তমাল গাছে আত্মা
বাড়ীতে ফিরেই নিশান উদভ্রান্তের মতন চেয়ে থাকে দেয়ালে টাঙানো একটা ফোটোর দিকে। ঐ দিকে তাকালেই বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে।ব্যাপারটা কি? মনের মধ্যে বিষয়টা তোলপাড় করে। রোজ রোজ এমন হলে একদিন যে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই খানিকটা ব্যগ্ৰ হয়ে মাকে শুধোয়, ঐ ঐ ছবিটা আমাকে কেন উথাল-পাথাল করে?
এই রহস্য দিনা কিছুটা আঁচ করে। উত্তর দিল, উনি যে তোর ঠাকুরদা। তাকে দেখে এত অস্থির হওয়া তোকে কি মানায়?
হ্যাঁ-না কিছুই বলল না নিশান। শুধু ফ্যালফ্যাল মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পসন্দপুর গ্ৰামে যে ক’ঘরের বসবাস, তার মধ্যে দীনা-সিতম আর নিশানদের বসতবাটি। বেশ সুনশান, গাছ-গাছালিতে পরিবেশটা শান্ত।নিশানের বাবা কর্মসূত্রে বাঙ্গালোরে থাকে। সে শুনেছে, বাবার এক ভাই ছিল।তার অনুজ। কিন্তু কোনো অজানিত কারণে তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজির মাঝেও রিতমের সন্ধান সুদূরপরাহত।
তবে রিতম অনেকবার বলতো তার অস্বাভাবিক অনুভূতির কথা। সেসব কথা দীনা-সিতমের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতো। এমন আবার হয় নাকি!
ওদের বাড়ী থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা তমাল গাছ ঘিরে ছোটখাটো জঙ্গল ছিল। ওই গাছটার পাশ দিয়ে গেলেই গা-ছমছমে ভাবটা রিতমকে ঘিরে ফেলত। কিন্তু ওই পথটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখান দিয়ে যেতে হবেই। অগত্যা দিনের পর দিন বাজার-হাট, অফিস বা বাস ধরতে গেলেই তমাল গাছের অমোঘ আকর্ষণে রিতম আচ্ছন্ন হয়ে যেত। বুঝতে দেরী হয় না, তোরণ বিশ্বাসের অপমৃত্যুই এমন অবস্থার পেছনে। তার অতৃপ্ত আত্মা ওই গাছের মধ্যেই লুকিয়ে।
রিতম ভীষণ ভীত-সন্ত্রস্থ। তার উদ্বেগের কথা দিনা-সিতম খুব ভালোভাবে অবগত হলেও কেন শান্ত-স্বত্যয়নের ব্যবস্থা করছে না?
তোরণ বিশ্বাসের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? বিশাল সম্পত্তির ভাগীদার রিতম-সিতম। তাই পিতাকে যদি পৃথিবী থেকে সরানো যায়, তালে অচিরেই ঐ বিপুল সম্পত্তির মালিকানা লুটেপুটে নেবে।
নিশান অতীতের এই পাঁচালীর সারবত্তা কিছুটা বোঝে। ঐ তমাল গাছের পাশ দিয়ে গেলে তার সারা শরীর হিম হয়ে যায়। আসলে এক ভয়ংকর খুনের মহাপাপে নাতি বেশ উদ্বেলিত। কিন্তু এর থেকে মুক্তির জন্য সিতম কেন তৎপর হচ্ছে না? দিনাকেও সে বলে, মা, ঐ তমাল গাছটা অশুভ। ওর পাশ দিয়ে গেলে কার যেন ফিসফিসানি, আয়, আয়, কাছে আয়…..…।
অত্যধিক লোভী দুই ভায়ের নৃশংস কর্মকাণ্ডে এক হত্যালীলা আজকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। একদিন গভীর রাতে খবর এলো, এক ক্রোশ দূরে একটি পুকুরে নিষ্প্রাণ দেহ ভেসে উঠেছে।
হৈ হৈ আওয়াজ তুলে গ্ৰামবাসীরা টর্চ, হ্যারিকেন হাতে অকুস্থলের দিকে এগোয়। পুকুরপাড়ে এসে ঐ দেহ দেখে তাদেরও চক্ষু ছানাবড়া! মৃতের বিস্ফারিত চোখ দুটি ঠেলে বার হচ্ছে। মৃত্যু একেবারেই স্বাভাবিক নয়। চার মাইল দূরে পুলিশ ফাঁড়িতে খবর যায়। সিতম-দীনাও ঐ বডি দেখে সনাক্ত করে। কিন্তু পুলিশ না আসা পর্যন্ত কিছু করা যাবে না। সেই ভোর হলে সদলবলে ও.সি সাহেব এলেন।
তৎক্ষণাৎ বললেন, এক্ষুনি মর্গে পাঠানো দরকার।ঐ দম্পতিকে দেহের সাথে যেতে বললেন। সব কাজ মিটে যাওয়ার পর সিতমের মনে হয়, তমাল গাছে খিদে নিয়ে আত্মা বসে আছে। সেই-ই প্রতিশোধ নিল।এটা তার এক নাম্বার বদলা।
এবার তবে কে? প্রায় পাঁচ বছর পরে এখন নিশান লক্ষ্যবস্তু। সিতমও যেহেতু বীভৎস হত্যার এক অংশীদার,তালে কি তার পুত্রকে এখন ঐ পরিচিত আত্মাই নানাভাবে ভয় দেখাচ্ছে। শ্রাদ্ধ-শান্তি কিচ্ছু করে নি! শুধু বারবার ভাবে, জলে চুবিয়ে কিভাবে পিতাকে না ফেরার দেশে পাঠিয়েছিল। এমন গুরুতর অপরাধ কতটা ঘৃণ্য? তাও বেমালুম ভুলতে চাইলেও ঐ তমাল গাছ ভুলতে দেয় না।
এখন সিতমের সব থেকে আদরের ধনকে ভয় দেখিয়ে দ্বিতীয় বদলা নেওয়ার চেষ্টা করছে কি?
এভাবেই প্রায় দু বছর কেটে গেল। নিশান এখন কলেজের ছাত্র। আর সেই কলেজে যেতে হয় তমাল গাছের পাশ দিয়ে।
মা-র কাছে সে বারবার শুনেছে,বাবা, কেন তাঁর শ্রাদ্ধ-শান্তি করছে না?
সিতামকে সেও অভিযোগের সুরে বলছে, বাবা, ঐ গাছের ভূত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে এখুনি কেন পুরোহিত ডেকে কাজ করা হচ্ছে না?
চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই রোজ রোজ যেতে যেতে একদিন নিশান ঐ বৃক্ষের নীচেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ব্যাপারটা খুউব শোচনীয়। সিতমও এবার সচেতন। পুজো-টুজো করা এখন অবশ্যই প্রয়োজন। কেন না নিশানের দিকে হাত বাড়িয়েছে অশুভ আত্মা।