Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » টেনিদা আর ইয়েতি || Narayan Gangopadhyay

টেনিদা আর ইয়েতি || Narayan Gangopadhyay

ক্যাবলা বলে, ইয়েতি-ইয়েতি। সব বোগাস।

চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠল হাবুল সেন।

হ, তুই কইলেই বোগাস হইব! হিমালয়ের একটা মঠে ইয়েতির চামড়া রাইখ্যা দিছে জানস তুই?

ওটা কোনও বড় বানরের চামড়াও হতে পারে।–চশমাসুদ্ধ নাকটাকে আরও ওপরে তুলে ক্যাবলা গম্ভীর গলায় জবাব দিলে।

হাবুল বললে, অনেক সায়েব তো ইয়েতির কথা লেখছে।

কিন্তু কেউই চোখে দেখেনি। যেমন সবাই ভূতের গল্প বলে–অথচ নিজের চোখে ভূত দেখেছে–এমন একটা লোক খুঁজে বের কর দিকি?

এইবারে আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় টেনিদা এসে চাটুজ্যেদের রোয়াকে পৌঁছে গেল। একবার কটমট করে আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে মোটা গলায় বললে, কী নিয়ে তোরা তক্কো করছিলি র‍্যা?

আমি বললুম, ইয়েতি।

অ–ইয়েতি।–টেনিদা জাঁকিয়ে বসে পড়ল : তা তোরা ছেলেমানুষ–ও-সব তোরা কী জানিস? আমাকে জিজ্ঞেস কর।

হাবুল বললে, ইস কী আমার একখানা ঠাকুর্দা আসছেন রে।

টেনিদা বললে, চোপরাও। গুরুজনকে অচ্ছেদ্দা করবি তো এক চড়ে তোর কান আমি–

আমি ফিল আপ দি গ্যাপ করে দিলুম : কানপুরে পৌঁছে দেব।

ইয়া–ইয়া কারেক্ট।–বলে টেনিদা এমন জোরে আমার পিঠে থাবড়ে দিলে যে হাড়-পাঁজরাগুলো পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠল। তারপর বললে, ইয়েতি? সেই যে কী বলে–অ্যাব–অ্যাব–অ্যাবো

ক্যাবলা বললে, অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান।

মরুক গে ইংরিজিটা বড় বাজে ইয়েতিই ভাল। তোরা বলছিস নেই? আমি নিজের চক্ষে ইয়েতি দেখেছি।

তুমি!–আমি আঁতকে উঠলুম।

অমন করে চমকালি কেন, শুনি?–চোখ পাকিয়ে টেনিদা বললে, আমি ইয়েতি দেখব না তো তুই দেখবি? সেদিনও পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেতিস, তোর আস্পর্ধা তো কম নয়।

হাবুল বললে, না–না, প্যালা দেখব ক্যান? আমরা ভাবতা ছিলাম–ইয়েতি তো দেখব প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা তুমি ওই সব ভ্যাজালে আবার গেলা কবে?

ঘনাদার নাম শুনে টেনিদা কপালে হাত ঠেকাল : ঘনাদা। তিনি তো মহাপুরুষ। ইয়েতি কেন–তার দাদামশাইয়ের সঙ্গেও তিনি চা-বিস্কুট খেতে পারেন। তাই বলে আমি একটা ইয়েতি দেখতে পাব না, একথার মানে কী?

ক্যাবলা বললে, তুমিও নিশ্চয় দেখতে পারো–তোমারও অসাধ্য কাজ নেই। কিন্তু কবে দেখলে, কোথায় দেখলে।

শুনতে চাস?–কথা কেড়ে নিয়ে টেনিদা বললে, তা হলে সামনের ভুজাওলার দোকান থেকে ছ আনার ঝালমুড়ি নিয়ে আয় কুইক।–আর তৎক্ষণাৎ আমার পিঠে একটা বাঘাটে রদ্দা কষিয়ে বললে, নিয়ায় না–কুইক।

রদ্দা খেয়ে আমার পিত্তি চটে গেল। বললুম, আমার কাছে পয়সা নেই।

তা হলে ক্যাবলাই দে। কুইক।

রদ্দার ভয়ে ক্যাবলাই পয়সা বের করল। শুধু কুইক নয়, ভেরি কুইক।

ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে টেনিদা বললে, এই গরমের ছুটিতে এক মাস আমি কোথায় ছিলুম বল দিকি?

আমি বললুম, গোবরডাঙায়। সেখানে পিসিমার বাড়িতে তুমি আম খেতে গিয়েছিলে।

ওটা তো তোদের ফাঁকি দেবার জন্যে বলেছি। আমি গিয়েছিলুম হিমালয়ান এক্সপিডিশনে।

অ্যা–সৈত্য কইতাছ?–হাবুল হাঁ করল।

আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি?-টেনিদা গর্জন করল।

বালাই ষাট–তুমি মিথ্যে বলবে কেন?–ক্যাবলা ভালোমানুষের মতো বললে, কোথায় গিয়েছিলে? এভারেস্টে উঠতে?

ছো–ছো–ও তো সবাই উঠছে, ডাল-ভাত হয়ে গেছে। আর কদিন পরে তো স্কুলের ছেলেমেয়েরা এভারেস্টের চুড়োয় বসে পিকনিক করবে। আমি গিয়েছিলুম আরও উঁচু চুড়োর খোঁজে।

আছে নাকি?–আমরা তিনজনেই চমকালুম।

কিছুই বলা যায় না হিমালয়ের কয়েকটা সাইড তো মেঘে কুয়াশায় চিরকালের মতো অন্ধকার–এখনও সেসব জায়গার রহস্যই ভেদ হয়নি। লাস্ট ওয়ারের সময় দুজন আমেরিকান পাইলট বলেছিল না? পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরেও তারা পাহাড়ের চুড়ো দেখেছিল একটা তারপর সে যে কোথায় হারিয়ে গেল

তুমি সেই চুড়ো খুঁজে পেয়েছ টেনিদা?আমি জানতে চাইলুম।

থাম ইডিয়ট। তা হলে তো কাগজে কাগজে আমার ছবিই দেখতে পেতিস। আমি কি আর তবে তোদের ওই সিটি কলেজের ক্লাসে বসে থাকতুম, আর প্রক্সি দিতুম? কবে আমাকে মাথায় তুলে সবাই দিল্লি-টিল্লি নিয়ে যেত আমি, কী, বলে,–একটা পদ্ম-বিভীষণ হয়ে যেতুম।

ক্যাবলা বললে, উঁহু, পদ্মবিভূষণ।

একই কথা।–ঝালমুড়ির ঠোঙা শেষ করে টেনিদা বললে, চুপ কর–এখন ডিসটার্ব করিসনি। না নতুন চুড়ো খুঁজে পেলুম না। সেই-যে, কী বলে–পাহাড়ের কী তুষারঝড়–

ক্যাবলা বললে, ব্লিজার্ড।

হ্যাঁ, এমন ব্লিজার্ড শুরু হল যে শেরপা-টেরপা সব গেল পালিয়ে। আমি আর কী করি, খুব মন খারাপ করে চলে এলুম কালিম্পঙে। সেখানে কুট্টিমামার ভায়রাভাই হরেকেষ্টবাবু ডাক্তারি করেন, উঠলুম তাঁর ওখানে।

তা হলে ইয়েতি দেখলে কোথায়?–আমি জানতে চাইলুম :সেই ব্লিজার্ডের ভেতর?

উঁহু, কালিম্পঙে।

কালিম্পঙে ইয়েতি। হাবুল চেঁচিয়ে উঠল : চাল মারনের জায়গা পাও নাই? আমি যাই নাই কালিম্পঙে? সেইখানে ইয়েতি? তাইলে তো আমাগো পটলডাঙায়ও ইয়েতি লাইমা আসতে পারে।

টেনিদা ভীষণ গম্ভীর হয়ে বললে, পারে–অসম্ভব নয়।

অ্যাঁ!–আমরা তিনজনে একসঙ্গে খাবি খেলুম।

টেনিদা বলল, হ, পারে। ওরা ইনভিজিবল–মানে প্রায়ই অদৃশ্য হয়ে থাকে। তাই লোকে ওদের পায়ের দাগ দেখে, কিন্তু ওদের দেখতে পায় না। যেখানে খুশি ওরা যেতে পারে, যখন খুশি যেতে পারে। আবার ইচ্ছে করলেই রূপ ধরতে পারে কিন্তু সেরূপ না দেখলেই ভালো। আমি কালিম্পঙে দেখেছিলুম–আর দেখতে চাই না।

আমি বললুম, কিন্তু ওখানে ইয়েতি এল কী করে?

ইয়েতি কোথায় নেই–কে জানে! হয়তো–এই যে আমরা কথা কইছি ঠিক এখুনি আমাদের পিছনে একটা অদৃশ্য ইয়েতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে।

আমরা ভীষণ চমকে তিনজনে পিছন ফিরে তাকালুম।

টেনিদা বললে, উঁহু, ইচ্ছে করে দেখা না দিলে কিছুতেই দেখতে পাবি না। ও কি এত সহজেই হয় রে বোকার দল? ওর জন্যে আলাদা কপাল থাকা চাই।

ক্যাবলা বললে, তোমার সেই কপাল আছে বুঝি?

হাঁটু থাবড়ে টেনিদা বললে, আলবাত।

হাবুল বললে, কালিম্পঙে ইয়েতি দ্যাখলা তুমি?

দেখলুম বইকি।

ক্যাবলা বললে, রেস্তোরাঁয় বসে ইয়েতিটা বুঝি চা খাচ্ছিল? না কি বেড়াতে গিয়েছিল চিত্রভানুর ওদিকটায়?

ইয়ারকি দিচ্ছিস?–বাঘা গলায় টেনিদা বললে, ইয়েতি তোর ইয়ারকির পাত্তর?

হাবুল বললে, ছাড়ান দাও-পোলাপান।

পোলাপান? ওটাকে জলপান করে ফেলা উচিত। ফের যদি কুরুবকের মতো বকবক করবি ক্যাবলা, তা হলে এক ঘুষিতে তোর চশমাসুদ্ধ নাক আমি

আমি বললুম, নাসিকে উড়িয়ে দেব।

ইয়া–একদম কারেক্ট?–বলে আমার পিঠ চাপড়াতে গিয়ে টেনিদার হাত হাওয়ায় ঘুরে এল–আগেই চট করে সরে গিয়েছিলাম আমি।

ব্যাজার মুখে টেনিদা বললে, দুৎ–দরকারের সময় একটা পিঠ পর্যন্ত হাতের কাছে পাওয়া যায় না। রাবিশ।

হাবুল বললে, কিন্তু ইয়েতি।

দাঁড়া না ঘোড়াড্ডিম–একটু মুড আনতে দে।–টেনিদা মুখটাকে ঠিক গাজরের হালুয়ার মতো করে, নাকের ডগাটা খানিক খুচখুচ করে চুলকে নিলে। তারপর বললে, হুঁ ইয়েতির সঙ্গে ইয়ার্কিই বটে। আমিও ইয়েতি নিয়ে একটু ইয়ার্কিই করতে গিয়েছিলুম। তারপরেই বুঝতে পারলুম–আর যেখানে ইচ্ছে চালিয়াতি করো–ওঁর সঙ্গে ফাজলেমি চলে না।

আমি বললুম, চলল না ফাজলেমি?

না।–খুব ভাবুকের মতো একটু চুপ করে থেকে টেনিদা বললে, হল কী জানিস, এক্সপিডিশন থেকে ফিরে কালিম্পঙে এসে বেশ রেস্ট নিচ্ছিলুম। আর ডাক্তার হরেকেষ্টবাবুর বাড়িতেও অনেক মুরগি–রোজ সকালে ককরককর করে তারা ঘুম ভাঙাত, আর দুপুরে, রাত্তিরে কখনও কারি, কখনও কাটলেট, কখনও রোস্ট হয়ে খাবার টেবিলে হাজির হত। বেশ ছিলুম রে–তা ওখানে একদিন এক ফরাসী টুরিস্টের সঙ্গে আলাপ হল। জানিস তো আমি খুব ভালো ফরাসী বলতে পারি।

ক্যাবলা বললে, পায়রা বুঝি?

পারি না? ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক–তা হলে কোন ভাষা?

হাবুল বললে, যথার্থ। তুমি কইয়া যাও।

লোকটার সঙ্গে তো খুব খাতির হল। এসব টুরিস্টদের ব্যাপার কী জানিস তো? সব কিছু সম্পর্কেই ওদের ভীষণ কৌতূহল। ইন্ডিয়ানদের টিকি থাকে কেন–তোমাদের কাকেদের রং এত কালো কেন, তোমাদের দেবতা কি খুব ভয়ানক যে তোমরা হরিবল-হরিবল (মানে হরিবোল আর কি!) চ্যাঁচাও-ইন্ডিয়ান গুবরে পোকা কি পাখিদের মতো গান গাইতে পারে, এ দেশের ছুঁচোরা কি শুয়োরের বংশধর? এই সব নানা কথা জিজ্ঞেস করতে করতে সে বললে–আচ্ছা মঁসিয়ো, তুমি তো হিমালয়াজে গিয়েছিলে, সেখানে ইয়েতি দেখেছ?

আমার হঠাৎ লোকটাকে নিয়ে মজা করতে ইচ্ছে হল। তার নাম ছিল লেলেফাঁ। আমি বেশ কায়দা করে তাকে বললুম, তুমি আছ কোথায় হে মঁসিয়ো লেলেফা? ইয়েতি দেখেছি মানে? আমি তো ধরেই এনেছি একটা।

–অ্যা, ধরে এনেছ?–লোকটা তিনবার খাবি খেল : কই, আজ পর্যন্ত কেউ তো ধরতে পারেনি।

আমি লেলেফাঁর বুকে দুটো টোকা দিয়ে বললুম, আমি পটলডাঙার টেনি শর্মা–সবাই যা পারে না, আমি তা পারি। আমার বাড়িতেই আছে ইয়েতি।

–অ্যাঁ!

–হ্যাঁ।

মঁসিয়ো লেলেফাঁ খানিকটা হাঁ করে রইল, তারপর ভেউভেউ করে কাঁদার মতো মুখ করলে, আবার কপ কপ করে তিনটে খাবি খেল–যেন মশা গিলছে। শেষে একটু সামলে নিলে চোটটা।

–আমায় দেখাবে ইয়েতি?

–কেন দেখাব না?

শুনে এমন লাফাতে লাগল লেলেফাঁ যে একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল। আর একটু হলেই গড়িয়ে হাত তিরিশেক নীচে একটা গর্তে পড়ে যেত, আমি ওর ঠ্যাং ধরে টেনে তুললুম। উঠেই আমাকে দুহাতে জাপটে ধরল সে আর পাক্কা তিন মিনিট ট্যাঙো ট্যাঙো বলে নাচতে লাগল।

–চলল, এক্ষুনি দেখাবে।

আমি বললুম, সে হয় না মসিয়য়া, যখন তখন তাকে দেখানো যায় না। সে উইকে সাড়ে তিন দিন ঘুমোয়, সাড়ে তিন দিন জেগে থাকে। ঘুমের সময় তাকে ডিস্টার্ব করলে সে এক চড়ে তোমার মুণ্ডু

আমি জুড়ে দিলুম, কাঠমুণ্ডুতে উড়িয়ে দেবে।

টেনিদা বললে, রাইট। লেলেফাঁকে বললুম-কাল থেকে ইয়েতি ঘুমুচ্ছে। জাগবে, পরশু বারোটার পর। তারপর খেয়েদেয়ে যখন চাঙ্গা হবে–মানে তার মেজাজ বেশ খুশি থাকবে, তখন–মানে পরশু সন্ধের পর তোমাকে ইয়েতি দেখাব।

লেলেফাঁ বললে, আমার ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি তুলতে পারব তো?

খবরদার, ও কাজটিও কোরো না। ইয়েতিরা ক্যামেরা একদম পছন্দ করে না চাই কি খ্যাঁচ করে তোমায় কামড়েই দেবে হয়তো। তখন হাইড্রোফোবিয়া হয়ে মারা পড়বে।

ইয়েতি কামড়ালে হাইড্রোফোবিয়া হয়?

হাইড্রোফোবিয়া তো ছেলেমানুষ। কালাজ্বর হতে পারে, পালাজ্বর হতে পারে, কলেরা হতে পারে, চাই কি ইন্দ্রলুপ্ত–এমন কি সনন্ত ষঙন্ত প্রত্যয় পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।

ক্যাবলা প্রতিবাদ করল : সনন্ত ষঙন্ত প্রত্যয় কী করে

ইয়ু শাটাপ ক্যাবলা–সব সময় টিকটিকির মতো টিকিস-টিকিস করবিনি বলে দিচ্ছি। শুনে লেলেফাঁ ফরাসীতে বললে, মি ঘৎ। মানে-হে ঈশ্বর।

ক্যাবলা বললে, ফরাসীরা কি মি ঘৎ বলে নাকি

শাটাপ আই সে!–টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল :ফের যদি তক্কো করবি, তা হলে এখুনি এক টাকার আলুর চপ আনতে হবে তোকে। যাকে বলে ফাইন।

ক্যাবলা কুঁকড়ে গেল, বললে, মী ঘৎ। থাক, আর তর্ক করব না, তুমি বলে যাও।

তবু তোকে আট আনার আলুর চপ আনতেই হবে। তোর ফাইন। যা–কুইক।

আমি বললুম, হুঁ, ভেরি কুইক।

বেগুনভাজার চাইতেও বিচ্ছিরি মুখ করে ক্যাবলা চপ নিয়ে এল।

বেড়ে ভাজে লোকটা–চপে কামড় দিয়ে টেনিদা বললে, যাকে বলে মেফিস্টোফিলিস।

আমি আকুল হয়ে বললাম, কিন্তু ইয়েতি?

ইয়েস ই য়ে স, ই য়ে তি। বুঝলি, আমার মাথায় তখন একটা প্ল্যান এসে গেছে। বাড়ি গিয়ে হরেকেষ্টবাবুকে বললুম সেটা। কুট্টিমামার ভায়রাভাই তো, খুব রসিক লোক, রাজি হয়ে গেলেন। তারপর ম্যানেজ করলুম কাইলাকে।

হাবুল বললে, কাইলা কেডা?

ও একজন নেপালী ছেলে–আমাদের বয়েসীই হবে। হরেকেষ্টবাবুর ডাক্তারখানায় চাকরি করে। খুব ফুর্তিবাজ সে। বললে, দাজু, রামরো রামরো। মানে–দাদা, ভালো, খুব ভালো।

ওদিকে সায়েবের আর সময় কাটে না।

–তোমার ইয়েতি কি এখনও ঘুমুচ্ছে?

নাক ডাকাচ্ছে।

সময়মতো জাগবে তো?

সময়মতো মানে? ঠিক বারোটায় উঠে বসবে। এক সেকেন্ডও লেট হবে না।

যা হোক–দিন তো এল। হরেকেষ্টবাবুর দোতলার হলঘরে আমি একটা কালো পর্দা টাঙালুম। প্ল্যান হল, খুব একটা ডিম লাইট থাকবে–আমি ধীরে ধীরে পর্দা সরিয়ে দেব। ইয়েতিকে দেখা যাবে। মাত্র দু মিনিট কি আড়াই মিনিট। তারপরেই আবার পর্দা ফেলে দেব।

আমি বললুম, কিন্তু ইয়েতি

ইয়ু শাটাপ–পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল! আরে, কিসের ইয়েতি? হরেকেষ্টবাবুর বাড়িতে মস্ত একটা ভালুকের চামড়া ছিল, প্ল্যান করেছিলুম কাইলা সেটা গায়ে পড়বে, আর একটা বিচ্ছিরি নেপালী মুখোশ এঁটে গোটা কয়েক লাফ দেবে–চেঁচিয়ে বলবে–দ্রাম-দ্রুম-ইয়াহু-মিয়াহু! ব্যস–আর দেখতে হবে না, ওতেই মঁসিয়ো লেলেফার দাঁতকপাটি লেগে যাবে।

সব সেইভাবে ঠিক করা রইল। সায়েব যখন এল, তখন ঘরে একটা মিটমিটে আলো সামনে একটা কালো পর্দা, তার ওপর আমি কাল থেকে সায়েবকে ইয়েতি সম্পর্কে অনেক ভীষণ ভীষণ গল্প বলছিলুম। বুঝতে পারলুম, ঘরে ঢুকেই তার বুক কাঁপছে।

মজা দেখবার জন্যে হরেকেষ্ট ছিলেন, তাঁর কম্পাউন্ডার গোলোকবাবুও বসে ছিলেন। বেশ অ্যাটমসফিয়ার তৈরি হয়ে গেলে-ওয়ান-টু-থ্রি বলে আমি পদার্টা সরিয়ে দিলুম। আর

আমরা একসঙ্গে বললুম, আর?

এ কী! এ তো কাইলা নয়! তার ভালুকের চামড়া পড়ে গেছে, মুখোশ ছিটকে গেছে চিতপাত অবস্থায় ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে সে ঠায় অজ্ঞান। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছাদ-পর্যন্ত-ছোঁওয়া এক মূর্তি। সে যে কী রকম দেখতে আমি বোঝাতে পারব না। মানুষ নয়, গরিলা নয়–অথচ গায়ে তার কাঁটা কাঁটা বাদামী রোঁয়া–চোখ দুটো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা। তিনটে সিংহের মতো গর্জন করে সে পরিষ্কার বাংলায় বললে, ইয়েতি দেখতে চাওনা? তবে নকল ইয়েতি দেখবে কেন-আসলকেই দেখো। বলে হাঃহাঃ করে ঘর-ফাটানো হাসি হাসল–তিরিশখানা ছোরার মতো ধারালো দাঁত তার ঝলকে উঠল, তারপর চোখের সামনে তার শরীরটা যেন গলে গেল, তৈরি হল একরাশ বাদামী ধোঁয়া-সেটা আবার মিলিয়ে গেল দেখতে-দেখতে। আর আমাদের গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেল যেন হিমালয়ের সেই ব্লিজার্ডের মতো একটা ঝড়ো হাওয়া, রক্ত জমে গেল আমাদের বন্ধ দরজার পাল্লা দুটো তার ধাক্কায় ভেঙে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ল। তারপর সেই হাওয়াটা হা-হা করতে করতে শাল আর পাইন বনে ঝাঁপটা মেরে একেবারে নাথুলার দিকে ছুটে গেল।

আমি তো পাথর। সায়েব মেঝেতে পড়ে কেবল গি গি করছে। কম্পাউন্ডার অজ্ঞান। হরেকেষ্টবাবু চেয়ারে চোখ উল্টে আছেন, আর বিড়বিড় করে বলছেন–কোরামিন-কোরামিন! সায়েবকে নয়–আমাকে দাও–এখুনি হার্ট ফেল করবে আমার।

টেনিদা থামল। বললে, বুঝলি, এই হচ্ছে আসল ইয়েতি। তাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে যাসনি-মারা পড়ে যাবি। আর তাকে কখনও দেখতেও চাসনিনা দেখলেই বরং ভালো থাকবি।

আমরা থ হয়ে বসে রইলুম খানিকক্ষণ। তারপর ক্যাবলা বললে, স্রেফ গুলপট্টি।

গুলপট্টি?–টেনিদা কটকট করে তাকাল ক্যাবলার দিকে; ওরা অন্তর্যামী। বেশি যে বকবক করছিস, হয়তো এখুনি একটা অদৃশ্য ইয়েতি তার সিংহের মতো থাবা তোর কাঁধের ওপর বাড়িয়ে দিয়ে

ওরে বাবা রে! এক লাফে রোয়াক থেকে নেমে পড়ে বাড়ির দিকে টেনে দৌড় লাগাল ক্যাবলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress