকতে পারে? ঠায় এদিকেই কিন্তু তাকিয়ে আছে।

নারায়ণ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, মেয়েটাকে ওরা লক্ষ করছে।

উদিত বলল, মেয়েটি তো ওদের কাউকে চেনে না।

মেয়েটাকে হয়তো ওরা চেনে।

চিনলেই বা, ওভাবে দেখার কী আছে?

নারায়ণ বলল, সেটাই ভাবছি, ওদের কী মতলব থাকতে পারে। ওদের সামনে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করব?

উদিত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। দেখাই যাক না, ওরা কী করে। কিন্তু তুই তো বলছিলি, একটা বিজয় দাশ না কে, স্মাগলার।

নারায়ণ বলল, এখান থেকে দেখে তা-ই মনে হচ্ছে একেবারে ডান ধারের লোকটা।

তার মানে গোটা দলটাই স্মাগলার।

তা হতে পারে।

কিন্তু স্মাগলিং-এর সঙ্গে মেয়েটার কী সম্পর্ক। ওরা মেয়েটাকে দেখছে কেন?

নারায়ণ কোনও জবাব দিল না। উদিতও কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। আবার বলল, নিশ্চয়ই মেয়েটা ওদের দলের নয়?

নারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, অসম্ভব।

উদিত বলল, অসম্ভব কিছুই না। এর চেয়ে অনেক সুন্দরী অ্যারিস্টোক্রাট মেয়ে শুনেছি ও সব দলে থাকে।

নারায়ণ বলল, থাকতে পারে, এ মেয়েটিকে আমার তা মনে হচ্ছে না।

উদিত চুপ করে সিগারেট খেতে লাগল। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে, সিগারেট জুতোর তলায় পিষতে পিষতে বলল, হলেই বা আর কী করা যাচ্ছে। যতক্ষণ কিছু একটা না ঘটছে, ততক্ষণ কিছুই করার নেই। চল, এবার গাড়ি ছাড়া যাক।

নারায়ণ বলল, পেট্রল পাম্পটা ঘুরে যাই। স্টকে কিছু তেল আর মবিল থাকা ভাল।

উদিত গিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসল। মেয়েটি ওর দিকে ঘেঁষে বসেছিল। উদিত অবিশ্যি, ধরেই নিয়েছিল, রাত্রি করে একলা মেয়েটিকে আর পিছনে পাঠানো চলবে না। মেয়েটি বলল, আমি কিন্তু এখানেই বসতে চাই।

নারায়ণ বলে উঠল, আপনি ইচ্ছা করলে, এ পাশের জানালার ধারে বসতে পারেন।

মেয়েটি বলল, না থাক, এই ঠিক আছি।

নারায়ণ উঠে, দরজা বন্ধ করল। বলল, উদিত গাড়ি ঘুরিয়ে নে।

উদিত গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। নারায়ণ মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপনার নামটা জানতে পারি?

মেয়েটি যেন একটু সময় নিল, তারপরে বলল, আমার নাম সুতপা।

লক্ষণীয়, পদবিটা বলল না। উদিত সিগারেট ধরাল। একটা পেট্রল ট্যাঙ্কের কাছে গাড়ি দাঁড় করাল। আলাদা টিনে পেট্রল আর অন্য পাত্রে মবিল নিয়ে আবার ওদের যাত্রা। উদিতের একটু লজ্জাই করল, মেয়েটির বসার ধরন দেখে। নারায়ণের কাছ থেকে অনেকখানি সরে এসেছে। উদিতের গায়ের সঙ্গে প্রায় গা ছুঁয়ে রয়েছে। লাট্ট গিয়ারে হাত দিতে গেলেই সুতপার গায়ে লাগছে।

উদিত বলল, আপনার অসুবিধে হচ্ছে।

কিছুই না।

উদিত বুঝতে পারছে, মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ও মনে মনে একটু অস্বস্তি বোধ করল। মীনাও ওকে চোখে চোখে রেখেছিল। যত বারই চোখ তুলে তাকিয়েছে, মীনার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে। মীনা একটা খেলা খেলছিল। দুষ্টুমির খেলা। এক-একটা মেয়ে ওরকম থাকে। নজরবন্দি করে, ঠোঁট টিপে হেসে রঙ্গ করা স্বভাব। সুতপার চেয়ে থাকাটা ঠিক সেরকম না। উদিত ঘাড় ফিরিয়ে এক বার নারায়ণকে দেখল। নারায়ণ এদিকেই তাকিয়ে ছিল। তার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি। উদিতকে চোখ নাচিয়ে কিছু ইশারা করল। উদিত তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিল। সামনের দিকে তাকিয়ে, জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন?

সুতপা বলল, আমার একটা কথাই বারে বারে মনে হচ্ছে।

কী?

দৈব। সত্যি বলুন তো, আপনি না থাকলে আজ কী হত?

এখনও সেই কথা ভাবছে সুতপা? তার মানে, নিজের অসহায় অবস্থার কথা এখনও ভুলতে পারছে না। উদিত হাসল, বলল, একটা কিছু ব্যবস্থা হতই।

সুতপা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যবস্থা?

তা কী করে জানব। কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হত।

সুতপা এবার নারায়ণের দিকে তাকাল। নারায়ণ এদিকেই তাকিয়েছিল। সে সুতপাকে বলল, আমি তো আপনাকে আগেই বললাম, উদিত না থাকলে আজ আমাদের মানিকচকে ডুবে মরতে হত।

উদিত বলে উঠল, বাজে কথা বলিস না।

নারায়ণ অতি উৎসাহে বা উত্তেজনায় প্রায় তোতলা হয়ে উঠল, এটাকে তুই বাজে কথা বলছিস?

তা ছাড়া আবার কী? আমরা ছাড়াও মানিকচকের ঘাটে আরও লোক ছিল।

সুতপা বলল, মাত্র কয়েকজন।

নারায়ণ একইভাবে বলে উঠল, আর তারা সবাই স্থানীয় লোক। কোথায় নিরাপদ জায়গা আছে, সবই জানে।

উদিত বলল, তোরাও তাদের সঙ্গেই সেই নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে পারতিস।

নারায়ণ বলল, হ্যাঁ, সে নিরাপদ মানে হয়তো, অন্ধকার রাত্রে কোমর-ডোবা জলে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, আর আমার এই ট্রাক কোথায় ভেসে যেত।

বাঁচতে গেলে মানুষকে অনেক কিছুই করতে হয়।

উদিতের কথা শুনে, নারায়ণের মুখে হঠাৎ কোনও কথা জোগাল না। সে যেন খানিকটা অসহায় বিরক্তিতে, সুতপার দিকে তাকাল। সুতপা একটু হাসল। বলল, কী জানি, আমি তো ভাবতে পারি না।

নারায়ণ গাল ফুলিয়ে বলল, দূর, ওর কথা বাদ দিন।

উদিত তা হলেই নিশ্চিন্ত হয়। সুতপা তাকাল উদিতের দিকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ। শুধু এঞ্জিনের শব্দ।

সুতপা জিজ্ঞেস করল, আপনারা দুজনেই শিলিগুড়িতে থাকেন?

উদিত নারায়ণের দিকে তাকাল। নারায়ণই জবাব দিল, না। উদিত থাকে জলপাইগুড়িতে। আমি থাকি শিলিগুড়িতে।

সুতপার চোখে জিজ্ঞাসা জেগে রইল। সে বোধ হয় শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ির সঙ্গে দুই বন্ধুর যোগাযোগটা ধরতে পারল না।

উদিত বলল, ওদের আসল বাড়ি জলপাইগুড়িতেই। শিলিগুড়িতেও একটা বাড়ি আছে। ও সেখানে থাকে।

নারায়ণ সুতপাকে বোঝাবার জন্য, তাড়াতাড়ি ধরতাই দিল, মানে আমাদের বিজনেস আছে কিনা। কনট্রাক্টারি ফার্ম, সিনহা অ্যান্ড সনস। সেটা শিলিগুড়িতেই।

সুতপা বলে উঠল, সিনহা অ্যান্ড সন্স তো খুব নাম করা ফার্ম।

উদিত মনে মনে অবাক হল। এ মেয়ে তা হলে সিনহা অ্যান্ড সন্সের নামও জানে। নারায়ণের মুখখানি খুশি আর বিস্ময়ে ফুলে উঠল। বলল, আপনি আমাদের ফার্মের কথা জানেন?

সুতপা বলল, নামটা শোনা আছে।

নারায়ণ বলল, মেটেলির ওদিকেও আমরা কিছু কাজকর্ম করেছি। তাতেই বোধ হয় শুনেছেন।

সুতপা বলল, তাই হবে বোধ হয়।

বলে মুখ ফিরিয়ে উদিতের দিকে তাকাল। উদিত চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে, ওদের কথা শুনছে, আর ভাবছে, সুতপা ঠিক কোথাকার মেয়ে। কলকাতার না মেটেলির। এখনও ওর মনে নানান কৌতূহলিত জিজ্ঞাসা। এরকম একটি মেয়ে, একলা কলকাতা থেকে মেটেলির পথে যাত্রা করেছে। একজন জোয়ান পুরুষের পক্ষেও যেটা ভাববার কথা। এখন বলছে, সিনহা অ্যান্ড সন্সের নামও তার শোনা আছে। অথচ মেটেলিতে নাকি তার আত্মীয়ের বাড়ি, দু-একবার সেখানে গিয়েছে। তাতেই একটা ফার্মের নাম তার জানা হয়ে গিয়েছে, এবং এই দুর্যোগে সুদূর মেটেলির আত্মীয় বাড়ি চলেছে। মেলানো যায় না।

উদিতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, এ দুর্যোগে একলা বেরোলেন কী করে?

সুতপা যেন চমকে উঠল, শব্দ করল, অ্যাঁ?

নারায়ণ তাড়াতাড়ি যোগ দিল, হ্যাঁ, আমিও ভাবছিলাম, এই দুর্যোগের মধ্যে আপনি কী করে বেরোলেন?

সুতপা যেন সহসা কোনও জবাব পেল না। বলল, মানে এই সবাই যেমন বেরিয়ে পড়েছে, সেইরকম ভাবেই বেরিয়ে পড়েছি।

নারায়ণই আবার জিজ্ঞেস করল, বাড়ি থেকে আপনাকে এভাবে একলা বেরোতে দিল?

সুতপা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, না, মানে

উদিত বলে উঠল, খুব জরুরি দরকারে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে, না?

সুতপা যেন জবাব খুঁজে পেল, হ্যাঁ, ভীষণ জরুরি দরকারে বেরিয়ে পড়তে হল।

নারায়ণ গোল মুখে হাঁ করে বলল, তা বলে একলা একলা, আপনার মতো একটি মেয়েমানে একজন অল্পবয়সি মহিলা?

উদিতের ঠোঁটের কোণ বেঁকে উঠল। সুতপা বলল, আমি তো একলা একলা বেরোই।

নারায়ণের তথাপি জিজ্ঞাসা, এত দূরের রাস্তায়, এইরকম দুর্যোগে?

নারায়ণ গোল চোখ তুলে, হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সুতপা বলল, আগেও তো এরকম বেরিয়েছি।

নারায়ণ তবু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সুতপা আবার বলল, বাড়ির লোকেরা বুঝতে পারেনি, এদিকে এরকম বন্যা হচ্ছে।

উদিত হেসে উঠল। সুতপা ওর দিকে ফিরে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, হাসলেন যে?

উদিত বলল, হাসি পেয়ে গেল। আপনার কথায় না, নারায়ণকে দেখে।

সুতপা বিব্রত কিন্তু চোখে সন্দেহ। সে উদিতের মুখ থেকে চোখ সরাল না। উদিত সেটা বুঝতে পারছে। ওর ঠোঁটের কোণে হাসিটা লেগে আছে। বেশ বুঝতে পারছে, যে কোনও কারণেই হোক, সুতপা সত্যি কথা বলতে পারছেনা। নারায়ণ সেটা একেবারেই ধরতে পারেনি, উত্তরোত্তর বিস্ময়ে আর কৌতূহলে কেবল, চোখ গোল করে, মুখের হাঁ বাড়িয়ে তুলছে।

উদিত একবার সুতপার দিকে দেখল। বলল, আসলে আপনার যে জরুরি দরকার ছিল। নারাণ সেটা বুঝতে পারছে না।

সুতপা ঘাড় কাত করে, মাথাটা পেছিয়ে নিয়ে এসে, উদিতের দিকে তাকাল। সহসা কিছু বলল না। ঠোঁট টিপে রইল; উদিত মুখ না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন?

সুতপা বলল, আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন?

উদিত ভুরু কুঁচকে বলল, কীসের সন্দেহ বলুন তো।

সুতপা বলল, আমি বাজে কথা বলেছি?

উদিতের হাসিটা প্রবল হয়ে উঠতে চাইল। কিন্তু ও হাসি চাপল। বলল, না না, সেরকম সন্দেহ করব কেন। আমি বলছি, আপনার যে ভীষণ জরুরি দরকার ছিল বেরোবার, সেটা নারাণ বুঝতে পারেনি। তাই না নারাণ?

উদিত নারায়ণের দিকে তাকাল। নারায়ণ যেন সুতপা উদিতের কথাবার্তা ঠিক বুঝতে পারছিল না। ওর গলা দিয়ে একটা জিজ্ঞাসাসূচক শব্দ বেরোল মাত্র, অ্যাঁ?

সুতপা উদিতের দিকে চোখ রেখে বলে উঠল, জরুরি দরকার না থাকলে কেউ এভাবে বেরোয়?

উদিত মুখের হাসি বজায় রেখেই বলল, আমি তো সে কথাই বলছি।

সুতপা ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, না, আপনি সে কথা বলছেন না।

উদিত সামনের দিকে চোখ রেখে, চুপ করে রইল। কোনও কথা বলল না।

সুতপার গলায় কি ঝাঁজ রয়েছে? ধরা পড়ে গেলে বোধ হয়, সকলের অবস্থা এরকমই হয়। ওর ঠোঁটের কোণের হাসিটা মিলিয়ে গেল না। সুতপার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে, সে সব জেনেশুনেই, এ অবস্থায় বেরিয়েছে। তেমন একটা জরুরি দরকার না থাকলে, বা বিপদে না পড়লে, এভাবে একলা একটি মেয়ে বেরোয় না। সুতপার কথা থেকেই এখন সেটা পরিষ্কার।

তথাপি সুতপা নারায়ণের প্রশ্নে বিব্রত বোধ করছিল। জবাব দিতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। নারায়ণকে সে বোঝাবার চেষ্টা করছিল, কিছু না জেনেশুনেই বেরিয়ে পড়েছে। পথের মাঝখানে এসে বিপদে পড়ে গিয়েছে। আসল কথাটা বলতে পারছিল না। সে জন্যই উদিতের হাসি পেয়েছে। অবিশ্যি আসল কথা এখনও কিছুই সুতপা বলেনি। সেটা জানবার দরকারই বা কী।

উদিত আস্তে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে সুতপার দিকে তাকাল। সুতপা ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। রুক্ষু চুলের গোছা কপালে এসে পড়েছে। তার আয়ত চোখের তারায়ও যেন ঝাঁজ ফুটে রয়েছে। উদিত বলল, আমি সে কথাই বলতে চেয়েছি। ভীষণ একটা দরকার না থাকলে, আপনি এরকম একটা ঝুঁকি নিতেন না। নিতেন কি?

সুতপার ঘাড়ে আবার একটা ঝাঁকুনি লাগল, বলল, নিতাম না-ই তো।

আমি তো সে কথাই বলছি।

সুতপার চোখে সেই তীক্ষ্ণ সন্দেহ এবং অনুসন্ধিৎসা। কিছু না বলে কেবল উদিতের দিকে চেয়ে রইল। নারায়ণ যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে, গোল গোল চোখে দুজনকে দেখতে লাগল। বলে উঠল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

উদিতের ঠোঁটের কোণ আর একটু বিস্ফারিত হল। সুতপার চোখের তারা কাঁপল। উদিত আবার সুতপার দিকে ফিরল। বলল, আমাকে ভুল বুঝবেন না।

সুতপার ভুরু কুঁচকে উঠল। বলল, আমার মনে হয় সেটা আপনিই আমাকে বুঝছেন।

উদিত সামনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, একেবারেই না। আমি আপনাকে একটুও ভুল বুঝিনি। আপনি বাজে কথা বলেছেন বলে, আমি একবারও ভাবিনি।

সুতপাকে শান্ত করার জন্যই, উদিতকে একটু মিথ্যা কথা বলতে হল। ও জানে, সুতপা একটা কিছু চাপতে চাইছে বলেই, এভাবে বেরিয়ে পড়ার নানান সাফাই গাইছে। আসলে সুতপার এ অবস্থাটা অসহায় আর করুণ। ও হাসিটা দমন করল, একটু গম্ভীর হয়ে উঠতে চাইল।

সুতপা নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। কোনও কথা বলল না। সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। গাড়ির মধ্যে চুপচাপ, কেবল এঞ্জিনের শব্দ। ড্যাশ বোর্ডের ফিকে আলোয়, তিন জনের মুখই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। স্পিডোমিটারের কাঁটা, নব্বই থেকে একশো কিলোমিটারে ওঠা নামা করছে।

উদিত বুঝতে পারছে, নারায়ণ ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার মুখের ভাবটা দেখবার জন্য উদিত এক বার মুখ ফেরাল। ফিরিয়ে অবাক হয়ে দেখল, নারায়ণের মোটা ঠোঁটের হাসি। চোখাচোখি হতেই, সে চোখের পাতা নাচাল, এবং ইশারায় এক বার সুতপাকে দেখল। উদিত তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিল। বোঝা গেল, নারায়ণ একটা কোনও রসাত্মক সিদ্ধান্তে এসেছে।

সুতপা কি সত্যি সত্যি রেগে গেল নাকি? তার মতো কেতাদুরস্ত মেয়ে এত সহজে নিজের রাগ প্রকাশ করবে? তাও এত অল্প পরিচিত লোকের কাছে? সেটা যেন কেমন একটু বেমানান।

নারায়ণের গলা শোনা গেল, মিস মিস

সুতপা নারায়ণের দিকে ফিরে তাকাল, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ।

আমি মজুমদার।

নারায়ণ বলল, মিস মজুমদার, আপনি কি রাগ করেছেন?

সুতপা যেন সহসা ঘুম থেকে জেগে উঠল। আয়ত চোখ বড় করে বলল, আমি রাগ করব কেন? রাগ করিনি তো।

নারায়ণ বলল, হঠাৎ যে রকম চুপ করে গেলেন।

সুতপা বলল, না, আমার ঘুম পাচ্ছে।

নারায়ণ শব্দ করল, ও!

সুতপা উদিতের দিকে এক বার দেখল। তারপরে নারায়ণের দিকে ফিরে বলল, আপনার বন্ধু রাগ করেছেন কি না দেখুন।

উদিত ঘাড় ফিরিয়ে সুতপার দিকে দেখল। সুতপার মুখে হাসি ফুটেছে। চোখের তারায় ঝিলিক। ও বলল, আমি রাগ করব কেন শুধু শুধু।

সুতপা বলল, করেননি তো?

উদিত পালটা জিজ্ঞেস করল, আপনি সত্যি করেননি তো?

সুতপা বলল, না। একটু মন খারাপ হয়ে গেছল।

উদিত সুতপার চোখাচোখি হল। সুতপা ঠোঁট টিপে হাসল। সে যে নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিয়েছে, উদিত বুঝতে পারল। ও নারায়ণের দিকে দেখল। নারায়ণ চোখের পাতা নাচিয়ে ইশারা করল। তার প্রেমে ভরা মনে একটা জোয়ার লেগেছে বোঝা গেল। সে বলে উঠল, রাগ জিনিসটা সবসময় খারাপ না।

উদিত শঙ্কিত হল। নারায়ণ কোন দিকে যেতে চাইছে। সুতপা জিজ্ঞেস করল, কী রকম।

নারায়ণ একটু টেনে টেনে হাসল। বলল, রাগের সঙ্গে অনুরাগ থাকলে, রাগটা খারাপ নয়।

উদিত এটাই আশঙ্কা করেছিল, নারায়ণ এ ধরনের একটা মোটা রসিকতা কিছু করে বসবে।

তাড়াতাড়ি বলে উঠল, থাক হয়েছে, তোকে আর রাগের তত্ত্ব বলতে হবে না।

সুতপা তার সারা শরীর কাঁপিয়ে, খিলখিল করে হেসে উঠল। ঝুঁকে পড়ায়, মাথাটা প্রায় উদিতের গাল ছুঁয়ে গেল। একটা মিষ্টি গন্ধ চুল থেকে পাওয়া গেল।

নারায়ণ বলল, আমি কি ভুল বলেছি মিস মজুমদার?

সুতপা হাসতে হাসতেই বলল, না, সত্যি বলেছেন। অনুরাগ না থাকলে, রাগ চণ্ডাল হয়ে ওঠে।

সুতপাও নারায়ণের তালে তাল দিচ্ছে। নারায়ণ বলে উঠল, ঠিক বলেছেন।

উদিত মুখ না ফিরিয়ে, গম্ভীরভাবে বলল, তবে কেউ রাগ করেনি, এই যা রক্ষে।

সুতপা ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে, উদিতের দিকে তাকাল। উদিত নির্বিকারভাবে গাড়ি চালাতে লাগল। আবার বলল, আর আমি যখন রাগ করি, তখন কোনও অনুরাগ থাকে না আমার রাগ একেবারে চণ্ডাল।

বলে সুতপার দিকে মুখ ফেরাল। সুতপা বলল, যাক, জানা রইল।

সেই মুহূর্তেই নারায়ণের গলায় গুন গুন সুর শোনা গেল। উদিত অবাক হয়ে এক বার নারায়ণ, এবং সুতপার দিকে তাকাল। সুতপা ঠোঁটের ওপর হাত চাপা দিল। তার সারা মুখে ও চোখে হাসির ছটা। উদিত জিজ্ঞেস করল, কী হল নারাণ।

নারায়ণ বলল, কী আবার হবে।

গান করছিস?

করতে ইচ্ছে করছে।

সুতপা বলে উঠল, একটা গান করুন না নারায়ণবাবু।

নারায়ণ যেন হঠাৎ থতিয়ে গেল, অ্যাঁ?

সুতপা বলল, একটা গান করুন।

নারায়ণ লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, না না, আমি সত্যি গান জানি না। এক এক সময় গান করতে ইচ্ছে করে, করতে পারি না।

উদিত বলল, বাঁচালি।

সুতপা উদিতের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কেন?

উদিত বলল, আমার আবার সকলের গান সহ্য হয় না।

সুতপা নারায়ণের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তার দিকে দেখল। নারায়ণ তার গালফোলা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ওর কথা বাদ দিন। এত দিন ধরে দেখছি তো, খালি গাড়ি চালাতে জানে।

সুতপা উদিতের দিকে দেখল। উদিতও একবার দেখল। নারায়ণ বলে উঠল, তার চেয়ে, আপনি একটা গান করুন মিস মজুমদার।

সুতপা চমকে উঠে বলল, আমি?

হ্যাঁ।

মাপ করবেন, আমার গলা দিয়ে কোনওদিন সুর বেরোয়নি।

উদিত বলল, আপনার গলা শুনে তা মনে হয় না। মানে আপনার গলার স্বর।

সুতপা বলল, গলার স্বর যেমনই হোক, তাতে গান গাওয়া যায় না।

উদিত তাকাল সুতপার দিকে। জিজ্ঞেস করল, সত্যি জানেন না?

সুতপা ঘাড় নেড়ে বলল, পারি না।

নারায়ণ বলল, বেশ জমত।

সুতপা বলল, তার চেয়ে আপনি যা পারেন, তাই করুন নারায়ণবাবু। বেশ তো গুনগুন করছিলেন।

নারায়ণ তার মোটা ঠোঁট টিপে একটু হাসল। তারপরে গলা খাঁকারি দিল।

উদিত ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। নারায়ণ হাত তুলে বলল, না না, ভয় নেই আমি গাইব না।

সুতপা আর একবার খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, বা রে গাইবেন না কেন।

নারায়ণ বাঁ দিকে হেলে পড়ে বলল, সত্যি জানি না।

উদিত বুঝতে পারল, সুতপা এখনও নিঃশব্দে হাসছে।

গাজোলে পৌঁছবার আগেই সুতপার চোখ বুজে এল। উদিতের কাঁধের কাছে তার মাথা নেমে এল। একটা হাত উদিতের কোলের কাছে। স্পিডোমিটারের আলোয় সুতপাকে এখন কেমন করুণ আর অসহায় দেখাচ্ছে। উদিত একবার পাশ ফিরে দেখল। এরকম কোনও মেয়ে কখনও এমন করে ওর পাশে বসেনি। সুতপা সত্যি সুন্দরী। নারায়ণের সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়ে গেল। নারায়ণ হাসল, চোখের ইশারা করল একটু। ফিসফিস করে বলল, তোকে দেখছি সত্যি ভাল লেগে গেছে।

উদিত শব্দ করে বলল, ওঁর ব্যাগটা সামলে রাখ, হেলে পড়েছে।

নারায়ণ তাড়াতাড়ি ব্যাগটা সামলে রাখল। গাড়ি গাজোল থেকে শামসীর দিকে বাঁক নিয়ে দু-তিন মাইল এগোতেই, একটা জোরালো আলো দেখা গেল। উদিত চমকে উঠল। জানালার কাছে, ভিউ ফাইন্ডারের কাঁচের দিকে তাকাল। জোরালো আলোর জন্য স্পষ্ট দেখা না গেলেও, সেই জিপ গাড়িটাই মনে হচ্ছে।

নারায়ণ পিছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিল। আলোটা খুব দ্রুত ওদের পিছনে পিছনে এগিয়ে আসছে। উদিত বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে দেখল, রাস্তায় জলের ইশারা জেগে উঠেছে। কিছু ঘন গাছপালাও দেখা যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করল, সামনে কি জঙ্গল আছে?

আছে, বিল আর জঙ্গল। কিন্তু উদিত পেছনে ওটা কী আসছে?

মনে হচ্ছে, সেই জিপটা।

খবরদার পাশ দিবি না।

মাথা খারাপ, আমার সামনে ওকে যেতে দেব না। কিন্তু কথা হচ্ছে, সামনে রাস্তায় জল উঠে গেছে। মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ, ইংলিশবাজারেই শুনেছিলাম, শামসীর কাছাকাছি জল পাওয়া যেতে পারে। আমসলের বিলটা নাকি ভেসে গেছে। মহানন্দার ওপর পুলটা ঠিক থাকলেই হয়।

পিছনে জোরে জোরে হর্ন বেজে উঠল। পাশ দেবার জন্য, পিছনের গাড়ি থেকে লাইটের সিগন্যাল আসতে লাগল। সুতপা ধড়মড়িয়ে উঠল, ওর তন্দ্রা ভেঙে গেল হর্নের শব্দে। ঘুম ভাঙা চমকে এবং খানিকটা ভয় বিহ্বলতায় এবার ওর ডান হাতটা কোলের ওপরে উঠল। বলল, কী হয়েছে?

উদিতের চোখ ভিউ ফাইন্ডারে। ওর মুখটা শক্ত। নারায়ণও জানালা দিয়ে তাকাল। এখন স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, বিজয় দাশদের জিপটা।

উদিত বলল, আমাদের পিছনে একটা জিপ আসছে।

সুতপা যেন চমকে উঠে বলল, সেই জিপটা নাকি, ইংরেজবাজারে যেটা দেখেছিলাম?

মনে হচ্ছে।

আমাদের পিছু নিয়েছে নাকি? সর্বনাশ!

নিতে পারে, আপনার ভয় পাবার কিছু নেই।

সুতপা উদিতের মুখের দিকে তাকাল। উদিতও এক বার দেখল তাকে। সুতপা যেন হঠাৎ খেয়াল করল ওর হাত উদিতের কোলে। তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে নিয়ে এল।

নারায়ণ বলল, বিজয় দাশ কি সত্যি আমাদের পিছু নিতে চাইছে?

উদিত বলল, লোকগুলোকে আমার ভাল লাগেনি।

কী চায় ওরা, টাকা? স্মাগলিং করে বলেই তো জানি।

স্মাগলারদের ডাকাত হয়ে উঠতে কতক্ষণ। অবিশ্যি, অন্য একটা উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।

কী রকম?

উদিত সুতপার দিকে তাকাল। সুতপা ওর দিকেই তাকিয়েছিল। সুতপার টানা চোখ দুটিতে ভীত জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। নারায়ণও সুতপার দিকে তাকাল।

সুতপা জিজ্ঞেস করল, ওরা কি আমার বিষয়ে কিছু ভেবেছে?

উদিত বলল, ভাবতে পারে। ইংলিশবাজারে ওরা আপনাকে বিশেষভাবে দেখছিল।

সুতপা বলল, সেটা আমিও দেখেছি। আমার মনে হয়, একটা লোকের মুখ আমার চেনা।

কে?

একজন অবাঙালি, মেটেলিতে লোকটাকে দেখেছি মনে হয়। বোধ হয় চালসা ফরেস্টের কনট্রাক্টর।

উদিত সুতপার দিকে আবার দেখল। বলল, মেটেলির অনেকেই আপনার চেনা বুঝি?

সুতপা হঠাৎ আবার সাবধান হয়ে গেল। বলল, না, মানে। এক বার গেছি, তাতেই যা চেনাশোনা।

নারায়ণ বলে উঠল, আপনার মুখটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল। হয়তো মেটেলিতেই কখনও দেখে থাকব।

সুতপা ছোট করে জবাব দিল, তা হতে পারে।

রাস্তায় ক্রমে জল দেখা দিল। দুপাশে, জলে জেগে ওঠা ঘন জঙ্গলের মাথা, রাস্তা অনুমান করে উদিতকে চলতে হচ্ছে। গাড়ির স্পিডও কমাতে হয়েছে। রাস্তার জলে কচুরিপানাও ভেসে এসেছে। পিছনের জিপটা এখন আর হর্ন বাজাচ্ছে না। ওরাও জলের জায়গাটা সাবধানে পার হতে চাইছে। ট্রাকের থেকে, জিপ আরও নিচু, তাই ওদের ভয় বেশি।

নারায়ণ বলল, শামসী পর্যন্ত যেতে পারলে, রেল স্টেশন পাওয়া যাবে। ওখানে একবার ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করে নিতে হবে, কী চায় ওরা।

উদিত বলল, মাথা খারাপ নাকি, ওদের সঙ্গে আমাদের মোকাবিলার কী থাকতে পারে। আমরা জানতে দিতেই বা যাব কেন, আমাদের পিছু নিয়েছে।

কিন্তু যদি রাস্তার মাঝখানে কোনওরকম গোলমাল লাগায়?

দেখা যাবে।

উদিতের মুখ শক্ত আর কঠিন দেখাল। আবার বলল, তা ছাড়া তোর কাছে লোডেড রিভলবার রয়েছে তো।

নিশ্চয়।

সুতপা দুজনকেই দেখছিল, কথা শুনছিল। চোখে ওর ভয়ের ছাপ। জিজ্ঞেস করল, লাইসেন্সড রিভলবার?

নারায়ণ বলল, হ্যাঁ।

সবসময় নিয়ে ঘোরেন।

মাঝে মধ্যে দরকার হয়, টাকা পয়সা থাকে তো।

সুতপা উদিতের দিকে তাকাল। উদিত সেটা লক্ষ করে বলল, ভয় পাবেন না, ওটা ম্যালেরিয়া জ্বরের মতো, একবার চাপলে ভূতের মতো চেপে ধরে।

সুতপা বলল, আমি ভয় পেতে চাই না।

উদিত একটু হাসল, বলল, কিন্তু ভরসাও তেমন পাচ্ছেন না।

সুতপা যেন আরও উদিতের কাছে ঘন হল। ওর নিশ্বাস লাগল উদিতের ঘাড়ের কাছে।

আমসলের বিলাঞ্চলটা পেরিয়ে, রাস্তা আবার শুকনো। উদিত স্পিড বাড়াল। পিছনের জিপও স্পিড বাড়িয়ে আবার হর্ন দিতে লাগল। এবার যেন পিছনের গাড়ি থেকে, চিৎকার হাঁকডাকও শোনা গেল।

নারায়ণ বলল, খিস্তি করছে।

উদিত বলল, করুক।

পিছনে গিয়ে কথা বলে আসব?

দরকার নেই।

গুলি করে ওদের চাকা পাংচার করে দিলেই তো মিটে যায়।

সেটা বেআইনি।

কিন্তু ওরা আগে যেতে চাইছে কেন?

ওদের তাড়া আছে তাই।

নারায়ণ চুপ করল। উদিতের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল। বলল, কী যে বলিস, তোকে আমি বুঝি না।

উদিত বলল, না বোঝবার কী আছে। আমরা কোনওরকমেই ওদের সঙ্গে টক্কর দিতে চাই না, কিন্তু ওদের আমার আগে যেতে দেব না।

শামসীতে গিয়ে ওরা চান্স নেবে।

নিতে দেব না। শামসীতে আমি দাঁড়াব না।

শামসীতে কিছু আলো আর লোকজনের দেখা পাওয়া গেল। রেললাইন এখনও ডোবেনি। স্টেশনে এসে আশেপাশে লোকেরা আশ্রয় নিয়েছে। উদিত শামসীতে গাড়ি এত আস্তে করল, যেন দাঁড়াবে। কিন্তু রাস্তার মাঝখান থেকে, একটুও নড়ল না। এক বার প্রায় দাঁড়িয়েই পড়ল। পিছনে জিপটার ব্রেক কষা এবং কয়েক জনের নেমে পড়ার জুতোর শব্দ শোনা গেল। উদিত হঠাৎ জোরে গাড়ি ছেড়ে দিল।

শামসী থেকে মালতীপুর। মালতীপুরের রাস্তায়, চান্দুয়া আর বলরামপুরের বিলের জল রাস্তা ছুঁয়েছে। কিন্তু ডোবায়নি। উদিতের দৃষ্টি সামনে। স্পিডোমিটারের কাঁটা আশি মাইলে ছুঁয়েছে। এত ভারী ট্রাকটাও থরথর করে কাঁপছে। উদিত বুঝতে পারছে, সুতপার অজান্তেই বোধ হয়, ওর একটা হাত উদিতের কাঁধে এসে উঠেছে। স্পিডের জন্য ভয় পাচ্ছে। নারায়ণ কোনও কথাই বলছে না। মনে হয়, সেও ভয় পেয়েছে।

শামসী থেকে চাঁচল পর্যন্ত, ন মাইল এল যেন চোখের পলকে। চাঁচলে এসে স্পিড কমাতে হল। খরবা থানার চেক গেট এখানে। একটা সরকারি বাংলো আছে।

নারায়ণ বলল, চাঁচলের বাংলোয় রাতটা থেকে গেলে কেমন হয়?

সুতপা বলে উঠল, জিপটাকে যদি এড়ানো যায়, তা হলে বাংলোয় যাওয়া ভাল।

উদিত বলল, না, যতটা পারি আমরা বেরিয়ে যাবারই চেষ্টা করব। কোথাও দাঁড়াতে চাই না।

উদিত, তুই হয়তো টায়ার্ড হয়ে পড়বি।

আগেও আমি সারারাত্রি গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু এঞ্জিনে এবার একটু জল দিতে হবে।

চেক গেটের কাছেই, নারায়ণ রাস্তার পাশের জলা থেকে জল এনে এঞ্জিনে ঢালল। চেক হল নামমাত্র। এক বার গাড়িটার চারপাশ দেখল। ভিতরে আলো ফেলে সুতপাকে এক বার দেখে নিল। নারায়ণ পুলিশকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। নিশ্চয় জিপটার বিষয়। উদিত ঠোঁটে আঙুলের ইশারায় বারণ করল।

চাঁচল থেকে গাড়ি পশ্চিমে বাঁক নিয়ে হরিশ্চন্দ্রপুর থানায় এল। ভিঙল, কোনার পেরিয়ে তুলসীহাট থেকে উত্তরে, কস্তুরিয়া হয়ে, ওয়ারির দিকে এগিয়ে চলল। নারায়ণই রাস্তার কথা বলছিল।

সুতপা আগের থেকে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। ওর চোখের পাতা আবার ভারী হয়ে আসছিল, উদিতের দিকে হেলে পড়ছিল। এ সময়ে, উদিতেরও যেন একটা ঢুলুনিভাব লাগল। ওপাশে নারায়ণ চোখ বুজে, পিছনে হেলান দিয়ে আছে। বোধ হয়, তারও ঘুম আসছে। ঘুম জিনিসটা বড় ছোঁয়াচে। পাশাপাশি দুজন ঘুমোলে, আর একজনের পক্ষে চোখ চেয়ে গাড়ি চালানো কঠিন ব্যাপার। যে চালায় সে ছাড়া এটা অন্য কেউ বোঝে না।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress