প্রান্তিক বাংলার প্রাণের উৎসব- টুসু পরব
জঙ্গলমহলের প্রাণের উৎসব টুসু পরব। এর প্রধান আকর্ষণ হলো গান— টুসু সঙ্গীত। এই গানগুলির মূল বিষয়বস্তু হল লৌকিকও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার কাহিনী ব্যক্ত করে। সাংসারিক ও সামাজিক সুখ দুঃখের ঘটনা এই টুসুগানের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বাংলা লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ এই টুসু গান। সামাজিক সচেতনতা, পণপ্রথা দূরীকরণ, সাক্ষরতার প্রসার ,বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধতা প্রভৃতি সামাজিক দায়িত্বের কথা বলা ূহয় এই গানগুলিতে।
গোষ্ঠীতে বিশ্বাসী কুড়মি জনজাতির পার্বন “টুসু” আজ জঙ্গলমহলের প্রাণের উৎসব। এই জনজাতির যাপনও সংস্কৃতি প্রকৃতি কেন্দ্রিক। কুড়মি লোক জীবনের হাসি কান্না সুখ দুঃখের কাহিনী সবথেকে বেশি ধরা পড়ে যে গানে তা হলো টুসু গান। সনাতন ঐতিহ্যের মতোই টুসু গানে ধরা পড়ে বর্তমান প্রেক্ষিত ও।
টুসু উৎসব কবে থেকে চলে আসছে তা সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও সম্রাট অশোকের আমলে একই ধরনের সমান্তরাল উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ধৌলি ও জৌগাডা শিলালিপিতে।
সংক্রান্তির আগের দিন হয় পৌষ আগলানো। পৌষ আগলানো মানে ফসল আগলানো। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন মেয়েরা গোবর দিয়ে পৌষ বুড়ি তৈরি করে। সন্ধ্যেবেলায় দীপ জ্বালিয়ে গান গাইতে গাইতে সারারাত জাগরনে কাটায়। একে টুসু জাগরন বলে। পৌষ আগলানো– ফসল আগলানো! পুরুষেরা পাহারা দেয় ক্ষেতের ফসল আর মেয়েরা গৃহের রক্ষক! একা রাত জাগা যায় না তাই দলবেঁধে উৎসব! টুসু ঘরের মেয়ে !ফসলরূপী আবাদের দেবী –কৃষি লক্ষ্মী।
তাই ঘরের শস্যরূপী দেবীর কাছে তাদের যত অভিযোগ আবদার। তার কাছেই সব আনন্দের প্রকাশ। গানগুলিতে তারই প্রকাশ—
” উপরে পাটা নিচে পাটা
তার ভিতরে দারোগা!
ও দারোগা পথ ছাড়ে দাও
টুসু যাবেন কলকেতা।
টুসু যাবেন কলকেতা
খিদা পেলে খাবেন কি?
আন গো টুসুর লতুন গামছা
জিলিপি ছাঁদা বাঁধে দি।”
একমাস ব্যাপী এই সামাজিক উৎসবের প্রধান ঋত্বিক কুমারী মেয়েরা! পয়লা পৌষ টুসু স্থাপন হবার দিন থেকেই প্রত্যেকদিন এক একটি বিশেষ ফুলে দেবীকে অর্চনা করা হয়! গাঁদা সরষে বাসক আকুন্দ ইত্যাদি। কালচক্র গড়িয়ে চলে আসে মকর সংক্রান্তি ।এবার যে বিদায় দিতে হবে টুসুকে—
“তিরিশ দিন রাখি মাকে তিরিশটি ফুল দিয়ে গো
আর রাখতে লারব মাকে মকর হইল বাদি গো।”
বিদায়বেলায় টুসু লক্ষ্মী প্রান্তিক মানুষদের আদরের দুলালী–
” কাঁদছো কেনে সাধের টুসু বড় দাদার হাত ধরে
ই সংসারে বিটিছেল্যা রহে কি বাপের ঘরে?”
রাত পোহালে আসে মকর! টুসু ভাসান দিয়ে নতুন জামা কাপড় পরে ঘরে ঘরে পিঠে খাবার ধুম পড়ে–” টুসু আমার চিন্তামণি
মাটির কথা শুনে,
ঘাম পথে আসে মকর
আমাদের ফাগুনে।”
গানে গানে টুসুর বাখান —একদল অন্য দলকে বিদ্রূপ করে
” আমার টুসু মুড়ি ভাজে চুড়ি ঝলমল করে গো
উয়ার টুসু হ্যাংলা মেয়্যা আঁচলা পাতে মাগে গো।”
গানে গানে টুসু নিরঞ্জন। রঙ্গিন সুদৃশ্য চৌদলে চাপিয়ে টুসুকে ভাসিয়ে দিয়ে শোকবিহ্বল নারীরা বলে—” আমার বড় মনের বাসনা
টুসু ধনকে জলে দিব না!”
এ যেন সেই চিরন্তন কন্যা বিদায়ের দৃশ্য!
মকরের অপরিহার্য অঙ্গ টুসু গান! মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষার মানবিক প্রকাশ এই গানগুলিতে। মানভূমের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনে মানুষকে সচেতন করার কাজে টুসু গানের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। প্রকৃত অর্থেই টুসু মহামিলনের পরব। হৃদয়ের টানে মেতে ওঠা প্রান্তিক মানুষজনের বড় মন ছোঁয়া লোক উৎসব এটি। জঙ্গলমহলের সারা বছর ধরেই উৎসবের বাতাবরণ। মনের টানে সকলে দলবদ্ধভাবে মেতে ওঠে এতে। উৎসব চলে আসছে পুরুষানুক্রমিক ভাবে। এটাই শাশ্বত লোকসংস্কৃতির পরিচয়। উৎসবের আবহে কেউই আর কাজকর্মে যুক্ত হতে চায়না। কাজে ডাকলে এই উত্তরই পাওয়া যায়—- “চাঁওড়ি বাঁউডী মকর আখ্যান ঘেঘ্যান সাঁই সুঁই
তারপর ডাকবি তুই।।”
তথ্যসূত্র-লোকভাষ, গুগোল
গানগুলি সংগৃহীত( বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার বরুণ দে)