ডরোথীর চিঠি
সুছন্দার স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা ঘটনা ঘটলো। ঘরে ফিরেই ডরোথীকে একটা চিঠি লিখতে বসলো সুছন্দা।
ডিয়ার ডরোথী,
তোরা কেমন আছিস? আমি এখানে এসে বি এ তে ভর্তি হতে পারিনি । পরের বছর ভর্তি হবো। বসে না থেকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চাদের পড়াই। তুই তো আমার সেই ভয় পাওয়া রোগটা জানিস। এখানে মাঝে মাঝে আর্মির স্রোত দেখা যায়। রাস্তায় অসংখ্য মিলিটারি চলেছে। প্রথম দিকে ওদের ভয় পেতাম। কিন্তু স্কুলে কাজ নেবার পর রোজই আমার ছুটির সময়ের সাথে ওদের ও মার্চ করার সময় মিলে যায়। নিঝুম দুপুরে চারদিক নিস্তব্ধ তার মধ্যে আমি মহানন্দা ব্রিজ পার হই। আমার বাড়ি ডান দিকে তাই আমি ডান দিকের রং সাইড ই ধরি । দূর থেকে নজরে পড়লো ওরা নিয়ম অনুযায়ী মার্চ করতে করতে আসছে মহানন্দা ব্রিজ এর দিকে । মহানন্দায় নীলচে সাদা ফেননিভ ঢেউ। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফের রূপোর ঝলক। তার সাথে পাহাড়ের কালচে গাঢ়ো নীল আর মেঘের হালকা নীলের সমাহার। বুঝলাম ঠিকই দেখেছি, ওরা মহানন্দা ব্রিজ এ আমার ফুটপাতই ধরেছে। বিশাল বাহিনী আসছে। মনে হলো ফুটপাত বদল করি । মেরুদণ্ড শিরশির করে উঠল। ভাবলাম যদি ওরা বুঝতে পারে যে আমি ভয় পেয়েছি তাহলে তো ওরা আমার পিছু ধাওয়া করবে ।
মুহূর্তে কল্যাণ স্যারের গলা ভেসে এল । রবিঠাকুরের “ইচ্ছে ইচ্ছে “মনে পড়ল । অমনি আমার ইচ্ছা শক্তি জাগরুক হয়ে গেল । মনে করলাম,আমি তো কোনো অন্যায় কাজ করি না। আমি শিশুদের আন্তরিক ভালোবেসে পড়াই । ছাত্র ও ছাত্রীদের উন্নতির চেষ্টা করি। তবে আমার কিসের ভয়? ওরা যেমন দেশের সেবক । আমি ও তো দেশের সেবিকা। আমার দেশ সেবায় তো কোন ফাঁক নেই ? এই মনোভাবটা আমায় আমার নিজের চলার পথে সাবলীল ভাবে চলতে দিলো। আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে,যে হেতু আমি আমার চলার পথে অটল থেকেছি একেবারে মুখোমুখি হয়েও। তাই ওরা আমার ঠিক দু’হাত দূরে এসেই প্রথম জন রাস্তায় নেমেছে আবার আমার পেছনে গিয়ে ফুটপাথ এ উঠেছে। ঠিক “ডায়না মোর “এর মতো । একেএকে রাস্তায় নেমে আবার ফুট পাথ এ উঠেছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য । আমি আমার দৃষ্টি ওদের দিকে না দিয়ে একেবারে সাবলীল থেকেছি নিজের চলার পথে । আমার দৃষ্টি তখন দূরে,কাঞ্চন জংঙ্ঘায়। ভাবলেশহীন চাহনি। এই চলা এমন ছিল যে কারো জন্য কারো চলা থেমে থাকেনি । ওদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়েছে। এমন মানুষদের না ভালোবেসে পারা যায়? ওদের কথা আমরা ভাবি না। ওরা আমাদের দেশ রক্ষা করে । আমাদের ভাব এমন যে এটা ওদের চাকরি, তাই করে। এ যেন বাবা মায়ের সন্তানেরা যা মনে করে ঠিক তেমনি । বাবা মা, সন্তান মানুষ করতে এতো করে কিন্তু সন্তান ভাবে ওটা তো ওদের কর্তব্য । দেশের জন্য প্রাণ বলিদান দিতেই ওরা যায় আমরা ভাবি ওটা তো ওদের কাজ ।
আমার কি মনে হয় জানিস? জেলখানার কয়েদী দের জেলখানায় না রেখে ফৌজএ ভর্তি করে দিলে ভালো হয়। ভালো কাজের সুযোগ পেলে ওরা ও ভালো হয়ে যাবে । একটা চাকরি পেলে ওদের অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে । আমাদের দেশ কলুষতা থেকে মুক্ত হবে। তোর কি মনে হয় জানাস আমাকে ।
ইতি—
তোর সুছন্দা ।
পোস্ট বক্সে চিঠি ফেলতে হাতে ঠেকলো আর একটা চিঠি । খুলে ফেলল চিঠি খানা । রমলার লেখা চিঠি । ছাতে উঠে গেল আরাম করে পড়বে বলে । মনে পড়ছে সেই ছোট্ট বেলার কথা। সুছন্দার বাবা শিলিগুড়ি আসার পর রমলার চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর সুছন্দার বিয়ে হয়ে গেল । কিছুদিন পর সুছন্দার স্বামীর অফিসের কাজে কাটিহারে যেতে হল । আবার খোঁজ পড়ল রমলার । ওদের বাড়ি যেতে ওর ভাই রমলার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে গেল সুছন্দা আর ওর স্বামীকে। দরজা যিনি খুললেন,তাঁর গলায় কন্ঠী। পরনে গেঞ্জি ও লুঙ্গি। বছর পঁয়তাল্লিশ হবে। বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে নীলাম্বরী শাড়ি পড়নে অল্প বয়সী এক মহিলা । বয়স বড়ো জোর পঁচিশ। দুই বিনুনি বুকের পরে ঝুলছে । সুন্দরী বলা যায় তাকে ।
সুছন্দা জিজ্ঞাসা করলো ভদ্রলোক কে- রমলা কি আছে ? উত্তরে ভদ্রলোক ঐ মহিলা কে বললেন- কে এসেছে দেখো । সুছন্দা ও তার স্বামী এগিয়ে গেলেন ঐ মহিলার দিকে। সুছন্দার হাসি দেখে সেই মহিলা বললেন- -তুই সুছন্দা না?
সুছন্দা তাজ্জব তবুও বলে- তুই কি রমলা?আমাকে চিনতে পারলি কি করে? রমলা বলে—তোর হাসিটা দেখেই চিনেছি। হাসিটা একই আছে ।
সুছন্দা কে ভেতরে নিয়ে গেল রমলা। দুই বন্ধুর গল্প শুরু হলো। সুছন্দা বলে- ঐ ভদ্রলোক কে? রমলা বলে—আমার স্বামী ।
হাঁ করে চেয়ে আছে সুছন্দা। বলে কি? এর বয়স তো রমলার দ্বিগুণ । সুছন্দা বললো- কি করে এমন হলো? রমলা যা বললো তার সারমর্ম হলো এই যে,যে কলেজে রমলা পড়ত সে কলেজের প্রফেসর ছিলেন ইনি। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদ চলছিল। সেই সময় ভদ্রলোকের দুঃখের কথা শুনে রমলা স্যারের কষ্টে সহানুভূতি জানাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে । এমন জড়িয়ে পড়ে যে বিয়ে করতে বাড়ির থেকে পালিয়ে গেছে। সেই থেকে মা বাবার সাথে সম্পর্ক নেই। খুবই খারাপ লেগেছে সুছন্দার । এ কেমন প্রেম? মাথায় ঢোকে নি সুছন্দার। তবে প্রফেসর লোকটি খুবই চতুরের চূড়ামনি তা বুঝেছে। ফাঁদ পেতে সরল মেয়েটির সর্বনাশ করেছে। এমন লোকের শায়েস্তা পাড়ার লোকেরই করা উচিত ছিল বলে মনে হয়েছে সুছন্দার। বেশ কয়েক বার সুছন্দা চিঠি দিয়েছে। তারপর বন্ধ হয়ে গেছে । হাতের চিঠিতে নজর দিল সুছন্দা। খুলে ফেলল চিঠি খানা । শান্তিনিকেতন থেকে লিখেছে।
সুছন্দা
অনেক দিন খবরাখবর নেই তোর। আমার স্বামী এক বছর হলো মারা গেছেন। আমি মালদা থেকে শান্তিনিকেতন এ চলে এসেছি। এতো দিন একসাথে থেকে ও তার ভালোবাসা পাইনি। সে আমার দেহটা ব্যবহার করেছে এতো বছর ধরে ।যাইহোক আমার পুরোনো দিন ভুলে একজন আমাকে আপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি আর ঐ খেলায় যেতে চাইনি । তুই তো জানিস গানে ডিপ্লোমা করেছিলাম। গানের টিচার এর কাজ নিয়ে শান্তিনিকেতন এ যাচ্ছি। পারলে একবার আসিস ।
“ইতি
তোর —রমলা ।
চিঠি টা ভাঁজ করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল সুছন্দা ।
কে যেন বেল বাজাচ্ছে ।