ডাকিনীতন্ত্র : 01
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার নিউজরুমে বসে একটা ক্রাইম রিপোর্ট লিখছিলাম। সেই সময় নিচের রিসেপশন থেকে টেলিফোন এল, সুদর্শন সান্যাল নামে এক ভদ্রলোক আমার দর্শনপ্রার্থী।
কপি লেখার সময় বাইরের কেউ এলে বিরক্ত হই। কিন্তু আজকের কপিটা ছিল মামুলি ধরনের। জেলপালানো এক উগ্রপন্থী কলকাতার একটা হোটেলে ধরা পড়েছে। আজকাল পঞ্জাব, কাশ্মীর অসম থেকে উগ্রপন্থীরা তাড়া খেয়ে কলকাতায় প্রায়ই আশ্রয় নিচ্ছে। কলকাতার মতো বিশৃংখল ভিড়েভরা বিশাল। শহরে গা ঢাকা দেওয়া সোজা। তবে পুলিশের কেরামতি আছে বলা উচিত। মাঝে মাঝে উগ্রপন্থীরা ধরা পড়ে এবং কাগজে খবর হয়, যদিও আমাদের। নিউজ ব্যুরোর নতুন সম্পাদক কমলদার মতে, কারে ধরতে কারে ধরছে। ছাড়ান দাও।
একটু পরে সুদর্শন সান্যাল এলেন।
ভদ্রলোক সত্যিই সুদর্শন। তবে চেহারায় কেমন বিষাদের ছাপ। উসকো খুসস্কো চুল। চোখে পুরু কাঁচের লেন্স। পরনে ঢিলে চকরাবকরা শার্ট এবং জিনস। কাঁধে কালো ব্যাগ। বললেন, পুরুলিয়া ডাইনি হত্যার রিপোর্টাজ আপনিই লিখেছেন।
–একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
–আপনার নাম জয়ন্ত চৌধুরী?
–হ্যাঁ। কী ব্যাপার বলুন তো?
সুদর্শন সান্যাল প্রশস্ত নিউজরুমে চোখ বুলিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। তবে গোপনে বলতে চাই।
বেশ তো! চলুন, লবিতে গিয়ে বসা যাক।
লবিতে বসার জায়গা নেই। অগত্যা এক কোণে গিয়ে দুজনে দাঁড়ালাম। সুদর্শন সান্যাল চাপা স্বরে বললেন, আপনার রিপোর্টাজ খুঁটিয়ে পড়েছি। তবে আপনার ব্যাখ্যা ছকবাঁধা বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ আপনি ডাইনিদের ব্যাপারটা, ইংরেজিতে যাকে বলে উইচক্র্যাফ্ট, একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন।
হাসি পেল। বললাম, আপনি উইচ্যাটে বিশ্বাস করেন বুঝি?
করি। সম্প্রতি আমি পুরুলিয়ায় গিয়েছিলাম। অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গলের ভেতর
ওঁর কথার ওপর বললাম, ডাইনি দেখেছেন?
ঠিক তা-ই। সুদর্শন সান্যাল মার্লবরো সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন, নিন। স্মাগড় সিগারেট নয়। গত সপ্তাহে আমেরিকা থেকে ফিরেছি। এখনও দু প্যাকেট আছে। সিগারেট আমি তত বেশি খাই না কিন্তু গত এক মাস ধরে আমার সিগারেট খাওয়া বেড়ে গেছে। আসলে একটা ভীষণ অ্যাংজাইটিতে ভুগছি।
সিগারেট নিয়ে বললাম, থ্যাঙ্কস্। তো অ্যাংজাইটি কি ডাইনি নিয়ে?
ঠিক ধরেছেন। আমি আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলিসে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছিলাম। হঠাৎ আমার জীবনে অদ্ভুত একাট অশান্তি এসে গেল। আমার স্ত্রী গোপা
বলুন!
ওয়েস্টে মেমসাহেবদের মধ্যে এখন উইচক্র্যাফ্ট নিয়ে খুব হিড়িক। গোপা কী ভাবে একটা গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, জানতাম না। সে-ও আমার সঙ্গে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছিল। যাই হোক, সংক্ষেপে বলি। আমি ও সব ব্যাপার একটুও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু ক্রমশ গোপা আমাকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ল। ধরুন, একটা সুন্দর আপেল। গোপা সেটা কেটে দেখাল, ভেতরে কুৎসিত একটা লার্ভা। কিংবা বেগুন কেটে তাজা রক্ত। রক্তটা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছি, সত্যিকার রক্ত।
ম্যাজিক!
সুদর্শন সান্যাল বিষঃ হেসে বললেন, না জয়ন্তবাবু! আমি একজন বিজ্ঞানী। আমাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। গোপা একদিন বলল, ওর গ্রুপলিডারের নির্দেশ, ওকে ভারতে ফিরতে হবে। ভারতই নাক উইচক্র্যাফটের আদি উৎস। এখানকার ডাইনিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের গুপ্তবিদ্যা সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে গোপাকে মরতে হবে। তাই গোপার সঙ্গে আমাকে ফিরতে হলো।
তারপর?
আমার পৈতৃক বাড়ি বাগবাজারে গঙ্গার ধারে। বাবা-মা বৈচে নেই। আমার মামাতো দাদা অবনী মৈত্র বাড়িটা দেখাশোনা করেন। নিচের তলায় ভাড়াটে আছে। অবনীদা বিপত্নীক। ছেলেমেয়ে নেই। একটা ঘরে একা থাকেন। সাধু সন্ন্যাসী টাইপের মানুষ বরাবর।
ঘড়ি দেখে বললাম, কলকাতায় ফিরে কী হলো বলুন?
বলছি। অবনীদার আবার তন্ত্রসাধনার বাতিক আছে। কাজেই গোপার সঙ্গে ওঁর জমে গেছে। কিন্তু আমার এটা একেবারে অপছন্দ।
কেন?
রাতবিরেতে দুজনে একটা ঘরে দরজা আটকে ধুনো জ্বেলে কী সব করে। অদ্ভুত শব্দ শুনে উঠি। ভীষণ ভয় করে আমার।
হুঁ। তা পুরুলিয়ায় কেন গিয়েছিলেন?
আপনার রিপোর্টাজ বেরুনোর পরদিন অবনীদা আর গোপা বলল, জরুরি কাজে বাইরে যাচ্ছে। ফিরতে দু দিন দেরি হবে। আমি ওদের গোপনে ফলো করলাম। ওরা পুরুলিয়া গেল ট্রেনে। তারপর ট্যুরিস্ট বাসে অযোধ্যা পাহাড়ে। একটা জিপ ভাড়া করে ফলো করেছিলাম। জঙ্গলের ভেতর ওরা বাস থামিয়ে। নামল। জিপ একটু দুরে থামিয়ে ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বললাম। তখন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ড্রাইভার বলল, আধঘণ্টার মধ্যে না ফিরলে সে জিপ নিয়ে চলে যাবে। কারণ ওখানে বুনো হাতির বড় উপদ্রব।
আপনি কী করলেন?
ওকে টাকার লোভ দেখালাম। আপনি তো দেখেছেন, অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে অনেক বসতি আছে। ড্রাইভার একটা বসতি দেখিয়ে বলল, আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করবে। তবে আমি যেন সাবধানে যাই। তখনও গোপাদের আবছা দেখা যাচ্ছিল জঙ্গলের পথে। তাই ফলো করতে অসুবিধে হয়নি। কিছুক্ষণ পরে জঙ্গলের পথ ছেড়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। ততক্ষণে জ্যোৎস্না ফুটেছে। জঙ্গলের ভেতর একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে ওরা থামল। তারপর আগুনের কুণ্ড জ্বলে উঠতে দেখলাম।
সুদর্শন সান্যালের মুখে উত্তেজনা ফুটে উঠেছিল। বললাম, তারপর কী দেখলেন বলুন?
আপনাকে বলতে লজ্জার কারণ নেই। দুজনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় কিছুক্ষণ আগুনের কুণ্ডের চারদিকে অদ্ভুত নাচল। তারপর
বলুন!
সুদর্শন সান্যাল চাপা স্বরে বিকৃত মুখে বললেন, সে এক জঘন্য দৃশ্য। স্বামী দেখছে, তার স্ত্রী তার মামাতো দাদার সঙ্গে–এনিওয়ে! আর মাথার ঠিক ছিল না। আমার সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। কী করব ভাবছি, হঠাৎ দেখি, গোপা এবং অবনীদা ওই অবস্থায় শূন্যে ভাসছে।
আপনার চোখের ভুল!
না। ওরা আগুনের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে চুপচাপ চলে এলাম। কলকাতা ফেরার দু দিন পরে ওরা ফিরল। আমি ঘুণাক্ষরে জানতে দিলাম না ওদের, কী দেখেছি। যাই হোক, এর পর আমার সিদ্ধান্ত, আমার আর বেঁচে থাকা উচিত নয়। গোপা ছিল আমার জীবনের স্বপ্ন। স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। এবার আমার কাছে বাঁচার অর্থ হয় না। আমি সুইসাইড করব।
আঁতকে উঠে বললাম! কেন ওসব কথা ভাবছেন?
সুদর্শন সান্যাল আবার একটা সিগারেট ধরালেন এবং আমাকেও দিলেন। বললেন, আমার জীবন আমার আপনাকে শুধু জানাতে এসেছিলাম, আপনার ব্যাখ্যা ঠিক নয়। ডাইনি আছে। আই মিন, উইচক্র্যাফ্ট সত্য। বিজ্ঞান এখনও সবকিছুর ব্যাখ্যা করতে পারে না। আচ্ছা চলি! আমার এই কার্ডটা রাখুন।
বলে ভদ্রলোক একটা নেমকার্ড দিয়ে হন্তদন্তভাবে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সুদর্শন সান্যাল, পাগল নন তো?
নাকি অসতী স্ত্রীর কীর্তিকলাপ দেখতে দেখতেই পাগল হয়ে গেছেন?
কিন্তু সত্যিই যদি উনি আত্মহত্যা করে বসেন?
উদ্বিগ্নভাবে নিউজরুমে ফিরে গেলাম। সাংবাদিক জীবনে বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখেছি। কিন্তু এমনটি কখনও দেখিনি। তাছাড়া ঘটনাটাও বড়। রোমাঞ্চকর।