Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডায়মন্ড ইজ ফর এভার || Sujan Dasgupta

ডায়মন্ড ইজ ফর এভার || Sujan Dasgupta

।।১।।

প্রমথ আর ফ্র্যান্সিস্কা মনে হচ্ছে এবার সিরিয়াস। অনেক দিন ধরেই ওরা প্রেম করছে, কিন্তু প্রমথ সাধারণত নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলে না। আজ সকালে খেতে বসে কেন জানি না, এনগেজমেন্ট রিং-এর প্রসঙ্গ তুলল।

যাঁরা একেনবাবুর কাহিনি আগে পড়েননি, তাঁরা কেউই আমাদের চিনবেন না। তাই চট করে নিজেদের পরিচয় দিয়ে নিই। আমি বাপি, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াই। প্রমথ আমার বাল্যবন্ধু, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে পোস্ট-ডক স্কলার। ইউনিভার্সিটির কাছেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে আমরা থাকি। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় বাসিন্দা হলেন একেনবাবু। ভদ্রলোক একজন গোয়েন্দা, সেইসঙ্গে ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টে ঘোড়াড্ডিম কিছু একটা করেন। নিঃসন্দেহে একটি ক্যারেক্টার!

‘এনগেজমেন্ট রিং’ কথাটা শোনামাত্র, একেনবাবু বললেন, “ডায়মন্ড ইজ ফর এভার স্যার। ম্যাডামকে একটা হিরের আংটি দিন।”

“আপনি তো মশাই বলেই খালাস! ভালো হিরের আংটির দাম কীরকম জানেন?” টিপিক্যাল প্রমথ, সংযত হয়ে কথা বলা ওর ধাতে নেই।

“না স্যার, তবে মিস্টার চুগানির কাছে নিশ্চয় ভালো ডিল পাবেন।”

হেমন্ত চুগানির সঙ্গে আমাদের পরিচয় রাজুর বর হিসেবে। রাজু আমাদের মেইন লাইব্রেরিতে কাজ করে। আসল পদবি বোধহয় চুঘানি, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে চুগানি নামটাই চালু। নিউ ইয়র্কেই হেমন্তর বিশাল গয়নার দোকান। একেনবাবুর ধারণা রাজুর পরিচয়ে নিশ্চয় সস্তায় পাওয়া যাবে!

মুশকিল হল প্রমথ ঠিক কী চায় সেটাই বলছে না। এমনিতে ব্যাটা নিজের হেরিটেজ নিয়ে একেবারেই সেন্টিমেন্টাল নয়। কিন্তু ওর হাবেভাবে এখন মনে হচ্ছে এমন কিছু ফ্রান্সিস্কাকে দিতে চায়, যেটার সঙ্গে আমাদের দেশের ঐতিহ্য জড়িত আছে। নিউ ইয়র্কের জেল্স, টিফানি, বা হেল্জবার্গ থেকে কেনা কিছু নয়।

সেটা আঁচ করেই একেনবাবু বললেন, “মিস্টার হেমন্ত তো আমাদের দেশের লোক স্যার, উনি নিশ্চয় খাঁটি দেশীয় জিনিস জোগাড় করে দিতে পারবেন। আর একইসঙ্গে বাপিবাবু যদি বেভ ম্যাডামের জন্য একটা আংটি কেনেন, তাহলে হয়তো দুটো কেনার জন্য ভালো ডিসকাউন্টও পাবেন।”

ইদানীং আমাদের দু-জনের বিয়ে নিয়ে একেনবাবুর এই ননসেন্স মাথাব্যথা অত্যন্ত বিরক্তিকর! তবে আমাকে কিছু বলতে হল না। প্রমথ ধমকাল, “আপনি মশাই চুরি আর খুন নিয়ে থাকুন, আমাদের বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না।”

“কী যে বলেন স্যার, বিয়ের কেস কত ইন্টারেস্টিং বলুন তো- দু-দুটো হৃদয়ের উষ্ণ মিলন!”

“আপনার মুণ্ডু!

এনগেজমেন্ট রিং-এর কথা এক বার তুলে প্রমথ মুখে কুলুপ এঁটেছে। তাতে কি একেনবাবু দমেন? প্রতিদিনই খাবার টেবিলে একটা-না-একটা জুয়েলারি দোকানের খবর আনেন— কোত্থেকে জোগাড় করেন ভগবান জানেন! একদিন কয়েকটা ক্যাটালগও নিয়ে এলেন। প্রমথ ব্যাজার মুখে বসে রইল, তাকিয়েও দেখল না। তারপর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার বলুন তো, আপনার হাতে কোনো কেস-ফেস নেই?”

এরকমভাবে কাউকে কিছু বলতে হয়? প্রমথটা দিন-কে-দিন আরও চোয়াড়ে হয়ে যাচ্ছে! আমারই খারাপ লাগল। দেখার কোনো দরকার ছিল না, তাও ক্যাটালগগুলোর পাতা উলটোতে শুরু করলাম। দেখতে দেখতেই একেনবাবুকে বললাম, “সত্যি আমাদের এই ট্রাই স্টেটে (নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি আর কানেক্টিকাট) এত যে গয়নার দোকান আছে, আমার কোনো ধারণাই ছিল না! কারা দেয় এসব দোকান?”

“বেশিরভাগ দোকানই স্যার সিন্ধি আর গুজরাতিদের। বাঙালিদের শুধু একটাই দোকান, হোয়াইট প্লেনসে মন্টু ঘোষের।”

শেষের খবরটা আমি জানতাম একেনবাবুর আগের একটা কেসের সূত্রে আমি যখন ক্যাটালগ দেখছি, প্রমথ বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে কলেজে যাবার জন্য রেডি হতে।

একেনবাবু স্বগতোক্তি করলেন, “প্রমথবাবু স্যার, ক্যাটালগগুলো দেখলেনও না।”

বললাম, “শুনুন, একেনবাবু, প্রমথ ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ টাইপের চটজলদি কিছুর মধ্যে নেই। ও ভেবে-চিন্তে কাজ করে, যদিও সেই ভাবনাচিন্তার ব্যাপারটা কাউকে জানাতে চায় না। আমরা বরং নিজেরাই খোঁজখবর করে একটা কি দুটো জায়গার কথা বলি। তারপর ও স্থির করুক কার কাছে যাবে।”

কথাটা একেনবাবুর মনে ধরল, “ঠিক আছে স্যার, সেটাই করা যাক।”

প্রমথকে না জানিয়েই আমরা এগোলাম। ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি বেভকে সঙ্গে নিলাম। মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ ও ভালো বুঝবে। একেনবাবু বেভের কানে কী মন্ত্র দিয়েছিলেন জানি না, ও দেখলাম এ ব্যাপারে দারুণ উৎসাহিত। মনে হয় আরও উৎসাহিত যে এই মিশনটা ফ্র্যান্সিস্কা আর প্রমথর অগোচরে আমরা করছি। বেভের কাছে একটা আইডিয়া পেলাম এদেশে এনগেজমেন্ট আংটির দাম সম্পর্কে। “হাজার পাঁচেক ডলারের মধ্যে মোটামুটি ভালো আংটি পেয়ে যাবে,” বেভ বলল।

দামের বহর শুনে একেনবাবুর তো প্রায় হার্ট অ্যাটাক হবার জোগাড়।

“পাঁ-আ-আ-চ হাজার, ম্যাডাম!”

আমিও বেভকে বললাম, “পাঁচ হাজার তো অনেক টাকা, এর থেকে সস্তায় কিছু পাওয়া যাবে না?”

“এর কমে টিফানিতে ভালো আংটি পাবে না।”

“টিফানিতে আমরা যাব না ম্যাডাম, প্রমথবাবু ইন্ডিয়ান কিছু দিতে চাইছেন।”

“তাহলে কম দামেও পেতে পার, টিফানিতে আড়াইশো-তিনশো পার্সেন্ট মার্ক-আপ থাকে।”

“তাহলে টিফানিতে লোকে যায় কেন?” জিজ্ঞেস করলাম বেভকে।

“টিফানির ডায়মন্ডগুলোর কোয়ালিটি আর এক্সেলেন্ট কাট গ্রেডের জন্য।”

বেভ ঠিক কী বলছে ভালো করে বুঝলাম না। আমার ধারণা ছিল আমাদের দেশেও ভালো ডায়মন্ড পাওয়া যায়, আর সুরাটে তো এখন খুব ভালো ডায়মন্ড কাটিং হয়। সুতরাং দেশি দোকানে ভালো আংটি না পাবার তো কোনো কারণ নেই। তবে আমাকে কিছু বলতে হল না। বেভই বলল, “তাহলে চলো না, একবার রাজুর বরের দোকানে যাই।”

রাজুর বর, হেমন্তর ‘এইচসি জুয়েলার্স’ ফর্টি ফোর্থ স্ট্রিটে একটা বড়ো বিল্ডিং-এর কুড়ি তলায়। বেভ রাজুকে বলে রেখেছিল আমরা বিকেলে যাব, কিন্তু কারণটা বলেনি। রাজু ভেবেই নিয়েছিল আমি বেভের জন্য এনগেজমেন্ট রিং কিনতে যাচ্ছি। আমরা যেতেই হেমন্ত হইহই করে অভ্যর্থনা করল। এর আগেও হেমন্তর দোকানে এক বার গিয়েছিলাম একেনবাবুর জন্য নীলা কিনতে। তখন যা-দেখেছি তার থেকে দোকানটা মনে হল অনেক বড়ো হয়েছে! ডিসপ্লেগুলোও অন্যরকমভাবে রাখা। আমি কি অন্য কোনো দোকানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছি! আমার এই অবাক হওয়াটা হেমন্তর চোখ এড়াল না। নিজের থেকেই বলল, “দোকানটা অনেক পালটানো হয়েছে। এক বছর আগে এই ফ্লোরে চারটে দোকান ছিল। আমার পাশের দোকানটা উঠে যাওয়ায়, তার জায়গাটা নিয়েছি। পুরোটা নয়, বাড়িওয়ালার সঙ্গে স্পেশাল একটা ডিল করে অর্ধেকটা আরেকটা কোম্পানিকে সাবলিজ করতে পেরেছি।’

এমন সময় হেমন্তর একটা জরুরি ফোন আসায় ‘এক্সকিউজ মি’ বলে যখন কথা বলছে, পাশের দোকানটা বাইরে থেকে আমরা দেখলাম। একটা ছোটো দেশি গয়নার দোকান। কোম্পানিটা হেমন্তরই এক বন্ধুর। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, সত্যি, গুজরাতি, সিন্ধি, মাড়োয়ারিরা ব্যাবসায় একে অন্যকে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য খুব সাহায্য করে। ম্যানহাটানের এই অঞ্চলে এরকম জায়গা পাওয়া সহজ নয়। পেয়েছে হেমন্তর বন্ধু বলেই। বাঙালিদের মতো কাঁকড়া-মানসিকতা ওদের নেই- আমরা কেউ কাউকে ওপরে উঠতে দিই না। প্রমথ অবশ্য এটা একেবারেই মানে না। এ নিয়ে কথা উঠলেই বলে, ‘তোর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, তুই ঘরের শত্রু বিভীষণ! নিজে বাঙালি, কিন্তু বাঙালিদেরই সবচেয়ে বেশি গালমন্দ করিস! মনে রাখিস, ওরা যা কিছু করে নিজের স্বার্থের জন্যেই করে। সব ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর ব্যাপার। আমি তোকে এখন দিচ্ছি, তুই পরে আমাকে দিবি। এটাই হচ্ছে অলিখিত চুক্তি।’

আমি বলি, ‘হতে পারে, কিন্তু বাঙালিরা তো তাও করে না।”

অবশ্যই আমাদের তর্কাতর্কি এতে শেষ হয় না। এমনিতে প্রমথ বিশ্বনিন্দুক, সব্বার দোষ খোঁজে। কিন্তু বাঙালিদের সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বললেই একটা অদ্ভুত পজিশন নেয়। তখন ও বুক ফুলিয়ে ‘আমি বাঙালি!’ তর্কাতর্কি যখন তুঙ্গে ওঠে, একেনবাবুই থামান। বলেন, ‘থাকুক না স্যার ওসব কথা, আপনারা তো আর ব্যাবসা করতে যাচ্ছেন না, আপনারা হচ্ছেন জ্ঞানের সাধক।’

প্রমথ ওঁর এই মিষ্টি কথায় ভোলে না। ‘ছাড়ুন তো! আপনি তো মশাই দিব্যি ব্যাবসা ফেঁদেছেন, ডিটেকটিভ এজেন্সি খোলেননি?’

‘কী যে বলেন স্যার, ওটা আবার ব্যাবসা হল নাকি!’

‘ঠিক,’ আমি একেনবাবুকে মদত দিই, ‘ওটা হল, প্রফেশনাল সার্ভিস!’

‘তোর মুণ্ডু! ক্লায়েন্ট ধরতে হলে রেফারেন্সগুলো চাই না? সেগুলো তো বাঙালিরাই দেবে। ইন রিটার্ন যারা রেফারেন্স দিচ্ছে, তাদের কেসগুলো একেনবাবু সস্তায় করে দেবেন। এটাও তো ‘গিভ অ্যান্ড টেক’! ‘

আমি রাগ করে বলি, ‘আবার ননসেন্স বকছিস!’

আচ্ছা, একেনবাবু কি অন্তর্যামী! এসব যখন ভাবছি, আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, “আচ্ছা স্যার, আপনি তো প্রমথবাবুকে বলেন, ননসেন্স-বকা বিশ্বনিন্দুক। তাও গাড়ি করে আমাদের এখানে নিয়ে এলেন কেন?”

“কেন আর, ছেলেবেলার বন্ধু হবার প্রায়শ্চিত্ত।”

“না স্যার, এটাও প্রমথবাবুর ওই ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ থিওরির জন্য। আপনি যখন বেভ ম্যাডামের জন্য রিং খুঁজবেন, তখন প্রমথবাবু সাহায্য করবেন।”

“আপনাকে মশাই একদিন আমি খুন করব। আর সেই খুনিকে আপনি ধরতে পারবেন না। কেন জানেন?”

“না স্যার।”

“কারণ আপনি তখন ডেড, বুঝলেন?”

ভাগ্যিস বেভ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের কোনো কথা কানে যায়নি!

“কী নিয়ে আলোচনা করছ তোমরা?” বেভ এসে জিজ্ঞেস করল।

“কিছু না।”

হেমন্তর কথা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।

“সরি, দাঁড় করিয়ে রাখলাম। কলটা খুব দরকারি ছিল,” বলে খুব সমাদর করে ওর অফিসে নিয়ে বসাল।

হেমন্তকে জানালাম কী ধরনের হিরের আংটির খোঁজ করছি। জেল্স, টিফানি, বা হেল্ডবার্গ থেকে কিছু কিনতে চাচ্ছি না, কারণ আমরা হাজার দু-আড়াইয়ের মধ্যে একটু ভারতীয়ত্ব মেশানো আংটি চাচ্ছি।

আমার কথা শুনে হিরের যে-আংটিগুলো হেমন্ত আমাদের দেখাল, তার কোনোটাতেই আমি ‘ইন্ডিয়াননেস’ খুঁজে পেলাম না। হেমন্ত পাক্কা ব্যবসায়ী, কিছু বলতেও হল না- আমার চোখ-মুখ দেখেই ব্যাপারটা আঁচ করল। “আপনি ইন্ডিয়াননেস পাচ্ছেন না, তাই তো? আসলে এই হিরেগুলো সবই এসেছে বাইরে থেকে। বৎসোয়ানা, রাশিয়া, সাউথ আফ্রিকা, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা থেকেই এখন হিরে বেশি আসে। তবে এগুলো সবই কাট করা হয়েছে সুরাটে। আমি গোলকোন্ডার হিরে এনে দিতে পারি, তবে খরচা বেশি পড়বে।”

“না না, হিরের জন্য নয়, আংটির স্টাইলগুলোই বরং আমার খুব একটা ইন্ডিয়ান মনে হচ্ছে না। তুমি কী বলো বেভ?”

বেভেরও আংটিগুলো খুব পছন্দ হয়েছে বলে মনে হল না।

“একেনবাবু, আপনার কী মত?”

“আমি আর কী বুঝি স্যার, বেভ ম্যাডামের পছন্দটাই আসল।’

“আমি একটা সাজেশন দিই,” বলেই হেমন্ত ধাঁ করে শোকেস থেকে ছোটো ছোটো হিরে বসানো সিলভার গোল্ডের দুটো চুড়ি নিয়ে এল। “এটা দেশের কারিগরদের তৈরি, ট্রাডিশনাল ইন্ডিয়ান ডিজাইন আর কনটেম্পোরারি ডিজাইনের

ব্লেন্ড।” বলে বেভকে বলল, “পরে দেখুন, খুব মানাবে আপনাকে!”

তার থেকে একটা বেছে হাতে পরতে পরতে বেভ হেমন্তকে বলল, “এটা কিন্তু আমার জন্য নয়।” তারপর হাতের চুড়িটা একটু ঘুরিয়ে মন্তব্য করল, “এটা বেশ ভালো হবে, এনগেজমেন্ট ব্যাঙ্গল, বেশ নতুনত্বও হবে।”

“কত দাম পড়বে এটার?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“এগুলো দামি হিরে নয়, হাজার দুই ডলারের মধ্যেই হয়ে যাবে।”

“যদি ভালো হিরে হয় স্যার?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

“টাইপ টু-এ হিরে হলে অন্তত হাজার চারেক তো হবেই।”

টাইপ টু-এ হিরের কথা আগে কোথাও শুনেছিলাম শুনেছিলাম, কিন্তু মনে করতে পারলাম না। সেই নিয়ে প্রশ্ন না করে জিজ্ঞেস করলাম, “তার জন্য কি আবার ইন্ডিয়াতে পাঠাতে হবে চুড়িটা?”

“না, না, হিরেটা জোগাড় করে দোকানেই সেট করে দিতে পারব। ডায়মন্ড সেট করার বন্দোবস্ত আমার এখানেই আছে।”

একেনবাবু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন দেখে হেমন্ত হেসে ফেলল, “শোরুমে বা অফিসে সেটা করি না, ঠিক পাশেই রিপেয়ার আর সেটিং-এর জন্য আলাদা একটা ঘর আছে।”

অফিস ঘরের দেয়ালটা কাচের। অফিসের ভার্টিক্যাল ব্লাইন্ড-এর ফাঁক দিয়ে রিপেয়ার শপটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল, খেয়াল করিনি এতক্ষণ। একটা ওয়ার্ক বেঞ্চে ক্ল্যাম্প লাগানো বাতি-দেওয়া ম্যাগনিফাইং গ্লাস, টেবিলে গোটা দুই জুয়েলার্স লুপ, প্লায়ার্স, কাটার, জুয়েলারের করাত, ব্রেজিং করার টর্চ, ইত্যাদি রাখা। সব ক-টা যন্ত্রপাতি আমি চিনিও না। আমার থেকে একেনবাবুর উৎসাহ বেশি, উনি দেখলাম উঠে দাঁড়িয়ে রিপেয়ার শপটা ভালো করে দেখছেন। চুড়িটা বেভের মনে হয় খুবই ভালো লেগেছে, তখনও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে শোকেস থেকে আরও দুয়েকটা চুড়ি এনে বেভকে দেখাল হেমন্ত। কিন্তু নিঃসন্দেহে প্রথম চুড়িটাই টপ। বেভের হাতে পরা চুড়িটার একটা ছবি তুলে নিলাম, প্রমথকে দেখাব বলে।

বেভ হেমন্তকে মজা করেই বলল, “আমাকে কিন্তু মডেলিং ফি দিতে হবে, এই যে বাপি ছবি তুলল।

“দেব,” হেমন্ত বলল, “যেদিন সুখবর পাব।”

হেমন্ত মনে হয় বেভের কথা বিশ্বাস করেনি, এখনও ধরে বসে আছে, বেভের জন্যেই এগুলো দেখছি। পরের প্রশ্ন থেকেই বুঝলাম সেটা, “বাজেট কত?”

আমি মাথা চুলকোচ্ছি। “হাজার তিন-চার,” বেভ উত্তর দিল।

“তাহলে কোনো সমস্যাই নেই। আমার স্টকেই লুজ হিরে আছে।”

আমরা যখন বিদায় নিচ্ছি, একেনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার শ্বশুরমশাই কেমন আছেন?”

আমি একটু অবাকই হয়ে গেলাম প্রশ্নটাতে।

হেমন্ত বলল, “ভালো। আপনার কনট্যাক্টে একটা ভালো কনসেন্ট্রেটর পেয়ে গেছেন পুনেতেই। আপনাদের দু-জনকেই ‘থ্যাংক ইউ’ ফর অল দ্য হেল্প!”

রহস্যটা ফেরার পথে পরিষ্কার হল। মাস চারেক আগে মেয়ের কাছে বেড়াতে এসে রাজুর বাবার শ্বাসকষ্টের খুব সমস্যা হয়েছিল। এমনিতেই ওঁর সিওপিডি ছিল, নিউ ইয়র্কের পোলেন অ্যালার্জি যোগ হয়ে ফলাফলটা হয়েছিল মারাত্মক। একটা পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকায় বাঁচোয়া। কিন্তু সেটাকে প্রায়ই চার্জ করাতে হত— খুবই অসুবিধাজনক। বেভের বাড়িতে একটা অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর পড়েছিল, বেভের বাবা যখন বেঁচে ছিলেন ব্যবহার করতেন। রাজুকে সেটাই বেভ দিয়েছিল যদি কাজে লাগে।

“জিনিসটা কী?” বেভকে জিজ্ঞেস করলাম।

“অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য স্পেশাল মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট। বাইরের বাতাস টেনে নিয়ে সেখান থেকে ফিল্টার দিয়ে নাইট্রোজেন সরিয়ে দিয়ে শুধু অক্সিজেনটা ডেলিভারি দেয়। অর্থাৎ অক্সিজেন সিলিন্ডারের কাজই করে, চালাতে শুধু ইলেকট্রিসিটি লাগে।”

“নাইট্রোজেন কী করে ফিল্টার করা যায়?”

“জিওলাইট দিয়ে।”

জিওলাইট নামটা প্রথম শুনলাম। একইসঙ্গে বেভের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হলাম, কিন্তু প্রশংসা করতে সাহস হল না। করতে গেলেই বলত, ‘তুমি কি ভেবেছিলে আমি ডাম্ব ব্লন্ড?’

“ইন্টারেস্টিং। কিন্তু পুনেতে আবার কিনতে হল কেন! তোমারটা নিয়ে যাওয়া যেত না?”

“আমি তো বলেছিলাম রাজুকে নিয়ে যেতে। রাজু বলল হেমন্ত বলেছে ওটা চলবে না, তোমাদের দেশের ইলেকট্রিসিটির ভোল্টেজ নাকি অন্য। এই নিয়ে আমি আর রাজু যখন কথা বলছিলাম, তখন ডিয়ার ডিটেকটিভ লাইব্রেরিতে এসেছিল। বলল, পুনেতে ওর কানেকশন আছে, ওখানে কেনার বন্দোবস্ত করে দেবে।”

আমি আমার বিদ্যে জাহির করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, “তার দরকার মনে হয় ছিল না, একটা স্টেপ ডাউন ট্রান্সফর্মার কিনলেই এখানকারটা ব্যবহার করা যেত।”

“বেভ ম্যাডামের সঙ্গে আপনি না থাকলে আমরা কী করে জানব স্যার! যাইহোক, অধিকন্তু ন দোষায়। এখানে একটা আছে, ওখানেও একটা। এখানে যখন আসবেন, এটা ব্যবহার করবেন।”

“হ্যাঁ, ওটা আমি রাজুকে রেখে দিতে বলেছি।” বেভ বলল।

“রেখে দিয়েছেন, ম্যাডাম। রিপেয়ার শপেই দেখলাম ওটা।”

।।২।।

আজকাল আমেরিকায় অনেক মেয়ে কানে ফুটো করে। কোথায় জানি পড়েছিলাম প্রায় আশি শতাংশ। মানে দশ জন মেয়ের মধ্যে আট জন! আগে খেয়াল করতাম না। এই লেখাটা পড়ার পর এখন খেয়াল করি। সত্যি, অনেকের কানেই ফুটো আছে দেখি, বিশেষ করে আমাদের এই নিউ ইয়র্ক সাইডে। বেভই তো কানে দুল পরে। তবে ওর দুলগুলো সাধারণত খুবই ছোটো— রুপো বা প্ল্যাটিনামের মধ্যে সেট করা একটা মুক্তো বা রুবি। আজ দেখলাম পরেছে ফিলিগ্রি করা গোল্ড বাস্কেট দুল। দারুণ মানিয়েছে ওকে।

জিজ্ঞেস করলাম, “এরকম দুল তো আগে তোমায় পরতে দেখিনি।”

“তুমি খেয়াল রাখো আমি কী পরি?”

“কেন রাখব না!”

খুশি হল উত্তরটা শুনে। “রাজুর সঙ্গে কালকে হেমন্তের দোকানে গিয়েছিলাম, সে-ই সাজেস্ট করল। এরকম আরও কয়েকটা কিনেছি।”

“হেমন্ত তো একজন ভালো খদ্দের পেয়েছে দেখছি।”

“ওর প্রোডাক্ট ভালো, আর টিফানির তুলনায় অনেক শস্তা।” তারপর এক ঝলক হেসে বলল, “তুমিও কিনতে পারো কয়েকটা, ভালো মানাবে তোমাকে। তার আগে অবশ্য কান ফুটো করতে হবে।”

“নো, থ্যাংক ইউ। ভালো কথা, রাজুর খবর কী? কেমন আছে?”

“ঠিকই আছে, তবে বাবার জন্য একটু চিন্তিত।”

“কেন?”

“ইন্ডিয়ার অক্সিজেন মেশিন ভালো কাজ করছে না, ফলে পোর্টেবল সিলিন্ডারের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। এখান থেকে ওরা একটা পাঠাবার কথা ভাবছে।” এটা বলার পরই চলে গেল একটা সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে। “আচ্ছা বলো তো, আমি কি চুড়ি পরব এখন থেকে?’

“কেন নয়, খুব সুন্দর মানিয়েছিল তোমাকে।”

“রাজু সবসময় পরে।” বলেই একটা ফোন আসায় সেটা ধরতে গেল বেভ। একটু বাদেই ফিরে এসে বলল, “জানো, আমি নেটে এদেশের বেশ কয়েকটা জুয়েলারি সাইটে গিয়েছিলাম। সবাই হিরের চুড়ি বিক্রি করছে দশ-পনেরো হাজার ডলারে, হেমন্ত যেগুলো তিন-চার হাজার ডলারে দেবে বলেছিল!”

“নিশ্চয় হিরের কোয়ালিটির জন্য দামের এত তফাত।”

“হতে পারে। তবে আমার চোখে ওগুলোর থেকে অনেক ভালো অ্যামাজন-এর ইন্ডিয়ান মেড গোল্ড-প্লেটেড মিনার কাজের চুড়িগুলো। গেস কত দাম?”

“দু-শো?” কম করেই বললাম।

“আন্ডার টোয়েন্টি ডলার।” বিজয়িনীর হাসি বেভের ঠোঁটে।

“মাই কাইন্ড অফ প্রাইস। তবে তোমার কাছে দশ-পনেরো হাজার তো সমস্যা হবার কথা নয়।”

আমার এই কথায় সত্যিই কোনো খোঁচা ছিল না। উত্তরাধিকার সূত্রে দাদুর সম্পত্তির মায়ের অংশ শেষমেশ নিতে রাজি হওয়ায় আমার চেনাজানার মধ্যে বেভ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ধনী। দু-এক মিলিয়নের কথা নয়, মাল্টি-মিলিয়নের কথা হচ্ছে। কিন্তু বেভের মুখ মেঘাচ্ছন্ন হল। বিষয়টা স্পর্শকাতর। সম্পত্তির এই ভাগ বহু বছর ও নিতে চায়নি, নিতান্ত মামার চাপে পড়ে… থাক সে পুরোনো গল্প।

কথা ফেরত নেওয়া যায় না, কিন্তু তার আঘাত কমানো যায়। তাড়াতাড়ি বললাম, “টিফানি, ব্লু নাইল, এমনকী হেমন্তর হিরের চুড়িও তোমাকে আমি উপহার দিতে পারব না, কিন্তু অ্যামাজনের মিনার কাজ করা গোল্ড-প্লেটেড চুড়ি দিতে পারব। নেবে?”

ওর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “নিশ্চয় নেব। দাও, আমি পরব।”

রাত্রে ডিনার খেতে খেতে প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কী রে, একেনবাবুর কোন কীর্তির কথা এখন লিখছিস?”

আজকাল প্রমথ মাঝে মাঝেই জানতে চায় কী লিখছি। যতটা লিখেছি আমাকে দিয়ে পড়ায়। আমার ধারণা, ওর সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু লিখেছি কিনা দেখে।

“আরে না একেনবাবুর কোনো কীর্তি নয়, বলতে পারিস তোকে নিয়ে লিখছি।”

“আমাকে নিয়ে মানে? শোন, আমাকে নিয়ে কোনো লেখা বাইরে যাবে না আমার অনুমতি ছাড়া। আগে দেখা কী লিখলি।”

আমি গল্পের ফাইলটা খুলে ল্যাপটপটা এগিয়ে দিতেই ভুরু কুঁচকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বলল, “এসব কী লিখেছিস! আমি ফ্রান্সিস্কার জন্য এনগেজমেন্ট রিং খুঁজছি কে বলল তোকে? একটা জেনারেল কোয়েশ্চেন থেকে তুই মহাভারত বানিয়ে ফেললি!”

“খুঁজছিস না?”

“যদি খুঁজেও থাকি, সে-নিয়ে এত লেখার কী আছে? আর কোনো টপিক খুঁজে পাচ্ছিস না! তা ছাড়া এই গল্পে বেভকে নিয়ে এত কথা কেন, অ্যাঁ? পড়ে তো ^মনে হচ্ছে এনগেজমেন্ট রিং বা চুড়ি তো তোরই কেনা দরকার!”

“একটু বেশিই লিখে ফেলেছি বোধহয়,” আমি স্বীকার করলাম।

“একটু বেশি? শোন, তুই একেনবাবুর রহস্য কাহিনি লেখা ছেড়ে দে। এটা কোনো গল্প হয়েছে? এখনও পর্যন্ত যা পড়লাম, তাতে না আছে সাসপেন্স, না আছে প্রেম!”

“আঃ, এটা তো সবে শুরু!”

“মর্নিং শোজ দ্য ডে। শুরুতেই যে গাড্ডায় নেমে পড়েছিস সেখান থেকে উঠতে পারবি না।”

এরকম একটা মারাত্মক ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষা করে কেন আমি এই গল্পটা লিখে যাচ্ছি, তার কারণ এর পরের ঘটনাগুলো। একটা চুরির তদন্তে আমরা অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে পড়লাম যে ঘটনার সঙ্গে হেমন্তও জড়িত।

বিশদ করে বলি। সকালে অফিসে বসে আছি, রাজুকে নিয়ে ঘরে ঢুকল বেভ। খুবই উত্তেজিত!

“কী ব্যাপার?”

“রাজুর হিরের আংটি চুরি হয়ে গেছে! একেনবাবুকে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু পাচ্ছে না।”

কারণটা আমার জানা ছিল। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসে একেনবাবুর আজ অল-ডে মিটিং। ফোন-টোন সব বন্ধ থাকবে বলে গেছেন।

“বিকেলের আগে তো ওঁকে ধরা যাবে না। কিন্তু ব্যাপারটা কি আমাকে বলতে পারো?”

রাজু যা বলল তার কিছুটা বুঝলাম, পুরোটা নয়। তাই এখন যা লিখছি, তাতে ভুলভাল কিছু থাকতে পারে। তার ওপর রাজু যখন ব্যাপারটা বলছে তখন প্রমথ ঘরে ঢুকেছে। সব বিষয়েই প্রমথ ওর জ্ঞান দেখাতে চায়! ব্যাটা জানে অনেক কিছু, কিন্তু গুল-তাপ্পিও মারে। যাইহোক, রাজুর কথাগুলো আগে লিখি— এই আংটিটা রাজুকে দিয়েছিলেন হেমন্তর মা, মানে রাজুর শাশুড়ি। তিনি আবার ওটা পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে। আংটির হিরেটা নাকি অর্ডিনারি নয়, গোলকোন্ডার হিরে! তার এমন কী স্পেশালিটি ভগবান জানেন! আমার মনে হল আংটির আসল মূল্য অন্যখানে। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া জিনিসে অনেক আবেগ- অনুভূতি জড়িয়ে থাকে, যার দাম বাজার মূল্য দিয়ে হয় না। তাও রাজুর মুখে বার দুয়েক গোলকোন্ডা গোলকোন্ডা শুনে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “তোমার শাশুড়ির শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া— সেটার জন্যেই তো ওটা অমূল্য! গোলকোন্ডার না কিম্বার্লির সেটা তো গৌণ, তাই না?”

মুখ দিয়ে কথাটা বেরোতে-না-বেরোতেই প্রমথ বলল, “স্টুপিডের মতো কথা বলিস না! গোলকোন্ডার ডায়মন্ড হচ্ছে সুপার-স্পেশাল টাইপ টু-এ ডায়মন্ড। পৃথিবীর মাত্র এক পার্সেন্ট হিরে হল টাইপ টু-এ।” বলেই গুচ্ছের জ্ঞান দিল, “কোহিনুর, হোপ ইত্যাদি ডায়মন্ডগুলো সব এই গোত্রের। এদের ক্রিস্টাল ল্যাটিসে নাকি নাইট্রোজেন খুব কম থাকে বা থাকেই না, ফলে শর্ট ওয়েভ লেংথের আলো আটকা থাকে না…”

“এইসব আগড়ম-বাগড়ম কথার মানে?”

“মানে হল, আলো এর ওপর পড়লে নষ্ট না হয়ে পুরোটাই বিচ্ছুরিত হয়। বুঝলি?” এই জ্ঞানটি আমাকে বিতরণ করার পর রাজুকে জিজ্ঞেস করল, “আমার একটাই প্রশ্ন, গোলকোন্ডার ডায়মন্ড হলে এটা বহু বছরের পুরোনো হিরে- তিন- চারশো বছর অন্তত। তোমাদের ফ্যামিলিতে কীভাবে এল?”

বেচারা রাজু। কাঁচুমাচু মুখে বলল, “আমি শুনেছি গোলকোন্ডার হিরে। অতশত সত্যিই জানি না, হয়তো ভুল বলছি।”

এতক্ষণে প্রমথর মাথায় ঢুকল যে ও মূল বিষয় থেকে শুধু সরে যায়নি, প্রকারান্তরে রাজুর পরিবারের সম্মান নিয়েও টানাটানি করছে! তখন সামাল দেবার চেষ্টা করল, “আরে না। তুমি ভুল কিছু বলছ না। বহু টাইপ টু-এ হিরে তিন-চারশো বছর আগে গোলকোন্ডার খনি থেকে পাওয়া গিয়েছিল বলে টাইপ টু-এ হিরেকে অনেক সময় গোলকোন্ডা হিরে বলা হয়। টাইপ টু-এ হিরে অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়, এমনকী আর্টিফিশিয়ালিও তৈরি করা যায় ছোটো সাইজের হলে। যাক সে কথা। আংটিটা হারাল কী করে?”

উত্তরটা রাজু এলোমেলোভাবে দিল। সেখান থেকে যা উদ্ধার করলাম সেটাই বলি। হেমন্তর এক শাঁসালো খদ্দের গোলকোন্ডা হিরের খোঁজ করছিল। যে সাইজের হিরে খুঁজছিল, হেমন্তর স্টকে সেই সাইজের কোনো হিরে তখন ছিল না। আরেক দিন আসতে বলে রাজুকে বলেছিল যদি ওর আংটি লোকটাকে দেখানোর জন্য হেমন্তকে দেয়। পছন্দ হলে হেমন্ত সুরাট থেকে ওই কোয়ালিটির একটা হিরে জোগাড় করে আনবে। সেটা শুনে রাজু ওর আংটি খুলে হেমন্তকে দেয়।

খরিদ্দার রাজুর আংটিতে বসানো হিরে দেখে দারুণ খুশি। ওটাই ওর চাই। হেমন্ত যতই বোঝায় ওটা শুধু স্যাম্পল হিসেবে দেখাচ্ছে, লোকটা তাও ছাড়ে না। তার বক্তব্য, ‘তুমি এটাই আমাকে দাও, এর জন্য আমি কুড়ি হাজার ডলার দিতে রাজি। ‘ “কুড়ি হাজার!” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “আমি তো ওটা তোমাকে পরতে দেখেছি, খুব বড়ো হিরে তো নয়!”

প্রমথ জ্ঞান দিল, “হিরের দাম নির্ভর করে ক্যারাট, কালার, ক্ল্যারিটি আর কাট-এর ওপর। তবে কিনা শেষমেশ ব্যাপারটা ফ্যান্সি প্রাইস – শুধু সাইজ হিসেবে তো দাম হয় না।”

আগেও এ ধরনের কথা আমি শুনেছিলাম, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। যাইহোক, পরে এ নিয়ে রাজুর সঙ্গে হেমন্তের কিছু আলোচনা হয়। রাজু হেমন্তকে বলেছিল, ‘অত ডলার দিতে চাইল লোকটা, আংটি থেকে হিরেটা খুলে ওকে বিক্রি করে দিলেই পারতে! পরে নাহয় একটা আর্টিফিশিয়াল হিরে আমার আংটিতে সেট করে দিতে! অর্ধেক খরচায় সেটা হয়ে যেত। ‘

হেমন্ত আপত্তি করে, ‘খেপেছ! মা ভালোবেসে তোমাকে নিজের আংটি দিয়েছেন। সেই আংটির হিরে আমি খুলে নেব!’

মোটকথা হেমন্ত খদ্দেরকে বুঝিয়েছিল, দিন কুড়ি সময় দিতে, প্রায় ওইরকম একটা হিরে ও জোগাড় করে আনবে।

“প্রায় ওইরকমই’ কেন? একইরকম হিরে পাওয়া কি সম্ভব নয়?” আমি প্রশ্ন করলাম। “এই যে তোমার কানে হিরের দুটো দুল? দুটো তো একই দেখতে!”

“এগুলো হিরের নয়, কিউবিক জারকোনিয়ার। দাম শ-দেড়েক ডলার, ভালো কোয়ালিটির ডায়মন্ড হলে হাজার কুড়ি পড়ত।”

“ওরেব্বাস! দেখতে কিন্তু একেবারে হিরের মতো!”

“থ্যাংক ইউ, তবে এ দুটোও ঠিক একরকম নয়, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখলেই তফাত চোখে পড়বে। আসলে হেমন্ত জানত এই খরিদ্দার টাকা দেবার আগে কোনো এক জহুরিকে আনবে মালটা যাচাই করার জন্য, শুধু জিআইএ সার্টিফিকেট দেখালে চলবে না, তাই তাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করেনি। যাইহোক, এরপর ওই খরিদ্দার হেমন্তকে যা বলল, তাতে হেমন্তের আক্কেল গুড়ুম! বলল, হেমন্ত যদি ওরকম এক ডজন হিরে এনে দিতে পারে, তাহলে ওইরকম দামেই সবগুলো হিরে ও কিনবে। আসলে হলিউডের এক সেলিব্রেটির বিয়ে হচ্ছে। তাকে ইমপ্রেস করার জন্য লোকটা কিনছে-এগুলো দিয়ে নেকলেস, ব্রেসলেট বা ওরকম কিছু হেমন্তকে দিয়েই বানাবে।”

রাজুর এই দীর্ঘ বয়ানেও আমি চুরির ব্যাপারটা জানতে পারলাম না। এক- আধটা প্রশ্ন করে এটুকু জানলাম জিআইএ সার্টিফিকেট হল জেমোলজি ইনস্টিটিউট অফ আমেরিকার দেওয়া সার্টিফিকেট; আর বুঝলাম, হিরে-ফিরে যাচাইয়ের ব্যাপারে রাজুর যা জ্ঞান, তার সিকিভাগও আমার নেই।

“চুরিটা কখন হল?”

“চুরিটা ধরা পড়েছে গতকাল রাত্রে। আমার আংটিটা প্রায় এক মাস ধরে হেমন্তর দোকানেই ছিল। কয়েক দিন আগে বারোটা হিরের ডেলিভারি আসে সুরাট থেকে। আমার আংটি আর সেই লুজ হিরেগুলো সব একইসঙ্গে অদৃশ্য হয়েছে।”

“রাত্রে ধরা পড়েছে মানে?”

“দিনের বেলা আমাদের শোরুম বন্ধ ছিল। হেমন্ত ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্টে একটা জায়গা পেয়েছে, সেটাকে ঠিকঠাক করছিল। কাস্টমাররা হিরে কেনার জন্য ওখানেই বেশি আসে। এদেশে ডায়মন্ড মার্কেটে ভালো করে দাঁড়াতে হলে ওই জায়গায় একটা ঠেকের দরকার।”

ম্যানহাটানের ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্টে কয়েক বার গেছি— ফিফথ অ্যাভিনিউ আর অ্যাভিনিউ অফ অ্যামেরিকাস-এর মধ্যে বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে খালি দোকান আর দোকান- হিরে আর হিরের গয়নার ছড়াছড়ি। খুচরো পাইকারি দু-ভাবেই বেচা-কেনা চলে।

“তা বুঝলাম। কিন্তু তোমাদের মেইন দোকানে তখন কোনো সিকিউরিটি ছিল না?”

“ছিল, যেরকম থাকে। দু-জন গার্ড তো ছিলই, তা ছাড়া দোকানের দু-জন কর্মচারী রিপেয়ার আর সেটিং-এর কাজ করছিল।

“তারা ট্রাস্টওয়ার্দি লোক?”

“খুবই। হেমন্তর গ্রামের ছেলে, দু-জনেই বেশ কয়েক বছর কোম্পানিতে পার্ট-টাইম কাজ করছে। গার্ডরাও একটা বন্ডেড সিকিউরিটি এজেন্সির— ওরাও বরাবরই পাহারার দায়িত্বে আছে।”

এই ব্যাপারগুলো আমি পুরোটা বুঝি না। আমার ধারণা দোকান থেকে কিছু চুরি হলে তার ক্ষতিপূরণ করার দায়িত্ব সিকিউরিটি এজেন্সির। কিন্তু দোকানে অন্য কোনো কর্মচারী উপস্থিত থাকলেও কি সেই দায়িত্ব তাদের? আরেকটা প্রশ্ন মাথায় এল। জিজ্ঞেস করলাম, “ডায়মন্ডগুলো কি আলাদা আলাদা ভাবে ইন্সিয়োরড ছিল?”

রাজু খুব পরিষ্কার করে ব্যাপারটা বলতে পারল না। তবে এ বিষয়ে আমি যতটুকু জানি, এই ধরনের চুরি হলে, তার ক্ষতিপূরণ পাবার ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে দামি ভিডিয়ো ক্যামেরা, ল্যাপটপ, আরও কী কী জিনিস নাকি চুরি হয়েছিল, তার টাকা পেতে ভদ্রলোকের দম ছুটে গিয়েছিল! তাও রিপ্লেসমেন্ট কস্ট মেলেনি। নানান হিসেবপত্তর করে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর সেটা তো ভিডিয়ো ক্যামেরা, ল্যাপটপ ইত্যাদির ব্যাপার—বড়োজোর হাজার দেড়-দুই ডলারের মামলা। আর এখানে? বারোটা ছোটো ছোটো হিরের দাম যদি কুড়ি হাজার ডলার করে হয়, তাহলে, সব মিলিয়ে প্রায় 2.4 মিলিয়ন ডলার! যে-ই চুরি করুক না কেন, ডলারের অঙ্কটা মন্দ নয়। আমি কুড়ি বছর পড়িয়েও অত টাকা পাব না।

প্রমথকে কথাটা বলতেই কানে কানে বলল, “পাবি, যদি বেভকে বিয়ে করিস।”

বেভ সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। বাংলা বোঝে না ঠিকই, রাজুও না- কিন্তু প্রমথর যদি কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে!

“পুলিশকে খবর দিয়েছে হেমন্ত?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

রাজু উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”

একেনবাবুকে বিকেলে ব্যাপারটা জানাব বলে রাজুকে বিদায় করলাম। বেভ অন্য একজন সেক্রেটারি আসেনি বলে তার কাজটা করছিল, ও-ও চলে গেল। প্রমথ বসল না। এদিকে এসেছিল অন্য একটা কাজে, আমার অফিসে ঢুকেছিল শুধু ঢু মারতে। সবাই চলে যাবার পর আমি চিন্তা করতে বসলাম, কী করে অদৃশ্য হতে পারে! জুতসই কোনো সম্ভবনাই মাথায় এল না। তবে মনে পড়ল, ঠিক এইরকমই একটা কেসের রহস্য কিছুদিন আগে একেনবাবু উদ্ঘাটন করেছিলেন। সেখানে নাইট গার্ডের একটা কুকুর ছিল। সেই নাইট গার্ড গয়না পাহারা দেবার সময়ে পিনাট বাটার হিরেতে লেপে কুকুরটাকে গিলিয়েছিল। সুতরাং গার্ডকে সার্চ করে কোথাও কিছু পাওয়া যায়নি। কুকুরকে পরে জোলাপ খাইয়ে তার নোংরা মল ঘেঁটে হিরেটা উদ্ধার করার প্ল্যান ছিল। কিন্তু একেনবাবুর বুদ্ধিতে সেটা ভেস্তে যায়। এখানে সিকিউরিটির যে লোক আছে, তার কোনো কুকুর নেই। সেদিক থেকে নিশ্চিন্তি। আর চুরিও হয়েছে দিনে-দুপুরে যখন দু-জন কারিগর দোকানে ছিল! কারিগরদের নজর এড়িয়ে গার্ড কি কোনো হিরে গিলতে পারে? একটা-দুটো নাহয় পারে, তা বলে সবগুলো? এক ডজন, মানে বারো-বারোটা হিরে? …যদি না… যদি না সবাই একসঙ্গে চক্রান্ত করে কাজটা করে।

বিকেলে বাড়িতে ফিরে একেনবাবুকে রাজুর হিরে চুরি যাবার গল্পটা বলতেই একেনবাবুও মনখারাপ করলেন, “খুব সুন্দর ছিল স্যার হিরেটা।”

প্রমথ কফি বানাচ্ছিল, বলল, “আপনি খেয়াল করেছিলেন?”

“কেন করব না স্যার! হালকা গোলাপি রঙের হিরে, অনেকটা ফেমাস গ্রাফ পিঙ্ক-এর মতো।”

“সেটা আবার কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ওই নামে একটা বিখ্যাত হিরে ছিল না? কী জানি স্যার, হয়তো ভুল নাম বলছি।”

“না, কোনো ভুল নাম বলছেন না।” প্রমথ বলল, “কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের আঙুলের দিকে আপনি যে এত নজর দেন, সেটা তো জানতাম না!”

“কী যে বলেন স্যার, ওঁরা তো সবাই ভগ্নীসমা।”

“সেটা আপনার ফ্যামিলিকে বোঝাবেন!”

‘ফ্যামিলি’ মানে একেনবউদি, সেটা এখন আমরা সবাই জানি।

“আঃ, ওসব ছাড় তো।” প্রমথকে ধমক দিয়ে একেনবাবুকে বললাম, “আপনাকে কিন্তু হিরেগুলো খুঁজে বার করে দিতে হবে। অন্যগুলো না হলেও চলবে, অন্তত রাজুর আংটিটা।”

প্রমথর মাথায় কী ঘুরছিল কে জানে, হঠাৎ বলল, “রাজুর আংটির ব্যাপারটা আমি বুঝি, একটা সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার জড়িয়ে আছে। কিন্তু হিরে নিয়ে এই মাতামাতি আমার অসহ্য লাগে!”

“কেন শুনি, এনগেজমেন্ট রিং কিনতে তোর অনেক টাকা খসবে বলে?”

“স্টুপিডের মতো কথা বলিস না! স্রেফ এক টুকরো কার্বনের জন্য, লাখ লাখ টাকা খরচা করা মিনিংলেস। ভেবে দ্যাখ, পেন্সিলের শিষের দাম যদি হত দশ লক্ষ টাকা, কিনতিস তাহলে? ওটাও তো গ্রাফাইট, মানে কার্বন।”

“না স্যার, তফাত আছে। এই দেখুন না, ম্যাডামের সংখ্যা তো পৃথিবীতে অনেক, কিন্তু আপনাদের দুই ম্যাডাম, মানে ফ্র্যান্সিস্কা ম্যাডাম, আর বেভ ম্যাডাম- এঁরা তো আলাদা।”

“ফালতু একটা কথা বললেন। যাক গে, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, আপনি এখন আপনার রাজু ম্যাডামের আংটিটা খুঁজে দিন!”

একেনবাবু প্যাঁচে পড়ে মাথা চুলকোলেন। “আসলে স্যার, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একটা জরুরি কাজ দিয়েছেন। সেটা ফেলে তো কোনো কিছুতে হাত দিতে পারব না।”

বলতে-না-বলতেই একেনবাবুর মোবাইলে বেভের ফোন।

“হ্যাঁ ম্যাডাম। …বাপিবাবু এখুনি বলছিলেন ব্যাপারটা। আসলে একটা বড়ো কাজে আটকে আছি… না, না, ম্যাডাম এটা কেন বলছেন, নিশ্চয় করব। মানে আমার যতটুকু সাধ্য। হ্যাঁ, হ্যাঁ, কালকেই কথা বলব… সকালেই।”

বেভের কথা না-শুনলেও কী কথা হয়েছে অনুমান করতে অসুবিধা নেই। প্রমথ চেপে ধরল, “কী মশাই, বাপি একটা অনুরোধ করল, তখন বললেন, “না”। আর বেভ বলতেই “হ্যাঁ।”

“আসলে স্যার, ম্যাডাম ‘না’ মানতে চান না।”

“ওসব ছেঁদো অজুহাত বাদ দিন তো! আসলে সুন্দরী মেয়ে দেখলেই, আপনি গলে যান।”

“শুনছেন স্যার, প্রমথবাবুর কথা!” আমার দিকে করুণভাবে তাকালেন একেনবাবু।

।।৩।।

পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখি, বেভ ছুটি নিয়েছে। ছুটি মানে আজকে ও কাজ করবে না। বেভ খুব অল্পই ছুটি নেয়। অফিসে বসে কাজ করতেই ওর নাকি ভালো লাগে। কী অদ্ভুত কথা! আমাকে তো আসতে হয় পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে। পড়াতে খুব খারাপ লাগে না ঠিকই, কিন্তু পরীক্ষার খাতা দেখা, সেগুলো গ্রেড করা, ডিপার্টমেন্টের বোরিং মিটিংগুলো অ্যাটেন্ড করা— আই জাস্ট হেট অল দোজ অ্যাক্টিভিটিজ। কিন্তু বেভকে দেখেছি ছুটি নিয়েও মাঝে মাঝে অফিসে চলে আসে। এর-ওর ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ গল্প করে, লাইব্রেরি যায়, ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আড্ডা দেয়। দরকার হলে অন্য সেক্রেটারিদের ছোটোখাটো কাজও করে দেয়। বোঝার উপায় নেই ছুটিতে আছে, না কাজ করতে এসেছে। এমনও হয়েছে বেভ ছুটি নিয়েছে, আমাকে জানিয়েওছে, কিন্তু ওকে ডেস্কে দেখে ছুটির কথা ভুলে হাতে লিখে কোনো মেমো ওর কাছে নিয়ে গেছি। আমার ইংরেজি প্রায়ই আড়ষ্ট আর দুর্বোধ্য হয়। রেভকে দিলেই কলম চালিয়ে ঠিকঠাক করে যাদের পাঠাতে হবে তাদের ইমেল করে দেয়। মেমোর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলেছে, ‘আমি তো করব না, জানো না আমি ছুটিতে!”

ঠিকই তো। আমি লজ্জা পেয়ে ‘ওহ্, সো সরি’, বলে মেমোটা তুলতে যাচ্ছি। তখন আমাকে আটকেছে।

‘আমি করে দিচ্ছি।’

‘না, না, ছি ছি। তুমি ছুটিতে, কেন করবে?’

‘বসেই তো আছি!’ মুখে হাসি।

আজকে অফিসে বসতেই বেভ ঘরে ঢুকে বলল, “তোমার তো আজ সকালে ক্লাস নেই, মিটিং-ও নেই।”

“ঠিক।”

“ডিটেকটিভ আসছে, আমাদের সঙ্গে হেমন্তর দোকানে যাবে। রাজু বেচারা আজ যেতে পারবে না। ওর ডিপার্টমেন্টের অনেকে ছুটিতে।”

“রাজুর আংটি চুরির তদন্ত?” উত্তরটা জানি, তাও প্রশ্ন করলাম।

“হ্যাঁ।”

“হেমন্ত জানে আমরা আসছি?’

“হ্যাঁ, রাজু ফোন করে বলে দিয়েছে। ওর দোকান এমনিতে দশটায় খোলে, কিন্তু আমাদের জন্য আগেই খুলছে। আমিও একটু আগে হেমন্তর সঙ্গে কথা বলেছি। ও দোকানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

এর মধ্যে প্রমথর ফোন। “শোন, হেমন্তর দোকান থেকে ফিরে এসে আমাকে ফোন করিস।”

“তুই কী করে জানলি আমি ওখানে যাচ্ছি!”

“কমান্ডার-ইন-চিফ-এর সঙ্গে সকালে আমার কথা হয়েছে।”

কাল রাত থেকে প্রমথ বেভকে ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ ডাকা শুরু করেছে। ওর নাকি অপরিসীম ক্ষমতা লোকদের লাইনে রাখার— হুকুম চালিয়ে, রাগের ভান দেখিয়ে, অভিমান করে- কোনো-না-কোনো উপায়ে!

“তুই যাওয়া থেকে কাটলি কী করে?” বাংলাতেই বললাম।

“কারণ ল্যাবে কাজ আছে। শোন, আমাদের কমান্ডার-ইন-চিফ খুব বুঝদার মেয়ে, শোনামাত্র আমি এক্সকিউজড। তবে তোদের এই মিশনে সঙ্গে আছি।’

“মিশন না মুণ্ডু!”

কয়েক মিনিটের মধ্যেই একেনবাবু এসে হাজির।

“বেশি দেরি করে ফেললাম, ম্যাডাম?”

“একেবারেই না, বাপিও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে।”

“বাঃ। সেটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। বাপিবাবু না থাকলে তো কাজটা এগোবেই না,” একেনবাবু একেবারে বিনয়ের অবতার।

“আজকে সবাই আমার নতুন গাড়িতে যাব। তোমরা তো দেখোইনি গাড়িটা। “ শেষটা মূলত আমাকে উদ্দেশ করে।

বলতে ভুলে গেছি, বেভকে ওর মামা একটা টেসলা উপহার দিয়েছেন। খুব একটা সস্তার গাড়ি নয়। কথাটা শুনে আমি অবাক হইনি। একজন এয়ারেস যখন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি স্রেফ অভিমান করে নিতে রাজি হচ্ছিল না, তখন যেন-তেন-প্রকারণ তাকে কিছু গছিয়ে খুশি করার চেষ্টা। বেভ ওর একমাত্র মামার অত্যন্ত আদরের। ধনকুবের দাদু কিছুদিন হল মারা গেছেন। সেই সম্পত্তির ভাগ বেভ শেষ পর্যন্ত নিতে রাজি হয়েছে। খবরের মধ্যে এটাই নতুন। যাইহোক, গাড়িটা আমার এখনও দেখা হয়নি। আমি গাড়িতে কলেজে আসি না, হেঁটে যাতায়াত করি। বেভও সাধারণত আসে না। দু-এক বার ওর গাড়িটা দেখাতে চেয়েছে, হয়ে ওঠেনি। একেনবাবু প্রবল উৎসাহে বললেন, “অবশ্যই যাব ম্যাডাম। টেসলা বলে কথা!”

টেসলা গাড়ি রাস্তায় আজকাল চোখে পড়ে। একসময়ে এই ইলেকট্রিক গাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। গ্যাস বা পেট্রোলে তো চলে না, ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে চার্জিং স্টেশনে গিয়ে ব্যাটারি চার্জ করতে হয়। পেট্রোলের জন্য যেরকম অজস্র পেট্রোল পাম্প রাস্তায় রাস্তায়, চার্জিং স্টেশন অত নেই। মাঝরাস্তায় চার্জ ফুরিয়ে গেলে কী করে কে জানে!

গাড়িতে উঠেই একেনবাবু বললেন, “ম্যাডাম, আপনি না থাকলে আমি জীবনে ইলেকট্রিক টেসলা-তে উঠতে পারতাম না! ভীষণ দামি গাড়ি, তাই না?”

বেভ কথা শুনে লজ্জা পেল। “না না, ডিটেকটিভ, এটা মডেল থ্রি, অত দামি নয়- হাজার পঞ্চাশেকে পাওয়া যায়।”

“সেটা কম হল ম্যাডাম? শুনেছি এটা নাকি নিজে নিজেই চলে, কোথায় যেতে চান বললেই নিয়ে যায় সেখানে।”

বলার ধরনে বেভ হেসে ফেলল। “একটা সফটওয়্যার প্যাকেজ এফএসডি পাওয়া যায়, যেটা হাইওয়েতে কাজ করে, তবে শহরের মধ্যে এখনও ভালো কাজ করে না।”

নামটা আমি শুনেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “এফএসডি মানে কি ফুল সেল্ফ ড্রাইভিং প্যাকেজ?”

“হ্যাঁ। নিজে নিজে লেন চেঞ্জ করা, গাড়ির সামনে কিছু এসে পড়লে ব্রেক কষা, রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করা— এইসব করতে পারে। আর এমনিতে এই গাড়ি অনেক কথাবার্তা শোনে।”

“তাই নাকি ম্যাডাম!”

“দেখবে?” বলে বেভ বলল, “লক দ্য ডোর।”

খট করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

“ওপন বুট।”

পেছনের ডিকিটা খুলে গেল।

“ফোল্ড মিররস।”

সঙ্গে সঙ্গেই রিয়ার ভিউ মিরর দুটো বন্ধ হয়ে গাড়ির পাশে লেপটে গেল।

“দারুণ ম্যাডাম, দারুণ।” একেনবাবু মাথা নাড়লেন। “আচ্ছা ম্যাডাম, বলুন না ওকে, ‘ক্যাচ দ্য ডায়মন্ড থিফ।”

ওঁর বলার ধরনে বেভ হেসে ফেলল। “সব কাজ তো এখনও পারে না ডিটেকটিভ, সেইজন্যেই তোমাকে চাই।”

“একদম ঠিক কথা, বেভ,” আমি বললাম, “আর আমিও চাই গাড়িটা তুমি চালাও, সেল্ফ ড্রাইভিং গাড়িতে আমার ভরসা নেই।”

“আমার ওপর ভরসা আছে?” বেভ সপ্রশ্নে তাকাল।

এরকম প্রশ্ন আসতে পারে একেবারেই ভাবিনি। বোকার মতো হাসলাম। ভাগ্যিস প্রমথ ছিল না, নইলে এ নিয়ে পরে অনেক খেপাত।

এক ঝলক হেসে বেভ বলল, “ভাবতে হবে না, আমিই চালাচ্ছি।”

।।৪।।

হেমস্ত দোকানের সামনে আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল। দেখেই বোঝা যায় বেশ ভেঙে পড়েছে! একে নতুন দোকান খোলার ঝামেলা, তার ওপর একসঙ্গে এতগুলো হিরে চুরি! শুধু চিন্তিত নয়, মানসিকভাবে বেশ বিধ্বস্ত

“কিছুই বুঝতে পারছি না, একেনবাবু। পনেরো বছর ধরে এই ব্যাবসা চালাচ্ছি কোনোদিন এরকম ঘটনা ঘটেনি! সিকিউরিটির জন্য এত খরচা করি তা সত্ত্বেও…”

একেনবাবু দোকানে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন, “পুলিশ কী বলছে স্যার?”

“খুব একটা ভরসা দিচ্ছে না। সিকিউরিটি ক্যামেরায় সন্দেহজনক কিছুই ধরা পড়েনি। দোকান ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, দু-জন কারিগর সেটিং-এর কাজ করছিল। বাইরে দু-জন গার্ড। কারিগররা কেউ বাইরে যায়নি। দোকানে বাইরে থেকে কেউ ঢোকেনি।”

“হিরে আর রাজু ম্যাডামের আংটি কোথায় ছিল স্যার?”

“ওটা রিপেয়ার শপ-এ একটা জুয়েলারি বাক্সে রাখা ছিল। কয়েকটা আর্জেন্ট সেটিং-এর কাজ ছিল। কারিগরদের বলেছিলাম সেগুলো শেষ করেই রাজুর আংটি আর লুজ হিরেগুলোকে পরিষ্কার করে রাখতে। পরের দিন খরিদ্দারের আসার কথা— কাজগুলো আগেভাগেই সেরে রাখতে চেয়েছিলাম।”

“পরিষ্কার মানে কি পালিশ করা স্যার?”

“না, না, খালি হাতে যে কোনো প্রেশাস স্টোন ধরলে হাতের ময়লা, তেল, ইত্যাদি লেগে ব্রাইটনেস হারায়। আমি একেবারে পিকচার পারফেক্ট কন্ডিশনে হিরেগুলো দেখাতে চেয়েছিলাম।”

“তার মানে স্যার, আংটি আর হিরেগুলো কারিগরদের হাতের কাছেই ছিল।”

“তা ছিল, কিন্তু ওরা খুব বিশ্বস্ত কারিগর। দোকানে যখন এসে দেখলাম জুয়েলারি বাক্সে হিরেগুলো নেই, ওরাও আমার মতো হতবাক! দু-জনেই ঈশ্বরের দিব্যি দিল, ওদের কোনো ধারণাই নেই কী করে অদৃশ্য হয়েছে। পুলিশও ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। লাই ডিটেক্টর টেস্ট দিতেও রাজি হয়েছে। আর আমিও ভাবছি, যদি চুরিও করে থাকে, ওগুলো রেখেছে কোথায়? দোকান তো তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। ভালো কথা, রাজুর আংটি পরে পাওয়া গেছে। শুধু হিরেগুলোই মিসিং! আংটি পাবার খবরটা অবশ্য রাজু এখনও জানে না।”

“সেটা কোত্থেকে পাওয়া গেল স্যার?”

“আমার অফিসে- ডেস্ক ড্রয়ারে। ওটাই প্রথমে ক্লিন করে আমার অফিসে রেখে দিয়েছিল। যখন হিরে কোথায় গেল বলে আমি তোলপাড় করছি, ভয় পেয়ে সেটা বলতেও ভুলে গিয়েছিল।”

“আর হিরেগুলো যে-জুয়েলারি বাক্সে রাখা ছিল, সেটা রিপেয়ার শপে কোথায় ছিল স্যার?”

“সেই বক্সটা রিপেয়ার শপের ভল্টে ছিল। আমাদের দুটো ভল্ট। বড়োটা অফিসে থাকে, ছোটোটা রিপেয়ার শপে। রিপেয়ারের কাজ যখন চলে, তখন দিনের শেষে যে-কাজগুলো শেষ হয়নি, সেগুলো ভল্টে তুলে রেখে কারিগররা চলে যায়। বাইরে কিছুই পড়ে থাকে না। জুয়েলারি বাক্সটা ভল্টেই পেয়েছি, শুধু ভেতরে কিছু ছিল না।”

“ভল্ট খোলা থাকে স্যার?”

“দিনের বেলা থাকে। রাতে বন্ধ করে যাই।”

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “হিরে তো গিলেও ফেলতে পারে। একেনবাবুই তো একটা হিরে চুরির কেস সল্ভ করেছিলেন কয়েক বছর আগে।”

“পুলিশ কাল রাতে একটা পোর্টেবল যন্ত্র এনে কুইক স্ক্যান করেছিল। বলেছিল সন্দেহজনক কিছু পেলে ফুল-বডি স্ক্যান করবে- আলট্রাসাউন্ড, এক্স-রে… ভগবান জানেন কী দিয়ে। মোটকথা তাতে কিছুই পায়নি।”

একেনবাবু বললেন, “বুঝলাম স্যার। এবার চলুন, রিপেয়ার শপটা একটু ভালো করে ঘুরে দেখি।”

আগের দিন আমি অফিস থেকে শপটা দেখেছি। জুয়েলারদের যন্ত্রপাতিগুলো অনেকটা ঘড়ি সারাবার যন্ত্রপাতির মতো। কলকাতায় একটা ঘড়ি সারানোর দোকানে এই ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দেখেছি। তবে এখানে ঝালাইয়ের জন্য ব্রেজিং-সল্ডারিং- এর কিছু জিনিসও রয়েছে। দুটো সোনার চেন ছেঁড়া অবস্থায় টেবিলে পড়ে আছে দেখলাম। ওগুলো জোড়া লাগাতে ওরকম কিছুর তো দরকার পড়বেই।

একেনবাবু দেখলাম দেয়ালের একটা কোণের দিকে ধ্যানস্থ হয়ে তাকিয়ে আছেন।

“কী দেখছেন এত? কিছুই তো নেই ওখানে।”

“হ্যাঁ স্যার, কিছুই নেই।”

“তাহলে!”

কিছু উত্তর না দিয়ে একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে হেমন্তকে বললেন, “সেই জুয়েলারি বাক্সটা একটু দেখাবেন স্যার, যেখানে হিরেগুলো ছিল?”

“নিশ্চয়, ওটাকে ভল্ট থেকে নিয়ে আমার অফিসে এনে রেখেছি।”

হেমস্ত আমাদের ওর অফিসে নিয়ে এসে ডেস্ক থেকে নরম ভেলভেটের লাইনিং দেওয়া একটা ফাঁকা বাক্স হাতে তুলে দিল। একেনবাবু সেটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খানিকক্ষণ দেখলেন। কিছু একটা ভাবছেন, বুঝতে অসুবিধা নেই। “আচ্ছা স্যার, পুলিশ কি দোকানের এয়ার-ভেন্টগুলো পরীক্ষা করেছে? টেবিলের নীচটা দেখেছে, বা দেয়ালের প্লাগ-পয়েন্টগুলোর পেছনে?”

“হ্যাঁ, সেসব জায়গাই তো দেখল অনেকক্ষণ ধরে। হাঁটু গেড়ে টেবিলের নীচের সারফেসটা যখন দেখছিল জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী খুঁজছেন?” বলল, ‘চোরেরা অনেক সময় টেপ দিয়ে বা চুয়িং গামে লাগিয়ে টেবিলের তলায় ছোটোখাটো জিনিস আটকে রাখে।”

“কিছুই পায়নি নিশ্চয়।”

“আমি জানতাম কিছু পাবে না। পুলিশে খবর দেবার আগে, টেবিলের নীচে পুরো জায়গাটা আমি নিজে ফ্লোর ব্রাশ দিয়ে ঝাঁট দিয়েছি, যদি হিরেগুলো ফ্লোরে পড়ে থাকে এই ভেবে। টেবিলের নীচে কিছু আটকানো থাকলে চোখে পড়ত।”

“ডায়মন্ড ডিটেক্টর টাইপের কোনো যন্ত্র পুলিশ ব্যবহার করেনি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“সেরকম কোনো যন্ত্র নেই,” হেমন্ত বলল, “যন্ত্র দিয়ে আংটি বা দুল খোঁজা যায়, কারণ সেখানে মেটাল আছে। লুজ ডায়মন্ড ডিটেক্ট করা যায় না।”

এটা আমার জানা ছিল না। একেনবাবু দেখলাম, চুপ করে আছেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, আপনারা ফ্লোর ক্লিন করতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যাবহার করেন না?”

“নিশ্চয় করি।”

“সেটা কোথায়?”

“পুলিশ নিয়ে গেছে, ওটার হোজ, ডাস্ট ব্যাগ, ইত্যাদি সব পরীক্ষা করতে। “ “ধরে নিচ্ছি স্যার, সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি।”

“ধরে নিচ্ছি, না। কিছু পাওয়া গেলে এতক্ষণে জানতে পারতাম।”

“কী ভাবছ ডিটেকটিভ?” বেভ জিজ্ঞেস করল।

“প্রমথবাবুর কথা ভাবছি।”

“হঠাৎ?”

“কিছু না ম্যাডাম। চলুন, এবার যাওয়া যাক।”

হেমন্ত জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বুঝলেন, একেনবাবু?”

“এখনও বুঝতে পারছি না স্যার। ভালো কথা, আপনার শ্বশুরমশাই এখন কেমন আছেন?”

“অনেকটা ভালো। আপনার লোকটিই যন্ত্রটা সারিয়েছে, ফিলটারটা পালটাতে হয়েছে- যা বুঝলাম।”

“যাক! এবার একটা ফাইনান্‌শিয়াল প্রশ্ন করব স্যার?”

“ফাইনান্‌শিয়াল প্রশ্ন! করুন।”

“হিরেগুলোর জন্য কোনো ইন্সিয়োরেন্স ছিল না?”

“হ্যাঁ, ছিল। চুরি, মিস্টিরিয়াস ডিস্যাপিয়ারেন্স, অ্যাক্সিডেন্টাল লস, থেফট সব কিছুই কভার্ড। কিন্তু এগুলো সবই ছিল আমি যা-খরচা করেছি সেই বেসিসে। কিন্তু বিক্রি করার লাভটা তো আর পাওয়া যাবে না।”

“তাহলে সমস্যা কোথায় স্যার? আপনি আবার জোগাড় করে আনুন না নতুন হিরে।”

“ইন্সিয়োরেন্সের টাকা পেয়ে সেটা জোগাড় করতে যা সময় লাগবে, ততদিন এই ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করবে না। আমি খোঁজ নিয়েছি, আমি ডেলিভার করতে পারছি না-জেনে ইতিমধ্যেই আরেক জনের কাছে সে বায়না করেছে। টাইমিংটা এখানে একটা বড়ো ফ্যাক্টর।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং, স্যার।” মাথা চুলকে একেনবাবু বললেন।

এটা এত কী ইন্টারেস্টিং বুঝলাম না। তবে একেনবাবুর হাবভাব দেখে বুঝলাম এখানে ওঁর আর বিশেষ কিছু করার নেই।

আমরা যখন ফিরে আসছি বেভ হেমন্তকে জিজ্ঞেস করল, “আমার একটা পেনড্যান্ট নেকলেস থেকে খুলে গেছে, তোমার লোকেরা নিশ্চয় লাগিয়ে দিতে পারবে?”

“আমিও লাগিয়ে দিতে পারব, নিয়ে এসো বা রাজুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়ো।”

“সো সুইট অফ ইউ, থ্যাংক ইউ।”

বুঝলাম হেমন্ত নিজেও জুয়েলারি সারাতে-টারাতে পারে। শুধু নিজের কর্মচারীদের ওপর নির্ভর করে না।

হেমন্ত আমাদের এগিয়ে দিতে এল। বেরোবার মুখে একেনবাবুর কী মনে হল জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা কাদের কাছ থেকে এই হিরেগুলো আপনার ক্লায়েন্ট এখন কিনছেন?”

হেমন্ত যে নামটা বলল, তাদের নাম আমি শুনেছি। জ্যাকসন হাইটসে ওদের বড়ো একটা গয়নার দোকান আছে। কুইন্সের লোকাল পত্রিকায় ওদের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। তারপর একটু চুপ করে বলল, “দেশে আমাদের পাশের টাউনে ওদের বাড়ি, সেইজন্যেই জানতে পেরেছি। আমাদের দু-জনেরই অনেক কমন ক্লায়েন্ট আছে।”

ফেরার পথে একেনবাবু হঠাৎ ‘একটা কাজ আছে’ বলে অদৃশ্য হলেন। গাড়িতে শুধু আমি আর বেভ। বেভ জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি মনে হয় হিরে চুরির সঙ্গে জ্যাকসন হাইটসের দোকান যুক্ত?”

“আশ্চর্য হব না, কিন্তু চুরিটা করল কীভাবে?”

।। ৫।।

সারাটা দিন হিরে নিয়ে নানান চিন্তায় কাটল, যার কোনোটাই কাজের নয়। বেভের সঙ্গে ইতিমধ্যে একেনবাবুর কথা হয়েছে। শুনলাম পুলিশ তাদের নিজেদের থিওরি অনুযায়ী এগোচ্ছে। ওদের সন্দেহ দু-জন কর্মচারীই এই চুরির সঙ্গে যুক্ত। কোনো একটা উপায়ে হিরেগুলো দোকান থেকে পাচার করেছে। আরেকটা ইন্টারেস্টিং খবর, এই দুই কর্মচারীই ফ্রি-লান্সার। বিভিন্ন দোকানে সার্ভিস দেয়। ওরা নাকি এ অঞ্চলের সুপার-স্যাকরা, নিয়মিত মাইনে দিয়ে ওদের ফুল-টাইম রাখার সামর্থ্য কোনো দোকানেরই নেই। যখন কোনো বিশেষ কাজের দরকার পরে, ওদের ডাকে। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সির দেশি গয়নার দোকানগুলোতে অনেক বছর ধরে কাজ করছে। দু’জনেই শিক্ষিত— একজন তো প্রমথর ফিল্ডে পড়াশুনোও করেছিল, কিন্তু দেশ থেকে পাশ করা কেমিস্ট্রি গ্র্যাজুয়েটদের এদেশে ভালো চাকরি পাওয়া কঠিন। অন্যজন অবশ্য পড়াশুনো করেও গুজরাতে তার বাবার দোকানে স্যাকরার কাজই করত। সেই ছিল প্রধান কারিগর, অন্যজন হাতে-কলমে কাজ শিখেছে শাগরেদি করে। ওদের বিরুদ্ধে কারোরই কোনো অভিযোগ নেই। হেমন্তও ওদের সন্দেহ করে না। এই ব্যাবসায় এক বার সুনাম চলে গেলে কাজ পাওয়া কঠিন। তার ওপর হিরে চুরি করে ওরা পার পাবে না। ধরা পড়ে যাবার রিস্ক ছাড়াও এদেশে কোনো দোকানের মালিক নির্ভরযোগ্য কাগজপত্র ছাড়া চুরির মাল কেনা বা বেচার চেষ্টা করবে না। তাই পুলিশও ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছে না। শেষের কথাটাতে আমার একটু খটকা লেগেছিল, তাই একেনবাবু বিকেলে ফিরতেই ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি নাকি বেভকে বলেছেন নির্ভরযোগ্য কাগজপত্র ছাড়া এদেশে কেউ হিরে কেনে না।”

“বলেছি স্যার।”

“কিন্তু কাগজপত্রগুলো যে সেই বিশেষ হিরের সেটা বুঝবে কী করে?”

“কেন, নম্বর দেখে স্যার!”

“কীসের নম্বর?”

“জিআইএ সার্টিফিকেটে যে আইডি নম্বর দেওয়া থাকে, সেটা পাথরের সাইডে লেজার দিয়ে খুব ছোট্ট করে লাগিয়ে দেওয়া হয়।”

“পাথরের সাইডে মানে?”

“বলছি স্যার, হিরের ওপরটা হল ক্রাউন, আর নীচের অংশ হল প্যাভেলিয়ন। এই দুইয়ের মাঝখানে ঘিরে থাকা অংশটা হিরের গার্ডল বা ঘের। ওইখানে নম্বরটা বসিয়ে দেওয়া হয়। খালি চোখে দেখাও যায় না।”

“ওরেব্বাস, এটা তো আমি জানতাম না! আপনার জ্ঞান দেখে তো মুগ্ধ হচ্ছি!”

“আমিও জানতাম না স্যার। আজকে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসে একজন এক্সপার্ট বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেন। লক্ষ লক্ষ ডলার নিয়ে কারবার- এ তো করতেই হবে।”

“কিন্তু দাঁড়ান! নম্বরটা যেমন লেজার দিয়ে বসানো হয়, সেরকম তো এটাকে পালিশ করে মুছেও ফেলা যায়।”

“তা যায় স্যার, কিন্তু তাতেও সমস্যা আছে।”

সমস্যাটা ঠিক কী জানার আগেই একেনবাবুর মোবাইলটা বেজে উঠল।

“তাই নাকি স্যার? সেটাই তো ভাবছিলাম। গুনে দেখেছেন? বারোটাই? …আরে না, না স্যার, কৃতিত্ব তো সব প্রমথবাবুর। … হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আসছি।”

“কোথায় চললেন?”

“এখুনি আসছি স্যার!”

প্রমথ রান্নাঘরে ছিল। একেনবাবু বেরিয়ে যেতেই আমি রান্নাঘরে গিয়ে প্ৰমথকে বললাম, “হ্যাঁ রে, একেনবাবুকে তুই কী বলেছিস? তোর প্রশংসা করছিলেন।”

“কী আবার বললাম!”

“একেনবাবু দিন-কে-দিন দুয়ে হয়ে উঠছেন। মনে হল তোর কোনো ইনফরমেশনে একটা পজিটিভ ডেভলপমেন্ট হয়েছে।”

“কী ইনফরমেশন আবার দিলাম বক্কেশ্বরকে!”

“সেটা এলেই জানতে পারবি।”

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরলেন একেনবাবু। তবে একা নয়, সঙ্গে বেভ। বেভকে দেখে আমি হতবাক!

“তুমি?”

একেনবাবু উত্তর দিলেন, “বেভ ম্যডামের কেস স্যার, উনি না থাকলে সল্ভ হবে কী করে!’

বেভ দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছে। ব্যাপারটা বেভই পরিষ্কার করে দিল। বেভ যখন রাজুকে ড্রপ করতে গিয়েছিল হেমন্তর দোকানে, তখনই একেনবাবু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে নিয়ে এসেছিলেন হেমন্তর দুই কারিগরকে অ্যারেস্ট করতে। হিরে অদৃশ্য হবার অংশ নাকি সমাধান হয়েছে। এখন এর পেছনে টাকা-খেলার জটটা খুলতে হবে। তারপর প্রমথকে বেভ বলল, “আর তোমার জন্যেই কেসটা নাকি ক্লিয়ার হয়েছে।”

“সেটাই বাপি বলছিল, কিন্তু আমি নিজে তো ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। এই যে একেনবাবু, মৌনীবাবা হয়ে না থেকে মুখটা একটু খুলে আমাদের আলোকিত করবেন?”

“কী যে বলেন স্যার! সবই তো জানেন আপনি!”

“কী জানি?”

“এই যে স্যার। ডায়মন্ড যত দামিই হোক, আসলে পিওর কার্বন। সেটাতে যদি আগুন লাগাতে পারা যায়, তাহলে কার্বন ডাই-অক্সাইড হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, কিছুই পড়ে থাকবে না।”

“সেটা কিন্তু আপনাকে বলিনি। ডায়মন্ডে আগুন লাগানো সহজ ব্যাপার নয়। ‘ “ঠিক স্যার, কার্বন ডাই-অক্সাইড কথাটা বললাম আমার পাস কোর্সের কেমিস্ট্রির জ্ঞান থেকে।”

“আঃ, আসলে যা বলতে চান বলুন তো!”

“বলছি স্যার, এ নিয়ে আমি একটু রিসার্চ করছিলাম। দেখলাম ডায়মন্ডে আগুন লাগানো সহজ ব্যাপার নয়, পোড়াতে হলে প্রচুর অক্সিজেন সাপ্লাই করতে হবে। আর তখনই স্যার, যে চিন্তাটা রিপেয়ার শপে ঢুকে মাথায় ঘুরছিল, সেটা দূর হল। আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, প্রথম দিন শপের একটা কর্নারে ম্যাডাম বেভের দেওয়া অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরটা ছিল, দ্বিতীয় দিন সেখানে ওটা ছিল না। আমি তাতে একটু অবাকই হয়েছিলাম। আপনার মনে আছে কিনা জানি না বাপিবাবু, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘কী দেখছেন এত? কিছুই তো নেই ওখানে।” আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘হ্যাঁ স্যার, কিছুই নেই।”

আমি বললাম, “খুবই মনে আছে, আপনার সেই বিভ্রান্ত দৃষ্টি।”

“হ্যাঁ স্যার, একটু কনফিউজড হয়েছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওটাকে কর্নার থেকে কেন সরানো হয়েছে। তারপর যখন দেখলাম ওটা ব্রেজিং করার টেবিলের সামনে, তখনই আমার মাথায় এল। এমনিতে হিরেকে পোড়ানো যাবে না, কিন্তু কনসেন্ট্রেটর ফুল স্ট্রেংথে চালিয়ে যদি হিরের টুকরোগুলোর ওপর অক্সিজেন ফ্লো করানো হয় এবং তারপর ব্রেজিং টর্চ দিয়ে সেটাকে জ্বালানো হয়, তাহলেই তো জ্বলবে! সম্ভবত ঘণ্টা চার-পাঁচের মধ্যেই হিরেগুলো পুড়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাবে।”

“কিন্তু অতগুলো দামি হিরে নষ্ট করে লাভটা কী হচ্ছে?”

“এটা একেবারে মোক্ষম বললেন স্যার। এটাই হল ডলার অ্যাঙ্গেল। এর জন্য বেশ কিছু অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চয় এদের হয়েছে। হয় এদেশে অথবা দেশে। কিন্ত টাকাটা এদের দিচ্ছে কে? নিশ্চয় সেই বিজনেসম্যান যিনি প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলারের অর্ডারটা পেলেন। সেটা পাবার জন্য দশ-বিশ হাজার ডলার খরচা করা সেই বিজনেসম্যানের কাছে কিছুই নয়। আমার আবার অঙ্ক ভালো আসে না স্যার, আড়াই মিলিয়নের টোয়েন্টি পার্সেন্ট কত হবে?”

“পাঁচশো হাজার।”

“হ্যাঁ স্যার, বিজনেসে অন্তত কুড়ি থেকে পঁচিশ পারসেন্ট লাভ তো নিশ্চয় করছেন। তার সামান্য একটা অংশ দিয়ে এই কারিগরদের কাজে লাগালেন। বিজনেসম্যানকে চোরাই মাল বিক্রি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। আইন মেনে মাল এনে বিক্রি করছেন। আর কারিগরদের দিকটাও ভাবুন। মাল চুরি করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। এখানে তো মাল বাতাসে উবে গেছে, ধরাছোঁয়ার বাইরে।”

“সবই বুঝলাম, কিন্তু এটাই যে ঘটেছে, শিওর হলেন কী করে?”

“এটাই আমাদের সৌভাগ্য স্যার। ওরা ডায়মন্ডগুলো জ্বালাবার চেষ্টা করেছিল একটু আনাড়িভাবে।”

“ঠিক,” প্রমথ বলল, “একেবারেই অ্যামেচার। ওরা যদি একটা কোয়ার্টজ বিকারে লিকুইড অক্সিজেন ঢেলে ব্রেজিং টর্চ দিয়ে ডায়মন্ডগুলোকে প্রচণ্ড গরম করে তার মধ্যে ফেলে দিত, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড হয়ে ওগুলো অদৃশ্য হয়ে যেত।”

“সেখানে ওদের একটা সমস্যা ছিল স্যার। সেই লিকুইড অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে আসা গার্ডদের চোখ এড়াত না, আর সিসিটিভিতেও ধরা পড়ত। তবে অক্সিজেনের ব্যাপারটা ওরা ভালো করেই জানত, আর অক্সিজেন কনসেন্ট্রেক্টর যে ব্যবহার করা যাবে, সেটাও মাথায় এসেছিল। শুধু সময় নিয়েই হয়েছিল সমস্যা। আরও ঘণ্টা কয়েক সময় পেলে হিরেগুলো বাতাসে মিলিয়ে যেত। সময়ের অভাবে অল্প একটু করে অংশ থেকে গেল। হিরের অংশ হিসেবে সেগুলো অবশ্য চেনা যাবে না। তাই ভ্যাকুয়াম করে ওগুলো পরে ফেলে দেবার মতলব করেছিল। ওই বারোটা গুঁড়ো হিরে ডাস্টব্যাগ থেকে বেরোতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।”

এর মধ্যেই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের ফোন- দু-জন স্যাকরাই অপরাধ স্বীকার করেছে। জ্যাকসন হাইটস-এর দোকানের মালিককেও পুলিশ গিয়ে অ্যারেস্ট করেছে। এত দ্রুত যে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হবে স্টুয়ার্ট সাহেব নাকি কল্পনাও করেননি!

একেনবাবু ফোনটা রাখতেই প্রমথ বলল, “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এর জন্য স্টুয়ার্ট সাহেব কোনো মেডেল-ফেডেল আপনাকে দেবেন না?”

“কী যে বলেন স্যার!”

“ঠিকই বলি, পুলিশদের এই ফ্রি সার্ভিস দেওয়া বন্ধ করুন তো! আর শুনুন, আরও একটা জিনিস এখানে প্রমাণ হল।”

“কী স্যার?”

“এই যে সেদিন আমাকে হিরের আংটি কেনাবার জন্য পোঁ ধরেছিলেন ‘ডায়মন্ড ইজ ফর এভার’ বলে, সেটা যে সত্যি নয় এখন মানছেন তো?”

“মানছি স্যার, কিন্তু ট্রু লাভ ইজ।”

“তাই নাকি! আপনি কি সত্যিই মনে করেন, ট্রু লাভ ইজ ফর এভার?”

“নিশ্চয় স্যার, তাতে কোনো ফাঁকি নেই।”

“এই যে বেভ, তুমি তোমার ডিয়ার ডিটেকটিভকে বাড়িতে পাঠাবার বন্দোবস্ত

করো, দেখছ তো বউদিকে উনি কীরকম মিস করছেন!”

“সো সুইট,” বলে বেভ একেনবাবুকে জড়িয়ে ধরল।

Tags:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress