Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেকার্স || Bani Basu » Page 24

ট্রেকার্স || Bani Basu

দিয়ার প্রবল শীত করতে থাকে। বাবাইয়ের শীত করতে থাকে। রেপ ভিকটিম থেকে খুনের আসামি! শাস্তি দেওয়া মানে কী? খুন করতে চাওয়াই তো একরকম! সেই ভিতরের প্রতিহিংসাটাকে আর একটু সামাজিক রূপ দেওয়া, এই তো? খুব জটিল প্রশ্ন। কিন্তু এ-ও তো অদ্ভুত! যে ছেলে তাকে ভ্যালেনটাইন পাঠায়, সে কী করে তাকে ড্রাগ খাইয়ে ধর্ষণ করে? এ তো বিকার, অতি ভয়ংকর। ও যদি তার প্রেমে পড়ত, তা হলে সামনে আসত, বন্ধুত্ব করবার চেষ্টা করত। এটাই তো স্বাভাবিক! প্রত্যাখ্যাত হলে অন্য কথা। কিন্তু ও তো সে পথেই যায়নি! এমন বাঁকা পথ ধরল, যা কোনও স্বাভাবিক মানুষের মাথায় আসবার কথাই নয়। ওই দেবার্ক বা রণদেবের কেস আলাদা। ওরা শুধুই জব্দ করতে চেয়েছিল দিয়ার অহংকারকে, অপমান করতে চেয়েছিল। কিন্তু আরিয়ান? কী মনোবৃত্তি থেকে ও কাজটা করল? বাবাইয়ের টানেই যে ও এই অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দিয়েছিল, এ বিষয়েও সন্দেহ নেই। এই চারটে দিন একসঙ্গে ঘুরেছে, কাটিয়েছে, অনেক সুযোগ দিয়েছে বন্ধুরা ওকে, বাবাইয়ের কাছাকাছি হওয়ার, কথা বলবার। কই? অথচ ঝগড়ার সময়ে স্পষ্ট বলে উঠল, “শি ইজ মাইন!” কী মানে এই কথার? এইসব ঘটনার? এইসব ব্যবহারের? কী মানে এইসব ছেলের?

জ্বরের ঘোরে, প্রবল ক্লান্তির অতলান্ত ঘুমে দু’জনেই স্বপ্ন দেখে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। চারজনের হাতেই হাতকড়া। উজ্জ্বলের ঘাড়ে ওরা চাপিয়ে দিয়েছে একটা ক্রস। অবিকল যিশুর ভঙ্গিতে, বিরাট ক্রুস কাঁধে, সামনে ঝুঁকে পড়ে, সে চলেছে। ভিয়া ডলোরোসা, যন্ত্রণার সেই ঐতিহাসিক পথ ধরে। সবাই হাততালি দিচ্ছে। কেন? উজ্জ্বল শহিদ হচ্ছে বলে? দিয়ার ভিতর থেকে প্রবল কান্নার ঢেউ উঠছে। সে ঘুমের ঘোরেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। বাবাই তার ঘোর লাগা লাল-লাল চোখ দিয়ে দিয়াকে দেখছে। কাঁদছিস কেন? আরিয়ানের জন্য? হি ইজ নো মোর! এ ক’দিনে একটা মায়া জন্মে গিয়েছিল, না?

দিয়া বলল, “স্বপ্ন দেখলাম, উজ্জ্বলকে ক্রুসিফিক্স কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে। তাই…”

“তুই ওকে ভালবাসিস, না রে?”

“প্লিজ বাবাই, বলিস না। শুধু ভালবাসলেই হয় না, মিউচুয়্যাল হওয়া চাই। ও তোকেই…”

“দিয়া, তোকে অনেকবার বলেছি…”

“চুপ কর, ভাইবোনের মতো, ভাইবোন তো নয়। দেখলি না, তোর জন্যে কেমন জান লড়িয়ে দিল। এখন শহিদ হতে চলেছে।”

“কী উলটোপালটা বকছিস! স্বপ্নের সঙ্গে রিয়্যালিটি গুলিয়ে ফেলছিস?” বলেই বাবাই স্বপ্নের মধ্যেই বুঝতে পারে, ওটাও তার স্বপ্ন ছিল। দিয়া ঘুমিয়ে যাচ্ছে, ন্যাকড়ার পুতুলের মতো। শুকতারার সার্ভিস, ডাবল ফল্ট করল, তার পয়েন্ট। অ্যাডভান্টেজ শুকতারা। কে হাঁকছে? অ্যাডভান্টেজ বাবাই কেউ বলছে না। পুলিশের গাড়িতেও দিয়া ঘুমিয়ে যাচ্ছে। একজন পুলিশ বলল, “ও তো মরে গিয়েছে। দুটো ডেডবডি একসঙ্গে স্বর্গে যাচ্ছে।”

দিয়া ঝুঁকে পড়ল বাবাইয়ের উপর। “কী বিজবিজ করছিস? কারা স্বর্গে যাবে? কে যাবে, কে যাবে না, আমি দিয়া ঘোষাল ঠিক করে দেব। প্ল্যানটা কার? উজ্জ্বলের না রূপের? রূপরাজ?”

“হলেই বা, আমরা সবাই ডিসকাস করেছি। একা ওর দায় নাকি?”

“তুই কেন রূপের সাফাই গাইছিস? রূপই তো আমাদের এমন বিপদে ফেলল, সক্কলে একসঙ্গে পুলিশবাড়ি যাব। আদমসুমারি হবে, ছাড়া পাব কি না… জানিস তো শুকতারা রাজসাক্ষী হয়েছে?”

“ধ্যাৎ, শুকতারা তো জজ। ও কি আর আমাদের ডেথ সেন্টেন্স দেবে? আফটার অল বন্ধু তো।”

দিয়া ভ্যাংচাল, “আফটার অল বন্ধু তো! আরিয়ানকে কেন মারলি? আফটার অল বন্ধু তো!”

সমস্ত স্বপ্নটাই বাবাই দেখছিল নাকি দিয়াই? দু’জনের স্বপ্ন কি মিশে গেল?

বেলা তিনটের সময়ে কাকতাড়ুয়ার চেহারায় ফিরে এসে উজ্জ্বল আর রূপ ওদের এই অবস্থায় দেখল। বিশাল জ্বর। ভুল বকছে। দুটো মেয়েই।

“হোপলেস,” ওরা মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে।

“এই দিয়া, এই বাবাই,” দু’জনে প্রাণপণে ডাকে। মাথা ধুইয়ে দেয়। বাবাইয়ের খাতা দিয়ে জোরে জোরে পাখা করে। “শিগগির উঠে বোস। ওষুধ গিলতে হবে।”

উজ্জ্বল কাঠ-কুটো জ্বালিয়ে চা করে। বিশেষ কিছু নেই, মুড়মুড় করে বিস্কুট খায় দু’জনে। তারপর মুণ্ডা বসতির দিকে চলে যায়। ওদের সাহায্যে পাহাড় থেকে নামতে রাত হয়ে যায়। ওরা ওদের খাটুলিতে করে দুটি অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে মাঠাবুরুর বনবাংলোয় পৌঁছায়, শেষ রাতে। প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে। এখান থেকে যোগাযোগগুলো করা যায়, ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন, থানা, হাসপাতাল। দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে উদ্ধারের আর্তি পৌঁছে যায় সদর থানায়। ‘রূপসী বাংলা’ ধরে কলকাতায় ফেরা। নার্সিংহোম, আবারও সেই ডক্টর সেন।

দুর্ঘটনার খবর পুলিশকে জানানো হয়েছে, যত শিগগির সম্ভব। ‘পুরুলিয়া ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন’ও ওদের গতিবিধি সম্পর্কে যথেষ্ট জানে। তবু পুলিশের সওয়াল থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। পুলিশ মুণ্ডাবসতিতে গিয়ে ওদের সম্পর্কে প্রশ্ন করছে। তার চেয়েও কঠিন বাড়িতে জবাবদিহি, পরিচিতজনের কৌতূহলী মুখ। মিডিয়ার কল্যাণে তাদের মুখগুলো এখন সবার চেনা। যে-যার মতো নিজের মতো ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তাইতে বিশ্বাস করছে। ত্রিকোণ প্রেম, দুটো, হতেই হবে। এর বাইরে জনগণের কল্পনা কাজ করে না। আরিয়ানকে যারা চিনত, তারা ছবিটা মিলিয়ে নিতে পারছে। মরিয়া ধরনের, চালবাজ, স্পয়েল্ট বরাবর। কিন্তু বাবাইকে, দিয়াকে যারা চিনত, তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। ছবি এক্ষেত্রে মিলছে না। রূপের বাড়িতে কোণঠাসা অবস্থা। উজ্জ্বল ফিরে গিয়েছে সোজা তার হস্টেলে। কিন্তু তার বাবা-মা তাকে তাড়া করেছেন সেখানে। উজ্জ্বল শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে, এরকম জিনিস আর হবে না। যেখানে যাবে, বলে যাবে, কোথায়, কতদিন, কাদের সঙ্গে। সবাইকারই ধারণা, ছেলেমেয়েরা পরস্পরের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যেই না বলে পালিয়েছিল। পরিষ্কার সেক্স অ্যাঙ্গল আছে, ওদের গল্পটাতে। অত দূরে, বন্য জায়গায়, শুধু সেক্সটুকুর জন্যে কেন যেতে হবে? এটা কেউ ভাবছে না। এই জনগণ জানে না, ‘ক্রাশ’-এর মতো ক্লাবে, নানান রিসর্টে, এমনকী, এইসব ছেলেমেয়েদের শূন্য বাড়িতেও, যৌন মজা উপভোগ করার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধে বর্তমান।

আরিয়ানের দেহাবশেষের শেষকৃত্য হয়ে গেছে। শ্মশান থেকে ফিরে সকলেই যে-যার বাড়িতে গিয়ে চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। কথা বলার ইচ্ছে নেই। দু’দিন পরে শুকতারার বাড়িতে জমায়েত। এখন পাঁচজন।

লনে চেয়ার। শুকতারা বলল, “চা না কফি?”

বিকেল বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। ছাঁটা ঘাসের উপর জলের ফোঁটা চিকচিক করছে। ঘাসের গন্ধ বেরোচ্ছে। সেই সঙ্গে বিকেলের গন্ধ। বিকেলের একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধও আছে। এই কলকাতা, এইসব পথঘাট, এই ছাঁটা ঘাসের লন, বিকেলের ডিজেল-মেশা সোঁদা গন্ধ, গাড়ি-গাড়ি-গাড়ি, সবই যেন বহুদূরের। কেমন অবাস্তব! দশদিনের, ট্রেন যাত্রা ধরলে, বারোদিনের অভিজ্ঞতাটা যদি বাস্তব হয়, তা হলে এই শহর, এর রুটিন কী করে বাস্তব হতে পারে? এই বিস্ময়, বিভ্রান্তি, চার জনের চোখেমুখে শিশিরের মতো লেগে আছে। দুটো অভিজ্ঞতার মাঝখানে যে দৌড়ঝাঁপ, ট্রেকিং অ্যাসোসিয়েশন, হাসপাতাল, থানা-পুলিশ, জবানবন্দি, কাগজে-কাগজে নিজেদের ছবি, খুন না আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা: ব্রেকিং নিউজ টিভি-র চ্যানেলে-চ্যানেলে। সমস্ত চ্যানেল হুমড়ি খেয়ে পড়ছে চারজনের ওপর, যেন ঘেরাও করছে, পিষে ফেলছে, এটাই বা কী? রিয়্যাল?

“চা না কফি?”

“এনিথিং।”

“কাজু-কেক-পেস্ট্রি-স্যান্ডউইচ?”

কেউ কোনও কথা বলল না।

“তোরা অমন মুখ শুকিয়ে আছিস কেন?” শুকতারা বলল। “দেখ শ্রাদ্ধের পরে একটা নিয়মভঙ্গ বলে অনুষ্ঠান তো আছে। লেটস হ্যাভ সাম গুডিজ।”

সামনে দাঁড়ানো বেয়ারা জাতীয় লোকটিকে নির্দেশ দিল শুকতারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভর্তি পট, কাপ, প্লেট, চামচ, বিস্কিট, কেক, স্যান্ডউইচ…

“সকলেই ব্ল্যাক তো? খালি দিয়ার একগঙ্গা দুধ চাই। না রে?” শুক কি একটু হাসবার চেষ্টা করছে।

দিয়া বলল, “তোকে বলতে হবে, কেন দুম করে ফিরে এলি?” সে অত সহজে ভুলছে না।

“সত্যি বলছি, আমি প্রচণ্ড কুঁড়ে। একদম কামচোর। ক্রিচার কমফর্টস ভীষণ জরুরি আমার কাছে।”

“তা হলে গেলি কেন? গোড়া থেকেই তো না করতে পারতিস?”

“রিয়্যালাইজ করিনি। ঝোপেঝাড়ে কম্মো করতে গিয়েই বুঝলাম। একটা পোকা অস্থানে-কুস্থানে এইসা কামড়ে দিল।” হেসে উঠল শুকতারা অল্প একটু, থামল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের রাঙানো নখগুলো দেখতে দেখতে আস্তে বলল, “আমি না গেলে আরিয়ান যেত না। আমি চাইছিলাম, ও যাক, শাস্তি পাক। কিন্তু ওর শাস্তির সময়ে আমি কী করে উপস্থিত থাকব? ভেরি অকওয়ার্ড। ও যে আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করত।” হঠাৎ সে বড় বড় চোখে একটু তেরছা করে উজ্জ্বলের দিকে তাকাল, “সত্যি করে বল তো, ওকে মেরেছিস? হ্যাভ ইউ পিপল রিয়্যালি কিলড হিম? মেরে থাকলে আমার কিছু বলার নেই। পুলিশকে বলে দেওয়ার মতো নীচও আমি নই। বাট আই ওয়ান্ট টু নো দা ট্রুথ।”

রূপ খুব আহত চোখে তার দিকে চেয়ে রইল, “আমাদের খুনি বলে মনে হয় তোর? ছোট থেকে না হলেও কিছুটা তো চিনেছিস। এইটুকু বিশ্বাসও কি আশা করতে পারি না আমরা তোর কাছে?”

বাকি তিনজন কোনও কথাই বলল না। ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে কেউ কেউ নামিয়ে রাখছে কাপটা।

উজ্জ্বল হঠাৎ তার শার্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট ক্যাসেট বের করল, “দিয়া, ডিক্টাফোনটা এনেছিস?”

পুঁচকে জিনিসটা টেবিলের উপর রাখল দিয়া। ক্যাসেট ভরল, চালিয়ে দিল। সমবেত কণ্ঠে বেজে উঠল, আহা! আহা! কী রেঁধেছিস রে!

তোর এ গুণ আছে জানতুম না তো! …দূর, আমি রান্নার কী জানি!

সেই বিগিনার্স লাক বলে একটা কথা আছে না…

আমিও পারি, আমায়ও একটা চান্স দে।

হিংসে হচ্ছে নাকি? স্পষ্ট আরিয়ানের গলা।

ক্যাসেট চলছেই চলছেই। প্রত্যেকের গলা স্পষ্ট। পশ্চাৎপটে ঝিঁঝির আবহ সঙ্গীত পর্যন্ত কান পাতলে শোনা যায়। পাতার সরসর। কী একটা পাখি ডেকে গেল।

শি ইজ মাইন, আরিয়ানের গলা।

তাই কি ওকে ড্রাগ খাইয়ে রেপ করেছিলি? রূপরাজ।

কোন সোয়াইন বলেছে? কে? রণবীর? দেব?

সমস্ত বলে দিয়েছে। তুই ভাবছিস তোর ‘ক্রাশ’ ক্লাবের ওই লম্পটগুলো তোকে প্রোটেকশন দেবে? ইউ আর স্যাডলি মিসটেকেন…

অবশেষে উজ্জ্বলের গলা, ব্যস আমাদের কাজ কমপ্লিট।

আমরা তোকে মিছিমিছি মারধর করতে চাই না। জাস্ট আইনের হাতে তুলে দেব।

মন দিয়ে শুনছিল শুকতারা, বলল, “তারপর?”

রূপ বলল, “আমাদের ওর কনফেশন আর রণবীরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যটা দরকার ছিল। আর রেকর্ড করিনি। ওই মদের বোতলটাই ওর সর্বনাশ করল। ওটা না থাকলে ওর বোল্ডারে বসার সাধ হত না।

উজ্জ্বল বলল, “সেটা বলা যায় না। হি ওয়াজ ফিলিং এক্সপোজড, আইসোলেটেড। ছিপছিপে জলের মধ্যে একটা বড় সাইজের বাদামি-কালো বোল্ডার। ইচ্ছে হতেই পারে। আসলে ওই আনএক্সপেক্টেড জলের তোড়টা। উপর দিকে হেভি বৃষ্টি হয়েছিল। আমরা নীচে অতটা টের পাইনি। চোখের সামনে দেখলুম, ঝোরার জল বেড়ে গেল। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে এল জল, খ্যাপা বানের মতো। ড্রাঙ্ক, অর নট ড্রাঙ্ক, ওই কিলার ঝোরার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া তখন অসম্ভব। কী ধার! কী তোড়! বাপ রে! এক যদি আমাদের দড়িটা ও ধরতে পারত।”

“দড়ি? দড়ি নিয়ে গিয়েছিলি কেন?” শুকতারা কেমন খাপছাড়া ভাবে প্রশ্ন করল। “আগে থেকেই জানতিস বুঝি, আরিয়ান ঝোরায় ভেসে যাবে, দড়ি ছুড়তে হবে।”

“কী আশ্চর্য!” হতাশ মুখ করে উজ্জ্বল বলল। “ট্রেকিং-এ যাচ্ছি। পুরো সেট আর অ্যাডভাইস নিচ্ছি পুরুলিয়ার অ্যাসোসিয়েশন থেকে, দড়ি, দড়ির মই, হাতুড়ি, হুক, সব থাকবে। থাকবে না? তুইও তো ছিলি সঙ্গে। এখনও কি আমাদের সন্দেহ করেই যাচ্ছিস? ভেরি ভেরি আনফর্চুনেট!”

“তা ঠিক নয়,” শুকতারা শূন্যের দিকে চেয়ে বলল। “পুলিশ তো তোদের প্রশ্নগুলো করতে পারে।”

রূপ উজ্জ্বলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ট্রেকিং-এর সরঞ্জাম নিয়ে পুলিশের মনে কোনও সংশয় নেই শুকস। ওদের খটকাটা অন্য জায়গায়। প্রথম, তুমি কেন মাঝপথে চলে এলে? আর দ্বিতীয়, আমরা কেউ বাড়িতে ডিটেল কিছু বলিনি কেন? দেখো দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেওয়া যায়, আমরা এই জেনারেশন তো অলরেডি নোটোরিয়াস ফর আওয়ার রেকলেসনেস। আর নট উই? কে অত বলা-কওয়ার ধার ধারে। অবাধ্য এই একটা, প্লাস সঙ্গে মেয়েরা থাকছে। মেয়েদের সঙ্গে ছেলেরা, বাড়িতে মধ্যযুগীয় আপত্তি হতে পারে। সহজ জিনিসকে ঘোরালো করে দেখতে তো গার্জেনদের জুড়ি নেই! কিন্তু শুক, তোমার মাঝপথে চলে আসাটা কেউ ভাল বুঝতে পারছে না। রোম্যান্টিক মান-অভিমানের একটা অ্যাঙ্গল দিচ্ছে।”

শুকতারা আধখানা চোখে চেয়ে বলল, “আমার কৈফিয়ত আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি। নতুন কিছু বলবার নেই। বাই এভরিবডি।”

সে উঠে দাঁড়াল। অন্যরাও। পুরোটাই যেন হঠাৎ।

টেবিলের ওপর কেক-পেস্ট্রি-বিস্কিট-স্যান্ডউইচের দল অসহায়, অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। আধ-খাওয়া, সিকি-খাওয়া, একেবারে না ছোঁয়া কফির কাপ।

শুকতারা পিছন ফিরে চলে যাচ্ছে। ওর সাদা টপটা, নীল রঙের ট্র্যাকস-এর ওপর কেমন ঝুলছে। দিয়া হঠাৎ কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল। বলল, “শুকস, কাঁদছিস কেন? তোকে কি এ দুর্বলতা মানায়? বিশ্বাস কর, আমাদের সবার মন খারাপ, ভীষণ।”

একটু থমকে দাঁড়াল শুকতারা। তারপর চলে গেল, খুব তাড়াতাড়ি। নিঃশব্দে সবাই বেরিয়ে এল।

প্রায় জনহীন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। এখান থেকে দিয়ার বাড়ি হাঁটা পথ। ভরা গ্রীষ্ম এখন। বসন্ত এখানে পথ ভুলে আসে। ক’টা দিন পলাশ-কুসুম ফুটিয়ে চলে যায়। তারপর এ-বঙ্গ গ্রীষ্মের কবলে। সে চৈত্রই হোক, আর ফাল্গুনই হোক, ক্যালেন্ডারে। খুব সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে এবার। গাছগুলো দুলছে, দেবদারু, গুলঞ্চ, দোলনচাঁপা, কৃষ্ণচূড়ার পাতা কেমন যেন রোমাঞ্চিত, থিরথির করে কাঁপছে।

বাবাই বলল, “দিয়া, তুই ঠিক দেখেছিস? শুকতারা কাঁদছিল? আমি ভাবতে পারছি না, শুককে কাঁদতে দেখব। অত শক্ত মেয়ে!”

দিয়া বলল, “তোরা তো কিছুই বুঝিস না। শি ওয়াজ ইন লভ উইথ আরিয়ান। তোর ওপর আক্রমণটাই বা ও কেমন করে মানবে? ওর মৃত্যুটাই বা কেমন করে সইবে? ওর দোটানাটা আজ দেখেও বুঝলি না?”

সকলেই পথের উপর থেমে গেল, যেন বজ্রপাত হয়েছে।

“যদি জানতিস, আগে বলিসনি কেন?” উজ্জ্বল আর রূপ একসঙ্গে বলে উঠল।

“জানতাম না তো! আজই চোখের সামনে দেখে জানলাম। দু’জনে একসঙ্গে পড়ে, একসঙ্গে অনেক জায়গায় যায়। তো কী? এ রকম ওয়র্কিং রিলেশনশিপ হাজারটা আছে। আরিয়ানও এভাবেই নিয়েছিল। ইনসিনসিয়ার ফুল একটা! শুকস ওয়জ ডিফরেন্ট। তা ছাড়া জানলেই বা কী করতিস? শাস্তিটা দিতিস না? মাফ করে দিতিস? তাতেও সবচেয়ে আপত্তি হত শুকেরই। এসব অপরাধের ক্ষমা নেই। ক্ষমা হয় না। আমরা আর কী শাস্তি দিয়েছি? একটা কনফেশন আদায় করেছি বই তো নয়। আসল শাস্তি যে দেওয়ার, সে-ই দিয়েছে।”

“আমরা কেউ কিছু বুঝলুম না, তুই বুঝলি?” ক্ষীণ গলায় রূপ বলল।

“তোরা ছেলেরা কিছু মনে করিসনি, জন্মবোকা। তোরা কিছুই কোনওদিন বুঝিসনি, বুঝবি না। কারণ, বেসিক্যালি বুঝতে চাস না।”

দিয়া ওদের ছেড়ে বাড়ির দিকে চলে গেল জোর কদমে। তার এই চলে যাওয়াটা দেখাল একেবারে শুকতারার মতো। একলা, মাথা উঁচু, কিছু গোপন করছে। এই গোপন করার মধ্যেই যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বাবাই উজ্জ্বলের দিকে তাকায়, উজ্জ্বল বাবাইয়ের দিকে। রূপরাজ ঈষৎ বিভ্রান্ত, ওদের দু’জনের দিকে। তারপর ওদের ভেদ করে শুকতারার দিকে, আরিয়ানের দিকে। তিনজন, পাঁচজন, না ছ’জনকে ঘিরেই পাক খায় পাহাড়ি নির্জনতা, ধামসা-মাদলের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, মহুয়ার গন্ধ। আধুনিক শহরের ভুলভুলাইয়ায় যা বোঝা যায় না সেইসব শব্দ, সেইসব বোধ এক গভীর পাহাড়ের ভুরুর দিক থেকে এক দণ্ড চেয়ে থাকে তাদের দিকে। তারপর পাগলা ঝোরার মতো ঝাঁপিয়ে আসে, ভাসিয়ে দেয়, বোল্ডারে-বোল্ডারে ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে যায় সব। ঠেকতেই হবে নিরাপদ ডাঙায়। সেভ আওয়ার সোলস, সেভ আওয়ার সোলস, এসওএস ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, রেডিয়ো ওয়েভে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress