ট্রেকার্স (Trekkers) : 14
ঝুমঝুম করে সন্ধে নামতে থাকে। চতুর্দিকে হাওয়া বয়, দখিনা পবন। হাওয়ার সঙ্গে চারিদিকে ছুটে যায় পরিমল। গাছের ও ফুলের। এত ভাল লাগার জন্য তাঁর নিজেকে কেমন ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল। এই ছেলেমেয়েগুলি এমন বিপদে পড়েছে, তিনি উপভোগ করছেন বসন্ত! উঠে পড়ে তিনি ঝরাপাতা আর শুকনো রেণুর ওড়াউড়ির মধ্য দিয়ে বড় রাস্তায় প্রদীপের মতো জ্বলে ওঠা বাতিগুলোর দিকে বিমুগ্ধের মতো তাকাতে-তাকাতে হাঁটতে লাগলেন। কত বসন্ত মনে পড়ে যাচ্ছে, কত গ্রীষ্ম, কত শীত, কত বর্ষাও। কেননা প্রত্যেকটা ঋতুর আরম্ভই ওইরকম অদ্ভুত মুগ্ধকর। সংযুক্তা ঠিকই বলেছে, এখন কি ইয়ং জেনারেশনের আর এ সব অনুভূতি হয় না? প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যোগ কি ছিন্ন হবার মুখে এইসব শহরে? ক্রিকেটারদের সেঞ্চুরি করে আকাশের দিকে তাকাতে দেখা যায়। আর কাউকে তো দেখেন না। কাচের বাইরে থেকে তাদের আড্ডারত দেখা যায় সচ্ছল কফিখানায়। টেলিস্কোপ নিয়ে আকাশ দেখেন কেউ কেউ। জগিং করতে দেখেন অনেককে। ছুটছে, হাঁটছে, খেলছে, কম্পিউটার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে। প্রকৃতি হল ট্যুরিজম, পিকনিক বা আউটিং-এর ক্ষেত্র। অনন্তের সংবাদ বহন করে আনা তো দূরের কথা, অকারণ পুলকে কাঁপিয়ে দেওয়া, কাঁদিয়ে দেওয়া এসবও আর বোধহয়….
এরকম একটা সিদ্ধান্তেই বা তিনি চট করে পৌঁছোচ্ছেন কী করে? তাঁর একটা ছেলেমেয়ে থাকলে হয়তো এই জেনারেশনের মনের কথাটা তিনি টের পেতেন। নেই বলেই তাই পাচ্ছেন না। তাঁরাই কি কাউকে ডেকে ডেকে বলতে গিয়েছেন?… আজ প্রথম দুমদাম করে কালবৈশাখী এসে গেল! এখন কীরকম আমের মুকুলের গন্ধ ভরা ঠান্ডা হাওয়া বইছে! মনটা অদ্ভুত ভাল লাগছে… বাঃ! দূর দিগন্তে একটা কালো হাতি ক্রমশই বড় হতে-হতে আকাশ ছেয়ে ফেলছে, দেখতে-দেখতে আশ্রয়ের খোঁজে তাড়াতাড়ি পা চালান। কিন্তু বারবার দেখা, মনের মধ্যে প্রথম আষাঢ়ের সজল মেঘ ঢুকে যাওয়া এই অনুভূতি কি তিনি কারও কাছে কখনও বলেছেন? না। কবিতা পড়েছেন, শুনেছেন, ভেতরে-ভেতরে বুঁদ হয়ে থেকেছেন এই পর্যন্ত। এরাও হয়তো অনুভব করে, কিন্তু বলে না। জীবনযাপনের ভেতর দিয়েই ওইসব আমেজ, খ্যাপামি প্রকাশ পায়। তিনি ডেটার অভাবে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারলেন না।
আস্তে-আস্তে বাড়ি ফিরলেন ধ্রুবজ্যোতি। মনটা ভালও, আবার খারাপও। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত বোধ তাঁর ভিতরে পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করছে। ধাক্কাধাক্কি বা কোনও দ্বন্দ্ব নয়। দুটোই আছে এবং ক্রমশ কলের ধোঁয়ার সঙ্গে উনুনের ধোঁয়ার মতো মিশে যাচ্ছে। এখন যদি কেউ তাঁকে কথার কথা জিজ্ঞেস করে, তিনি সোজাসুজি ভাল আছি বা ভাল নেই বলতে পারবেন না। সত্যি কথা বলতে হলে তাঁকে বলতে হবে, ভাল-খারাপ আছি।
সাংসারিক দিক থেকে তিনি সেই শতকরা পাঁচজনের একজন, যার কোনও বিকট বা ঘ্যানঘেনে সমস্যা নেই। সংযুক্তা মাটিতে পা রেখে চলা খুব সহজ মেয়ে। তিনি হয়তো তা ছিলেন না, কিন্তু নিজের প্রতি সুবিচার করলে তাঁকে বলতেই হয় যে, সংযুক্তার ইতিবাচক প্রভাবটা তাঁর খুব কাজে লেগেছে। কর্মসূত্রে প্রথম জীবনে কাছাকাছি থাকতে পারতেন না। কে জানে হয়তো সেই জন্যেই তাঁদের মধ্যে প্রণয় জিনিসটা অনেক দিন জাগ্রত ছিল। এখন বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বও কি প্রেম নয়? তাঁর শয্যা-জীবন তিনি কোনও বাইরের লোকের সঙ্গে আলোচনা করেন না। যারা করে, তাদের পছন্দ করেন না। কিন্তু সেখানেও প্রণয় টিকে আছে। সন্তান যখন হচ্ছিল না, তাঁরা উদ্বিগ্ন হননি। দু’জনে দু’জায়গায় থাকেন বলেও তো সমস্যা। সেগুলো একা সামলাতে হবে সংযুক্তাকেই। কিন্তু তারপর একদিন এল যখন তাঁরা ডাক্তারের কাছে গেলেন, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তারের রায় হল, না হওয়ার কোনও কারণ নেই। যে কোনওদিন কতকগুলো নিয়ম ফলো করলেই হয়ে যাবে। কিন্তু হল না। তাতে মেয়েরাই আগে ভেঙে পড়ে। কিন্তু ওই যে, সংযুক্তা অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল মেয়ে। সে বলল, এ নিয়ে মাথা ঘামাবার কী আছে? আমরা কিছু অলরেডি জন্মানো শিশুর ভার নিতে পারি। তবে কী জানো, কাঁথা-কানি, আর সইবে না। ওই সময়ে তাঁরা নানা সূত্রে অসহায়, দরিদ্র মেয়েদের সন্ধান করে করে প্রথম শীলুকে আনেন। সে তখন বারো বছরের মেয়ে। বোঝবার বয়স হয়েছে, বয়ঃসন্ধি এল বলে। শীলুকে ওঁরা এনেছিলেন সরকারি হোম থেকে। বহু কদর্য অভিজ্ঞতা তখনই হয়ে গিয়েছে মেয়েটির। তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে প্রথমে অনেকদিন বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, এঁরা কোনও বদ উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে আসেনি। কুঁকড়ে থাকত, এই বুঝি মার খেল। সংযুক্তা ওকে আস্তে আস্তে তৈরি করতে লাগলেন। ধ্রুবজ্যোতির সহযোগিতা থাকত, কিন্তু প্রধান সংযুক্তা। তাকে স্কুলে ভর্তি করা, পড়ানো, স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, এ সবের কৃতিত্ব সংযুক্তারই পাওনা। শীলু যেন বাড়ির আশ্রিত মেয়ে, কাজকর্ম লেখাপড়া সবই করে। কোনও বাড়াবাড়ি ওঁরা করেননি কখনও। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কম্পিউটার স্কুলে ট্রেনিং শেষ করে তার যখন চাকরি হল, তাঁদের তিনজনেরই একটা অদ্ভুত আনন্দ হয়েছিল। বাড়িতে সেদিন খাওয়া-দাওয়া হয়। শীলুর বন্ধুবান্ধব আসে। প্রথম কয়েক মাস এখান থেকেই সে যাতায়াত করত। তারপর একটু দূর পড়ে গেল ওর কর্মক্ষেত্র। কয়েকজনের সঙ্গে মেস করে থাকতে শুরু করল। এখন তো দুই বন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। মাঝে মাঝে আসে। খুব সংযত, বুদ্ধিমতী এবং বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে। শীলু থাকাকালীনই বিলু এবং মিলু এসে গিয়েছে। বিলু এসেছিল গ্রাম থেকে, একেবারে বাড়ির কাজের জন্যই। তাঁদের একটি পরিচিত পরিবার বলেছিল ওর কথা, অনাথ মেয়ে, কাকা-কাকির কাছে খুব কষ্টে আছে। কাজ পারে খুব ভাল, পড়াশোনাতেও মাথা আছে। বিলু যখন এল দেখলেন, বেশ শ্যামশ্রী মেয়েটি। চোখদুটো নিচু করে রাখে। কিন্তু তুললে টের পাওয়া যেত, তাতে ঝিলিক আছে। গোড়া থেকেই অঙ্কে খুব মাথা। গ্রামে ন’ক্লাস পর্যন্ত পড়ে এসেছিল। একটু ঘষে-মেজে নিতে বেশ ভাল হয়ে গেল। ওর উপর ধ্রুবজ্যোতির খুব আশা হয়েছিল। কাজকর্ম করত একেবারে নিখুঁত করে, আর অত বুদ্ধি। মাধ্যমিকে অঙ্কে একশো পেল, সংস্কৃতে নব্বুই, ইংরেজি, বাংলায় ভাল না। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রত্যেকটাতেই ষাটের উপরে। চার বছর পড়িয়ে তবে পরীক্ষা দিইয়েছিলেন উচ্চমাধ্যমিক। সেটা দিয়ে ছুটিতে ও গ্রামে গিয়ে আর ফিরল না। সেটাতেও ওই একই রকম আশ্চর্য-করা রেজাল্ট। খুবই ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ, ব্যথিত হয়েছিলেন সংযুক্তা। খুব ভাল পরীক্ষা দিয়ে যদি শোনা যায় খাতা হারিয়ে গিয়েছে, তা হলে যেরকম নিজের হাত পা কামড়াতে ইচ্ছে করে, মাথায় বাড়ি মেরে মরে যেতে ইচ্ছে করে, তেমন। সংযুক্তা অন্তত তাই বলেছিলেন।
তাঁদের রাগ-ঝাল-কান্না সবই যখন মিইয়ে এসেছে, তখন একদিন স-স্বামীক বিলুসুন্দরী দেখা করে গেলেন। গ্রামের মাখাসন্দেশ হাঁড়িতে করে আর পুকুরের বড়-বড় কই। চেহারায় খুশি-খুশি ভাব, বেশ ছলছলে লাবণ্যময়ী। তার বরটিকে সত্যিই কেউ পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি বলবে না। পেটা সরল গড়ন, মাথায় কদমছাঁট চুল, শার্ট-প্যান্ট পরা। গ্রাম্য জবুথবু ভাব বা মস্তানি কোনওটাই নেই। ছেলেটি মুদির দোকান বাড়িয়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর করেছে। নিজের ঘর পাকা করেছে, দু’বিঘের বাগান, বড় পুকুর জমির মধ্যে। নিজের জেনারেটর পর্যন্ত আছে। ব্যাবসাঅন্ত প্রাণ। দেখা গেল, বিলুরও তাই। মাত্র এই ক’মাসেই সে কত সঞ্চয় করে সার্টিফিকেট কিনেছে নিজের নামে দেখাল। সংযুক্তাকে বলে গেল, এখুনি বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যান নেই ওদের। সংযুক্তা তাকে ওপ্ন ইউনিভার্সিটির কোর্স নিতে বললেন। সে-ও নাকি তাই ভাবছিল।
ভাল করে খাওয়া-দাওয়ার পর বিদায়ের সময়ে ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “আমরা কিন্তু তোমার ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলেছি বেলা। কোনওদিন বিপদে পড়ে আমাদের শরণাপন্ন হলে, আর পেরে উঠব না। নিজের ব্যবস্থা কী করছ?”
তখনই বিলু বলে, “তিন মাস অন্তর একটা করে সার্টিফিকেট কিনে রাখছি বাবা, নিজের নামে।” বেচারাম বলল, “ওর নামে ব্যাঙ্কে আলাদা অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছি বাবু। ও তো আমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট সব কিছুরই কাজ করে। মাস-মাইনে দিই। আপনাদের শিক্ষার গুণে এমন লক্ষ্মীমন্ত বউ পেয়েছি মা,” লজ্জায় মুখ নিচু করল ছেলেটি। সে-ও নাকি মাধ্যমিক পাশ।
চলে গেলে নিভৃতে নিজেদের মধ্যে তাঁরা বলাবলি করেছিলেন, সবদিক দিয়ে তো ভালই হল, মেয়েটা সুখী হয়েছে। বুদ্ধি বার করেছে মগজ থেকে। সে-ও বাঁচল। তাঁরাও বাঁচলেন। একটা উঠতি বয়সের মেয়ের দায়িত্ব যতই হোক, মাথার থেকে নামল। ভিন্ন সংস্কৃতির কোনও ব্যক্তিকে কি শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নেওয়া যায়!
ওঠবার স্টেপে জুতোর তলা ঘষে ভেতরে ঢুকলেন ধ্রুবজ্যোতি। সংযুক্তার কোনও মিটিং-টিটিং আছে। এখনও বাড়ি ফেরেনি। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকলেন, একতলা শুনশান। এ মেয়েটা গেল কোথায়? রান্নাঘরে, ওর নিজের ঘরে সর্বত্র খুঁজলেন। তারপর দোতলায় উঠলেন। বাইরে থেকে চাবি দেওয়া। সে তো বেরিয়ে গিয়েছে এমন হতে পারে না! তাঁর হঠাৎ কেমন ভয় হল। কোনও দুর্ঘটনা ঘটল না তো, মেয়েটা চাপা। কিছু ঘটাল না তো? তিনি পা টিপে-টিপে তেতলায় উঠলেন। ছাতে একটা চিলেকোঠা আছে শুধু, বাকিটা ছাত। খোলা। দাঁড়ালেন, এদিক ওদিক চেয়ে চোখে পড়ল একটা মনুষ্য আকৃতি পাঁচিলের কাছে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বটে, আর একটু এগিয়ে দেখলেন মিলু হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তারার আলো পড়েছে। মুখটা জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে। আর একটু কাছে এগিয়ে শুনলেন মৃদুস্বরে গান গাইছে মিলু, ‘…সূর্য তারা দলে দলে কোথায় বসে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগনতলে,… এই যে তোমার আলোকধেনু।’
তিনি পা টিপে-টিপে ফিরে আসছিলেন, মিলু টের পেয়ে গেল। একটু ছুটে এসে বলল, “বাবা, তুমি ফিরেছ? চলো চা করে দিই।”
“না, না তোকে চা করতে হবে না। ও আমি একটু করে নিতে পারব।”
“রাগ করছ কেন? আজ ছাতে কাপড় তুলতে এসে এমন হয়ে গেল।”
“রাগ করিনি। তুই গান গাইছিলি, ডিসটার্ব করতে চাই না।”
মিলু তরতর করে তাঁর আগে-আগে দু’চার সিঁড়ি টপকে-টপকে নীচে নেমে গেল। তিনি একটু চেঁচিয়ে বললেন, “সাবুর পাঁপড় আনবি। তোরও আনবি, বারান্দায় বসলাম।”
টেবিলে তাঁরা একসঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করেন। সকালের দিকে প্রত্যেকে আলাদা-আলাদা। কিন্তু রাত্রে মোটের উপর একসঙ্গেই। ওদের বেশ কিছুদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, কিছুটা সহবত শেখাবার পরই ওঁরা এটা করেছিলেন। কিন্তু ওরা সংকুচিত হয়ে থাকত অনেক দিন। বিলু তো বটেই, মিলুও অনেকদিন পর্যন্ত পরে খাব, পরে খাব করে একসঙ্গে বসাটা এড়াতে চাইত। তাঁরা কোনও জোর করেননি। শীলু যখন চাকরি পেয়ে এল, আসতে থাকল, খাবার টেবিলে ওঁদের সঙ্গে অনেক কথা হত ওর। অফিস নিয়ে, কলিগ নিয়ে, কাজ নিয়ে। খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। তবু ওঁদের দু’জনকে একসঙ্গে খাওয়ার সুযোগ দিয়ে বিলু-মিলু এই আসছি-এই আসছি করে কাটিয়ে দিত।
বারান্দার চায়ের আসর একেবারে যুগলের। মিলু চা পাঁপড়ভাজা নিয়ে এসে বসল। বলল, “আমি কিন্তু টোস্ট খেয়েছি, পেয়ারা খেয়েছি। আর কিছু খেতে পারব না, তুমি খাও।”
“চা, চা-ও খাবি না?”
“চা তো আমি খাই না বাবা।”
“ঠিক আছে, না-ই খেলি। বোস।” কুড়মুড়-কুড়মুড় শব্দ হয় পাঁপড় খাওয়ার। চায়ে চুমুক দিয়ে ধ্রুব বলেন, “সন্ধেটা বেশ, না?”
মিলু বলল, “অপরূপ। কেমন হাওয়া সাঁতার দিচ্ছে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে, অন্ধকারটা আর অন্ধকার থাকছে না।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছিল। তোর গাঁয়ের সন্ধে রাতের কথা মনে আছে?”
মিলু থেমে-থেমে বলল, “আজ খুব মনে পড়ছিল। ওখানে যেমন বেশি মশা তেমনি বেশি তারাও। আকাশটা এরকম ভ্যাসকা নয়, একটু কালচে নীল রঙের বিরাট, জীবন্ত আকাশ। খাটুনি, মার, খেতে না পাওয়া সব না বাবা সয়ে যেত, ওই আকাশটা দেখতে পেতুম বলে।” অনেকখানি বলে ফেলে যেন লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল মিলু।
মিলুর ইতিহাস খুব ভয়ংকর। সে কথা আজকাল অসাবধানেও উল্লেখ করেন না তাঁরা। মাতৃহীন মেয়েটিকে দশ এগারো বছর বয়সে বাংলাদেশের বরিশালের কোনও গাঁ থেকে পাচার করা হয় পশ্চিমবঙ্গে। সম্ভবত তার সৎমা ও বাবাই বেচে তাকে। ইন্ডিয়ায় কাজ পাবে, এ-কথা বলায় সে বাড়ির অত্যাচার থেকে বাঁচবে মনে করে চলে আসে। হাসনাবাদে এক ব্রথেলে প্রথম রাখা হয় তাকে, পরে হয়তো মুম্বই কি দুবাই পাঠানো হত, কিন্তু সেখানেই ধর্ষিত হতে-হতে একজনের দু’চোখে আঙুল ঢুকিয়ে সে পালায়। দুদ্দাড় পালায়। তখন রাত, রাস্তাঘাট শুনশান। বহুদূর ছুটে একটা ট্রাক থামায়। ট্রাক ড্রাইভার তাকে থানায় নিয়ে যাবার আশা দিয়ে মদ খাওয়াতে চেষ্টা করে, অত্যাচার চালায়। ভোরের দিকে লোকটা যখন নেশার ঘোরে ঘুমোচ্ছে, তখনই সে পালায়। এবার কাউকে বিশ্বাস করে না, কাছাকাছি থানায় গিয়ে সব ঘটনা বলে। দারোগাবাবু তাকে নিজের বাড়িতে স্থান দেন। সেখানে অজস্র খাটুনি এবং প্রহার জোটে। সেখান থেকে পালিয়ে সে কীভাবে সংযুক্তাদের এনজিওর এক ভদ্রমহিলার কাছে পৌঁছোয়, সে এক ইতিহাস। ও নিজেই সংযুক্তার কাছে থাকতে চায়।
তিনি বললেন, “যে-গানটা গাইছিলি, গা না।”
“ভাল করে জানি না, শুনে-শুনে তোলা বাবা।”
“তা হোক।”
অন্ধকার এখন গাঢ় সবুজ শাড়ি পরা মিলুকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সেই অনামা অন্ধকার থেকে সে গেয়ে উঠল, ‘চরাও মহাগগনতলে… এই যে তোমার আলোকধেনু/ সূর্য তারা দলে দলে—কোথায় বসে বাজাও বেণু…’
ধ্রুবজ্যোতি আস্তে ধরিয়ে দিলেন, ‘তৃণের সারি তুলছে মাথা, তরুর শাখে শ্যামল পাতা— আলোয়-চরা ধেনু এরা ভিড় করেছে ফুলে ফলে’
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এইটুকুই বারবার গাইল মিলু। তারপরে দু’জনেই চুপ করে বসে রইল। ধ্রুব আসলে মিলুর গানে খুব বিচলিত বোধ করছিলেন। খুব সুরেলা গলা, ভাবগভীর।
“বাবা, ভগবান আছেন, না?” মিলু ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করল।
এ মেয়েটি জীবনকে কাঁচাখেকো হিসেবে দেখেছে, একে তিনি কী উত্তর দেবেন?
বেশ কিছুক্ষণ পরে বললেন, “ইটস নট রাইট টু টেক গড ফর গ্রান্টেড।”
“মানে?”
“ভগবান আছেনই তিনি আমায় উদ্ধার করবেন, এরকম ভাবনা ঠিক নয়। তুই তো নিজেকেই নিজে উদ্ধার করতে পেরেছিলি।”
“তোমাদের কে মিলিয়ে দিল?”
“মিলু, তোর মাকে কিন্তু তুই-ই খুঁজে নিয়েছিলি। প্রথম কয়েকবার ঠকতে-ঠকতে তোর চোখ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তুই যে মাকে খুঁজে নিলি, অ্যাপিল করলি, এতে আমি কোনও ভগবান খুঁজে পাচ্ছি না।”
“তুমি কি ভগবানে বিশ্বাস কর না?”
“ক্রিয়েশনে বিশ্বাস করলে ক্রিয়েটরকে বিশ্বাস করতেই হয়। সেটা কথা না। কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের আগে-পিছে কিছুই জানি না। এর মধ্যে নিজের বুদ্ধি, বোধ এগুলোতে শান দিতে হয়। নিজের লক্ষ্য স্থির করতে হয়। লেগে থাকতে হয়, আবার সুখী হবার ক্ষমতাও আয়ত্তে আনতে হয়। আমাদের লক্ষ্য উন্নততর মানুষ হওয়া, ভগবান অনেক দূরের ব্যাপার।”
“আমার কিন্তু সত্যি মনে হয়, কেউ এইসব তারা-সূর্য-চাঁদ সবাইকে চরাচ্ছে। শুধু মানুষের বেলাই আর পেরে উঠছে না, বা করছে না। কিন্তু খুব ডাকলে সাড়া পাওয়া যায়। গাঁয়ে যখন থাকতুম নিজেকে নিয়ে কিচ্ছু ভাবতুম না, দিনের দিন জীবন কেটে যেত। তারপর যখন বিপদে পড়লুম সত্যি বলছি বাবা, ‘ত্রাহি মধুসূদন’ ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। এখনও আমি প্রতিদিন সর্বক্ষণ…”
“ভাল করিস, প্রেয়ার খুব ভাল জিনিস।”
মিলু উঠে গেল। আলো জ্বেলে দিল ঘরের, দালানের, সিঁড়ির। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিতেই দেখল, সংযুক্তা শুয়ে রয়েছেন।
“ও মা! তুমি কখন এসেছ?”
“মিনিট দশেক।”
“ডাকোনি কেন?”
“বেশ তো কথা বলছিলি, শুধু-শুধু ডিসটার্ব করব কেন?”
কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে ধ্রুবজ্যোতি ভেতরে এলেন, “ওহ, তুমি ফিরেছ!”
মিলু বলল, “মা, চা খাবে?”
“না, অনেক চা কফি খাওয়া হয়েছে আজকে, ম্যারাথন মিটিং চলছে তো চলছেই। রাত্রের রান্নাটা করে নিতে পারবি?”
“কেন পারব না?” মিলু চলে গেল।
ধ্রুবজ্যোতি হেসে বললেন, “তুমি কি ঘাপটি মেরে আমাদের কথা শুনছিলে?”
“শুনছিলুম,” সংযুক্তা ক্লান্ত গলায় স্বীকার করলেন।
“কী বুঝলে?”
“ভাল লাগছিল। মেয়েটা এত কথা ভাবছে। তবে ধ্রুব সত্যিই বলছি সমস্ত বাড়ি অন্ধকার, বারান্দায় অন্ধকারে তোমরা দু’জনে, আমার মনটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। হঠাৎ যেন সেই ঔরঙ্গাবাদ ফোর্টের অন্ধকার কুয়োয় পড়ে গিয়েছি।”
“কত দিন এরকম পরীক্ষা দিতে হয় মানুষকে?” একটু থেমে ধ্রুব বললেন।
“আজ বুঝলাম, আমরণ,” সংযুক্তা বললেন। “শুধু তোমাকে নয়, আমাকেও, মিলুকেও। সব মানুষকেই পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। এটাতে এতদিনেও আমি তোমাকে বুঝলাম না, এ জাতীয় অভিমান কোরো না। কেননা, অনুরূপ সিচুয়েশনে তোমারও এমন হত।”
একটু পরে সংযুক্তা বললেন, “আমি চান-টান করে আসি। এতক্ষণ গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে পা ধোওয়া পর্যন্ত হয়নি।” তিনি চলে গেলেন।
ধ্রুবজ্যোতির মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। আসলে তিনি গোড়া থেকেই স্ত্রীজাতির শ্রেণি বিভাগটা অনুভব করেন। ওইভাবেই তৈরি হয়েছেন, সংস্কারটা ওই রকমই। ব্যক্তি হিসেবে নিজের মধ্যেও এই রকমই তিনি। দিদিমা-ঠাকুমা, মা-কাকিমা, মাসি-পিসি, স্ত্রী-বান্ধবী, কন্যা-পৌত্রী। আজকাল চতুর্দিকে যা দেখা যায়, নাতনির বয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে আদ্দামড়া বুড়ো প্রেম করছে। লিঙ্গ ‘স্ত্রী’ হলেই তার সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হচ্ছে মানুষ। এগুলো তাঁর মধ্যে বিবমিষার উদ্রেক করে। একটি ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে তিনি পঁয়ষট্টি কোনও কাম সম্পর্কে হঠাৎ জড়িয়ে পড়লেন অন্ধকার আর নির্জনতার সুযোগ নিয়ে, এ জিনিস তাঁর কল্পনার বাইরে। তাঁর যদি মেয়ে থাকত, নাতনি থাকত, তা হলে তাঁর সামাজিক অবস্থানটা হয়তো আরও স্পষ্ট হত। তিনি একটি দাদু শ্রেণির মানুষ হতেন। যেহেতু তা হননি, শরীরটাকে রেখেছেন সুস্থ, সবল, সুঠাম তাই হয়তো তাঁকে স্পষ্ট করে চেনা যায় না, কিন্তু মনের দিক থেকে মানুষের যে বছরে-বছরে পরিণততর হওয়ার কথা, সেটা তিনি হয়েছেন। কিন্তু তিনি সংযুক্তার উপর রাগ-অভিমান করতে পারলেন না। শুধু বুঝলেন, সহজ মানুষ হওয়া সহজ নয়, একেবারেই সহজ নয়। সংযুক্তা তো একেবারেই খোলাখুলি স্বীকার করে গেল, পরিস্থিতিটা সন্দেহজনক। সে গোয়েন্দাগিরি করেছিল, করে নিশ্চিন্ত হয়েছে।