ট্রেকার্স (Trekkers) : 19
বর্ষা আর আসছেই না। ছোটখাটো বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু বর্ষা নয়। জুন শেষ হতে চলল। এই শোনা যাচ্ছে, সে আন্দামানে এসে গিয়েছে, এই শোনা যাচ্ছে কেরলে। কিন্তু কোথায় কী! তবে ঝড় উঠছে বিনা নোটিসে। প্রবল গরম তিন কি চার দিন, তারপরেই ঝটপট, ধেয়ে আসে গোঁয়ার ঝড়। বেশ কিছু গাছ পড়ে, যানজট হয়, কিছু মানুষ মারা যায়, তারপর আবার যথারীতি তাপমাত্রা উঠতে থাকে। অথচ ধ্রুবজ্যোতি এবারে ভীষণ ব্যগ্র প্রকৃত বর্ষার চেহারা দেখতে। অকাল বর্ষা বা বৃষ্টি আর বর্ষাকালের বৃষ্টির তফাতটা ঠিক কোথায়, তিনি সরেজমিনে তদন্ত করতে চান। লোককে বললে হাসবে। লোকটার ষাটের বেশি বয়স হয়ে গেল, এতগুলো বর্ষা দেখল, ফাল্গুন কিংবা আশ্বিনের হঠাৎ-বাদলও বহুবার এঁর দেখার কথা, আসল আষাঢ়ে, শ্রাবণী, ভাদুরে বর্ষার তো প্রশ্নই ওঠে না ঠিকই। কিন্তু ধ্রুবজ্যোতি তবু মনে করছেন, তাঁর সেভাবে অকালবাদল আর আসলবাদল দেখা হয়নি।
হায়ার সেকেন্ডারিতে মিলু বেশ ভালই করেছে। যদিও সংযুক্তা মনে করেন, ওর বাংলা পেপারের প্রতি পরীক্ষক সুবিচার করেননি। তবু বাংলা অনার্স নিয়ে জেইউ-তে ভর্তি হতে ওর অসুবিধে হল না। ভাল হবে এখন এমএ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে চলে যাবে।
সংযুক্তা প্রথমেই বলে দিলেন, “কো-এড, মিলু নিজেকে ‘সাবধান সাবধান’ বলবি।”
মিলু রীতিমতো তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাকাল সংযুক্তার দিকে। যেন বলতে চাইছে, কী ভাবো তুমি আমায়? এত কিছুর পরও আমি…
মিলু যে পুরুষজাতীয় কাউকে বিশ্বাস করে না, তাদের প্রতি যে তার সীমাহীন ঘৃণা, একমাত্র বাবা ছাড়া, এ-কথা ধ্রুবজ্যোতি আন্দাজ করতে পারেন। সংযুক্তা এখনও পারেন না। তাঁর ভয় ‘বয়সকাল’কে। বয়সকালের হরমোন মানুষকে বড্ড বিভ্রান্ত করে, বিধ্বস্ত করে। এই ভাবনায় তিনি মিলুর সঙ্গে বেশ একটা সমবয়সিসুলভ দোস্তি পাতিয়ে ফেলেছেন, যাতে মিলু তার মনের-প্রাণের কথা তাঁকে বলে। রকম দেখে ধ্রুবজ্যোতি হাসেন, কিন্তু মিলুকে নিয়ে তিনিও একটু ত্রস্ত, অন্য কারণে। পটকা এবং কটাগোবিন্দর খুনের কিনারা পুলিশ করতে পারেনি। কিন্তু ঘরে কোনও তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির প্রমাণ তারা পেয়েছে। তৃতীয় ব্যক্তি সম্ভবত মেয়ে, কেননা তারা ঘরে একটি মেয়ের ক্লিপ পেয়েছে। হাতের ছাপ নেই, পায়ের ছাপও কোথাও নেই। কিন্তু তাঁর ভয় হচ্ছে, সত্যিই কি নেই? পুলিশ সব প্রমাণের কথা তো বলে না! মেয়েটা যে পালিয়ে এল কাপড়ে অত রক্ত নিয়ে, পথে কি তার কোনও চিহ্ন ফেলে আসেনি? আসলে খুনটা আবিষ্কৃত হয়েছে তিনদিন পর, তার মধ্যে সব চিহ্ন ধুয়েমুছে গিয়েছে রাস্তাঘাটে। কিন্তু ঘরে? এবং পুলিশ ছাড়া, গুন্ডাগুলোর কোনও লোক যদি জেনে থাকে?
দুটো কুখ্যাত গুন্ডা খুন হয়েছে, ওম শান্তি। এ নিয়ে পুলিশের এত মাথা ঘামাবার দরকারই বা কী! কটাগোবিন্দ তিনবার খুনের দায়ে জেল খেটেছে। প্রত্যেকটা খুনই অনিচ্ছাকৃত বলে রায় দিয়েছে আদালত। ইচ্ছাকৃত হলেই বা কী! সাংঘাতিকের চেয়েও সাংঘাতিক নয় বলে কতজনেরই তো মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে না। কটাগোবিন্দর পিছনে কোন রঙের পলিটিক্স রয়েছে, তা-ও তো জানা যাচ্ছে না। মরেছে আপদ গিয়েছে, কাঁহাতক আর জনগণের পয়সায় খুনে পোষা যায়! কিন্তু ভয় তো তবু যায় না। মিলু আপত্তি করলেও তিনি শোনেন না। তাকে কম্পিউটার ক্লাসে পৌঁছে দেওয়া আর নিয়ে আসা তাঁর একটা কাজ হয়েছে। মেন গেটে মিলু নেমে যায়, তিনি আর একটা স্টপ গিয়ে নেমে পড়েন, ফেরত বাসে ফিরে আসেন। ছুটির সময় উল্টো দিকে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকেন। মিলু রাস্তা ক্রস করলেই দু’জনে প্রথম বাসে উঠে পড়েন। এগুলো মিলুকে বন্ধুবান্ধবদের কাছে লজ্জা থেকে বাঁচাতে। এ ছাড়াও একটি কাজ তিনি সংযুক্তার সঙ্গে মিলে যুক্তি করে করেছেন। মিলুর ঝাঁকড়া চুল ছোট, প্রায় বয়কাট করে দেওয়া হয়েছে। তার চোখে পাওয়ার নেই কিন্তু পাওয়ারলেস মোটা ফ্রেমের চশমা পরছে সে। কলেজে যায় ঘাঘরা, মিডি-স্কার্ট কিংবা জিনস-টপ পরে। তাকে সত্যিই আর পুরনো মিলু বলে চেনা যাচ্ছে না। আগে সে শাড়ি আর সালোয়ার ছাড়া কিছু পরত না। স্কুলেও শাড়িই ইউনিফর্ম ছিল। এই পরিবর্তনে মিলুরই সবচেয়ে কম সায় ছিল, বিশেষ করে জিন্স পরে হাঁটার সাহসই সে অনেকদিন পায়নি। অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে, বাড়িতে প্র্যাকটিস করে, জিনিসটা চালু করতে হয়েছে। তবে ক্রমশ স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছে সে।
বিজয় সুর তাঁর সেই প্রতিবেশী, একদিন খপাত করে ধরলেন তাঁকে।
“বুঝলেন দাদা, এদের লাই দিতে নেই।”
“কাদের কথা বলছেন?”
“এই ধরুন, ঝিয়ের মেয়ে-টেয়ে…ফ্যাশন কী ধরেছে, খেয়াল করেছেন? আপনার ওই…”
“কী, ঝিয়ের মেয়ে? প্লিজ বিজয়বাবু, ও কথাটা আর বলবেন না, বিশ্রী লাগে। মেয়েটিকে আমরা নিজের মেয়ের মতো পালন করছি। আবার যদি কথাটা বলেন, আমি অফেনস নেব। কী ফ্যাশন দেখলেন?”
“বাঃ চুলের কাট কী! চশমা পরে, প্যান্টুলুন পরে, যখন হেঁটে যায়, আমার-আপনার মেয়ের সঙ্গে তফাত ধরতে পারবেন না।”
“বাংলায় কত পেয়েছে জানেন? বাহাত্তর পারসেন্ট। ওর মা বলছে, আরও বেশি পাওয়া উচিত ছিল।”
“বলেন কী? তবে ইংরিজি, নিশ্চয় ধেড়িয়েছে?”
“সেভেনটি পার্সেন্ট।”
“বলেন কী? ও তো তৃণাকে ছাড়িয়ে গেল তা হলে। কবে থেকে বলছি দাদা, আমার মেয়েটাকে একটু কোচ করে দিন।”
“আরে আপনার তৃণা চমৎকার মেয়ে। পিছনে লেগে থাকাটা একটু বন্ধ করুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মিলুর বাংলা ও ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে সংযুক্তা এমন পড়লেন যে, ধ্রুবজ্যোতি জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলেন, “কী গো, ওকে দিয়ে কি খবর পড়াবে?”
উত্তরে সংযুক্তা একটা রহস্যময় হাসি দিলেন।
গানের জন্য বাড়িতেই এক উচ্চাঙ্গ সংগীতের ট্রেনারকে রেখে দিলেন ধ্রুব। অতবার নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসার হাঙ্গামা পোষায় না। মিলুর একটা গুণ হল, সে খুব বাধ্য। গান, লেখাপড়া দুটোই সে ভালবাসে, উপভোগ করে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে রবীন্দ্রসংগীত শিখতে চাইছিল অথচ বাবা তাকে এক ক্ল্যাসিক্যাল ট্রেনার এনে দিলেন। কিন্তু বাবা যখন তাকে বোঝালেন যে, গানের ভিত্তি আগে তৈরি করে নিতে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক দরকার, তখন ভাল না লাগা সত্ত্বেও সে মেনে নিল এবং অচিরেই দেখা গেল সে রাগসঙ্গীতে মজেছে। ভাল পারছে না। কিন্তু রেডিও খুলে শুনছে। মিলুর গলার আওয়াজ খুব পরিষ্কার নয়, অথচ ভাব আছে খুব। মাস্টারমশাই তাকে ক্রমাগতই পালটা সাধাচ্ছেন। জিনিসটা ক্লান্তিকর কিন্তু মিলুর অধ্যবসায় দেখার মতো।
ভোল, ভোল মিলু, ভুলে যা কোথায় জন্মেছিলি। কে তোকে বিক্রি করে দিয়েছিল, সেখানকার ক্লিন্ন অভিজ্ঞতা, ভুলে যা। দারোগার বুটের লাথি, দারোগা-গিন্নির চাবির বাড়ি, ভুলে যা। সব ভোলবার পর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সময়ে আবার ফিরে-ফিরে আসা সেই একই চেহারার পৃথিবীতে। সবচেয়ে জরুরি ভুলে যাওয়া, তুই দুটো মানুষকে খুন করতে বাধ্য হয়েছিলি।
তবু কোনও-কোনও রাত্তিরবেলায় মিলু ঘুমোতে-ঘুমোতে হঠাৎ কঁকিয়ে ওঠে। সংযুক্তা বলেন, “দুঃস্বপ্ন দেখছিস, পাশ ফিরে শো।”
“না, বাবাকে ডাকো,” মিলু এমন করে বলে যেন, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ধ্রুব আসেন। “কী হল?”
“বলো আগে আমায় ধরিয়ে দেবে না?”
“প্রশ্নই নেই, মিলু আমি মনে করি তুই ঠিক কাজ করেছিস।”
“পুলিশে যদি আমায় খুঁজে বার করে?”
“চান্স নেই,” নিজের মনের সংশয় সত্ত্বেও ধ্রুব বলেন।
মিলু আস্তে-আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে প্রায়ই একটা হালকা ঘুমের ওষুধ দিতে হয়। মিলুর জন্যে যোগব্যায়ামের শিক্ষকও রেখে দিলেন ধ্রুব। মহিলা। এবং অবশেষে এই বুড়ো বয়সে একটা গাড়ি কিনলেন, ছোট গাড়ি। তিনজনে আরামসে ঘুরে বেড়ানো যাবে।
অবশেষে বর্ষা এলেন, ভোরবেলা লেকের ধার থেকে ভদ্রমহিলাকে দেখলেন ধ্রুবজ্যোতি। ভুষো কালির রং। প্রবল মোটা। থাকে থাকে চর্বি। পেট, পিঠ, কোমর আলাদা করা যায় না। গম্ভীর, কতটা রাগী এখনও বোঝা যাচ্ছে না। পশ্চিমদিক থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসছেন। দেখতে-দেখতে ছেয়ে গেল গোটা আকাশ। বিদ্যুৎ চিড়িক মারতে লাগল। মনু দীক্ষিত বললেন, “ফিরুন দাদা। ওরে ব্বাপ! মেঘ তো নয়, পাহাড় একটা।”
টপটপ করে জল পড়তে লাগল। ঠিক যেন কেউ কাঁদছে। ছাতা নেই, বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন ধ্রুবজ্যোতি। রাস্তা পার হতে না হতেই আকাশ ভেঙে পড়ল। কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। গরম জলে চান, আদা দিয়ে চা। কিছুতেই কিছু না। মাথা টিপটিপ করছে, চোখে জ্বালা, নির্ঘাত জ্বর আসছে। আরও এক কাপ দিবি মিলু? মিলু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ে আসে, “কেন যে ছাতা নিয়ে বেরোও না।”
“আরে তুক আছে, আমি ছাতা নিলে বৃষ্টি পড়ে না।”
“কী জানি বাবা, আমি তো বরাবর উলটোটাই শুনেছি,” সংযুক্তা বললেন।
“আমি আসলে বর্ষার বৃষ্টি আর এই চৈত-ফাগুনের বৃষ্টির তফাতটা ধরতে চাইছিলুম,” কেন কথাটা বললেন, কেন এ-তফাত ধরতে চান ধ্রুব নিজে জানেন। আর কেউ তো জানে না।
তাই সংযুক্তা হেসে কূল পান না, “তার জন্যে ভিজতে হল, তুমি যে কী বোকা।”
মিলু বলল, “চৈত-ফাগুনের বিষ্টি খুব লোক্যালাইজড হয়, বাবা। ঘনঘটা থাকে না। যখন হল, খুব বীরবিক্রমে হল। তারপর যেই হয়ে গেল, আকাশ যেমনকে তেমন। দিনের বেলা হলে রোদ-ঝিকমিক, রাত হলে তারা-চিকমিক। জমি সে জলটুকু শুষেও নেয়।
ধ্রুব সংযুক্তার সঙ্গে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কী সুন্দর বলল।
যেমনকে তেমন। রোদ ঝিকমিক, তারা চিকমিক!
ওপার বাংলার অখ্যাত সেই গ্রাম কি ভাবতে পেরেছিল তার অবহেলা, নির্যাতনের পাঁশকুড়ো থেকে এমন আকাশ দেখা যাবে? আকাশটা কি তাঁরা মিলুকে দিলেন না, সেটা ওর ভেতরেই ছিল? মনে পড়ে যায়, সেই শিল্পীর কথা—কেমন করে অত বড় পাথরে মূর্তিটা গড়লেন? শিল্পী বললেন, “মূর্তিটা পাথরেই ছিল, চারপাশে থেকে অতিরিক্তটুকু খালি ছেঁটে দিয়েছি।”
“নাঃ, বেশ ফ্যাঁচফ্যাচানি হচ্ছে, ধ্যাত্তেরি।”
“ভাপ নাও একটু,” সংযুক্তা বললেন।
“আবার ভাপ?”
মিলু গরম জলের কেটলি নিয়ে এল, সংযুক্তা তোয়ালে বার করলেন। পাঁচ মিনিট ভাপ নেওয়ার পর গরম লুচি আর আলু-মরিচ এল। কোনওমতে খেয়ে নিয়ে বিছানায় কাত হলেন ধ্রুব। ঝিমঝিম করছে শরীর, মাথাটা যেন আর এখানে নেই, বনবন করে ঘুরতে-ঘুরতে কোথায় চলে গিয়েছে।