টেলিফোন-2
সর্বাণী ও সর্বানন্দের মধ্যে কলহ-বিবাদ, বাদ বিসম্বাদ কয়েকদিন হল প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ মিটে গেছে। অর্থাৎ শাস্ত্রে যাকে বলে দাম্পত্য কলহ, সেটা দত্তবাড়িতে এখন আর নেই বললেই চলে।
এসব জেনে যাঁরা বিস্মিত বোধ করছেন তাঁদের ঘটনাটা খুলে বলি। এই সপ্তাহের গোড়ার দিকে সর্বানন্দের ঘর আলো করে একটি টেলিফোন এসেছে। লাল রঙের ঝকঝকে টেলিফোন। সেলুলার কর্ডলেস এসব কিছু নয়। নিতান্তই সাধারণ একটি টেলিফোন। কিন্তু সেই যথেষ্ট।
স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই এখন টেলিফোন-অন্ত প্রাণ, দু’জনে কলহ করার অবকাশই পাচ্ছেন না। সর্বাণী রাতদিন টেলিফোনটা পরিষ্কার সাদা কাপড় দিয়ে মুছছেন। পাশে দাঁড়িয়ে সর্বানন্দ ডিরেকশন দিয়ে যাচ্ছেন।
এক ফাঁকে সর্বাণীদেবী নিউ মার্কেটে গিয়ে দুটো ভাল লেসের ঢাকনা কিনে এনেছেন ফোন ঢেকে রাখার জন্য। সেটা দিয়ে ফোনটা যত্নে ঢেকে রাখা হয়। অবশ্য সর্বানন্দ বলেছেন, এভাবে ফোনটাকে চাদর মুড়ি দিয়ে রাখলে ফোনটা ঘুমিয়ে থাকবে, তখন ফোন এলে বাজবে না।
সর্বাণী জানেন। এটা সর্বানন্দের রসিকতা। কারণ লেসের রুমাল ঢাকা ফোনটা যথারীতি ক্রিং ক্রিং করে বাজে। তবে ফোন না এলে বাজবে কী করে।
মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার। এর মধ্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের প্রত্যেককে তিন-চারবার করে ফোন করা হয়ে গেছে। সেই তুলনায় ফোন কম এসেছে, সে তো হবেই কে আর বিনা প্রয়োজনে পয়সা খরচ করে ফোন করতে যায়।
সর্বানন্দ সর্বাণীকেও যখন তখন যাকে তাকে ফোন করতে নিষেধ করেছেন। ফোনের বিল উঠবে সেইজন্য তো বটেই, তা ছাড়াও অন্যেরা অপ্রয়োজনীয় ফোন পেয়ে বিরক্ত হবে, ভাববে হাভাতে, নতুন ফোন নিয়ে আমাদের বার বার ফোন করে যাচ্ছে।
কিন্তু কোন কিছুক্ষণ না বাজলেই সর্বাণীর মনে সন্দেহ হয়, খারাপ হয়ে যায়নি তো। রিসিভার তুলে দেখেন ডায়ালটোন আছে কি না কিন্তু তাতেও মন শান্ত হয় না, প্রতিবেশী বউদিকে ফোন করে বলেন, ‘বউদি, আমাদের ফোনটা খারাপ হয়ে গেছে কি না বুঝতে পারছি না, আপনি আমাকে একবার ফোন করুন না।’ বউদি বলেন, ‘ফোন খারাপ হয়ে থাকলে তুমি ফোনে কথা বলছ কী করে।’
সর্বাণীর এসব দুশ্চিন্তার দিন অবশ্য শেষ হয়েছে। গতকাল থেকে কী হয়েছে কে জানে, টেলিফোন বাজছে তো বাজছেই। দু’ মিনিট পর পর ক্রিং ক্রিং টেলিফোন বেজে উঠছে।
প্রথমে কিছুটা উল্লসিত হলেও, অনতিবিলম্বে, সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়ার পরে পর পর দু’বার ফোনটা ধরার পর সর্বাণী ব্যাপারটার ভয়াবহতা টের পেলেন।
‘হ্যালো হাজরা থানা?’ সর্বাণী হ্যাঁ, না কিছু বলার আগেই, ওদিক থেকে প্রশ্ন, ‘কাল রাতে বসুশ্রী সিনেমার পাশ থেকে মিস্টার হেপে মান্নাকে আপনারা গ্রেপ্তার করেছিলেন। তিনি কি এখনও লক-আপে আছেন?’
তাড়াতাড়ি ‘রং নম্বর’ বলে সর্বাণী টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেটা আবার বেজে উঠল, ‘হ্যালো আপনি কি বড়বাবুর ওয়াইফ বলছেন, বড়বাবু বোধহয় মাল-টাল টেনে এ-বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছেন, ওঁরা কাছ থেকে একটু জেনে দিন তো কালীঘাট খালে লাশটা কার। ওটা জনদরদি, সমাজ সেবক মিস্টার হেপে মান্নার লাশ?’
সর্বাণী ফোন নামিয়ে রেখে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার ক্রিং ক্রিং। এবার সর্বাণীকে অব্যাহতি দিয়ে সর্বানন্দ এসে ফোনটা ধরলেন। এবার নতুন কেস, ভারী মিষ্টি আর মালায়েম গলা, ‘বল তো আমি কে বলছি?’ ‘শালা’ বলে সর্বানন্দ ফোন রেখে দিলেন। তবে রিসিভারের ওপরে বসালেন না, পাশে বসিয়ে দিলেন। যাতে কোনও ফোন আর না আসতে পারে।
সেভাবেই ফোনটা আপাতত কয়েকদিন থাকবে।