ট্রেকার্স (Trekkers) : 06
‘ভ্যালেনটাইনস ডে’, বাবাই একটা বিদেশি চকোলেটের বাক্স পেয়েছে সুন্দর করে প্যাক করা। উপরে একটা লাল ভেলভেটের গোলাপফুল আটকানো। আসলের সঙ্গে তফাত করা যায় না। এক কথায় অপূর্ব। কে পাঠাল? বাবাই রানাঘাটের মেয়ে ছিল এক সময়ে। মফসস্লি। কিন্তু মাধ্যমিকের পর দুর্দান্ত রেজাল্ট করে সেই যে কলকাতামুখো হল, হস্টেলে-হস্টেলে কেটে গেল তিন বছর। চার বছরের মাথায় আর তাকে মফসস্লের বলে চেনা যায় না। গোলপার্কের কাছে একটা প্রাইভেট হস্টেলে থাকে সে। বাবাইয়ের চেহারা পাতলা, নরম। কিন্তু সে তার শহরে বেশ ভাল স্প্রিন্টার বলে নাম করেছিল। খেলাধুলায় অল্পবিস্তর ক্ষমতা অনেকেরই থাকে। কিন্তু সেটা খুব উচ্চস্তরের না হলে চট করে কেউ খেলাটা চালিয়ে যেতে উৎসাহ বোধ করে না। যদি অন্য কোনও উপায় না থাকত, তা হলে হয়তো বাবাই খেলা নিয়ে পড়ে থাকত। কিন্তু সে খুব ভাল রেজাল্ট করল। উচ্চাশার মোড় ঘুরে গেল তারও, তার পরিবারেরও। তার দিদির অনেক দিন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাবা-মা’র একটু বেশি বয়সের সন্তান সে। তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের কিছু স্বপ্ন আছে। তা ছাড়া সে কিছু চায় বললে, সেটা যুক্তিসংগত হলে, বাবা-মা না করতে পারেন না। সুতরাং সে কলকাতায় এসে গেল। প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হল। বাবাই খুব চটপটে, বুদ্ধিমতী, সবই। কিন্তু তবু তার বন্ধু-বান্ধবেরা বুঝতে পারে, বাবাইয়ের মধ্যে মফসস্ল এখনও বেঁচে আছে। সে লো-ওয়েস্ট জিন্স্ পরবে না, মিনিস্কার্ট পরবে না, ভুরু প্লাক করবে না, বেশি রাত করে আড্ডা, আমোদ-প্রমোদেও তার আপত্তি আছে। এগুলোকেই তার বন্ধুরা মফসস্লি মানসিকতা বলে চিহ্নিত করেছে। যদিও শহরেও এরকম মেয়ে হাজারে হাজারে আছে। এইগুলোই যদি সে খুব জোরের সঙ্গে করতে পারত, তা হলে লোকে বলত মেয়েটার ব্যক্তিত্ব আছে। কিন্তু সে বলে, না বাবা না, আমার দরকার নেই। না বাবা না, অত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকলে আমায় হস্টেলে ঢুকতে দেবে না। এ ছাড়াও বাবাইয়ের মধ্যে একটা সরলতা আছে, সে চট করে মানুষকে বিশ্বাসও করে ফেলে। ওভাবে বিশ্বাস করতে নেই জেনেও। এটা স্বভাব। মাঝে মাঝেই তাই প্র্যাকটিক্যাল জোকের শিকার হয় বাবাই। বন্ধুরা তুমুল হাসে। বাবাই মুখে বলে, “যাক, তোদের একটা হাসির সুযোগ তো দিলাম, ধন্যবাদ দে আমায়।” কিন্তু নিভৃতে জিভ কাটে। আর কখনও সে এরকম বোকামি করবে না, প্রতিজ্ঞা করে নিজের কাছে।
আজ এই ‘ভ্যালেনটাইন’ পেয়ে সে প্রথমেই চকোলেটের মোড়কের মধ্যে বালি, নুড়ি ইত্যাদি খুঁজতে লাগল। খুব সাবধানে একটা চাখল তারপর। দারুণ তো? হাত দিয়ে সবগুলো ঘেঁটে মিশিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আর একটা তুলল। এটা আবার অন্য রকম। বাদামে ভরা, চমৎকার। মিষ্টিস্বাদের সঙ্গে বাদামের নিউট্রাল স্বাদ মিশে অনন্য। তার রুমমেট শ্রেয়া এই সময়ে ঘরে ঢুকে দেখে, বাবাই চোখ বুজিয়ে হাঁ করে একটা তেকোনা চকোলেট তুলছে। একটু-একটু করে মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সামনে একটা বাক্স খোলা। ডালার গোলাপ ফুলটাও তার চোখে পড়ল। শ্রেয়া আসানসোলের মেয়ে। একটা বিপিও-তে চাকরি করছে। খুব বেশি সময় পায় না। সে বেরোবে বলে তৈরি হয়ে ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে বাবাইয়ের বিছানার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে শব্দ করে একটা চকোলেটের মোড়ক খুলতে থাকল। মুখে দুষ্টু হাসি। বাবাই চোখ মেলে অপ্রস্তুত। শ্রেয়া বলল, “কী রে, স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করছিস মনে হচ্ছে? একলা খাবি?”
“না রে শ্রেয়াদি। কেউ জোক করেছে কিনা পরীক্ষা করছিলাম। র্যানডম একটা বেছে নিয়ে মুখে পুরছি। এই নে, খা না।” শ্রেয়া অবাক হয়ে বলল, “ভ্যালেনটাইন পাঠিয়েছে কেউ, কে? জোক করবে কেন, তুই কি জামাই? জামাইদের লোকে ঠকায় বলে জানি।”
কাঁচুমাচু মুখ করে বাবাই বলল, “কার্ডে কোনও নাম নেই। কে আবার আমাকে ভ্যালেনটাইন-ফাইন পাঠাতে যাবে? আমি এসবের মধ্যে নেই সবাই জানে।”
“আরে বাবা কোনও নাছোড় রোমিও পাঠিয়েছে। মালদার পার্টি। অন্তরাল থেকে শরক্ষেপ করছে। কাউকে মনে করতে পারছিস?”
“না বাবা। অনেকের সঙ্গেই তো মিশি, স্রেফ বন্ধুত্বের বেসিস।”
“যাক, সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। তুই যদি উইলিং না হোস, কেউ থোড়ি তোকে ফোর্স করছে?”
তার থুতনিটা নেড়ে দিয়ে মা-মাসির কায়দায় শ্রেয়া বলল, “যা চার্মিং তুই, পিছনে লাইন লেগে যেতেই পারে। একদম পাত্তা দিস না। জাস্ট চারদিকে নজর ফেলে রাখবি, আর মন দিয়ে নিজের কেরিয়ার করবি। পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় এসে যাবে বুঝলি তো? প্রেম-ফ্রেম বিয়ে-ফিয়ে আপাতত সিনেই নেই।”
শ্রেয়াদি বেরিয়ে গেল। এইসব ভ্যালেনটাইন-ফাইন অত্যন্ত অর্থহীন, বাজে, খেলো ব্যাপার বাবাইয়ের কাছে। কিন্তু সে দেখেছে, তার বন্ধুদের অনেকেই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে। সে যদি ব্যাপারটার হাস্যকরতা নিয়ে বেশি কথা বলে, শুনতে হয় ‘সেই গাঁইয়াই রয়ে গেলি, জীবনটাকে চেটে-চেটে খেতে শেখ।’ কোনও ছেলে বন্ধুর সঙ্গে একা একা সিনেমা যাওয়া, খেতে যাওয়া, এসব পর্যন্ত করেনি সে। এরা ব্যাপারটাকে ডেটিং বলে। জাস্ট ফান। ওদের কথাই হচ্ছে জাস্ট ফান। এত তাড়াতাড়ি কেউ থোড়ি জীবনসঙ্গী ঠিক করতে যাচ্ছে, জাস্ট ফান।
বাবাইকে বাবা-মা একটা মোবাইল দিয়েছেন। সে উজ্জ্বলকে ফোন করল। উজ্জ্বলকে সে খেলাধুলোর সূত্রে অনেক ছোট থেকে চেনে, “এই উজ্জ্বল, তুই কি আমায় ভ্যালেনটাইন পাঠিয়েছিস?”
“কী পাঠিয়েছি, ভ্যালেনটাইন? আমি? তোকে? বাবাই তোর মাথাটা দেখা।”
“না রে। কে একজন নাম-টাম না দিয়ে পাঠিয়েছে। আমাকে আর কে পাঠাবে ওসব বল।”
“তাই সব ব্যাটাকে ছেড়ে এই বেঁড়ে ব্যাটাকে ধরলি?”
“জাস্ট জিজ্ঞেস করছি, রাগ করছিস কেন বাবা? তোকে না বললে কাকে বলব?”
“বলেছিস ভাল করেছিস, আমি খেয়াল রাখব।”
আসলে এ কথাটা আর কাউকে বললে সে নির্ঘাত ঠাট্টা খাবে। হজম করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বাবাই তৈরি হয়ে কলেজ চলে গেল। কলেজে খুব হইচই। শাশ্বত খুব উত্তেজিত। বলল, “ব্যাপারটা কী বল তো! ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড ইকনমিওয়াইজ স্যাচুরেশন পয়েন্টে চলে গিয়েছে। সব বিজনেস এখন সাবকন্টিনেন্টে। আর ব্রিটিশরাজের অভিজ্ঞতা থেকে এরা জানে যে, এই সাবকন্টিনেন্ট হল বুদ্ধির চেঁকি। বর্ন কাক ইন ময়ূরপুচ্ছ। যা খাওয়াবে, তাই খাবে। ভ্যালেনটাইনটি খাওয়াল, ভাল ব্যাবসা হচ্ছে। গভর্নমেন্টকে কেমিক্যাল হাব খাইয়েছে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার খাইয়েছে, মাইক্রোলেভেলও খাওয়াচ্ছে। জিন্স, ব্যাগি, হটপ্যান্ট, নাইটক্লাব, ড্রাগ, বাচ্চা আর মেয়ে পাচার, কিডনি চুরি, স-ব ওই শালারাই খাইয়েছে।”
“হ্যাঁ, নিজেদের আর কোনও দোষ নেই। সব ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না, বাচ্চা কিনা!”
“দোষ নেই তো বলছি না। প্রথমেই তো বলে দিয়েছি, বর্ন কাক ইন ময়ূরপুচ্ছ।”
“আফটার অল একটা হার্মলেস ফান, এ নিয়ে এত তুলকালাম করার কী আছে?”
ঈপ্সা বলল, “কী রে বাবাই, তোর কী মত?”
“আমি এর মধ্যে কোনও মজা খুঁজে পাই না। কীরকম ফরেন-ফরেন লাগে।”
“ফরেন মানে?”
“ধর, কেউ আমাকে একটা মেল পাঠিয়েছে ক্যালিফর্নিয়া থেকে। আমি কে, কী, কিচ্ছু না জেনে। কিংবা আইসল্যান্ড থেকে। ও মেলটার কোনও মানে আছে আমার কাছে?”
ঈপ্সা বলল, “ইট ডিপেন্ডস। আইসল্যান্ড থেকে কেউ তোর সঙ্গে ভাব করতে চাইছে, ইটস থ্রিলিং না? আমি হলে মেলটার জবাব দেব। আমি কে, কী, সে কে কী এগুলো ক্রমশ প্রকাশ্য। তখন যদি দেখা যায়, আমার সঙ্গে মিলছে না, বন্ধ করে দেব। অত চিন্তার কী আছে? সব কিছুকেই অত ফাইনাল ডিসিশনমার্কা ছাপ্পা দিতে হবে কেন?”
বাবাই বলল, “তুই কোনও ভ্যালেনটাইন পেয়েছিস?”
“লট্স,” ঈপ্সা বলল। “আমার বন্ধুরা সব এক একটা করে পাঠিয়েছে। জাস্ট কার্ডস। দিয়াকে চিনিস তো? দিয়া একটা দারুণ কার্ড পাঠিয়েছে। অশ্বিন বলে একটা বন্ধু আছে সে পাঠিয়েছে, আরও অনেক। আরে আমার পিসি হয় সম্পর্কে আমার থেকে কয়েক মাসের ছোট তিন্নি, ও-ও তো একটা পাঠিয়েছে। আরও আছে। ছাড় তো, বদারেশন। আমিও গুচ্ছের কিনে রেখেছিলুম। কয়েকজনেরটা পেয়ে আবার রিটার্ন কার্ড পাঠাতে হল। যত্ত হুজুগ। তুই ক’টা পেয়েছিস?”
বাবাই হঠাৎ খুব স্মার্ট হয়ে গেল, বলল, “লট্স।”
“তাই, কে-কে দিল?”
“ব্লাইন্ড।”
“মানে?”
“যেমন ব্লাইন্ড ডেট।”
“বলিস কী রে!” ঈপ্সা উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “তা হলে তো সিরিয়াস রে।”
“তুইও যেমন, ঠাট্টা ধরতে পারিস না?”
ঈপ্সা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বাবাই রহস্যময় একটা হাসি দিল। যাক, সে ঈপ্সাকে ভড়কে দিতে পেরেছে। হঠাৎ তার মনে হল, অনায়াসে মিথ্যে কথা বলতে পারাটাই স্মার্টনেসের সবচেয়ে বড় লক্ষণ। ভাল ছাত্রীর মতো পয়েন্টটা সে বুঝে নিল এবং মনে-মনে হাসতে লাগল। আর তাকে কেউ হারাতে পারবে না।
ছুটির সময় ঈপ্সা বলল, “আয় না রে, আমাদের আড্ডায়! আজ উইক ডে বলে শনিবার ফেলেছি। তোর কিচ্ছু ক্ষতি হবে না। উইক-এন্ডে একটু হল্লা করতে না পারলে টিঁকব? বেশি সাধাসাধি করতে পারব না কিন্তু।”
“কোথায়, তোদের আড্ডাটা?”
“এক একবার এক একজনের বাড়িতে হয়।”
“চাঁদা আছে তো?”
“তা তো আছেই। তুই প্রথম গেলে আমার ইনাভাইটি হিসেবে যাবি।”
“কারা আসে?”
“অনেকে, যে যে-দিন পারে। পোস্ট ভ্যালেনটাইন আড্ডা ভালই জমায়েত হবে।”
“ঠিক আছে যাচ্ছি একদিন। দেখি, কেমন লাগে।”
“আমি তোকে নিয়ে যাব,” ইপ্সা বলল, “তোর হস্টেল থেকে তুলে নেব।”