Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডাকিনীতন্ত্র || Syed Mustafa Siraj » Page 10

ডাকিনীতন্ত্র || Syed Mustafa Siraj

করুণাময়ীকে শেয়ালদা স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিয়ে কর্নেলের আপার্টমেন্টে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছিল। এ রাতেও কর্নেল আমাকে বাড়ি ফিরতে দিলেন না। তবে খবরের কাগজে চাকরির কারণে প্রায়ই আমাকে এ রকম বাইরে কাটাতে হয়।

খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে বসে কর্নেল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, করুণাময়ী সম্পর্কে কী বুঝলে জয়ন্ত?

বললাম, জেদি এবং কড়া ধাতের মহিলা। কিন্তু আশ্রমের গুরুজির প্রতি আনুগত্যের চেয়ে ভয়টাই যেন বেশি।

স্কুলটার কথা ভুলে যাচ্ছ তুমি।

স্কুলে কী আছে?

ওঁর অন্তিম আশ্রয়। জীবনে যে সবকিছু হারিয়েছে, তার পক্ষে একটা শক্ত আশ্রয় আঁকড়ে ধরে থাকা খুবই স্বাভাবিক। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, তাছাড়া চিন্তা করো, স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হওয়ার মতো শিক্ষাদীক্ষাও ওঁর আছে। এদিকে সদানন্দবাবুর যতই প্রতিভা থাক, অ্যাকাডেমিক শিক্ষা তত কিছু ছিল না। কাজেই স্ত্রীর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলার প্রশ্ন ছিল। এসব ক্ষেত্রে রুচির সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

কর্নেল চোখ বুজে অভ্যাস মতো ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। বললাম, একটা ব্যাপার আমার আশ্চর্য লাগছে। পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি খুঁজে বের করতেই যেন উনি আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। শিশিটা পাওয়া গেল ভবতারণের ঘরে। অথচ উনি আর উচ্চবাচ্য করে চুপচাপ চলে গেলেন। বলবেন, আপনি ওঁকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু আফটার অল ওঁর একমাত্র ছেলেকে খুন করা হয়েছে। একজন জেদি কড়া ধাতের মহিলার পক্ষে এই রিঅ্যাকশন অস্বাভাবিক। বরং বলব, অবনীর রিঅ্যাকশন অত্যন্ত স্বাভাবিক। এতক্ষণ সম্ভবত সে থানায় খবর দিয়েছে।

কর্নেল হাসলেন। চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, থানায় গেলে এতক্ষণ থানা থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হতো। আমার ধারণা, গোপা ফিরে না আসা পর্যন্ত অবনী অপেক্ষা করবে।

কিন্তু আমার ভাবনা হচ্ছে, ভবতারণের সঙ্গে অবনীর ঝামেলা বেধেছে কি না।

বাধবার চান্স আছে। তবে

তবে কী?

ভবতারণ শিববাবুর অনুগত। তাছাড়া তার সঙ্গে পাড়ার গুণ্ডামস্তানদের যোগাযোগ আছে। অবনী তাকে ঘাঁটাবার সাহস এই রাত্রিবেলায় পাবে কি না সন্দেহ।

আচ্ছা কর্নেল, ভবতারণের ঘরে শিশিটা পাওয়া গেল। অথচ সে বলছে কিছু জানে না। কিন্তু তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে বেপরোয়া।

হ্যাঁ। শিববাবু তার গার্জেন। সে বেপরোয়া হতেই পারে।

শিববাবু এবং ভকতজির চক্রান্তের কথা সুদর্শনের চিঠিতে আছে। ওঁরা ভবতারণকে দিয়ে পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি হাতিয়ে থাকতে পারেন। তারপর কাউকে দিয়ে–

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বেশি ভাবলে ঘুমুতে পারবে না। ওঠ। শুয়ে পড়া যাক।

সকালে আবার কথাটা তুললাম। কর্নেল খবরের কাগজে চোখ বুলোচ্ছিলেন। বললেন, হুঁ। ভবতারণ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য। মালিক ওষুধের কারবারি। কাজেই ওষুধ সম্পর্কে কিছু ধারণা তার থাকতেই পারে। তার ঘরে অবনী বা সুদর্শনের অজ্ঞাতসারে বাইরের লোক আসার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। সুদর্শনের মৃত্যুর। পর শিববাবু এবং ভকতজির নির্দেশে সে গোপাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে। টাকাকড়ির লোভ সাংঘাতিক লোভ।

উৎসাহিত হয়ে বললাম, অবনী এবং গোপাকে ফলো করে সুদর্শন পুরুলিয়ার অযোধ্যাপাহাড়ে গিয়েছিল। তখন এই শিশিটা হাতানোর অগাধ সুযোগ ভবতারণের ছিল।

নিশ্চয় ছিল।

আবার দেখুন, সুদর্শনের ল্যাবে ভকতজির গোডাউন থেকেও সিঁড়ি বেয়ে ঢোকা যায়। কেউ ল্যাবের দরজা খুলে দিলেই হলো। ঘটনার রাত্রে সুদর্শন ঘরে ছিল না। রাত একটায় ফিরে এসেছিল। ওই সময়ের মধ্যে তার সুইসাইডাল নোট চুরি করা সোজা।

হুউ। খুব সোজা। কিন্তু সুইসাইডাল নোটের কথা কার জানা ছিল, সেই প্রমাণ আমরা পাইনি।

ধরুন, দৈবাৎ ওটা কারও চোখে পড়েছিল।

তা হলে বলব, ওটা চোখে পড়ার পরই সুদর্শনকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছিল। তার আগে নয়। কারণ সুদর্শনকে মেরে ফেলার ঝুঁকি ছিল। অনেকেই জড়িয়ে যেত খুনের মামলায়। কাজেই শিশিটা চুরি অত আগে হয়নি।

হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, নাহ্। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।

কর্নেল বললেন, সব ডেলিবারেট মার্ডারের মোটিভ থাকে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ কিংবা বৈষয়িক লাভ। এক্ষেত্রে কারও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার। কোনও সূত্র আমরা পাইনি। কাজেই বৈষয়িক লাভই মোটিভ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই না?

চমকে উঠলাম। বললাম, তাহলে গোপা প্রথমেই সন্দেহযোগ্য। কিন্তু গোপা। তো এসেছিল সদানন্দ বটিকার ফর্মুলা হাতাতে। এই প্রপার্টির ওপর তার লোভ থাকার কথাও না। আপনার মতে সে বিদেশী কোনও মাফিয়াচক্রের মেম্বার। ফর্মুলা হাতানোর পর সুদর্শনকে সে মেরে ফেলবে কেন?

ঠিক বলেছ। কিন্তু অবনীকে সে ট্রাঙ্ককলে জানিয়েছে, প্ল্যান বদলে কলকাতা ফিরে আসছে। সত্যি যদি সে ফিরে আসে, তখন রহস্যের পর্দা আশা করি সরে যাবে। কর্নেল কাগজ ভাঁজ করে রেখে বললেন, সমস্যা হলো জয়ন্ত, এ এমন একটা কেস, যা কোনওভাবেই হোমিসাইড বলে প্রমাণ করা যাবে না। আমার উদ্দেশ্য শুধু এই হত্যারহস্য জানা। তবে তোমার পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ।

কোন্ পয়েন্টটা?

ভবতারণের ঘরে পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি পাওয়া গেল কেন? চলো, বেরুনো যাক।

কোথায় যাবেন?

ভবতারণের কাছে। তাকে রাত্রে কিছু জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি।…

গাড়িতে যেতে যেতে বললাম, বৈষয়িক লাভ যখন মোটিভ, তখন নিঃসন্দেহে ভকতজি এভং তাঁর সহযোগী শিববাবু এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে আছেন, যদি গোপাকে আপনি রেহাই দেন।

কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না।

বাগবাজার স্ট্রিটে ঢুকে অস্বস্তি হচ্ছিল। কালো অ্যামবাসাডর দেখলেই বুক ধড়াস ধড়াস করে উঠছিল। কর্নেল নির্বিকার। ট্রামরাস্তা পেরিয়ে সেই গতিতে ঢুকে গেটের কাছে হর্ন দিলাম। মন্দিরের দিক থেকে অবনী তান্ত্রিক দৌড়ে এল। এক গাল হেসে বলল, ভবা কাটু। সকালে ভকতজির খোঁজে গেলাম। সে-ও কাট। ওর কর্মচারীরা বলল, বোম্বে গেছে। বুঝলেন তো?

কর্নেল বললেন, বুঝলাম। থাক্। আর ভেতরে যাব না। ভবতারণকে জেরা করতে এসেছিলাম।

অবনী অদ্ভুত হাসতে লাগল। বলল, কাল রাত্রে আপনারা যাওয়ার পর শিবু উকিলের কাছে গিয়েছিল ব্যাটাচ্ছেলে। সকালে কালীদা চুপিচুপি বলল, শিবু উকিল ওকে গা ঢাকা দিতে বলেছে।

ভবতারণ কখন চলে গেছে জানেন?

কাল রাত্রেই। শিবু উকিলের বাড়ি থেকে এসে স্যুটকেস বোঁচকাকুঁচকি নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি ওকে পুলিশে দেবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে নিষেধ করেছেন। তাই চুপচাপ ছিলাম। এই এক্ষুণি ভাবছিলাম আপনাকে টেলিফোন করি। মায়ের দয়ায় আপনি এসে পড়লেন।

গোপা এখনও এসে পৌঁছতে পারেনি?

এসে যাবে। তন্ত্রের আকর্ষণ। তারা! ব্রহ্মময়ী! মা গো!

আচ্ছা চলি!

শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে পৌঁছে কর্নেল বললেন, আমাকে এখানে নামিয়ে দাও জয়ন্ত! আজ আর অফিস কামাই কোরো না। দরকার হলে আমি রিং করব।…

কর্নেল সেদিন রিং করলেন রাত নটায়। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে রিপোর্টারস রুমে তখন খুব কাজের হিড়িক। আমার ছোট একটা অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। প্রেসক্লাবে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স থেকে সদ্য ফিরেছি। তাড়াহুড়ো করে কপিটা লিখে বেরিয়ে পড়লাম।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি, গোপা বসে আছে। মুখে যেন হিংস্রতার তীক্ষ্ণ ছাপ। আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ঘড়ি দেখল।

কর্নেল বললেন, তুমি কি শুধু তোমার ফেলে যাওয়া নোটবইটা নিতেই এসেছিলে?

গোপার চোখে সেই অস্বাভাবিক চাউনি লক্ষ্য করছিলাম। সে শুধু মাথাটা দোলাল।

তা হলে প্রপার্টির দাবি তুমি করবে না?

না। প্রপার্টির দাবি করার অধিকার আমার নেই।

কেন তা বলতে আপত্তি আছে?

উই ওয়্যার নট লিগ্যালি ম্যারেড কর্নেল সরকার। উই ওয়্যার জাস্ট লিভিং টোগেদার।

আই সি! কর্নেল হাসলেন। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছ।

দ্যাটস্ রাইট। সেজন্যই আমার ফেরার কথা আপনাকে জানাতে বলেছিলাম।

কিন্তু তুমি তো চলে যাচ্ছ! আমাকে লড়ার সময় দিচ্ছ না।

সময় যথেষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি–এনিওয়ে! উঠি বলে সে দরজার কাছে গিয়ে মার্কিন ঢঙে বলল, বাই! তারপর বেরিয়ে গেল।

কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! দরজা বন্ধ করে দে।

বললাম, মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।

কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, আমিও বুঝিনি! গোপা সাড়ে আটটা নাগাদ এসে বলল, এ দেশের ডাকিনীতন্ত্র সম্পর্কে সে অনেক তথ্য। সংগ্রহ করেছিল। সেই নোটবইটা সে ভুল করে ফেলে গিয়েছিল। সেটা নাকি এতই জরুরি যে

হঠাৎ কর্নেল চোখ খুলে সোজা হলেন তারপর হাত বাড়িয়ে টেলিফোনে ডায়াল করলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, রিং হয়ে যাচ্ছে। অবনী কি ভাঙের নেশায় কাত হয়ে গেছে?

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন রেখে দিলেন। আবার ধ্যানস্থ হলেন। আপনমনে বললেন, গোপা কি সত্যিই ডাকিনীতন্ত্রের নোটবই ফেলে গিয়েছিল?

বললাম, আপনাদের এই চ্যালেঞ্জের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার টেলিফোন তুললেন। ডায়াল করে বললেন, রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। ব্যাপারটা দেখতে হয়।

জয়ন্ত! কুইক!

কোথায় যাবেন?

সান্যালবাড়ি।

সে কী!

জয়ন্ত! আমার অস্বস্তি হচ্ছে। ওঠ। ষষ্ঠী! বেরুচ্ছি। দরজা বন্ধ করে দে।

লনে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম দুজনে। স্টার্ট দিয়ে বললাম, ও বাড়ি যেতে আমারও অস্বস্তি হচ্ছে।

কর্নেল গলার ভেতর বললেন, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক আমাকে আর ঘাঁটাতে সাহস পারেন না। সম্ভবত উনি পুলিশমহলে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। ভবতারণ এবং ভকতজি ঠিকই গা ঢাকা দিয়েছে ওঁর পরামর্শে। তা না হলে অবনীই বাড়ি থেকে গলাধাক্কা খেত।

কর্নেলের নির্দেশে গলির মোড়ে গাড়ি লক করে রেখে দুজনে এগিয়ে গেলাম। আলো দেখে বুঝলাম, নিয়মিত লোডশেডিংয়ের সময় উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রথমেই চোখে পড়ল গেটে তালা দেওয়া নেই। কর্নেল ঢুকে পড়লেন, তারপর হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করে পোর্টিকোর তলায় গিয়ে দেখি, দরজা হাট করে খোলা।

ওপরতলার করিডরে গিয়ে কর্নেল অবনীর ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। দরজা খোলা। কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হুঁ! যা ভেবেছিলাম।

ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে। মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছে অবনী তান্ত্রিক। স্পন্দনহীন শরীর। একটা মদের গেলাস ভেঙেচুরে মেঝেয় ছড়িয়ে রয়েছে। অবনীর মুখের পাশে একটু রক্ত। বললাম, এ কী! সর্বনাশ!

কর্নেল আস্তে আস্তে বললেন, সুদর্শনের হত্যাকারীকে শাস্তি দিতেই ফিরে এসেছিল গোপা। মাফিয়াচক্রের মেম্বারদের কাছে সাংঘাতিক বিষের বড়ি থাকে। চলে এস জয়ন্ত! আমাদের এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়।

আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। শরীরের ওজন বেড়ে গেছে যেন। গেট দিয়ে বেরুনোর সময় কেউ লক্ষ্য করছে কি না, সেদিকে মন ছিল না। যন্ত্রচালিতের মতো গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম। আমার ভয় হচ্ছিল, অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব হয় তো।

বাগবাজার স্ট্রিটে পৌঁছে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, থানায় জানানো উচিত ছিল।

ছেড়ে দাও। যথাসময়ে পুলিশকে জানানোর লোক প্রচুর পাওয়া যাবে।

কিন্তু অবনী কেন সুদর্শনকে মেরে ফেলল?

গোপাকে পাওয়ার লোভে। এবং সে ভেবেছিল গোপাকে পাওয়া মানে কার্যত প্রপার্টি হাতে পাওয়া। তবে ভুলটা করেছিল গোপাই। অবনীকে বড় বেশি প্রশ্রয় দিয়েছিল। সেটা হয়তো স্রেফ অভিনয়। কিন্তু নির্বোধ অবনীর মনে লোভ জাগিয়ে দেওয়ার পক্ষে সেটা যথেষ্টই।

আমি এই সম্ভাবনার কথা আপনাকে বলেছিলাম কিন্তু!

নেহাত আন্দাজে বলেছিলে। কিন্তু গোড়া থেকেই অবনী আমার সন্দেহের তালিকায় ছিল। পরে জানলাম সে বি. এস-সি পর্যন্ত পড়েছে এবং ওষুধ কারখানায় কাজও করেছে। তার পক্ষে পটাসিয়াম সায়নায়েডের খোঁজ রাখা খুবই সহজ। কিন্তু দৈবাৎ সুসাইডাল নোটটা তার হাতে না এলে সে গোপার। প্রতি যত লোভীই হোক, সুদর্শনকে খতম করার ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। সুদর্শন নিজে থেকে কবে আত্মহত্যা করবে, সেই আশায় তাকে থাকতে হতো। তবে আজ ভবতারণের ঘরে শিশি উদ্ধারে অতি উৎসাহ তার মুখোশ খুলে দিয়েছিল।

বললাম, গোপা দিল্লি থেকে ফিরে সুদর্শনের হত্যাকারীকে শাস্তি দিল। কেন? এখানে থাকার সময় কি সে আঁচ করেনি কিছু? এখানে থাকার সময় সে এটা করতে পারত।

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন, এ প্রশ্নের জবাব গোপাই দিতে পারে। কিন্তু এখন আর তাকে পাচ্ছি কোথায়?

চ্যালেঞ্জ কথাটা এখনও আমি বুঝতে পারিনি কর্নেল!

সুদর্শনের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জ।…

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে দেখি, ভবতারণ ফুলো ফুলো মুখ এবং লাল চোখ নিয়ে মেঝেয় বসে আছে। কর্নেলকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে পা ধরতে এল। কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তোমার ভয়ের কারণ নেই। ভবতারণ! কিন্তু আগে বলো, কে তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে?

ভবতারণ চোখ মুছে বলল, উকিলবাবু আমাকে চণ্ডীতলা আশ্রমে গিয়ে মাঠাকরুণের কাছে সব বুঝিয়ে বলতে বলেছিলেন। সেখানে গিয়ে দিব্যি কেটে সব বললাম। মাঠাকরুণ আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। দিনে আসতে আমার সাহস হলো না পুলিশের ভয়ে। তাই সন্ধ্যার ট্রেনে চলে এলাম।

হুঁ। তোমার কোনও দোষ নেই ভবতারণ। কিন্তু তোমার ঘরে বিষের শিশি গেল কী করে?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না স্যার! তবে

বলো!

আমার ঘরের তালা খোলা সহজ। বাড়ির সব তালার চাবি অবনীবাবুর কাছে আছে। খুললে উনিই খুলতে পারেন।

ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে?

আজ্ঞে!

আচ্ছা ভবতারণ, তুমি সুদর্শনকে সাহেব বলতে কেন?

উকিলবাবু বলেছিলেন ওঁদের সাহেব-মেমসাহেব বলবি। তাই বলতাম।

তুমি সুদর্শনের ঘর পরিষ্কার করতে?

আজ্ঞে।

সুদর্শনের ঘরের কোনও কাগজপত্র অবনীবাবুকে দিয়েছিলে?

ভবতারণ চমকে উঠল। বলল, সাহেব জোরে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে কোথায় বেরিয়েছিলেন। ঘর সাফ করতে গিয়ে দেখি, একটা ভাঁজ করা কাগজ টেবিলের নিচে পড়ে আছে। আমি কাগজটা কুড়িয়ে টেবিলে রাখতে যাচ্ছি, সেইসময় অবনীবাবু এসে বললেন, ওটা কী রে দেখি! উনি কাগজটা দেখে বললেন, পাগলের কাণ্ড! ওর বউকে দেখাই। বলে হাসতে হাসতে ওটা নিয়ে চলে গেলেন।

কবে?

যেদিন রাত্রে সাহেব মারা গেলেন।

কিন্তু কখন কাগজটা পেয়েছিলে?

বিকেলবেলায়। সেদিন দুপুর পর্যন্ত সাহেব ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন। ডাকাডাকি করে ওঠালাম। খেয়ে দেয়ে বেরুলেন। ফিরলেন রাত একটায়। তারপর–

তুমি ওকে কাগজটার কথা বলোনি?

মনে ছিল না। উনিও কিছু জিজ্ঞেস করেননি। করলে নিশ্চয় বলতাম।

এমন সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর বললেন, গোপা! কোথা থেকে ফোন করছ?… ঠিক আছে? বোলো না। শুধু একটা কথা জানতে চাই। তুমি দিল্লি গিয়ে কী ভাবে জানতে পারলে অবনী…হ্যাঁ। আমি দেখে এসেছি।… না। অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, যে মৃত্যু হত্যা বলে প্রমাণ করা যাবে না, তা নিয়ে…হ্যাঁ, বুঝেছি।… হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!

কর্নেল ফোন রেখে বললেন, গোপা লাইন কেটে দিল।

ও কী বলল?

কর্নেল ভবতারণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে। তুমি এস ভবতারণ! তোমার চিন্তার কারণ নেই। তুমি আশ্রমে গিয়েই থাকো কিছুদিন। মাঠাকরুণের সেবাযত্ন করো।

ভবতারণ বেরিয়ে যাওয়ার পর বললাম, গোপা কী বলল?

বিবেকযন্ত্রণা তাকে দিল্লি থেকে ফিরিয়ে এনেছিল।

সে কি জানত কে সুদর্শনকে খুন করেছে?

জানতে পেরেছিল। কিন্তু রিস্ক নিতে চায়নি। এখানে শিববাবু তার পিছনে লেগেছেন। তার চেয়ে দিল্লি থেকে গোপনে ফিরে অবনীকে শাস্তি দিয়ে যাওয়া তার পক্ষে নিরাপদ মনে হয়েছিল। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, আমাকে কথাটা অবনীর মাধ্যমে জানাবার কারণ এবার আশা করি বুঝতে পারছ। সে বলতে চেয়েছিল আমি তাকে যেন বিপদে না ফেলি। কারণ আমিও সুদর্শনের হত্যাকারীর শাস্তি চাই। কিন্তু সত্যি বলতে কী, খুনের বদলে খুন, এমন শাস্তি চাইনি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
Pages ( 10 of 10 ): « পূর্ববর্তী1 ... 89 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *