মুঙ্গেরে উত্তরবাহিনী গঙ্গা
মুঙ্গেরে উত্তরবাহিনী গঙ্গা প্রাচীন কেল্লার কোল দিয়া বহিয়া গিয়াছে। আজ হইতে তিন শত বছর আগেকার কথা; কিন্তু তখনই মুঙ্গেরের কেল্লা পুরাতন বলিয়া পরিগণিত হইত। তাহারও শতাধিক বর্ষ পূর্বে লোদি বংশের এক নরপতি বিহার পুনরধিকার করিতে আসিয়া মুঙ্গেরে পদার্পণ করিয়াছিলেন, তখনও এই কেল্লা দণ্ডায়মান ছিল। কোন্ স্মরণাতীত যুগে কাহার দ্বারা এই দুর্গ নির্মিত হইয়াছিল কেহ জানে না। হিন্দুরা বলিত, জরাসন্ধের দুর্গ।
মুঘল বাদশাহীর আমলে মুঙ্গের শহরের বিশেষ প্রাধান্য ছিল না; ইতিহাসের পাকা সড়ক। হইতে শহরটি দূরে পড়িয়া গিয়াছিল। যে সময়ের কথা, সে সময় একজন মুঘল ফৌজদার কিছু সৈন্য সিপাহী লইয়া এই দুর্গে বাস করিতেন বটে কিন্তু দীর্ঘ শান্তির যুগে দুর্গটিকে যত্নে রাখিবার কোনও সামরিক প্রয়োজন কেহ অনুভব করে নাই; প্রাকারের পাথর খসিয়া পড়িতেছিল, চারিদিকের পরিখা প্রায় ভরাট হইয়া গিয়াছিল।
দুর্গের পূর্ব দক্ষিণ ও উত্তরে তিনটি দ্বার; তিনটি সেতু পরিখার উপর দিয়া বহির্ভুমির সহিত দুর্গের সংযোগ রক্ষা করিয়াছে। পরিখা পরপারের দুর্গকে বেষ্টন করিয়া অর্ধচন্দ্রাকার শহর। শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানের বাস। হিন্দুরা প্রাতঃকালে উঠিয়া গঙ্গাস্নান করিত, তারপর ঘৃত, তিসি ও তেজারতির ব্যবসা করিত; মুসলমানেরা প্রতি শুক্রবারে দুর্গমধ্যস্থ পীর শাণফা নামক পীরের দরগায় শিরনি চড়াইত। তাহাদের জীবনযাত্রায় অধিক বৈচিত্র্য ছিল না।
একদিন ফাল্গুন মাসের মধ্যাহ্নে কেল্লার দক্ষিণ দরজার বাহিরে, পরিখার অগভীর খাত যেখানে গঙ্গার স্রোতের সহিত মিলিয়াছে সেইখানে বসিয়া একটি যুবক মাছ ধরিতেছিল। অনেকগুলি নামগোত্রহীন গাছ হলুদবর্ণ ফুলের ঝালর ঝুলাইয়া স্থানটিকে আলো করিয়া রাখিয়াছে; সম্মুখে বিপুলবিস্তার গঙ্গার বুকে দুই-একটি চর জাগিতে আরম্ভ করিয়াছে। এই সময় প্রায় প্রত্যহ দ্বিপ্রহরে পশ্চিম হইতে বাতাস ওঠে, চরের বালু উড়িয়া আকাশ কুম্ফটিকাচ্ছন্ন হইয়া যায়। গৃহবাসী মানুষ ঝরোখা বন্ধ করিয়া ঘরের অন্ধকারে আশ্রয় লয়, কেবল বহিঃপ্রকৃতির কবোষ্ণ শূন্যতায় বসন্তের বিদায়বাতাবহ পাখি গাছের বিরল পত্রান্তরাল হইতে ক্লান্ত-স্তিমিত কণ্ঠে ডাকিয়া ওঠে—পিউ বহুৎ দূর! আজও পাখি থাকিয়া থাকিয়া ডাকিতেছিল—পিউ বহু দূর।
হলুদবর্ণ ফুলের ভারে অবনম্র একটি নামহীন গাছ গঙ্গার স্রোতের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া যেন দর্পণে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল। চারিদিক নির্জন, আকাশে বালু উড়িতেছে, পিছনে ভীমকান্তি দুর্গের উত্তুঙ্গ প্রাকার বহু ঊর্ধ্বে মাথা তুলিয়াছে—এইরূপ পরিবেশের মধ্যে ঐ পীত-পুষ্পিত গাছের ছায়ায় বসিয়া যুবকটি নিবিষ্টমনে ছিপ দিয়া মাছ ধরিতেছিল।
যুবকের নাম মোবারক। সে কান্তিমান পুরুষ, বলিষ্ঠ চেহারায় একটি উচ্চ আভিজাত্যের ছাপ আছে। তাহার বয়স বড় জোর কুড়ি-একুশ, গায়ের বর্ণ পাকা খরমুজার মতো; ঈষৎ গোঁফের রেখা ও চিবুকের উপর কুঞ্চিত শ্বশুর আভাস তাহার মুখে একটি তীক্ষ্ণ মাধুর্য আনিয়া দিয়াছিল। তাহার উপর চোখে সুমা, পরিধানে ঢিলা পায়জামা ও ঢিলা আস্তিনের ফেন-শুভ্র মমলী কুর্তা। মেয়েদের তো কথাই নাই, পুরুষেরাও মোবারককে একবার দেখিলে ঘাড় ফিরাইয়া আবার তাকাইত।
মোবারক মাছ ধরিতে ভালবাসে, মাছ ধরা তাহার নেশা; তবু আজ যে এই বালুবিকীর্ণ মধ্যাহ্নে সে ঘরের আকর্ষণ উপেক্ষা করিয়া মাছ ধরিতে আসিয়াছে তাহার অন্য কারণও ছিল। পরীবানুর সহিত তাহার বাজি লাগিয়াছিল। পরীবানু মোবারকের বধূ, নববধূও বলা চলে, কারণ বিবাহ যদিও কয়েক বছর আগে হইয়াছে, মিলন হইয়াছে সম্প্রতি। পরীর বয়স সতেরো বছর, রূপে সে মোবারকের যোগ্যা বধূ—অনিন্দ্যসুন্দরী; বাদশাহের হারেমেও এমন সুন্দরী দেখা যায় না। মাত্র ছয় মাস তাহারা একত্র ঘর করিতেছে; নব অনুরাগের মদবিহ্বলতায় দুজনেই ড়ুবিয়া আছে।
পরী তামাসা করিয়া বলিয়াছিল, ভারী তো রোজ রোজ তালাওয়ে মাছ ধরো। দরিয়ায় মাছ ধরতে পারো তবে বুঝি বাহাদুরী।
মোবারক বলিয়াছিল, কেন, দরিয়ায় মাছ ধরা এমন কি শক্ত কাজ?
শক্ত নয়? ধরেছ কোনও দিন?
যখন ইচ্ছে ধরতে পারি।
ধরো না দেখি। পুকুরের পোষা মাছ সবাই ধরতে পারে। গঙ্গার মাছ ধরা অত সোজা নয়।
বেশ, রাখো বাজি।
রাখো বাজি।
মোবারক ওড়না ধরিয়া পরীকে কাছে টানিয়া লইয়াছিল; কানে কানে বাজির শর্ত স্থির হইয়াছিল। শর্ত বড় মধুর। অতঃপর মোবারক ছিপ এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ লইয়া মহোৎসাহে দরিয়ায় মাছ ধরিতে বাহির হইয়াছিল।
মাছ কিন্তু ধরা দেয় নাই, একটি পুঁটিমাছও না। যবের ছাতু, পিঁপড়ার ডিম, পনির প্রভৃতি মুখরোচক টোপ দিয়াও গঙ্গার মাছকে প্রলুব্ধ করা যায় নাই। দীর্ঘকাল ছিপ হাতে বসিয়া থাকিয়া মোবারক বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। সূর্য পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িয়াছে গাছের ছায়া গাছের তলা হইতে সরিয়া যাইতেছে। অন্য দিন হইলে মোবারক বাড়ি ফিরিয়া যাইত, কিন্তু আজ এত শীঘ্র শূন্য হাতে বাড়ি ফিরিলে পরী হাসিবে। সে বড় লজ্জা। মোবারক বঁড়শির টোপ বদলাইয়া বঁড়শি জলে ফেলিল এবং দৃঢ় মনোযোগের সহিত ফানার দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল।
গাছের উপর হইতে একটা পাখি বিরস স্বরে বলিল, পিউ বহুৎ দূর!
মোবারকের অধর কোণে চকিত হাসি ফুটিয়া উঠিল। সে উপর দিকে চোখ তুলিয়া মনে মনে বলিল, সাবাস পাখি! তুই জানলি কি করে?
এই সময় গঙ্গার দিক হইতে দূরাগত তূর্য ও নাকাড়ার আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেই মোবারক চমকিয়া সেই দিকে চাহিল। গঙ্গার কুঞ্চিত জলের উপর সূর্যের আলো ঝলমল করিতেছে। দূরে দক্ষিণদিকে অসংখ্য নৌকার পাল দেখা দিয়াছে, বোধ হয় দুই শত রণতরী। ঐ তরণীপুঞ্জের ভিতর হইতে গভীর রণবাদ্য নিঃস্বনিত হইতেছে।
স্রোতের মুখে অনুকূল পবনে তরণীগুলি রাজহংসে মতো ভাসিয়া আসিতেছে। মোবারক লক্ষ্য করিল, তরণীব্যুহের মাঝখানে চক্ৰবাকের মতো স্বর্ণবর্ণ একটি পাল রহিয়াছে। সেকালে সম্রাট ভিন্ন আর কেহ রক্তবর্ণ শিবির কিম্বা নৌকার পাল ব্যবহার করিবার অধিকারী ছিলেন না; কিন্তু সম্রাট-পদ-লিঙ্গুরা নিজ নিজ গৌরব গরিমা বাড়াইবার জন্য পূর্বাহেই এই রাজকীয় প্রতীক ধারণ করিতেন। মোবারকের বুঝিতে বিলম্ব হইল না, কে আসিতেছে। সে অস্ফুট স্বরে বলিল, ঐ রে সুলতান সুজা ফিরে এল।
কয়েক মাস পূর্বে সাজাহানের মৃত্যুর জনরব শুনিয়া সুলতান সুজা এই মুঙ্গের শহর হইতেই মহা ধুমধামের সহিত পাল উড়াইয়া আগ্রা যাত্রা করিয়াছিলেন। যে ঘাটে নৌবহর সাজাইয়া তিনি যাত্রা করিয়াছিলেন, তাহার নাম দিয়াছিলেন সুজাই ঘাট। [অদ্যাপি এই ঘাট সুজি ঘাট নামে পরিচিত।] এখন খাজুয়ার যুদ্ধে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঔরংজেবের হাতে পরাজিত হইয়া তিনি আবার সুজাই ঘাটে ফিরিয়া আসিতেছেন।
মোবারক অবশ্য যুদ্ধে পরাজয়ের খবর জানিত না। কিন্তু মুঙ্গেরের মতো ক্ষুদ্র শহরে সাম্রাজ্যগৃপ্ন যুবরাজ ও বিপুল সৈন্যবাহিনীর শুভাগমন হইলে সাধারণ নাগরিকের মনে সুখ থাকে না। সৈন্যদল যতই শান্ত সুবোধ হোক, অসামরিক জনমণ্ডলীর নিগ্রহ ঘটিয়া থাকে। গতবারে ঘটিয়াছিল, এবারও নিশ্চয় ঘটিবে। তাই মোবারক মনে মনে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল।
দুর্গমধ্যেও নৌবহরের আগমন লক্ষিত হইয়াছিল। ফৌজদার মহাশয় চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি শান্তিপ্রিয় প্রৌঢ় ব্যক্তি; সাজাহানের নিরুপদ্রব দীর্ঘ রাজত্বকালে নিশ্চিন্তে ফৌজদারী ভোগ করিয়া তিনি কিছু অলস ও অকর্মণ্য হইয়া পড়িয়াছিলেন। রাজদরবারের সমস্ত খবরও তাঁহার কাছে পৌঁছিত না; ভয়ে ভয়ে সিংহাসন লইয়া লড়াই বাধিয়াছে এইটুকুই তিনি জানিতেন। কয়েক মাস পূর্বে সুজা আগ্রার পথে যাত্রা করিলে তিনি বেশ উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিলেন; হয়তো আশা করিয়াছিলেন তক্ত তাউস্ সুজারই কবলে আসিবে। তাই তাঁহাকে আবার ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া তিনি বিব্রত হইয়া পড়িলেন। যা হোক, সুলতান সুজাকে অমান্য করা চলে না, সিংহাসন পান বা না পান তিনি শাহজাদা। উপরন্তু তাঁহার সঙ্গে অনেক সৈন্য সিপাহী রহিয়াছে।
দুর্গের দক্ষিণ দ্বার হইতে সুজাই ঘাট মাত্র দুইশত গজ দূরে। ফৌজদার মহাশয় কয়েকজন ঘোড়সওয়ার লইয়া ঘাটে সুজার অভ্যর্থনা করিতে গেলেন।
দেখিতে দেখিতে নৌবহর আসিয়া পড়িল। মোবারক যেখানে মাছ ধরিতে বসিয়াছিল সেখান হইতে বাঁদিকে ঘাড় ফিরাইলেই সুজাই ঘাট দেখা যায়। ঘাটটি আয়তনে ছোট; সব নৌকা ঘাটে ভিড়িতে পারিল না, ঘাটের দুইপাশে কিনারায় নঙ্গর ফেলিতে লাগিল। চারিদিকে চেঁচামেচি হুড়াহুড়ি, মাঝিমাল্লার গালাগালি; গঙ্গার তীর দুর্গের কোল পর্যন্ত তোলপাড় হইয়া উঠিল। মোবারক দেখিল এখানে মাছ ধরার চেষ্টা বৃথা! সে ছিপ গুটাইয়া বাড়ি ফিরিয়া চলিল। বিরক্তির মধ্যেও তাহার মনে এইটুকু সান্ত্বনা জাগিতে লাগিল, পরীবানুর কাছে কৈফিয়ৎ দিবার মতো একটা ছুতা পাওয়া গিয়াছে।