Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তনু অতনু সংবাদ || Samaresh Majumdar » Page 4

তনু অতনু সংবাদ || Samaresh Majumdar

মাছ ধরা

মঙ্গলরা চেয়েছিল ওরা যখন মাছ ধরবে তখন সতীশ রায় যেন উপস্থিত থাকেন। ইতিমধ্যে দুটো ডিঙ্গি নৌকো, টানা জাল, হাতজাল কিনে দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে ধরা মাছ নিয়ে যাওয়ার মজবুত ঝুড়িও।

মাথা নেড়ে বলেছিলেন, না, তোমরা এবার সাবালক হও। আমি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এবার হাতেকলমে কাজটা তোমাদের করতে হবে। আমি ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে লোকে ভাববে আমার ব্যবসা। কাজে নামলে তোমরা নিজেরাই এগিয়ে যেতে পারবে। আরও কী করলে ভালো লাভ হতে পারে তা আবিষ্কার করবে।

বেলা নটা নাগাদ সতীশ রায় খবর পেলেন ছেলেরা বাইশ কেজি মাছ ধরেছে। সবই বড় বড় রুই অথবা কাতলা। স্থানীয় বাজারে যার দাম ষাট টাকা কেজি। কিন্তু, সেগুলো চালানি, অন্ধ্র প্রদেশ থেকে আসে। চারটে সাইকেলের পেছনে ব্যাগে ভরে ওরা কাছাকাছি হাটে গিয়ে বিক্রি করে দিল পঞ্চাশ টাকা কেজিতে। মাছওয়ালা ওই মাছ স্বচ্ছন্দে পঁয়ষট্টি টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পারবে।

বেলা বারোটা নাগাদ মঙ্গলরা এল দেখা করতে। সতীশ রায় তখন স মিলে। কাঠচেরাই-এর একটা করাত তখন শব্দ করছে। মঙ্গল এগারোশ টাকা তার সামনে রাখতেই তিনি রেগে গেলেন, একি! এখানে টাকা রাখছ কেন?

আজকে এই দাম পেয়েছি–।

ভালো কথা। তোমাদের কী বলেছিলাম? অর্ধেক নিজেদের মধ্যে ভাগ, করে বাকিটা ব্যাঙ্কে জমা দাও! ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট তো খুলেছ!

হ্যাঁ।

ঠিক আছে।

আজ্ঞে নৌকা, জালের দাম–।

ছয়মাস পরে কত লাভ হল দেখি, তারপর হিসেব করব। ও হ্যাঁ, শুনলাম, তোমরা নাকি রুইকাতলা ছাড়া মাছ ধরোনি, ছোট মাছ ওঠেনি?

উঠেছিল। প্রথম দিন তাই–।

ছোট মাছেরও খদ্দের আছে এবং তাদের দাম বেশি বলে লাভও বেশি। আর টার্গেট করবে যাতে তিরিশ কেজি বড় আর দশ কেজি ছোট ধরতে পারো। যাও। আমাকে কাজ করতে দাও। ও হ্যাঁ, অবনীদা কবে আসবেন?

আজই।

তাহলে তোমরা তিনটের মধ্যে মাঠে তৈরি থাকবে। শহর থেকে যে লোকটা খেলা শেখাতে আসবে তাকে যেন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে না হয়।

ছেলেরা চলে গেলে ম্যানেজারবাবু বললেন, সদর থেকে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন, বললেন, উনি অবনীবাবুর ভাই।

তাই নাকি। সে কোথায়? ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সতীশ রায়।

স্বাস্থ্যবান এক প্রৌঢ়কে সঙ্গে নিয়ে ম্যানেজার ফিরে এলো। সতীশ রায় বললেন, নমস্কার। বসুন।

আমি নির্মল, আমার দাদা অবনী আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

হ্যাঁ। খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন বলে। অবনীদার কাছে শুনেছি আপনি দীর্ঘদিন চা-বাগানের দায়িত্ব সামলে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন!

হ্যাঁ। এখন বেশির ভাগ চা-বাগানে কাজের পরিবেশ চলে গেছে। আমি আত্মসম্মান বিক্রি করতে রাজি নই বলে বাড়িতে ফিরে এসেছি। নির্মল বললেন।

এই কারণেই মনে হয়েছিল আপনার সঙ্গে কথা বলা যায়। দেখুন, চা বাগান সম্পর্কে আমার ধারণা ভাসা ভাসা। যেতে আসতে দেখি কিন্তু ব্যবসা সম্পর্কে কৌতূহলী হইনি। শুনেছি এখন কেউ কেউ ফ্যাক্টরি ছাড়া শুধু চায়ের বাগান তৈরি করে পাতা বিক্রি করছেন। আমার ম্যানেজারবাবু এ ব্যাপারে আগ্রহী। আপনি বলুন তো ব্যবসা হিসেবে এর সম্ভাবনা কতটুকু?

নির্মলবাবু হাসলেন, আমি কখনই ভাবিনি প্রপার অর্গানাইজেশন ছাড়া চা গাছ তৈরি, পাতা প্লাকিং, ফ্যাক্টরিতে প্রোসেসিং করা সম্ভব। প্রত্যেকটা ডিভিশন এ ওর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন অন্য অনেক শিল্পের মতো চা-ও বিভক্ত হতে চলেছে। হ্যাঁ, আপনি সেরা জাতের পাতা উৎপাদন করে যাদের কারখানা আছে তাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু কোন্ জমিতে চা-গাছ লাগাচ্ছেন সেটা দেখতে হবে। আমি শুনেছি খড়গপুরের মতো গরম জায়গায় নাকি চা-চায় নিয়ে পরীক্ষা চলছে।

কীরকম জমি হলে ভালো হয়?

সামান্য ঢালু যাতে জল দাঁড়াবে না।

তারপর?

প্রথমে মাটি তৈরি করা, গাছ লাগানো, নার্সারি করা। প্রচুর কাজ। কতটা জমিতে চাষ করতে চান সেই বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে সয়েল টেস্ট করা দরকার। মাটির ওপর গাছের প্রাণশক্তি নির্ভর করে। টেস্ট রিপোর্ট পেলে বলা যেতে পারে কী করা উচিত।

সাধারণত গাছ লাগাবার কতদিন পরে পাতা তোলা যায়?

চা গাছ দু-ভাবে করা যায়। বীজ থেকে অথবা বড় গাছের ডাল কেটে। দুটোই মাটিতে পুঁতে একবছর অপেক্ষা করতে হয়। এই অবস্থাটাকে বলে নার্সারি। একবছর পরে নার্সারি থেকে তুলে জমিতে পোঁতা হয়। বীজের গাছ পাতা তোলার জন্যে উপযুক্ত হয় চারবছর বাদে, কিন্তু কলমের গাছের পাতা বছর দুয়েক পরেই তোলা যায়। নির্মলবাবু জানালেন!

তার মানে অন্তত আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হবে? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন। তারপরে রিটার্ন পাব। দেখুন, এ ব্যাপারে আমি আগ্রহী কিন্তু যদি আপনি দায়িত্ব নেন তাহলেই। সতীশ রায় বললেন।

আপনি আমাকে জানেন না। আমার বায়োডাটা দ্যাখেননি। তবু আমার ওপর দায়িত্ব দিচ্ছেন কেন? নির্মলবাবু অবাক হলেন।

দেখুন ল্যাংড়া আমের গাছে আর যাই হোক ফজলি ফলবে না। আপনি অবনীদার ভাই, ইচ্ছে করলেও ততটা খারাপ করতে পারবেন না যতটা করলে আমার ক্ষতি হয়। আপনি একটা প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করুন। শুরুর সময় কী ধরনের কতটা জমি দরকার। আড়াই বছরে কী কী খরচ কোন্ কোন্ বাবদ করতে হবে? চায়ের পাতা বিক্রি শুরু হলে বাৎসরিক খরচের বিনিময়ে কত লাভ হতে পারে–এসব বিশদে তৈরি করে ফেলতে কতদিন সময় লাগবে?

বেশিদিন লাগার কথা নয় কিন্তু তার আগে জমি দেখা দরকার। এক এক জমিতে এক এক ধরনের পাতা হয়। জমি কী অবস্থায় আছে, সেটাকে বাগানে পরিণত করতে কত খরচ হবে তা না দেখলে বোঝা যাবে না। নির্মলবাবু বললেন।

সতীশ রায় একমুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন, চলুন।

ঘণ্টাদেড়েক ধরে গাড়ি নিয়ে চক্কর দিলেন ওঁরা। খাস জমি, ধানচাষের যোগ্য নয়, যেসব জমি অবহেলায় পড়ে আছে সেগুলো দেখে নির্মলবাবু ফিরে গেলেন। কথা দিলেন পনেরো দিনের মধ্যে প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করে দেবেন।

দিন ঠিক হয়ে গেল।

হাতে বেশি সময় নেই। ডুডুয়ার সতীশ রায়ের ছেলের বিয়ে বলে কথা। কাকে ছেড়ে কাকে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। নাগেশ্বর প্রস্তাব দিল, ডুডুয়ার প্রত্যেক বাড়ির একজনকে আসতে বললেও তো কয়েক হাজার হয়ে যাবে। অত লোক বউভাতের দিন কোথায় বসে খাবে? তার চেয়ে ঝাড়াই বাছাই করে পাঁচশো লোককে নেমন্তন্ন করাই ভালো।

সতীশ রায় সেই কর্মটি করতে গিয়ে দেখলেন কোনভাবেই হাজারের নিচে নামাতে পারছেন না। চিঠি ছাপা হল। সদরের বড়কর্তাদের নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করে এলেন। আত্মীয়স্বজনরা চলে এলেন দিন-দুই আগেই। বাড়িতে ভিয়েন বসল। নাগেশ্বর এবং গোরক্ষ চব্বিশঘণ্টাই পড়ে আছে এ বাড়িতে, তদারকি করতে। সদর থেকে নামকরা রান্নার ঠাকুর আনা হল। পরিবেশনের দায়িত্ব নিল তরুণ সংঘের ছেলেরা। ইতিমধ্যে মাছ বিক্রি করে তারা ভালো অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে।

অবনীদার কোচিং-এ ভালো ফল হয়েছে। তরুণ সংঘ গত তিনটি ম্যাচের দুটো জিতেছে, একটি ড্র করেছে। অবনীদা জেলার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে নাম এনট্রি করিয়েছেন। সেখানে খেলার যোগ্যতা অর্জনের খেলায় জিতে গেছে তরুণ সংঘ। কিন্তু মঙ্গলরা বুঝতে পারছিল অবনীদা বেশি জোর দিচ্ছেন দশ থেকে তোর বাচ্চাদের ওপর। ওরা অন্ধের মতো অবনীদার কথা শুনছে এবং বেশ চটপট রপ্ত করছে খেলার কায়দা। অবনীদা বলে গেছেন বড়দের সঙ্গে ছোটদের একটা ম্যাচ তিনি খেলাবেন। যে গোল দেবে তাকে পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার দেবেন তিনি।

বাড়ির পেছনে ডুডুয়ার ধারে বসে সত্যচরণ ভেবে পাচ্ছিল না তার কী করা উচিত। ঘন ঘন বুক নিংড়ে শ্বাস বেরিয়ে আসছে। যদি সে সাঁতার না জানতো তাহলে ডুডুয়ার এই কালো জলের তলায় চুপচাপ শুয়ে পড়ত।

হঠাৎ এলোকেশীর গলা কানে এল, ওমা! তুমি এখানে?

সত্যচরণ কোন কথা বলল না।

এলোকেশী বলল, ওদিকে দর্জি তোমার বিয়ের পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। চল, পরে দেখবে ঠিক হয়েছে কিনা।

আমি কোথাও যাব না। গম্ভীর গলায় বলল সত্যচরণ।

অ্যাঁ? একি কথা! আজ বাদে কাল বিয়ে, জলের ধারে বসে থেকে অসুখ বাধাবে নাকি? ওঠ, চল।

সত্যচরণ এলোকেশীর দিকে তাকাল, এলাদি, তুমি আমাকে বাঁচাও।

বাঁচাব? কেন? কী হয়েছে তোমার?

আমি বিয়ে করতে পারব না।

সেকি? তোমার কি বউ পছন্দ হয়নি?

না। তা নয়। কিন্তু আমার পক্ষে কি বিয়ে করা উচিত? আমি তো আর, মানে, আমার মনের কৌমার্য তো নেই।

অ।

বিশ্বাস করো, পাখি ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।

যাকে নিয়ে ভাবছ সে তো তার স্বামীর সঙ্গে বেশ মজায় আছে।

থাকুক। ওর শরীর নিয়ে আমি চিন্তা করি না। ওর মন তো আমার মন নিয়ে গিয়েছে। শ্বাস ফেলল সত্যচরণ।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, কতদূর এগিয়েছিলে?

মানে?

ওঃ। চুমুটুমু খেয়েছিলে? চোখ ছোট করল এলোকেশী।

এম্মা! নাঃ। রক্ত জমল সত্যচরণের গালে।

ও। হাত ধরেছিলে? মাথা নাড়ল সত্যচরণ, না। দূর থেকে দেখেছি। পাখিও দেখেছিল।

তার মানে কথাবার্তাও হয়নি?

মুখে হয়নি, মনে মনে হয়েছে।

আর কয়েকমাস পরে যখন তোমার পাখি বাপের বাড়িতে আসবে বাচ্চার জন্ম দিতে তখনও এসব কথা বলতে পারবে?

পারব। সারাজীবন পারব।

তাহলে ওই মেয়েটার কী হবে? বেচারা তোমাকে দেখতে এতদূরে এল। সমস্যাটা খুব শক্ত। একটু ভেবে দেখি। এখন চল, পাঞ্জাবিটা পরে দেখবে। নইলে বড়বাবুর কানে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধবে। এলোকেশী সত্যচরণের হাত ধরে টেনে নিয়ে এল বাড়িতে।

সত্যচরণকে দেখে মতির মা দৌড়ে এল, উঃ। কোথায় গিয়েছিলে? এইসময় কেউ বাড়ির বাইরে যায়?

আমার জন্যে কাউকে ভাবতে হবে না। নিচু গলায় বলল সত্যচরণ।

আঃ! চুপ। এখন এসব কথা বলতে নেই। বাড়ি ভর্তি লোক। নাও, পাঞ্জাবি পরে দ্যাখো–। মতির মা অনুনয় করল।

কিছু কিছু আত্মীয়স্বজন এর মধ্যে এসে পড়েছেন। তাদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তরুণ সংঘের ছেলেরা দুবেলা কাজ করছে এখানে। তারা তো বটেই,ডুডুয়ার কিছু লোক দু-বেলা পাত পাড়ছে এ বাড়িতে।

সমস্যা হল সন্ধেবেলায়। নাগেশ্বর গোরক্ষ ভেবে পাচ্ছিল না কী করে তার সমাধান করবে। বাড়িতে গিজগিজ করছে লোক, পরে আরও বাড়বে। এইসময়ে বাইরের ঘরে বসে পানাহার করা অসম্ভব ব্যাপার। গত পরশু যা হওয়ার শেষ বার হয়ে গিয়েছে। এরকম চললে সেই বউভাতের পর বাড়ি খালি না হওয়া পর্যন্ত আহ্নিকবিহীন হয়ে থাকতে হবে। ভাবলেই শরীর ঝিমঝিমিয়ে উঠছিল ওদের? তার পর যদি বউমা এসে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তাহলে তো কথাই নেই।

বিকেল নাগাদ ওদের দুজনকে দেখে সতীশ রায় বললেন, এইমাত্র একটা খারাপ খবর পেলাম হে।

ওরা মুখ চাওয়াচায়ি করল। যে কোনও খবর তাদের ডিঙিয়ে কেউ বড়বাবুর কানে পৌঁছে দিচ্ছে। এ তো ভালো কথা নয়।

পোস্টমাস্টার মেয়ে নিয়ে ফিরে এসেছে। বিষঃ গলায় বললেন সতীশ রায়।

মেয়ে নিয়ে? মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছিল! গোরক্ষ বলল।

হা হয়েছিল। কিন্তু বাসরঘর থেকে জামাই জ্বরে পড়ে। নতুন বউ নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে।

সর্বনাশ। কলকাতায় শুনেছি খুব ডেঙ্গু হচ্ছে এখন। নাগেশ্বর বলল।

তেরাত্তির না কাটতে ওই ডেঙ্গুতেই মারা গিয়েছে ছেলেটা। বউভাত হয়নি। বিধবা মেয়েকে নিয়ে ফিরে এসেছে পোস্টমাস্টার। চল, একবার দেখা করে আসি।

দূরত্ব এমন কিছু নয় তবু সতীশ রায় গাড়িতে উঠলেন। সামনে গোরক্ষ এবং নাগেশ্বর।

পোস্টমাস্টার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সতীশ রায় ওঁর কাঁধে হাত রাখলেন, কোনও কথা বললেন না। নাগেশ্বর বলল, ভগবানের যে কী ইচ্ছে কখন হয়, কেন হয় তা তিনিই জানেন।

গোরক্ষ বলল, কিন্তু মেয়েটা তো কোনও দোষ করেনি, ও কেন শাস্তি পেল?

সতীশ রায় মাথা নাড়লেন, শাস্তির কথা কেন বলছ? ও তো কোনও অন্যায় করেনি। আপনি ভেঙে পড়বেন না মাস্টারমশাই। নিজেকে শান্ত করুন।

পারছি না। সাধ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিলাম। বেচারা একটা দিনও স্বামীর ঘর করতে পারল না। উলটে অপয়া বদনাম নিয়ে ফিরে এল। এখন সারাজীবন পড়ে আছে সামনে, ওর যে কী হবে!

আবার বিয়ে দেবেন। আমি আপনার পাশে আছি। কয়েকটা মন্ত্র পড়লেই কেউ বিবাহিতা হয় না। ওর তো ফুলশয্যাই হয়নি। সতীশ রায় বললেন, বাড়ির সবাইকে আমার কথা বলবেন। আমি মনে করি সে এখনও কুমারী।

কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দিয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলেন সতীশ রায়। এখন ধূপছায়া নেমেছে পৃথিবীতে। নাগেশ্বর আর গোরক্ষ ড্রাইভারের পাশে বসে পোস্টমাস্টারের মেয়ের দুভার্গ্য নিয়ে আলোচনা করছিল।

সতীশ রায় বললেন, ডুডুয়া ব্রিজ ছাড়িয়ে হাইওয়ে ধরে চল।

ড্রাইভার মাথা নাড়ল।

নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছি বড়বাবু?

ভ্রমণে। সতীশ রায় উত্তর দিলেন।

দু-পাশে পাতলা অন্ধকার। নির্দেশ পেয়ে গাড়ি হাইওয়ে থেকে নেমে জঙ্গলের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল। সতীশ রায় বললেন, ডিকি থেকে বাস্কেট বের করে আনো। আলো জ্বালার দরকার নেই।

ড্রাইভার আদেশ মান্য করতে দেখা গেল বাস্কেটের ভেতরে দুধরঙের পানীয়, গ্লাস, জল, কাজু এবং চিনেবাদাম সাজানো রয়েছে: গাড়ির দরজা খোলা থাকায় হালকা আলোয় এসব স্পষ্ট দেখতে পেয়ে নাগেশ্বর চেঁচিয়ে উঠল, একটু পায়ের ধুলো দিন বড়বাবু। ওঃ। হৃদয় একেবারে শীতল করে দিলেন। এ আপনি ছাড়া কেউ পারত না।

গোরক্ষ বলল, একেবারে চমকে দিয়েছেন বড়বাবু। খুব ভালো হল। এখন বাড়ি তো বাজার। তার চেয়ে এই নির্জনে, দ্যাখো নাগেশ্বর, জোনাকি জ্বলছে।

উল্লাস। বলে চুমুক দিলেন গ্লাসে সতীশ রায়, একটা কথা। তোমরা হাইওয়ে থেকে চূড়য়ায় ঢুকেই গাড়ি থেকে নেমে যাবে। আজ রাত্রে আমার বাড়ির লোকজন দু-দুটো মাতাল দেখুক তা আমি চাই না।

আপনি যা চান তাই হবে। নাগেশ্বর মাথা নেড়ে গোরক্ষর দিকে তাকাল, আহ্নিক যদি করতে চাও তাহলে রাত্রে বড়বাবুর বাড়িতে যাওয়া চলবে না।

গোরক্ষ বলল, মাথা খারাপ। নিজের সর্বনাশ করব কেন?

নাগেশ্বর বলল, তা যাই বল, বিয়ের মতো বিয়ে হচ্ছে এই ডুডুয়ায়। গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।

বরযাত্রীরা কটা বাস চেপে যাবে? প্রথম গ্লাস শেষ করে ফেলল গোরক্ষ। আজ পরিবেশ পালটে যাওয়ায় তার গতি বেড়েছে।

কটা বাস মানে? বরকে নিয়ে বাবোজন যাবে, তার জন্যে বাসের দরকার হবে কেন? একটা অ্যাম্বাসাডার আর একটা সুমোতেই চমৎকার ধরে যাবে।

সেকি? মাত্র বানোজন বরযাত্রী? হাঁ হয়ে গেল নাগেশ্বর?

আমরা কি খেতে পাই না যে পঞ্চাশ ষাটজন লোক নিয়ে মেয়ের বাড়িতে খেতে যাব? এগারোজনের টিম একজন দ্বাদশ ব্যক্তি। তোক দেখে বলবে এরা অত্যাচার করতে আসেনি। কে কে যাবে সেটা এখনও ঠিক করিনি। সতীশ রায় বললেন।

হঠাৎ পেছনের জঙ্গলে শব্দ হল। চমকে উঠল গোরক্ষ। গাড়ির দরজা বন্ধ করতেই আলো নিভে গেল। নাগেশ্বর বলল, শব্দ কিসের?

সতীশ রায় চিৎকার করলেন, ড্রাইভার।

গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভার নেমে গিয়েছিল কিন্তু তার তো কাছেপিঠে থাকার কথা। এদিকে আওয়াজটা বেড়েই চলেছে।

বড়বাবু, মনে হয় কোনও বন্যজন্তু! কী হবে? গোরক্ষ বলল।

কেউ গাড়ি চালাতে জানো? সতীশ রায় পেছন থেকে বললেন।

না, না। দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল।

ওয়ার্থলেস। যাও, ড্রাইভারকে খুঁজে বের করে নিয়ে এসো৷ কড়া গলায় বললেন সতীশ রায়। অন্ধকারেই গ্লাস শেষ করল নাগেশ্বর।

সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দুলে উঠল নৌকোর মতো। সতীশ রায় দেখলেন অন্ধকারে নড়ছে। চাপা গলায় বললেন, চুপ! হাতি।

হা-হা। নাগেশ্বরের দাঁত বাজনা বাজাতে লাগল।

একটু একটু করে এগিয়ে এল যে প্রাণীটি গাড়ির পাশে তার আয়তন আদৌ বেশি নয়। চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকারে সতীশ রায় দেখলেন একটা হাতির বাচ্চা শুড় তুলে কিছু শুঁকে গাড়ির জানলায় ধাক্কা মারছে। যত ছোট হোক ইচ্ছে করলে ঠেলে উলটে দিতে পারে বাচ্চাটা। আর ও নিশ্চয়ই একা নেই, দলে মা বাবাও আছে। তারা একটা পা তুলে দিলে দেখতে হবে না।

সতীশ রায় বললেন নিচু স্বরে, দরজা খুলে সোজা দৌড়াও। এখানে বসে থাকলে মারা পড়বে।

–দ-দ-দ। নাগেশ্বর তোতলাল।

যে পড়ে থাকবে সে মরবে। এই আমি দরজা খুলছি।

পরের কিছুটা সময় চিরটাকাল ভুলে থাকবেন সতীশ রায়। হাইওয়ের ওপর উঠে তাঁর বুক থেকে হৃৎপিণ্ড যেন ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অনেকদিন দৌড়াননি, তার ওপর এভাবে দৌড়। বয়সটাও জানান দিচ্ছে। অনেকক্ষণ হাঁপানোর পর শুনতে পেলেন, মিনমিনে গলায়, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ।

ওরা যে মানিকজোড় তাতে কোন সন্দেহ হল না। সতীশ রায় বললেন, চল, হেঁটেই ফিরতে হবে।

পিচের রাস্তায় বসে পড়ল ওরা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই পাশের গাছ থেকে ড্রাইভারের গলা শোনা গেল, বড়বাবু!

অন্ধকারেও যেটুকু দেখা যায়, ড্রাইভারকে নেমে আসতে দেখা গেল, আটটা হাতি, ভয়ে সাড়া দিতে পারিনি।

তা-তাই বলে আমাদের বিপদে ফেলে রেখে তুমি গাছে উঠে বসে থাকবে। বড়বাবু, এর চাকরি খতম করে দিন। নাগেশ্বর বলল।

তুমি হলে কী করতে? বিপদভঞ্জন হয়ে উদ্ধার করতে যেতে? সতীশ রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, গাড়িটাকে বোধহয় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে ওরা।

এখন কোনও আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। গোরক্ষ বলল।

ঠিক কথা। ওরা বোধহয় ওখান থেকে চলে গেছে। নাগেশ্বর বলল।

সতীশ রায়ও কান পেতে কোনও শব্দ শুনতে পেলেন না। হাতিরা কখনও এক জায়গায় বেশিক্ষণ শান্ত হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে না। এই অঞ্চলের জঙ্গলে হাতির দল ধান পাকলে আসে। সেসময় তাদের তাড়াবার জন্যে প্রস্তুত থাকে কৃষকেরা। এমন অসময়ে ওরা কেন এল? ওদিকের জঙ্গলে কী খাবার একদম নেই! সতীশ রায় বললেন; সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দ্যাখো তো গাড়ির কি অবস্থা। মনে হচ্ছে হাতিরা ওখানে নেই। যদি দ্যাখো আছে, তাহলে কাছে যাওয়ার দরকার নেই।

. ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এগোল ড্রাইভার। নাগেশ্বর বলল, ওকে দেখে আবার রেগে না যায় হাতিরা!

একটু একটু করে পাঁচ মিনিট কেটে যাওয়ার পর ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে এল। তারপর হেডলাইট জ্বালিয়ে দ্রুত চলে এল গাড়িটা হাইওয়ের ওপর। ঝটপট গাড়িতে উঠে বসে সতীশ রায় বললেন, আশ্চর্য! গাড়ির ক্ষতি করেনি ওরা?

না। ড্রাইভার আবার গাড়ি চালু করল।.

ডুডুয়া ব্রিজের ওপর যখন চলে এল ওরা, তখন নাগেশ্বর চিৎকার করে উঠল, আরে! বোতলটা কোথায় গেল? দাঁড়াও, গাড়ি থামাও।

দরজা খুলতেই আলো জ্বলল। সিটের ওপর বা নিচে কোথাও ওদের বোতল নেই। গোরক্ষ চেঁচিয়ে উঠল, জানলার কাঁচ নেই। ভেঙে ফেলেছে।

সতীশ রায় সেটা দেখতে পেলেন। তিনি তার পাশে রাখা বাস্কেটটার দিকে তাকাতে দেখলেন সেটা উলটে পড়ে গেছে নিচে। দুটো সিটের মাঝখানে টাইট। হয়ে আটকে আছে সেটা।

শালা। বদমাস হাতি। আমাদের বোতল ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। চেঁচিয়ে উঠল নাগেশ্বর।

গোরক্ষ বলল, বোতলের গন্ধেই এসেছিল। হাতিরা মদ খেতে খুব ভালোবাসে বড়বাবু, আপনারটাও নিয়ে গেছে?

সতীশ রায় বাস্কেটটাকোনমতে তুলতে দেখতে পেলেন তার বোতল নিচে পড়ে আছে। বললেন, চেষ্টা করেছিল, বাস্কেটের জন্যে নিতে পারেনি।

শত্রু শত্রু, সর্বত্র শত্রু। বিড়বিড় করল নাগেশ্বর, কী কাণ্ড! ব্যাটা গ্লাসদুটোও নিয়ে গেছে। ওইটুকুনি পুঁচকে হাতি, বড় হলে কী হবে!

বাড়ির কাছে এসে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন সতীশ রায়। তারপর নিজের বোতলটা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বললেন, কোনও নির্জন জায়গায় গিয়ে ওদের দু-দুবার গ্লাসে ঢেলে দেবে। তার বেশি নয়। তারপর বোতলটা বাস্কেটে রেখে দেবে। আমি যাচ্ছি!

আপনার জিনিস আমাদের দিলেন? নাগেশ্বর গদগদ।

বাড়িতে উৎসব, খাও একদিন। দরজা খুলে নেমে পড়লেন তিনি। কিন্তু গ্লাস? গ্লাস যে নেই?

জোগাড় করে নাও। ঠিক পেয়ে যাবে। হাঁটলেন সতীশ রায়। দুহাতে মাথা ঠুকল নাগেশ্বর, নমস্য মানুষ।

দয়ার শরীর। গোরক্ষ বলল।

চল ভাই ড্রাইভার। নাগেশ্বর বলল।

আমি ভাবছি, বউমা বাড়িতে এলে কী হবে আমাদের! গোরক্ষ বলল।

কালকের কথা কাল ভাবব। এখন চল, একটা নির্জন জায়গা বের করতে হবে যেখানে হাতি আসবে না। নাগেশ্বর সুর ধরল।

খারাপ খবর বাতাসের আগে ছোটে। তাকে মদত দেয় কিছু ঈর্ষাকাতর মানুষ। স্থানীয় মানুষেরা ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয় এখানেই, যে যার মতো করে। পোস্টমাস্টার মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েছিলেন কলকাতায়, সেটা অনেকেই ভালো চোখে দ্যাখেনি। অনেকে ভেবেছিলেন, এটা উঁট দেখানোর জন্যে, বেশিরভাগই হতাশ হয়েছিলেন বিয়ের খাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায়। তাই পোস্টমাস্টারের মেয়ে বিয়ের পরেই বিধবা হয়েছে জানার পর সেটা পাঁচজনকে জানাবার তাগিদ অনুভব করেছিলেন অনেকেই। বাইরে দুঃখ দুঃখ ভাব থাকলেও একটা চোরা সুখও বুদবুদের মতো ছিল।

হরিপদ এসে খবরটা এলোকেশীকে দিল। আত্মীয়স্বজনের জন্যে চাররেলা খাবার তৈরি: থেকে মুক্তি পেয়েছে এলোকেশী ঠাকুর এসে যাওয়ায়। খবরটা শুনে চোখ বড় করে বলল, খবরদার কথাটা, ছোটবাবুকে বোলো না হরিপদদা।

এসময় খারাপ খবর শুনতে নেই।

কিন্তু বন্যার জল বাঁধ ভাঙলে আটকানো অসম্ভব। সত্যচরণের ঘরে ডাক পড়ল এলোকেশীর। এলোকেশী ঘরে ঢুকে দেখল খাটের মাঝখানে ফ্যাকাসে, মুখে

বসে আছে সত্যচরণ।

কী হল?

এলোদি–। গলা ধরে গেল সত্যচরণের।

–বলো।

যা শুনেছি তা ঠিক?

আ মরণ। তোমার কানে কে দিল?

মতির মা। বলল আমি নাকি গুরুবলে বেঁচে গিয়েছি। আমার সঙ্গে বিয়ে হলে নির্ঘাত মরে যেতাম। ওর কপালে বৈধব্য যোগ ছিল তো?

যত্ত বাজে কথা। রেগে গেল এলোকেশী, আমি তো প্রায় আধমরা লোককে বিয়ে করে বিধবা হয়েছি। সুস্থ লোককে বিয়ে করলে কী হতাম? কী জন্যে ডাকছিলে?

তুমি একটু ওদের বাড়িতে যাবে?

ওমা! আমি গিয়ে কী করব?

ওকে বলবে খবরটা শুনে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ওকে নিয়ে আমি প্রায় পঞ্চাশটা কবিতা লিখেছি, সেগুলো দিয়ে দেবে ওকে!

আশ্চর্য! কাঁচা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ো না তো?

কেন? অবাক হল সত্যচরণ।

সে মরছে নিজের জ্বালায়! বিধবা হয়ে বাপের ঘাড়ে পড়ে থাকলে কি হয় তা আমাকে দেখে বুঝতে পারছ না? এলোকেশী ঠোঁট কামড়াল।

কিন্তু–! আমি যে ওর কথা ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না।

তাই? ঠিক আছে। আমি বড়বাবুকে গিয়ে বলছি।

কী বলবে?

বলব, মালবাজারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে ডুডুয়ার পোস্টমাস্টারের মেয়ের সঙ্গে ছোটখোকার বিয়ে দিন। এটা তার ইচ্ছে।

সর্বনাশ। মেরে হাড় ভেঙে দেবে বাবা। জানো, মাঝে মাঝে বাবাকে আমার কংস, রাবণ বলে মনে হয়। সত্যচরণ শ্বাস ফেলল।

তাহলে এক কাজ করো, পাখিকে নিয়ে কোথাও উড়ে যাও। ঠোঁট টিপে হাসল এলোকেশী।

হুঁঃ। তুমি কী মনে করেছ একথা আমি ভাবিনি? ভেবেছি। কিন্তু ও যদি আমার সঙ্গে যেতে না চায়। মানে, আমার মনে যে এত ব্যাপার আছে তা তো ও জানে না। তাছাড়া যদি বা যায় তাহলে ওকে নিয়ে কোথায় যাব? কোথায় থাকব? কী খেতে দেব? ব্যাস, আর সাহস পাই না। সত্যচরণ আবার শ্বাস ফেলল।

সাহস যখন নেই তখন বাপ যা বলছে তাই করো। এলোকেশী আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

বিকেল তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না সত্যচরণ। বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সে। তারপর ঘুরপথে হেঁটে পোস্টঅফিসের সামনে চলে এল।

দুপুরের পর পোস্টঅফিস ফাঁকাই থাকে। ছোট্ট কাউন্টার। তার ভেতরে বসে একটা লোক খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পেছন ফিরে কথা বলছে, আপনি ছাড়বেন না মাস্টারমশাই। বিয়ে যখন একবার হয়ে গিয়েছিল তখন স্বামীর সব সম্পত্তি আপনার মেয়ে পাবেই।

আঃ। চুপ করো। এখনই এসব কথা কেন? ভেতরে বসা একজন কিছু লিখতে লিখতে বললেন।

লোহা গরম থাকতে থাকতে ঘা দিতে হয়। প্রিয়জন মারা গেলে লোকে শোকে অন্ধ হয়ে পড়ে থাকে না তাকে দাহ করতে যায়? এও তেমনি। এখনই একটা ভালো উকিল দেখে কি চাই? লোকটা হঠাৎই সত্যচরণের উপস্থিতি টের পেয়ে জিজ্ঞাসা করল।

না, মনে। বাবা এসেছিলেন? আচমকা জিজ্ঞাসা করে ফেলল সত্যচরণ।

বাবা? কে তোমার বাবা? লোকটি সন্দিগ্ধ।

শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায়।

অ্যাঁ! তু তুমি বড়বাবুর ছেলে। বেশিদিন এখানে কাজ করছি না তো তাই। তোমাকে দেখিনি। কিছু মনে কোরো না। না তো, উনি আজ আসেননি। মানে, এখানে ওঁর পায়ের ধুলো খুব কম পড়ে। লোকটি বলল।

ও।

দাঁড়াও। মাস্টারমশাই, দেখুন কে এসেছে? বড়বাবুর ছেলে। লোকটি হাসল।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলেন পোস্টমাস্টার, ও, তাই নাকি? তোমার শুনলাম বিয়ে?

মুখ নিচু করল সত্যচরণ।

লোকটি বলল, আমি এখনও নেমন্তন্ন পাইনি? আপনি পেয়েছেন মাস্টারমশাই?

আহ। চুপ করো। তা বাবা তোমার বাবা তো এখানে আসেননি।

ও।

উনি কাল সন্ধেবেলায় এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন।

ও। আপনার মেয়েকে বলবেন আমরা ডুডুয়ার সবাই ওর ভালো চাই। গড়গড় করে বলে গেল সত্যচরণ।

শুনে খুব খুশি হলাম।

লোকটি বলল, পাখি যদি ওর মুখ থেকে শোনে তাহলে মনে জোর পাবে।

সে তো বিছানা থেকে উঠতেই চাইছে না। পোস্টমাস্টার বললেন।

বড়বাবুর ছেলে এসেছে শুনলে হয়তো স্বাভাবিক হবে। ওকে নিয়ে গিয়ে একবার দেখুন না। লোকটি উপদেশ দিল।

পোস্টমাস্টারের বাড়ি অফিসের পেছনেই। লাগোয়া। সত্যচরণকে নিয়ে পোস্টামাস্টার বাড়ির ভেতরে এলেন। একটা উঠোনকে ঘিরে গোটা চারেক ঘর। তাদের দেখে পোস্টামাস্টারের স্ত্রী এগিয়ে এলেন।

পোস্টামাস্টার বললেন, ডুডুয়ার বড়বাবুর ছেলে। গতকাল ওর বাবা নিজে এসেছিলেন, আজ ও এসেছে।

ভদ্রমহিলা আঁচলের প্রান্ত দাঁতে কাটলেন।

তোমরা কথা বলো। আমি কাজ শেষ করি। পোস্টমাস্টার চলে গেলেন।

বারান্দায় চেয়ার দেখিয়ে ভদ্রমিহলা বললেন, বসুন।

আমাকে আপনি বলবেন না। আমি অনেক ছোট।

শব্দ করে শ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা, কপাল পুড়িয়ে এল মেয়েটা। এত নরম এত শান্ত মেয়ের কপাল যে এভাবে পুড়বে স্বপ্নেও ভাবিনি।

আমরা–আমরা সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছি। বিড় বিড় করে বলল সত্যচরণ।

এখন ওর কী হবে ভেবে পাচ্ছি না। ভদ্রমহিলা দরজার দিকে তাকালেন।

সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আছি। ও কোথায়? সাহসী হল সত্যচরণ।

বিছানায় পড়ে আছে। আচ্ছা, দেখছি। ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে যেতেই সত্যচরণ দু-হাতে মাথার চুল ঠিক করে নিল। তখন ভেতর থেকে অনুরোধ এবং প্রত্যাখ্যানেরসংলাপ ভেসে আসছে। শেষপর্যন্ত মায়ের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল পাখি। সত্যচরণের মনে হল সে শোকের প্রতিমা দেখছে।

বড়বাবুর ছেলে, নিজে তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ভদ্রমহিলা বললেন।

আপনি বসুন।

তুমি চা খাবে বাবা?

না না।

একটু শরবত করে দিই। ভদ্রমহিলা রান্নাঘরে চলে গেলেন।

সত্যচরণ কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। পাখি দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। যেন সময় স্থির হয়ে আছে বলে মনে হল সত্যচরণের।

কিছু বলবেন? পাখি কথা বলল।

না, মানে, আমাকে কি কখনও দেখেছেন?

না।

কখনও না?

মাথা নেড়ে নীরবে না বলল পাখি।

মুখ নিচু করল সত্যচরণ। তারপর উদাস হয়ে উঠোনের একপাশের আমগাছের দিকে তাকাল সে। একটা ল্যাজঝোলা পাখি হুড়মুড়িয়ে উড়ে গেল গাছের ডাল ছেড়ে।

সত্যচরণ বলল, তাহলে যাই।

শরবত খাবেন না?

কী হবে খেয়ে! আচ্ছা, আপনি আমাকে আগে নাই বা দেখে থাকলেন, এখন তো দেখলেন! এর পরে তো না বলতে পারবেন না?

কপালে ভাঁজ পড়ল পাখির, তা তো পারবই না!

ব্যাস। তাহলেই হল। হাসল সত্যচরণ, আমি যাই। আপনার মাকে বলে (দেবেন।

দ্রুত সে বেরিয়ে গেল পাশের টিনের দরজা দিয়ে। পাখির মুখে না শুনে যে বিশাল পাথরটা বুকের ওপর চেপে বসেছিল শেষ কথায় তা সরে গেছে একেবারেই।

বেশ সকালবেলায় নির্মলবাবু এলেন সদর থেকে এসে হকচকিয়ে গেলেন।

সতীশ রায় তাকে দেখে একটু বিব্রত। ছেলের বিয়েতে তিনি অবনীদাকে নেমন্তন্ন করেছেন কিন্তু ওঁর ভাই নির্মলের কথা খেয়াল করেননি।

নির্মলবাবু বললেন, বুঝতেই পারছি আপনি খুব ব্যস্ত। আপনার ব্যস্ততা কেটে গেলে না হয় চা-বাগানের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

মাথা নাড়লেন সতীশবাবু, ছেলের বিয়ে, ব্যস্ততার কী আছে। আপনি বসুন। অবনীদা বোধহয় কিছু বলেননি বাড়িতে?

না। দাদাকে তো জানেনই। আত্মভোলা মানুষ। যখনই এখান থেকে ফিরে যান অল্পবয়সী ছেলেদের প্রশংসা করেন। উনি প্ল্যান করেছেন চার বছর ধরে ওদের তৈরি করবেন এবং তারপর ওই টিম নিয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলবেন। ওঁর বিশ্বাস পশ্চিমবাংলার সেরা দলগুলোকে জব্দ করতে পারবে এই ছেলেরা। নির্মলবাবু বললেন, দাদা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন।

সাফল্য পেতে গেলে স্বপ্ন দেখতেই হয়। যাক গে, আপনার কী ধারণা হল? আমাদের এই এলাকায় চা গাছের চাষ করা যাবে?

নির্মলবাবু একটু থমকে গিয়ে হেসে ফেললেন, এতদিন আমি চা-বাগান তৈরির কথা শুনেছি, চা-গাছ চাষ করার কথা এই প্রথম শুনলাম। কথাটা ঠিকই। হ্যাঁ। যাবে। তবে সয়েল টেস্ট করাতে হবে।

বাজেট কিছু করেছেন?

আনুমানিক এক কোটি টাকার কাছাকাছি। নির্মলবাবু বললেন, জমি কিনে নিয়ে প্রজেক্ট রিপোর্ট দিলে ব্যাঙ্ক বা সরকার লোন দেবে।

সেটা আমি জানি। আপনি এগিয়ে যান। আমাকে আরও তিন সপ্তাহ সময় দিন। বাড়ির ঝামেলা চুকে গেলে আপনার সঙ্গে বসব। কিন্তু সতীশ রায় নির্মলবাবুর হাত ধরলেন, ত্রুটি মার্জনা করতে হবে।

সেকি? এসব কী বলছেন? হাত ছাড়িয়ে নিলেন নির্মলবাবু।

আমার পুত্রবধূর হাতে ভাত খেতে আপনাকে আসতে হবে। এবং সপরিবারে। দ্রুত পকেট থেকে নিমন্ত্রণ পত্র বের করে নাম লিখে সতীশ রায় নির্মলবাবুর হাতে দিলেন।

আপনার নিমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম। কিন্তু একটা অনুরোধ। বউভাতের দিন আমাকে আসতে বলবেন না। আমি না হয় সামনের রবিবারের দুপুরে এসে ভাত খেয়ে যাব। আচ্ছা চলি। নমস্কার জানিয়ে চলে গেলেন নির্মলবাবু।

কিছুক্ষণ ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন সতীশ রায়। তারপর হাসলেন। ভাই তো দাদার কিছু কিছু পাবেই। এই লোক চাটুকার নয়। এর হাতে এক কোটি টাকার প্রকল্পের দায়িত্ব স্বচ্ছন্দে দেওয়া যায়। যার আত্মসম্মানবোধ প্রবল সে কখনই নিজেকে ছোট করতে পারবে না।

ঘড়ির দিকে তাকালেন সতীশ রায়। নটা বেজে গেছে। চিৎকার করে ডাকলেন, হরিপদ, হরিপদ। নাগেশ্বর ছুটে এল ভেতর থেকে, কিছু বলছেন? সেই ভোর থেকেই ওরা চলে এসেছে এই বাড়িতে।

আঃ। তুমি কেন? গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে তুমি যাবে নাকি? সকাল নটা বেজে গেল তবু কারও হুঁশ নেই। হরিপদ। চিৎকার করলেন তিনি।

হরিপদ ছুটে এল।

সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, গায়ে হলুদের তত্ত্ব রেডি?

না-মানে–। মাথায় হাত দিল হরিপদ।

আশ্চর্য! ওই মেয়েটা হাঁ করে বসে আছে। এখান থেকে তত্ত্ব না গেলে সে স্নান করতে পারবে না আর তোমা ইয়ার্কি মারছ? ক্ষেপে গেলেন সতীশ রায়।

আসলে এখনও, এয়োরা এসে পড়েননি–। হরিপদ বলল।

এয়ো? ও। তাঁদের খবর দিয়েছিলে?

হ্যাঁ। মতির মা বলে এসেছিল।

সংসারের কাজ সামলে তারা আসবেন। কিন্তু এলোকেশী কী করছে?

বসে আছে। মতির মা বলেছিল এই গায়ে হলুদের ব্যাপারটা এয়োরাই করুক। হরিপদ নিচু গলায় জানাল।

কেন? এলোকেশী কী করছে? অ। এখনও সেই বিধবার অজুহাত চালাচ্ছে? উঃ। কী যন্ত্রণা! যাও, গিয়ে বলো, দশ মিনিটের মধ্যে এলোকেশী যেন যা করার তা শেষ করে। আর সে যদি না করতে চায় তাহলে এই বাড়িতে থাকার দরকার নেই। যাও। সতীশ রায়ের কথা শেষ হওয়ামাত্র হরিপদ অদৃশ্য হল।

চুপচাপ শুনছিল নাগেশ্বর, হঠাৎ হুংকার দিল, এতক্ষণে তোমার আসার সময় হল? গায়ে হলুদ দেওয়ার জন্যে আগে আসতে বলেছিলাম না?

সতীশ রায়কে দেখে গেট পেরিয়ে আসা স্থলাঙ্গিনী ঘোমটা টানলেন মাথায়, দিদির দেরি হয়ে গেল আসতে।

গোরক্ষ বেরিয়ে এল, দেরি তো হবেই। গায়ে হলুদে আসতেই এত সাজ, বউভাতের দিন যে কত দেরি হবে কে জানে।

সতীশ রায় দেখলেন স্থূলাঙ্গিনী ঘোমটা টেনে ভেতরে যাচ্ছেন এবং তখনই তার পেছনে ক্ষীণাঙ্গিনীকে দেখা গেল। প্রথম জন নাগেশ্বরের, দ্বিতীয় জন গোরক্ষক্ষার স্ত্রী। ঠিক তখনই শাঁখ বেজে উঠল। সঙ্গে উলুধ্বনি। মহিলারা ভেতরে যাওয়ার আগেই হরিপদ ছুটে এসে জানাল, গায়ে হলুদ হয়ে গিয়েছে।

বাঃ। গাড়িতে তোল তত্ত্বগুলো।

নাগেশ্বর গোরক্ষ তত্ত্ব নিয়ে গাড়িতে যেতে চেয়েছিল মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু তোমাদের এখানে অনেক কাজ আছে বলে তাদের আটকালেন সতীশ রায়। হরিপদ সেজেগুজে গাড়িতে উঠল। তরুণ সংঘের ছেলেরা বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের দুজনকে সঙ্গে যেতে বললে তারা আনন্দিত হয়ে গাড়িতে উঠল।

দুটো গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। সতীশ রায়ের গাড়িতে বর যাবে। ওর সঙ্গে থাকবেমঙ্গল এবং আরও দুজন। বাকি দুটো গাড়িতে বরকর্তা এবং বরযাত্রী। বিয়ের লগ্ন সন্ধে সাড়ে সাতটায়। বিকেল পাঁচটায় বেরুতে হবে। পৌঁছে আশীর্বাদ-পর্ব আছে দু-পক্ষের। নাগেশ্বররা চেয়েছিল আগেই আশীর্বাদ হয়ে যাক। আশীর্বাদ উপলক্ষে খাওয়াদাওয়াটা বেশ জম্পেশ করে হত। কিন্তু সতীশ রায় বলেছিলেন, তাহলে তো ওদেরও আগে করতে হবে। মিছিমিছি ভদ্রলোকের খরচ বাড়িয়ে কী লাভ।

চারটে নাগাদ বরযাত্রীরা তৈরি হয়ে এল। নাগেশ্বর এবং গোরক্ষর সাজ দেখবার মতো। ধুতি পাঞ্জাবিতেই হয়নি। কাঁধে উড়নি নিয়েছে। নিজে তৈরি হয়ে নিয়ে সতীশ রায় হাঁকলেন, হরিপদ, খোকাকে তৈরি হয়ে নিতে বলল। কথার পরেই খেয়াল হল তাঁর, বাঙালির ছেলে বিয়ে করতে যাবে ধুতি পরে, সেটা পরতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করো। নইলে নাগেশ্বর পরিয়ে দেবে ধুতি।

হরিপদ ভেতরে গেল। এখন গ্রামের অনেক বাড়ির মহিলা ভিড় করেছেন অন্দরমহলে। সত্যচরণের ঘরে উঁকি মারল হরিপদ। সে ঘরে নেই। বাইরে এসে। হরিপদ এলোকেশীকে জিজ্ঞাসা করল, খোকা কোথায়?

ঘরে নেই?

না।

ঘণ্টাখানেক আগে বাথরুমে যেতে দেখেছিলাম।

হরিপদ সেখানে গিয়ে দেখল বাথরুমের দরজা খোলা, সেখানে কেউ– নেই। কথাটা মতির মায়ের কানে যেতেই সে ব্যস্ত হয়ে খোঁজ নিতে লাগল। না। বাড়িতে না বাগানে, কোথাও সত্যচরণকে পাওয়া গেল না।

মতির মা দুহাতে মাথা ধরে বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল, বলেছিলাম, বলেছিলাম। এখন কী হবে?

হরিপদ জিজ্ঞাসা করল, কী বলেছিলে?

এখনই বিয়ে না দিতে। কাঁদতে কাঁদতে বলল মতির মা।

চোপ। বড়বাবু শুনলে আস্ত রাখবে না। আমি যাই খুঁজে দেখি। হরিপদ বেরিয়ে গেল খিড়কি-দরজা দিয়ে।

ক্রমশ খবরটা অন্দরমহলে ছড়িয়ে গেল। সত্যচরণকে পাওয়া যাচ্ছে না। এলোকেশীর সন্দেহ হল। পোস্টমাস্টারের বাড়িতে যায়নি তো? সে খিড়কি দরজা দিয়ে দৌড়াল।

পোস্টমাস্টারের বাড়িতে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে এলোকেশী জিজ্ঞাসা করল, খোকা কি এখানে এসেছে?

বারান্দায় দাঁড়ানো পোস্টামাস্টারের বউ অবাক। কে খোকা?

বড়বাবু, মানে সতীশ রায়ের ছেলে। এলোকেশী বলন।

পাখি বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে দাঁড়াল। পোস্টমাস্টারের বউ বলল, কদিন আগে এসেছিল। কেন?

ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।

সেকি?

আজ ওর বিয়ে!

ও মাগো, ছেলেটার বোধহয় মাথা ঠিক নেই। পোস্টামাস্টারের বউ বলল।

মানে?

ও এসে পাখিকে বারংবার জিজ্ঞাসা করেছে ওকে কখনও দেখেছে কিনা। দেখলে ওর কী লাভ হবে কে জানে!

এলোকেশী আর দাঁড়াল না। বাড়ি ফিরে এল খিড়কি দরজা দিয়ে। এসে দেখল হরিপদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে মহিলাদের ভিড়। এইসময় নাগেশ্বর ভেতরে এল, খোকা রেডি? বড়বাবু তাড়া দিচ্ছেন। এখনই বেরুতে হবে আমাদের।

নাগেশ্বরের বউ মিনমিন করে বলল, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

আঁঃ! সেকি? ও হরিপদ? চিৎকার করল নাগেশ্বর।

হরিপদ চুপচাপ মাথা নাড়ল।

নাগেশ্বর তৎক্ষণাৎ দৌড়াল। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সতীশ রায় ঘটকের সঙ্গে হেসে কথা বলছিলেন। নাগেশ্বর তাকে ফিসফিসিয়ে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে বড়বাবু।

সতীশ রায় চোখ ছোট করলেন, কী যা তা বকছ?

হ্যাঁ বড়বাবু। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাথা নাড়ল নাগেশ্বর।

সতীশ রায় দ্রুত অন্দরমহলে ঢুকলেন। বারান্দা এবং উঠোনের জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলেন নাগেশ্বর মিথ্যে কথা বলেনি। তাকে দেখতে পেয়ে মতির মায়ের কান্না বেড়ে গেল।

হরিপদ।

আজ্ঞে।

এসব কী শুনছি? সে কোথায়?

অনেক খুঁজে এসেছি, কোথাও পাইনি।

সতীশ রায় মতির মায়ের দিকে তাকালেন, তুমি নিশ্চয়ই জানো সে কোথায় গেছে?

মাথা নাড়ল মতির মা, আমাকে কিছুই বলেনি।

বিশ্বাস করি না। তুমিই আদর দিয়ে ওকে বাঁদর করেছ। উঃ। এখন কী করি! সাড়ে সাতটায় লগ্ন। মেয়েটার কাছে আমি মুখ দেখাব কী করে? তেমনি দ্রুতপায়ে বসার ঘরে চলে এলেন সতীশ রায়। সেখানে তখন বেশ কয়েকজন চিন্তিত মুখে বসে আছে। ঘটকমশাই বললেন, বড়বাবু, একবার মালবাজারে ফোন করলে ভালো হয়।

ফোন করে কী বলবে? সতীশ রায় মাথা নাড়লেন।

বললে হয়, আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরি হবে। ঘটকমশাই বললেন।

পৌঁছাতে দেরি হবে। যখন পৌঁছাবে তখন কাকে নিয়ে পৌঁছাবে? সতীশ। রায় গজগজ করলেন, যত ইয়ার্কিমারা কথাবার্তা।

গোরক্ষ পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বড়বাবু, একবার পোস্টমাস্টারের বাড়িতে খোঁজ নিলে হয় না? মানে, ওর মেয়ের জন্যে সত্যচরণ দেবদাস হতে চেয়েছিল

ও যদি সেখানে যায় তো সেখানেই থাকুক। এ বাড়িতে সে জীবনে ঢুকতে পারবে না। আমি ভেবে নেবো আমার কোনও ছেলে নেই। সতীশ রায় ঝপ

করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। হরিপদ দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিল। এগিয়ে এসে চুপিচুপি গোরক্ষকে বলল, সেখানে থোকা যায়নি।

তুমি জানলে কী করে? গোরক্ষ সন্দেহের চোখে তাকাল।

এলোকেশী গিয়েছিল খোঁজ করতে।

এলোকেশী সেখানে কেন গিয়েছিল? গোরক্ষর জেরা।

যদি খোকাকে ওখানে পাওয়া যায়। হরিপদ থতমত খেলো।

আমার বাড়িতে, নাগেশ্বরের বাড়িতে না গিয়ে ওখানে সত্যচরণকে পাওয়া যাবে বলে এলোকেশীর মনে হল? গোরক্ষ নাছোড়বান্দা।

আমি তা বলতে পারব না।

গোরক্ষ নিচু হয়ে সতীশ রায়কে বলল, মনে হচ্ছে এটা একটা চক্রান্ত। আর এই চক্রান্তে এলোকেশীও আছে। সে পোস্টমাস্টারের বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়েছিল।

সেখানে দেখা পেয়েছে?

না। বলছে সেখানে যায়নি।

তাহলে তো চকেই গেল। এলোকেশী হরিপদরা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে কেন? কী স্বার্থ ওদের। চক্রান্ত যদি করে থাকে তাহলে ওই বদমাশই করেছে। সে ভেবেছে এই করে পাঁচজনের সামনে আমার মুখ পোড়াবে। তুমি, থানায় চলে যাও। বড়বাবুকে আমার নাম বলে অনুরোধ করে যে করে হোক ওকে খুঁজে বের করতে।

নাগেশ্বর বলল, এখনই থানা পুলিশ করবেন বড়বাবু?

ঘটকমশাই বললেন, আর মাত্র দু-ঘণ্টা সময় আছে।

এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল। দু-বার রিঙ হতে নাগেশ্বর গিয়ে রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো! কে বলছেন? কান পেতে শুনে সে মাথা নাড়ল, না না, এই রওনা হব আমরা। হা হা জানি। বড়বাবু তৈরি হয়ে গেছেন। ঠিক আছে। রিসিভার রেখে নাগেশ্বর বলল, মিথ্যে বললাম।

সতীশ রায় তাকালেন।

নাগেশ্বর বলল, মেয়ের দাদু। বলল এখনই রওনা হতে। আমি মিথ্যে বললাম।

আঃ। ন্যাকামি কোরো না। যেন তুমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। কী করি ঘটকবাবু? মাথায় কিছুই আসছে না। এমনভাবে বেইজ্জত করল ছেলেটা?

এইসময় মঙ্গল ঘরে এল। তাকে দেখে সতীশ রায় বললেন, শুনেছ?

মাথা নাড়ল মঙ্গল, একজন বলল ঘণ্টা আড়াই আগে সত্যচরণকে বাসে উঠতে দেখেছে।

বাসে উঠেছে? কোন বাসে?

শিলিগুড়ির বাসে।

শোনামাত্র সতীশ রায় যেন এলিয়ে পড়লেন।

গোরক্ষ ইশারায় ঘটকমশাই আর নাগেশ্বরকে ডেকে বাইরে চলে এল। ওরা কাছে এলে বলল, সে যখন শিলিগুড়ি চলে গিয়েছে তখন আজ রাত্রে তাকে আর পাওয়া যাবে না। কোথায় খুঁজব শিলিগুড়িতে?

তার মানে মেয়েটা লগ্নভ্রষ্টা হবে। ঘটকমশাই বললেন।

অত্যন্ত অন্যায়। নাগেশ্বর বলল।

এখন একটাই উপায় আছে। মাথা নাড়ল গোরক্ষ।

কী উপায়? ঘটকমশাই যেন ডোবার আগে খড়কুটো দেখতে পেলেন।

একদিন আপনি একটা গল্প বলেছিলেন, মনে আছে? অনেকটা এরকম?

গোরক্ষর কথায় নাগেশ্বরের মনে পড়ল। হ্যাঁ হ্যাঁ। বর পালিয়ে গিয়েছিল। সেই খবর বরের বাবা পাত্রীপক্ষকে দিতে গিয়েছিলেন। তারা জোর করে বরের বাবাকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছিল। মনে পড়েছে।

গোরক্ষ বলল, আমার মাথায় একটা রাস্তা এসেছে। ছেলে যখন বেপাত্তা হয়ে গেছে তখন মেয়েটার সর্বনাশ না করে বড়বাবু যদি বিয়েটা করে ফেলেন তাহলে সব দিক রক্ষা পায় কী বলেন ঘটকমশাই?

ঘটকমশাই-এর চোখ বড় হয়ে গেল, কিন্তু বয়সের পার্থক্যটা।

কী এমন পার্থক্য? তাছাড়া বড়বাবুর শরীর স্বাস্থ্য যে কোনও যুবকের চেয়ে মজবুত। খাওয়াদাওয়া ঘুমোনো সব নিয়ম করে। সন্ধেবেলায় যখন আহ্নিক করতে বসেন তখন দু-গ্লাস খাওয়া হলেই রাতের খাবার খেতে চলে যান। গোরক্ষ বলল।

তাছাড়া মেয়েকে পছন্দ হয়েছে বড়বাবুর। সত্যচরণের পছন্দ হয়নি বলে কেটে পড়েছে। বয়স নিয়ে ভাববেন না ঘটকবাবু। হিরের আংটি বেঁকে গেলেও সেটা হিরেরই থাকে। না, এছাড়া আর কোনও রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না আমিও। বলল নাগেশ্বর, ছেলে বিবাগী হল, মানুষটা থাকবে কী নিয়ে?

ঘটকমশাই বললেন, পাত্রীপক্ষ রাজি হবে কিনা সন্দেহ।

আরে আগে বড়বাবুকে রাজি করান। তারপর তো পাত্রীপক্ষ। গোরক্ষ রেগে গেল, যান। আপনি বড়বাবুকে আড়ালে ডেকে প্রস্তাবটা দিন।

আমি? না না। এ আমি পারব না। একেবারে কঁচা খেয়ে নিতে পারেন। ঘটকমশাই বিভ্রান্ত।

নাগেশ্বর বলল, ঠিক আছে। তিনজনেই যাচ্ছি কিন্তু যা বলার আপনি বলবেন।

ওরা এগোল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress